চন্দ্রপুকুর পর্ব-৪+৫

0
311

#চন্দ্রপুকুর
||৪র্থ পর্ব||
-ঈপ্সিতা শিকদার
দিলরুবার সাথে গল্প-গুজবের মাঝেই সারা রাত পাড় হলো। ফজরের আজান দিতেই প্রহরী বলে উঠে,
“বেগম নবাববাড়ির মহাপরিচারিকা ও শিক্ষিকা এসেছেন।”

যামিনী ভয় নিয়ে উঠে দাঁড়ায়। প্রায় কয়েক মুহূর্ত কেটে গেলেও নিজের বেগমকে নিশ্চুপ দেখে দিলরুবা অবাক হয়ে যায়।

বিড়বিড়ায়,
“কী হলো বেগম? আর কতক্ষণ দাঁড় করিয়ে রাখবেন তেনাদের। আসতে বলুন।”

“আ-আমি আসতে বলবো?”

ইশারায় সায় জানায় রমণীকে তার প্রিয় দাসী। সেও বিলম্ব না করে শুধায়,
“জী, আসুন।”

ঘরে ঢোকা দু’জন আলখাল্লা পরিহিতা নারী। ঘরে ঢুকতেই তারা দৃষ্টি ঝুঁকিয়ে সালাম দেন।

“আসসালামু ওয়ালাইকুম বেগম। আপনার ও শাহের বিয়ের কথা শুনলাম অভিনন্দন আপনাকে।”

যামিনী উত্তর দিবে কোথা থেকে? অপরিচিত মানুষের এমন অনভ্যস্ত আচারণে নিসাড় হয়ে রয়েছে।

তবুও দিলরুবার মৃদু ধাক্কা ও ইশারায় সে কোনোরকম জবাব দেয়,
“ধন্যবাদ, মহাপরিচারিকা ও শিক্ষিকা। এইখান্স আসতে কোনো রূপ সমস্যা হয় নাই তো?”

কিশোরীর প্রশ্নে একপলক গাঢ় দৃষ্টিতে তাকিয়েই শব্দ করে হেসে দেন। যামিনী নির্বাক, সে বুঝতেই পারছে না হাসার কারণ।

“দেখেছেন হুজুর আপা কেন শাহ বারবার করে বলেছে ঠিকভাবে তালিম দিতে? আমাদের ছোটো নবাব তো একদম আনাড়ি কন্যা বিয়ে করে প্রাসাদে তুলেছেন।”
ঠাট্টা করে উঠেন মহাপরিচারিকা। সাড়া দেন নবাববাড়ির শিক্ষিকা।

“শোনেন বেগম, নবাব পরিবার ও প্রাসাদের কিছু নিয়মকানুন, রীতিনীতি আছে। জমিদার নবাব মেহমাদ শাহের যোগ্য বেগম হয়ে উঠতে হলে এসব কিছুর তালিম নেওয়া এবং নিজেকে পটু করা আবশ্যক। সবার প্রথমে আপনাকে জানতে হবে পরিবারের আচার-আচারণ, চালচলনের রীতিনীতি।

জানতে ও মানতে হবে ইসলামের প্রতিটি বিষয়, বিশেষ নামাজ-কালামের কার্যপন্থা। কথা বলার এই ধরন ছাড়তে হবে। কথাবার্তা, চালচলন, আচারণে থাকতে হবে মাধুর্যতা, রুচিশীলতা ও আভিজাত্য। আপনাকে তালিম আজ রাত থেকেই দিব। আপনি প্রস্তুত হন, আমরাও প্রস্তুত হচ্ছি। ঠিক আছে?”

“জী।”

“তবে বিদায় বেগম।”
মাথা নত করে স্থানত্যাগ করেন তাঁরা।

যামিনী উদাস হৃদয়ে দরজার পাশে স্থির খাটিয়ায় বসে পড়ে। চোখজোড়া বদ্ধ হয়ে আসে তার নিজের অনিশ্চিত ও অপরিচিত জীবনের চিন্তা করলে। নোনাজল গড়িয়ে পড়ে আঁখিজোড়া হতে অচিরেই।

দিলরুবা বুঝতে পেরে তার প্রিয় বেগমের পায়ের কাছে বসে হাত দু’খানে নিজের দুই হস্তের মাঝে নিয়ে মিনতি করে,
“আপনি কাঁদবেন না বেগম। নিজের জান-প্রাণ লাগিয়ে দিন যোগ্য বেগম হতে। দেখবেন শীঘ্রই আল্লাহর দয়ায় জমিদার বাবুর হৃদয়ে একমাত্র আধিপত্য আপনার হবে।”

খাণিকটা আশ্বস্তই হয় রমণী। মনে মনে অটল হয় নিজেকে এই নবাববাড়ির রীতিনীতিতে সিদ্ধ করার উদ্দেশ্যে।

___

মেহমাদ শাহ তার দাদীজান তথা বেগম লুৎফুন্নেসার সম্মুখে নত দৃষ্টিতে দাঁড়িয়ে। বেগম লুৎফুন্নেসা নিজের কাঠের বাক্সটি থেকে পান পাতা বের করে তাতে জর্দা ও চুন দিয়ে খাওয়ার উপযোগী করছেন।

অনেকটা সময় নীরবতা থাকার পর মেহমাদ নিজেই জিজ্ঞেস করে,
“আমাকে কি আপনি ডেকেছিলেন দাদীজান?”

“হুম।”

“আপত্তি না থাকলে কী জন্য জানতে পারি?”

কিছুটা তাচ্ছিল্য মাখা হাসি ফুটে উঠে বৃদ্ধ নারীটির তেজস্বী মুখশ্রীতে।
“সময় হলেই জানবে আমার শাহ। বউ পেয়ে এতো অধৈর্য্য হয়ে উঠেছো দাদীজানকে প্রশ্ন করো? বাহ! বাহ! ভালোই উন্নতি!”

নিরুত্তাপ যুবক। পুরো কক্ষ জুড়ে নীরবতা, শোনা যাচ্ছে শুধু যাঁতি দিয়ে সুপারি কাটার শব্দ। নিজের কাজে ব্যস্ত থেকেই প্রিয় পৌত্রের উদ্দেশ্যে মুখ খুললেন বেগম লুৎফুন্নেসা,
“শুনলাম, ঐ আঁধারিয়া কন্যাকে না কি নবাববাড়িতে তুলতে না পেরে জঙ্গলের দালানে তুলেছো?”

নির্লিপ্ত ভঙ্গিমায় মেহমাদ শাহ উত্তর দেয়,
“এই নবাববাড়িতে একমাত্র রাজত্ব আপনার। এখানে কে থাকবে বা কে থাকবে না এর সিদ্ধান্ত অবশ্যই আপনি নিবেন। আমি আপনার সিদ্ধান্তকে আমি সম্পূর্ণরূপে সম্মান করি। মানি তাতে আমার কোনোরূপ আপত্তি করার অধিকার নেই।

তিন কবুল বলে পূর্ণ চেতনায় এই ধরনী ও যাবতীয় সৃষ্টির রচিয়তা শেহেনশাহ্ আল্লাহকে সাক্ষী রেখে সেই কন্যাকে নিজের ইহোকাল ও পরকালের জন্য কবুল করেছি। ঐ আল্লাহর পবিত্র বন্ধনকে অস্বীকার করার সামর্থ্য আমার নেই, নেই সামর্থ্য সেই স্ত্রীলোকের দায়িত্ব অস্বীকার করার।”

“আমার সিংহ, তুমি ভুল যাচ্ছো তুমি কে? তুমি সাধারণ ঘরে জন্মানো কোনো বালক নয়, তুমি নবাব বাড়িতে জন্ম নেওয়া শাহজাদা। নবাববাড়ি এবং গোটা শেরপুরের দায়িত্ব পালন না শুধু তোমার কাজ। গোটা বিশ্বের থেকে নবাববাড়ি ও শেরপুরের রহস্য রক্ষা করার দায়িত্বও তোমার।

আর তোমার স্ত্রীও কোনো সাধারণ বধূ হবে না, তার কাঁধেও তোমার সমান দায়িত্ব থাকবে। তুমিই একদফা ভাবো সেই যোগ্যতা আছে না কি ঐ কিশোরীর? জানো তো পরিকল্পনা সঠিক না থাকলে ক্ষমতাধর রাজাও জিতা যুদ্ধে হারে?”

“সর্বশ্রেষ্ঠ পরিকল্পনাকারী আল্লাহ। নিশ্চয়ই তাঁর পরিকল্পনা অনুযায়ীই আমাদের বিবাহ হয়েছে। এখন বিদায় দাদীজান। আসসালামু আলাইকুম।”

মেহমাদ শাহ বেগম লুৎফুন্নেসার কক্ষ ত্যাগ করে। বৃদ্ধ নারীটির মুখমণ্ডল প্রদাহপূর্ণ। মনে মনে পরিকল্পনা আঁকছেন দাবার ছক থেকে অপ্রিয় পাশাটিকে সরানোর।

যুবক বের হলে মিনার ‘হুজুর’ বলে তার পিছন পিছন তার কক্ষ আসে। অনেকটা খোশামুদি করেও নিজের কৌতূহল প্রকাশ করে সে।

“আচ্ছা, জমিদার বাবু। আপনি তো চাইলে আমাকে বা অন্যকাউকেও আদেশ করতে পারতেন ঐ মেয়েকে বিবাহ করতে। তা না করে আপনি নিজেই এমন বদসুরত…?”

নিজের মনিবের চোখে চোখ পড়তেই কথা সেখানেই বন্ধ করে মাথা নিচু করে ফেলে মিনার। নিজের খাস ভৃত্যের কথায় স্মিত হেসে গম্ভীর গলায় উত্তর দেয়,
“ঝামেলাটা আমার ছিল তার ফলাফল অন্যকে ভোগ করালে আমার ক্ষমতা বোঝানো হতো ঠিকই। কিন্তু সম্ভ্রম ও মান নিচে নেমে যেতো। আর মানুষের মাঝে বদসুরাত বলে কিছু আছে আমার মনে হিয় না।”

___

“বেগম! বেগম! বেগম!” উৎফুল্লতার সহিত যামিনীকে ডাকতে ডাকতে কক্ষে ঢোকে দিলরুবা।

হঠাৎ প্রিয় বাঁদীকে এত আনন্দিত দেখে একটু আশ্চর্যই হয় যামিনী। সেই সঙ্গে তার মুখশ্রীতেও উদিত হয় মুচকি হাসি।

“কী হয়েছে গো দিলরুবা? মনে এত রঙ কেন লাগলো আজ?”

“প্রিয় বেগম, আমার নয় আপনার দিন-রাত রঙিন হতে চলেছে। আপনার আঁধার গগনের চাঁদ আসতে চলেছে গো, চাঁদ। আরে খবর পাঠিয়েছে জমিদার বাবু, আসছেন তিনি আজ। তার পাক পায়ের ছোঁয়ায় ধন্য হবে এই শিকার দালান, ধন্য হবে আপনার কামরা।”

বুক ধ্বক করে উঠে যামিনীর। তার শিরায় শিরায় এক অন্যরকম উত্তেজনা, অন্যরকম উল্লাসও বিদ্যমান বটে। কেন যেন খুশি খুশি লাগছে! কী একটা আনন্দ! তবে কি সে বিয়ের দিনের এতকাল পর পুনরায় স্বামীকে দেখবে ভেবেই মনে রঙ লেগেছে তার?

ঠিক প্রথমদিনের মতোন হাম্মাম খানায় নিয়ে রমণীকে চন্দন, দুধ, গোলাপ জল দিয়ে স্নান করানো হয়। গোটা গায়ে মাখানো হয় সুগন্ধি, পরানো ফিনফিনে পাতলা, মসৃণ ও মোলায়েম কাপড়ের শাড়ি। তীক্ষ্ম কালো এক জোড়া চোখ সাজানো হয় সুরমায়, হস্ত মেহদিতে, চরণ আলতায়। অতঃপর সাদা মুক্তোদানার গহনাই হয় তার সজ্জার বস্তু।

মেহমাদ শাহ দালানে পা রাখতেই সারা দালানে গুঞ্জন পড়ে যায় তার আগমনের। যামিনীর গোটা দেহ কেঁপে উঠে, অজানা এক শিহরণ জাগছে দেহে। সে লাগোয়া বিশালাকার বারান্দার বেড়া ঘেঁষে দাঁড়িয়ে বড়ো বড়ো শ্বাস ফেলতে শুরু করে।

একটু বাদেই প্রহরীর কণ্ঠ কর্ণগোচর হয়।
“জমিদার নবাব মেহমাদ শাহ কামরায় আসছেন।”

রমণীর মনে হচ্ছে এবার এই মরণ উত্তেজনা ও উল্লাসে জ্ঞানই হারিয়ে ফেলবে সে। বেড়ায় ভর দিয়ে কোনোরকম দাঁড়িয়ে থাকে সে।

মেহমাদ শাহ ভিতরে ঢুকে গোটা কক্ষে চোখ বুলাতেই ভ্রু কুঁচকে যায়। যামিনী যে এখানের কোথাও নেই। কিছু একটা আভাস পেয়ে বারান্দার দিকে অগ্রসর হয়।

যুবক রমণীকে দেখতে পায় অবশেষে। যামিনী তার দিকে ঘুরে বেড়ায় গা এলিয়ে দাঁড়িয়ে, চোখজোড়া বন্ধ। তার মৃদু কম্পিত দেহের দিকে খেয়াল করতেই বিদ্যুৎ লাগে যেন মেহমাদের।

ধীর পায়ে অগ্রসর হয় সে যামিনীর দিকে। কিশোরী বুঝতে পেরে বিদ্যুৎগতিতে চোখজোড়া খুলে ফেলে। মাথা ঝুঁকিয়ে সালাম জানায়,
“আসসালামু আলাইকুম, বাবু মশাই।”

মেহমাদ কিছু না বলেই তার একদম কাছ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে চিবুক ধরে নত মুখখানা উঁচু করে। নিজের মুখশ্রী তার দিকে এগিয়ে নিতেই চেনা শঙ্কায় চোখ বন্ধ করে ফেলে যামিনী।

যুবক একগাল হেসে রিনরিনে গলায় বলে,
“এতোটুকু সাহস নিয়ে মেহমাদ শাহের মনমোহিনী হতে চাও? মেহমাদ শাহের ভালোবাসা বিষাক্ত সর্পের ন্যায়, তার যন্ত্রণা ছোবল সহ্য করার ক্ষমতা তোমার নেই। আর এসব সুরমা, লালি এগুলো দিয়ে মেহমাদের বাহুতে জায়গা পাওয়া যায় না কন্যা। মেহমাদের হৃদয়কে আগে আপন করো। নিজের ইচ্ছেতে আমার নিকটে এসো, মনে ভয় নিয়ে শুধু মনোরঞ্জন করতে এসো না কন্যা। এমন নারীর অভাব হবে না আমার জন্য।”

মেহমাদ শাহ চলে যায়। কেন জানে না যামিনী, তবে তার খুব করে কান্না পায়। ঝরঝরিয়ে কেঁদে দেয় সে। সেই সাথে হাতকে বেড়ার উপর আঘাত করে হৃদয়ের শোক ও যন্ত্রণায়। হাতে থাকা কাচের চুড়িগুলো তো চৌচির হয়ই, সেই সাথে কাচের আঘাতে ক্ষত-বিক্ষত হয়ে যায় হস্তও। সব চুড়ি ভেঙেই শান্ত হয়ে আকাশের দিকে মুখ এগিয়ে দাঁড়ায় সে।

এত ক্ষোভ তবে কীসের? তাহলে কি সে চাচ্ছিলো মেহমাদ আসুক, তাকে ছুঁয়ে দিক? এই বিষয়টি যে একদম জানা নেই রমণীর এমনটা নয়। তারও হৃদয়ে আছে বহু স্বপ্ন, প্রত্যাশা, কামনা নিজের স্বামীকে জুড়ে৷ যার পূর্ণতা আকাঙ্ক্ষা তার লোমে লোমে পরিপূর্ণ।
এদিকে তার সাথে ক্রন্দন করতে বসে আকাশও। মুষলধারে বৃষ্টি নামে। ভিজিয়ে দেয় রমণীকে।

জমিদারকে বের হতে দেখে যামিনীর কক্ষে ঢোকে দিলরুবা। বারান্দায় দাঁড়িয়ে থেকে যামিনীকে এভাবে ভিজতে দেখে অবাক হয় সে। আতঙ্কিত হয় যখন তার প্রিয় বেগমের হাত থেকে গড়িয়ে পড়া রক্ত দেখে।

“বেগম, বেগম, ভিতরে আসুন। আপনার হাত থেকে রক্ত পড়ছে। ভিতরে আসুন।”

যামিনী শুনে না তার কথা। দিলরুবা নিজে হাত ধরে নিতে আসলে সে শুধায়,
“যাও তুমি দিলরুবা। আমাকে একা ছেড়ে দাও। আমার যন্ত্রণার দহম তুমি বুঝবে না।”

অনেক চেষ্টার পরও দিলরুবা সহ অন্যান্য দাসীরা যামিনীকে ভিতরে নিতে পারে। গোটা দালানে দাবানলের ন্যায় ছড়িয়ে পড়ে এ কথা। মেহমাদ শাহের কানে আসতেই সে নিজের কক্ষ ছেড়ে ক্ষুব্ধ হয়ে যামিনীর কক্ষে ঢুকে।

দাসীদের ভীড় দেখে ধমক দিয়ে উঠে সে,
“বের হও সকলে! বের হও! কামরা আমার খালি চাই এই মুহূর্ত!”

পরমুহূর্তেই সমগ্র কক্ষ খালি হয়ে যায়। মেহমাদ বারান্দার দিকে অগ্রসর হয়। যামিনীর কোমড় আঁকড়ে ধরে নিজের সাথে মিশিয়ে ক্ষুব্ধ কণ্ঠে প্রশ্ন করে,
“তোমার স্পর্ধা কী করে হয় আমার উপস্থিতিতে এমন কাণ্ড রটানোর? কী করে?”

তাকে অবাক করে যামিনী নৈশব্দে তার অধরোষ্ঠে নিজের অধর ছুঁয়িয়ে দেয়। বক্ষে লুটিয়ে পড়ে আকুতিভরা কণ্ঠে আবেদন করে,
“আপনার সব ক্রোধ মেনে নিলাম বাবু মশাই। মেনে নিলাম আপনার ভালোবাসার যন্ত্রণা। মেনে নিলাম আপনার সকল বিষাক্ত ছোবল। তবুও আমাকে আপনার ভালোবাসার ভিক্ষে দিন। আপনার হৃদয়ে জায়গা দিন। জায়গা দিন আপনার এই বক্ষে, বাহুতে, আপনার গোটা দেহে। আমার আঁধার যৌবন আপনার চরণে অর্পণ করছি বাবু মশাই, ফিরিয়ে দিবেন না।”

মেহমাদ শাহ অপলক দেখতে থাকে এই বৃষ্টিসিক্ত কিশোরীকে। চাঁদের আলোতে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে তার মুখশ্রী। কৃষ্ণাঙ্গ গড়ন, গোলগাল শিশুসুলভ মুখশ্রী, সরু নাক, ছোটো টানা টানা হরিণীর ন্যায় মায়া ধরানো আঁখি, পুরু ঠোঁট। সবমিলিয়ে যেন কোনো গ্রিক পৌরাণিক কাহিনীর দেবী। চিবুক ধরে ললাটে গভীর চুম্বন করে। কোলে তুলে নিয়ে অগ্রসর হয় কক্ষের দিকে যুবক।

দাসীর দ্বারা ঔষধ আনিয়ে নিজ হাতে লাগিয়ে দেয় যামিনীর হস্তে। অতঃপর নিশুতি রাতে অন্যরকম এক সুখকর ও যন্ত্রণাকর পথ পাড়ি দেয় মেহমাদ শাহ ও তার চন্দ্রমল্লিকার।

___

পালঙ্কে দেহের তীব্র যন্ত্রণা নিয়ে শুয়ে আছে যামিনী। মেহমাদ শাহ নিজ হাতে ব্যথা উপশমের জন্য কুসুম গরম পানিতে ভিজানো কাপড় দিয়ে ছেঁক দিয়ে দিচ্ছে প্রেয়সীকে। তাও যেন কন্যার আর্তনাদ থামার নেই।

“চন্দ্রমল্লিকা, তুমি ছোটো তুমি তো বুঝবে না, জানো না। আমারই বোঝা উচিত ছিল, এত কম বয়সে চাপ দিয়ে ফেললাম…”

মেহমাদের হাত ধরে তাকে থামিয়ে দেয় যামিনী। তার হাত নিজের বুকে জড়িয়ে রিনরিনে কণ্ঠে বলে উঠে,
“বাবু মশাই, যেই যন্ত্রণা আমায় আপনার আরও কাছে নিয়ে যায় তা সুখের আমার নিকট, তা আমায় ধন্য করে। দয়া করে নিজেকে দুষবেন না। তাছাড়া আপনি জানেন গ্রামের সখা সমবয়সী রত্নার আরও আগে বিয়ে হয়েছিল, একটা ছেলেও আছে এখন। আমার শুধু একটাই আর্জি, তা হলো আপনি আমাকে নিজের নিকটে রেখেন, এতোটা নিকটে যেন কেউ না আলাদা করতে পারে আমাদের। কারণ আপনি ছাড়া আমি সূর্যহীন ধরনীর ন্যায়, অন্ধকারে ডুবন্ত এক ধ্বংসস্তূপ।”

মেহমাদ ভালোবাসা সিক্ত এক স্পর্শ দেয় তার চন্দ্রমল্লিকার চিবুকে। যামিনী তৃপ্তির হাসি দেয়।

চলবে…

#চন্দ্রপুকুর
||৫ম পর্ব||
-ঈপ্সিতা শিকদার
“না, বাবু মশাই আমাকে ছেড়ে যাবেন না আপনি। একটু অনুগ্রহ দেখান আপনার চন্দ্রমল্লিকার উপর।”

যামিনীর অভিমানী কণ্ঠ শ্রবণগত হতেই মেহমাদ শাহ কাগজপত্র থেকে চোখ উঠিয়ে তার ক্রন্দনরত মুখশ্রীর উপর দৃষ্টি স্থির করে। তার চন্দ্রমল্লিকা শিশুদের ন্যায় ঠোঁট ফুলিয়ে কাঁদছে। এমন শিশুসুলভ আচারণে স্মিত হাসে যুবক।

কিশোরীর নরম, শীর্ণ হস্ত খানা ধরে হ্যাঁচকা টান দিয়ে নিজের পাশে নরম গদিতে বসায়। যামিনী আদুরে বিড়ালের ন্যায় আরও গা ঘেঁষে বসে৷

বুকে মাথা রেখে বলে,
“বিয়ের দেড়মাস পর প্রথমবারের মতো আপনাকে নিকটে পেলাম। চারটে দিনও ঠিক-ঠাক কাটলো না, আর আপনি চলে যাবেন বলছেন। বাবু মশাই আর ক’টা দিনই থেকে যান না আমার শয্যায়, আমার বক্ষে।”

মেহমাদ শাহ তার মুখশ্রী বক্ষ থেকে তুলে দু’হাতে আগলে নেয়। দু’চোখের কোণে জমিত মুক্ত দানার ন্যায় ঝলমলে অশ্রু মুছে ধীর স্পর্শে।

“আমার মায়াবী হরিণী, আমার এলোকেশী, রাজকন্যা, সোনালি পক্ষী এভাবে নাবালকের সদৃশ কেঁদো না। আমাকে যেতে হবে চন্দ্রমল্লিকা। বহু কাজ পড়ে আছে, জমিদারদের জমিদারিই প্রথম অগ্রাধিকার। আমি আবার আসবো, বেশ খাণেক সময় নিয়ে আসবো।”

“তবে আপনার নিকটে নিয়ে যান। যেখানে সারাটা সময় নিজ নয়নযুগল ধন্য করতে পারি আপনাকে দেখে। আপনি হীনা আমি এক তৃষ্ণার্ত চাতক পাখি, যে ব্যাকুল আপনার একদফা দর্শন পেতে।”

ছলছল চাহনি ও অশ্রুভেজা কণ্ঠ যামিনীর। যুবকের হৃদয় ছুড়ি আঘাত করে যায় এরূপ প্রেমময় ও মাধুর্য পূর্ণ বাণীতে। হৃদয়ের সবটুকু অনুভূতি নিংড়ে ঢেলে দেয় কিশোরীর অধরে।

স্বীয় মনমোহিনীকে বাহুবন্ধনে আবদ্ধ করে শুধায়,
“নিয়ে যাবো তো, তোমার যোগ্য স্থানে তোমায় রাখতে হবে না? তুমি দোয়া কোরো আমাদের জন্য আল্লাহর নিকট। আর হ্যাঁ, নবাব মেহমাদ শাহের স্ত্রীকে আঁখিজলে নয়, ঔদ্ধত্যে (গর্ব/অহং) মানায়।”

শেষ বাক্যটি শ্রবণেন্দ্রিয়ে প্রবেশ করতেই যামিনীর ক্রন্দনরত মুখশ্রীতেই একগাল হাসি ফুটে উঠে। আরও গভীর ও দৃঢ়ভাবে জড়িয়ে ধরে নিজের স্বপ্নপুরুষকে।

মেহমাদ শাহ তার থেকে বিদায় নিয়ে নবাববাড়ির জন্য যাত্রা শুরু করে ঘোড়ার গাড়ি করে। যামিনী সেই অবধি তাকিয়ে থেকে তার যাওয়ার পথে যেই অবধি গাড়িটি অদৃশ্য না হয়ে যায়।

___

উঠানে চাদর বিছিয়ে চৌকি পেতে বসে যামিনী তসবিহ পড়ছে, দিলরুবাও নিচে বসে আছে। সন্ধ্যালোকের আবছা আলো, মৃদু বাতাসে শীতল আবহাওয়া বেশ মন মাতানো পরিবেশই। তবে রমণী উদাস মনে আকাশ পানে তাকিয়ে আছে। ভাবছে নিজের এই আলো-আঁধার সংসারের কথা।

সময় চলছে আপন গতিতে, এর সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলছে যামিনীর সংসারও। নয় মাস, সাধারণ হিসেবে প্রায় দুইশত সত্তর দিন কেটে গিয়েছে তাদের বিবাহের, অথচ সর্বমোট পঁয়তাল্লিশ দিনও হয়তো যামিনী তার বাবু মশাইকে পায়নি। নিজের মন্দ ভাগ্যের প্রতি উপহাস করে নিজেই হাসলো। আবার এক ফোঁটা অশ্রুও ফেললো।

বিড়বিড়ালো,
“আল্লাহ, আমি কতোটা মেহমাদকে চাই। তিনি শুধু আমার ভালোবাসা ও স্বপ্নই নয়, প্রয়োজনও। তবে এখন তিনি আমার নেশাতে পরিণত হয়েছে। না তাকে ছাড়া আমার দিন কাটতে চায়, আর শয্যাতে বিভীষিকাময় হয়ে উঠে রাত্রির অন্ধকার।

তিনি আমার জীবনের আশার চন্দ্রপুকুর। তুমি তো সবচেয়ে আপন তোমার বান্দার, সর্বোত্তম পরিকল্পনাকারী। উনাকে আমার নিকটে আনার তবে ব্যবস্থা করো না খুব দ্রুতো। আমি যে জীবনীশক্তিহীন হয়ে পড়ছি আমার বাবু মশাইকে ছাড়া।”

সেই মুহূর্তেই গোটা শিকার দালানে গুঞ্জন পড়ে যায় মেহমাদ শাহের আগমনের। অবিশ্বাস্য বোধ হয় রমণীর। এত সত্বর (দ্রুত) বুঝি দোয়া কবুল হয়?

সে অবিলম্বে দালানে ঢোকার সংকীর্ণ পথে যেয়ে দাঁড়ায়। হাতের ইশারায় স্থান শূণ্য করতে আদেশ করে সকল খাদিম ও দাসীদের। তার অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে কাঙ্ক্ষিত পুরুষটির আগমন হয়। তবে প্রতিবারের ন্যায় এবার মেহমাদ শাহের প্রাণচঞ্চল এক গালি হাসি বিদ্যমান মুখমণ্ডল দেখতে পায় না। শুধু দর্শন করে এক ক্লান্ত যুবককে।

মেহমাদ শাহ এগিয়ে এসে তার সম্মুখে দাঁড়াতেই রমণী ‘বাবু মশাই’ বলে হাতের পিঠে চুমু খায়।

“আসসালামু আলাইকুম। আপনি কেমন আছেন? সেই যে গেলেন আর তো এলেন না আপনার এই অধম চন্দ্রমল্লিকার নিকট। এতোটাই মুছে ফেলেছেন আমায় হৃদয়ের কিতাব হতে?”

যুবক নিঃশব্দে বক্ষে মিশিয়ে নেয় তাকে। আবেগ ভরা কণ্ঠে বলে উঠে,
“আমি ক্লান্ত চন্দ্রমল্লিকা। প্রচণ্ড ক্লান্ত এক সৈনিক। যে আঁধারের সাথে লড়তে লড়তে হারতে প্রস্তুত, তবে তুমি আমার এক ফালি চন্দ্রসুধা হয়ে লড়ার বল দাও। তুমি আমার প্রাণশক্তি ও প্রেরণার উৎস তুমি, চন্দ্রমল্লিকা। ভালোবাসি, চন্দ্রমল্লিকা।”

“আমিও ভালোবাসি। মাত্রা ছাড়ানো প্রিয় আপনি আমার।”

কয়েক মুহূর্ত উষ্ণ বন্ধনে পেড়িয়ে গেল। মেহমাদ শাহ নিজের থেকে সরিয়ে ফেলল যামিনীকে।

“এই কড়া রৌদ্রে এখানে আসতে আসতে ঘেমে-নেয়ে শরীর আঠালো হয়ে গিয়েছে। স্নান করতে হবে। আমি কক্ষে যাচ্ছি। তুমি দাসীদের বলো হাম্মাম খানা তৈরি করতে আমার স্নানের জন্য।”

হৃদয় মুচড়ে উঠে কিশোরী। মেহমাদ শাহকেও তার ন্যায় দাসীরা স্নান করাবে না কি সেই শঙ্কায়। এ যে একদমই তার চাওয়া ভিন্ন।

কিছুটা বিড়ম্বনা ও লজ্জা নিয়ে সে প্রস্তাব রাখে,
“আপনি যদি কিছু মনে না করেন বাবু মশাই আজ আপনাকে আমি স্নান করতে সহায়তা করি?”

দুষ্টু হাসে মেহমাদ শাহ।
“এতোটা অধৈর্য্য হয়ে পড়েছো কেন চন্দ্রমল্লিকা? তোমার শয্যাতেই তো রাত্রি পাড় হবে আজ আমার।”

অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে যামিনী। লাজুক হাসি খেলানো মুখে ঝুঁকে কোনোরকম বিদায় জানিয়ে চলে গেল।

এই রজনীটি ভয়ংকরতম সুন্দর কাটালো যামিনী মেহমাদ শাহের সঙ্গ পেয়ে। তবে সুখের সমাপ্তি করে ফজরের নামাজের পরেই বিদায় জানালো তার বাবু মশাই।

বিদায়ের লগ্নে মেহমাদ শাহের বক্ষে মিশে কেঁদে দেয় যামিনী। মেহমাদ শাহ রমণীর অশ্রু মুছে তার ডান হাতে লালচে রত্নে সজ্জিত স্বর্ণের তৈরি কঙ্কন পরিয়ে দিয়ে হাতের পিঠে গভীর চুম্বন করে।

“আমাদের খানদানী কঙ্কন আজ তোমায় দিলাম। আমার সকল ভালোবাসা, অনুভূতি মেশানো এই কঙ্কনে। যতোবার আমার স্মৃতি, প্রণয়ে দগ্ধ হবে ততোবার ছুঁয়ে দিয়ো এই কঙ্কনকে, মনে করবে আমাকেই ছুঁয়ে দিলে। করতে পারবে না আমায় ভালোবেসে আমার উদ্দেশ্যে অপেক্ষা?”

“আপনার চুম্বনরস, এমন কী একটা দর্শনই যথেষ্ট আমার জন্য এক যুগ পাড় করার জন্য। যন্ত্রণাদায়ক ভীষণ! তবে সবশেষে যখন আপনার নিকটে যাই বাবু মশাই তখন সব ভুলে যাই।”

অনুভূতিকে মাটি দিয়ে ঘোড়ার গাড়িতে উঠে বসে মেহমাদ শাহ। তবে ব্যাকুলা পক্ষীর ন্যায় দাঁড়িয়ে থাকে যামিনী।

___

আজ প্রায় আড়াই মাস মেহমাদ শাহের আগমন হয়নি যামিনীর কক্ষে। চিঠি এসেছে এ অবধি তিনটে, তাও বেশ ক’দিন পূর্বে। তবে কিশোরী মানিয়ে নিয়েছে, প্রেমভক্তি নিয়ে অপেক্ষা করে আছে প্রিয়তমের আসার।

হিরের তাজটিকে মাথায় সাজিয়ে ঘুরে ঘুরে দেখছে যামিনী। আর চাপা হাসছে। এই তাজটি যখন মেহমাদ শাহ পঞ্চমবার এসেছিল তখন উপহার দিয়েছিল, রমণীর অত্যন্ত প্রিয় এটি।

তার আয়নায় নিজেকে পর্যবেক্ষণ করার মাঝেই দিলরুবা প্রবেশ করে। তাকে কেমন যেন উদ্বিগ্ন ও দ্বিধান্বিত দেখাচ্ছিল।

“কী হয়েছে দিলরুবা? কিছু বলতে চাও তুমি আমাকে?”

“বেগম, ক্ষমা করবেন। কীভাবে বলবো জানা নেই, তবে আপনাকে জানানো আবশ্যক। দালানে এবং সবার মাঝে গুঞ্জন চলছে জমিদার বাবুর না কি তার ফুপির দ্বিতীয় কন্যা মেহনূরের সাথে বিয়ে ঠিক হয়েছে।”

যামিনী স্তম্ভিত, দুঃখিত ভীষণ। মুহূর্তেই অসাড় হয়ে পড়ে, তার হাত থেকে পড়ে যায় প্রিয় তাজটি।

“দিলরুবা! তোমার স্পর্ধা কী করে হয় এমন উপহাস করার? আমি জানি আমার বাবু মশাইয়ের স্ত্রী তো আমি। সে অন্যকাউকে কেন বিয়ে করবে?”

“ভুল-ত্রুটি মার্জনা করবেন। বিশ্বাস করুন আমি মিথ্যে বলছি না, যা শোনা যাচ্ছে তা-ই বলছি শুধু।”

রমণী ধপাস করে মেঝেতে বসে পড়ে। তার মন্দ ভাগ্যে এতোটা সুখ দেওয়ার পরে কেন ছিনিয়ে নিচ্ছে উপরওয়ালা? তীব্র বেদনায় চিৎকার করে কেঁদে উঠে। ক্রন্দনধ্বনিতে কেঁপে উঠে যেন গোটা দালানই। দিলরুবা চেয়েও থামাতে পারে না। তার হৃদয়ের ক্ষত যে এতো সহজে উপশম হওয়ার নয়।
|
চলবে…