চন্দ্রপ্রভা রজনী পর্ব-১৪+১৫

0
329

#চন্দ্রপ্রভা_রজনী
#পর্বঃ১৪
লিখাঃসামিয়া খান

পড়নে স্কুল ড্রেস,মাথায় বিনুনি করা,কাঁধে স্কুল ব্যাগ,এক জোড়া সাদা কেডস পায়ে দিয়ে একটা পনের ষোল বছর এর মেয়ে রাস্তায় দাড়িয়ে কার জন্য যেনো অপেক্ষা করছে।গোলগাল বেশ মিষ্টি একটা চেহারা।সারাদিন স্কুল করাতে মুখটা বেশ মলিন।তারপরও সেই ক্লান্ত পরিশ্রান্ত মুখমণ্ডল নিয়ে কারো জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে।
অনেকক্ষণ অপেক্ষা করার পরও কাওকে না পেয়ে বিরক্তিতে পায়চারি করা শুরু করলো এদিক সেদিক।
হুট করে একটা সাদা কালার এর গাড়ী দেখে চোখ চকচক করে উঠলো মেয়েটির।তার ক্রাশের গাড়ী এটা সে বেশ ভালো করে জানে।হাসি মুখে গাড়ীর দিকে দৌড়ে গলো মেয়েটি।

গাড়ীর হর্ণ দিয়ে গেট খোলার সংকেত দিলো স্বাধীন।গেট খোলা হয়ে গেলে যখুনি তার ভেতর গাড়ী ঢুকাতে যাবে হুট করে একটা মেয়ে সামনে এসে দাড়ালো।তাড়াতাড়ি করে স্বাধীন গাড়ীর ইঞ্জিন অফ করে দিলো।তা নয় এখুনি গাড়ী দ্বারা আঘাতপ্রাপ্ত হতো মেয়েটি।রাগে কয়েকটা খিস্তি দিলো মনে মনে স্বাধীন।জোরে করে গাড়ীর দরজা খুলে বেশ ঝাঁঝালো কণ্ঠে সামনে থাকা মেয়েটির উদ্দেশ্য বলল,

“অন্ধ হয়েছিস নাকী।ছাগল কোধাকার।চোখে দেখিস না যে গাড়ী আসছে?”

মূর্হতেই মেয়েটির হাসিমাখা উজ্জ্বল মুখমণ্ডলে কালো মেঘ ছেয়ে গেলো।মেয়েটাকে চিনে স্বাধীন।নাম ওয়াফা।এবার ক্লাস টেনে পড়ে।এর আগেও দুই একদিন কথা হয়েছিলো তাই জানা।স্বাধীন নাকী ওর ক্রাশ।

সে থেকে মাঝেমধ্যে বাড়ীর সামনে বা রাস্তায় দাড়িয়ে কথা হয়।কোথায় থাকে, কোথায় পড়ে এগুলো কিছু জানার প্রয়োজনবোধ করেনি স্বাধীন।ওয়াফাকে চুপ করে থাকতে দেখে স্বাধীন যখন আবার গাড়ীতে ফিরে যাবে তখন পিছন থেকে ওয়াফা বলল,

“কেমন আছেন?”

“মাথা আছি।এই মেয়ে তুমি এত আমার বাড়ীর সামনে কী করো?”

স্বাধীনের ধমকে বেশ ভয় পেলো ওয়াফা।কখনো স্বাধীন এভাবে কথা বলেনা।উল্টো অনেক ভদ্র ও ভালোভাবে বলে।কিন্তু আজ হঠাৎ করে কী হলো ওর কে জানে।

“আপনার সাথে কথা বলতে বেশ ভালো লাগে আমার।”

কথাটা বেশ মিনমিন করে বললো ওয়াফা।তাতে যেনো দপ করে উঠলো স্বাধীন।

“এই আমাকে কী তোমার মতো রাস্তার মানুষ পেয়েছো?সারাদিন দেখি রাস্তায় রাস্তায় ঘুরতে।দারোয়ান চাচা!দারোয়ান চাচা!”

স্বাধীনের চিৎকার
চেঁচামেচিতে ভেতর থেকে একটা লোক বের হয়ে আসলো।বেশ মোটা ভুড়িওয়ালা।

“কী ওইছে স্বাধীন বাবা।”

“দারোয়ান চাচা এই মেয়েটাকে দেখে রাখেন।ফালতু একটা মেয়ে।বাড়ীর আশেপাশে যেনো আর না দেখি।আর এই নেন চাবি।গাড়ী পার্ক করে দিয়েন।”

স্বাধীনের যাওয়ার পথে অশ্রুভরা চোখে তাঁকিয়ে রইলো ওয়াফা।মানুষটা এমন কেনো করে গেলো তার সাথে।হঠাৎ তার শরীরে শক্ত ঘর্মাক্ত একটা পুরুষালি হাত পড়ায় চকিত হলো তার।দারোয়ানটা তার বাহু ধরেছে এবং তা বেশ অশালীনভাবে।পান খাওয়া হলুদ দাঁত বের করে অত্যন্ত অশ্লীল ভঙিতে হাসছে।ওয়াফার এই হাসির আসল ব্যাপারটা বুঝতে অসুবিধা হয়নি।আশেপাশে তাঁকিয়ে দেখতো পেলো পুরো নির্জন রাস্তা।এই রাস্তায় এখন যদি কোনো বিপদ ঘটে তাহলে কেও দেখবেনা।ছোট হলেও ওয়াফার মাথায় বেশ বুদ্ধি আছে।স্কুলে ক্যারাটে প্রতিযোগীতায় বেশ কয়েকবার চ্যাম্পিয়ন হয়েছে।একটা জোড়ে শ্বাস নিয়ে দারোয়ান এর মেন পয়েন্ট বরাবর একটা লাথি বসিয়ে দিলো।ব্যাথায় কুকুড়ে মাটি লুটিয়ে পরলো দারোয়ান।
,
,
,

নিজের বাড়ীর সাথে দিহানের বাড়ীর তুলনা করছে আরিয়ান।আরিয়ানরা উচ্চবিত্ত হলেও দিহান তার থেকে কয়েক ধাপ এগিয়ে মনে হচ্ছে।কথাটা ভাবতে ভাবতে ঠোঁট টিপে হাসলো আরিয়ান।তার কাছে দিহানের সমপরিমাণ না থাকলেও ভবিষ্যতে যে হবেনা তেমন তো কোনো কথা নেই।

অথচ মায়ার জন্য আরিয়ান সুবাহকে বিয়ে করেছে।সেই মায়া তাকে ভুলে দিব্যি দিহানে মজে আছে।বুক চিড়ে একটা দীর্ঘশ্বাস বের হয়ে আসলো।আরিয়ানরা বিরাট ড্রয়িংরুমে বসে আছে।তার সাথে বসেছে সুবাহ।সামনের কাউচে আফিয়ার সাথে দিহা বসে গল্প করছে।মায়া-দিহান এখনো তাদের সাথে দেখা করতে আসেনি।আরিয়ান যেখানে বসে আছে সেখান থেকে সিঁড়ি একদম স্পষ্ট দেখা যায়।সিঁড়ি দিয়ে দিহান আর মায়া নামছে।মায়ার হাত শক্ত করে ধরে রেখেছে দিহান।এগুলো দেখে আরিয়ান বেশ নির্বিকার।পূর্বের ন্যায় বসে আছে।অথচ তার ভিতরে কী চলছে তা একমাত্র সে এবং অন্তর্যামি জানে।

সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে দিহান তার মায়ের উদ্দেশ্য বলল,

“মা দেখো তো এই ছোট্ট বিলাইটাকে তোমার পছন্দ হয় কীনা?”

তাদের আসতে দেখে আফিয়া হাসি মুখে এগিয়ে গেলো।মায়া তাকে সালাম দিলে সে সবিনয়ে সালাম এর উত্তর নিয়ে মায়াকে জড়িয়ে নিলো বুকে।

“কীসব বলো না দিহান।এটা বিলাই হতে যাবে কেনো?এটা আমার একমাত্র পুত্রবধূ।”

“ওর মধ্যে তো একটু বিলাই স্বভাব আছে তাই ওকে বিলাই বলি।”

পিছনে সুবাহাকে দেখতে পেয়ে তার দিকে ছুটলো দিহান।ভাইকে আসতে দেখে তার বুকে ঝাঁপিয়ে পরলো।

“এটা তো আমার আরেক কলিজা।মায়া এটা আমার আরেক বোন সুবাহ।”

সুবাহ কে এবং কার স্ত্রী তা চিনতে ভুল হয়নি মায়ার।আর শুনেছেও সে আরিয়ান এর স্ত্রী।ভাইয়ের বাহুডোর থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে মায়ার দিকে এগিয়ে গেলো সুবাহ।

মায়া সামনে থেকে দেখে বেশ অবাক হলো সে।বিস্ময়ে আরিয়ানকে বলল,

“ভাবী তোমাকে তো সেদিন আমি বিলবোর্ডে ভাইয়ের সাথে দেখেছি।আরিয়ান আপনার মনে আছে না?”

“মনে থাকবেনা আবার।বাই দ্যা ওয়ে ভাবী আপনি মডেল?”

আরিয়ান এর কথাগুলো যে ব্যাঙ্গাত্বক ছিলো তা বেশ বুঝতে পারলো মায়া।তাও মুখ থেকে হাসি সরালো না।কেও কিছু বলার আগে দিহান বলল,

“এইযে আরিয়ান আমার সাথে তো তোমার কথাই হলো ন।”

“এইযে এখন হবে।”

দিহান আর আরিয়ান বেশ হেসে হেসে কর্মদন করলো।

“তা আরিয়ান তুমি একটা কথা ভুল বললে মায়া মডেল নয়।ইনফ্যাক্ট ও জানতো না যে ওর ছবি তুলবো আমি।আর এখন যেহেতু আমার বউ হয়েছে তাই আর কোথাও ওর ছবি থাকবেনা।”

“ইউ আর ভেরী পজিসিভ ম্যান।”

“ইয়েস।মায়া কাম হেয়ার।”

মায়া দিহানের কাছে আসলে দিহান আরিয়ান এর সাথে তার পরিচয় করিয়ে দিলো।দুজনে এমনভাবে পরিচিত হলো যেনো কোনোদিন কেও কাওকে দেখেনি।

খাবার টেবিলে সবাই ডিনার করতে বসেছে।বিকাল থেকে সবাই অনেক আড্ডা দিয়েছে একসাথে।ডাইনিং টেবিলের সবার সামনেই মায়াকে দিহান খাইয়ে দিচ্ছে।তা দেখে টিপ্পনি কেঁটে আরিয়ান বলল,

“ভাই তো দেখছি একদম বউ পাগল।”

“বউ পাগল না বউ এর জন্য পাগল গো।আর মায়া তো একটু অসুস্থ তাই খাইয়ে দেই।”

“কী হয়েছে মায়ার?”

“এক জানোয়ার দ্বারা আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছে।”

খাওয়া থেমে গেলো আরিয়ানের।মায়াকে তো সে সেদিন বেশ মেরেছিলো।তার রেশ এখনো হয়তো কাঁটেনি।কিন্তু দিহান কী তার ব্যাপারে জানে?

আফিয়া দিহানকে এ ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলে দিহান কিছু বলেনা।দিহা আফিয়াকে চোখ দিয়ে ইশারা করে কথা আর আগাতে না করে।আফিয়াও আর আগায় না।মায়া পরম শান্তিতে দিহান এর হাতে খাচ্ছে।তাদের দুজনকে দেখে গলা দিয়ে আর কিছু নামতে চাচ্ছে না আরিয়ানের।

“মায়া তুমি পড়াশোনা কতোদূর পর্যন্ত করেছো?”

“ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছিলাম।”

“বাহ।ভালো তা বাদ দিলে কেনো?”

“কারণ ছিলো মা।”

“এখন আর কোনো কারণ দেখানো যাবেনা।বাবু ওর পড়াশোনা আবার শুরু করাবে।দেখো আমি খোলামেলা বলতে ভালোবাসি।পড়াশোনা না শেষ হওয়া পর্যন্ত কনসিভ করা চলবেনা।আমিও এককালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তাম।কিন্তু পড়ার মাঝখানে দিহান গর্ভে আসলো তাই আর পড়া হলোনা।”

“বাবার সাথে তো তোমার সেখানেই পরিচয়।”

“হুম তোমার বাবা ছাত্রলীগ করতো।”

হঠাৎ দিহা তাদের কথার মাঝখানে বলল,

“মা তুমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটা কাহিনি শুনাই যা কয়দিন আগে একটা আর্টিকেলে পড়েছি আমি।

১৯৫৬ সাল পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনে ছিলো, একটা ছেলে যদি একজন মেয়ের সাথে কথা বলতে চায়, তবে তাকে প্রক্টর বরাবর দরখাস্ত দিতে হবে। শুধুমাত্র প্রক্টর অনুমতি দিলেই সে কথা বলতে পারবে। এছাড়া নয়। এমনকি তার ক্লাসের কোন মেয়ের সাথেও না।

ডিসেম্বর ১৯২৭, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার মাত্র ৬ বছর পর। একদিন কোলকাতা থেকে একজন যুবক এলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ঘুরে দেখবেন। কয়েকজন বন্ধু বান্ধব নিয়ে সে ঘুরতে বের হলো। তখন কার্জন হল ছিলো বিজ্ঞান ভবন। ঘুরতে ঘুরতে যখন কার্জন হলের সামনে এসে পড়লো তারা, সে যুবক দেখলো দূরে একটা থ্রী কোয়ার্টার হাতার ব্লাউজ আর সুতির শাড়ি পরা এক মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সে তার বন্ধুদের জিজ্ঞেস করলেন, এই মেয়েটি কে? তখন তার বন্ধুরা বলল, এ হলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম মুসলিম নারী ছাত্রী। তখন সেই যুবক বলে, সত্যি? আমি এই মেয়ের সাথে কথা বলব। তখন সে যুবক মেয়েটির সাথে কথা বলার জন্য একটু এগিয়ে গেলে তার বন্ধুরা তাকে বাঁধা দেয়। বলে, না তুমি যেওনা। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে মেয়েদের সাথে কথা বলার অনুমতি নেই। তুমি যদি ওর সাথে বিনা অনুমতি ছাড়া কথা বলো তবে তোমার শাস্তি হবে। সেই যুবক বলল, “আমি মানি নাকো কোন বাঁধা, মানি নাকো কোন আইন।”

সেই যুবক হেঁটে হেঁটে গিয়ে সেই মেয়েটির সামনে দাঁড়ালো। তারপর তাকে বলল, আমি শুনেছি আপনি এই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম মুসলিম নারী ছাত্রী। কি নাম আপনার? মেয়েটি মাথা নিচু করে বলল, ফজিলাতুন্নেছা। জিজ্ঞাসা করলো, কোন সাবজেক্টে পড়েন? বলল, গণিতে। গ্রামের বাড়ি কোথায়? টাঙ্গাইলের করোটিয়া। ঢাকায় থাকছেন কোথায়? সিদ্দিকবাজার। এবার যুবক বললেন, আপনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম মুসলিম নারী ছাত্রী, আপনার সাথে কথা বলে আমি খুব আপ্লুত হয়েছি। আজই সন্ধ্যায় আমি আপনার সাথে দেখা করতে আসবো।

মেয়েটি চলে গেলো। এই সব কিছু দূরে দাঁড়িয়ে এসিস্ট্যান্ট প্রক্টর স্যার দেখছিলেন। তার ঠিক তিনদিন পর। ২৯ ডিসেম্বর ১৯২৭, কলা ভবন আর বিজ্ঞান ভবনের নোটিশ বোর্ডে হাতে লেখা বিজ্ঞপ্তি টানিয়ে দেয়া হলো যুবকের নামে। তার নাম লেখা হলো, তার বাবার নাম লেখা হলো এবং বিজ্ঞপ্তিতে বলা হলো, এই যুবকের আজীবনের জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ নিষিদ্ধ।

তারপরে এই যুবক আর কোনদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আসেননি। সেইদিনের সেই যুবক, বৃদ্ধ বয়সে ১৯৭৬ সালের ২৯ আগস্ট মৃত্যুবরণ করলেন। যে যুবকটা আর কোনদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবেশ করেননি, তার মৃত্যুর পরে তার কবর হলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে।

বলো তো লোকটা কে ছিলো?”

“সেই যুবকের নাম, বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম।ফজিলাতুন্নেছা জোহাকে নিয়ে একটা কবিতা লিখেছেন তিনি।নাম হলো ” বর্ষা বিদায়”।”

“বাহ বেশ ইন্টারেস্টিং তো।তোকে কে বলল দিহা?”

“আপু এটা আমাকে মায়ার ভাই মি.সবুজ বলেছে।হি ইজ মাই পেশেন্ট।”

“দিহা এতকিছু বললি ফজিলাতুন্নেছা জোহার সম্পর্কে কিছু জানিস?”

“না তো ভাই।”

“ফজিলাতুন্নেছা জোহা ছিলো এই দেশের প্রথম মুসলিম নারী যে স্কলারশিপ পেয়ে বিলেতে পড়তে গিয়েছিলো এবং তার বিষয় ছিলো গণিত।”

একটু মন খারাপের সুরেই সুবাহ বলল,

“তোমরা কতোকিছু জানো ইতিহাস সম্পর্কে। আর আমি কিছুই না।আরিয়ান আপনি এ ব্যাপারে জানতেন?”

“হুম।বই না পড়লে কখনো জ্ঞান অর্জন করা যায় না।তেমনি এসব ইতিহাস জানতে হয়।ফজিলাতুন্নেছা জোহার মতোও মেয়ে আছে আবার এমন মেয়েও আছে এ পৃথিবীতে যারা টাকা-পয়সা আর সুন্দর ছেলে দেখলে নিজের ভালোবাসাকে ছাড়তে দ্বিধাবোধ করেনা।”

“তা অবশ্য ঠিক আরিয়ান।নারী মন বড় বিচিত্র। তা মায়া তোমার বাবার নাম কী?”

“আজমল খান।”

“বিশিষ্ট শিল্পপতি আজমল খান?”

“জ্বী।”

আফিয়ার পুরো দুনিয়া হঠাৎ করে ঘুরে গেলো।তার মানে আরিয়ান এর প্রাক্তন এখন দিহান এর স্ত্রী।আবার মায়ার উপর নিজের ভাবীকে খুন করার আরোপ আছে।না আর ভাবতে পারছেনা সে।খাওয়া ছেড়ে উঠে দাড়ালো সে।

“দিহান আমি একটু আসছি।”

,
,

এই প্রথম মাহসিন দিহানের কাছ থেকে কিছু লুকালো।দিহান তাকে মায়ার প্রাক্তন সম্পর্কে সব জানতে বলেছিলো কিন্তু এখন সে জানতে পারলো সেই ছেলেটি আর কেও নয় সুবাহার স্বামী আরিয়ান।যদি এখন সে সত্যি দিহানকে বলে তো কী হবে তা জানা নেই তার।অনেক কষ্টে বুকে পাথর দিয়ে সে এই বিষয়টা চেপে গেলো।আর এখন এই বিষয়টা গোপন করা উত্তম আর সে না বললে দিহান কখনো এ ব্যাপারে জানতে পারবেনা।
,
,
,

“এত রাতে বাহিরে কী করিস তুই রিশা?”

দোলনায় দোল থেকে খেতে রিশা আরিয়ানকে জবাব দিলো,

“ভাই তুই আমার সাথে কথা বলবিনা।”

“কেনো কী হলো বোন?”

রিশার মাথায় রেখে কথাগুলো বললো আরিয়ান।আরিয়ানের দিকে চোখ তুলে তাঁকালো সে। চোখ ভর্তি তার পানি টলমল করছে।

“কী হয়েছে?কাঁদছিস কেনো?”

“ভাই জানিস মানুষের তার কৃতকর্মের ফল তার স্বজনরা পায়।তাইতো তোর করা অন্যায়ের শাস্তি আমি পাচ্ছি।”

“আমি বুঝতে পারলাম না।”

“তুই যদি সুবাহকে বিয়ে না করতি তো তোর মায়ার সাথে বিয়ে হতো।তাহলে আমি দিহানকে পেয়ে যেতাম।”

“দিহানকে ভালোবাসিস?”

“হুম।”

“বোন আমার কাঁদিস না। আমি সব ঠিক করে দিবো দেখিস।”

“কিছুই ঠিক হবেনা ভাই।”

“হবে।সব ঠিক হবে।”

আরিয়ান এর ফোন আসলে রিশাকে রেখে কথা বলতে বলতে রুমে চলে আসে আরিয়ান।সুবাহ ঘুমানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে।মেয়েটা একদম বয়লার মুরগী টাইপ।একটু পরিশ্রম করতে পারেনা।এতসময় বাহিরে ছিল কিন্তু আরামে তাতেও কতোটা নেতিয়ে পড়েছে।ফোন রেখে ওকে নিয়ে শুয়ে পড়লো আরিয়ান।সুবাহ প্রায় ঘুমিয়ে পড়েছিলো কিন্তু হঠাৎ কীযেনো মনে পড়ায় আবার জেগে উঠলো।

“আরিয়ান!আরিয়ান শুনেন।”

“হুম বলো বয়লার মুরগী।”

“ধ্যাত সিরিয়াস কথা।”

“ওকে বলো।”

“ভাইয়া যে বিয়ে করেছে তা যেনো বাবা কখনো না জানতে পারে।তা নয় আয়শা ভাবীর মতো মায়া ভাবীর অবস্থা হবে।”

“আয়শা ভাবী কে?”

“দিহান ভাইয়ার আগের স্ত্রী।”

“তোমার ভাই আগে বিয়ে করেছিলো?”

“হ্যাঁ।”

“সে স্ত্রী কই?”

“মারা গিয়েছে।”

“কীভাবে?”

“বড় বাবা মানে দিহান ভাইয়ের বাবার নিজস্ব একটা পার্টি ছিলো রাজনীতির।সে অনেক বছর আগে মারা গিয়েছে।কিন্তু তার পরে চেয়ারম্যান দাদুই ছিলো।দাদুই এর পরে তো বাবার হওয়ার কথা।কিন্তু দাদুই তার পরে চেয়ারম্যান হিসেবে দিহান ভাইয়ের যে বউ হবে তার কথা বলে গিয়েছে।আর যে পর্যন্ত ভাইয়ার বউ না আসছে সে পর্যন্ত অস্থায়ী চেয়ারম্যান বাবা।আর সত্য বলতে গেলে বাবা কাওকে এই পদ দিবেনা।এজন্য বিয়ের দিন আয়েশা ভাবীকে বিষ খাইয়ে মেরে ফেলে।এ ব্যাপারে আমরা সব জানি কিন্তু প্রমাণ নেই তাই কেও কিছু বলতে পারিনা।”

“তার মানে মায়ার জীবন সংকটে?”

“হুম।যতোদিন পর্যন্ত বাবা না জানবে বিয়ের ব্যাপারে ততোদিন সেফ।বাবা জানলে মেরে ফেলতে পারে।জানেন রাজনীতিতে কেও আপন না।”

আরিয়ানের গা কাঁপছে।সে কীভাবে এত বড় ভুল করতে পারলো।বিছানা থেকে কোনোমতে টলতে টলতে সে উঠে দাড়ালো।তারপর ভাঙা ভাঙা গলায় বললো,

“সুবাহ একটু আগে তোমার বাবা কল করেছিলো।আর আমি বলে দিয়েছি দিহান ভাই আর মায়ার বিয়ের কথা।”

চলবে,,,

#চন্দ্রপ্রভা_রজনী
#পর্বঃ১৫
লিখাঃসামিয়া খান

“এ পৃথিবীতে সবথেকে কঠিন জিনিস হচ্ছে রাজনীতি।পলিটিক্স, পলিটিক্স, পলিটিক্স।আজকাল কোন জায়গায় পলিটিক্স নেই তা বলতে পারবে আফিয়া?”

মাসুদের প্রশ্নে কোনো জবাব দিলনা আফিয়া।চুপচাপ বিছানা ঘুছাতে লাগলো।ফোঁস করে একটা নিশ্বাস নিয়ে মাসুদ সাহেব আবার বলা শুরু করলো,

“রাজনীতি আমার ছোট বেলা থেকে খুব পছন্দের ছিলো।ছোটোবেলায় দেখতাম আমার বয়সের ছেলেদের উপন্যাসের বই নিয়ে মাতামাতি করছে।অথচ আমার সেদিকে কোনো মন ছিলনা।আমি তখন বিখ্যাত বিখ্যাত রাজনীতিবিদদের জীবনী পড়তে ব্যস্ত।”

“তোমার জন্য কী দুধ এখন নিয়ে আসবো। খাবে?”

“নাহ।তার আগে আমার পাশে একটু বসো তোমার সাথে কিছু কথা বলি।”

মাসুদের পাশে গিয়ে আফিয়া বসলো।আফিয়ার হাতদুটো নিজের মধ্যে নিয়ে বলতে শুরু করলো,

“জীবনে অনেক ক্ষেত্রে রাজনীতি দেখেছি। কিন্তু বিশ্বাস করো সবথেকে জটিল রাজনীতি হচ্ছে সংসারে যে রাজনীতি খাঁটে।এখানে সবথেকে কূটনীতিক চাল চালতে পারে নারী।নারীর থেকে বড় রাজনীতি হয়ত এই পৃথিবীতে কোনো পুরুষ বুঝেনা।তারা যেভাবে একটা সংসার চালায় তা দেশ চালানোর থেকে কম না।”

“হঠাৎ কথাগুলো আমাকে বলার কারণ?”

“আগে শুনো তো।তা যা বলছিলাম।যখন ভাইয়ার দল গড়ে উঠা শুরু করলো তখন ভিতরে ভিতরে স্বপ্ন দেখা শুরু করলাম আমি বড় রাজনীতিবিদ হওয়ার।খুব কম বয়সে ভাইয়ার নাম ডাক হলো।আমারও ভালো লাগতো যে একদিন আমিও বড় হবো।কিন্তু যেদিন ভাইয়া তার সব সম্পত্তি থেকে আমাকে আলদা করলো তখন খুব লাগলো।বাবাও যেনো কীরকম গা ছাড়া ছিল আমার জন্য।”

“পুরোনো কথা বাদ দেও মাসুদ।”

মাসুদ সাহেব থামলো না।নিজের বলার ধারাবাহিকতা চালু রাখলো।

“নীলা নাম ছিলো মেয়েটার।যাকে আমি খুব ভালোবাসতাম।এখনও মনে পড়ে মেয়েটাকে।মধুবালার মতো দেখতে ছিলো।সেই ভালোবাসাকে বিসজর্ন দিলাম তোমার আর দিহানের জন্য।বাবার কথায় বিয়ে করলাম।অথচ আমাকে তুমি কোনো পুত্র সন্তান দিতে পারলে না। তাও মানলাম।কিন্তু বাবা কী করে গেলো?দলের চেয়ারম্যান দিহানের বউকে করে গেলো।আয়শা অনেক ভালো একটা মেয়ে ছিলো।ভালো রাজনীতি বুঝতো।অথচ মরতে হলো অকালে।তার কারণ কারো অজানা নয়।”

“মাসুদ তুমি মায়াকে কিছু করবেনা।আমার ছেলেটা ওকে অনেক ভালোবাসে।”

“আয়শা মেয়েটা আমার অনেক প্রিয় ছিলো।মুখ ভরে আঙকেল বলে ডাকতো।তাকেই যখন নিজের পথের কাঁটা হতে দেখলাম তখন উপড়ে ফেলে দিলাম।মায়াকেও তো আমি দেখিনি এখনো।মায়ার প্রতি যে মায়া কম হয়।”

“মনে রেখো মাসুদ তোমার ঘরেও দুটো মেয়ে আছে।অন্যের মেয়ের ক্ষতি করতে চাইলে তা নিজের উপর আসবে।প্রকৃতি কিন্তু প্রতিদান দিতে ভুলেনা।”

মুখটা একদিকে বাঁকা করে মৃদু হাসলো মাসুদ সাহেব।আফিয়ার দিকে কিছুটা ঝুঁকে তার চিবুক চেপে ধরলো।

“রাজনীতির ক্ষেত্রে কেও আপন না।আমার পাপের শাস্তি আমি পাবো।তা আমার মেয়েরা পাবেনা।মা হয়ে মেয়েদের অভিশাপ দেও তাই নাহ।এই মায়াকে তো আমি দেখে নিবো।”
,
,
,

আরিয়ান চলে যাওয়ার সময় যেনো কেমন করে তাকাচ্ছিলো মায়ার দিকে।অদ্ভুত মোহময় চাহনি ছিলো তখন।এত সহজে মায়াকে ছাড়বেনা আরিয়ান তা বেশ ভালো বুঝতে পারছে মায়া।

মায়ার অগোছালো চুল নিয়ে মেতে রয়েছে দিহান।হাত দিয়ে নানা ভঙিমা করছে চুলগুলো নিয়ে।বিছানায় হেলান দিয়ে শুয়ে আছে দিহান।তার বুকে মাথা রেখে শুয়ে আছে মায়া।মানুষটা একদম অপরিচিত তার কাছে।তারপরও কেমন একটা স্বামী, স্বামী গন্ধ আসে তার থেকে।আচ্ছা স্বামী, স্বামী গন্ধ হয় কী?যেমন-মা,মা গন্ধ আসে।বিয়ের পর প্রতিটি মেয়ের জীবনে হয়ত পরিবর্তন আসে।তা সে মানলেও আর না মানলেও।মায়ার জীবনেও এসেছে।

“প্রিয়ংবদা কী ভাবছো?”

“অনেককিছু।”

“তা সেই অনেককিছুর মধ্যে কী কী?”

“উহু।বলা যাবেনা।”

“বলো না।”

“উহু।আর প্রিয়ংবদা মানে কী?”

“যে নারী সবসময় প্রিয় কথা বলে।”

“আমার সবকথা আপনার কাছে প্রিয়?”

“মায়াবিনীর মায়াবিদ্যার মন্ত্র উচ্চারণ শুনতে কোন প্রেমিক পুরুষের অপছন্দ হতে পারে?”

“মায়ামতি,মায়াবিনী হলাম।এরপর মায়াবতী বলবেন।”

“সবাই মায়াবতী হতে পারে কিন্তু মায়াবিনী হতে পারেনা।”

দিহানের কথায় উচ্চস্বরে হেঁসে উঠলো মায়া।হাঁসতে হাঁসতে বলল,

“আপনার সিনেমার নায়িকাগুলো আপনার ডায়লগ শুনে প্রেমে পড়েনা?”

“হুর।তাদের কথা বাদ দেও।তুমি জানো টপ নায়িকাদের বয়স কতো?ওরা সব বুড়ি হয়ে গিয়েছে।সব ভোটক্সের আর প্লাস্টিক সার্জারির কামাল।এমনও হয়েছে আমার থেকে বড় নায়িকাদের সাথে রোমান্স করতে হয়েছে।”

“বাহ নায়কসাহেব।”

“জ্বী নায়কসাহেবের বউ।”

“আমাকে একটা জিনিস দিবেন?”

“বাবু বাদে সব দিবো।”

“আমি আপনার কাছে বাবু চাইতাম না।আসলে আমি জিকজ্যাকের বিয়ে দিতে চাই।”

মায়ার কথায় কী রিয়াকশন দিবে তা বোধগম্য হলো না দিহানের।শেষমেশ বিড়ালের বিয়ে।মায়াকে কিছু বলার আগে দরজায় শব্দ হলো।দিহান উঠে গিয়ে দরজা খুলে দিলে হুড়মুড়িয়ে কেও রুমের ভিতরে প্রবেশ করলো।তাকে দেখে মায়া বিছানা থেকে নেমে দাঁড়ালো।বাকরুদ্ধ মায়া।এত রাতে আরিয়ান এখানে কী করে?

মায়াকে দেখে নিজের ভালোবাসা সামলাতে পারলোনা আরিয়ান।দৌড়ে গিয়ে ওকে নিজের বাহুডোরে চেপে ধরলো।রাত বাজে বারোটা।মধ্যরাতে স্বামী -স্ত্রীর রুমে এসে স্বামীর সামনে তার স্ত্রীকে বাহু বন্ধনে আবদ্ধ করার পরিণাম অবশ্যই ভালো কিছু হবেনা!

চলবে,,,