চাঁদের আলো পর্ব ০৩

0
1822

চাঁদের আলো
পর্ব ০৩
Writer Tanishq Sheikh

মিন্টুর মুখের হাসি উবে যায় জরিনেকে এই বাড়ি দেখে।খুশি মনে দুপুরবেলা নিরিবিলি নতুন বউ নিয়ে বাড়ি ফিরছিল মিন্টু।রাস্তা ঘাটে তেমন কেউ ছিল না।বাড়ির উঠানে এসে দাঁড়াতেই জরিনের মুখ দেখে চমকে যায়। চার বছর মিন্টুকে ছাড়া জরিনে এই বাড়ি পড়ে আছে এ’কথা যেন কিছুতেই বিশ্বাস হচ্ছে না মিন্টুর।মিন্টুর নতুন বউ ভ্যান থেকে নেমে পেছনে এসে দাঁড়ায়।কৌতূহল চোখে চেয়ে থাকে স্বামীর গলা জড়িয়ে কাঁদতে থাকা মেয়েটার দিকে।মিন্টু গলা থেকে জরিনের হাত ছাড়িয়ে দু’কদম পিছিয়ে দাঁড়ায়।অনিচ্ছাকৃত হাসি ঠোঁটে ঝুলিয়ে নতুন বউকে একবার দেখে নেয়।ঢোক গিলে সামনে তাকিয়ে বলে,
” জরিনে তুই!”
জরিনের যেন কোনো খেয়াল নেই।তার দৃষ্টি দিয়ে খুশির অশ্রু ঝরছে।মনে বইছে প্রশান্তির পবন।মিন্টুর রাগ হচ্ছে নিজের নির্বুদ্ধিতার উপর।একটু খোঁজ নিয়ে আসলেও পারত।তাহলে এমন অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার মুখোমুখি হতে হতো না।কিন্তু কি করে খোঁজ নিতো?এতোবছর কারও সাথে যোগাযোগ ছিল না মিন্টুর।দারিদ্র্যতা গ্লানি মুছতে ছুটেছিল ঢাকা।পেছনে ফেলে গিয়েছিল জরিনেকে।ঢাকার বাহারি আলোক ধাঁধায় একসময় মন থেকে জরিনে নামটা মুছে গেল।সেখানে জায়গা হলো মিতু,কুলসুমের।তাদের সাথেও মিন্টুর বনিবনা হলো না।মিন্টুর হঠাৎ জরিনের কথা মনে পড়ল।সেই কিশোরী গায়ের বধূর টান মিন্টুকে গাঁয়ে ফিরতে উদ্যত করলো।কিন্তু ফেরা আর হলো না সে’বার মিন্টুর।গার্মেন্টস অপারেটর হওয়ার সুযোগ মিন্টু কোনোমতেই ছাড়তে চাইল না। কাজের চাপে জরিনের কথা মনে রেখে সময় কাটতে লাগলো।দেখতে দেখতে সাড়ে ৩ বছর কেটে গেল।মিন্টুর ইচ্ছা হলো ফিরতে।আবার ভাবলো এতোবছর নিশ্চয়ই জরিনে ওর আশায় বসে নেই।মেঝো ভাইকে একদিন কল করে জিজ্ঞেস করেছিল জরিনের কথা।মেঝো ভাই কিছুই বলতে পারলো না।মিন্টু ধারণা করে নিলো জরিনে আর তার নেই।কষ্ট লাগলো কিন্তু সময় খুব দ্রুতই সে কষ্ট কাটিয়ে দিল।মিন্টু এখন সুপারভাইজার। গার্মেন্টসের এক সুন্দরী মেয়ের সাথে চুটিয়ে প্রেম করে ৪ মাস।তারপর বিয়ে করে কিছুদিন যেতেই বাড়ি চলে আসে নতুন বউ নিয়ে।বাড়িতে যে তার জন্য এতোবড় চমক অপেক্ষা করছে তা মিন্টু ঘূর্ণাক্ষরেও টের পায় নি।গলা শুকিয়ে আসছে মিন্টুর।জরিনের কান্নার শব্দে পাড়াপ্রতিবেশিরা হুমড়ে পড়েছে মিন্টুর বাড়ির উঠানে।সবার চোখ মিন্টুর পেছনে দাঁড়ানো নতুন বউটার দিকে।জরিনের হুশ ফেরে মিনারার গলার আওয়াজে।মিনারা আহ্লাদিত স্বরে মিন্টুর নতুন বউয়ের থুতনি ধরে বলে,
” ও মা! কি সুন্দর বউ এনেছিস রে মিন্টু? এতোবছর বাদে এই চমক দেখাইতে আসলি। তা বেশ বেশ।”আড়চোখে জরিনের স্তব্ধিত মুখটার দিকে তাকিয়ে হাসে মিনারা।জরিনে নতুন বউয়ের দিকে এগিয়ে আসে।আপাদমস্তক ভালো করে দেখে ফ্যালফ্যাল করে মিন্টুর মুখপানে চেয়ে থাকে।মিন্টু মুখ নামিয়ে চুপচাপ ঘরে চলে যায়।
ঘন্টাখানিক এভাবেই কেটে যায়।মিনারা সহ আরও কয়েকজন বউ ঝিরা নতুন বউকে ঘরে তুলতে গেলে জরিনে পথ আগলে দাঁড়ায়।
” আমার ঘরে ও ঢুকবো না বুজি।”
” এ কেমন তরো কথা জরিনে?মিন্টুর নয়া বউ তাইলে কই থাকবো?”
” কে মিন্টুর বউ!মিন্টুর বউ খালি আমি।এই ছেরি বাইর হ বাড়িততে।বাইর হ।”নতুন বউকে ধাক্কা দিতে গেলে মিন্টু জরিনের হাত টেনে দূরে সরিয়ে দেয়।জরিনে ব্যাকুলস্বরে মিন্টুর হাত ধরে বলে,
” আমার সাথে এমন অন্যায় কইরো না। দ্যাখো আমি তোমারে এহনও ভালোবাসি।তুমি জানো আমাগো একটা চান্দের মতোন ফুটফুটে মাইয়্যা হইছিল।কলেরায় মাইয়্যা মইরা গেছে গো।” জরিনে কান্নায় ভেঙে পড়ে মিন্টুর পায়ের কাছে।মিন্টুর কানে সে’সব কিছুই ঢোকে না।সে’শুধু নতুন বউ ময়নার শুকনো মুখটার দিকে চেয়ে আছে।ময়না মিন্টুর তাকানো দেখে কেঁদে ফেলে।মিন্টু চোয়াল শক্ত করে মিনারা কে বলে,
” ময়নারে ঘরে নিয়ে যাও তো ভাবি।”
” না আমার ঘরে ঐ ছেরি ঢুকবো না।” জরিনে হুঙ্কার দিয়ে ওঠে মিন্টুর সামনে।
” চুপ!তোর ঘর আবার কি? এই বাড়ি-ঘর সব আমার।তুই তোর বাপের বাড়ি চলে যা জরিনে।”
” এইডা কি কও তুমি?এতোকাল তোমার আসার পথ চাইয়া ঝড় ঝঞ্ঝার মধ্যেও এই ভিটে ছাইড়া যায় নেই।আর আইজ তুমি কইতাছো আমারে চইলা যাইতে?”
” হ কইতাছি।”
” তোমার পায়ে ধড়ি এমন কথা কইয়ো না।আমি তোমারে ছাড়া কেমনে বাঁচুম কও? আমরা দুইজন তো কসম খাইছিলাম।বাঁচলে একসাথে বাঁচুম আর মরলে একসাথে মরুম।আমি তো কসম রাখছি তুমি কেন ভুলে গেলা।”
“তুই তোর বাপের বাড়ি যা জরিনে।তোর খরচপাতি আমি দিয়া দিমু। এইহানে তোর থাকার দরকার নাই।”
” তোমার কথায় কি হইবো?পাষান পুরুষ!আমি যামু না।যামু না আমি।”
” দেখি তুই কেমনে না যাস?” মিন্টু জরিনের হাত ধরে টেনে উঠানে নিয়ে যায়।জরিনে মিন্টুর পা জড়িয়ে ধরে কাঁদে।
” আমারে খেদাইয়ো না।আমার বাপ মা স্বজন সব তো তোমার জন্যে ছাড়ছি।কোন মুখে যামু তাগো সামনে।”
” আমি ওসব জানি না।আমার বাড়ি তুই থাকতে পারবি না এই আমার শেষ কথা।”
” তোমার দিলে কি আমার জন্য একটুও দয়া হয় না? আমার চক্ষের পানি কি তোমার বুকে লাগে না।এমন নিষ্ঠুর হয়া গেছ তুমি!”মিন্টু জরিনের কোনো কথা শোনে না।টেনে ধরে বাড়ির বাইরে বের করে দেয়।জরিনে আবার ঢুকতে গেলে মিন্টু থাপ্পড় দিয়ে নিচে ফেলে দেয়।
“আর এক পা আগাইবি তো খাঁড়াইয়া খাঁড়াইয়া তোরে তালাক দিমু জরিনে।”
জরিনে থমকে দাঁড়ায়। পা দুটো অসাড় হয়ে আসে জরিনের।ধপ করে বসে চিৎকার করে কাঁদতে থাকে।মিন্টু নতুন বউ নিয়ে ঘরে তোলে।ভাইয়ের বউরা খাবার নিয়ে আসে তাদের জন্য। জরিনে পথের ধুলোয় বসে থাকে কাঠের পুতুলের মতো।বিকালে এলোমেলো পায়ে উঠে,ঘরের পেছনে মেয়ের কবরে শুয়ে কাঁদে।
সন্ধ্যায় শালিস বসে।গ্রামের মেম্বার, মাতুব্বর,চেয়ারম্যান আসে মিন্টুর বাড়ি।উঠানে গোল হয়ে বসে গ্রামের মাথারা।গায়ের মানুষ আড়ালে আবডালে লুকিয়ে সব দেখতে,শুনতে থাকে।চেয়ারম্যানের অনুরোধে হামজা মাস্টারও আসে।পুত্রহীন চেয়ারম্যান ভাগ্নে হামজাকে নিজের উত্তরাধিকার মানে।সবকাজে হামজার পরামর্শে চলে।আজও তাই নিয়ে এসেছে জোর করে।মিন্টু ও তার ভাইয়েরা একপাশে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে।জরিনেকে ধরে পারুল অন্ধকার ঝুপড়ির রান্নাঘরে দাঁড়ানো।
মিন্টুর মেঝো ভাইয়ের ইঙ্গিতে মাতুব্বর গলা ঝেড়ে বলে,
” গাঁয়ের সব লোক জানে মিন্টুর প্রথম বউ জরিনের স্বভাব ভালো না।গাঁয়ের মর্দাগো লগে রাত বিরাতে লটরপটর চলে তার।এমন বউ তালাক দিতে চাওয়াতে দোষের কিছু নাই।”মাতুব্বরের কথায় সবাই সম্মতি জানায়।চেয়ারম্যান গম্ভীরমুখে বসে আছে।হামজার দিকে তাকাতেই মাতুব্বর আবার গলা খেঁকিয়ে বলে,
” আমি বুঝাইতে আইছিলাম দেইখা আমার কানডা কাইটা দিছে। দেহেন!চেয়ারম্যান সাব।ওরে সুযোগ দিয়া কিছু হইবো না।”
চেয়ারম্যান আজমত আলি বিরক্ত হয়ে ধমকায় মাতুব্বরকে।
” চুপ থাকো তুমি।তুমি যে কি সে সবাই জানে।শাক দিয়ে মাছ ঢাকার চেষ্টা কইরো না।”চেয়ারম্যানের কথা শুনে হারান মুখ ছোট করে বসে থাকে।আজমত আলি ভাগ্নের মুখের দিকে তাকায় পরামর্শের জন্য। হামজা সোজা হয়ে বসে। গম্ভীরমুখে বলে।
“মিন্টুর কথায় তো সব সিদ্ধান্ত হবে না।জরিনের কথাও শুনতে হবে। দুপক্ষের কথা শুনেই সিদ্ধান্ত যা হবার হবে।পারুল জরিনেকে নিয়ে আসো সামনে।” পারুল জরিনেকে ধরে সামনে নিয়ে আসে।জরিনে ছলছল চোখে স্থির দৃষ্টি নিচে তাকিয়ে থাকে।ভয়ংকর ঝড়ের কবলে পড়লে মানুষের যেমন অবস্থা হয় জরিনেরও তেমন।
” তোমার কিছু বলার আছে জরিনে?”হামজার কোমল স্বরে বলা কথা শুনে জরিনে শব্দ করে কেঁদে ওঠে।ছুটে গিয়ে হামজার পায়ে হুমড়ে পড়ে।
” ও স্যার,আমার তো সব শেষ স্যার।যার জন্য ঘর দুয়ার,আত্মীয় স্বজন ছাড়লাম, শেয়াল কুকুরের থাবা থেইকা নিজেরে বাঁচাইয়া রাখলাম। আজ সেই মানুষটা আমারে ছাড়ার জন্য কলঙ্ক দিতাছে।আমারে ফাঁসি দিয়া দেন স্যার। আমি বাঁচতে চাই না।বাঁচতে চাই না।”হামজার চোখে জল চলে আসে।চোখের জল কোনোমতে আঁটকে পারুলকে ইশারায় উঠাতে বলে জরিনেকে।পারুল কান্নায় ভেঙে পড়া জরিনেকে কষ্টে শিষ্টে উঠিয়ে দাঁড় করায়।হামজা গলা পরিষ্কার করে বলে,
” আজ রাতটা আরেকবার ভেবে দেখো মিন্টু। কাল না হয় সিদ্ধান্ত নিও!”
” এতো ভাবাভাবির কি আছে মাস্টার সাব!দুই স্ত্রী নিয়ে ঘর করা আমার পক্ষে সম্ভব না।”
“সে’কথা তোমার আগে মাথায় আসে নাই।এই মেয়েটার এখন কি হবে?তুমি কি মানুষ!চারটা বছর বউ সন্তান রেখে নিরুদ্দেশ ছিলে।এদের জীবন কি করে কেটেছে চিন্তা করেছ একবার।তোমার মেয়েটা মরে গেল না খেয়ে চিকিৎসার অভাবে।তোমার বিবেক কি নাড়া দেয় না মিন্টু! ” মিন্টু থম মেরে যায়।মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকে।জরিনে আশা নিয়ে সেদিকে তাকিয়ে থাকে।ভাঙনের ঢেউ একবার যে পাড় ধরে সে পাড় ভেঙেই ছাড়ে।জরিনের আশার পাড়ও ভাঙল মিন্টুর জবাবে।
“স্যার এতো কথা আমি বুঝিনা।এই বউ আমি রাখুম না শেষ কথা।আর মাইয়্যা মাইয়্যা করতাছেন কেন? যে ছেরি বাপ মা ছাইড়া আমার হাত ধরে রাতে বিরাতে বাড়ি ছাড়ছে। সে যে আমার অবর্তমানে অন্য কারো হাত ধরে নাই তার কি ঠিক আছে? ঐ মাইয়্যা আমার না কার কে জানে?”
” মিন্টু! “হামজা চিৎকার করে ওঠে মিন্টুর উপর।জরিনের শরীর অসাড় হয়ে আসে।পারুল শক্ত করে ধরে রাখে জরিনেকে।জরিনে মনে মনে মৃত্যু কামনা করে।এই কথা শুনার আগে সে মরে গেলেই ভালো হতো।মেয়ের মরাতে আজ তার শান্তি লাগে।বাপের মুখে এমন কথা শোনার চেয়ে মরায় ভালো হয়েছে হাসির।
চেয়ারম্যান হামজাকে শান্ত করে বসায়।শালিসের সিদ্ধান্ত কাল সকালে হবে বলে সবাই চলে যায়।হামজা জরিনেকে নিজের বাড়ি নিতে চাইলে জরিনে যায় না।রান্না ঘরের ঝুপড়িতে বসে নিষ্পলক চেয়ে থাকে।রাত গভীর।চারপাশে ঝিঁ ঝিঁ পোকার ডাকে মুখরিত।জরিনে দাওয়ার খুঁটিতে হেলান দিয়ে বসে আছে।হঠাৎ কানে আসে মিন্টু আর তার নতুন বউয়ের ভালোবাসার গোঙানি। জরিনের কানে মনে হয় কেউ সীসা ঢেলে দিয়েছে।জ্বলে পুড়ে অঙ্গার হয়ে যাচ্ছে কানদুটো সে শব্দ শুনে।কান চেঁপে অন্ধকারে দিক হীন ছুটে চলে।নদীর ধারে এসে শাড়িতে বেঁধে মুখ থুবড়ে পড়ে।সমস্ত শরীরের ভার ছেড়ে দিয়ে বালুতে মুখ ডুবিয়ে কাঁদে জরিনে।মুখ তুলতেই চাঁদের আলো মুখের উপর পড়ে।জরিনে চিৎ হয়ে শুয়ে উদ্ভট ভাবে হাসতে হাসতে কাঁদে।চাঁদের দিকে মুখ করে খালি গলায় সুর তুলে গায়,,,
আমার ভাঙা ঘরে,
চাঁন্দের আলো জ্বলে।
সেই আলোর পরশে,
আন্ধার ডুইবা মরে।।
একলা ঘরে, একলা আমি,
সঙ্গে নাই মোর সঙ্গী সাথী।
দুয়ারে শকুন ডাকে,
পরাণ ধড়ফড় করে।
আমার ভাঙা ঘরে,
চাঁন্দের আলো জ্বলে,,,
জরিনে গলা টেনে কাঁদতে কাঁদতে নদীর জলে নেমে যায়।চাঁদের আলোয় নদীর স্বচ্ছ জল মুক্তোর মতো চিকচিক করে।জরিনে বিমুগ্ধ নয়নে চেয়ে গলা ডুবিয়ে দেয় সেই জলে।

চলবে,,,,