চিত্তবৃত্তি পর্ব-০৮

0
216

#চিত্তবৃত্তি : ৮
#জান্নাতুল_নাঈমা

সময় বহমান। আর মানুষ পরিবর্তনশীল৷ মানুষের জীবন, অনুভূতি সবকিছুরই পরিবর্তন ঘটে৷ তাই তো মুসকানের মাঝেও পরিবর্তন ঘটল৷ অদ্ভুত শান্তির পরিবর্তন। কিছু শান্ত, মিষ্টি আর শীতল অনুভূতির সঙ্গে বিচরণ ঘটল তার। পদে পদে অনুভব করতে লাগল ইমন নামক মনোমুগ্ধকর পুরুষটাকে। তার সঙ্গে কাটানো একেকটা মুহুর্তকে। ইদানীং তার বলা প্রতিটি কথাতেই যেন মোহগ্রস্ত হয়ে পড়ে মুসকান। যতক্ষণ মানুষটা তার সঙ্গে থাকে ততক্ষণ অন্য একটা জগতে চলে যায়। যেই জগৎটা সম্পূর্ণ ভিন্ন। একান্তই তার নিজস্ব জগৎ। যেখানের রাজা ইমন আর রানি সে নিজে। জগৎটা এত সুন্দর কেন? মনে প্রশ্ন আসামাত্রই যেন উত্তর পেয়ে যায়। এই জগতের রাজাই যে সুদর্শন। এই সৌন্দর্য শুধু বাহ্যিকে নয় অন্দরেও৷ আশ্রমের সামনে বাগানে হাঁটছে মুসকান। তার ইচ্ছে অনুযায়ী হরেক রকমের ফুলগাছ লাগানো হয়েছে এখানে৷ দুইপাশে সারি সারি হরেক রকমের ফুল গাছ মাঝখানের রাস্তা দিয়ে হাঁটছে সে। আর ভাবছে ইমনের কথা। নিজের ভাগ্যের কথা। সৃষ্টিকর্তা মানুষকে সবদিকেই শূন্য করে দুনিয়ায় পাঠায় না৷ তাই যদি হতো ইমন নামক পুরুষটা তার জীবনে আসত না। অনেক ভেবেছে সে। অনেকভাবে পরীক্ষাও করেছে। নাহ ঐ মানুষটা হারেনি। বরং পদে পদে প্রমাণ পেয়েছে তার হৃদয় গভীরে থাকা শক্ত অনুভূতিটুকুর। গেটের সামনে এসে থামল মুসকান। ভাবল, এরপর কী হবে? দাদুভাইও চায় তার আর ইমনের সংসার হোক। চায় না শুধুই ঐ বাড়ির লোকজন৷ সে কী করবে? উদারতা দেখিয়ে ইমনকে চূড়ান্ত প্রত্যাখ্যান করবে? নাকি নিজের জন্যও এবার ভাববে৷ স্বার্থপর হবে নিজের সুখের জন্য? বুক চিরে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো মুসকানের। একদিকে সদ্য তৈরি হওয়া অনুভূতি অপরদিকে চৌধুরী পরিবার। দোটানায় ভুগছে সে। ওদিকে ইমন অপেক্ষায় আছে চূড়ান্ত উত্তরটির। ঐ মানুষেরও তো একটা স্বপ্ন আছে। চাকরি করছে। এবার বিয়ে করে সংসারীও হবে৷ এটাই স্বাভাবিক। আর কতদিন অপেক্ষায় রাখবে? অনেক ভেবেচিন্তে মুসকান সিদ্ধান্ত নিল। আগামীকাল শুক্রবার। ইমন আসবে। আজও আসার কথা ছিল। জরুরি কাজে ব্যস্ত হয়ে আসতে পারেনি। ফোন করে জানিয়েছে তাকে। আজ নয় আগামীকাল আসবে৷ এজন্য অবশ্য কিছুটা বিষণ্ন লাগছিল মুসকানের। ইদানীং যেন মানুষটা তার অভ্যাসেও পরিণত হয়েছে। সপ্তাহে দু’টো দিন কয়েকঘন্টা করে সময় না কাটালে বুকটা বিষণ্নতায় ভরে ওঠে। ঐ মানুষটা যতক্ষণ কাছাকাছি পাশাপাশি থাকে অদ্ভুত প্রশান্তি লাগে মনে। দিনকে দিন অনুভূতি গাঢ় হচ্ছে। মানুষটার প্রতি দুর্বল হয়ে পড়ছে৷ আসক্তি বাড়ছে। এভাবে কতদিন চলবে? একটা সিদ্ধান্তে তো এবার আসতেই হবে। হঠাৎ করেই ফোন বেজে ওঠল। স্ক্রিনে ভেসে ওঠল ‘ ছোটোসাহেব ‘ আচমকাই মুখে হাসি ফুটল মুসকানের। এতদিন তার কাছে ফোন ছিল না। যেদিন থেকে ইমন ফোন নামক যন্ত্রটি তাকে উপহার দিয়েছে, সেদিন থেকে একে অপরের কাছাকাছি আসার পথটা আরো সুগম হয়েছে। এই যেমন যখন তখন ফোন করে জানান দেয়, শুনছ প্রেয়সী আমি তোমারই ভাবনাতে বিভোর। কাল্পনিক ভাবনায় ঈষৎ হেসে ফোন রিসিভ করল মুসকান। ওপাশ থেকে ইমন দরদ মেশানো গলায় বলল,

– ফ্রি আছো?

– হ্যাঁ ফ্রিই।

– কী করছিলে?

– হাঁটছিলাম। আপনি?

– আর বলো না একটা ঝামেলা হয়ে গেছে!

আঁতকে ওঠল মুসকান৷ জড়সড় হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল একপাশে। বাড়িতে কোনো সমস্যা হলো না তো? ফোন কেনার পর থেকে ইয়াশফা আপুর সাথে ফেসবুকে যোগাযোগ হয়। আপুই বলেছিল, মেজো কাকা বলাবলি করে,

– মেয়েটাকে বাড়ি থেকে বিদায় করে বিপদ বাড়ল দেখি। আরো কায়দা হলো দু’টির। মাঝে মধ্যেই পথেঘাটে ঘুরতে দেখা যায়। ইমনকে আটকে রাখা তো কঠিন। ছেলেটা কারো কথা শুনছে না। কাউকে পাত্তা দিচ্ছে না।

মেজো কাকার সেই কথা ভেবে চিন্তা হলো মুসকানের৷ কিন্তু ইমন সম্পূর্ণ অন্য কথা বলল,

– কালকে রেডি থেকো এক জায়গায় যেতে হবে।

ক্ষীণ স্বরে প্রশ্ন করল মুসকান,

– কোথায়? আর কী ঝামেলা হয়েছে!

– সব বলব। সকাল সকাল রেডি হয়ে থাকবে কেমন? এখন রাখছি।
.
.
পরেরদিন সকাল সকাল ইমন এলো। মুসকান তৈরি হয়েই ছিল। তাকে নিয়েই বেরিয়ে পড়ল। বাসস্ট্যান্ড যেতেই দেখল একটি যুবতী মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে৷ দেখতে বেশ সুন্দরী বয়স ঠিক আঁচ করতে পারলো না। সেই মেয়েটির সামনে গিয়েই থামল ইমন। মৃদু হেসে পরিচয় করিয়ে দিল,

– সায়রী এই হলো মুসকান। আর মুসকান ও সায়রী। আমার ক্লোজ ফ্রেন্ড। আমরা একসঙ্গেই পড়াশোনা করেছি।

হতভম্ব হয়ে গেল মুসকান। ফ্যালফ্যাল চোখে তাকিয়ে রইল সায়রীর পানে৷ অধর কামড়ে গভীর চিন্তায় ডুবে গেল সে। ছোটোসাহেবের আবার বান্ধবীও আছে? তাও এমন সুন্দরী! পরোক্ষণেই ভাবল, থাকতেই পারে। বর্তমানে এ আর অস্বাভাবিক কী? তার কোনো ছেলে বন্ধু নেই। তার কোনো ছেলের সঙ্গে পরিচয় নেই বলে অন্যরাও তার মতো হবে এমন তো কথা নেই। হাঁপ নিঃশ্বাস ছেড়ে সায়রীকে সালাম দিল সে। সায়রী সালাম ফিরিয়ে বলল,

– কেমন আছ মুসকান? তোমার কথা অনেক শুনেছি আমি।

মুসকান জবাব দিল। সায়রী তার কাঁধ জড়িয়ে ধরে ইমনকে বলল,

– বেশ মিষ্টি দেখতে। তোর চয়েজ বলতেই হয় মাশাআল্লাহ মাশাআল্লাহ। দারুণ মানিয়েছে তোদের।

সায়রীর কথায় বাঁকা হাসলো ইমন। প্রফুল্ল চিত্তে তাকিয়ে কিঞ্চিৎ মাথা দুলালো। বলল,

– চল সিএনজি নিতে হবে।

সায়রী মুসকানের হাত চেপে ধরে এগুতে শুরু করল। পয়তাল্লিশ মিনিট পর ওরা টাঙ্গাইল শহরে চলে এলো। মুসকান দুরুদুরু বুকে সায়রীর হাত শক্ত করে ধরে এগিয়ে চলল ইমনের পিছু পিছু। ইমন ওদের নিয়ে চলে গেল তার নিজস্ব ফ্ল্যাটে। যেটা তার মা ইরাবতীর টাকায় কেনা৷ সরকারি ঊর্ধ্বতম কর্মকর্তা ছিল ইরাবতী চৌধুরী। অকালে মৃত্যুবরণ করায় পেনশনের টাকা আর জীবিত থাকা অবস্থায় যা সঞ্চয় করেছিলেন তাই দিয়ে মোজাম্মেল চৌধুরী এই ফ্ল্যাটটা ইমনের নামেই কেনেন৷ গতমাসে ভাড়াটিয়া চলে যাওয়াতে আপাতত ফ্ল্যাটটি ফাঁকাই। আসবাব পত্র নেই বললেই চলে। একটি বেডরুমে শুধু একটি সিঙ্গেল বেড। এছাড়া তিনটে বেতের চেয়ার টেবিল ছাড়া আর কিছুই নেই। মুসকান জানতে পারল, আজ সায়রী আর দিহান বিয়ে করবে। সেই বিয়ের শাক্ষি হিসেবেই তাকে আনা হয়েছে। এছাড়া আরো কয়েকজন ফ্রেন্ডও আসবে। কথায় কথায় জানা গেল, বিয়ে নিয়ে বাসায় বেশ চাপ যাচ্ছে সায়রীর। বয়স তো কম হলো না৷ সামনে মাসে সাতাশ হবে। অথচ দিহানের সঙ্গে তার ন’বছরের প্রেম। অপদার্থটা এখন পর্যন্ত একটা চাকরি জুটাতে পারল না৷ অথচ সে প্রাইমারি স্কুলের হেড মিস্ট্রেস। একটা বেকার ছেলেকে তার পরিবার জামাই হিসেবে মানবে না। বাবা মেয়ের প্রতি বিরক্ত হয়ে বলেছে,

– হয় আমার পছন্দের পাত্রকে বিয়ে করো নয়তো বাড়ি থেকে বেরিয়ে গিয়ে ঐ ছেলেকে বিয়ে করো। তবুও লোককে বলতে পারব ঐ অপদার্থের সঙ্গে বিয়ে আমি মানিনি। মেয়ে স্বেচ্ছায়ই করেছে।

বাবার দর্পযুক্ত এই কথাগুলো আর সহ্য হচ্ছিল না সায়রীর। এতবছরের সম্পর্ক ত্যাগ করাও তার পক্ষে সম্ভব না। দিহানের স্থানে অন্য পুরুষ অসম্ভব। ভাবতেই পারে না সে। উনিশ বছর বয়স থেকে যাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখছে তাকে ছাড়া অন্য মানুষের বউ হবে? বয়স হয়েছে বলে কী আবেগ চলে গেছে নাকি? হোক সে চাকুরিজিবী মেয়ে৷ হোক দিহান বেকার। তাতে কী? ভালোবাসা, অনুভূতি কী সেই হিসেব করে চলে? কক্ষণো না। অবশেষে দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে বেরিয়েই পড়ল সে৷ লোকে মন্দ বলবে বলুক৷ এমনিতেও কম বলে না। সাতাশ বছর বয়সী চাকরিজিবী মেয়েও সমাজে কাঙ্ক্ষিত সম্মান পায় না। শুধুমাত্র সে অবিবাহিত বলে। তাই সমাজকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে, পরিবারকে তোয়াক্কা না করে বেকার ছেলেটাকে বিয়ে করতে চলে এসেছে।

মুসকান খুব ইতস্তত করছিল। এভাবে বিয়েটা যেন তার ভেতরে অস্বস্তি বাড়াচ্ছিল খুব। কাজির অপেক্ষা করছিল সবাই। ইমন দিহান, সায়রীকে রুমে আলাদা ভাবে কথা বলতে পাঠাল। মুসকানকে নিয়ে গেল পাশের রুমের বেলকনিতে। নিরিবিলিতে দাঁড়িয়ে শেয়ার করল সমস্তটা৷ সব শুনে মুসকানের মন কিঞ্চিৎ শান্ত হলো। ইমন আবারো তাকে বুঝিয়ে দিল, মানুষের হৃদয়ের প্রেম কতটা গভীর হতে পারে। ভালোবাসা কী, ভালোবাসার মানুষ কতটা গুরুত্বপূর্ণ। সবটা অনুভব করাতে চেষ্টা করল। ইমনের ওসব কথায় অদ্ভুত এক ঘোরে চলে গেল মেয়েটা৷ বুকের গভীরে শুরু হলো ধুকপুক ধুকপুক। ইমন তার দিকেই নির্নিমেষে তাকিয়ে। ঐ প্রগাঢ় চাহনিতে সহসা চোখ আঁটকে গেল মুসকানেরও। শরীর জুড়ে বয়ে গেল শিরশিরে অনুভূতি। হাত, পায়ে শুরু হলো মৃদু কম্পন। ইমন খেয়াল করল মুসকানের পাতলা মসৃণ ঠোঁটজোড়াও কেঁপে কেঁপে ওঠছে। যেন সে কিছু বলতে চাইছে কিন্তু বলতে পারছে না। সহসা ইমন হাত বাড়াল। ওর ঠোঁটদ্বয়ে স্পর্শ করল তর্জনী দ্বারা। বক্ষঃস্থল ধড়াস ধড়াস করে ওঠল মুসকানের। হঠাৎ তার এমন এলোমেলো লাগছে কেন? নিঃশ্বাস গুলো এমন অস্বাভাবিক বেগে ছুটছে কেন? কী হলো তার! ইমনের স্পর্শ বাঁচিয়ে এক কদম পিছিয়ে গেল সে। ইমন মৃদু হেসে বলল,

– সব অনুভূতি বলতে হয় না৷ কিছু অনুভূতি বুঝে নিতেও হয়।
নীরস গলায় ঢোক গিলল মুসকান। কী অদ্ভুত মানুষটা। উনি কি মানুষ পড়তে জানে? শিক্ষকরা কি অন্তর্যামী হয়? ইমন পেশায় শিক্ষক বলেই কি এভাবে বলতে পারছে? নাকি তার প্রতি মানুষটার অনুভূতির প্রগাঢ়তা এতই বেশি যে মুখ ফুটে না বললেও বুঝে নেয় সবটা। সর্বনাশ! আঁতকে ওঠল মুসকান৷ কিঞ্চিৎ ভীত চোখে তাকাল সে। ইমন ইশারায় জিজ্ঞেস করল,

– কী?

সে মাথা নাড়িয়ে ঘুরে দাঁড়াল। শ্বাস নিল ঘনঘন। ইমন দু-হাত পকেটে গুঁজে টান টান হয়ে দাঁড়াল। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,

– কী ভাবলে?

সহসা ঘুরে দাঁড়াল মুসকান। আকুল দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,

– কেউ মানবে না। তাই ভাবতে সাহস পাচ্ছি না।

– মিথ্যা।

হকচকিয়ে গেল মুসকান। ইমন স্বভাবসুলভ হেসে বলল,

– তুমি অলরেডি ভাবছ।

– কিন্তু…

থামিয়ে দিয়ে ইমন বলল,

– মুসকান… আমি মানুষটা খুব সহজ। কিন্তু পরিস্থিতি ভেদে বড্ড কঠিনও।

দু’কদম এগিয়ে এলো ইমন। মুসকান হকচকিয়ে গেল। ইমনের দৃঢ় দৃষ্টি, দৃঢ় চোয়ালদ্বয় এ মুহুর্তে অপরিচিত লাগল খুব। ঠিক কঠিন কোনো বইয়ের লেখার মতো। যা বুঝতে হিমশিম খেতে হয়। ইমন একই ভাবে বলল,

– আমি চাই না তুমি কখনো কারো সঙ্গে আপোস করো। এই যে আমি তোমাকে চাইছি এর মানে এই না তোমারো আমাকে চাইতে হবে। যদি তোমার মন না চায়, আমি যদি তোমার চিত্তে আমার প্রতি আকাঙ্ক্ষা সৃষ্টি করতে না পারি তাহলে দরকার নেই তোমাকে আমার। যেমন সুসম্পর্ক, বন্ধুত্বের সম্পর্ক চলছে সেটাই চলবে। আর যদি আমার প্রতি তোমার অনুভূতি জন্মে থাকে তাহলে আমার পরিবারকেও তোয়াক্কা করার প্রয়োজন নেই। আমার পরিবার চাইবে বলে তুমি আমার হবে, আমার পরিবার চাইবে না বলে তুমি আমার হবে না৷ এই নিয়ম আমি মেনে নিব না৷ তুমি আমার পরিবারকে বিয়ে করবে না করবে আমাকে। সো গুরুত্বটা ঠিক আমাকেই দেবে অন্য কাউকে নয়।

মুসকানের চোখ দুটো চিকচিক করছে। ইমন ঐ অশ্রুসিক্ত চোখে চোখ রাখতে পারলো না৷ বুকের ভেতর চিনচিন করে ওঠল। তাই দৃষ্টি ফিরিয়ে নিয়ে বলল,

– তোমার চোখে আমি আমার জন্য যা দেখছি তা ট্রু। মুখ ফুটে বলার প্রয়োজন নেই।

– আপনার বাবা মানবে না ছোটোসাহেব।

কাঁপা কণ্ঠ মুসকানের। সহসা ইমন মুখোমুখি হলো তার৷ হাত বাড়িয়ে স্পর্শ করল কাঁধজোড়া। কিছুটা কঠিনভাবেই। এরপর দৃঢ়চিত্তে চোখে চোখ রেখে বলল,

– আই ডোন্ট কেয়ার। আমার কেবল তোমাকে চাই। সবচেয়ে বড়ো কথা সম্পর্কটা গড়ব তুমি আর আমি। সারাজীবন একসাথে থাকব তুমি আর আমি। লিসেন, তুমি আমাকে চাও? ভালোবাসা তৈরি হয়েছে আমার প্রতি? তাহলে কেন তুমি অন্যদের কথা ভাবছ?

কাঁধ বাকি কথাগুলো বলল ইমন৷ মুসকানের চোখ গলে অশ্রু গড়িয়ে পড়ল। ইমন অধৈর্য হলো সে অশ্রু দেখে। বলল,

– আমার যা বোঝার, যা জানার হয়ে গেছে মুসকান। এরপর আমাকে আর কেউ আটকাতে পারবে না। তুমি নিজেও না। আমি জাস্ট অপেক্ষায় ছিলাম এটুকুর জন্য। হ্যাঁ এটুকুর জন্যই।

মুসকান অবাক চোখে তাকাল। দৃষ্টি প্রশ্ন স্পষ্ট। ইমন উত্তরটা দেয়ার পূর্বে অনুমতি চাইল,

– তোমার কেমন লাগবে জানি না। কিন্তু আমি একটাবার তোমাকে জড়িয়ে ধরব জাস্ট একবার।

কথাটা বলেই জড়িয়ে ধরল ইমন। থরথর করে দেহ কাঁপতে লাগল মুসকানের। নিঃশ্বাস আঁটকে এলো। লজ্জায় গুটিয়ে গেল অদ্ভুতভাবে। ইমন সন্তর্পণে বুকের সঙ্গে মিশিয়ে চোখ বুজে কাটিয়ে দিল কয়েক পল। এরপর আচমকা সরে দাঁড়াল। বলল,

– খারাপ লাগছে? ঘৃণা হচ্ছে? এই স্পর্শে গা ঘিনঘিন করেছে?

মুসকান কম্পিত দেহে চোখ বুজে ঠায় দাঁড়িয়ে। ইমন খেয়াল করল তার গাল বেয়ে অশ্রু গড়াচ্ছে। ঠোঁট কামড়ে বিচলিত ভঙ্গিতে সে পুনরায় জিজ্ঞেস করল,

– ঘৃণা হচ্ছে মুসকান?

মুসকান উত্তর করল না। তার পুরো পৃথিবী উলোটপালোট লাগতে শুরু হয়েছে অদ্ভুত শিরশিরানিতে দেহ জুড়ে অনুভূত হচ্ছে। কীসের ঘৃণা? কীসের খারাপ লাগা? সে তো আবেশে মাতোয়ারা। ইমন উত্তর না পেয়ে মৃদু ধমক দিল,

– মুসকান আমি কিছু জিজ্ঞেস করছি। বলো ঘৃণা হচ্ছে?

চমকে ওঠল মুসকান। মাথা নেড়ে বোঝাল,

– না।

– গা ঘিনঘন করছে?

এবারেও না করল মুসকান। সহসা চোখমুখ উজ্জীবিত হলো ইমনের। পুরো পৃথিবী জয় করে নেয়ার মতো তৃপ্ততা পেল সে। উত্তেজনায় হাসফাস করে বলল,

– অথচ সেইদিন ইভানের স্পর্শে তুমি লজ্জায়, ঘৃণায় কষিয়ে থাপ্পড় বসিয়েছিলে। সারা বাড়ির লোককে চিৎকার করে ওর মুখোশ খুলে দিয়েছিলে।

মুসকান আচমকা বলল,

– সেই স্পর্শে অশালীনতা ছিল। কিন্তু আপনার স্পর্শে আমি অশালীনতা খুঁজে পাইনি।

কথাটা বলে থতমত খেল সে। ইমন তাকিয়ে রইল ওর মুখপানে৷ ভ্রু নাড়িয়ে শুধাল,

– কী পেয়েছ তাহলে?

লজ্জায় সিঁটিয়ে গেল মেয়েটা৷ পিছু ঘরে চলে যেতে উদ্যত হলো। ইমন ত্বরিত ওর হাত আঁটকে ধরল। বলল,

– উত্তরটা দিয়ে যাও।

– আমি বলতে পারব না।

ইমন কিঞ্চিৎ হাসলো। অবাক কণ্ঠে বলল,

– এতকিছু হয়ে গেল মুসকান! আমার ভালোবাসা আর এক তরফা নয়। আজ তাহলে এই পৃথিবীর সর্বোচ্চ সুখী মানুষ আমি। ওদের বিয়েটা হয়ে যাক। শিঘ্রই বাবার কাছে যাব। সরাসরি গিয়ে আমার সিদ্ধান্ত জানাব। ছেলে হিসেবে কর্তব্য টুকু করব। বাকিটা তার ইচ্ছে।

– উনি না মানলে প্লিজ আপনি পাগলামি করবেন না। আমার জন্য পরিবারের সঙ্গে বিরোধিতা করবেন না।

এমন মুহূর্তে এমন একটি কথা শান্ত স্বভাবের ইমনকে যেন উত্তপ্ত করে তুলল। শান্ত মানুষের রাগ বাঘকেও হার মানায়। কথাটা ইমনের ক্ষেত্রে একবিন্দুও ভুল নয়। তাই তো প্রচণ্ড ক্রুদ্ধ হলো সে। হেচকা টানে মুসকানকে করে নিল নিজের মুখোমুখি। অগ্নি চাহনি নিক্ষেপ করে বলল,

– আমি আবারো বলছি নিজের ইচ্ছে, স্বপ্নটাকে কারো সঙ্গে আপোস করবে না। তুমি আমার মুসকান। যেই সত্যি আজ আমি অনুভব করেছি সেই সত্যিটা এ জন্মে তো অস্বীকার করবই না৷ পরপারেও যেন অটল থাকে যতদ্রুত সম্ভব সেই ব্যবস্থা করব।

মুসকানের বুকের ধুকপুকানি বেড়ে গেল। নিঃশ্বাস হলো ঘন৷ ইমন টের পেল সেই অনুভূতি। যা আরো গভীর আরো গাঢ় করতে আলগোছে ওর ললাটে গভীর চুম্বন এঁটে দিল। হৃদয়ে এঁটে দিল একচ্ছত্র অধিকার,

– বউ হবে আমার শিঘ্রই।

যা মুসকানের শিরায় শিরায় তীব্র আন্দোলন শুরু করল। চুপিচুপি যেন বলে গেল, ‘ তুমি ইমন চৌধুরীর বউ হবে শিঘ্রই ‘ আকাশে, বাতাসে যেন ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ল, ‘ শোনো মেয়ে তুমি কিন্তু ছোটোসাহেবের বউ হবে। ‘ টিপ্পনী কেটে এও বলল, ‘ ছোটোসাহেবের ‘
তীব্র লজ্জায়, আবেশে লাল হলো মেয়েটির গাল। শরীর জুড়ে বয়ে গেল মৃদুমৃদু কম্পন। ইস ভালোবাসার অনুভূতি গুলো এমন কেন? মাতোয়ারা কে করল তাকে? ভালোবাসা না ইমন? তক্ষুনি যেন উত্তর মিলল, ভালোবাসাই তো ইমন চৌধুরী। ইমন চৌধুরীই তো ভালোবাসা।

চলবে….