চিত্ত চিরে চৈত্রমাস পর্ব-২২+২৩

0
244

#চিত্ত_চিরে_চৈত্রমাস
#মম_সাহা

পর্বঃ বাইশ

মায়ের বুকের মাঝে যত্নে লেপ্টে থাকা চিত্রার লতার মতন দেহখানি, চোখো অশ্রুদের সমাহার, কণ্ঠে অভিযোগের তুমুল মি* ছিল। মুনিয়া বেগম হাসলেন, মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,
“কে বলেছিস শুনতে পাই নি, আবার বল।”

“ওরা আমায় ভালোবাসে নি, আম্মু। তোমার মতন কেউ ভালোবাসতে পারে না।”

“ভালোবাসবে কী করে? সবাই তো আর মা না।”

চিত্রা মায়ের বুক থেকে মুখ তুলে মায়ের দিকে তাকালো। যেন কত সহস্র বছর পর দেখতে পেলো মায়ের মুখখানা! কি ভীষণ মিষ্টি!

বাহার তখনও পকেটে হাত গুঁজে দাঁড়িয়ে আছে, মুখে লেপ্টানো মিষ্টি হাসি। চিত্রা মায়ের দিকে তাকিয়ে আদুরে স্বরে বললো,
“তুমি কেনো গেলে আম্মু? তুমি যাওয়ার সাথে সাথে সুখ গুলোও তো আমায় ছেড়েছে।”

“কিছু কিছু ক্ষেত্রে মানুষ হারানো উত্তম, মানুষ হারালে বাস্তবতা বুঝা যায়। তাই গিয়েছিলাম। তোমার বাহার ভাইকে তো রেখে গিয়েছিলাম, যেন তোমায় আগলে রাখে তুহিন ভাইজানসহ। কিন্তু ভাবি নি তোমার বাস্তবতা এতটা নিষ্ঠুর।”

“বাহার ভাই জানতো তুমি কোথায়!”

চিত্রার চোখে-মুখে তুমুল বিষ্ময়। মুনিয়া বেগম মাথা নাড়ালেন। কোমল কণ্ঠে বললেন,
“হ্যাঁ, জানতো। আমি প্রশিক্ষণের জন্য চট্টগ্রাম গিয়েছিলাম, কাউকে বলে যাই নি কেবল তোমার মাথার ভূ* ত ছাড়ানোর জন্য। কে জানতো, সুখও তোমায় ছেড়ে যাবে!”

শেষের কথাটায় দীর্ঘশ্বাসের ছোঁয়া। চিত্রা বাহার ভাইয়ের দিকে তাকালো। অভিমানীনির অক্ষি দ্বয়ের ভাষা যেন বুঝলো বাহার ভাই, তাই তো দু’কম এগিয়ে এলো, চিত্রার সামনা-সামনি দাঁড়িয়ে ছোট্টো কণ্ঠে বললো,
“আন্টিকে বুদ্ধিটা দেওয়ার জন্য আমি কোনোরকমের গিল্টি ফিল করছি না। তোমার বিয়ের সাধ ছাড়ানোর জন্য ই বুদ্ধি।”

চিত্রা মুখ ভেংচি দিলো। বাহার হাসতে হাসতে ফিসফিস করে বললো,
“চিন্তা কিসের মেয়ে? মনে রেখো, আমি তোমায় আলো দেবো, সূর্য ডোবার পরেও।”

চিত্রা তৃপ্তির শ্বাস ফেললো। বাহার তাদের রিক্সায় উঠিয়ে পাঠিয়ে দিলো গন্তব্যে। রিক্সার বিপরীতে হাঁটা ধরলো সেও, গুনগুনিয়ে গেয়ে উঠলো,
“ভুলভাল ভালবাসি,
কান্নায় কাছে আসি
ঘৃণা হয়ে চলে যাই থাকি না
কথা বলি একা একা,
সেধে এসে খেয়ে ছ্যাঁকা
কেনো গাল দাও আবার বুঝি না।”

(৫৭)

আফজাল সওদাগর যখন বাড়ি ফিরলেন, বাড়ির এমন বিধ্বস্ত অবস্থা দেখে সে প্রায় হতভম্ব। ছোটোবেলা থেকেই পরিবারকে আগলে রাখার এক অদম্য শখ তার মনে ছিলো। ভাই-বোনদের সে খুব ভালোবাসতেন তাই তাদের আগলিয়ে রাখার নিখুঁত এক চেষ্টা চলতো তার ভেতর। আর তার চেষ্টাকে সবসময় সাহায্য আর সম্মান করেছে তার অর্ধাঙ্গিনী। একমাত্র এ পরিবারটাকে এক রাখার জন্য কত কিছু সে মনের মাঝে দাফন করেছেন, আর আজ সেই রোজা সওদাগর কিনা কারো ভেঙে যাওয়ার কারণ!

ফ্যাকাশে মুখ নিয়ে আফজাল সওদাগর বসে আছেন তার রুমের আরাম কেদারায়। চোখেমুখে তার ভেসে উঠেছে কালো অতীতের কিছু স্মৃতি। জীবনে উপরে উঠার জন্য, নিজের স্বার্থের জন্য কম পাপ করেন নি। ক্ষমতার কারণে সে ধামাচাপা দিয়েছে কত পাপ! বাহিরের দুনিয়ার সাথে সে যতটা শক্ত, পরিবারের জন্য ঠিক ততটাই কোমল। কিন্তু আজ! কি হলো অবশেষে? পাপ তো বাপকেও ছাড়ে না।

আফজাল সওদাগরের সামনে ঠান্ডা লেবুর শরবত নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন রোজা সওদাগর। মুখে তার কথা নেই। গম্ভীরতা পুরো মুখ জুড়ে।

আফজাল সওদাগর লেবুর শরবত টা নিলেন না, বরং অদ্ভুত কণ্ঠে বললেন,
“আমার যুবক বয়সের পাপের শাস্তি কি তুমি, এখন দিচ্ছো?”

স্বামীর গম্ভীর কণ্ঠে কাঁপলেন রোজা সওদাগর। কিন্তু কথা বললেন না। ঠাঁই দাঁড়িয়ে রইলেন চুপচাপ।

আফজাল সওদাগর অনেক বছর পুরোনো প্রতিজ্ঞার কথা ভুলে গেলেন এক নিমিষেই। স্ত্রীর হাতের শরবতের গ্লাসটা ছুঁড়ে ফেললেন মেঝেতে। ঝনঝন শব্দে ভেঙে টুকরো টুকরো হলো গ্লাসটা। সাথে ভীত হলো রোজা সওদাগরও। মিনিট ব্যবধানে সশব্দে চ* ড় পড়লো তার গালে। সে তাজ্জব,হতভম্ব হয়ে ফ্যালফ্যাল তাকিয়ে রইলো স্বামীর পানে। আজ থেকে তেইশ-চব্বিশ বছর আগে দেওয়া কথাটা ভেঙে ফেলেছে তার স্বামী, তা যেন সে মানতে পারলো না।

আফজাল সওদাগরের তখন চোখ দিয়ে ঝরছে অগ্নি। সেই আগুনে সে যেন জ্বালিয়ে দিবে তার অর্ধাঙ্গিনীকে। কণ্ঠে তার তুমুল ক্ষোভ, চিৎকার দিয়ে বলে উঠলেন,
“তোমার সাহস হলে কীভাবে, আমার অবর্তমানে আমার পরিবারটাকে এক ছিন্ন বিছিন্ন করার? ফকিন্নির বাচ্চা।”

রোজা সওদাগর নিরুত্তর। অনেক দিন পর স্বামীর পুরোনো রূপ দেখে প্রায় সে নিশ্চুপ হয়ে গেছে। মানতে কষ্ট হচ্ছে তার যে এটাই তার স্বামী। আফজাল সওদাগরের মুখের ভাষা বিশ্রী থেকে বিশ্রী হলো। ক্রোধ ঝরে পড়লো সারা শরীর উপচে। টিকতে না পেরে রোজা সওদাগরের চুলের মুঠি টেনে ধরলেন। বা’গালে আরও একটা চ* ড় বসিয়ে বললেন,
“ফকিন্নির মেয়ে হুট করে রাজার আসনে বসলে তো এমনই হবে। তুই আবার আমার ভাইয়ের মেয়ের গায়ে হাত তুলিস। তোর সাহস দেখে আমি অবাক।”

“আপনার সাহস দেখেও আমি অবাক। ভুলে যাচ্ছেন, আমার কাছে আপনার ইজ্জত আমানত আছে? এমন কিছু করবেন না যে আমার সবটা মেলে দিতে হয় সবার সামনে।”

রোজা সওদাগর যে খুব নিবিড় একটা হুমকি দিলো তা বুঝতে বাকি রইলো না আফজাল সওদাগরের। তার রাগ তখন সীমা পেরিয়ে গেলো। অনবরত আঘাত করতে থাকলো তার স্ত্রীকে।

তাদের ঘরের এমন হৈচৈ শুনে অবনী বেগম, অহি, চাঁদনী সহ সবাই ছুটে আসে। এমন বিরল ঘটনা ঘটতে দেখে তারা রীতিমতো অবাকে হা হয়ে রইলো। লতা বেগম আর অবনী বেগম এসে হাত ছুটানোর চেষ্টা করলো কিন্তু আফজাল সওদাগরের পুরুষ শক্তির কাছে তাদের জোড়াজুড়িটা খুবই স্বল্প। চাঁদনীর শরীর তখনও দুর্বল, কণ্ঠে অসুস্থতার ছোঁয়া, তবুও সে এই ক্ষীণ কণ্ঠে বললো,
“আব্বু, কি করছো? আম্মুকে ছাড়ো।”

মেয়ের দুর্বল কণ্ঠ কর্ণদ্বয়ে পৌঁছাতেই হাতের চাপ ঢিলে করে দিলো আফজাল সওদাগর। ছেড়ে দিলেন অর্ধাঙ্গিনীকে। মেয়ের দিকে তাকিয়ে সে স্তব্ধ হয়ে যায়। তাকে নিয়ে সবার মনে যে সম্মানের জায়গা ছিলো, আজ সে জায়গাটা কেমন যেন হালকা হয়ে গেলো। রোজা সওদাগরও তেমন প্রতিক্রিয়া দেখালেন না। সেও চায় নি তার স্বামীর সম্মান কিঞ্চিৎ কমুক। তাই তো ঘটনা ধামাচাপা দিতে ক্ষীণ স্বরে বললো,
“সবাই বের হও, উনি মাত্র এসেছেন তো তাই মাথা গরম। তোমরা যাও এখন।”

সাথে সাথে সবাই বেরও হয়ে গেলো বিনা প্রতিবাদে। অহি চাঁদনীকে ধরে নিয়ে গেলো। আফজাল সওদাগরও আবার বসে পড়লেন আরামকেদারা খানায়। সে তার জীবনে ভাই, ভাইদের ছেলে-মেয়ে,বোন, বোনের ছেলেকে অনেক বেশিই ভালোবেসেছে। আর চিত্রাকে বোধহয় একটু বেশিই ভালোবেসেছে কারণ সে চিত্রার মাঝে তার অতীতের খুব গোপনের মায়া-মায়া, আদুরে সেই কন্যার প্রতিচ্ছবি খুঁজে পায়। যার প্রতি দায়িত্বহীন হয়েছিল বিধায় তার অগোচরে সে কন্যা ঢলে পড়েছিল মৃত্যুর মুখে। সে নিজেকে ক্ষমা করতে পারে নি। না প্রায়শ্চিত্ত করতে পেরেছে সে পাপের, তন্মধ্যেই রোজা সওদাগরের এহেন আচরণ তাকে আরও ভেঙে দিয়েছে, তাই তো সে হারিয়ে ফেললো নিজের এতদিনের ব্যাক্তিত্ব কিংবা বলা যায় খোলশ।

(৫৮)

তপ্ত দুপুরে ঘামে ভিজে একাকার অহির শরীরখানা। কি মারাত্মক রোদ উঠেছে পহেলা অক্টোবরের আকাশে!বিরক্তের আকাশে হুট করে মুগ্ধতা নিয়ে হাজির হলো নওশাদ। সাদা শার্ট, গলায় টাই, কালো প্যান্টে মারাত্মক সুন্দর লাগছে লোকটাকে। অহি যখন নওশাদের এমন রূপ দেখলো, সে বেশ অবাক হয়েই তাকিয়ে রইলো নওশাদের পানে।

অহিকে দেখেই হাসি খুশি নওশাদ হেলেদুলে চলে এলো অহির পাশে। মিষ্টি একটা হাসি উপহার দিয়ে বললো,
“কি হে মিস, আজ রোদ বোধহয় আপনাকে বেশিই উত্যক্ত করেছে!”

অহি ওড়না দিয়ে কপালের ঘাম টুকু মুছলো, বিরক্তের স্বরে বললো,
“হ্যাঁ বেশিই উত্যক্ত করেছে, আর এখন আপনি নিশ্চিত তার চেয়েও বেশি করবেন।”

নওশাদ হেসে দিলেন। মাথার পেছনে চুল গুলোতে হাত বুলিয়ে বললেন,
“তা আপনি মিছে বলেন নি। হুট করে আপনার কথা মনে হলো, তাই চলে এলাম উত্যক্ত করতে।”

“আপনি নাকি কাজ করেন? তা সারাদিন মেয়েদের পিছনে ঘোরা ছাড়া তো কোনো কাজ আপনার নেই দেখছি।”

“মেয়ের পিছনে ঘুরি ঠিক তবে মেয়েদের পিছে না। আর এখন লাঞ্চ ব্রেক চলছে মিস।”

নিজের ঝাঁঝালো কথার বিপরীতে নওশাদের হাসি খুশি উত্তরে কিঞ্চিৎ খারাপ লাগলো অহির। তাই সে আর কিছু না বলেই হাঁটা ধরলো। নওশাদও সাথে সাথে হাঁটতে হাঁটতে বললো,
“আপনার জন্য একটা জিনিস এনেছি মিস।”

অহি ভ্রু কুঁচকালো। চোখ মুখ কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো,
“কি জিনিস?”

নওশাদ তার পকেট থেকে তৎক্ষনাৎ কালো গোলাপ টা অহির সামনে ধরলো। চোখের মাঝে আনন্দের চিলিক খেলিয়ে বললো,
“কালো গোলাপ, ভালোবাসার বিষাদময় প্রতীক। পছন্দ তো আপনার?”

অহি মিনিট দুই ফুলটার দিকে তাকিয়ে রইলো। হুট করে তুমুল মাথা ব্যাথায় তার চোখ বন্ধ হয়ে আসার উপক্রম। কেমন যেন শিরা-উপশিরায় আ* ন্দোলন চালালো রাগ। নওশাদের হাত থেকে ছিনিয়ে নিলো গোলাপটা এবং ভীষণ নিষ্ঠুরভাবে কয়েক টুকরো করে ছুঁড়ে মারলো তা দূরে। নওশাদ কেবল ফ্যালফ্যাল করে দেখলো সবটা। সে যেন কোনো ভাষা খুঁজে পেলো না। অহির কাছে এমন একটা আচরণ সে ঠিক আশা করে নি বলা যায়।

অহি তুমুল রাগে হেঁটে চলে গেলো কয়েক পা। নওশাদ তখনো ঠাঁই দাঁড়িয়ে। এই গোলাপটা কেনার জন্য সে অফিস ছুটি নিয়েছে, ফুলের দোকানের কর্মচারীটার সাথে কথা কাটাকাটি করেছে, অথচ যার জন্য এটা কেনা হলো, সে কি করলো!

অহি কয়েক পা এগিয়ে আবার থেমে গেলো। ফিরে তাকালো নওশাদের থমথমে মুখটার দিকে। খারাপ লাগায় ছেয়ে গেলো তার মনের আঙিনা। সে আবার পিছু ফিরলো, পিছুটান টেনে নিয়ে গেলো তাকে নওশাদ অব্দি। অহি ক্ষীণ স্বরে মাথা নত করে বললো,
“মন খারাপ করবেন না। আমি আসলে ফুল পছন্দ করি না। ফুল দেখলেই ছিঁড়ে ফেলতে ইচ্ছে হয়। বলা যায় এটা আমার একটা মানসিক রোগ যা কেউ জানেনা। খুব ছোটোবেলার বিদঘুটে ঘটনার প্রভাবে আমার এই মানসিক রোগ, যা মাঝে মাঝে মানুষ খু* ন করার ইচ্ছে জাগাতেও সাহায্য করে।”

#চলবে

#চিত্ত_চিরে_চৈত্রমাস
#মম_সাহা

পর্বঃ তেইশ

(৫৯)

নিবিড়, নিশ্চুপ স্বচ্ছ জলে পরিপূর্ণ ছোট্টো একটা পুকুরের পাশের বেঞ্চিতে বসে আছে অহি এবং নওশাদ। রোদ ঝিমিয়ে বিকেল প্রায়। প্রকৃতিও বেশ চুপচাপ। নওশাদ তাকিয়ে আছে অহির দিকে, চোখেমুখে তার প্রশ্নের ছড়াছড়ি। ভেতরের অনুভূতিরা অধৈর্য্য, উৎকণ্ঠিত। কিন্তু সে অহিকে সময় দিলো, নিজেকেও প্রস্তুত করলো অপ্রস্তুত কিছু শোনার জন্য। অহি দীর্ঘক্ষণ সময় নিলো। কিছু কথা যখন বলা হয় না পরিস্থতির চাপে তখন তা যুগ যুগ ধরে স্মৃতির পাতায় থাকতে থাকতে চাপা পরে যায়। চাইলেও তখন আর তা খুব সহজে মেলে ধরা যায় না। অহির অবস্থাও ঠিক তা-ই। খুব বাজে অভিজ্ঞতা ভুলে যাওয়ার চেষ্টা চালাতে চালাতে আজ তা ধূলো পড়ে ধোঁয়াশা হয়ে গেছে। সেই ধূলো পরিষ্কার করতে কিঞ্চিৎ সময় তো লাগবেই।

প্রায় মিনিট দশ পর অহি মুখ খুললো, কণ্ঠ ধ্বনিরা প্রস্তুত হলো বিভীষিকা ময় কথা গুলো বলার জন্য। ভীষণ বিশাল এক দীর্ঘশ্বাস ফেলে সে বলা শুরু করলো,
“ছোটোবেলা থেকেই আমার মা আমার ব্যাপারে ভীষণ উদাসীন ছিলো, সেই উদাসীনতার জন্য ছোটো বয়সে আমার সাথে ঘটে গিয়েছে বড় বিপর্যয়। আমার বয়স তখন সাত কিংবা আট হবে। বাবা-মায়ের একদিন তুমুল কথা কাটাকাটি, অবশেষে কথা কাটাকাটির অবসান ঘটলো আমাকে গৃহান্তর করার মাধ্যমে। মায়ের জেদের কারণে আমার এত বড় বাড়ি, এত সুন্দর পরিবার থাকতেও আমাকে পাঠানো হয় হোস্টেল। জীবন বোঝার আগেই যৌ* নতার লালসার শিকার হবো তা হয়তো কারোই জানা ছিলো না। হোস্টেলের পর্যবেক্ষণ করতো এক মামা ছিলো যে সব বাচ্চাদের আদর করতো। আমাদের চকলেট দিতো, কোলে নিয়ে ঘুরতো। আমি খুব কমই মামার সান্নিধ্যে যেতাম। ছোটোবেলা থেকে খুব চুপচাপ থাকার কারণেই মানুষের সাথে কম মিশতাম। তখন সময়টা শীতকাল, ডিসেম্বর বা জানুয়ারীর দিকে। হোস্টেলের বেশিরভাগ দায়িত্বরত সদস্য ছুটিতে। আমি বিকেলে হোস্টেলের পেছনের দিকে বাগানে খেলছিলাম। ফুল আমার প্রিয় ছিলো বিধায় সেটা নিয়েই নিজের আপন মনে হাবিজাবি এঁকে খেলায় মত্ত ছিলাম। এর মাঝেই সেই লোকটা এলো যে সব বাচ্চাদের আদর করতো। তথাকথিত নিয়মে সে আমার মাথায় গালে হাত বুলিয়ে দিলো, চকলেট দিলো অথচ আমি নিলাম না। বাচ্চা হলেও বুঝতাম অপরিচিত কারো কাছ থেকে কিছু নেওয়া উচিৎ না। মামা তখন একটা সূর্যমুখী ফুল এনে আমার হাতে দিলো, আমি তো খুশিতে আত্মহারা। আমাকে হাসি-খুশি দেখে মামা কোলে নিলেন। আমিও বেশ আনন্দে কোলে উঠে গেলাম। যখন আমি ফুল নিয়ে ব্যস্ত তখন অনুভব করলাম আমার… আমার বুকে প্রচন্ড ব্যাথা হচ্ছে। ব্যাথার চোটে চোখে টলমলে অশ্রুদেরও ভীড় জমে গেলো। আমি উফ্ করে শব্দ করে উঠলাম। মামার দিকে তাকিয়ে বললাম ‘মামা, ব্যাথা’। মামা বিদঘুটে হেসে বললো, ‘আদর করলে একটু ব্যাথা লাগবেই, মামা তো তোমাকে আদর করছি।’ আমি তবুও কিছুটা মোচড়ামুচড়ি করছিলাম, অস্বস্তিতে ভরে গেছে আমার শরীর। আমার ছোটো নাজুক শরীরটা তখন মামার হাতের মুঠোয়, সে যেভাবে পেরেছে সেভাবে ছুঁয়ে দিয়েছে। তারপর বাগানের মালি কাকাকে আসতে দেখে সে আমায় ছেঁড়ে দিলো। তারপর আমি ফুলটা ছুড়ে ফেলে নিজের ঘরে চলে গেলাম।”

দীর্ঘ বক্তব্যের পর থামলো অহি। অদ্ভুত ভাবে নওশাদের চোখে অশ্রু থাকলেও অশ্রু নেই অহির চোখে অথচ তার কণ্ঠনালী কাঁপছিলো। অহি মাথা নিচু করলো, ডান হাত দিয়ে অনবরত নিজের বাম হাত মুচড়োচ্ছিলো। তার যে সেসব অতীত মনে করে খুব কষ্ঠ হচ্ছে তা বুঝতে বাকি রইলো না নওশাদের। তাই তো সে গলা পরিষ্কার করে বিবশ কণ্ঠে বললো,
“আজ নাহয় থাক। অতীত নাহয় অতীতই থাকুক।”

অহি হাসলো, তাচ্ছিল্য করে বললো,
“ঘৃণা হচ্ছে তাই না আমার উপর! হওয়াটাই স্বাভাবিক।”

অহির কথার ধরণে হতবিহ্বল নওশাদ। তাজ্জব হয়ে বললো,
“কী বলছেন? আপনার খারাপ লাগছে বিধায় না করেছি।”

অহি হাসলো, দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,
“এখন আর খারাপ লাগে না। এত বছর নিজের মাকেও বলতে পারি নি এসব কথা। কেবল আমি আর আমার ঐ আল্লাহ জানতো আমি যে কি লুকিয়ে বেঁচে ছিলাম। আজ যেহেতু বলা শুরু করেছি, তাহলে বলি?”

‘তাহলে বলি’ কথাটাই যেন কেমন নিবিড় আর্তনাদ ছিলো। বিদঘুটে অতীত বের করে মন হালকা করার একটা হাহাকার ছিলো যা ছুঁতে পারলো নওশাদকে। সে ধীর কণ্ঠে বললো,
“আমি শুনছি তবে, আপনি বলুন।”

অহি পুকুরের ঝলমলে, স্বচ্ছ জলরাশির দিকে তাকিয়ে বলা শুরু করলো,
“সেইদিন আমার সাথে ঘটা বিদঘুটে ঘটনা টা কিঞ্চিৎ নাড়িয়ে দিয়েছিল আমাকে। কই, বাবা-চাচা সবাই তো আমাকে আদর করতো কিন্তু কখনো এমন ব্যাথা দেওয়া আদর তো করতো না। সন্ধ্যার দিকে যখন সব নিরিবিলি মালি কাকা এলেন আমার ঘরে। আমি তখন পড়ার টেবিলে বই নিয়ে বসেছি। কাকা এসেই আমার পাশে হাঁটু ভেঙে বসলেন, তার চোখেমুখে কি যেন একটা হাবভাব। সে আমাকে কেমন ক্ষীণ কণ্ঠে বললেন ‘তোমার সাথে ফজলু কিছু করছে?’ আমি এক ঝটকায় বুঝে ফেললাম কাকা বিকেলের সেই ঘটনার কথা বলছে। আমি ভয় পেয়ে গেলাম, অনবরত ডানে-বামে মাথা নাড়াতে নাড়াতে বললাম ‘না’। মালি কাকা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে চলে গেলেন তখনই। আমার ছোটো মনে তখন অনাকাঙ্ক্ষিত ভয়েরা হানা দিলো। সেই ঘটনার তিনদিন পরের কাহিনী। আমি রাতে খাবারের পর দাঁত ব্রাশ করতে করতে হোস্টেলের পিছনের বারান্দায় গেলাম যেটা আমার অভ্যাস ছিলো। সেখানেই হোস্টেলের কর্মচারীদের কোয়াটার ছিলো। আমি হঠাৎ ভীষণ হাসাহাসির শব্দ শুনলাম ঐ মামার ঘর থেকে। তার দরজাটাও হালকা খোলা ছিলো। আমি ধীরে ধীরে পৌঁছে গেলাম সেই ঘরটাতে। কিন্তু দরজা পুরোটা হাত দিয়ে খুলে দিতেই আমি হতভম্ব। ভেতরের দেখা দৃশ্যটার জন্য আমি প্রস্তুত ছিলাম না। এত অপ্রত্যাশিত কিছু ছিলো। আমাদের খাবার সার্ভ করা খালা আর মামা ছিলেন সে ঘরে। আমি ভয় পেয়ে ছুটে আসতে নিলেই খালা দৌড়ে এসে ধরে ফেললেন আমায়। মামার চোখে তখন উপচে পড়া লালসা। মামার লালসাকে সাঁই দিলেন খালাও। সে আমাকে জোর করে ধরে আমার জামার পেছনের চেইনটা খুলে দিলেন। একজন মহিলা, যার কন্যার বয়সী হয়তো ছিলাম আমি, সে কিনা মামাকে খুশি করতে আমায় বলিদান করার জন্য উঠেপড়ে লেগেছিলো। মামার এলোমেলো, নোংরা ছোঁয়ায় আমি নেতিয়ে গিয়েছিলাম। তারপর….”

কথা থেমে গেলো অহির। তুমুল কান্নায় ভেঙে পড়লো সে। নওশাদও আবিষ্কার করলো তার হৃৎপিণ্ড প্রয়োজনের তুলনায় বেশি বিট করছে। অস্বাভাবিক ভাবে কাঁপছে তার শরীর। ঘৃণায় ভরে উঠেছে অনুভূতিরা। ছোটো একটা মেয়েকেও কিনা ছাড় দেয় নি! সে চাইলো,অহির কাঁধে ভরসার হাত দিয়ে চোখের জল মুছিয়ে দিতে, কিন্তু সে তা করলো না। কারণ অহির মনে এখন অতীতের নোংরা ছোঁয়ার স্মৃতি কিলবিল করছে, নওশাদের সঠিক ছোঁয়াও হয়তো আরেকটা ভিন্ন ঘৃণার সৃষ্টি করতে পারে। তাই নওশাদ নিজেকে সংযত করলো। কাঁদতে দিলো অহিকে।

অহি কাঁদলো, পাহাড়ের মতন অটল অহি নিমিষেই গলে জল। কাঁদতে কাঁদতে যখন চোখের জল ফুরালো সে ভেজা কণ্ঠে বললো,
“নওশাদ, জানেন সেদিন আমি বেঁচে গিয়েছিলাম। আমার সাথে খারাপ ঘটতে গিয়েও ঘটে নি। আমার চিৎকারে মালি কাকা ছুটে এসেছিলো, হৈচৈ শুনে ছুটে এসেছিলো আমাদের হোস্টেলের কয়েকজন মেডাম। আমি ততক্ষণে নেতিয়ে পড়ে গিয়েছি। কাকার কারণে শেষ মুহূর্তে আমি বেঁচে যাই। অতঃপর মেমরা আমাকে বলে এসব নাকি খারাপ কথা, মানুষ জানলে আমায় নোংরা বলবে তাই যেন কাউকে না জানাই। আমিও তাই লুকিয়ে গেলাম সবটা। ওদের কি হয়েছিল পরে আমার জানা নেই, কেবল আমাকে পাঠিয়ে দিয়েছিল বাড়িতে। মিছে অযুহাত দেখিয়ে বলে ছিলো আমি নাকি থাকতে চাচ্ছি না আর সেখানে। তারপর থেকে সে ঘটনা আমাকে মানুষ থেকে মানসিক রোগীতে রূপান্তরিত করলো। কাউকে বলতে না পারার কারণে খুব বাজে ভাবে পোকায় খেয়ে ফেললো আমার ভেতর টা। এরপর থেকে আমি ফুল সহ্য করতে পারতাম না। মাঝে সাঝে ঐ মানুষ গুলোকে খু* ন করার তৃষ্ণাও জাগতো। এটা ধীরে ধীরে মানসিক সমস্যা হয়ে গেলো।”

নওশাদ চুপ, নিরুত্তর। অহির ক্ষণে ক্ষণে নাক টানার শব্দ পাওয়া গেলো। কিছুটা ক্ষণ দু’জনে চুপ থাকার পর উঠে দাঁড়ালো অহি। ক্ষীণ স্বরে বললো,
“বুঝলেন তো নওশাদ, মনের মাঝে যেই ঘৃণা আছে তা নিয়ে আমি আরও একজনকে ভালোবেসে ফেলেছিলাম। কিন্তু আমি জানি মানুষটা আমার না। আর আমিও তো পবিত্র না।”

“আমার কাছে কারো বিদঘুটে ছোঁয়া আপনার অপবিত্রতা হতে পারে না। আর ভালোবাসার কথা তো আপনিই বললেন, সে মানুষ যেহেতু আপনার না তবে যে মানুষ আপনাকে ভালোবাসছে তাকে নাহয় আগলে নিন।”

“হয়তো পারবো না। আমার এমন কলুষিত জীবনের সাথে আপনাকে জড়াতে চাইছি না। আপনার ভালোর জন্য বলছি, ভুলে যান ভালোলাগাকে।”

কথা শেষ করেই অহি পা বাড়ালো নিজ গন্তব্যে, নওশাদ কেমন অদ্ভুত কণ্ঠে বললো,
“কী আশ্চর্য! আপনি আমার ভালো চাইলেন, অথচ আমায় চাইলেন না!”

কথার মাঝে কি যেন একটা ছিলো যা থামিয়ে দিলো অহির পা। পিছুটান তো অহির জন্য না, তবে আজ কেন থামিয়ে দিলো তাকে সে পিছুটান!

(৬০)

চিত্রার কোচিং শেষ হতে হতে সন্ধ্যা নামলো প্রকৃতিতে। সোডিয়ামের আলোয় রাস্তাঘাট উজ্জ্বল। চিত্রা খুশি মনে এক প্যাকেট ঝালমুড়ি কিনলো আর হেলতে দুলতে হাঁটা ধরলো নিজের বাড়ির পথে। কিছুদূর যেতেই তার চোখ আটকালো পরিচিত মানুষটার দিকে, অথচ মানুষটার এখানে থাকার কথা না। যেই মুহূর্তে চিত্রা তাকে ডাক দিতে নিবে মানুষটা তখনই হাঁটতে হাঁটতে পাশের একটা আঁধার গলিতে ঢুকলো। চিত্রারও কি যেন মনে হলো, সেও ধীর পায়ে হাঁটতে হাঁটতে মানুষটার পিছে পিছে আঁধার গলিতে প্রবেশ করলো। বেশ কত গুলো নোংরা গলি, ভূতুড়ে প্রকৃতি পাড় হয়ে রঙিন এক দুনিয়ায় প্রবেশ করলো চিত্রা। কেমন অদ্ভুত এক দুনিয়া। চিত্রা হতভম্ব আশপাশের মানুষ গুলোর দিকে তাকিয়ে। সভ্য সমাজে অসভ্যের স্থান দখল করা প* তিতালয়ে এসে পড়েছে সে। ধানমন্ডির রাস্তা পার হয়ে অনেকটা দূরেই যে চলে এসেছে সে, তা আর বুঝতে বাকি রইলো না তার। চিত্রা বেশ অবাক হয়েছে অমন মানুষকে এইরকম একটা জায়গায় আসতে দেখে। ঘেমে-নেয়ে একাকার হয়ে গেছে তার শরীর। মৃদু কম্পন দেখা দিয়েছে তার শরীরের শিরায়-উপশিরায়। তন্মধ্যে কেমন বিদঘুটে হাসি দিয়ে একটা লোক বলল,
“কি সুন্দরী, দাম কত তোর?”

কিশোরী চিত্রা আরও ক্ষাণিকটা ভয় পেয়ে যায়। সে আর কোনো কথা না বলে যে রাস্তা দিয়ে এসেছে, সে রাস্তাতেই ছুট লাগায়। পেছন থেকে ম* দ খেয়ে নেশায় বিভোর হওয়া লোকটার বিদঘুটে হাসির শব্দ ভেসে এলো। চিত্রা চোখ-মুখ বন্ধ রেখেই যেন ছুটে চললো। কতটা দৌড়িয়েছে তার জানা নেই, তার দৌড়ানোর সমাপ্তি হলো একটা শক্ত সামর্থ্য দেহের সাথে ধাক্কা খাওয়ার পর।

“কি ব্যাপার, দৌড় প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করবে নাকি? এভাবে চোখ-মুখ বন্ধ রেখে কোথায় যাচ্ছো!”

সামনের পুরুষটির কথায় চোখ মেলে তাকালো চিত্রা। গলা শুকিয়ে কাঠ প্রায়। তবুও বেশ কষ্টে সে উচ্চারণ করলো,
“একটু পানি দেন, বাহার ভাই।”

চিত্রার এমন উত্তেজিত মুখমন্ডল দেখে অবাক হলো বাহার। দ্রুত পাশের দোকানটা থেকে পানির বোতল কিনে আনলো। চিত্রার দিকে বাড়িয়ে দিলো সে পানির বোতল। চিত্রা ডান-বামে না দেখেই ঢকঢক করে বেশ খানিকটা পানি পান করলো। অতঃপর জোরে জোরে শ্বাস নিতে লাগলো।

বাহার ভ্রু কুঁচকালো, অবাক কণ্ঠে বললো,
“কোথায় গিয়েছিলে? হাঁপাচ্ছো কেনো?”

চিত্রা বেশ কতক্ষণ চুপ থেকে নিজেকে ধাতস্থ করলো। তারপর বেশ ভাবুক স্বরে বললো,
“বাহার ভাই, সব রহস্যের সমাধান হচ্ছে না কেনো জানেন? ধূলো পড়েছে চেহারায় আর আমরা মুছছি আয়না। আসলে আমরা রহস্যের সঠিক রাস্তায় এখনো হাঁটাই ধরি নি।”

#চলবে