#চেরি_ব্লসমের_সাথে_এক_সন্ধ্যা
#লেখা: ইফরাত মিলি
#পর্ব: ৩৭
____________
আজকে জঙ্গল পেরিয়ে জোহানের টাইম হাউজে আসতে মিতুলের ভয় করেনি। ভয় যে কী জিনিস সেটাই ওর খেয়ালে ছিল না। ওর মস্তিষ্ক জুড়ে ছিল কেবল জোহান। টাইম হাউজের দরজা খোলাই পেল এসে। মিতুল ভিতরে প্রবেশ করলো। ওর পদধ্বনির চাপা শব্দ হলো ফ্লোর জুড়ে। বাতাসের সাথে ফ্রিসিয়াস ফুলের মিষ্টি সুগন্ধ ভেসে বেড়াচ্ছে। ফ্রিসিয়াস ফুলগুলো যে জানালার কাছে রাখা, সেই জানালার সামনে দাঁড়িয়ে আছে জোহান। মুখ সম্পূর্ন জানালার দিকে ঘোরানো। দেখতে পাচ্ছে না মিতুল। জোহানের চোখ থেকে যে অনর্গল জলের ধারা নামছে নীরবে, তা দৃষ্টির অগোচরে ওর। মিতুল বুঝতে পারছে না প্রথমে কী বলবে জোহানকে। কী বলে সান্ত্বনা দেবে। দ্বিধায় ভুগছে ও। মিতুল যখন কিছু বলবে বলবে করেও বলে উঠতে পারছিল না, তখন জোহানকেই বলতে শুনলো,
“আমার এখানে এই টাইম হাউজ ওঠানোর কারণটা আমি তোমাকে বলিনি মিতুল।”
মিতুল চোখ তুলে তাকালো। জোহানের মুখ জানালার দিকেই ঘোরানো এখনও। জোহান ওর দিকে না তাকিয়েই বলতে লাগলো,
“এই ঘরটা আমার তেরো তম জন্মদিনের উপহার ছিল। পেয়েছিলাম পনেরো তম জন্মদিনে। পনেরো তম জন্মদিনে প্রথম পা রেখেছিলাম এই ঘরে।
আমার জন্মদিনে সবাই আগে থেকেই আমার জন্য গিফট কিনে রাখতো। শুধু আমার ড্যাড কিনতো না। ড্যাড আমাকে জিজ্ঞেস করে নিতো আগে। কেক কাটার সময় বলতো, ‘জোহান, কী চাই তোমার?’।
আমি সব সময় একটা উত্তরই দিতাম, ‘মম’স লাভ’। মমের ভালোবাসাই একমাত্র চাওয়া ছিল আমার। কিন্তু তেরো বছর থেকে আমার সেই চাওয়া পাল্টে যায়। আমার চাওয়াগুলো হয়ে ওঠে বিলাসবহুল। কারণ আমি বুঝতে পেরেছিলাম আমার প্রতি মমের ভালোবাসা খুবই ঠুনকো। ওটা কোনোদিন গাঢ় হবে না আর। আমি যতই চাই না কেন মম আমায় বেশি ভালোবাসুক, সে বাসবে না। কারণ, আমার মমের ভালোবাসার বিস্তর জায়গা জুড়েই আমার ব্রাদার বিরাজ করে। মম যে আমায় ভালোবাসে না সেটা নয়। ভালোবাসে আমায়। তবে সেটা খুবই কম। আমার ব্রাদারকে যদি দশ পার্সেন্ট ভালোবাসে, তাহলে আমাকে ভালোবাসার পরিমাণটা বোধহয় সেখানে দুই কী তিন। এর বেশি নয়। যেটা আমার কাছে খুবই তুচ্ছ। এত তুচ্ছ ভালোবাসায় আমার মন ভরছিল না। আমি চাইতাম আমার প্রতি মমের এই তুচ্ছ ভালোবাসা আরও কিছুটা গাঢ় হোক। কিন্তু হচ্ছিল না। বুঝতে পেরেছিলাম আর হবেও না। তাই এই ঠুনকো ভালোবাসার প্রতি ছোটা বন্ধ করলাম। পরিবর্তন করে ফেললাম আমার চাওয়া পাওয়া সব কিছু। তেরো তম জন্মদিনে আমি প্রথম আমার চাওয়ায় ভিন্নতা এনেছিলাম। ড্যাড যখন জিজ্ঞেস করেছিল, ‘কী চাই তোমার?’, আমি প্রথম মমের ভালোবাসা না চেয়ে অন্য কিছু চেয়েছিলাম। দৃঢ়তার সাথে বলেছিলাম, ‘অ্যা হাউজ!’।”
জোহান একটু থামলো।
তারপর আবার বলতে লাগলো,
“ওই দিনটায় কী ছিল আমি জানি না। কোনো এক অদম্য শক্তি লুকানো ছিল বোধহয় দিনটায়। যা আমাকে ওই দিনের পর থেকে পুরোপুরি পাল্টে দিয়েছে। আর ওই অদম্য শক্তিটা মূলত আমার মমের কথাতেই জড়িয়ে ছিল। ওই দিন আমার তেরো তম জন্মদিনের আগের দিন ছিল। স্কুল থেকে ফেরার পথে আমার চারজন সহপাঠী…মানে ওই চারজন। যারা একদিন রাস্তায় আমাদের গাড়ি আটকে ছিল। সাথে তুমি ছিলে। তোমার সামনে রাস্তায় মেরেছিল আমাকে। ওদের ব্যাপারে তোমায় সত্যিটা আগে বলিনি আমি। কেন মেরেছে, কারা ওরা, কিছুই না। বলেছিলাম আমি হ্যান্ডসাম বলে হিংসা করে মারে ওরা। মজা করে বলেছিলাম ওটা। ওরা হিংসা করে নয়। আমাকে মেরে মনে তৃপ্তি, আনন্দ পায় বলে মারে। আমাকে মেরে, হেনস্থা করে ওদের মনে তৃপ্তি, মজার এই ঘনঘটার প্রথম সৃষ্টি হয় স্কুল জীবন থেকে। যেটা এখনও রয়ে গেছে ওদের মাঝে। শুধু পার্থক্য হয়েছে এটাই যে, আগে ওরা মারতো আর আমি চুপচাপ মার খেতাম। আর এখন মার খেয়ে সাথে সাথে ওদের মার দেওয়ারও ব্যবস্থা করি।
তো সেদিন স্কুল ছুটির পর বাড়ি ফেরার পথে ওরা জোর করে একটা নির্জন জায়গায় নিয়ে গিয়েছিল আমায়। মেরেছিল খুব। ওই দিনের মারটাই সবচেয়ে বেশি যন্ত্রণাদায়ক ছিল। সহ্য করতে কষ্ট হচ্ছিল। তবুও ওদের কিছুই বললাম না। শুধু হৃদয়ে দহন হচ্ছিল। মমের জন্য। কারণ, মম বিষয়টা জানার পরও আমার জন্য কিছুই করছিল না। মার খেয়ে বাড়ি ফিরলাম। নোজ ব্লিডিং হচ্ছিল। এমতা অবস্থায়ই মমের কাছে গেলাম। মম তখন বারান্দায় ছিল। ভীষণ রেগে ছিলাম সেদিন আমি। আমার ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গিয়েছিল। মমের কাছে গিয়েই পিঠের ব্যাগটা ছুঁড়ে ফেললাম ফ্লোরে। মম দাঁড়িয়ে যায়। আমি সেদিন কোনো দিক, কোনো কিছু বিবেচনা না করেই মমকে চেঁচিয়ে বলেছিলাম,
‘আমি আর সহ্য করতে পারছি না মম। প্লিজ! কিছু করো। এরকম চলতে থাকলে একসময় আমি মারা যাব। প্লিজ কিছু করো। কথা বলো আমার স্কুল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে। কথা বলো ওদের অভিবাবকদের সাথে। প্লিজ মম! ডু সামথিং। যদি এগুলো না পারো তবে আমাকে অন্য স্কুলে ট্রান্সফার করো। প্লিজ মম!’
মম শোনেনি আমার কথা। মম বুঝতে পারেনি আমার কষ্ট। সে তীব্র বিরক্ত, রাগ নিয়ে বলেছিল, আমার এই ঝামেলা নিয়ে বসে থাকার মতো সময় তার হাতে নেই। এরপর আর কোনো কমপ্লেইন যেন না করি তার কাছে। আমার নিজেরটা নিজেকেই সামলে নিতে বলেছিল মম। মমের ওই কথাগুলো আমার পাল্টে যাওয়ার চাবিকাঠি ছিল। ওইদিন আরও অনেক কথা কাটাকাটি হলো মমের সাথে। ড্যাড সেদিন বাড়িতে ছিল। সব জানলো সে। মম এবং ড্যাডের মাঝে তর্কাতর্কি হলো খুব। ড্যাড সিদ্ধান্ত নিলো আমাকে অন্য স্কুলে ভর্তি করাবে। কিন্তু ড্যাড যতক্ষণে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, তার অনেক আগে আমার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়ে গিয়েছিল। আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম ওই স্কুলেই থাকবো আমি। যারা আমার সাথে অমন করে তাদের সাথে টেক্কা দিয়ে ওই স্কুলেই টিকে থাকবো আমি। ঠিক তাই করলাম। মাথা উঁচু করেই দাঁড়ালাম ওদের সামনে। আগে আমি এমন ছিলাম না মিতুল। একাকী স্বভাবের ছিলাম। কারো সাথে বন্ধুত্ব গড়ে তুলতে পারিনি। আলাভোলা বাচ্চা টাইপ ছিলাম আমি। ভীতু প্রকৃতির ছিলাম। মূলত মমের কারণেই অমন ছিলাম আমি। চোখের সামনে মমকে দেখতাম সে ব্রাদারকে আদর করছে, যত্ন করছে, খাইয়ে দিচ্ছে। অথচ আমি? আমার প্রতি তার ভীষণ উদাসীনতা। আমাকে দেখভাল করার সময় হতো না তার। এমন হওয়ার কারণেই আমি মানসিক ভাবে ভীষণ বিষাদগ্রস্ত ছিলাম। আশেপাশের কোনো কিছুতেই মনোযোগ ধরে রাখতে পারতাম না। আমার মাথায় শুধু ঘুরতো মম। মম আমাকে ভালোবাসে না। এসবের সাথে আবার যোগ হয়েছিল স্কুল বুলিং। সবকিছু মিলিয়ে মানসিক ভাবে আরও বেশি ভেঙে পড়েছিলাম আমি।
কিন্তু ওইদিনের পর থেকে অন্যরকম হয়ে গেছি। আগে বাসা থেকে স্কুলে যাওয়ার জন্য বাইরে পা রাখতেই ভয় ঘিরে ধরতো আমাকে। কিন্তু ওই দিনের পর থেকে এক উদ্যমী মন নিয়ে স্কুলে যাওয়া শুরু করেছিলাম। ভয় লাগতো না কোনো কিছুতে। আমি ধীরে ধীরে স্কুলের অনেকের সাথে বন্ধুত্ব গড়তে লাগলাম। এর মাঝে আমার অন্যতম প্রিয় বন্ধু হচ্ছে রিকার্ডো। রিকার্ডো অনেক আগে থেকেই আমার সাথে ভাব জমাতে চাইতো, কথা বলতে চাইতো। কিন্তু আমিই ওর সাথে মিশতে পারতাম না। তবে ওই দিনের পর আমি নিজে গিয়েই ওর সাথে ফ্রেন্ডশিপ করেছি। ও-ই ছিল আমার প্রথম বন্ধু। ওর সাথে বন্ধুত্ব করার কারণে জীবন আরও কিছুটা পাল্টে যায়। বলতে গেলে ভালো ভাবেই পাল্টে যায়। আমি ভালো থাকার রাস্তা খুঁজে পাই। ধীরে ধীরে আরও অনেক বন্ধু হয় আমার। বন্ধুরা সব সময় পাশে ছিল আমার। এখনও আছে। ওই রাবিশগুলো আমার সাথে বেয়াদবি করলে, আমার বন্ধুরাই তা মোকাবেলা করতো। শুরু হলো আক্রমণ, পাল্টা আক্রমণ। সেই যে শুরু হলো তা এখন পর্যন্ত চলছে।”
বলে জোহান বড়ো করে দীর্ঘশ্বাস ফেললো। চুপ থাকলো কয়েক সেকেন্ড। তারপর আবার বললো,
“মাঝে মাঝে আমি খুব কষ্ট অনুভব করি মিতুল। আমার কাছে সব আছে। ড্যাডের কাছে যখন যা চাই তাই পাই। আমি ইচ্ছা খুশি মতো চলাফেরা করতে পারি। ঘুরে বেড়াতে পারি যেখানে খুশি সেখানে। সব কিছুই আমার ইচ্ছা। তবুও মাঝে মাঝে ভীষণ কষ্ট অনুভব করি। প্রায়ই একটা প্রশ্ন জেগে ওঠে মনে, ‘মম কেন আমাকে ব্রাদারের মতো ভালোবাসে না?’। মাঝে মাঝে মনে হয় আমি মমের আসল ছেলে নই। এডপ্ট এনেছে আমায়। কিন্তু এই ভাবনা আমি বেশিক্ষণ ধরে রাখতে পারি না। কারণ, আমি দেখতেই যে মমের মতো। আমি জানি মমই আমার আসল মম। আমার মম, আমার ড্যাড, আমার ব্রাদার এরা সবাই-ই আমার আসল আপনজন। আমি মমের আপন। ব্রাদার যেমন মমের আপন, তেমনি আমিও আপন। কিন্তু তারপরও মম কেন এত কেয়ারলেস আমার প্রতি সেটা সত্যিই জানি না আমি। মম নিজেও এই ব্যাপারটা জানে কি না সন্দেহ। ছোট বেলা থেকেই মম আমার প্রতি উদাসী। মম ব্রাদারের সব কিছু নিজ হাতে করে দিলেও আমার একটা দুটো কাজও করে দিতো না। সব মেইডদের উপর ছেড়ে দিতো।
এদিক থেকে আমার ভাগ্যটা খুব ভালো যে, আমাদের বাসার মেইডগুলো খুব ভালো ছিল। যে সময় আমি খুব ছোট ছিলাম, সে সময় মিসেস রুবি ছিলেন আমাদের বাসার মেইড হিসেবে। তিনি খুব আদর করতেন আমায়। খেয়াল রাখতেন আমার। এরপর আমার যখন এগারো বছর বয়স, সে সময় মিসেস রুবি চলে যাওয়ার পর এলো ক্যামিলা। ক্যামিলার বয়স তখন কম ছিল। মাত্র আঠারো। ক্যামিলা খুব ভালোবাসতো আমায়। খুব কেয়ার করতো আমার। আমিও আস্তে আস্তে ক্যামিলাকে নিজের বড়ো বোনের মতো ভাবতে শুরু করি। মমের কারণে আমার মন হুটহাট করে খারাপ হয়ে গেলে ক্যামিলা এসে মন ভালো করার চেষ্টা করতো। বলতো, ‘মন খারাপ করো না। মম তোমায় ভালোবাসে না তো কী হয়েছে? আমি তো বাসি। তোমার ড্যাডও বাসে। তুমি কি জানো তোমার ড্যাড যে কোনো কিছুর থেকে তোমায় সবচেয়ে বেশি ভালোবাসে?’
ক্যামিলা বার বার এটাই বোঝাতে চাইতো যে, ড্যাড আমায় খুব বেশি ভালোবাসে। আমিও জানি ড্যাড আমায় খুব ভালোবাসে। ড্যাড বোধ হয় পৃথিবীতে সবার থেকে বেশি ভালো আমাকেই বাসে। কিন্তু ড্যাডের একার ভালোবাসা নিয়ে যে আমি সন্তুষ্ট ছিলাম না। ড্যাডের ভালোবাসার পাশাপাশি মমের ভালোবাসাও চাইতাম আমি। বরং ড্যাডের ভালোবাসার থেকেও মমের ভালোবাসা বেশি করে চাইতাম। ব্রাদারের ভালোবাসাও চাইতাম আমি। কিন্তু মমের সাথে সাথে ব্রাদারের ভালোবাসাও পাইনি। মমের ভালোবাসা যা পেয়েছি, আর যা পাই, ব্রাদারের ভালোবাসা পাইনি তার তিন ভাগের এক ভাগও। বুঝতে পারি না ব্রাদারের এমন করার মানে! বুঝতে পারি না মমের এমন করার মানে! শুধু যেটুকু বুঝতে পারি সেটা হলো…”
থেমে গেল জোহান। বলতেও ভীষণ কষ্ট হচ্ছে ওর। কষ্ট নিয়েই বললো,
“শুধু যেটুকু বুঝতে পারি সেটা হলো, আমি এখনও মমের ভালোবাসা পেতে চাই। আমার মন খুব গোপনে এখনও এটাই চেয়ে যাচ্ছে।”
বলতে বলতে চোখ বুজে ফেললো জোহান। পুরোনো কষ্ট যেন তরতর করে আরও বেশি বেড়ে যাচ্ছে। সে চোখ বুজে রইল খানিক ক্ষণ।
এর মাঝে পিছন থেকে চাপা কান্নার মিহি সুর ভেসে আসায় চোখ খুলে ফেললো আবার।
পিছনে তাকিয়ে দেখতে পেল ফুঁপিয়ে কাঁদছে মিতুল। ওর কান্নার চাপা সুর ধীরে ধীরে ভারী হয়ে ঘরময় ছড়িয়ে পড়লো। জোহান বললো,
“আরে, তুমি কাঁদছো কেন? আমি তো আমার কথা বললাম। কাঁদা তো উচিত আমার। তুমি কেন কাঁদছো?”
মিতুল কাঁদতে কাঁদতে বললো,
“কেন বলোনি তুমি? তোমার জীবনে এত কষ্ট কেন বলোনি আগে? এত কষ্টে আছো তুমি, সেটা কেন বলোনি?”
“তোমাকে বলবো? বললে কী করতে তুমি?”
মিতুল সঙ্গে সঙ্গে কিছু বলতে পারলো না। একটু সময় নিয়ে কেঁদে কেটে বললো,
“তোমার ভিতরে এত কষ্ট লুকিয়ে আছে আমি সত্যিই বুঝতে পারিনি জোহান।”
“ওহ তুলতুল, কান্না থামাও। বোকা মেয়ের মতো কাঁদছো কেন? কান্না থামাও।”
মিতুল ধীরে ধীরে নিজেকে ধাতস্থ করলো। তারপর জোহানের দিকে তাকালো ভালো করে। মুখে জায়গায় জায়গায় লাল গাঢ় দাগ। দুই এক জায়গায় কেটে গেছে সামান্য।
মিতুল কিছু না বলে, জোহানকে হাত ধরে এনে কাউচের উপর বসিয়ে দিলো। তারপর বেডরুমে গিয়ে ফার্স্ট এইড বক্স নিয়ে এলো। জোহানের ক্ষত স্থানগুলো পরিস্কার করতে লাগলো আস্তে আস্তে।
জোহান গভীর চোখে তাকিয়ে আছে মিতুলের দিকে। তাকিয়ে থেকে এক সময় বললো,
“আমি আঘাত পাওয়ার পর আমার মম কখনো এরকম কেয়ার করেনি আমাকে।”
জোহানের কথায় আবারও কেঁদে উঠলো মিতুল। জোহান বললো,
“আরে, তুমি আবারও কাঁদছো কেন?”
মিতুল অনেক কষ্টে নিজের কান্না সংযত করলো।
একটু সময় পর বললো,
“তুমি তো বলেছিলে তোমাকে দশ গুণ বেশি বোনাস দেবে ওরা। তোমার হাত ভাঙা হবে, পা ভাঙা হবে, সাথে আরও কী কী ভাঙা হবে তুমি জানো না। তাহলে শুধু এই একটুখানি আঘাত পেয়েছো কেন?”
জোহান অবাক হয়ে বললো,
“মানে কী তুলতুল? আমার হাত, পা ভাঙা হলে তুমি খুশি হতে?”
“ছি, কী বলছো তুমি? তোমার হাত, পা ভাঙা হলে আমি খুশি হবো কেন? আমার ভীষণ কষ্ট লাগবে।”
“তাই?”
মিতুল আর কিছু বললো না। শুধু কান্না কান্না একটা ভাব উগড়ে উঠতে লাগলো।
(চলবে)
#চেরি_ব্লসমের_সাথে_এক_সন্ধ্যা
#লেখা: ইফরাত মিলি
#পর্ব: ৩৮
____________
আজকে খুব সকালে ঘুম থেকে উঠলো মিতুল। বাড়ির কেউ তখনও ওঠেনি। মিতুল চুপি চুপি ক্যামিলার রুমে গিয়ে ক্যামিলাকে জাগালো। ক্যামিলার সাহায্য নিয়ে নিজ হাতে খাবার তৈরি করলো। রান্না মোটামুটি ভালোই জানে ও। রান্না করেছে মূলত জোহানের জন্য। রাতেই ওর মাথায় হঠাৎ জোহানকে রান্না করে খাওয়ানোর ভূতটা চেপেছিল। কাল রাতে বোধহয় কিছু খায়নি বেচারা জোহান। জোহানের জন্য ওর বড্ড মায়া বেড়ে গেছে কালকের পর থেকে। মায়া করে জোহানের জন্য রান্না করেছে ও। বাড়ির সবাই জেগে গেলেও কেউ টের পেল না ও রান্না করেছে। সবাই ভাবছে ক্যামিলা রান্না করেছে। রান্না শেষ হলে মিতুল দ্রুত খাবার নিয়ে বেরিয়ে পড়লো জোহানের টাইম হাউজের উদ্দেশ্যে।
জায়িন বারান্দার শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে স্পষ্ট দেখতে পেল মিতুল জঙ্গলে ঢুকছে।
খুব খুশি মনে খাবার নিয়ে জোহানের টাইম হাউজের দিকে যাচ্ছে মিতুল। জোহানকে নিজের হাতের রান্না খাওয়াবে ভাবতেই মনে অন্যরকম প্রশান্তি হচ্ছে। কালকে রাতে জোহানের টাইম হাউজে যাওয়ার কিছুক্ষণ পরই ক্যামিলাও গিয়েছিল টাইম হাউজে। ও আর ক্যামিলা অনেক সময় ধরে টাইম হাউজে থাকার পর বাড়িতে ফিরেছিল। জোহান ফেরেনি। টাইম হাউজেই ছিল রাতে।
মিতুল টাইম হাউজে এসে দরজা বন্ধ দেখলো। ভেবেছিল ভিতর থেকে লক করা। কিন্তু দরজায় মৃদু ঠ্যালা দিতেই দরজা খুলে যায়। মিতুল হাসি হাসি মুখে প্রবেশ করলো ঘরের ভিতরে। বেড রুম থেকে জোহানের কণ্ঠ ভেসে আসছে। সেই সাথে সাদাত আঙ্কলের। মিতুল আর এক পা’ও সামনে বাড়াতে পারলো না। দরজা থেকে মাত্র দুই কদম সামনে এগিয়ে ছিল। সেই দুই কদমেই থেমে গেল। সাদাত আঙ্কল এখানে উপস্থিত! না, না অসম্ভব। জোহানের জন্য ও খাবার নিয়ে এসেছে সেটা কিছুতেই সাদাত আঙ্কলের সামনে প্রকাশ করতে পারবে না। মিতুল তড়িৎ গতিতে খাবারের ট্রে নিয়ে বেরিয়ে এলো টাইম হাউজ থেকে। যে খাবার নিয়ে এসেছিল, তা আবার ফিরিয়ে নিয়ে যাবে বাড়িতে। কিছুতেই সাদাত আঙ্কলের সামনে পড়বে না ও।
জোহানের চোখ বেড রুমের জানালা থেকে বাইরের দিকে পড়তেই দেখলো মিতুল তড়িঘড়ি করে রাস্তা ধরে বাড়ির দিকে যাচ্ছে।
জোহান বেড রুমে বসেই উচ্চৈঃকণ্ঠে ডেকে উঠলো,
“হেই তুলতুল!”
মিতুল জায়গাতেই থমকে গেল। জোহানের ডাক! জোহানের কেন ডাকতে হবে ওকে? এখান থেকে চুপিচুপি চলে যেতে চাইলেই জোহান টের পেয়ে যায় কীভাবে? মিতুল জোহানের কণ্ঠ অনুসরণ করে জানালার দিকে তাকালো। জোহানকে জানালার কাছেই দাঁড়ানো দেখলো।
জোহান আবারও উচ্চৈঃকণ্ঠে বললো,
“চলে যাচ্ছ কেন তুমি? ভিতরে এসো।”
মিতুল দিগভ্রান্ত অবস্থায় পড়লো। কিছুতেই চায়নি এখন এখানে এভাবে সাদাত আঙ্কলের সামনে পড়তে। কিন্তু এই জোহান সেটা হতে দিলো না। এখন এখান থেকে চলে গেলে কী ভাববে সাদাত আঙ্কল? মিতুল উপায়ন্তর না পেয়ে আবার টাইম হাউজে ফিরে এলো। খাবার নিয়ে একেবারে জোহানের বেড রুমে প্রবেশ করলো। জোহান বেডে হেলান দিয়ে আধ শোয়া অবস্থায় আছে। আর ওর পাশে বসে আছে সাদাত আঙ্কল। মিতুলের অস্বাচ্ছন্দ্য বোধ হচ্ছে। সাদাত আঙ্কল কী ভাববেন এখানে এসেছে বলে?
জোহান মিতুলের হাতের ট্রে দেখে বললো,
“হোয়াট ইজ দিজ?”
মিতুল এবার আরও অস্বস্তির গভীরতায় ডুবে গেল। জোহানের কি এই প্রশ্ন না করলেই হতো না! মিতুল তোতলাতে তোতলাতে বললো,
“খা-খাবার এনেছিলাম। ভাবলাম রাতে কিছু খাওনি তাই…”
মিতুল ঠিক করে কিছু বলতেই পারলো না।
জোহান কেমন করে একটু হাসলো যেন। তারপর ড্যাডকে বললো,
“তুমি জানো ড্যাড, মিতুল কিন্তু খুব ভালো ট্রিটমেন্ট করতে পারে। আই থিংক ও একজন ডক্টর হলে খারাপ হতো না।”
মিতুলের হৃদয় কেমন ছ্যাত করে উঠলো। জোহান কি ওর ড্যাডকে বলে দেবে কালকে ও জোহানের প্রাথমিক ট্রিটমেন্ট করেছিল? ইশ না! ও চায় না এটা। জোহান যেন কিছু না বলে ওর ড্যাডকে।
জোহান ট্রিটমেন্টের ব্যাপারে বললো না আর কিছু। হঠাৎ করে জিজ্ঞেস করলো,
“আচ্ছা ড্যাড, মম কি খুব বেশি রেগে আছে?”
সাদাত আঙ্কল বললেন,
“না, খুব বেশি নয়।”
আরও কিছু টুকিটাকি কথা হলো বাবা, ছেলের মাঝে। মিতুলের এখানে দাঁড়িয়ে থাকতে একদমই ভালো লাগছিল না। বাবা, ছেলের কথার মাঝে নিজেকে উটকো ব্যক্তি মনে হয়েছে ওর। সাদাত আঙ্কলের অফিসে যেতে হবে বলে অল্পতেই চলে যান জোহানের টাইম হাউজ থেকে।
জোহান মিতুলকে সটান দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বললো,
“আমার জন্য খাবার নিয়ে এসে ওখানেই দাঁড়িয়ে থাকবে? খাবার কি আমাকে খাওয়াতে এনেছো? না কি নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকবে বলে এনেছো?”
“তোমাকে খাওয়াবো বলেই এনেছি।”
মিতুল জোহানের কাছে এসে বেডের উপর রাখলো ট্রে।
জোহান দেখলো মিতুল ওর জন্য চিকেন পাৰ্ম এবং লাসানা নিয়ে এসেছে।
মিতুল বললো,
“তোমার জন্য নিজ হাতে তৈরি করেছি এগুলো।”
জোহান একটু অবাক হলো।
“তুমি?”
মিতুল মাথা নাড়লো। জোহানের দিকে চিকেন পার্মের প্লেট এগিয়ে দিয়ে বললো,
“খেয়ে দেখো কেমন হয়েছে।”
“হঠাৎ করে আমার জন্য তুমি নিজ হাতে খাবার তৈরি করেছ যে, কারণ কী?”
মিতুল একটু অপ্রস্তুত হয়ে পড়লো। কিন্তু দ্রুতই উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করলো।
“এমনিই ইচ্ছা হলো তাই।”
জোহান একটু বাঁকা চোখে তাকিয়ে বললো,
“এমনিই?”
“এমনি নয়তো কী? খাবার বানানোর পেছনে আবার কোন কারণ থাকবে? দোষ হয়ে গেছে আমার খাবার বানানোয়? ঠিক আছে, তাহলে দাও নিয়ে চলে যাচ্ছি। আর আমি তো চলেই গিয়েছিলাম। তুমিই তো আবার ডাকলে।”
“না ডাকলে জানতাম কী করে যে তুলতুল আবার আজকাল আমার জন্য নিজ হাতে খাবার তৈরি করছে? ডাকলাম বলেই তো জানতে পারলাম। বাই দ্য ওয়ে, তুমি আমার জন্য খাবার নিয়ে এসে, তা আমাকে না খাইয়ে আবার পালিয়ে যাচ্ছিলে কেন সে সময়? ইদানিং এত পালানো শুরু করলে কেন তুমি? কালকে বিকেলেও দেখলাম তুমি আমার টাইম হাউজে এসে আবার পালিয়ে যাচ্ছ। আজকেও দেখলাম তাই। কেন? পালাও কেন তুমি?”
“দেখো জোহান, আমি কোথায় যাব, কী করবো, না করবো এগুলো একান্ত আমার নিজের ব্যাপার। এগুলো নিয়ে প্রশ্ন করার অধিকার তোমার নেই। সুতরাং এগুলো নিয়ে প্রশ্ন না করলেই খুশি হবো আমি।”
মিতুলের মাঝে একটু রাগের উপস্থিতি লক্ষ্যনীয়।
জোহান আর কথা বাড়ালো না মিতুলের সাথে। চিকেন পাৰ্ম নেওয়ার জন্য হাত বাড়ালেই, মিতুল আবার নিয়ে নিলো প্লেটটা। বললো,
“আমি কেটে দিচ্ছি।”
মিতুল চিকেন পাৰ্ম পিস করে কেটে দিলো।
জোহান কাঁটা চামচ দিয়ে এক পিস মুখে পুরলো।
মিতুল প্রশংসা শোনার জন্য বসে আছে। ও জানে ওর বানানো চিকেন পাৰ্ম সুস্বাদু হয়। ভাইদের কাছ থেকে কত প্রশংসা শুনেছে চিকেন পাৰ্ম নিয়ে!
মিতুল মনে মনে আকুলতা নিয়ে বসে রইল। সময় কেটে গেল। কিন্তু জোহানের থেকে কোনো প্রশংসা এলো না। মিতুলের মাঝে রাগ রাগ ব্যাপারটা বেড়ে উঠছে। জোহান এখনও কেন প্রশংসা করছে না? মিতুল আর ধৈর্য ধরতে পারলো না। কাঠ গলায় জোহানকে বললো,
“আমার তৈরিকৃত খাবার কি খুব খারাপ হয়েছে?”
“না, একেবারে খারাপ হয়নি। মোটামুটি ভালোই হয়েছে।”
মিতুল গর্জে উঠলো,
“মানে? ‘একেবারে খারাপ হয়নি’, ‘মোটামুটি ভালোই হয়েছে’ মানে কী এসবের? তুমি এটা বোঝাতে চাইছো যে, আমার বানানো খাবার ভালো হয়নি?”
মিতুল জোহানের কিছু বলা পর্যন্ত অপেক্ষা করলো না। বসা থেকে দাঁড়িয়ে নিজেই ফের বলে উঠলো,
“হাউ ডেয়ার ইউ! আমার বানানো খাবারের বদনাম করো তুমি? জানো কত মানুষ আমার রান্নার প্রশংসা করেছে? আমার মা, আমার আব্বু, আমার ভাইয়েরা, আমার কাজিনরা, আমার সকল আত্মীয় স্বজনরাই আমার রান্না খেয়ে প্রশংসা করেছে। আর তুমি আমার রান্নার বদনাম করছো?”
“তারা তো তোমার রিলেটিভস। সে জন্য তোমাকে মিথ্যা করে হলেও…”
“জোহান…” মিতুল তীব্র ক্ষোভে চিৎকার করে উঠলো।
“কী? যেটা সত্যি সেটাই তো বলছি।”
মিতুল আক্রোশিত হয়ে বাংলাতে বলে উঠলো,
“তুমি জীবনেও শুধরাবে না আসলে। বদমাইশ, বদমাইশই থেকে যাবে। তোমার পুরো শরীর জুড়েই শয়তানিপনা কিলবিল করছে। তোমাকে পুকুরে চুবিয়ে মারার ইচ্ছাটা চলে গিয়েছিল আমার। কিন্তু সেটা যেতে যেতেও হুট করে ফিরে এসেছে আবার। তোমাকে একদিন সত্যি সত্যিই পুকুরে চুবানি খাওয়াবো আমি।”
বলেই মিতুল জোহানের হাত থেকে চিকেন পাৰ্মের প্লেটটা কেড়ে আনলো। জোহানের জন্য যা খাবার এনেছিল তা সব গুটিয়ে টাইম হাউজ থেকে বেরোনোর পথে চলতে লাগলো। আর এক পা বাড়ালেই টাইম হাউজ থেকে বাইরে চলে যাবে ও। মিতুল পা বাড়িয়েও থেমে গেল আবার। হঠাৎ করে মনে হলো, ও একটু বাড়াবাড়ি করে ফেলেছে। কালকে জোহান মনে এত কষ্ট পেয়েছে, আর আজকে ও এরকম আচরণ করলো! এটা কি ঠিক হলো? হাত থেকে প্লেট পর্যন্ত কেড়ে এনেছে! এত নিষ্ঠুর কবে হয়ে গেল ও? কারো হাত থেকে খাবারের প্লেট কেড়ে আনার মতো নিষ্ঠুরতা কী করে করলো ও? মিতুলের অপরাধ বোধ হচ্ছে।
ফিরে এলো আবার জোহানের কাছে।
জোহান ভ্রু নাড়িয়ে বললো,
“কী? চলেই তো গেলে আবার ফিরে এলে কেন? আমি তো ডাকিনি তোমায়।”
মিতুল কিছু না বলে জোহানের দিকে ট্রে এগিয়ে দিলো।
জোহান অভিমানের সুরে বললো,
“খাবো না আমি। নিয়ে যাও তুমি তোমার খাবার।”
মিতুলের মেজাজ আবার বিগড়ে গেল,
“শোনো, বেশি ভাব দেখিও না তুমি। বড্ড বেশি ভাব দেখাও তুমি। খেলে বলো। নাহলে সত্যি সত্যিই নিয়ে চলে যাব।”
জোহান একটু দমে গেল। বললো,
“ঠিক আছে, খাব আমি।”
তারপর একটু থেমে আবার বললো,
“এক কাজ করো, তুমি নিজ হাতে খাইয়ে দাও আমায়।”
মিতুল অবাকের তুঙ্গে উঠে বললো,
“কী? খাইয়ে দেবো তোমায়?”
“হ্যাঁ, দিতেই পারো। এতে এত অবাক হওয়ার কী আছে? আমি একজন রোগী! একজন রোগীকে তুমি খাইয়ে দিতেই পারো।”
“কে রোগী? কোথায় রোগী? আমি তো কোনো রোগী দেখতে পাচ্ছি না।”
“দেখতে পাচ্ছো না মানে? তোমার সামনেই তো জলজ্যান্ত একজন রোগী বসে আছে।
ইট’স মি। আমাকে কি তোমার রোগী বলে মনে হয় না? দেখো…”
জোহান নিজের মুখের ক্ষত দেখাতে গিয়ে, ভুলে ক্ষত রেখে অন্য জায়গায় অঙ্গুলি করে বললো,
“এই যে ক্ষত! তা কি তুমি দেখতে পাচ্ছো না? এরপরও কি তোমার সন্দেহ আছে আমি একজন রোগী কি না?”
“এই সামান্য একটু আঘাত পেয়ে তুমি নিজেকে রোগী বলে দাবি করো? তুমি নিজেকে রোগী বললেই তো আর রোগী হয়ে যাবে না। তুমি সম্পূর্ণ সুস্থ একজন মানুষ। তাই সময় নষ্ট না করে, নিজের টা নিজে খেয়ে নাও।”
বলেই মিতুল বেরিয়ে গেল।
_______________
মম রাগ করে আছে। জোহানের ভালো লাগছে না। আজকে সারাদিনে রুম থেকে বের হয়নি মম। তার খাবার রুমে পাঠানো হয়েছে। রুমে বসেই খেয়েছে।
কালকের মতো এর আগে এমন ঝগড়া ঝাটি আর হয়নি। এর আগে মম এটা সেটা নিয়ে বকা ঝকা করলেও, ও চুপ ছিল। মাঝে মধ্যে ইচ্ছা হলে দুই একটা কথার উত্তর দিতো, না হলে না। কিন্তু মম রাগ করে থাকতো। যা জোহানকে শান্তিতে থাকতে দেয় না। জানে মমের ওর প্রতি অবহেলা আছে, কিন্তু ও মমকে খুব ভালোবাসে। তাই মমের এমন রাগ করে থাকাতে কষ্ট হয় ওর।
জোহান মমের রাগ ভাঙ্গানোর জন্য এলো। বন্ধ দরজায় নক করে নরম কণ্ঠে বললো,
“মম, আর ইউ অ্যাংগ্ৰি? ওপেন দ্য ডোর।”
ভিতর থেকে মমের কোনো উত্তর এলো না। জোহান বললো,
“আই অ্যাম স্যরি মম! আমি চাইনি কালকে ওরকম একটা পরিস্থিতির সৃষ্টি করতে। রাগ করে থেকো না তুমি।”
এবার মমের কণ্ঠ শুনতে পেল। মম কাঠ গলায় বললেন,
“আমি রাগ করে নেই জোহান। আমার মাথায় পেইন করছে। তাই আমি রুম থেকে বের হচ্ছি না। তুমি এখন যাও এখান থেকে।”
জোহান বলার মতো কিছু পাচ্ছে না। কষ্ট হচ্ছে। বলার জন্য ওর কাছে শব্দ ভাণ্ডারের ব্যাপক অভাব পড়েছে। জোহান শুধু একটি বাক্যই বললো,
“আশা করছি খুব তাড়াতাড়ি তোমার রাগ ভেঙ্গে যাবে।”
বলেই দরজার কাছ থেকে সরে পড়লো জোহান।
মিতুল আড়ালে দাঁড়িয়ে জোহানের সব কথা শুনেছে। হঠাৎই আবার মন খারাপ হলো ওর। জোহানের কষ্টের পালা যে আবার বেড়ে যাচ্ছে সেটা বুঝতে পারলো। সকালেও জোহান ঠিক ওর আগের চেনা জোহানের মতোই ছিল। চঞ্চল। এখন আবার এমন! জোহানকে এভাবে দেখতে খারাপ লাগছে ওর। ও চায় না জোহান এরকম থাকুক।
মিতুল জোহানের কাছে চলে এলো। জোহান মমের ওখান থেকে সোজা লনে চলে এসেছে।
সূর্য ঢলে পড়েছে পশ্চিম আকাশে। পড়ন্ত বিকেলের সোনালী রোদ্দুর নিঝুম মুগ্ধতা ছড়াচ্ছে। জোহান ইজি চেয়ারে বসে আছে।
মিতুল ইজি চেয়ারের দিকে এগিয়ে এলো। বসলো জোহানের পাশের চেয়ারে। জোহান চুপচাপ। প্রথম কথা বললো মিতুল,
“এই জোহান, ঘুরতে যাবে আমায় নিয়ে?”
জোহানের থেকে সরাসরি উত্তর এলো,
“না।”
“কেন?”
জোহান চেয়ার থেকে উঠতে উঠতে বললো,
“মন ভালো নেই আমার। যাব না আমি।”
জোহান হেঁটে কয়েক পা দূরে চলে এলেই, মিতুল পিছন থেকে দৌঁড়ে এসে পথ আগলে ধরলো ওর।
“আরে চলো না। গেলে মন ভালো হয়ে যাবে। চলো।”
জোহান মিতুলকে ঠেলে সরিয়ে দিলো সামনে থেকে।
“যাব না আমি।” বলতে বলতে ঘরের দিকে যেতে লাগলো।
মিতুল পিছন থেকে বললো,
“সত্যিই যাবে না?”
জোহান একই উত্তর দিলো,
“না।”
(চলবে)