#চৈত্রিকা (১৯)
#বোরহানা_আক্তার_রেশমী
_____________
৫৫.
অর্পিতার হাতের রক্ত কোনো মতে আটকানো গেলেও পুরোপুরি চিকিৎসার জন্য তাকে নিয়ে শহরে যেতে হবে। শায়লা বিলাপ করে কাঁদছে। বড়রা সবাই চিন্তায় আছে। চৈত্রিকা তখনো চিত্রের পাশে দাঁড়িয়ে আছে। ছেলেটা যেভাবে ভেঙে পড়েছে তাতে নিজের ক্ষ’তি করতে হয়তো খুব বেশি ভাববে না৷ প্রহর আড়চোখে কয়েকবার তাকিয়েছে চৈত্রিকার দিকে। চিত্রর আশেপাশে তাকে ঘুরতে দেখে খুব বেশি সময় লাগেনি পুরোটা বুঝতে। মুখে কিছু না বললেও মনে মনে বেশ কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে তবে মুখের গম্ভীর ভাবটা একটু সরায় না। ডাক্তারের সাথে সব পরামর্শ শেষ করে ঠিক হয় প্রহরই যাবে অর্পিতাকে নিয়ে। সাথে যাবে শিমুল আর শায়লা। ছোট্ট অয়ন আর অর্থি এসব কিছু দেখে ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে আছে। তাদের আগলে রেখেছে পল্লবী। কথামতো কিছুক্ষণের মধ্যেই প্রহর, শিমুল আর শায়লা অর্পিতাকে নিয়ে শহরের উদ্দেশ্যে রওনা হয়। চিত্র শুধু ফ্যালফ্যাল করে দেখে। মুখে কিছু বলতে পারে না। কি বলবে তা ভেবেও পায় না। তার জন্যই তো তার অর্পির আজ এমন অবস্থা তাহলে সে মুখে কি বলবে? চৈত্রিকা শুধু চিত্রর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। একে একে সবাই ফিরে আসে অন্দরমহলের দিকে। চিত্র এলোমেলো পায়ে নিজের ঘরের দিকে যেতে নিলে আটকে দেয় চৈত্রিকা। চিত্র পেছন ফিরে তাকায়। চৈত্রিকা হাসার চেষ্টা করে বলে,
‘আপনি একা ঘরে গিয়ে কি করবেন চিত্র ভাই? আপনি বরং এখানেই বসুন না!’
চিত্র হাসে। পুরো বাড়ির সকলে যখন অর্পিতাকে নিয়ে ব্যস্ত, তার মানসিক অবস্থাটা ভাবার মতো কেউ নেই তখন কয়েকদিন পরিচিত একটি মেয়ে তার কথা ভাবছে! সম্পর্কে তো মেয়েটি তো তার ভাবীজান হয়। বয়সে তার থেকে কয়েক বছরের ছোট অথচ কি সুন্দর বুঝ তার! চিত্র কিছুক্ষণ চৈত্রিকার মুখের দিকে তাকিয়ে ছোট করে বলে,
‘আমি অর্পি নই ভাবীজান। চিন্তা করবেন না। আমি তো ভীষণ স্বা’র্থপর তাই নিজের ক্ষ’তিটা করবো না৷’
চৈত্রিকা দৃষ্টি এদিক ওদিক করে। ঠিক ভরসা করে উঠতে পারে না। তবে মুখে কিছু বলেও না৷ চিত্র চলে যায়। হলরুমে পল্লবী, নীরা, অর্থি, অয়ন, স্মরণ, চয়ন, নাসিমা, সাদিক সবাই বসে আছে। পিয়াস এসবের ধারে কাছেও থাকে নাহ বরাবরই। চৈত্রিকা একবার সবার মুখের দিকে তাকাতেই স্মরণ ব্যস্ত গলায় বলে,
‘আমার মা কোথায়? অনেকক্ষণ থেকে তো মা’কে দেখিনি!’
চৈত্রিকা বাঁকা হাসে। সবার অগোচরে চুপচাপ অর্পিতার ঘরের দিকে যায়। সেখানে পাহাড়ায় থাকা একজন লোক চৈত্রিকাকে দেখে মাথা নিচু করে সালাম দেয়৷ চৈত্রিকা স্বর গম্ভীর করে বলে,
‘ঘরেই আছে তো? কেউ এসেছিলো?’
লোকটি নীচু স্বরে ছোট্ট করে বলে, ‘জ্বি। ঘরেই আছে তবে কেউ আসেনি।’
চৈত্রিকা ‘আচ্ছা’ বলে তাকে যেতে বলে। লোকটা যেখানে বসে ছিলো সেখানে মোটা একটা রড আর একটা বেল্ট ছিলো। দুটোর দিকে এক নজর তাকিয়ে ঘরের দরজা খুলে দেয়। মেঝেতে হাত, পা আর মুখ বাঁধা অবস্থায় পড়ে আছে শিল্পা। যে লোকটি পাহাড়ার কাজে ছিলো সেই লোকটিই শিল্পাকে বেঁধে রেখেছিলো। চৈত্রিকা কোনো কথা না বলে চুপচাপ প্রথমে শিল্পার হাত পায়ের বাঁধন খুলতে থাকে। শিল্পা চৈত্রিকাকে দেখেই ছটফট শুরু করে। যেনো কিছু বলতে চায়! মুখটা খুলে দেওয়ার সাথে সাথেই শিল্পা বড় বড় শ্বাস নিয়ে খ্যাক করে ওঠে। দাঁতে দাঁত চেপে বলে,
‘এটা তুই ঠিক করিসনি বড় বউ! আমার সাথে লাগতে এসে ভালো করলি না। পেছন থেকে বেঁধে রেখে আ’ঘাাত না করে সাহস থাকলে সামনাসামনি আ’ঘাত কর।’
চৈত্রিকা হেঁসে ওঠে। শিল্পার চুলের ভাজে হাত রেখে বলে, ‘আমি তো এখনো আপনাকে ফুলের টোকাও দেইনি শ্রদ্ধেয় খালাজান! আর চৈত্রিকা পেছন থেকে আ’ঘাত করে না। শ’ত্রুর সাথে সামনাসামনি লড়াই করার যথেষ্ট সাহস এই চৈত্রিকার আছে৷ ভীতুরা পেছন থেকে আ’ঘাত করে কিন্তু চৈত্রিকা বুক টান টান করে সামনে দাঁড়িয়ে একদম বুক বরাবর আ”ঘাত করে।’
চৈত্রিকার তেজী কন্ঠের কাছে শিল্পার গলা শুকায়। প্রথমবারের মতো শান্তশিষ্ট মেয়েটির এমন সাহসী রুপ হজম করতে সময় লাগে। কিন্তু চৈত্রিকার কাছে তো সে হার মানবে না। তাই কোনোরকমে নিজেকে শান্ত করে রু’ক্ষ স্বরে বলে,
‘একদম বড় বড় কথা বলবে না। দেবরের সাথে যে কি কি করে বেড়াও তা তো তখন দেখলামই! এমন চ”রিত্রহী’ন মেয়েদের মুখে এতো বড় বড় কথা মানায় না। একে তো মামাও একটা চ’রিত্রহী’ন তার ভাগ্নীর আবার চরিত্র কেমনে ঠিক হবে? চয়ন ভাই কেমনে যে ওইরকম বাড়ির মেয়েকে বউ করে আনলো কে জানে বাপু! বাপ মা’কে কেউ কখনো দেখেনি, চিনে না, জানে না। আদৌও বাপ মায়ের কোনো পরিচয় আছে কি না কে জানে! তোমার বাপ তোমারে এমন অসভ্যতা শিখাইছে হ্যাঁ? তোমার বাপ, মাও কি তোমার মতো চ’রিত্রহী’ন ছিলো নাকি?’
শিল্পার বলতে দেড়ি হলেও তার গালে থা’প্প’ড় পড়তে মিনিট খানেকও দেড়ি হলো না। পুরো ঘরে স্বশব্দে যেনো বেজে উঠলো থা’প্প’ড়টা। এতো জোড়ে একটা থা’প্প’ড় হজম করতে শিল্পার বেশ খানিক সময় লাগলো। অবাক চোখে চৈত্রিকার দিকে তাকিয়ে দেখে চৈত্রিকার চোখ, মুখ লাল হয়ে আছে। তবে এই চেহারাতে অন্য কিছু ছিলো যা শিল্পাকে ভয় পেতে বাধ্য করে। চৈত্রিকা চোয়াল শক্ত করে বলে,
‘আপনার নোং’রা মুখে আমার বাবাকে নিয়ে একটা টু শব্দও করলে আপনার জিভ টেনে ছি’ড়ে ফেলবো আমি। আমাার বাবা কি কি শিখিয়েছে তা যদি প্রয়োগ করি তাহলে আপনার পা থেকে মাথা পর্যন্ত প্রত্যেকটা শিরা উপশিরা কেঁপে উঠবে। আমার চরিত্র কেমন তা আমি আপনার মতো নিচু মহিলার থেকে শুনবো না। আর এই ধরনের ভুল গুলো যেনো ২য় বার না হয় তার ব্যবস্থা করতেছি। চলেন!’
শিল্পা ভয় পেয়ে যায়। চৈত্রিকার রাগে তখনো মাথায় আগুন জ্ব’লছে। গটগট পায়ে ঘরের বাহিরে এসে বেল্ট তুলে নিয়ে এগোয় শিল্পার কাছে। শিল্পা কিছু বলার আগেই নিজের সমস্ত শক্তি দিয়ে ঘা বসায় শিল্পার পিঠে। শিল্পা ব্যাথায় আর্তনাদ করে ওঠে। চৈত্রিকা তখন উন্মাদ। হঠাৎ করে চৈত্রিকার এমন ভ’য়ং’কর রুপ দেখে, ব্যাথায় শিল্পা চিৎকার করে কাঁদতে থাকে। চৈত্রিকা হাত ধরে টেনে তোলে শিল্পাকে৷ নি’ষ্ঠুর গলায় বলে,
‘অর্পিতা আপুর সাথে অন্যায়ের শা’স্তি! চিত্র ভাইকে উ’স্কিয়ে খারাপ ভাবে অর্পিতা আপুর সম্মানে হাত দেওয়ার শাস্তি! উনি ভেতর থেকে যতটা কষ্ট পেয়েছে ততটাই কষ্ট পাবেন আপনি। আপু যতটা কষ্ট এখন পাচ্ছে সবকিছুর শাস্তি একসাথে পাবেন।’
শিল্পায় ব্যাথায় কিছু বলতে পারে না। চৈত্রিকা শিল্পাকে যেভাবে দাঁড় করিয়েছিলো ঠিক সেভাবেই আবার মা’রতে থাকে। শিল্পা আঘাত সহ্য করতে না পেরে স্বাভাবিক ভাবেই ঘর থেকে বের হয়। চৈত্রিকার চুল ততক্ষণে খুলে গেছে তবে হাত থেমে নেই। তার চেঁচামেচিতে হলরুম থেকে সবাই ছুটে আসে। তবে চৈত্রিকা থামে না। নিজের সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে শিল্পাকে যা তা বলতে থাকে আর মা’রতে থাকে৷ শিল্পা মেঝেতে শুয়ে পড়েছে সহ্য করতে না পেরে। স্মরণ কাছে আসতে নিলে দুয়েকটা আ’ঘাত সেও পায়। দুপাশ থেকে পল্লবী, নীরা, নাসিমা চৈত্রিকাকে থামানোর চেষ্টা করে। চয়ন, সাদিক গম্ভীর মুখে দাঁড়িয়ে আছে৷ চেচামেচি শুনে চিত্রও আসে। চৈত্রিকার এমন উন্মাদ রুপ দেখে নিজেও ভড়কায়। চৈত্রিকাকে কোনো রকমে থামিয়ে পল্লবী রাগী সুরে বলে,
‘এগুলো কি ধরনের বেয়াদবি চৈত্রিকা? জমিদার বাড়ির মেহমানদের সাথে কেউ এমন করে? কি করেছে উনি? মা’রছো কেনো?’
চৈত্রিকা দাঁতে দাঁত চেপে বলে, ‘কি করেছে তা ওই মহিলাকেই জিজ্ঞেস করুন! আজ অর্পিতা আপুর এই অবস্থা, চিত্র ভাইয়ের এমন অন্যায়ের পেছনে মূল মাথা কে? উনাকে জিজ্ঞেস করুন!’
সবাই অবাক হয়ে তাকায়। শিল্পাকে চুপ থাকতে দেখে চৈত্রিকা আবারও রেগে তেড়ে আসতে নিলে শিল্পা ব্যার্থার্ত অবস্থায় ভয়ে গড়গড় করে কোনোরকমে বলে,
‘সব আমি করেছি। আমিই চিত্রকে উ’স্কিয়েছি সব কিছু করার জন্য৷ ‘ও’ ভালোবাসা পাওয়ার লো’ভে অ’ন্ধ হয়ে গিয়ে আমার প্ল্যানে ফেঁসে গেছে। আমি করেছি সব। আমাকে আর মে’রো না চৈত্রিকা।’
সবাই অবাক হয়ে যায়। চৈত্রিকা নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করে। চৈত্রিকার এই রুপে জমিদার বাড়ির মেয়েগুলো অবাক হলো। যে নীরা কখনো মাথা নিচু ছাড়া উচু করে কথা বলেনা সেই নীরাও ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রয় রুদ্রানী রুপের চৈত্রিকার দিকে। অদ্ভুত ভাবে এই মেয়েটিকে এই রুপেই বেশি অপরুপ লাগে। নারী হবে সূর্যের মতো তেজী যার তেজই বলে দেবে তার কতটা মূল্য!
৫৬.
অর্পিতার ঘটনার পর থেকেই অর্থির মন খারাপ। নিবিড় কিছুই জানে না তাই সে আজও পড়াতে এসেছে। পল্লবী এতে কোনো রকম দ্বিরুক্তি না করে নিবিড়কে পড়াতে বলে নিজে চলে গেছে। নিবিড়ের বেশ অদ্ভুত লাগলেও পাত্তা দেয় না ঘটনাটা। স্বাভাবিক ভাবেই অর্থিকে বলে,
‘বই খাতা বের করো!’
অর্থি নিশ্চুপ। কোনো কথাও বলছে না, কাজও করছে না। বিষয়টা খেয়াল করে নিবিড় ভ্রু কুঁচকায়। ভেবেই নেয় অর্থি আজও পড়াতে ফাঁকি দেবে। মেয়েটার ওপর সে বড়ই বিরক্ত। কাল মা’র খাওয়ার পরও আজ কেমন ত্যাড়ার মতো কথা না শুনে বসে আছে! নিবিড় আবারও বেশ শান্ত গলায় বলে,
‘অর্থি! আমি তোমাকে বই, খাতা বের করতে বলেছি! অঙ্ক করো!’
অর্থি মাথা নিচু করে বলে, ‘আমি আজ পড়বো না মাষ্টারমশাই।’
নিবিড়ের রাগ হয়। নিজেকে দমানোর চেষ্টা করে বলে, ‘কেনো পড়বে না? কি সমস্যা?’
অর্থি কারণ না বলে চুপ করে থাকে। অর্পিতার বিষয়টা বলবে কি বলবে না তা বুঝে উঠতে পারে না। এর মধ্যেই নিবিড় আবারও প্রশ্ন করে, ‘কি সমস্যা? পড়বে না কেনো? চুপ করে আছো কেনো? কথা বলতে পারো না?’
অর্থি ফাঁকা ঢোক গিলে বলে, ‘অর্পিতা আপু অসুস্থ। তাই পড়বো না।’
নিবিড় বিষয়টা বোঝে না। উল্টো অর্থি মজা করছে বা পড়ায় ফাঁকি দিচ্ছে ভেবে রাগে একটা বেতের বা’রি বসিয়ে দেয় অর্থির হাতের কনুইয়ের ওপর। অর্থি হুট করে মা’র খাওয়ায় বেশ ব্যাথা পায়। ব্যাথায় আর্তনাদ করে ভাসা ভাসা চোখে তাকায় নিবিড়ের দিকে। নিবিড় দাঁতে দাঁত চেপে বলে,
‘তোমাকে ফাঁকি দিতে নিষেধ করিনি? পড়ার ভয়ে এতো বাহানা কেনো তোমার? কি সমস্যা?’
কান্না গুলো গলায় গিলে নিয়ে চোখ ঝাপ্টায় অর্থি। অভিমানে ছোট্ট মুখটা কালো হয়ে যায়। দৃষ্টি এদিক ওদিক করে কন্ঠে অদ্ভুত এক টান রেখে আওড়ায়,
‘আমি ফাঁকি দেওয়ার জন্য কিছু বলিনি মাষ্টারমশাই। আপনি সব সময় আমার বিষয়ে এমন কেনো ভাবেন? আমি মানছি আমি পড়ালেখা করি নাহ তাই বলে কি অর্পিতা আপুকে নিয়েও মিথ্যা বলবো? আপু সত্যিই অসুস্থ মাষ্টারমশাই। আপু হাত কে’টে ফেলেছিলো সেখান থেকে রক্ত পড়ে পুরো ঘর একদম রক্তে ভেসে গেছে। আপুকে নিয়ে বড় ভাইজান শহরে গেছে। আপুর এমন অবস্থাতে কি পড়তে ভালো লাগে মাষ্টারমশাই?’
নিবিড় নির্বাক হয়ে অর্থির অভিমানী গলার কথা শুনে। নিজেই কয়েকটা ফাঁকা ঢোক গিলে বেত রেখে কাঁপা কাঁপা হাত এগিয়ে দেয় অর্থির কাছে। ছোট করে বলে,
‘সরি অর্থি! আসলে আমি!’
অর্থি শোনে না। নিবিড়ের হাত সরিয়ে দিয়ে চোখ মুছে বের হয়ে যায় ঘর থেকে। নিবিড় হতাশ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। নিজের ওপর রাগও হয়। কেনো সে পুরোটা না শুনে মেয়েটাকে অযথা মা’রলো!
৫৭.
সন্ধ্যার দিকে বাড়ি ফেরে প্রহর, অর্পিতা, শিমুল, শায়লা। অর্পিতা এখন কিছুটা সুস্থ। শিমুল আর শায়লা শহরেই থেকে যাওয়ার জিদ করলেও প্রহরের কড়া গলার কাছে তারা টিকতে পারেনি। অর্পিতাকে কিছু বলেনি প্রহর। অর্পিতা নিজেও চুপচাপ। বাড়িতে এসে অর্পিতাকে তার ঘরে দিয়ে প্রহর প্রথমে যায় নিজেদের ঘরে। হলরুমে কমবেশি সবাই থাকলেও স্মরণ, শিল্পা, চিত্র আর চৈত্রিকাকে কোথাও দেখেনি প্রহর। বাাড়ির পরিবেশটা বেশ নিস্তব্ধ মনে হলেও প্রহর কিছু বলেনি। তার বোঝা শেষ বাড়িতে কিছু হয়েছে। তাই দ্রুত নিজের ঘরে যায়। ঘরে ঢুকতেই চোখে পড়ে বিছানায় ঘুমন্ত চৈত্রিকাকে। অবেলায় এভাবে চৈত্রিকাকে ঘুমাতে দেখে বেশ অবাকই হয়। ধীর পায়ে চৈত্রিকার কাছে যেতে নিয়েও গোসলখানায় ঢুকে। একেবারে গোসল করে শুধু টাউজার পড়ে উদোম বুকেই বের হয়ে আসে। টি-শার্টটা কোনো রকম পড়তে পড়তে চৈত্রিকার কাছে গিয়ে বসে। আলগোছে কপালে হাত রেখে দেখে জ্বর আছে কি না! কিন্তু প্রহরের স্পর্শেই জেগে ওঠে চৈত্রিকা। চোখের সামনে হুট করে প্রহরের মুখ ভেসে আসায় চমকে উঠে সরে যায়। মস্তিষ্ক কিছুক্ষণের জন্য কাজ করা বন্ধ করে দেয়। প্রহর ভ্রু কুঁচকে বলে,
‘সবসময় এমন লাফাও কেনো? কি সমস্যা? কপালেই তো হাত দিয়েছি শুধু। আর তুমি এই অবেলায় ঘুমাও কেনো?’
চৈত্রিকা কিছুক্ষণ ঝিম মে’রে বসে থাকে। তারপর অলস গলায় বলে, ‘সন্ধ্যা হয়ে গেছে! অর্থি ডাকে নাই কেন আমাকে?’
প্রহর কিছু বলে না। চুপচাপ নিজের চুল মুছতে থাকে। চৈত্রিকা ফট করেই খাট থেকে নামে। শাড়ি ঠিক করতে করতে বলে, ‘অর্পিতা আপু এসেছে? কেমন আছে এখন? কোথায় আছে? ঠিক আছে তো? আপনারা কখন এসেছেন?’
‘ধীরে ধীরে প্রশ্ন করো! আমি পালিয়ে যাচ্ছি না বা যাবোও না। অর্পি ঠিক আছে। নিজের ঘরে আছে আর আমরা একটু আগেই এসেছি।’
চৈত্রিকা আর কোনো কথা না বলে দরজার দিকে হাঁটা লাগায়। পেছন থেকে প্রহর শান্ত গলায় শুধায়, ‘বাড়িতে কি হয়েছে আজ?’
চৈত্রিকা থেমে যায়। খানিকটা অবাক হয়। প্রহর তো আজ বাড়িতে ছিলো না। তবে জানলো কেমন করে যে বাড়িতে কিছু হয়েছে! পেছন ফিরে তাকায় চৈত্রিকা। প্রহর তখনো নিজের কাজে ব্যস্ত। চৈত্রিকাকে চুপ থাকতে দেখে সে নিজেই আবারও বলে, ‘এতো ভেবে কাজ নেই৷ আমি প্রহর রেনওয়াজ! সবার মুখ দেখেই বলে দিতে পারি কার মনে কি চলে! সেখানে সামান্য ঘটনাটুকু বুঝা আমার জন্য তেমন বড় কোনো ব্যাপার না।’
চৈত্রিকা স্বাভাবিক ভঙ্গিতে হাসে। হাসিমুখেই বলে, ‘হবে না? জমিদার সাহেব বলে কথা! এমন তীক্ষ্ণ বুদ্ধি না হলে কি আর মানুষ মা’রা যায় জমিদার সাহেব?’
প্রহরের হাত থেমে যায়। তবে নিজের পক্ষে বা বিপক্ষে একটা টু শব্দও করে না। শুধু অদ্ভুত ভাবে হাসে। চৈত্রিকা ঘর থেকে বের হতে হতে বলে, ‘আজ একজনকে অন্যায়ের শা’স্তি দিয়েছি। ভবিষ্যতে এমন ঘটনা অহরহ ঘটবে জমিদার সাহেব। তখন নিজ চোখে না হয় দেখে নিবেন!’
চৈত্রিকার যাওয়ার পথে প্রহর অবাক হয়ে তাকায়। চৈত্রিকা করেছে টা কি? আবার নিজের বিপদ নিজেই টেনে আনেনি তো!
চলবে..
#চৈত্রিকা (২০)
#বোরহানা_আক্তার_রেশমী
________________
(নোট পড়বেন।)
৫৮.
গভীর রাতে ঘুমন্ত পুরো জমিদার বাড়ি। আকাশে চিকন এক চাঁদ আর তারার মেলা। বাহিরে থেকে থেকে শিয়ালের হাক ভেসে আসছে। এই গভীর রাতেই চিত্র এসেছে অর্পিতার ঘরে। ভেবেছিলো ঘরের দরজা বন্ধ হবে কিন্তু তার ভাবনা ভুল করে ঘরের দরজা খোলায় পায় চিত্র। চিত্র বেশ খানিকটা অবাক হলেও আলগোছে ঘরে ঢোকে। বিছানায় অর্পিতা, অর্থিকে ঘুমন্ত অবস্থায় দেখে নিঃশব্দে এসে মেঝেতে হাটু মুড়িয়ে বসে। কাঁপা কাঁপা হাতে অর্পিতার ব্যান্ডেজ করা হাতটা ধরে কয়েকটা ফাঁকা ঢোক গিলে। ব্যান্ডেজ হওয়া হাতটা কিছুক্ষণ ছুঁয়ে দিয়ে তাকায় অর্পিতার মুখের দিকে। মেয়েটার চোখ মুখ ফোলা ফোলা। চোখের পাতা তখনো ভেজা। চিত্র ফের কাঁপা কাঁপা হাতে অর্পিতার চোখের পাতা ছুঁয়ে দেয়। বিড়বিড় করে বলে,
‘আমার অন্যায়ের শা’স্তি আমাকে না দিয়ে কেনো নিজেকে দিতে চাইলি অর্পি? আমি তো জানি আমি খুব বড় একটা অন্যায় করেছি। তুই আমাকে কেনো শা’স্তি দিলি না? তুই আমাকে দুই চারটা থা’প্প’ড় দিতি! মা’রতি, কা’টতি! তোর যা মন চায় করতি কিন্তু নিজেকে কেনো শা’স্তি দিলি? কতোটা কষ্ট পেয়েছিস তাই না!’
চিত্রর চোখ থেকে আপনা আপনি পানি গড়িয়ে পড়ে অর্পিতার হাতে। চিত্র হাতটা আগলে নিয়ে আলগোছে মাথা রাখে হাতের ওপর। কোনো রকম কান্না না আটকে ফের বলে,
‘আমি তোকে অনেক বেশি কষ্ট দিয়ে ফেলেছি তাই না অর্পি? আমি তো তোকে পাবার লো’ভে অ’ন্ধ হয়ে গেছিলাম। ভুল ঠিক ভাবার বিন্দুমাত্র জ্ঞানও ছিলো না আমার। কিন্তু যদি জানতাম এই একটা ভুল সিদ্ধান্তের জন্য তুই কষ্ট পাবি তবে আমি হাসিমুখে তোকে অন্যের হতে দেখতাম। তোকে যে বড্ড ভালোবাসি অর্পি। সেই কবে থেকে! আবেগের রঙে ভাসতে শুরু করার পর থেকেই তো তোর প্রতি দুর্বলতা আমার। আমি তোকে অনেক বেশি কষ্ট দিয়েছি তাই না? আমি খুব খারাপ তাই না অর্পি? আমাকে আর একটাবার ভালোবেসে শুধরে নিবি অর্পি? আমি আর কখনো তোকে কষ্ট দেবো না। একদম পাক্কা প্রমিজ!’
চিত্র কাঁদছে তখনো। প্রত্যেকটা পুরুষই হয়তো একজন নারীর প্রতি দুর্বল। আত্মসম্মান, ব্যাক্তিত্ব সবার ক্ষেত্রে খাটলেও দিনশেষে সবাই একজনের কাছেই আবেগী হয়ে পড়ে। কিশোর বয়সের প্রেমের মতো জীবনটাকে আরো একবার রঙিন বসন্ত করে তোলে। চিত্র অর্পিতার হাতে পর পর দুটো চুমু দিয়ে বলে,
‘আমি জানি আমি ক্ষমার অযোগ্য তবুও আমি তোর কাছে আজীবন ক্ষমা চেয়ে যাবো। তুই আমার হবি কি না জানা নেই তবে আমার অন্যায়ের জন্য আমি তোর পা ধরেও ক্ষমা চাইতে রাজি। নিজেকে কখনো কষ্ট দিস না প্লিজ। আমার ওপরে যত রাগ, অভিমান, অভিযোগ সব আমার ওপরেই দেখাস তবুও নিজের ক্ষতি করিস নাহ। তুই না চাইলে আমি কখনো তোর সামনেও আসবো না তবুও তুই নিজের ক্ষতি করিস না অর্পি। আমি যে কতটুকু ভালোবাসি তোকে তা কখনোই মুখে প্রকাশ করতে পারবো না। তুই তো জানিস আমি ভীষণ এলোমেলো। আমি পারি না গুছিয়ে কিছু বলতে। তুই তো আমাকে সব সময় বুঝে নিতিস! আরো একবার বুঝে নে না অর্পি!’
চিত্র এরপর কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থাকে। তারপর চোখ মুছে উঠে অর্পিতার কপালে ছোট্ট করে চুমু দেয়। কোনো রকমে এলোমেলো পায়ে বের হয়ে যায় ঘর থেকে। চিত্র চলে যাওয়ার সাথে সাথেই চোখ মেলে তাকায় অর্পিতা। ঠোঁট কামড়ে কান্না আটকানোর চেষ্টা করে। চোখের কোণা বেয়ে জল গড়ায়। কপালে হাত রেখে কান্না ভেজা কন্ঠে বলে,
‘শুধু বাহিরের ক্ষ’তটা দেখলে চিত্র ভাই? ভেতরটা যে একদম রক্তা’ক্ত হয়ে আছে এটা একবারও দেখলে না! আমার প্রতি এই অসীম ভালোবাসা যদি এতো সব ঘটনার আগে দেখাইতা আজ আমরা দুজনে হয়তো একে অন্যের সাথে আষ্টেপৃষ্টে থাকতাম।’
৫৯.
সকাল বেলায় অর্পিতাকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে যাবে প্রহর, শিমুল। শায়লা এসে কয়েকবার স্মরণ আর শিল্পার কথা জিজ্ঞেস করলে কেউ কিছু বলেনি৷ কাল যা হয়েছে তাতে কারোরই মন মেজাজ ভালো না তারওপর শিল্পার কু’কর্মের কথা স্বীকার করাতে মেজাজ আরো খারাপ হয়ে আছে। কিন্তু নিজের বোনের এমন বি’শ্বাস’ঘা’তকতা কি আদৌও শায়লা মেনে নিতে পারবে? এটা কি সম্ভব? পল্লবী নিজ মনেই ভাবছিলো আর কাজ করছিলো। নাসিমা, নীরা হাতে হাতে কাজ করছিলো দেখে চৈত্রিকা নিজেও তাড়াতাড়ি আসে। পল্লবীর সাথে কাজে হাত দিয়েছিলো তখন নীরা নিচু স্বরে বলে,
‘এতো দেড়ি করলে যে! বড় ভাইজান উঠেছে ঘুম থেকে?’
চৈত্রিকা না বোধক মাথা নাড়ায়। তারপর নিজের কাজে মন দেয়। পল্লবী চৈত্রিকার সাথে কথা বলে না ঠিকমতো তবে আজ চুপ করে থাকলো না। চৈত্রিকাকে ছোট করে বললো,
‘বড় বউ! শায়লা কয়েকবার শিল্পা আর স্মরণের খোঁজ করেছে। আমি কিন্তু কিছুই বলিনি। ভাবছি মেয়েটা কি আদৌও মানতে পারবে আপন বোনের বি’শ্বাস’ঘা’তকতা!’
চৈত্রিকা এক পলক পল্লবীর দিকে তাকালেও প্রথমেই কিছু বলে না। নিজ কাজে মন দিয়ে কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে, ‘মানতে না পারলেও মেনে নিতে হবে। সত্য তো সবসময় সত্যই হয়। মানতে পারলেও শিল্পা খালা দোষী আর মানতে না পারলেও শিল্পা খালা দোষী। আমি তো ভেবেছিলাম কাকিকে আপনি সবটা বলেছেন কিন্তু এখন তো উল্টো কথা বলছেন!’
পল্লবী মুখ দিয়ে ‘চ’ শব্দ উচ্চারণ করে বলে, ‘যত সহজ ভাবছো তত সহজ নাকি বড় বউ? শায়লা মানতে পারবে না এসব।’
‘কেনো মানতে পারবে না? যেখানে নিজের স্বা’র্থের জন্য একজন মা তার মেয়েকে মে’রে ফেলতে চায় সেখানে বোনের সাথে বোনের বিশ্বাস’ঘা’তকতাটুকু বড় কোনো বিষয় না। তাই কাকি ঠিক বুঝবে। আপনি বুঝিয়ে বলেন সবটা। আর না পারলে আমাকে বলবেন আমি বলে দিবো।’
চৈত্রিকার নিঃসঙ্কোচে এমন কথা শুনে নাসিমা চমকায়। ফ্যালফ্যাল করে কিছুক্ষণ নিজের মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে ফাঁকা ঢোক গিলে। মেয়েটা এখনই অতীত টানতে শুরু করেছে কেনো? চৈত্রিকা আড়চোখে সবটাই দেখে। এর মধ্যেই শায়লা আসে। চৈত্রিকার দিকে তাকিয়ে বলে,
‘প্রহর ঘুম থেকে ওঠেনি বড় বউ? কখন যাবে ডাক্তারের কাছে?’
চৈত্রিকা স্বভাব সূলভ স্বাভাবিক ভাবেই বলে, ‘তারা তো ডাক্তারের কাছে যাবে না কাকি। ডাক্তার কাকা নিজেই আসবে।’
শায়লা ছোট্ট করে ‘ওহ’ বলে। চৈত্রিকা কাজ শেষ করে হাত ধুয়ে আপনমনে নিজেদের ঘরের পথে আসে। উদ্দেশ্য প্রহরকে ডেকে দিয়ে অর্পিতার ঘরে যাবে তাকে খাওয়াতে। কিন্তু পথিমধ্যে নিজের শাড়ির আঁচলে টান পড়ায় থেমে যায়। হুট করে এমন হওয়ায় ভেতরে ভেতরে চমকালেও ওপরে নিজেকে স্বাভাবিক রাখে। বড় বড় শ্বাস নিয়ে পিছু ফিরে দেখে পিয়াস দাঁড়িয়ে আছে। হাতে তার আঁচলের একটা অংশ। রাগে চোয়াল শক্ত হয়ে আসে। মনে মনে কঠিন এক সিদ্ধান্ত নেয়। পিয়াসের হাত থেকে শাড়ির আঁচল টেনে নিতে নিলে তা আরো শক্ত করে চেপে ধরে পিয়াস। মুখে শ’য়’তা’নী হাসি ঝুলিয়ে নিয়ে বেশ রসিয়ে রসিয়ে বলে,
‘বড় ভাবীজান মনে হয় অনেক ব্যস্ত!’
চৈত্রিকা নিজের শাড়ির আঁচল ছেড়ে দিয়ে ভালো মতো দাঁড়ায়। তারপর পিয়াসের চোখে চোখ রেখে বলে, ‘জ্বি দেবর ভাই। আমি আসলেই এখন খুব ব্যস্ত। শাড়ির আঁচল ছাড়ুন!’
পিয়াস ছাড়ে নাহ। উল্টো শাড়ির আঁচলে টান দেয়। চৈত্রিকা তাল সামলাতে না পেরে দু পা এগিয়ে যায় পিয়াসের দিকে। পিয়াস নিজের হাসি ধরে রেখে বলে,
‘এতো ব্যস্ততা থাকলে চলবে? নিচে তো সবাই ব্যস্ত। আপনি না হয় একটু ব্যস্ততা কাটিয়ে দেবরের দিকে নজর দিলেন! তাতে ক্ষ’তি কি?’
চৈত্রিকা হাত বগলদাবা করে দাঁড়ায়। নিজেই এগিয়ে ১ হাতের দূরত্ব রেখে দাঁড়ায়। কন্ঠ স্বরে তেজ ধরে রেখে বলে, ‘অবশ্যই। তবে আপনি বোধহয় ভুলে গেছেন যে আমি আপনার বড় ভাবীজান। প্রহর রেনওয়াজের বউ।’
‘ভুলবো কেনো ভাবীজান? আমি তো জানি আপনি আমার বড় ভাইয়ের বউ। এজন্যই তো আসলাম আপনার কাছে অল্প কিছু শিখতে।’
কথাটুকু বলতে দেড়ি হলেও চৈত্রিকা থা’প্প’ড় মা’রতে এতটুকুও সময় বিলম্ব করেনি। গায়ের সমস্ত শক্তি দিয়েই থা’প্প’ড়টা দিয়েছিলো আর এজন্যই পিয়াস দু পা সরে গেছে। চৈত্রিকা টান দিয়ে শাড়ির আঁচল ছাড়িয়ে নিয়ে নিজের গায়ে ভালোমতো জড়িয়ে নেয়। পিয়াস র’ক্তচক্ষু নিয়ে তাকায় তার দিকে৷ চৈত্রিকা হেঁসে বলে,
‘আমিও আপনাকে একটু শিক্ষা দিলাম দেবর ভাই। বড় ভাবীর আঁচলে টান দেওয়া কত বড় অ’ন্যায় তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলাম। তা দেবর ভাই শিক্ষা কি হয়েছে নাকি আরো একটু লাগবে?’
পিয়াস রাগে কটমট করে ওঠে। আঙুল উচিয়ে চিবিয়ে চিবিয়ে বলে, ‘কাজটা ভালো করলি না।’
চৈত্রিকা দ্বিগুণ রেগে এগোলো। পিয়াসের মতো আঙুল তুলে চোয়াল শক্ত করে বলে, ‘কাজটা শুধু ভালো না একদম মহৎ একটা কাজ করছি। তোর মতো জা’নো’য়া’রকে কেউ শিক্ষা দিতে পারে না তবে আমি একটু একটু করে দিবো। আমি মহুয়া না যে তোর মিষ্টি কথায় গলে যাবো! আমি চৈত্রিকা। আমাকে ছুঁতে আসলেও তোর হাত পু’ড়’বে। আর তোকে থা’প্প’ড় মা’রায় কি করে নিবি করে নে! তুই অন্যায় করছিস আমি শা’স্তি দিয়েছি এতে তোর বাপেরও ক্ষমতা নাই চৈত্রিকার একটা চুল বাঁকা করবে।’
চৈত্রিকার আগুন চোখে তাকিয়ে পিয়াসের গায়ের লোম দাঁড়িয়ে যায়। মেয়েটাকে যতটা সাদা সিধে ভেবেছিলো সে যে এতোটাও সাদাসিধা না তা হাড়ে হাড়ে বোঝা শেষ পিয়াসের। মনের মধ্যের জিদ মাথা চা’ড়া দিয়ে ওঠে। চৈত্রিকার আগুন চেহারার দিকে তাকিয়ে দুর থেকে হাসে প্রহর। হাতটা মুষ্টিবদ্ধ করে নিয়ে বিড়বিড় করে আওড়ায়,
‘চৈত্রিকা প্রহর রেনওয়াজ। একদম পার্ফেক্ট জীবনসঙ্গী।’
৬০.
অর্থিকে আজ আর পড়াতে আসেনি নিবিড়। অর্পিতার বিষয়ে জানার পর আর কালকে অর্থির অভিমানের পর সে ভেবেছে অর্থিকে একটু হালকা হওয়ার সময় দিক। বেচারী অর্থি নিবিড়িরের ওপর ভীষণ করে অভিমান করেছে। নিবিড় আসেনি বলে সেও কিছু বলেনি৷ পল্লবীকে নিবিড় গতকালই বলে গেছে আজ আর পড়াতে আসবে না৷ অর্পিতা অসুস্থ বিধায় ঘর থেকে বের হচ্ছে না। চৈত্রিকা অর্পিতার সাথে আছে। এই ফাঁকে অর্থি বাড়ি থেকে বের হয়ে গেছে। মন খারাপ নিয়ে চুপচাপ চলে এসেছে জমিদার বাড়ির বড় দীঘির সামনে। সময়টা তখন সন্ধ্যার আগে। গোধূলি লগ্ন। আকাশের লাল আভার দিকে তাকিয়ে দু পা পানিতে ভিজিয়ে রেখেছে। রোদ নেই তবে আকাশের এই লালাভটা যেনো অর্থির মুখের ওপরেই পড়ছে। বোকা অর্থি অনেক অনেক চিন্তা ভাবনার মধ্যে ডুবে ছিলো। খেয়ালই করেনি তার মাষ্টারমশাই তার পাশে এসে বসেছে। নিবিড় অনেকটা সময় পরও অর্থির সাড়াশব্দ না পেয়ে নিজেই গলা পরিষ্কার করে। অর্থি চমকে তাকায়। নিবিড়কে দেখে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে তার মুখের দিকে। নিবিড় ঠোঁট কামড়ে হেঁসে বলে,
‘আমি কিন্তু তোমার স্বপ্ন না। আবার স্বপ্ন ভেবে ভুলভাল বকো না।’
অর্থি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে মুখ ফিরিয়ে নেয়। নিবিড়ের মুখটা কালো হয়ে যায়। চোখ ছোট ছোট করে অর্থির মুখের দিকে তাকিয়ে বলে, ‘মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছো কেনো? কথা বলবে না?’
অর্থি জবাব দেয় না। নিবিড় দুটো জবা ফুল তুলে ধরে অর্থির সামনে। অর্থি একবার তাকিয়ে ফের নজর সরিয়ে নিয়ে বলে, ‘এগুলোর প্রয়োজন নেই মাষ্টারমশাই। আপনি আজ পড়াতে আসলেন না যে!’
নিবিড় বোঝে অর্থি তার ওপর অভিমান করে আছে। অসহায় চোখে তাাকিয়ে থাকে অর্থির মুখপানে। অর্থির সেদিকে কোনো ভ্রুক্ষেপ নাই৷ নিবিড় কয়েকবার ফাঁকা ঢোক গিলে কাঁপা কাঁপা গলায় বলে,
‘দেখো অর্থি! আমি দুঃখিত। আমি কাল বুঝতে পারিনি। তাছাড়া তোমাকে তো আমি মা’রি না বলো! তুমি একেবারেই খুব ফাঁকি দিচ্ছো ইদানীং এর জন্যই রেগে কিছু না শুনে না বুঝে মে’রেছি। আমি তো তোমার ভালোর জন্যই…’
‘আমি কি আপনাকে কিছু বলেছি মাষ্টারমশাই? আপনি আমার মাষ্টারমশাই তাই আমাকে মা’রতেই পারেন। আর আপনি কাল থেকে পড়াতে আসবেন আমি ভালো মতো পড়া করে দিবো।’
নিবিড়কে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই চলে যায় অর্থি। অর্থির হঠাৎ পরিবর্তন হজম হয় না নিবিড়ের। হজম করতে তার সময় লেগে যায় বেশ অনেকটা। অর্থির যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থেকে বিড়বিড় করে,
‘এটা কি সত্যিই অর্থি ছিলো! সেই অর্থি!’
চলবে..