চৈত্রিকা পর্ব-২১+২২

0
463

#চৈত্রিকা (২১+২২)
#বোরহানা_আক্তার_রেশমী
_______________

৬১.
কেটেছে বেশ ক’দিন। এর মধ্যে প্রায় সবকিছুই ঠিকঠাক। অর্পিতাও সুস্থ হয়ে উঠেছে তবে আগের চেয়ে অনেক বেশি চুপচাপ হয়ে গেছে। কারো সাথে প্রয়োজন ব্যাতীত কোনো কথা বলে না। চিত্র এমনিতেই আগে থেকে শান্তশিষ্ট, চুপচাপ ধরনের। এসব ঘটনার পর আরো বেশি চুপচাপ হয়ে গেছে। সহজে অর্পিতার সামনে পড়ে না। অর্পিতার চোখের দিকে তাকায় না। চৈত্রিকা আর প্রহরের সম্পর্ক যেমন ছিলো তেমনই আছে। অর্থি আর নিবিড়ের মধ্যকার অভিমান এখনো মেটেনি। নিবিড় প্রথম দু’দিন অভিমান ভাঙানোর চেষ্টা করলেও এখন আর করে না। তার একমাত্র কারণ অর্থির পড়ালেখা। নিবিড়ের ওপর অভিমান করে সে এখন ঠিকমতো পড়া দেয়। তাই নিবিড়ও বেশি ঘাটায় না। যা করলে মেয়েটার ভালো হবে তাই করুক। তার ওপর অভিমান করেও যদি পড়ালেখা করে তবে এই অভিমানে ক্ষ’তি নেই। প্রতিদিনের মতোই ঘুম থেকে উঠে অর্থি পড়তে বসেছে। আগের মতো চঞ্চলতা নেই মেয়েটার মধ্যে। এখন সারাদিন পড়ালেখা নিয়েই বসে থাকে। একটা ঘটনার পর যেনো পুরো জমিদার বাড়িটাই নিশ্চুপ হয়ে গেছে। বাকিরা সবাই অর্থির পরিবর্তন পড়ালেখার জন্য ভাবলেও পল্লবী ভেতরে ভেতরে অস্থির হয়ে আছে। মেয়েটার হঠাৎ কি হলো? সকাল সকালই মেয়ের সাথে কথা বলার জন্য অর্থির ঘরে আসে পল্লবী। অর্থিকে পড়তে দেখে বেশ স্বাভাবিক গলায় বলে,

‘যে মেয়েকে টেনে তুলে পড়তে বসাতে পারতাম না সে মেয়ে নিজেই সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে পড়তে বসেছে! কি হয়েছে রে তোর? তুই না সারাদিন বলিস ‘পড়তে ভাল্লাগে না আম্মাজান।’ এখন আবার নিজেই পড়ছিস!’

অর্থি ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বলে, ‘না পড়লে তো বকা দেন এখন পড়তেছি তাও বকাবকি করতেছেন আম্মাজান!’

‘তোকে বকলাম কখন? তোর পরিবর্তন টা আমার চোখে পড়লো তাই জিজ্ঞেস করলাম!’

অর্থি কিছু বলে না। পল্লবী কিছুটা সময় চুপ থেকে অর্থির পাশে বসে। বই খাতা সরিয়ে মেয়েকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে নেয়। অর্থি ফ্যালফ্যাল করে তাকায় নিজের আম্মাজানের দিকে। পল্লবী অর্থির মুখ দুহাতের আজলে আগলে নিয়ে সরাসরি তাকায় মেয়ের চোখের দিকে। অর্থি নিজেও তাকায়। পল্লবী অদ্ভুত ভাবে হেঁসে বলে,

‘মেয়ের চোখে যে অন্য কিছু দেখা যায়!’

অর্থি চোখ সরিয়ে নেয় দ্রুত। দৃষ্টি এদিক ওদিক করে আবার তাকায় নিজের মায়ের দিকে। পল্লবী তখনো নিজের মেয়েকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে ব্যস্ত। তার মেয়ে তো চাপা স্বভাবের নয়! সামান্য কিছু হলেও তো এই মেয়ে পুরো বাড়ি মাথায় তুলে ফেলে৷ সাথে প্রহর আর চিত্র বাড়িতে থাকলে সেদিন আর জমিদার বাড়ি কোনোরকমেই বাড়ি থাকে না৷ অথচ মেয়ের চোখে স্পষ্ট কিছুর বেদনা, চাপা অভিমান ছিলো! অর্থি পল্লবীর এমন করে তাকিয়ে থাকা দেখে ভয় পেয়ে যায়। চোখ ছোট ছোট করে বলে,

‘আম্মাজান ওভাবে কি দেখেন? আমি কিন্তু কিছু করিনি৷ বকা দিবেন না একদম।’

পল্লবী হাসে। মেয়ের বই খাতা সব তুলে টেবিলের ওপর গোছাতে গোছাতে বলে, ‘আজ আর পড়তে হবে না। চল আজ তুই, বড় বউ, মেজো বউ আর অর্পিতার সাথে জমিয়ে গল্প করবি। সামনেই তো তোর মাধ্যমিক! মাথায় বেশি চাপ নিবি না৷ অল্প অল্প করে সবটা পড়ে ফেলবি।’

অর্থি বাধ্য মেয়ের মতো মাথা নাড়ায়। তারপর মায়ের আঁচল ধরে হল রুমে আসে। সেখানে আগে থেকেই চৈত্রিকা, নীরা, অর্পিতা সবাই ছিলো। টুকটাক হাতে হাতে কাজ করছে। বাড়ির পুরুষরা সব তখনো ঘুমেই আছে। অর্থিকে নিচে আসতে দেখে চৈত্রিকা হেঁসে বলে,

‘পড়া শেষ অর্থি?’

অর্থি মাথা নাড়ায়। অর্পিতা একবার তার দিকে তাকিয়ে চুপচাপ নিজের মতো সোফায় বসে থাকে। অর্থি গুটিগুটি পায়ে তার পাশেই বসে। অর্পিতা টের পেয়েও কিছু বলে না৷ অর্থি ঠোঁট উল্টে বেশ নিচু স্বরে বলে,

‘তোমাকে এভাবে দেখতে একদম আমাদের তেতুল তলার শেও’ড়া পে’ত্নীর মতো লাগে আপু। তোমার এমন পে’ত্নী পে’ত্নী মুখ দেখলে কেউ তোমাকে বিয়ে করবে না।’

অর্পিতা ভাবলেশহীন ভাবে বলে, ‘সে আমাকে এমনিও কেউ বিয়ে করবে না।’

অর্থির মুখটা একটু খানি হয়ে যায়। মাথা নিচু করে বলে, ‘কেউ না করলেও আমার চিত্র ভাইয়া করবে। জানি আমি!’

অর্পিতার চোখ জোড়া চঞ্চল হয়। হার্টবিটের গতি বাড়ে। আড়চোখে একবার অর্থির মলিন মুখের দিকে তাকিয়েও চোখ সরিয়ে নেয়। কোনো রকম কথা বলে না। এতো সহজে সে চিত্রর হবে না। সজ্ঞানে, রাগের বসে যে অন্যায় সে করেছে তার জন্য শা’স্তি তাকে পেতেই হবে।

৬২.
নিজের কাজকর্ম শেষ করে চৈত্রিকা প্রহরকে ডাকতে এসেছে। প্রহর তখনো পড়ে পড়ে ঘুমোচ্ছে। প্রহরকে ঘুমন্ত অবস্থায় দেখে চৈত্রিকা খানিকটা চোখ মুখ কুঁচকায়। তারপর নিজে আগে হাতমুখ ধুয়ে এসে ডাকে প্রহরকে। প্রহর ঘুম থেকে উঠে কোনো কথা ছাড়াই কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে চৈত্রিকার মুখের দিকে। হুট করে এমন তাকানোই চৈত্রিকা ভড়কে যায়। দৃষ্টি এদিক ওদিক করে বলে,

‘এমন হা করে কি দেখেন জমিদার সাহেব?’

প্রহরের সহজ, সাবলীল জবাব, ‘জমিদার বাড়ির বড় বউকে দেখি।’

চৈত্রিকা প্রহরের এক ধ্যানে তাকানো আর কথায় খানিকটা ইতস্তত বোধ করে। কোনো রকমে প্রহরের সামনে থেকে সরে গিয়ে বলে, ‘জলদি উঠুন! আজ একটু মামা বাড়ি যাবো।’

প্রহরের ভ্রু কুঁচকে যায়। নিজের মতো উঠতে উঠতে বলে, ‘কেনো? ওখানে আবার কেনো যাবে?’

‘এমনিতেই। মামি আর সাথীর সাথে দেখা করবো। একই গ্রামে থাকি অথচ ঠিকমতে দেখা সাক্ষাৎও হয় না।’

‘তোমার মামি আর সাথীকে বলো এখানে আসতে! আমি খবর পাঠিয়ে দিচ্ছি।’

চৈত্রিকা কোমড়ে হাত দিয়ে কপালে ভাজ ফেলে তাকায় প্রহরের দিকে। পা থেকে মাথা পর্যন্ত পর্যবেক্ষণ করে বলে, ‘আমি গেলে সমস্যা কি?’

প্রহরের গম্ভীর জবাব, ‘অনেক সমস্যা আছে।’

চৈত্রিকা পাত্তা দেয় না। নিজের একটা শাড়ি বের করে আলমারি থেকে। তারপর সেটার ভাজ খুলতে খুলতে বলে, ‘আপনার এতো ভাবতে হবে না জমিদার সাহেব। আপনি গিয়ে গোসল করে আসুন আগে!’

চৈত্রিকার কথা শেষ হওয়ার সাথে সাথেই তার হাতে টান পড়ে। প্রহর চৈত্রিকার হাতের বাহু চেপে ধরে নিজের কাছাকাছি এনে দাঁড় করায়। দুজনের মধ্যে খানিকটাও দূরত্ব নেই। চৈত্রিকা চমকে মাথা উচিয়ে তাকিয়ে থাকে প্রহরের মুখের দিকে। গম্ভীর মুখটায় যেনো গাম্ভীর্যতা আরো এঁটে বসেছে। তার শক্ত সামর্থ্য পেশিবহুল বাহুতে চৈত্রিকা আটকে গেছে। সরে আসার চেষ্টা করেও কোনো প্রকার লাভ হয় না। প্রহর চোখ মুখের গাম্ভীর্য ধরে রেখে কন্ঠে দ্বিগুণ গম্ভীরতা টেনে বলে,

‘জমিদার সাহেবের গিন্নির জন্য জমিদার সাহেবই ভাববে এটাই স্বাভাবিক নয় কি মিসেস চৈত্রিকা প্রহর রেনওয়াজ?’

চৈত্রিকা বড় বড় শ্বাস নেয়। নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করে। পুরুষ মানুষের এতো কাছাকাছি থাকা কি চারটে খানি কথা? সে তো এতো গভীর ভাবে কোনো পুরুষের সাথে মেশেনি। তাও আবার পুরুষটি তার স্বামী। কিন্তু চৈত্রিকার অদ্ভুত ব্যবহার মানেই প্রহর তার দুর্বলতা টের পাবে। তাকে দুর্বল করতে হাজারও বার এমন দূরত্ব মেটাবে না তার কি মানে আছে! মনে মনে নিজেকে শক্ত করে। ততক্ষণে প্রহর তাকিয়েই আছে চৈত্রিকার মুখের দিকে। এক পলকের জন্যও তার দৃষ্টি এদিক ওদিক হয়নি কিংবা চোখের পলকও পড়েনি। চৈত্রিকাকে আরো শক্ত করে চেপে ধরে ন’খ বসিয়ে দেয় চৈত্রিকার কোমড়ে। চৈত্রিকা চোখ বন্ধ করে দাঁতে দাঁত চেপে থাকে। সে বন্ধ চোখের দিকে তাকিয়েই প্রহর আওড়ায়,

‘আমি যখন বলেছি তুমি ওই বাড়িতে যাবে না। তার মানে যাবে না।’

চৈত্রিকারও কাঠকাঠ জবাব, ‘আমি যাবোই।’

প্রহরের কপালে ভাজ পড়ে। মেয়েটা তৈরী কি দিয়ে! সবসময় তেজ, জিদ দেখানোটা কি তার স্বভাব? নিজেকে যথেষ্ট শান্ত রাখার চেষ্টা করে। চৈত্রিকা চোখ তুলে প্রহরের চোখের দিকে তাকায়। তারপর প্রহরের হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করে বলে,

‘আমাকে ছাড়ুন জমিদার সাহেব! আপনাকে আগেও বলেছি আবারও বলছি আপনার এতো কাছে আসা পছন্দ নয় আমার।’

‘পছন্দ না হলেও আমি কাছে আসবোই চৈত্রিকা। ধর্মমতে বিয়ে করা বউ তুমি আমার। তোমার থেকে দুরে থাকার প্রশ্নই আসে না। আর যদি এতোই আমার স্পর্শ বিরক্ত লাগে তবে বিয়ে করার আগে ভাবলে না কেনো? তাই এখন তোমার পছন্দ কিংবা অপছন্দেই আমার স্পর্শ তোমার মেনে নিতে হবে।’

চৈত্রিকা মুখ ফিরিয়ে নেয়। প্রহর বাঁকা হেঁসে সরাসরি তার কপালে গভীর চুম্বন এঁটে দেয়। চৈত্রিকা কেঁপে ওঠে। ২য় বারের মতো চমকে উঠে নিজের অজান্তেই আঁকড়ে ধরে প্রহরের টি-শার্ট। প্রহর ছেড়ে দেয় চৈত্রিকাকে। চৈত্রিকা ছাড়া পেয়েই দ্রুত সরে যায় দুরে। বড় বড় শ্বাস নিয়ে মনে মনে বকা দেয় জমিদার সাহেবকে। প্রহর ঠোঁট কামড়ে আলমারি থেকে নিজের কাপড় নিয়ে গোসলখানায় ঢুকে পড়ে। চৈত্রিকা আড়চোখে তা দেখে ঘন ঘন শ্বাস নিয়ে বসে পড়ে বিছানায়। ‘থ’ মে’রে কিছুক্ষণ মেঝেতে তাকিয়ে থেকে নিজের কপালে হাত দেয়। মেয়েটা কি জানে তার প্র’তিশো’ধের আ’গুন বাড়ার সাথে সাথে গালদুটোই লজ্জার আভাও বাড়ছে! উহু জানে না মেয়েটা। কারণ সে তখনো নিজের প্র’তিশো’ধের আ’গুনে মত্ত্ব। যেদিন সে বুঝবে, জানবে তখন তার কেমন অবস্থা হবে? খেয় হারিয়ে ফেলবে না তো আবার!

৬৩.
চৈত্রিকার জিদের কাছে হার মেনে প্রহর নিজেই তাকে নিয়ে যাচ্ছে আজম আলীর বাড়ি। লাল পাড়ের শুভ্র শাড়ি জড়িয়েছে গায়ে। চুলগুলো খোঁপা করে মাথায় আঁচল টেনে নিয়েছে। প্রহর বার বার আড়চোখে তাকাচ্ছে তার দিকে। তাতে অবশ্য চৈত্রিকার হেলদোল নেই। সে নিজের মতো রোদ আড়াল করতে বার বার নিজের মাথার ঘোমটা ভালো করে টেনে নিচ্ছে। দু হাত ভর্তি কাঁচের রেশমী চুড়ি পড়া। প্রহর অন্যদিকে তাকিয়ে ঘন ঘন শ্বাস নেয়। নিজেকেই বকা দিয়ে বিড়বিড় করে বলে,

‘মেয়েটা কি সাং’ঘা’তিক! বাড়িতে থাকলে তো কখনো আমার সামনে এতটুকুও সাজগোজ নেই অথচ মামার বাড়ি যাচ্ছে কি সুন্দর সেজেগুজে। সে কি আর জানে তার এই রুপ আমাকে কিভাবে ঘায়েল করে! তাকালেই তো আমি নিজের খেয় হারিয়ে ফেলি। এ মেয়ে কবে বুঝবে?’

চৈত্রিকা শুনতে পায় না সে কথা। সে চলছে নিজের মনে। নিজ মনের চিন্তা ভাবনায় সে এতোই মগ্ন যে তার পাশে তার জমিদার সাহেবের কথা বোধহয় তার মনেই নেই। প্রহর গাছের ছায়াতে এসে চৈত্রিকাকে বলে,

‘একটু জিড়িয়ে নেও! আর একটু গেলেই তো আজম আলীর বাড়ি। ঘেমে নেয়ে তোমার মুখ বেয়ে ঘামের পানি পড়ছে রীতিমতো।’

চৈত্রিকা তাকায় প্রহরের দিকে৷ আগা গোড়া পর্যবেক্ষণ করে বলে, ‘ব্যাপার কি জমিদার সাহেব? মনে হচ্ছে বউয়ের দিকে একটু বেশিই তাকাচ্ছেন? খেয়াল রাখছেন! মহুয়া বুবুর প্রতি ভালোবাসা কি তবে উড়ে উড়ে আমার ডানায় এলো নাকি?’

মহুয়ার নাম শুনেই প্রহরের মাথায় আগুন জ্ব’লে ওঠে। হাত মুষ্টিবদ্ধ করে অন্যদিকে তাকায়৷ কাঠকাঠ গলায় বলে, ‘কারো প্রতি ভালোবাসা কারোর ডানায় উড়ে যায়নি! তুমি আমার বৈধ স্ত্রী তাই তোমার দিকে তাকানো, তোমার খেয়াল রাখা আমার কাছে তেমন কোনো বড় ব্যাপার না। আর যদি আসে ভালোবাসার কথা তবে বউকে ভালোবাসতে আবার অন্যের ভালোবাসা আনতে হবে কেনো?’

চৈত্রিকা কিছু বলে না৷ শুধু তাকিয়ে থাকে প্রহরের রাগ হওয়া লাল মুখের দিকে। মনে মনে আওড়ায়, ‘আপনি মোটেও সহজ না জমিদার সাহেব। আপনি এক রহস্য মানব। রহস্যের এক বিশাল জট আপনি!’

চৈত্রিকা আর প্রহর খানিকটা সময় দাঁড়িয়ে থাকো। প্রহরের রুমাল দিয়েই নিজের মুখের ঘাম মুছে নেয় চৈত্রিকা। এরপর দুজনে কোনো রকম কথা ছাড়াই চলে আসে আজম আলীর বাড়ি৷ আজম আলী তখন বাড়িতে নেয়। প্রহর আর চৈত্রিকাকে দেখে সাথী আর সনিয়া বেগম ভীষণ খুশি হন। প্রহরকে আগে বসতে দিয়ে সাথীকে বলে নাস্তা আনতে। প্রহর বেশ নম্র গলাতেই বলে, ‘এসবের কোনো প্রয়োজন নেই মামিমা। আমি আসলে চৈত্রিকাকে দিতে এসেছি। মামা নেই বাড়িতে?’

সনিয়া বেগম মাথা নাড়িয়ে ‘না’ বোঝায়। প্রহর ভেতরে ভেতরে শান্ত হয়। সনিয়া বেগম, চৈত্রিকা, সাথী সবাইকে বিদায় জানিয়ে নিজে বাড়ি থেকে বের হয়। সনিয়া বেগমের কথায় শুধুমাত্র এক গ্লাস পানি খেয়েই বের হয়েছে। প্রহর যেতেই সনিয়া বেগম নিচু স্বরে বলে,

‘তুই একটু এগিয়ে দিয়ে আয় উনাকে!’

চৈত্রিকা একটুও গায়ে মাখে না সে কথা। নিজের মাথার আঁচল খুলে হাত পাখা দিয়ে হাওয়া খেতে খেতে বলে, ‘উনি কি বাচ্চা নাকি যে আমার এগিয়ে দিতে হবে! এসব ছাড়ো আর আমার খাতিরযত্ন করো দেখি! জমিদার বাড়ির বড় বউ আসছে তোমাদের বাড়ি হুহ!’

চৈত্রিকার কথার ধরণে হেঁসে ফেলে সনিয়া বেগম আর সাথী। সনিয়া বেগম চৈত্রিকার কান মুলে দিয়ে বলে, ‘তাই না! এমন পি’টুনি দেবো যে তুমি কোন বাড়ির মেয়ে আর কোন বাড়ির বউ সব ভুলে যাবে!’

চৈত্রিকা সনিয়া বেগমের হাত ছাড়াতে ছাড়াতে বলে, ‘মামি ব্যাথা পাচ্ছি তো! ছাড়ো জলদি।’

সনিয়া বেগম ছেড়ে দেয়। সাথী হেঁসে বলে, ‘আজ কিন্তু তোকে অনেক সুন্দর লাগছে চৈত্র! একদম জমিদার গিন্নি মনে হচ্ছে।’

‘তুইও এ কথা বলছিস? তুই তো জানিসই অর্থি কেমন! আসার আগে অন্তত ১০ বার বলেছে, ‘ভাবীজান আপনাকে অনেক সুন্দর লাগছে।’ একটু পর পর ঘুরে ফিরে এসে একই কথা বলে। আমার মনে হয় জমিদার সাহেব কখনো সুন্দর বললেও আমি এতো লজ্জা পাবো না যতটা অর্থি বললে পাই।’

৩ জনই হাসে। টুকটাক কথার পর চৈত্রিকা আশে পাশের পরিবেশ পর্যবেক্ষণ করে নিচু স্বরে বলে, ‘আজ আমার এখানে আসার একটা কারণ আছে মামি!’

সনিয়া বেগম আর সাথী জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকায়। চৈত্রিকার দৃষ্টি চঞ্চল হয়। ভালো মতো চারপাশে তাকিয়ে বেশ ছোট করে বলে, ‘তোমার কাছে কিছু জানার ছিলো!’

‘কি রে?’

‘মহুয়া বুবু আর জমিদারের মেজো ছেলের মধ্যে কি কোনো রকম অ’বৈ’ধ সম্পর্ক ছিলো মামি?’

৬৪.
পিয়াস সকালের নাস্তা শেষ করেই কোথাও বের হওয়ার জন্য তৈরী হচ্ছিলো। নীরা ঘরে এসে আঁড়চোখে একবার তা পরখ করে নিয়ে বেশ স্বাভাবিক ভাবেই বলে,

‘কোথাও যাচ্ছেন?’

পিয়াস নিজের কাজ করতে করতেই বলে, ‘তোমাকে বলতে হবে?’

‘আপনি সবসময় এভাবে কথা কেনো বলেন? কোথাও যাচ্ছেন এটা বলে গেলেই তো হয়!’

পিয়াস তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকায়। নিজের কাজ থামিয়ে বলে, ‘তুমি আবার মুখে মুখে তর্কও করা শিখে গেছো?’

‘মুখে মুখে তর্ক করছি না। আমি আপনার স্ত্রী। আপনি কোথায় যাচ্ছেন, কেনো যাচ্ছেন এগুলো জানার সম্পূর্ণ অধিকার আমার আছে!’

পিয়াস জ্ব’লে ওঠে। বি’শ্রী ভাষায় গা’লি দিয়ে বলে, ‘স্ত্রীর অধিকার তোর গলায় পা’ড়া দিয়ে বের করবো। বড় বড় কথা বলা শিখছিস!’

নীরার কান ঝা ঝা করে ওঠে। ক্রুদ্ধ নয়নে পিয়াসের দিকে তাকিয়ে বলে, ‘ভাষা ঠিক করে কথা বলেন! আপনার কথার পিঠে কোনো সময় কথা বলি না মানে এই না আমি কিছু বলবো না। এবাড়িতে এখন এমন একজন নারী আছে যে আপনাকে পি’ষে ফেলতে পারবে।’

নীরার এ কথার পিঠে চোখ মুখ কুঁচকে নেয় পিয়াস। নীরা ত্রুর হেসে বলে, ‘আপনার কি মনে হয় সেদিন আমি দেখিনি বড় ভাবী আপনাকে থা’প্প’ড় মে’রেছিলো? অবশ্য এটা আপনার জন্য ভীষণ বেশি দরকার ছিলো। যে ভাই নিজের বড় ভাইয়ের বউয়ের দিকে কু’নজ’র দেয় তার জন্য এই একটা থা’প্প’ড় যথেষ্ট না।’

পিয়াস তেড়ে আসে। নীরা এক পাও সরে না। অনেক অন্যায় সহ্য করার পর এবার মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে সে। এবার এই জমিদারদের অন্যায়ের শা’স্তি নিজ চোখে দেখার সাথে সাথে নিজেও সামিল হবে শা’স্তি দেওয়ার কাজে। পিয়াস নীরার সাহস দেখে অবাকের ওপর অবাক হয়। যে মেয়ে কখনো তার চোখের দিকে তাকিয়েও কথা বলে না! একটা ধমক খেলেই চুপচাপ সরে যায়! সে মেয়ে আজ তার চোখে চোখ রেখে তারই মুখের ওপর কথা বলছে! এসব কিছুর সাহস কি তবে চৈত্রিকার থেকে পাচ্ছে? চৈত্রিকার ওপর ক্ষো’ভ আকাশ ছুঁয়ে যায় পিয়াসের। নীরাকে কিছু না বলে গটগট করে ঘর থেকে বের হতে হতে নিজেই বলে,

‘তোমার ডানা কে’টে দিবো কৌশলে চৈত্রিকা। তুমি ধীরে ধীরে বাজিমাত করো আমি একেবারে বাজিমাত করে তোমাকে চুপ করিয়ে দেবো। আমাকে দেওয়া থা’প্প’ড়ের বদলে তোমাকে যদি নিজের বিছানা পর্যন্ত টেনে না আনতে পারি তবে এই আমি পিয়াস রেনওয়াজ নই। অপেক্ষা করো চৈত্রিকা! উফফস সরি বড় ভাবীজান।’

পিয়াসের মুখের কু’টিল হাসি চওড়া হয়। লা’লসা ভরা ঘৃ’ণ্য এক হাসি দিয়ে নিজের চুল ঠিক করতে করতে চলে যায় বাড়ির বাহিরে। নীরা তাকিয়ে থাকে সে হাসির দিকে। মনে মনে অজানা ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে যায়। এ যেনো আবারও এক মৃ’ত্যু খেলা!

চলবে..