চৈত্রিকা পর্ব-২৩+২৪

0
505

#চৈত্রিকা (২৩)
#বোরহানা_আক্তার_রেশমী
_______________

৬৫.
সন্ধ্যার আগে আগেই প্রহর আসে চৈত্রিকাকে নিতে। সারাদিন চৈত্রিকাকে এ বাড়িতে রাখলেও রাতে সে এখানে থাাকার অনুমতি দেবে না। চৈত্রিকাও আর জিদ করেনি৷ যে উদ্দেশ্যে তার আসা সে উদ্দেশ্য পূরণ হয়েছে। সারাদিনে আজম আলী দুপুরে একবার বাড়ি এসেছিলো তবে চৈত্রিকাকে দেখে কোনো রকম প্রতিক্রিয়া না করে উল্টো নিজের মতো খাওয়া দাওয়া করেই বের হয়ে গেছে। এতে তো চৈত্রিকা যারপরনাই অবাক। হঠাৎ করে আজম আলী একদম চেঞ্জ! মনে মনে সারাদিনের সকল বিষয় গুলো ঘাটছিলো আর নিজের শাড়ি ঠিক করছিলো। তখন বাহির থেকে হাঁক ভেসে আসে প্রহরের। চৈত্রিকা নিজেকে সামলে নিয়ে দ্রুত নিজের চুল খোঁপা করে মাথায় আঁচল টেনে নেয়। বাহিরে এসে দেখে প্রহর উঠোনের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে। গরমে ঘেমে গেছে বেচারা। চৈত্রিকাকে দেখে মুখটা যেমন গম্ভীর ছিলো তেমন গম্ভীর রেখেই বলে,

‘সন্ধ্যা হয়ে যাচ্ছে। জলদি চলো!’

চৈত্রিকা মাথা নাড়িয়ে সনিয়া বেগম আর সাথীর থেকে বিদায় নেয়। তারপর দুজনে একসাথে পা মিলিয়ে হাঁটতে শুরু করে। প্রহরের চোখ মুখ গম্ভীরতায় ছেয়ে আছে। তার ভেতরের খবর বোঝা কঠিন। চৈত্রিকা চুপচাপ নিজের মতো হাঁটছে। আশে পাশে মানুষ কাজ শেষ করে ঘরে ফিরছে। প্রহরকে দেখে সালাম দিচ্ছে তবে চৈত্রিকার দিকে কেউ ভুল করেও তাকাচ্ছে না৷ প্রথমদিকে চৈত্রিকা এটা খেয়াল না করলেও পরেরদিকে একটু অবাক হয়। যার সাথেই দেখা হচ্ছে সে প্রহরকে সালাম দিয়ে মাথা নিচু করে চলে যাচ্ছে। চৈত্রিকা ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বলে,

‘সাধারণত কোনো মেয়ে মানুষ দেখলে পুরুষ মানুষরা এক পলক হলেও তাকায় কিন্তু যারা সামনে দিয়ে যাচ্ছে এরা তো একপলকও তাকাচ্ছিলো না আমার দিকে। এটা কি অতি সাধারণ ব্যাপার নাকি জমিদার বাড়ির কোনো জটিল ব্যাপার জমিদার সাহেব?’

প্রহর জবাব দিলো না। সিনা টান টান করে শুধু নিজের মতো হেঁটে গেলো। চৈত্রিকা ঘাড় বাকিয়ে তাকায় প্রহরের দিকে। প্রহরের হঠাৎ এরুপ ব্যবহার ঠিক বোধগম্য হলো না তার। প্রহর তো তার প্রশ্নের জবাব না দিয়ে এমন করে চলে যাওয়ার মানুষ না! তবে? কি হয়েছে জমিদার সাহেবের? চৈত্রিকা নিজ মনের চিন্তা ভাবনা ধরে রেখেই হাঁটতে থাকে। এর মাঝেই দুজনে চলে আসে জমিদার বাড়ির সামনে। পাশেই জমিদার বাড়ির বড় দিঘী। সেখানেই দাঁড়িয়ে পেছন থেকে প্রহর বলে,

‘চৈত্রিকা! বিশ্বাস’ঘা’তকতার শা’স্তি কি জানো?’

চৈত্রিকার পা দুটো থেমে যায়। গরমে ঘেমে যাওয়া মুখ নিয়েই ফিরে তাকায় প্রহরের দিকে। প্রহর তখনো এক দৃষ্টে তার দিকে আছে। চৈত্রিকা অবাক কন্ঠে বলে, ‘মানে?’

প্রহর পলক না ফেলে তাকিয়ে থাকে। চৈত্রিকার চোখে মুখে অবাকতার রেশ ছাড়া চমকানো বা থমকানোর কোনো রেশ বিন্দুমাত্র নেই। চৈত্রিকার চোখের দিকে তাকিয়ে থাকে সরাসরি। চোখ না সরিয়েই বলে,

‘মানে বিশ্বাসঘা’ত’কতার শা’স্তি কি জানো?’

চৈত্রিকা অবাকতা দমিয়ে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকায়। প্রহর অদ্ভুত ভাবে হেঁসে কোনো রকম বাক্য ছাড়াই তাকায় পাশে থাকা দীঘির দিকে। চৈত্রিকা প্রহরকে দেখে নিজেও তাকায় পাশে থাকা দীঘির দিকে। প্রথম দিকে বুঝতে অসুবিধা হলেও পরক্ষণেই প্রহরের ইঙ্গিত বুঝে যায়। চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে থাকে প্রহরের দিকে। কিছু বলার আগেই প্রহর নিজ স্থান ত্যাগ করে।

৬৬.
চৈত্রিকা রাতের বেলায় বিছানার ওপর বসে বসে প্রহরের বিকেলের কথাগুলো ভাবছিলো। প্রহরের রহস্যে তার পুরো মাথাটাই খু’লে প’ড়ে যাওয়ার মতো অবস্থা। চৈত্রিকার মাথা ব্যাথা শুরু হয়। মাথা থেকে সব বের করে দিয়ে মাথা ঠান্ডা করে নেয়। এরপর ভাবতে শুরু করে জমিদার বাড়ির প্রতিটি সদস্য নিয়ে। এরমাঝেই দরজা খোলার শব্দ কানে আসে। চৈত্রিকা মাথা উঁচিয়ে সেদিকে তাকিয়ে দেখতে পায় প্রহরকে। চৈত্রিকা কপালে ভাজ ফেলে তাকিয়ে থাকে। প্রহর নিঃশব্দে চৈত্রিকার কাছে আসে। পা থেকে মাথা পর্যন্ত পর্যবেক্ষণ করে পেছনে থাকা হাত থেকে একটা ব্যাগ বের করে। চৈত্রিকা শুধু তাকিয়ে দেখে কোনোরুপ কথা বলে না। প্রহর ব্যাগ থেকে একটা আলতার বোতল বের করে চৈত্রিকার পায়ের কাছে বসে। চৈত্রিকার পায়ের দিকে হাত বাড়াতে নিলেই ফট করে পা সরিয়ে নেয় চৈত্রিকা। ভ্রু কুঁচকে বলে,

‘কি হয়েছে? পায়ে হাত দিচ্ছেন কেনো?’

প্রহরের সহজ জবাব, ‘বউয়ের পায়ে আলতা পড়াবো তাই।’

চৈত্রিকা মনে মনে বকা দেয় প্রহরকে। নিজ মনেই আওড়ায়, ‘ঢঙ দেখলে বাঁচি না ভাই। একবার নিজেই মা’রার হুমকি দেয় আবাার নিজেই আসছে আমার পায়ে আলতা লাগাতে! মানে এ যেনো গরু জ’বাইয়ের আগে তার সেবাযত্ন।’

প্রহর চৈত্রিকার চোখ মুখের দিকে এক পলক তাকিয়ে হুট করেই চৈত্রিকার পা টেনে ধরে। চৈত্রিকা চমকে উঠে পা সরাতে নিলে প্রহর কঠিন কন্ঠে বলে,

‘এতো পাকামো আমার পছন্দ নয়। মনে মনে যা ইচ্ছে ভাবো তাতে আমার কিছু বলার নাই কিন্তু আমি যখন বলেছি তোমার পায়ে আলতা রাঙাবো তখন আমি রাঙাবোই। চুপচাপ বসে থাকো।’

‘আপনার স্পর্শও আমার পছন্দ নয়। পা ছাড়ুন তো!’

প্রহর তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকায়৷ সে দৃষ্টি চৈত্রিকার ওপর রেখেই বলে, ‘বার বার এক কথা বলে কি মজা পাও? আমি বলেছি না তোমাার পছন্দ হলেও এই স্পর্শ পাবে পছন্দ না হলেও পাবে!’

চৈত্রিকা কিছু বলতে নিলে প্রহর চোখ রাঙায়। চৈত্রিকার ভ্রু কুঁচকে যায়। লোকটার কি মাথার তা’র ছিড়ে গেলো? তাকে চোখ রাঙাচ্ছে! মানে চৈত্রিকা কি ভয় পায় নাকি! মুখ বাঁকিয়ে নিজের মতো বসে থাকে। প্রহর ঠোঁট চেপে হেঁসে নিজের মতো করে চৈত্রিকার পায়ে আলতা দিয়ে দেয়। ফর্সা পায়ে আলতা যেনো ফুটে উঠেছে। সেই আলতা রাঙা পায়েই প্রহর পড়িয়ে দেয় এক জোড়া নুপুর। চৈত্রিকা ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। যে মানুষটা বিকেলে ওমন করলো সে হঠাৎ করে এতো ভালোবাসা কেনো দেখাচ্ছে! এ ভালোবাসা কি আদৌও সত্য নাকি শুধুমাত্র দেখানো! এগুলোর পেছনে অন্য কোনো কারণ নেই তো? কোনো রহস্য নেই তো? চৈত্রিকার ভাবনার মাঝেই প্রহর তার পায়ের পাতায় ঠোঁট ছোঁয়ায়। চৈত্রিকা চমকে, কেঁপে ওঠে। দ্রুত পা সরিয়ে নেয়। প্রহর কপালে থাকা চুলগুলো সরিয়ে তাকায় চৈত্রিকার দিকে। চৈত্রিকা দৃষ্টি এদিক ওদিক করে দ্রুত বিছানা থেকে নেমে যেতে নেয়। প্রহর হাত ধরে আটকে দিয়ে হুট করে টেনে শুইয়ে দেয়। ঘটনার আকস্মিকতায় চৈত্রিকা হতভম্ব। প্রহর নিজেও পাশে শুয়ে পড়ে। চৈত্রিকাকে টেনে নেয় নিজের প্রশস্ত বুকে। কি থেকে কি হচ্ছে তা
ভাবতে ভাবতেই চৈত্রিকাা যেনো ঘোরে চলে গেছে। পিটপিট করে তাকিয়ে আছে প্রহরের মুখপানে। প্রহর চোখ বন্ধ করে বলে,

‘আজ থেকে এ প্রশস্ত বক্ষপিঞ্জরই তোমার সঠিক, নিরাপদ স্থান।’

চৈত্রিকা কোনো কথা ছাড়াই তাকিয়ে থাকে প্রহরের দিকে। পলক না ফেলে তাকিয়ে প্রহরকে বোঝার চেষ্টা করে। যে পুরুষের চোখের গভীরতাই চৈত্রিকার মতো নারী বুঝতে পারে না সে নারী কি করে এই পুরুষটির মুখভাব দেখে ভেতরের খবর বোঝার চেষ্টা করে! চৈত্রিকা দীর্ঘশ্বাস নেয়। চোখ নামিয়ে নিয়ে নিজেকে শান্ত করে। তারপর ঠান্ডা মাথায় নিজেকে প্রহরের থেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করে। তাতে তো সে নিজেকে ছাড়াতে পারেই না উল্টো আরো ফেঁসে যায় প্রহরের শক্ত সামর্থ্য পেশিবহুল বাহুতে। ক্লান্ত হয়ে হাল ছেড়ে দেয়। প্রহরের ঠোঁটের কোণে দেখা মিলে অদ্ভুত হাসি। সে হাসি মিলিয়ে নিয়ে ভীষন নিচু স্বরে বলে,

‘জমিদার সাহেবের থেকে নিজেকে ছাড়ানো এতো সহজ নয় চৈত্রিকা। আর না এই জমিদারকে বোঝা সহজ!’

৬৭.
অর্পিতা নিজের ঘরে বসে বসে চুল বেনুনী করছিলো। সেসময় আসে শায়লা। মেয়েকে এমন নিস্তেজ দেখে তার আর ভালো লাগে না৷ সে জানে নিজের বোনের কর্মকান্ড। পল্লবী তাকে বুঝিয়ে বলেছে সবটা। নিজের একটা ভুল সিদ্ধান্তে আজ তার মেয়েটা কেমন অনুভূতিশূণ্য। অপরাধবোধ কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে তাকে। মলিন মুখে এসে বিছানার ওপর বসে। অর্পিতা এক পলক নিজের মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে নিজের কাজে মন দেয়। শায়লা উসখুস করতে থাকে। অর্পিতা তা আড়চোখে খেয়াল করে বলে,

‘কিছু বলবেন আম্মাজান?’

শায়লা করুণ চোখে তাকিয়ে বলে, ‘এভাবে কতদিন কাটাবি মা? তোর এমন নিস্তেজ, নিস্তব্ধ রুপ যে আমাকে পু’ড়িয়ে মা’রে।’

‘আপনি বেশি বেশি ভাবছেন আম্মাজান। আমি আগের মতোই আছি।’

‘আমি তোর মা। তুই কেমন আছিস তা আমি নিজ চোখেই দেখতে পাচ্ছি।’

অর্পিতা কোনো কথা বলে না। চুপচাপ নিজের মতো বসে আয়নায় নিজের প্রতিবিম্বর দিকে তাকিয়ে থাকে। সে সত্যিই আর আগের মতো নেই। এতোকিছুর পর কি আগের মতো হওয়া যায়? তার ভাবনার মাঝেই বেশ ইতস্তত স্বরে শায়লা বলে,

‘তুই চাইলেই কিন্তু চিত্রর সাথে সবটা ঠিক করে নিতে পারিস। ছেলেটা তোকে পছন্দ করে তাছাড়া তুইও তো পছন্দ করিস।’

‘এসব ছাড়া অন্য কিছু কি আপনার বলার আছে আম্মাজান?’

শায়লা বোঝে তার মেয়ে তার সাথে এই বিষয়টা নিয়ে কথা বলতে চাচ্ছে না৷ তাই হতাশার শ্বাস ফেলে মেয়ের দিকে তাকিয়ে থাকে। কিছু সময় দুজনের মাঝেই চলে পিনপতন নীরবতা। এরপর চুপচাপ শায়লা উঠে নিজের ঘরে চলে যায়। অর্পিতা ওভাবেই বসে থাকে। নিজের প্রতিবিম্বের থেকে চোখ সরায় না। ঘোর লেগে যায় তবুও দৃষ্টি সরায় না অন্যদিকে। মাথা ঘুরিয়ে উঠতেই চোখ বন্ধ করে নেয়। সাথে সাথেই চোখের কোণা বেয়ে এক ফোঁটা জল গড়ায়। অর্পিতা উঠে এসে দাঁড়ায় জানালার কাছ ঘেঁষে। বাহিরে গোল একটা চাঁদ উঠেছে। চাঁদের চারপাশে তারার ঝলকও আছে৷ সব মিলিয়ে বাহিরের সবটা,পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। অর্পিতা অনেকটা সময় সেখানে দাঁড়িয়েই কাটিয়ে দেয়। যেনো কারো অপেক্ষায় আছে। অদ্ভুত ভাবেই গভীর রাতে সেই ঘরে পা রাখে চিত্র। পুরো বাড়ি যখন ঘুমন্ত পুরী তখন অর্পিতা আর চিত্র মুখোমুখি দাঁড়িয়ে। চিত্র অর্পিতাকে জেগে থাকতে দেখে প্রথমে চমকায়। কিন্তু অর্পিতা চমকায়নি। খানিকটা অবাকও হয়নি। যেনো সে আগে থেকেই জানতো আজ এই ঘরে চিত্রর পদচারণ ঘটবেই। চিত্রর চোখে মুখে দ্বিধাদন্দের আভাস থাকলেও অর্পিতা তাকিয়ে আছে নির্নিমেষ। যেনো তার চোখ মুখে কোনো ধরনের দ্বিধার খানিকটাও ছাপ নেই। দুজনের মাঝেই রয়েছে পিনপতন নীরবতা। চিত্র যেভাবে, যেখানে দাঁড়িয়ে ছিলো সেখানেই থাকে। এগিয়ে আসে অর্পিতা। সরাসরি চোখের দিকে তাকিয়ে শুধায়,

‘এতো রাতে আমার ঘরে কি করো চিত্র ভাই?’

চিত্র চোখ নামিয়ে নেয়। দৃষ্টি এদিক ওদিক করে উত্তর ভাবতে থাকে। সে কেনো এসেছে এখানে? নিজেও কি জানে এ প্রশ্নের উত্তর! অনেকটা সময় পরও যখন চিত্র কোনো প্রকার জবাব দেয় না তখন অর্পিতা ফের বলে,

‘গভীর রাতে কোনো যুবতী মেয়ের ঘরে কোনো পুরুষ আসলে কি সেই মেয়েকে ভালো বলা হয় চিত্র ভাই? বার বার কি আমার সম্মানে হাত না দিলেই নয়? তুমি কি ভাবো তুমি প্রতিদিন রাতের আঁধারে এ ঘরে আসো এটা কখনোই কারোর চোখে পড়বে না?’

চিত্র অবাক হয়ে তাকায়। অর্পিতার কঠিন চোখ মুখ দেখে তার ভেতরের অসহায়ত্ব টের পায়। অর্পিতা চোখ মুখ ফিরিয়ে নিয়ে কাঠকাঠ গলায় বলে,

‘তুমি আর কখনো এ ঘরে আসবে না চিত্র ভাই৷ সে দিন হোক কিংবা রাত! কখনোই তুমি আসবে না।’

চিত্রর হঠাৎ করে কি হলো জানা নেই। ধপ করে বসে পড়ে অর্পিতার পায়ের কাছে। অর্পিতা চমকে তাকাতেই চিত্র ভীষণ অসহায়ত্ব নিয়ে কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বলে,

‘আমি জানি নাা তোকে কি বলা উচিত আমার! আমি আর এ যন্ত্রণা বয়ে বেড়াতে পারছি না অর্পি। আমাকে এ যন্ত্রণা থেকে একটু মুক্তি দিবি? আমি কি ততোটাই খারাপ, ঘৃণ্য যতটা হলে ক্ষমা করা যায় না? আচ্ছা অর্পি পাপ করার পর মন থেকে ক্ষমা চাইলে তো সৃষ্টিকর্তাও ক্ষমা করে দেয় তবে তুই কি পারিস না আমাকে একটাবার ক্ষমা করতে! শুধুমাত্র একটাবার!’

অর্পিতা সরে যায়। কোনোরুপ প্রতিক্রিয়া না করে শুধু একটাই কথা বলে, ‘সব পাপের ক্ষমা হয় না চিত্র ভাই।’

চিত্রর কাছে বলার মতো অনেক কিছু থাকলেও গলা দিয়ে কোনো শব্দ বের হলো না। বসা থেকে উঠে অর্পিতার মুখের দিকে তাকিয়ে ঘুরে দাঁড়ায়। দরজা পর্যন্ত গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে। নিস্তেজ গলায় বলে,

‘শেষ পর্যন্ত তোর ক্ষমা না করার আক্ষেপ, আফসোস নিয়েই হয়তো আমি হারিয়ে যাবো। তুই বড্ড পা’ষাণ অর্পি। আমার এক আকাশ সমান ভালোবাসাও শুধুমাত্র একটা অন্যায়ের জন্য তোর চোখে পড়ে না। তুই ভালো থাক। কখনো যেনো আমার এ ভালোবাসা তোর প্রয়োজন না হয়! তোর যেনো কখনো আফসোস না হয়!’

চিত্র চলে যায়। শেষের কথাটুকু বলতে গিয়ে তার কন্ঠ ভারী হয়ে আসে। অর্পিতা চিত্রর যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকে। মনটা কেমন চাপা কষ্টে ভার হয়ে আসে। হুট করেই চিত্রর কথাগুলো তীরের মতো হৃদয়ে লাগে। দুদিকে দুজনেরই হৃদয় পু’ড়ে অথচ একটা দ্বিধা, একটা ভুলে দুজনেই আটকে গেছে। এ দ্বিধা শেষ হতে গিয়ে না আবার দুজনের একজন শেষ হয়!

চলবে..

#চৈত্রিকা (২৪)
#বোরহানা_আক্তার_রেশমী
________________

৬৮.
পুরো জমিদার বাড়িতে হাহাকার উঠে গেছে। কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না চিত্রকে। পল্লবী হলরুমে বসেই আহাজারি করে কাঁদছে। চয়ন,সাদিক, শিমুল, প্রহর, পিয়াস চিন্তিত মুখে বসে আছে। অর্থি নিজেও কেঁদেই চলেছে। চৈত্রিকা তাকে সামলালেও কি থেকে কি করবে কিছুই বুঝতে পারছে না। অর্পিতা এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে পল্লবীর কান্নারত মুখের দিকে। বার বার কাল রাতে চিত্রর কান্নারত মুখটা ভেসে উঠছে। শায়লা পাশে বসে মেয়ের দিকে তাকিয়ে আছে। পল্লবীর কাছেই নাসিমা আর নীরা বসে আছে। সকাল বেলা চিত্রকে খাবারের জন্য ডাকতে গেলে অর্থি তাকে কোথাও খুঁজে পায়নি৷ তখন বিষয়টা স্বাভাবিক ভাবে নিলেও দিন পেড়িয়ে রাত হওয়ার পরও যখন চিত্রর দেখা মেলেনি তখন খোঁজ শুরু করে চয়ন আর প্রহর। তাদের সব লোককে খুঁজতে বলে। রাত ১০ টা পর্যন্ত চেনা পরিচিত এমনকি চিত্রর বিশ্ববিদ্যালয়ে খোঁজ নিয়েও তাকে পাওয়া যায়নি। তখন থেকেই চিন্তিত পরিবার বসে আছে হলরুমে। পল্লবীর কান্নায় বিরক্ত হয়ে চয়ন গম্ভীর স্বরে বলে,

‘কান্নাটা একটু থামাবে গিন্নি? কি শুরু করলে! চিত্র ম’রে নাই এখনো।’

পল্লবী আর অর্পিতা আঁতকে ওঠে। পল্লবীর কান্না আপনা আপনিই বন্ধ হয়ে যায়। অর্পিতার শ্বাস ভারী হয়ে আসে। অর্থির কান্নার আওয়াজ বেড়ে যায়। চৈত্রিকা অর্থিকে বুকে আগলে নিয়ে কান্না থামানোর চেষ্টা করলেও দৃষ্টি থাকে অর্পিতার মুখের দিকে। তার থেকে চোখ সরিয়ে পল্লবীর দিকে তাকাতেই পল্লবীর রাগী মুখ চোখে পড়ে। পল্লবী তেজী কন্ঠে বলে,

‘আমার ছেলেকে নিয়ে উল্টো পাল্টা বললে ঠিক হবে না চয়ন রেনওয়াজ। আমার ছেলেকে আজ খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না তার একমাত্র কারণই তো আপনি আর আপনার ভাতিজি। ওই মেয়ের এতো অ’হং’কার! আমার ছেলেটা ওর খালা আর খালাতো ভাইয়ের উ’স্কানিতে ভুল করলো আর সেই ভুলের শা’স্তি হিসেবে আমার ছেলেটাকেই ‘ও’ নিখোঁজ করে ফেললো!’

অর্পিতা তাকিয়ে থাকে পল্লবীর মুখের দিকে। পল্লবী উন্মাদ হয়ে ওঠে। অর্পিতার দিকে তাকিয়ে বলে, ‘শান্তি পাইছিস তুই? আমার ছেলেটা তো তোকে ভালোবাসতো! তুই নিজের জিদ ধরে রেখে শান্তি পাইছিস? আমার ছেলের কিছু হলে আমি তোকে শান্তিতে বাঁচতে দেবো না অর্পিতা। তোরা জমিদার বংশ পারিসই শুধু মানুষকে লু’টে নিতে! মায়ের বুক ফাঁকা করতে। কিন্তু আমার বুক ফাঁকা হলে আমি তোদের সবাইকে! তোকে আর চয়ন রেনওয়াজকে একদম বেঁ’চে থাকতে দেবো না। মনে রাখিস!’

পল্লবীকে ঠান্ডা করার চেষ্টা করে নাসিমা। চয়ন রেনওয়াজ তাকিয়ে থাকে পল্লবীর মুখের দিকে। পল্লবী যে উন্মাদ হয়ে গেছে তা বুঝতে একটুও বাকি রয় না। সন্তান হারানোর চিন্তায় পল্লবী যে মনের ক্ষো’ভ প্রকাশ করছে তা ঢের বোঝা যাচ্ছে। অর্পিতা একটা কথারও জবাব দেয় না শুধু নিস্তব্ধের মতো তাকিয়ে থাকে পল্লবীর মুখের দিকে। চয়ন পল্লবীকে কিছু বলতে নিলে থামিয়ে দেয় প্রহর। নিজের কাঠিন্যতা ধরে রেখে কঠিন গলায় বলে,

‘চিত্র আপনারও নিজের রক্ত আব্বাজান তাই কি বলছেন এটা একটু ভেবে বলবেন! উনি নিজের সন্তানকে খুঁজে পাচ্ছে না তাই কান্নাকাটি, আহাজারি করবেই এতে আপনি ‘চিত্রর ম’রার’ কথা বলে তার ব্যাথিত হৃদয়ে আবারও ব্যাথা দেওয়ার অধিকার রাখেন না।’

চয়ন রেনওয়াজ চুপ করে যান। তিনি এতো ক্ষমতাশীল হলেও প্রহরের বেলায় চুপ করে যায়। তার চেয়ে বেশি তো কেউ প্রহরকে চিনে না! তাই সে সহজে প্রহরকে ক্ষে’পিয়ে তোলে না। প্রহর এগিয়ে আসে পল্লবীর কাছে। চৈত্রিকা পুরো বিষয়টাই দেখে। সে কিছু বলতে চেয়েও চুপ করে যায়। দেখতে চায় প্রহর কি করে! প্রহর নিজের মায়ের কাছে বসে তার মুখটা দুহাতের আজলে নেয়। কন্ঠস্বর নরম করে বলে,

‘দেখুন আম্মাজান! অর্পিতা তো একটা মেয়ে। আপনিও তো মেয়ে। আপনি তো শুধু মেয়ে না একজন মা’ও। আপনি নিজের জ্ঞান থেকে বলুন তো! আপনার সাথে যদি কোনো ছেলে এমন একটি ঘটনা ঘটাতো যা আপনার সম্মানে হাত দেয় আপনি কি তাকে সহজে ক্ষ’মা করতে পারতেন? আপনি কি পারতেন তাকে এতো সহজেই সব ভুলে মাফ করে দিতে!’

পল্লবী জবাব দেয় না। শুধু তাকিয়ে থাকে প্রহরের মুখের দিকে। প্রহর একটু থেমে ফের বলে, ‘অর্পিতা কিন্তু খুবই ভালোবাসে চিত্রকে। এটা চিত্র জানেও আর বুঝেও। ছেলেটা একটা অ’ন্যায় করেছে যার জন্য অর্পিতা তাাকে শা’স্তিস্বরূপ বিয়েও করেনি, কাছেও টেনে নেয়নি। একজনকে ভালোবেসে তাকেই আবার দুরে রাখাটা কি কষ্টের না আম্মাজান? আপনি যেমন আপনার ছেলেকে ভীষণ ভালোবাসেন তেমনই মেয়েটাও তার ভালোবাসার মানুষকে খুবই ভালোবাসে। তাহলে তাকে সব দোষ দেওয়াটা কি উচিত আম্মাজান? মানছি অর্পিতা চিত্রকে ক্ষমা করেনি। কাছেও টেনে নেয়নি। চিত্রর ব্যাথাটাও বুঝেনি কিন্তু আপনিও তো অর্পিতার দিকটা বুঝতেছেন না আম্মাজান? ওর সাথে যা যা ঘটেছে গত কয়েকদিনে তাতে ওর সবটা মানিয়ে নিতে, বুঝে নিতেও তো সময় লাগতো!’

পল্লবী চোখ নামিয়ে নেয়। আসলেই তো! সেও তো মেয়ে অথচ অর্পিতার দিক তো সে এভাবে কখনোই ভাবেনি! উল্টো সবসময় অর্পিতাকে মনে মনে দোষ দিয়ে চিত্রকে নিয়ে ভেবে গেছে। তবে কি এই জমিদার বাড়ির স্বা’র্থ’পর গুলোর মতো সেও স্বা’র্থপর হয়ে গেছে! চৈত্রিকা অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে প্রহরের দিকে। তার মনেও কথা গুলো স্পষ্ট ছিলো। কথাগুলো তো সেই বলতো অথচ সেগুলো কি সুন্দর গুছিয়ে বলে দিলো প্রহর! সে তো প্রহরের থেকে এমন কিছুই আশা করেনি! সে ভেবেছিলো নিজের বাবা, মায়ের মতোই সেও অর্পিতার দিকে আঙুল তুলবে। কিন্তু তাকে সম্পূর্ণ ভুল প্রমাণিত করে দিয়ে প্রহর তার থেকেও ভালো করে বুঝিয়ে দিলো অর্পিতার দিকটা। প্রথমবারের মতো প্রহর নামক জমিদার সাহেবকে তার মন্দ মনে হলো না। মনে হলো না এই ব্যাক্তি এতো বেশি পা’ষাণ হতে পারে! মনে হলো না এই মানুষটা কাউকে সর্বস্বহারা করতে পারে! চৈত্রিকা প্রহরের নতুন রুপ দেখে ভুলেই বসলো অতীতের কর্মকান্ড। পলকহীন তাকিয়েই রইলো প্রহরের মুখপানে। তার ভাবনার মাঝেই প্রহর পল্লবীকে নিজে আগলে নেয়। ছেলের বুকে মাথা রেখে নিঃশব্দে কাঁদে পল্লবী। প্রহর ফের নরম স্বরে বলে,

‘আপনার বড় ছেলে আপনাকে কথা দিচ্ছে আম্মাজান! আপনার ছোট ছেলের গায়ে একটা টোকাও পড়তে দেবো না। আপনার ছেলেকে সুস্থ ভাবে ফিরিয়ে দেবো আপনার কাছে।’

নরম স্বর হলেও কথার মাঝে ছিলো বিশাল কিছুর আভাস। চৈত্রিকা তখনো বোকার মতো তাকিয়ে আছে প্রহরের দিকে। অর্পিতা কৃতজ্ঞতা নিয়ে তাকাায় প্রহরের দিকে। যেখানে একজন নারী হয়ে অন্য এক নারী তাকে বুঝতে অক্ষম সেখানে একজন পুরুষ হয়ে কি সুন্দর, সাবলীল ভাবে তার মনের ব্যাথাটা, তার দিকটা বুঝিয়ে দিলো প্রহর! অর্থি কাঁদতে কাঁদতে সেখানে ঘুমিয়ে পড়েছে। চৈত্রিকা অর্থিকে আগলে রেখে নিচু স্বরে প্রহরের উদ্দেশ্যে বলে,

‘অর্থি তো ঘুমিয়ে পড়েছে! ওকে একটু ঘরে দিয়ে আসেন।’

প্রহর নীরার দিকে তাকিয়ে কিছু একটা ঈশারা করে। নীরা পল্লবীকে ধরতেই প্রহর উঠে গিয়ে অর্থিকে কোলে তুলে নেয়। কোনো শব্দ ছাড়াই ছোট্ট অর্থিকে নিয়ে যায় অর্থির ঘরে। চৈত্রিকা পিছু পিছু না গিয়ে আসে অর্পিতার কাছে। অর্পিতার পাশে বসে অর্পিতার থুতনীতে হাত রেখে চুল গুলো কানের পৃষ্ঠে গুজে দেয়। সহজ গলায় বলে,

‘নিজেকে দোষী ভাববেন না আপু। চিত্র ভাই হয়তো অভিমানে কোথাও চলে গেছে দেখবেন আপনার বড় ভাইজান ঠিকই তাকে ফিরিয়ে আনবে। উঠুন এখন! অনেক রাত হয়েছে। কাকিমা আপনি আজ আপুর সাথে ঘুমাবেন। আপুকে নিয়ে ঘরে চলুন!’

চৈত্রিকার এতো সহজ স্বাভাবিক আচরণ দেখে শায়লা আর অর্পিতা তাকিয়ে থাকে। তারপর চৈত্রিকার কথা অনুযায়ী অর্পিতা কোনো শব্দ না করেই নিজ জায়গা থেকে উঠে পড়ে। শায়লা আর চৈত্রিকাই অর্পিতাকে তার ঘরে নিয়ে যায়। চৈত্রিকা অর্পিতাকে শুইয়ে দিয়ে মাথায় অল্প একটু হাত বুলিয়ে দিয়ে শায়লাকে থাকতে বলে নিজে উঠে আসতে নেয়। অর্পিতা তার হাত টেনে আটকে দিয়ে বলে,

‘চিত্র ভাই কাল আমার ঘরে এসেছিলো বড় ভাবীজান। আমি উনার কান্নাকে গ্রাহ্য না করে কঠিন গলায় তাকে তাড়িয়ে দিয়েছি। আজ তার নিখোজ হওয়ার জন্য সম্পূর্ণ দায়ীই কিন্তু আমি।’

চৈত্রিকা অবাক হয়। তবে নিজের অবাকতা দমিয়ে অর্পিতার হাত ছাড়িয়ে দেয়। তার মুখের দিকে তাকিয়েই বলে, ‘যা হওয়ার তা হয়ে গেছে তাতে নিজেকে দায়ী ভাবার দরকার নাই অর্পি আপু। আমরা বুঝি আপনার সাথে যা হয়েছে তা ঠিক না কিন্তু যেহেতু চিত্র ভাই মন থেকে ক্ষমা চেয়েছিলো তাই আপনার উচিত ছিলো তাকে একটা বার ক্ষমা করে সুযোগ দেওয়া। কিন্তু আপনি নাা দিয়ে যখন নিজেদের মধ্যে দূরত্ব বাড়ালেন তখন না হয় আরেকটু এই দূরত্ব সহ্য করুন! সব ঠিক হয়ে যাবে ইন শাহ আল্লাহ। আর একটা কথা! কোনোকিছুতে নিজেকে দোষী ভাববেন না। আপনি তো জানেন আপনি কি পরিমাণ ভালোবাসেন তাকে! তবে নিজেই নিজেকে দোষ দিয়ে নিজেকে আর নিজের ভালোবাসাকে ছোট করবেন না।’

চৈত্রিকা মুচকি হেঁসে চলে যায়। অর্পিতা টলমল চোখে তাকিযে থাকে সেদিকে। আসলেও প্রহর রেনওয়াজের যোগ্য বউ। দুইজনের মাঝেই রয়েছে কাঠিন্যের, তেজের, সাহসের, নমনীয়তার এক অদম্য শক্তি। দুজনই ভীষণ অদ্ভুত তবুও দুজন ভীষণ রকম বুঝদার।

৬৯.
১ দিন, ২ দিন করে কাটলো পুরো ৭ দিন। সময় পেরোলো তবে চিত্রকে পাওয়া গেলো না আর। প্রহর হন্যে হয়ে খুঁজছে। বাহিরে সারাদিন চিত্রকে নিয়ে খোজাখুজি, চিন্তার শেষে যখন বাড়িতে ঢোকে তখন তার মা ছুটে এসে একটাই প্রশ্ন করে, ‘চিত্র কোথায়?’ এ প্রশ্নের জবাব সে দিতে পারে না। অর্পিতা ঘরবন্দী করে রাখে নিজেকে। অর্থির চঞ্চলতা একদম কমে গেছে। চৈত্রিকা আর নীরা পুরো বাড়িকে সামলাচ্ছে একা হাতে। দু জা মিলে বাড়ির মানুষের খেয়াল রাখা থেকে শুরু করে বাড়ির প্রতিটা ইটকেও যেনো খেয়ালে খেয়ালে রাখছে। অর্পিতা থেকে শুরু করে সবার সব বিষয়ে খেয়াল রাখে দুজনে। সামনেই অর্থির মাধ্যমিক এজন্য নিজেরাই সময় করে অর্থিকে পড়তেও বসায়। নিবিড়ও আসে। চিত্র নিখোঁজ এটা সেও জানে। ভেতরে ভেতরে খারাপ লাগলেও অর্থিকে শান্ত্বনা দেওয়ার মতো ভাষা তার কাছে নেই। আজও পড়াতে এসেছে নিবিড়। অর্থি বই খাতা নিয়ে বসে আছে। বইয়ের ওপর মাথা রেখে জানালার বাহিরে দিয়ে তাকিয়ে আছে। চোখ মুখ মলিনতায় ভরে উঠেছে। নিবিড় এসে তাকে অন্যমনষ্ক দেখে প্রথমে হতাশার শ্বাস ফেললেও চুপচাপ এসে বসে তার সামনের চেয়ারে। অর্থি এক পলক নিবিড়ের দিকে তাকিয়ে নিজের অঙ্ক খাতা খুলে বসে। মন মেজাজ কোনোটাই খুব বেশি ভালো নেই। নিবিড় শান্ত স্বরে বলে,

‘পড়েছো কিছু অর্থি?’

অর্থি দুপাশে মাথা নাড়ায়। নিবিড় দীর্ঘশ্বাস নেয় কিন্তু কিছু বলে না। ধৈর্য সহকারে বলে, ‘এখন তাহলে একটু পড়ো!’

অর্থি সে কথা শুনেও শুনে না। নিবিড়ের দিকে তাকিয়ে নিজেই প্রশ্ন করে, ‘আচ্ছা মাষ্টারমশাই! আপনি তো মিথ্যা বলেন না তাই না! আপনি একটু বলেন না আমার ছোট ভাইজান ফিরবে তো? আবার আগের মতো আমাকে ভালোবাসবে তো? ছোট ভাইজান না আসলে তো আমি মাধ্যমিকে বসবো না। এবার ছোট ভাইজান আসলে আমি প্রতিদিন তাাকে নিয়ম করে পড়া দেবো, ঠিক মতো তার সব কথা শুনবো। আমার ছোট ভাইজান আসবে তো মাষ্টারমশাই?”

নিবিড় কিছু বলতে পারে না। গলা কেঁপে ওঠে। কোনো রকমে কাঁপা কাঁপা শব্দে বলে, ‘চিন্তা করো না অর্থি। দেখবে তোমার ছোট ভাইজান ঠিক ফিরে আসবে!’

অর্থি টেবিলের ওপর মাথা নত করে শুয়ে পড়ে। বাহিরে চোখ বুলিয়ে নিজ শব্দে আওড়ায়, ‘ছোট ভাইজান তবে ফিরে আসে না কেনো?’

নিবিড় কিছুক্ষণ চুপ থেকে কাঁপা কাঁপা হাতে ছোট্ট অর্থির মাথায় হাত বু্লিয়ে দেয়। মিনিট খানেক না যেতেই অর্থি ফুঁপিয়ে ওঠে। ভয় পেয়ে নিবিড় নিজ জায়গা ছেড়ে উঠে এসে দাঁড়ায় অর্থির সামনে। এক হাত অর্থির গালের ওপর রেখে ব্যস্ত গলায় বলে,

‘কি হলো অর্থি? তুমি…’

কথা শেষ হওয়ার আগেই অর্থি জাপ্টে ধরে নিবিড়কে। মুখ গুজে দেয় নিবিড়ের পেটে। নিবিড় চমকে ওঠে। অর্থি কাঁদতে থাকে। নিবিড় কি করবে বুঝে ওঠে না৷ এই অবস্থায় তাদের কেউ দেখলে সর্বনাশ হয়ে যাবে কিন্তু মেয়েটার যা অবস্থা তাতে হুট করে ঠেলে সরিয়ে দিলেও ভীষণ কষ্ট পাবে। দ্বিধাদন্দ মন নিয়েই অর্থির মাথায় কাঁপা কাঁপা হাতে হাত বুলায়। বিড়বিড় করে বলে,

‘তোমার স্পর্শে, তোমার হাহাকারেই আমার সর্বনাশ অর্থি।’

৭০.
রাতে সব কাজ শেষ করে চৈত্রিকা পল্লবীকে ঘরে দিয়ে নিজের ঘরে আসে। প্রহর তখন মাথা নিচু করে বসেছিলো বিছানার ওপর। তার এমন বসে থাকায় চৈত্রিকার ভ্রু কুঁচকে যায়। ধীর পায়ে এগিয়ে আসে প্রহরের সামনে। শান্ত গলায় বলে,

‘এখানে এভাবে বসে আছেন কেনো জমিদার সাহেব? খাবেন না?’

প্রহর চোখ তুলে তাকায়। চৈত্রিকা ভয় পেয়ে যায় প্রহরের চোখ দেখে। লাল টকটকে চোখ যেনো চৈত্রিকাকে কিছুর আভাস দিচ্ছে! চৈত্রিকা তাকিয়ে থেকে বুঝার চেষ্টা করে। তবে বরাবরই এই রহস্যময় পুরুষকে বুঝে ওঠে না। প্রহর চৈত্রিকার দিকে তাকিয়ে কন্ঠস্বর নিচু করে বলে,

‘ক্ষুধা নেই। তুমি খেয়েছো?’

চৈত্রিকা উপরনীচ মাথা নাড়ায়। প্রহর ‘আচ্ছা’ বলে আবার মাথা নিচু করে নেয়। চৈত্রিকা ওভাবেই কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে কি মনে করে যেনো জিজ্ঞেস করে বসে, ‘মন খারাপ জমিদার সাহেব?’

প্রহর প্রথমে চুপ থাকলেও পরমুহূর্তে চোখ তুলে তাকায়। করুণ কন্ঠে বলে, ‘আমি কখনো এতোটা অসহায় হয়ে পড়িনি চৈত্রিকা। নিজের আপন মানুষদের বিশ্বাসঘা’তকতাও আমাকে বাঁকা করতে পারেনি তবে আজ আমি ভেতর থেকে বাঁকা হয়ে যাচ্ছি৷ কত খুঁজেছি চিত্রকে৷ কিন্তু পাচ্ছি না।৷ প্রতিদিন যখন আম্মাজান কাছে এসে চিত্রর কথা জানতে চায় তখন নিজেকে ভীষণ অসহায় মনে হয়। আম্মাজানকে দেওয়া কথা আমি রাখতে পারছি না চৈত্রিকা।’

চৈত্রিকা কোনো কথা বলে না। চুপচাপ নিজের জায়গায় দাঁড়িয়ে তাাকিয়ে থাকে প্রহরের মুখের দিকে। পায়ের নখ দিয়ে খুঁটতে থাকে মেঝে। কতটা সময় এভাবেই যায়। হুট করেই প্রহর উঠে আসে চৈত্রিকার একদম কাছে। চৈত্রিকা চমকায় না। মাথা উচিয়ে তাকিয়ে থাকে প্রহরের মুখপানে। প্রহর ছোট্ট করে বলে,

‘আমি তোমাকে একটুখানি জড়িয়ে ধরি চৈত্রিকা?’

চৈত্রিকা এপর্যায়ে চমকায়। গায়ের লোম দাঁড়িয়ে যায়। তার অনুমতির আশা না করেই প্রহর শক্ত করে চৈত্রিকা নিজ বাহুডোরে আনে। জড়িয়ে ধরে বড় করে শ্বাস টানে। শ্বাস আটকে থাকে চৈত্রিকার। দৃষ্টি এদিক ওদিক করে মনে মনে আওড়ায়,

‘নিজ অসহায়ত্বে আমাকে টেনে নিবেন না জমিদার সাহেব। আমি যে নিজের অসহায়ত্বটাই ভুলে যাবো!’

চলবে..
(আসসালামু আলাইকুম। ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।)