চৈত্রিকা পর্ব-৪৪+৪৫

0
463

#চৈত্রিকা (৪৪)
#বোরহানা_আক্তার_রেশমী
________________
(নোট পড়বেন)

১৭.
দুর দুরান্তে কেবলই ফজরের আযান পড়েছে। নামাজে যাওয়া ব্যাক্তিগন বাদে সবাই ঘুমে। চৈত্রিকা সারা রাতই ঘুমায়নি। বলা বাহুল্য তার চোখে ঘুমেরা ধরা দেয়নি। আযান কানে আসতেই উঠে বসে। মন দিয়ে আযান শুনে উঠে গিয়ে নামাজ আদায় করে নেয়। জায়নামাজ উঠিয়ে একবার প্রহরের দিকে তাকায়। প্রহর ঘুমে বিভোর। চৈত্রিকা কু’টিল হেঁসে ঘর থেকে বের হয়। শাড়ির আঁচল মাটিতে লুটোপুটি খাচ্ছে। চুলগুলো খোলা রাখা। এই মুহুর্তে চৈত্রিকাকে বিধ্বস্ত নারীর চেয়ে কম মনে হচ্ছে না। চৈত্রিকা গুটি গুটি পায়ে পিয়াসের ঘরের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। ঘরের দরজা ভেতর থেকে আটকানো। একবার নিজের হাতের ত’লোয়ারের দিকে তাকিয়ে দরজায় কড়া নাড়ে৷ একবার, দুইবার করে কয়েকবার কড়া নাড়ার পর পিয়াস বি’শ্রী একটা গা’লি দিয়ে ঘরের দরজা খুলে দেয়। রাগী কন্ঠে বলে,

‘সকাল সকাল কার এতো দরকার পড়ছে! দরজা খুলছি না মানে বুঝিস না যে আমি ব্যস্ত!’

ঘুম ঘুম চোখে মুখ না দেখেই নিজের মতো বকবক করে যায় পিয়াস। চৈত্রিকা ঠোঁট প্রসারিত করে হাসে। কন্ঠে দারুণ রকম শীতলতা টেনে বলে, ‘এতো ব্যস্ত থাকলে বড় ভাবীজানকে সময় কখন দেবেন দেবর ভাই? একটু ব্যস্ততা কাটিয়ে না হয় ভাবীজানের দিকেও নজর দিলেন!’

এই সময় চৈত্রিকার কন্ঠ শুনে সকল রকমের ঘুম উবে যায় পিয়াসের। ড্যাবড্যাব করে চৈত্রিকার দিকে তাকায়। চৈত্রিকা এতো সকালে এখানে কেনো? নিজের কন্ঠে অবাকতা ধরে রেখে বলে,

‘আপনি এই সময়! আমার ঘরে কেনো ভাবীজান?’

চৈত্রিকা ফের হাসে। তবে এই হাসি ছিলো হিং’সা’ত্মক হাসি। পিয়াসের বুঝে উঠার আগেই অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবে ত’লোয়ার চা’লিয়ে দেয় পিয়াসের বুক বরাবর। বুক থেকে টেনে পেট অব্দি আ’ঘাত করে। ফলে বুকে থেকে পেট পর্যন্ত কে’টে যায় তবে খুব বেশি গভীর হয় নাহ। আকস্মিক আক্রমণে পিয়াস কিছুই বুঝে উঠে নাহ। চিনচিনে ব্যাথা, বুক থেকে পেটের জ্ব’লনে এবং আতঙ্কে চিৎকার করে ওঠে। চৈত্রিকা সুযোগের সদ্ব্যবহার করে ধাক্কা মা’রে পিয়াসকে। পিয়াস মেঝেতে পড়ে গেলে নিজের শাড়ির একটা টুকরা মুখে পুড়ে দেয়। সাথে করে আনা দড়ি দিয়ে হাত পা বেধে ফেলে। সবকিছু এতো দ্রুত হয়ে যায় যে পিয়াস নিজেও নির্বাক হয়ে পড়ে। নিজে কিছু করার সুযোগই পায় না। শুধু পিটপিট করে তাকিয়ে থাকে। ব্যাথায় চোখ মুখ নীল হয়ে যায়। গোঙাতে থাকে। চৈত্রিকা ততক্ষণে হিং’স্র হয়ে উঠেছে। চোখে মুখে ক্রো’ধ, রা’গ, প্রতিহিং’সা, প্রতি’শো’ধের নেশা স্পষ্ট। বড় বড় শ্বাস নিয়ে নিজেকে নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করে। কিন্তু ফলাফল শূণ্য। রাগে ত’লোয়ার দিয়ে মেঝেতে খুঁটতে থাকে। পিয়াস ব্যাথায় তখনও ছটফট করছে। চৈত্রিকা পিয়াসের ছটফট করা দেখে হাসে। ত’লোয়ার এনে পিয়াসের চোখ বরাবর রেখে আফসোসের সুরে বলে,

‘আহারে! খুব বেশি কষ্ট হচ্ছে দেবর ভাই? কোথায় কষ্ট হচ্ছে একটু দেখি! চোখ খু’লে কি হাতে এনে দিবো? দেখাবেন আপনি!’

পিয়াস আঁতকে ওঠে। মাথা দুপাশে বারংবার নাড়িয়ে বোঝায় তাকে আ’ঘাত না করতে! চৈত্রিকা বাঁকা হাসে। ত’লোয়ার একদম চোখের ১ ইঞ্চি দুর নেয়। পিয়াস চোখ বন্ধ করে ফেলে। মনে মনে এই প্রথমবার হয়তো আল্লাহকে স্মরণ করতে থাকে। মৃ’ত্যুর ভয় বুঝি জা’নোয়া’রদেরও মানুষ বানিয়ে দেয়! চৈত্রিকা সরিয়ে নেয় ত’লোয়ার। একবার দরজার দিকে তাকিয়ে উঠে গিয়ে দরজা আটকে দেয়। এরপর ফিরে এসে নিজের জায়গায় বসে শান্ত কন্ঠে শুধায়,

‘মৃ’ত্যুকে খুব ভয় লাগছে পিয়াস রেনওয়াজ? খুব বেশি? যখন অন্যদের প্রাণ কেড়ে নিতেন তখন বুঝি একটুও ভয় লাগতো না!’

পিয়াসের চোখের কোণা বেয়ে পানি গড়ায়। বার বার মাথা এদিক ওদিক করতে থাকে। যেনো বার বার একটাই কথা বোঝাতে চাচ্ছে ‘আমাকে মা’রবেন না।’ চৈত্রিকা বেশ মজা পেলো। ত’লোয়ারের একটা আ’ঘাত কপালের অংশে করলো। চুলের গোড়া থেকে ধীরে ধীরে তলোয়ার দিয়ে গভীর আ’ঘাত করতে থাকে। পিয়াস পারে না শুধু গলা ফাটিয়ে কাঁদতে। চৈত্রিকা একটু আ’ঘাত করে তলোয়ার আবার সরিয়ে নেয়। পিয়াসের চোখ থেকে তখন টুপটাপ পানি গড়াচ্ছে। চৈত্রিকা শব্দ করে হেঁসে দেয়। হাসতে হাসতেই বলে,

‘আহারে! খুব কান্না পাচ্ছে? আমারও না ভীষণ কান্না পাচ্ছে দেবর ভাই! আমি কিভাবে কাঁদি বলুন তো! আপনাকে শা’স্তি না দিয়ে তো মন খুলে শান্তি মতো কাঁদতেও পারবো নাহ। আজকে কিন্তু বাঁচার আশা রাইখেন না দেবর ভাই! আজ যদি আপনার বাপসহ ১৪ গো’ষ্ঠীও চলে আসে তাও আপনার মৃ’ত্যু অবধারিত। ম’রবেন মানে ম’রবেনই। যতক্ষণ না ম’রবেন ততক্ষণ আমি মা’রতেই থাকবো। আপনার দেহ থেকে প্রানভোমরা ছিনিয়ে নিয়েই আমি ক্ষ্যান্ত হবো।’

পিয়াস ভীতু দৃষ্টিতে তাকালো। এই প্রথম চৈত্রিকার ভ’য়ং’কর রুপ দেখে পিয়াসের আত্মা কাঁপতে শুরু করে। কাউকে ভয় না পাওয়া পিয়াস প্রথমবারের মতো মৃ’ত্যু ভয় পেলো তাও একজন নারীর কাছে। চৈত্রিকাকে এই রুপে দেখবে তা বোধহয় কখনো কল্পনাতেও আনেনি পিয়াস। ভয়ে, ব্যাথায় পিয়াস কাঁদতে থাকে। এই আটকা পড়া অবস্থাতে তার পক্ষে কোনো ভাবেই কিছু করা সম্ভব না। চৈত্রিকা কিছুটা সময় চুপচাপ বসে পিয়াসের আ’র্তনাদ, ছটফটানো দেখতে থাকে। মনের কোথাও যেনো একপ্রকার শান্তিরা দোলা দিয়ে যায়। একপর্যায়ে চৈত্রিকা পিয়াস মাথার র’ক্ত হাত দিয়ে চেপে ধরে। ভীষণ রকম ঠান্ডা গলায় বলে,

‘তোর মুখ খুলে দিবো। যা যা প্রশ্ন করবো সবগুলোর ঠিক ঠিক উত্তর দিবি। আর মুখ খোলার সাথে সাথে যদি চিৎকার করিস তাহলে তোর গ’লার মধ্যেই ত’লোয়ার ঢু’কিয়ে দেবো। মাথায় থাকবে?’

পিয়াস জানে চৈত্রিকা এখন যা বলবে তাই করবে। তাই ভদ্র ছেলের মতো মাথা নাড়াতে থাকে। চৈত্রিকা পিয়াসের মুখ থেকে কাপড় টেনে বের করে নেয়। পিয়াস ব্যাথায় দাঁতে দাঁত চেপে থাকে তবুও মুখ দিয়ে টু শব্দও বের করে না। চৈত্রিকার একটুও মায়া হয় নাহ। বরং পিয়াসকে মা’রার জন্য মন প্রাণ ছটফট করতে থাকে। তাই দেড়ি না করেই শুধাতে থাকে,

‘সাথীকে তুই মা’রছিস? সাথী আ’ত্ম’হ’ত্যা করে নাই তাই না!’

পিয়াস ফাঁকা ঢোক গিলে প্রথমে মাথা দুদিকে নাড়ায়। চৈত্রিকা ক্ষে’পে ত’লোয়ার নিয়ে পিয়াসের গলা বরাবর ধরে দাঁতে দাঁত চেপে বলে, ‘সত্যি কথা বল!’

সাথে সাথেই পিয়াস মুখ খোলে৷ ব্যস্ত কন্ঠে বলে, ‘হ্যাঁ হ্যাঁ আমিই মা’রছি৷ সাথী আ’ত্ম’হ’ত্যা করে নাই। আমি মা’রছি ওরে!’

‘কেন? সাথী তোরে বিয়ে করছিলো কেন?’

পিয়াস ভয়ে গড়গড় করে সবটা বলতে থাকে, ‘আমি ওরে ভুলভাল বুঝিয়েছিলাম। বড় ভাইজানও যে আমাদের মতো প্র’তা’র’ক, বি’শ্বাস’ঘা’তক এটা বিশ্বাস করিয়েছিলাম। আপনার বিপদ এ বাড়ির কোণায় কোণায় এটা বুঝিয়েছি। সাথী খুব নরম মনের ছিলো। আপনাকে ভালোও বাসতো খুব তাই সবটা বিশ্বাস করে নেয়। এরপর ওকে আমাকে বিয়ে করার জন্য নানান রকম ভাবে জোড় করি। আপনার, ওর বাবা-মায়ের ক্ষ’তি করার চেষ্টা করতে থাকি। চিত্রর ওই অবস্থা হওয়ার পর সাথী ভয় পায়। আর আমাকে বিয়ে করতে রাজি হয়ে যায়। বোকা মেয়ে ছিলো! বুঝতে পারেনি ওকে ফাঁদে ফেলে মা’রার জন্যই এই বাড়িতে এনেছি! ‘ও’ আপনাকে সব বলে দিতে চেয়েছিলো কিন্তু আমার ভয়ে পারেনি। ওর মনে এটাও বসে গেছিলো যে বড় ভাইজানও ভালো নাহ।’

‘ওরে মা’ইরা ফেললি কেন?’

‘আপ-আপনারে ভে’ঙে দেওয়ার জন্য৷ ভাবছিলাম সা-সাথীর মৃ’ত্যুতে আপনি ভ-ভয় পাবেন। আ-আতঙ্কিত হবেন। শি-শিক্ষা পাবেন আমার সাথে লাগতে আসার! এরপর আমি অনায়াসে আপনাকেও মে-মে’রে ফেল-ফেলবো।’

শেষের কথাগুলো বলতে গিয়ে বার বার তোতলাতে থাকে পিয়াস। চৈত্রিকা পিয়াসের স্বীকারোক্তি শুনে রাগে বড় বড় নিঃশ্বাস নিয়ে ফের মুখের মধ্যে কাপড়ের টুকরা গুজে দেয়। নিজের চুল আঁকড়ে ধরে কয়েক সেকেন্ড দাঁতে দাঁত চেপে বসে থাকে। কিন্তু রাগ নিয়ন্ত্রণ হয় নাহ। মাথা ছেড়ে সাথে সাথেই ত’লোয়ার দিয়ে একদম এ’ফোঁড় ও’ফোঁড় করে দেয় পিয়াসের বু’ক। র’ক্ত ছিটকে এসে পড়ে চৈত্রিকার মুখে। পাগলের মতো বলতে থাকে,

‘তোর যতো শ’ত্রুতা ছিলো আমার সাথে। তুই ওই নির্দোষ মেয়েটাকে শা’স্তি দিলি কেনো? তোর তো বাঁ’ইচা থাকারই অধিকার নাই। তোরে যদি সেইদিন শুধু হাতে আ’ঘাত না করে বুক বরাবর আ’ঘাত করতাম তাইলে আজকে আমার সাথী বেচে থাকতো। আমাকে নিঃস্বার্থে ভালোবেসে যাওয়া ওই মানুষগুলাও ভালো থাকতো। তোর মতো জা’নো’য়া’ররে না মা’ইরা আমি যে অ’পরাধ করছি তার শা’স্তি ভ’য়াবহ। তুই যত পা’প করছিস তার সব শা’স্তি আজ তোরে একবারে দিয়ে দিবো।’

ব্যাথায় চোখ মুখ নীল বর্ণ ধারণ করে পিয়াসের। মুখে কাপড় থাকায় মুখ দিয়ে র’ক্ত বাহিরে বের হতে পারে নাহ। চৈত্রিকা ক্ষ্যান্ত হয় নাহ। পর পর আরো দুবার এক নাগাড়ে ত’লোয়ার বসিয়ে দেয় বু’কে। নোং’রা হৃয়টাকে যেনো টু’করো টু’করো করার চেষ্টায় মেতে ওঠে। পিয়াস সহ্য করতে পারে নাহ। চোখ মেলে দু বার শরীর ঝাঁকুনি দিয়েই স্থির হয়ে যায়। চোখ দুটো এক পানেই তাকিয়ে রয়। চৈত্রিকা ত’লোয়ার বের করে নিয়ে ছুড়ে মা’রে। পাশ ফিরে আয়নার দিকে তাকাতেই নিজেই ভয় পায়। কাঁপা কাঁপা হাতে নিজের মুখে হাত ছোঁয়ায়। চোখ থেকে টপটপ করে দু ফোটা জল গড়ায়। পিয়াসের দিকে তাকিয়ে সব ভয়, ভীতি কেটে যায়। ভেতরের আ’গুন তাজা হয়। পিয়াসের মুখ থেকে কাপড় বের করে হাত পায়ের বাধন খুলে দেয়। পিয়াসকে মে’রেও যেনো মনে শান্তি পায় না। মনে হয় আরো ভ’য়ং’কর শা’স্তি দিতে পারলে ভেতরটা শান্তি পেতো। চৈত্রিকা করেও তাই। পাগলের মতো ত’লোয়ার নিয়ে পুরো শ’রীরে আঘাত করে। এরপর কোনোরকমে পিয়াসকে টেনে বারান্দায় নিয়ে গিয়ে ফেলে দেয়। বাহিরে তখন কেবলই ভোরের আলো ফুটতে শুরু করেছে। চৈত্রিকা ওই অবস্থাতেই ঘর থেকে বের হয়। সাথে নিয়ে যায় সেই ত’লোয়ার। মাথায় কাপড় টেনে জমিদার বাড়ির সদর দরজা দিয়ে বের হয়ে যায়। উপর থেকে সবটাই দেখে প্রহর। চোখে মুখে বিস্ময় কিংবা আতঙ্ক কোনোটাই নেই৷ একবার পিয়াসের ঘরে ঢুকে পুরো ঘরটা ভালো করে দেখে নেয়। এরপর বারান্দায় উঁকি দিয়ে নিচে পড়ে থাকা পিয়াসের লা’শ দেখে হাসে। ভেতরে শান্তির ঢেউ বয়ে যায়। বিড়বিড় করে বলে,

‘আফসোস তোরে আমি মা’রতে পারিনি! তবে আমার বউই তোরে মা’রছে। বিশ্বাস কর ভাই! তোর একেক ফোঁটা র’ক্ত আমার ভেতরটা শান্তিতে ভরিয়ে তুলতেছে।’

১৯.
চৈত্রিকা র’ক্তাক্ত অবস্থাতেই সাথীর কবরের কাছে যায়। মসজিদ থেকে বেশ দুরেই কবরস্থান। এদিকটাই মানুষ কমই আসে। চৈত্রিকা নির্ভয়ে, বাকরুদ্ধ ভাবে সাথীর কবরের পাশে বসে। মাথার কাপড় নামিয়ে দিয়ে সাথীর কবরের মাটিতে হাত দেয়। কবরের ওপর নিজের ঠোঁট ছুঁইয়ে ফিসফিস করে বলে,

‘বোন দেখ! তোর খু’নীর র’ক্ত! ‘ও’ তোকে ঠিক যে পরিমাণ কষ্ট দিয়েছে আমি ওরে তার থেকেও দ্বিগুণ কষ্ট দিয়ে মা’রছি। আমার জন্য তুই এভাবে চলে যাবি জানলে কখনোই তো তোদের আমার সাথে জুড়তাম নাহ। আমি যদি আগেই ওই জা’নো’য়ার’টাকে মে’রে দিতাম তাহলে হয়তো আজ তুই আমার সাথে থাকতি! আমি তোরে আগলে রাখতে পারিনি বোন। আমার দেওয়া কথা আমি রাখতে পারিনি। তোরে বাঁচাতে পারিনি। তুই কি আমারে মাফ করবি সাথী? মাফ করবি!’

চৈত্রিকা কাঁদতে শুরু করে। কবরের ওপর মাথা রেখে হাউমাউ করে কাঁদে। ভোরের আলো যখন পুরোপুরি ফুটে গেছে তখন কবরস্থান থেকে বের হয়ে আসে। সামনেই পড়ে একটা বিশাল পুকুর। কোনো কিছু না ভেবে সেই পুকুরেই নেমে পড়ে। হাতে, মুখে লেগে থাকা সমস্ত র’ক্ত তুলে ভালো ভাবে গোসল করে নেয়। অনেকটা সময় পানিতেই থাকে। কোনোরকমে নিজেকে স্বাভাবিক করে উঠে আসে পানি থেকে। এ সময় আজম আলী আর সনিয়া বেগম জমিদার বাড়িতে তাই চৈত্রিকা সরাসরি তাদের বাড়িতেই যায়। ঘরের দরজায় তালা ঝুলানো দেখে একটু হতাশই হয়। একবার নিজের ভেজা কাপড়ের দিকে তাকায় তো আরেকবার দরজার দিকে তাকায়। ফিরে চলে আসতে নিলেই চোখ পড়ে বারান্দার দড়িতে ঝুলানোর তারই একটা শাড়ির দিকে। মুহূর্তের চৈত্রিকার ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে ওঠে। শাড়ি নিয়ে কলপাড়ে গিয়ে যত দ্রুত সম্ভব শাড়ি বদলে নেয়। এরপর হাঁটা লাগায় জমিদার বাড়ির উদ্দেশ্যে। জমিদার বাড়ির কাছে আসতেই সব কিছু চুপচাপ, শান্ত মনে হলো। চৈত্রিকা ভ্রু কুঁচকে বাড়িতে প্রবেশ করতেই দেখে কাল যেখানে সাথীকে শুইয়ে রাখা হয়েছিলো ঠিক সেখানেই আজ পিয়াসকেও শুইয়ে রাখা হয়েছে। মনে মনে হাসে চৈত্রিকা। আশে পাশে খেয়াল করে দেখে কেউ কাঁদছে নাহ। গ্রামের লোকজনও তেমন নেই। পিয়াসের লা’শের পাশেই চয়ন মাথায় হাত দিয়ে বসে আছে। ছোট্ট অর্থি আঁচলে মুখ গুজে কাঁদছে। সে তো এতোকিছু বোঝে নাহ! সে বোঝে তার ভাই মা’রা গেছে। কেউ ভীষণ নৃ’শং’স ভাবে তার ভাইকে মে’রে ফেলেছে। পল্লবী, শায়লা, নাসিমা, অর্পিতা এমনকি নীরাও নিশ্চুপ। নাসিমা পিয়াসের মৃ’ত্যুতে আরো ভয় পেয়ে গেছে। সে জানে এই কাজটা হয় চৈত্রিকার নয়তো প্রহরের। এই দুজন ছাড়া কারোর এতো বড় কলিজা নেই যে পিয়াস রেনওয়াজকে মে’রে দেবে! চৈত্রিকাকে বাড়িতে ঢুকতে দেখেই চয়ন তেড়ে আসে। রুক্ষ কন্ঠে বলে,

‘তুমি আমার পিয়াসকে মে’রেছো তাই না!’

চৈত্রিকা কপালে ভাজ ফেলে চয়নকে এড়িয়ে আসতে আসতে বলে, ‘আমি কেনো মা’রবো আপনার ছেলেকে? মা’রলে তো আগে আপনাকে মা’রবো। তাছাড়া কেবল কাল আমার বোন মা’রা গেছে। আমার নিশ্চয় এখন ওই মানসিকতাটা আর নেই!’

চয়ন মানে নাহ। ফুঁসে উঠে বলে, ‘যুক্তি দিচ্ছো আমারে! চয়ন রেনওয়াজরে! যত যত যুক্তি দাঁড় করাও না কেনো! তবুও আমি জানি এসব কাজ একমাত্রই তোমার। এসবের পর তোমাকে আমি শান্তিমতো কখনোই বাঁচতে দেবো নাহ। র’ক্ত একটু একটু করে শু’ষে নিবো।’

চৈত্রিকা দাঁড়িয়ে পড়ে। পেছন ফিরে বলে, ‘কি করতে পারেন করে নেন!’

চয়ন ফুঁসতে থাকে। চৈত্রিকা সরাসরি নিজেদের ঘরের দিকে যায়। প্রহর দাঁড়িয়ে ছিলো রেলিং এর পাশে। প্রহরকে দেখেও চৈত্রিকা সেদিকে যায় নাহ। পিয়াসের ঘর পেড়িয়ে যাওয়ার সময় মনে হয় ঘরে কিছু পরিবর্তন ঘটেছে! তাই যাওয়া থামিয়ে পিছু ফিরে ঘরের মাঝে ঢোকে। মেঝে একদম পরিষ্কার। এক ফোঁটা র’ক্তও কোথাও নেই। দেখলে মনেই হবে না এই ঘরেই কাউকে নৃ’শং’স ভাবে মে’রে ফেলা হয়েছে! চৈত্রিকা অবাক হলো। সে তো মেঝে পরিষ্কার করেনি। তার স্পষ্ট মনে আছে এই মেঝে র’ক্তে র’ঞ্জিত করেই সে ঘর থেকে বের হয়েছে। তবে! এর মাঝেই ঠান্ডা এক হাওয়া চৈত্রিকার মুখে লাগে। পরপরই কানের কাছে ফিসফিসানোর আওয়াজ পায়,

‘তুমি এতোটা করতে পারলে এটুকু করতে পারবো না চৈত্র? তুমি পা’প মুছে দিতে পারলে আমি বুঝি পাপের চিহ্ন মুছে দিতে পারি না! শত হলেও আমরা একই রাস্তার পথিক বউজান!’

চলবে..

#চৈত্রিকা (৪৫)
#বোরহানা_আক্তার_রেশমী
________________

২০.
পিয়াসের কবর দেওয়া হয় যোহরের নামাজের পর। চয়ন, সাদিক, প্রহর, চিত্র পিয়াসের পোস্টমর্টেম করতে দেয়নি। কেনো দেয়নি একমাত্র তারা ছাড়া আর কেউ জানে না। পিয়াসের জানাজায় তেমন একটা মানুষও ছিলো নাহ। পিয়াসের কবর দেওয়ার জন্য নিয়ে যাওয়ার পর নীরা আর ঘর থেকে বের হয়নি। যে মানুষটা মা’রা গেছে সে তো নীরার স্বামী ছিলো। এই মানুষটাকেই ভীষণ ভালোবাসতো নীরা। সময়ের তালে অবহেলায় ভালোবাসা ফিকে পড়ে গেলেও মনের মায়াটা এখনো রয়ে গেছে। সাদা শাড়ি পড়ে জানালার কাছ ঘেষে বসে আছে নীরা। একবার নিজের সাদা রঙের দিকে তাকিয়ে আরেকবার তাকায় আকাশের দিকে৷ হেঁসে বলে,

‘একসময় চাইতাম তোমার রঙে নিজেকে রাঙাতে। হে আকাশ তাকিয়ে দেখো! তুমি আর আমি আজ শুভ্র রঙে একই রকম ভাবে সেজেছি। আমার ব্যাথা গুলো এভাবে শুভ্র রঙে পরিণত হবে তা আমি জানতাম। তবুও এতো কষ্ট কেনো হচ্ছে? আমার ভেতরটা এভাবে দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে কেনো?’

নিজে প্রশ্ন করে নিজেই আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে। উত্তর আসে না। আসবে কেমন করে? নীরা চোখ বন্ধ করে নেয়। চোখের কোণ থেকে টুপ করে দু ফোঁটা জল গড়ায়। নীরা জানালা থেকে সরে এসে টেবিল থেকে নিজের লেখা ডায়েরি হাতে নেয়। এক পলক কভারে তাকিয়ে হাসে। কভারের উপরে সুন্দর করে লিখা ‘আমার প্রিয় পুরুষ!’ নীরা বহুদিন বাদে ডায়েরী নিয়ে বসেছে। ঝাপসা চোখে পৃষ্ঠা উল্টে লিখতে শুরু করে,

‘আমার প্রিয় পুরুষ ছিলেন আপনি। আজ আর নেই। উহু! শুধু প্রিয়র তালিকাতে নয় যে এমন নয়! আপনি এই পৃথিবীতেই আর নেই। আমার ভাবতেও ভীষণ কষ্ট হয় জানেন! আমি কি চেয়েছিলাম আর কি হয়ে গেলো! আপনাকে পুরোটা চেয়েছিলাম আর আপনি আজীবন কল্পনা হয়েই থেকে গেলেন! আচ্ছা আপনার কি কখনোই মনে হয় আমার সাথে আপনার সুন্দর একটা জীবন হতো? হতো তো! আপনি এতো এতো অ’ন্যায় না করলে আজ হয়তো আপনি আর আমিও ভীষণ সুখী হতাম। ভালো থাকতাম। আপনার জন্য মৃ’ত্যুটাও ভীষণ কম শা’স্তি জানেন তো! অথচ আমার ভেতরটা হাহাকার করছে আপনার শূণ্যতায়। পৃথিবী আমাকে এতো বড় শা’স্তি দিলো আপনাকে ভালোবাসার! আমিই কেনো এতো শা’স্তি পেলাম? আপনাকে ভালোবেসে আমিই কেনো পেলাম না? কেনো আমার ভালোবাসা শেষ অব্দি হাহাকারেই আবদ্ধ থাকলো? পৃথিবীর ঘৃ’ণ্য মানুষটারও তো অধিকার থাকে ভালোবাসা পাওয়ার তবে আমি কেনো পেলাম না? আমাকে কেনো ভালোবাসলেন না? আমার না ভীষণ কষ্ট হচ্ছে! দেখুন আমি কাঁদছি! আপনার জন্য কাঁদছি। আপনাকে ভালোবেসে ম’রার জন্য কাঁদছি। আমি ভেতর থেকে র’ক্তাক্ত হয়ে যাচ্ছি পিয়াস!’

নীরা আর লিখতে পারে নাহ। কলম ফেলে মুখে হাত গুজে ওভাবেই কাঁদতে থাকে। চিৎকার করে কাঁদতে থাকে। পৃথিবীতে ভালোবাসার মতো সুখ যেমন কিছুতে নেই তেমনই এই ভালোবাসার মতো বিষাদও কিছুতে নেই। কি ভীষণ য’ন্ত্রণা! কি অসহ্য রকম হৃদয’ন্ত্রণা!

সারাদিন নিজেকে সামলে রাখলেও পল্লবী ছেলের কবর হওয়ার পর ঘরের দরজা আটকে কাঁদতে থাকে। ছেলে যতোই খারাপ হোক! তবুও তো তারই ছেলে ছিলো। মা সবসময় মা-ই হয়। অর্থি ঘরের বাইরে থেকে মায়ের কান্নার আওয়াজ পেয়েছে। মা’কে বিরক্ত না করে সরাসরি নিজের ঘরে যায়। সেখানে নিবিড় আগে থেকেই শুয়ে ছিলো। বেচারার এমনিতেই জ্বর তারওপর এতো ধকল নিতে পারছে নাহ। অর্থি নিজের কান্না গিলে নিবিড়ের পাশে বসে। কপালে হাত দিয়ে জ্বরটা দেখে ভাঙা গলায় বলে,

‘আপনার তো একটুও জ্বর কমেনি মাষ্টারমশাই। ডাক্তারের কাছে যাবেন না?’

নিবিড় চোখ মেলে অর্থির দিকে তাকায়। মেয়েটার মুখ ফ্যাকাশে হয়ে আছে। যে মেজো ভাই তাকে এক ফোটাও ভালোবাসেনি সেই মেজো ভাইয়ের মৃ’ত্যুতেই মেয়েটা ভেঙে পড়েছে। কান্না করে চোখ মুখ ফুলিয়ে ফেলেছে। কন্ঠটা এখনো কেমন ভাঙা! নিবিড় রয়ে সয়ে নিজের মাথাটা অর্থির কোলে রেখে বলে,

‘দেখি! তোমার ভীষণ মন খারাপ তাই না অর্থি? মন খারাপ করো না বোকা মেয়ে। যা হয় তা ভালোর জন্যই হয়। তোমার ভাই এমন কোনো ভালো কাজ আজ পর্যন্ত করেনি যার জন্য কেঁদে ভাসাতে হবে!’

অর্থি প্রাণহীনভাবে হাসে। নিবিড়ের মাথায় হাত বুলিয়ে নিজে খাটের সাথে হেলান দিয়ে বসে। চোখ বন্ধ করে ছোট্ট করে বলে, ‘আমি তো অতো শতো বুঝি নাহ মাষ্টারমশাই। হয়তো মেজো ভাইজানের মৃ’ত্যুটা সবার জন্যই ভালো তবুও সে আমার ভাইজান ছিলো। তাকে আমি বড় ভাইজান আর ছোট ভাইজানের মতোই ভালোবাসতাম। বাসি! আমি জানি উনি ভালো ছিলেন না তবুও উনি আমার ভাইজান ছিলেন। একটা সময় উনিও আমাকে একই রকম ভালোবাসতেন। জানি না বড় হয়ে কেনো বদলে গেলেন! কিন্তু আগে আমাকে সমান ভাবে ভালোবাসতো। আমি তো ভুলিনি সে সব স্মৃতি! তাই আমার মেনে নিতে একটু কষ্ট হচ্ছে।’

নিবিড় দীর্ঘশ্বাস ফেলে। চোখ তুলে তাকিয়ে দেখে অর্থির চোখের কোনা বেয়ে জল গড়াচ্ছে। মেয়েটা তখনো চোখ বন্ধ করেই রেখেছে। অর্থির চোখের পানি টুপ করে তার কপালের ওপর পড়ে। নিবিড় চোখ বন্ধ করে নেয়। আলগোছে মাথাটা তুলে অর্থির পাশে সোজা হয়ে বসে। এক হাতে অর্থিকে কাছে টেনে নিয়ে নিজের বাহুতে আবদ্ধ করে। অর্থি ভরসার জায়গা পেয়ে, স্বামীর প্রশস্ত বুক পেয়ে মুখ গুজে দেয়। কাঁদতে থাকে। নিবিড়ের অদ্ভুত প্রশান্তি লাগে। উহু এটা শুধু এখন না! যতবার মেয়েটি তার বুকে মাথা রেখেছে ততবারই তার বক্ষপিঞ্জরের ঝড় থেমে সব শীতল হয়ে গেছে। নিবিড় ঠোঁট বাড়িয়ে অর্থির মাথায় চুমু খায়। অর্থি নিবিড়ের শার্ট চেপে ধরে কাঁদতে থাকে। কান্নার সময় একটু আদুরে অনুভূতি হলেই কান্না পায় মানুষের। এটা বেশির ভাগ মানুষের ক্ষেত্রেই হয়। অর্থিও তাদের দলেরই। হিচকি তুলে কাঁদতে থাকে। নিবিড় শক্ত করে নিজের সাথে জড়িয়ে ধরে। চোখ বন্ধ রেখে বলে,

‘কাঁদবে না অর্থি। তোমার কান্না আমার সহ্য নাহ। তুমি যেখানে মাথা রেখে আছো ঠিক ওখানেই ব্যাথা করে। এই মেয়ে কান্না বন্ধ করো! তোমার মাষ্টারমশাইয়ের যে কষ্ট হয় এটা তুমি বোঝো না?’

অর্থি শুনলো। অন্যসময়ে হয়তো ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে বলতো ‘এখানে ব্যাথা কেমন করে হয় মাষ্টারমশাই? এখানে হৃদয় থাকে না? হৃদয় কোথায় একটু দেখি!’ কিন্তু এসময় কিছুই বললো নাহ। চুপচাপ পড়ে রইলো নিবিড়ের বুকে। নিবিড় মাথাটা খাটের সাথে এলিয়ে দিয়ে বলে,

‘মেয়ে তুমি আমাকে আজীবন পু’ড়িয়েই মা’রবে। আগেও পু’ড়িয়েছো এখন আমার হয়েও আমাকে পো’ড়াচ্ছো। কবে এই পো’ড়ানো বন্ধ করবে? কবে এক পশলা বৃষ্টি হয়ে আমাকে শীতল করবে? কবে?’

২১.
সনিয়া বেগম, আজম আলী কেউই জমিদার বাড়ি থেকে এখনো নিজ বাড়িতে যায়নি। তাদের মানসিক অবস্থার কথা ভেবে এই বাড়ির কেউ যেতেও দেননি। পিয়াসের মৃ’ত্যু খবর পেয়ে সনিয়া বেগম আর আজম আলী যতটা অবাক হয়েছেন ততটাই অবাক হয়েছে পিয়াসকে মা’রার ধরণ দেখে। এতো নৃ’শং’স! আচ্ছা এভাবে মা’রার সময় কি চৈত্রিকার হাত কাঁপেনি? সনিয়া বেগম ভালো মতোই জানেন এই কাজটা চৈত্রিকা ছাড়া আর কেউ করবে নাহ। তাই সুযোগ বুঝে চৈত্রিকার কাছে আসে সনিয়া বেগম। তখন প্রহর ঘরে নেই। চৈত্রিকা নিজের ঘরে বসে আকাশ দেখছে। ঘরের দরজা খোলা-ই ছিলো। সনিয়া বেগম ঘরে প্রবেশ করতেই চৈত্রিকার এলোমেলো অবস্থা দেখে তাকিয়ে রইলেন। তার মাঝে আর কোনো রকম অনুভূতি কাজ করছে নাহ। মেয়েকে হারিয়ে তার সকল অনুভূতিও যেনো হারিয়ে গেছে। শীতল কন্ঠে চৈত্রিকাকে ডাকে,

‘চৈত্র!’

চৈত্রিকা চমকে ওঠে। পেছনে তাকিয়ে সনিয়া বেগমকে দেখে চোখ পিটপিট করে। সনিয়া বেগম কাছে এসে বসে। চৈত্রিকা শুধু তাকিয়ে থাকে। মায়ের মতো মামীর মুখ থেকে কিছু একটা শোনার অপেক্ষায় থাকে। নিজের মায়ের পর এই মানুষটাই তো আগলে রেখেছে, ভালোবেসেছে। অথচ তার জন্যই আজ এই পরিবারে শোকের ছায়া। বোনের মতো সাথী কবরে শুয়ে আছে। মায়ের মতো মানুষটা কাঁদতে কাঁদতে চোখ মুখের হাল বেহাল বানিয়ে ফেলেছে। চোখ মুখ ফ্যাকাশে হয়ে আছে। চোখের নিচে কালি পড়ে গেছে ১ দিনেই৷ চুল, শাড়ি এলোমেলো হয়ে আছে। চৈত্রিকা চোখ নামিয়ে নেয়। সনিয়া বেগম বলেন,

‘পিয়াস রেনওয়াজকে তুই মে’রেছিস তাই না?’

চৈত্রিকা উত্তর দেয় না। সনিয়া বেগম নীরবতাকেই সম্মতি ধরে নেন। কেমন অদ্ভুত ব্যস্ত স্বরে বলে, ‘আমার মেয়েটাকে ওই জা’নো’য়া’র’টাই মে’রেছে তাই না? আমার সাথী আ’ত্ম’হ’ত্যা করে নাই তাই না চৈত্র?’

চৈত্রিকা মাথা নিচু করে ঠোঁট কামড়ে কান্না আটকায়। মাথা উপর নীচ নাড়ায়। সনিয়া বেগম পাগলের মতো চৈত্রিকার হাত জাপ্টে ধরে। চৈত্রিকা সনিয়া বেগমের চোখের দিকে তাকাতেই তিনি হাহাকার করে বলেন,

‘ওই জা’নো’য়া’রটা কেন মা’রলো আমার মেয়েরে? আমার মেয়েটা কি ক্ষ’তি করছিলো ওর? চৈত্র তুই তো ওরে ওর প্রাপ্য শা’স্তি দিয়া দিলি! কিন্তু আমার মেয়েটা কি ফিরবো? আমার মেয়েটার সাথেই কেন এমন হলো?’

চৈত্রিকা হাত ছাড়িয়ে নিয়ে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে সনিয়া বেগমকে। সনিয়া বেগম ডুকরে ওঠে। মেয়েকে হারিয়ে তিনি পা’গল হয়ে গেছেন যেনো! আহারে মা! মায়েরা সন্তানদের এভাবেই ভালোবাসেন বুঝি! চৈত্রিকার চোখ ভিজে আসে। তবুও কান্না আটকায়। সনিয়া বেগম অনেকক্ষণ কাঁদে। কাঁদতে কাঁদতে ক্লান্ত হয়ে চৈত্রিকার কোলেই শুয়ে পড়েন। নিচু স্বরে বলেন,

‘মেয়ে হারানোর শোকে তোরে কাল যা তা বলছি। কিছু মনে নিস না মা!’

‘মায়েরা সন্তানকে বকতেই পারে৷ এই বকাগুলো কিছুই না মামী।’

এরপর কিছুক্ষণ চুপ থেকে বিড়বিড় করে বলে, ‘পিয়াস রেনওয়াজের মৃ’ত্যুর কাছে তোমার এই কথাগুলো কিছুই নাহ মামী। তোমার কথাগুলোতে যে পরিমাণ কষ্ট পেয়েছি ঠিক ততটাই শান্তি পেয়েছি শ’য়’তা’নটাকে মৃ’ত্যু দিয়ে। আহা মামী! কেনো যে তুমি চোখ ভরে দেখতে পারলে না সে দৃশ্যটা! কেনো যে মৃ’ত্যুর সময় পিয়াস রেনওয়াজের আ’ত্মার ছটফটানো টা দেখতে পারলে না!’

এর মাঝোই ঘরে আসে প্রহর। সনিয়া বেগম আর চৈত্রিকাকে এক সাথে দেখে একটু হাসে। প্রহরকে দেখামাত্রই সনিয়া বেগম তড়িঘড়ি করে উঠে পড়ে। কোনো কিছু না বলেই বেড়িয়ে যেতে নেয় ঘর থেকে। প্রহর কিছু বলতে চেয়েও বলে না। চোখ মুখ গম্ভীর করে দাঁড়িয়ে থাকে। চৈত্রিকা একবার সনিয়া বেগমের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে প্রহরের দিকে তাকায়। প্রহর গম্ভীর চোখে তাকিয়ে আছে। চৈত্রিকা চোখ সরিয়ে নিয়ে আগের মতো আকাশ পানে তাকায়। প্রহর আলগোছে এগিয়ে যায় চৈত্রিকার কাছে। চৈত্রিকার পাশে বসে কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে। ঘাড় বাঁকিয়ে চৈত্রিকার দিকে তাকিয়ে দেখে তার কোনো হেলদোল নেই৷ নিজের মতো আকাশ দেখতে ব্যস্ত সে। একবারও ফিরে তাকালো না জমিদার সাহেবের দিকে। আচ্ছা এই কঠিন মনের মেয়েটা কি বুঝতেছে না তার জমিদার সাহেব কি ভীষণ কষ্ট পাচ্ছে! এই যে বুকের বাম পাশের চিনচিনে অনুভূতি বুঝি এই পা’ষাণ মেয়েটি সত্যিই বুঝতে পারে না! প্রহর বড় করে শ্বাস নেয়। শান্ত কন্ঠে শুধায়,

‘জমিদার সাহেবের থেকে বুঝি মুখ ফিরিয়ে নিয়েছো?’

চৈত্রিকা অনুভূতিহীন হয়ে তাকিয়ে রইলো দুরে। চোখের পলক এদিক ওদিক করলো না। ঠায় হয়ে বসে থাকে নিজ মনে। প্রহর তখনও শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। ১ মিনিট, ২ মিনিট করে কয়েক মিনিট চলে যায়। প্রহর অধৈর্য হয়ে পড়ে। অবশেষে চৈত্রিকা ভাঙা গলায় আওড়ায়,

‘এভাবে আমার দিকে তাকিয়ে থাকবেন না জমিদার সাহেব। আমার ভীষণ কষ্ট হয়।’

প্রহর অস্থির হয়ে তাকায়। চৈত্রিকা দৃষ্টি ফিরিয়ে প্রহরের দিকে আনে। সাথে সাথেই প্রহরের মনে হয় তার বুকে কেউ ধারালো ছু’ড়ি বসিয়ে দিয়েছে। প্রিয় নারীর চোখে স্পষ্ট ব্যাথা তার ভেতরটা এফোড় ওফোড় করে দেয়। এতো শক্ত পুরুষ হয়েও তার মনে হলো সে ভেঙে গেছে। ভেঙে পড়েছে! বার কয়েক ফাঁকা ঢোক গিলে। চৈত্রিকাকে জাপ্টে ধরে বলে,

‘চৈত্র এভাবে তাকিও নাহ। তোমার জমিদার সাহেবের ভেতরটা এফোড় ওফোড় হয়ে যায় যে! তোমার এই ব্যাথা, এই চাপা ঘৃ’ণার দৃষ্টি যে তোমার জমিদার সাহেবকে ভে’ঙে চু’ড়ে দেয়। বোঝো না? এই মেয়ে এক আকাশ ভালোবাসার ভীড়ে আমি কি তোমার ঘৃ’ণার দৃষ্টি পাওয়াটাই প্রাপ্যের খাতায় রাখি? আমাকে এভাবে ভে’ঙে দিও না বউজান। আমাকে আঁকড়ে ধরে রাখো। আমি যে ভীষণ ভালোবাসি তোমায়!’

২২.
জমিদার বাড়ি মৃ’ত্যু শোকে আচ্ছন্ন হয়ে আছে। সবাই প্রিয় মানুষ হারানো, তিক্ত সত্য মেনে নিতে হিমশিম খাচ্ছে। একেকজন একেক ভাবে গুটিয়ে নিয়েছে নিজেকে। পিয়াসের মৃ’ত্যুর পর নাসিমা আতঙ্কিত হয়ে আছে। বার বার ভাবছে কখন কোন দিক থেকে চৈত্রিকা তাকেই না মে’রে দেয়! নাসিমার এমন ভীতু হওয়া দেখে ভীষণ রকম বিরক্ত সাদিক। নাক মুখ সিটকে বলে,

‘এতো ভয় পাওয়ার কি আছে নাসিমা? তুমি একটু বেশি বেশি!’

নাসিমা খ্যাক করে ওঠে। চিবিয়ে চিবিয়ে বলে, ‘এতো কিছুর পরও ভয়ের কি আছে জিজ্ঞেস করছো! তুমি বুঝতেছো না পিয়াসকে যে চৈত্রিকা মে’রে ফেলছে?’

সাদিক ভ্রু কুঁচকে তাকায়। নাসিমা কাচুমাচু হয়ে বসে। টেবিল থেকে এক গ্লাস পানি খেয়ে এসে আবার কাচুমাচু হয়ে থাকে। সাদিকের দিকে চেয়ে বলে,

‘তোমার কি মনে হয়? প্রহর আর চৈত্রিকা ছাড়া কখনো কারোর সাহস হবে এতো বড় একটা কাজ করার? আমি প্রহরকে যতটুকু চিনি ‘ও’ কখনোই নিজের প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করবে না কিন্তু চৈত্রিকা সাথীর মৃ’ত্যুর পর আরো ক্ষে’পে উঠেছে। ওর মাঝে এখন প্রতি’শো’ধের নেশা জ্ব’লন্ত শিখার মতো ফুটছে। বুঝতেছো না?’

‘হ্যাঁ তাহলে এখনো তুমি ভয়ে ম’রো। যত্তসব!’

সাদিক রেগে বের হয়ে যায়। সে মুখে যতই বড় বড় কথা বলুক না কেনো! পিয়াসের সাথে যা হয়েছে তারপর মনে মনে তারও ভয় বেড়েছে কিন্তু সে তো পুরুষ মানুষ! কখনোই নিচু হবে না একটা মেয়ের কাছে! কখনোই নাহ।

সাদিক চলে যেতেই নাসিমা আরো জড়োসড়ো হয়ে বসে। তার ভেতরটা ভয়ে ছটফট করছে। আশে পাশে যেনো চৈত্রিকা হাজারবার তাকে মা’রার পণ করছে! কানে হাত চেপে পাগলের মতো মাথা নাড়াতে থাকে দুদিকে। বিড়বিড় করে আওড়াতে থাকে,

‘মা’রিস না চৈত্র। আমাকে মা’রিস নাহ।’

চলবে..