#চৈত্রিকা (৪৬)
#বোরহানা_আক্তার_রেশমী
_________________
২৩.
আজ সাথী আর পিয়াসের মৃ’ত্যুর মিলাদ। ৩ দিনের দিন খাওয়ার ব্যবস্থা আর ওদের মিলাদ দেওয়াটাই মূখ্য উদ্দেশ্য। পুরো গ্রামকেই দাওয়াত করা হয়েছে। বাড়িতে সকাল থেকেই কাজের ধুম পড়েছে। বাড়ির অবস্থা খারাপ হওয়ায় অর্থির বিদায় হয়নি। বাধ্য হয়ে নিবিড়কেও জমিদার বাড়িতে থাকতে হয়েছে। গত ২ দিন নিবিড়ের বাবা মা কেউ এ ব্যাপারের জন্য জমিদার বাড়িতে না আসলেও আজ দাওয়াতের উছিলায় ঠিকই এসেছে। পল্লবী কাজ সামলাবে নাকি নতুন বেয়াই বেয়াইনের আপ্যায়ন করবে তা বুঝে ওঠে নাহ। শেষ মেশ নিবিড়ের বাবা মায়ের আতিথেয়তার ভার পড়ে চৈত্রিকার ওপর। চৈত্রিকা বিনাবাক্যে মেনে নেয়। চয়ন যদিও নিবিড় আর অর্থির বিয়েটা মেনে নিতে পারেনি কিংবা নিবিড় বা তার পরিবারের কাউকেই পছন্দ করে না তবুও সবটা চুপচাপ হজম করে নেয়। পিয়াসের মৃ’ত্যুর পর সবথেকে বেশি চুপচাপ হয়ে যায় নীরা। তবুও সব কাজই নিরুপণ ভাবে করছে। সবাই বোঝে তার মনের অবস্থা কিন্তু বোঝার পরও কারো কিছু করার নেই। কিই বা করতে পারবে! অর্পিতা একবার নীরার মুখের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে। কাজ করতে করতে এগিয়ে আসে নীরার কাছে। নিচু স্বরে জিজ্ঞেস করে,
‘আপনার কি খারাপ লাগছে মেজো ভাবীজান! আপনি না হয় গিয়ে বিশ্রাম নেন! এদিকটা আমি সামলে নিবো।’
নীরা মলিন মুখে হাসে। ছোট্ট করে বলে, ‘সমস্যা নেই অর্পিতা। তুমি যাও কাাজ করো!’
‘আপনি সিউর কোনো সমস্যা নাই?’
নীরা মাথা নাড়ে। অর্পিতা আর কিছু না বলে নিজের কাজ করতে থাকে। নীরা নিজেও মন দিয়ে নিজের কাজ করতে থাকে। এর মাঝে হুট করেই মাছের আঁশটে গন্ধ নাকে আসতেই নীরা পেট চেপে ধরে। এক দৌড়ে চলে যায় কল পাড়! এক পাশে বসে গড়গড় করে বমি করে দেয়। নীরার হঠাৎ এমন ছুটে যাওয়া দেখে অর্পিতা নিজেও পিছু পিছু ছুটে এসেছিলো কিন্তু হঠাৎ করে নীরার এমন বমি দেখে বেশ চমকায়। দ্রুত নীরাকে আগলে নিয়ে মাথা চেপে ধরে এক হাতে। অন্য হাত দিয়ে পিঠে হাত বুলিয়ে দেয়। নীরা বমি করে ক্লান্ত হয়ে কল পাড়েই বসে পড়ে। অর্পিতা পানি দিয়ে নীরার চোখ মুখ ধুয়ে দেয়। কুলি করায়! চিন্তিত সুরে বলে,
‘কি হয়ছে ভাবীজান? হঠাৎ কি হলো? বমি হচ্ছে কেনো? কাল থেকে কিছু খাননি?’
নীরা মাথা নাড়িয়ে ক্লান্ত গলায় বলে, ‘খেয়েছিলাম!’
এর মাঝেই পেছন থেকে একজন অপরিচিত মহিলা বলেন, ‘কি গো মেজো বউ? তোমার চোখ মুখ দেইখা তো ভালা ঠেকে নাহ। পো*য়াতি নি?’
নীরা আর অর্পিতা দুজনেই চমকে ওঠে। দুজনই অবাক হয়ে নিজেদের দিকে তাকায়। অর্পিতা কথা ঘুরাতে বলে, ‘তেমন কিছু না চাচি! মেজো ভাবী তো অসুস্থ তাই হয়তো এমন হয়ছে!’
মহিলাটি মুখ বাকিয়ে কি যেনো বলতে বলতে চলে যায়। অর্পিতা নীরাকে ধরে তুলে ঘরে নিয়ে যায়। দুজনেই কথাটা এড়িয়ে গেলেও মনের মাঝে খুতখুত রয়েই যাচ্ছে। অর্পিতা আপাতত মাথা থেকে সব বের করে দিয়ে নীরাকে শুইয়ে দেয়। সাবধানে থাকতে বলে নিজে চলে যায় রান্নাঘরে। নীরা একবার সেদিকে তাকিয়ে চোখ ফিরিয়ে নেয়। খাটের সাথে হেলান দিয়ে বসে চোখ বন্ধ করে থাকে কিছুটা সময়। মনের ভেতর যেনো হাজার টা প্রশ্নের ঝড় বয়ে যাচ্ছে। নিজ জায়গা থেকে উঠে আয়নার সামনে বসে। নিজেকে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করতে থাকে। চোখ মুখ আগে থেকে কালো হয়ে গেছে কিন্তু পরিবর্তন এসেছে অনেক। গত মাস থেকেই শরীরটা খারাপ ছিলো। মাঝে জ্বর, ঠান্ডার কারণে কিছু খেতে পারেনি বলে সে ধরেই নিয়েছে তার বোধহয় এ কারণেই এতো সমস্যা। গত মাসে তার বিশেষ সময়েও কিছু হয়নি। এটাও সে স্বাভাবিক ভাবেই নিয়েছিলো কিন্তু এই মাসেও যখন সেম ভাবে তার বিশেষ সময় পার হয়ে গেলো অথচ হলো নাহ তখনই মনে সন্দেহ জাগে। আর তারপরই হঠাৎ করে এতো শতো কান্ড ঘটে যায়। নীরা বড় করে শ্বাস নেয়। নিজের পেটে হাত রেখে অনুভব করার চেষ্টা করে। বার কয়েক বড় বড় শ্বাস নিয়ে পেট থেকে হাত সরিয়ে নেয়। চোখ ভরে আসে কান্নায়। বিড়বিড় করে বলে,
‘যে এই পৃথিবী থেকেই চলে গেলো কেবল ২ দিন তারই অস্তিত্ব আবার কি আমার মাঝে মিশে রইলো? এ কেমন ভ’য়ং’কর য’ন্ত্রণা আল্লাহ! যে অনুভূতি একটা মেয়ের সবচেয়ে খুশির কারণ! সেই অনুভূতিই আমার তিক্ত কেনো লাগছে? আমার ভেতরটা পা’ষাণ হয়ে যাচ্ছে কেনো?’
২৪.
নিবিড়ের জ্বরটা আগের চেয়ে যথেষ্ট কম। নেই বললেই চলে। তবে অর্থির মনটা এখনো বিষণ্ন। নিবিড়কে কোনো কাজ দেয়নি প্রহর। তারা দুই ভাই মিলেই সবটা সামলাচ্ছে। তাই নিবিড় নিজ ঘরে বসে বসেই সময় কাটায়৷ অর্থিও ঘর থেকে বের হয়নি৷ চুপচাপ বারান্দার দরজা ঘেষে বসে আছে। নিবিড় একবার ঘর থেকে উঁকি দিয়ে অর্থিকে দেখে নেয়৷ তারপর নিঃশব্দে অর্থির পেছনে এসে দাঁড়ায়। অর্থি বুঝতেই পারে নাহ। নিবিড় গলা পরিষ্কার করে অর্থির পাশে বসে পড়ে। অর্থি নিবিড়ের দিকে তাকাতেই নিবিড় এক হাতে আগলে নেয় অর্থিকে। অর্থি আলগোছে নিজের মাথাটা নিবিড়ের কাঁধে রেখে চোখ বন্ধ করে থাকে। নীরবতা ভেঙে নিবিড়ই বলে,
‘গত দুদিন থেকেই এমন চুপচাপ বসে আছো! তোমার এমন চুপচাপ স্বভাব আমার ভালো লাগে না মেয়ে! আমার ওপর একটুও মায়া হয় না?’
অর্থি মাথা তুলে ফ্যালফ্যাল করে তাকায়। নিবিড় হাসে। অর্থির চুল এলোমেলো করে দিয়ে বলে, ‘এতো বোকা দৃষ্টিতে তাকাও বলেই তো এতোবার তোমার প্রেমে পড়ি!’
অর্থি মাথা নিচু করে নেয়। নিবিড় হাসে৷ মেয়েটা বুঝি বড় হয়ে গেলো! এখন বুঝি অনুভূতিময় কথাগুলো সহজেই বুঝে যায়! অর্থি আর নিবিড় দুজনেই চুপচাপ বসে থাকে। এর মাঝেই বাহির থেকে ডাক পড়ে। নিবিড়ের মা ডাকছে নিবিড়কে। নিবিড় ডাক শুনে বারান্দা থেকে উঠে এসে দরজা খুলে দেয়। অর্থিও মাথায় কাপড় দিয়ে এগিয়ে আসে। নিবিড়কে দেখেই নিবিড়ের মা নিপা বেগম ছেলেকে জড়িয়ে ধরে। অস্থির হয়ে জিজ্ঞেস করে,
‘তোর শরীর কেমন এহন আব্বা? একবার বাড়িত যাওন লাগে না? আমি চিন্তায় ম’ইরা যাই।’
নিবিড় হেঁসে বলে, ‘তুমি তো নানি বাড়ি গেছিলে। আসলেই তো কাল! আজ বিকেলেই চলে যাবো বাড়িতে।’
নিপা বেগম মেনে নেয়। ছেলের সাথে হাজারটা কথা বলে পেছনে তাকান। সেখানে অর্থি ছোট ছোট চোখ করে তাকিয়ে আছে। নিপা বেগম চোখ মুখ কুঁচকায়। অর্থিকে সে এর আগেও কয়েকবার দেখেছে। মেয়েটা একদম বোকা আর কথা বেশি বলে। শান্ত ভাবটা তার মধ্যে নেই। তার পছন্দের উল্টো মেয়েটা। শুধু রুপ আর জমিদার মেয়ে ছাড়া আর কোনো দিকই খুঁজে পায় না নিপা বেগম। মেয়েটাকে তার যথেষ্ট অপছন্দ অথচ এই মেয়ের সাথেই তার ছেলের বিয়ে হলো! কিভাবে হয়েছে তাও সে জানে। অর্থির ওপর মনে মনে ভীষণ ক্ষে’পে আছে তিনি৷ তার ধারণা অর্থি নিবিড়কে ফা’সিয়ে বিয়ে করেছে। তাই অর্থিকে দেখতেই তার হাসি হাসি মুখটা তেতোর মতো হয়ে যায়। গম্ভীর স্বরে অর্থিকে উদ্দেশ্য করে বলে,
‘শাওড়ি মা রে দেখলো যে সালাম করন লাগে এই বুদ্ধিডাও কি মাথায় অয় নাই? মা এ কিছুই শিখায় নাই তোমারে?’
অর্থি হকচকিয়ে যায়। দ্রুত একটু এগিয়ে এসে মুখেই সালাম দেয়। তাতে যে নিপা বেগম সন্তুষ্ট হলেন না এটা তার মুখ দেখেই বোঝা যায়। নিবিড় পাশ থেকে নিচু স্বরে বলে,
‘আম্মা! ‘ও’ তো ছোট মানুষ। অতো বোঝে নাহ। বাদ দাও!’
নিপা বেগম ছেলের দিকে কড়া দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলেন, ‘এহন কি তোর লাইগা ছেলের বউয়ের লগে কথাডাও কইতে পারমু না নিবিড়!’
নিবিড় হেঁসে সরে যায়। অর্থি মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। নিপা বেগম অর্থির কাছে এগিয়ে এসে আগের মতোই গম্ভীর স্বরে বলে, ‘পা এ হাত দিয়া সালাম করন লাগে জানো না!’
অর্থি দৃষ্টি এদিক ওদিক করে বলে, ‘আম্মাজান বলতেন একমাত্র আল্লাহ ছাড়া আর কারোর সামনে মাথা নত করা উচিত নয়।’
নিপা বেগম মনে মনে ভীষণ ক্ষুদ্ধ হলেন। তবে এই মুহুর্তে কিছু না বলে সবটা গিলে ফেললেন। একবার ছেলের দিকে তাকিয়ে একদম নিচু স্বরে অর্থির কাছে ঘেঁষে এসে বললেন,
‘কোনডা উচিত আর কোনডা অনুচিত ওইডা না হয় আমি আমার বাড়িত্তে শিখামুনি তোমারে! কয়দিন আর থাকবা বাপের বাড়িত? শান্তিতে থাইকা নেও এরপর আর শান্তির আশা কইরো না।’
অর্থি চমকায়। নিপা বেগম চলে যায়। নিপা বেগমের কথার সঠিক সারমর্ম অর্থি বুঝতে পারেনি। বোকা মেয়েটা বুঝেই উঠেনি তার শ্বশুড়বাড়িতে ঢোকার আগেই অশান্তির বীজ বোনা হয়ে গেছে!
২৫.
গ্রামের সব মানুষের খাওয়া দাওয়া শেষ। চৈত্রিকা নিজেও খেয়ে নিয়েছে। এরপর ঘরে ঢুকেছে আর বের হয়নি। বের হতে মূলত ভালোও লাগছে না তার। সাথীর মৃ’ত্যুর পর তার সবকিছুই বিষাদ লাগে। আচ্ছা আমাদের কাছের মানুষগুলো হারিয়ে যায় কেনো? কেনো তারা আজীবন আমাদের সাথে থাকে না? চৈত্রিকার প্রশ্নগুলোর উত্তর যেনো আপনা আপনিই আসে, ‘মানুষ কখনো আজীবন বাঁচে না। জন্ম হলে মৃ’ত্যু নিশ্চিত এটাই নিয়তি। এই সত্যকে মেনেই আমাদের আজীবন বাঁচতে হয়। সবাই কখনোই থাকে নাহ। কে কোথায়, কিভাবে হারালো তা ধরে না রেখেই আমাদের এগোতে হয়। বাঁচতে হয়! ভালো থাকতে হয়!’ চৈত্রিকা দীর্ঘশ্বাস নেয়। অভিযোগ করার জায়গা নেই। কার কাছে, কার ওপর করবে অভিযোগ? চৈত্রিকার ভাবনার মাঝেই প্রহরের ক্লান্ত কন্ঠ ভেসে আসে,
‘খেয়েছো চৈত্র?’
চৈত্রিকা এক পলক তাকায় প্রহরের দিকে। ঘামে ভেজা ক্লান্ত চোখ মুখ। প্রহরের থেকে চোখ সরিয়ে নিয়ে ছোট্ট করে জানান দেয় যে সে খেয়েছে। প্রহর আর কিছু না বলে নিজের শার্ট খুলে বিছানায় শুয়ে পড়ে। ঘুমে চোখ দুটো বুজে আসছে যেনো! চৈত্রিকা আড়চোখে প্রহরের দিকে তাকিয়ে ছোট্ট করে বলে,
‘অনিম ভাই এসেছে?’
প্রহর চোখ বন্ধ করে চোখের ওপর হাত রাখে৷ ওই অবস্থাতেই বলে, ‘এখনো তো আসেনি। আসবেও না বোধহয়!’
চৈত্রিকা ভাবলেশহীন ভাবে বলে, ‘আসবে। আমাকে নিতে আসবে অনিম ভাই।’
প্রহর অবাক হলো। চোখের ওপর থেকে হাত সরিয়ে উঠে পড়ে। চৈত্রিকার দিকে শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে শুধায়, ‘তোমাকে নিতে আসবে মানে?’
‘নিতে আসবে মানে নিতে আসবে। আমি ওই শহরেই আবার যাচ্ছি।’
প্রহরের হুট করেই ভীষণ রাগ হলো। চৈত্রিকার মনের দিকটা বুঝেই সে এই ৩ দিন চুপচাপ মেনে নিয়েছে সব। তার মানে তো এই না যে চৈত্রিকা তাকে ছেড়ে কিংবা তাাকে না বলেই শহরে চলে যাবে আর সেটা সে মেনে নিবে! চৈত্রিকার বাহু শক্ত করে চেপে ধরে নিজের দিকে ফিরায়। চোখ মুখ ততক্ষণে শক্ত হয়ে গেছে। চৈত্রিকা অনুভূতিশূণ্যের মতো চেয়ে রয় প্রহরের মুখ পানে। প্রহর বড় বড় শ্বাস নিয়ে রাগ নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করে বলে,
‘কোথায় যাবে তুমি? কেনো যাবে?’
চৈত্রিকা হেসে বলে, ‘ভয় নেই জমিদার সাহেব! আমি বিশ্বাসঘা’তকের মতো ছেড়ে যাবো নাহ। শুধু ক’দিনের জন্য একটু ওখানে থাকতে যাবো। তারপর চলে আসবো!’
প্রহর ছেড়ে দেয় চৈত্রিকাকে৷ চোখ থেকে ঘুম উবে গেছে। এই কঠিন চৈত্রিকা কবে বুঝবে তাকে হারানোর ভয়ে এই পা’ষাণ পুরুষ দিনে দিনে ভেতরে ভেতরে ম’রণ য’ন্ত্রণা সহ্য করেও উপরে চুপচাপ গম্ভীর হয়ে আছে! নাহ এই মেয়েটি কখনোই হয়তো বুঝবে নাহ। অনেকক্ষণ দুজন ওভাবেই বসে থাকে। এর মাঝেই বাহির থেকে ডাক আসে। অনিম এসেছে তাই চৈত্রিকার ডাক পড়েছে। চৈত্রিকা দীর্ঘশ্বাস ফেলে উঠে যায়। ঘরের দরজার সামনে গিয়েও দাঁড়িয়ে যায়। শান্ত কন্ঠে বলে,
‘আপনার আর আমার মাঝে দূরত্ব বেড়েছে জমিদার সাহেব। সাথীর মৃ’ত্যুর পর আপনার আর আমার দূরত্ব হয়েছে আকাশ পাতাল। আমি তো আপনাকে বিশ্বাস করেছিলাম কিন্তু আপনি আমার বিশ্বাসটা ভাঙলেন কেনো?’
প্রহর অবাক কন্ঠে বলে, ‘আমি তোমার বিশ্বাস ভেঙেছি? তোমার ধারণা সাথীর মৃ’ত্যুর পেছনে আমার হাতও..!’
চৈত্রিকা তাচ্ছিল্য করে হাসে। চোখের কোণা জলে ভরে আসে। বলে, ‘সাথী বলেছিলো আপনি আর পিয়াস রেনওয়াজ মিলে সব করছেন। কিন্তু আমি বিশ্বাস করিনি। আপনাকে বিশ্বাস করেছি। আচ্ছা মহুয়া বুবু আর পিয়াস দুজন মিলেই তো আপনাকে ঠ’কিয়েছিলো! তবে আপনি মহুয়া বুবুকে শা’স্তি দিলেন পিয়াস রেনওয়াজকে কেনো দিলেন না?’
‘আমি প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ছিলাম এবং এখনো আছি। জমিদাররা প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করে না আর তা যদি হয় প্রহর রেনওয়াজ তবে তার কাছে ন্যায় অ’ন্যায়ের মতো প্রতিজ্ঞা রাখাটাও ভীষন জরুরি।’
চৈত্রিকা হাসে। কথা না বাড়িয়ে উল্টো ঘুরে চলে যেতে নেয়৷ প্রহর পেছন থেকে ডাকে। চৈত্রিকা ফিরে তাকাতেই প্রহর অদ্ভুত কন্ঠে বলে,
‘তোমার জমিদার সাহেব বিশ্বাসঘা’তক নয়। তুমি যদি খানিকটাও আমার ভালোবাসা বুঝতে চৈত্র তবে তোমার কাছে আমি বিশ্বাসঘা’তক না হয়ে, ঘৃ’ণা না পেয়ে তোমার ভরসার স্থান হতাম। শুধু ভালোবাসলেই হয় নাহ চৈত্র ভালোবাসার মর্ম হিসেবে বিশ্বাসটাও আঁকড়ে ধরে রাখতে হয়। ভালোবাসার মানুষকেও ধরে রাখতে হয়। হেলায়, ভুলে হারিয়ে ফেললে আর কখনো পাওয়া যায় নাহ। আমি তোমার সাথে আজীবন ভালোবেসে কাটাতে চেয়েছি কিন্তু তুমি না চাইলে আমি তোমাকে জোড় করতে পারি নাহ। করবোও নাহ। তোমার মন চাইলে মুক্ত হয়ে যেতে পারো।’
চলবে..
#চৈত্রিকা (৪৭)
#বোরহানা_আক্তার_রেশমী
_______________
২৬.
কেটেছে প্রায় ১৫ দিনের মতো। জমিদার বাড়ি আর আগের মতো নেই। অর্থির বিদায় হয়েছে মিলাদের পরেরদিনই। একই গ্রাম হওয়ার পরও অর্থির সে কি কান্না! পল্লবীকে ছেড়ে সে কিছুতেই যাবে নাহ। কোনো রকমে জোড় করে পাঠানো হয়েছে। চৈত্রিকা ৩/৪ দিনের মতো শহরে ছিলো। তারপর আবার ফিরে চলে আসছে। প্রহর আর চৈত্রিকার মাঝে দূরত্ব বেড়েছে বেশ অনেকটা। এতো সবের মধ্যে শুধু ঠিক আছে চিত্র আর অর্পিতা। কাল তারা শহরে চলে যাবে। দুজনেরই পড়ালেখা আছে। কতদিন আর এখানে থাকা যায়! তাছাড়া এখানে সবাার মুখ দেখলে দুজনেরই কষ্ট হয়। পল্লবীই দুজনকে শহরে চলে যেতে বলেছে। নীরা ডাক্তার দেখিয়ে সিউর হয়েছে সে সত্যিই প্রেগন্যান্ট। এই কথাটা গত ১৫ দিনে সে কাউকেই জানায়নি। মূলত ভয় পাচ্ছে বিষয়টা কে কিভাবে নিবে! পিয়াস মা’রা গেছে ১ মাসও হয়নি এর মাঝেই এতো বড় একটা খবরে সে নিজেই এলোমেলো হয়ে গেছে। আজ নীরার বাড়ির লোকজনও আসবে তাকে নিয়ে যেতে। যেখানে পিয়াসই নেই সেখানে অল্পবয়সী বিধবা মেয়েকে তারা রাখবে কেনো? অযথাই মেয়ের জীবন ন’ষ্ট না করে তারা মেয়েকে আবার বিয়ে দেবে! নীরা এই কথা শোনার পর থেকেই চিন্তিত হয়ে পড়েছে। কি করবে আর কি করবে না ভেবেই হয়রান হয়ে যাচ্ছে। নিজের ঘরে বেশ অনেকক্ষণ পায়চারী করে আর থাকতে পারে না নীরা। বিষয়টা নিয়ে সরাসরি চৈত্রিকার সাথে কথা বলা উচিত ভেবেই ছুট লাগায় চৈত্রিকার ঘরের দিকে। প্রহর তখন বাহিরে গেছে। হয়তো কোনো কাজে! ঘরে চৈত্রিকা একাই বসে ছিলো। নীরা ঘরে কড়া নাড়ে। চৈত্রিকা দরজা খুলে দেখে নীরা। চৈত্রিকা কিছু বলার আগেই নীরা দ্রুত ঘরের দরজা বন্ধ করে দিয়ে চৈত্রিকার হাত আঁকড়ে ধরে বলে,
‘আপনার সাথে জরুরী কথা আছে ভাবীজান!’
‘আচ্ছা আচ্ছা! কি কথা আছে তা বলবেন কিন্তু এতো উত্তেজিত হচ্ছেন কেনো বুবু?’
নীরা বড় বড় শ্বাস নেয়। চৈত্রিকা নীরাকে বিছানার ওপর বসাতেই নীরা শান্ত কন্ঠে বলে, ‘আমি প্রেগন্যান্ট ভাবীজান!’
চৈত্রিকা চমকায়। একটু জোড়েই বলে ওঠে, ‘কিহহ!’
নীরা ভয় পায়। চৈত্রিকা নিজের অবাকতা কাটানোর চেষ্টা করে হেঁসে বলে, ‘এটা তো ভালো খবর! কবে পেলেন এই সুখবর? একবারও জানালেন না তো বুবু!’
‘২ মাস চলছে। জেনেছিলাম মিলাদের দিন। পরে ডাক্তার দেখিয়ে সিউর হয়েছি।’
‘এতোদিন পর বলছেন এতো ভালো খবর?’
নীরাা চুপ করে থাকে। ভীষণ কান্না পায় তার। কিছুক্ষণ ওভাবে চুপ থাকে। চৈত্রিকা বোঝে নীরার মনে নিশ্চয় কিছু চলছে! মেয়েটা চিন্তিত। হয়েছে টা কি আসলে? চৈত্রিকা নিজেও আলগোছে নীরার সামনে চেয়ার টেনে বসে। নীরা মাথা নিচু করে বলে,
‘ভালো খবর টা কি আসলেই ভালো ভাবীজান? উনি মা’রা গেছে কেবল ১৫ দিন। আমি ২ দিনের দিন জানতে পেরেছি। এটা যে কি বেদনাদায়ক তা কি বোঝাতে পারি? এই বাচ্চাটা আরো আগে আসলে হয়তো উনি শুধরে যেতেন! আবার হয়তো যেতেন না। কিন্তু উনি নিজের সন্তানের খবরটাও পেলেন না। এটার য’ন্ত্রণা আমি কেমন করে বোঝাবো?’
চৈত্রিকা হাতে হাত চেপে বসে থাকে। সে নিজ হাতে একটা অনাগত সন্তানকে অনাথ করে দিয়েছে। তারই বা কি করার ছিলো! পিয়াস যে পরিমাণ অ’ন্যায় করেছে তাতে এই শা’স্তিটুকু তার প্রাপ্য ছিলো। চৈত্রিকা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে মাথা নিচু করে রাখে। নীরা ব্যস্ত গলায় বলে,
‘আমি কিন্তু আপনাকে কোনো দোষ দিচ্ছি না ভাবীজান। আপনি যা করেছেন তা কারোর না কারোর করারই ছিলো। তাছাড়া এটা আমার ভাগ্যে ছিলো।’
চৈত্রিকা শান্ত স্বরে বলে, ‘যা হয় তা ভালোর জন্যই হয় বুবু। কে বলতে পারে! পিয়াস বেঁচে থাকলে আপনার এই সন্তানকে নিজের মতো জ’ঘন্য বানাতো না! চয়ন রেনওয়াজ নিজ হাতে নিজের ছেলেকে যেভাবে অন্যায় শিখিয়েছে পিয়াস রেনওয়াজও যে তা করতো না তার কি নিশ্চয়তা ছিলো?’
নীরা চুপ থাকে। কিছুটা সময় দুজনে ওভাবেই বসে থাকে। চৈত্রিকা স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করে বলে, ‘আচ্ছা নিচে চলেন! এতো ভালো সংবাদ সবাইকে জানাতে হবে তো নাকি!’
নীরা আতকে ওঠে। আতঙ্কে হাত চেপে ধরে চৈত্রিকার। দুদিকে মাথা নাড়িয়ে বোঝায় ‘না’। চৈত্রিকা বুঝতে পারে নাহ নীরার ব্যবহারের মানে। জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাতেই নীরা ভয়ে বলে,
‘আমার মনে হয় না এই বিষয়টা সবাই স্বাভাবিক ভাবে নিবে! আমি জানি নাহ আদৌও মানুষ আমার বাচ্চাটাকে সঠিক ভাবে নিবে কি না!’
‘মানে কি?’
‘মানুষ এমনই ভাবীজান। যেহেতু উনি মা’রা গেছে তাই কারোরই বলতে বাঁধবে না এটা উনার সন্তান না!’
নীরার কন্ঠ কেঁপে ওঠে। চৈত্রিকা ফুঁসে ওঠে। কন্ঠের জোড় বাড়িয়ে বলে, ‘কেনো বলবে? আমরা জানি সত্যটা।’
নীরা চুপ করে থাকে। চৈত্রিকা নীরার হাত ধরে বলে, ‘চলেন নিচে যাবো! এসব ভেবে যত নিজেকে গুটিয়ে নিবেন ততই মানুষ পার পেয়ে যাবে। শক্ত হোন! নিজের লড়াই নিজে লড়তে শিখেন!’
নীরা কান্না ভেজা চোখে তাকিয়ে বলে, ‘আমার সাথেই এমন কেনো হলো ভাবীজান?’
‘যা হয় তা ভালোর জন্যই হয় বুবু। আল্লাহ কিছু কেড়ে নিয়ে আবার কিছু দিয়েও দেন! আপনার ভালোবাসা কেড়ে নিয়ে হয়তো বাঁচার জন্য অবলম্বন দিলেন তিনি! আপনি আঁকড়ে ধরে রাখুন।’
২৭.
অর্থির আজ ভাতের ফ্যান ঢালতে গিয়ে হাতে পড়ে হাত পু’ড়ে গেছে। জীবনে রান্নাঘরে না যাওয়া মেয়েটা এ’কদিনে যথেষ্ট ভুলের ওপর ভুল করেই গেছে আর নিপা বেগম কথা শুনিয়ে গেছেন। এই সংসারে পা রাখার পর অর্থির বোঝা হয়ে গেছে তার কপালে সুখ নেই। আগের সেই চঞ্চল, বোকা অর্থি এখন যথেষ্ট কম কথা বলার চেষ্টা করে। নিবিড়ের সাথেও মেপে মেপে কথা বলে। কখন কোথা থেকে শ্বাশুড়ি এসে ক’টু কথা শোনাবে এই ভয়েই! হাতে ভাতের ফ্যান পড়ার সাথে সাথেই অজান্তে অর্থির মুখ থেকে ‘ওমাগো’ বের হয়ে আসে। ছুটে আসে নিপা বেগম। অর্থি কান্না ভেজা চোখে হাতটা ততক্ষণে পানিতে চুবিয়েছে। কি ভীষণ জ্বা’লা পো’ড়া যে করছে! নিপা বেগম রান্নাঘরে এসে নিচে ভাতের ফ্যানের সাথে কিছুটাা ভাত পড়া দেখে ক্ষে’পে উঠলেন। রাগে কটমট করতে করতে বলতে শুরু করলেন,
‘কোনো কামডাই তোমারে দিয়া হয় না। সামান্য দুইডা ভাত রানতো দিছি তাও তুমি পারতাছো না! মা এ কি খালি খাওয়াইয়া আর খোলা ষা’ড়ের মতো ছাইড়া দিয়াই বড় করছে? আর কিছুই শিখায় নাই? আমার কত্তডি ভাত ন’ষ্ট করলা? ভাতের ফ্যানডিও তো ছাগলরে দেওয়া যাইতো হেইডাও ন’ষ্ট করলা! এখন পানির মধ্যে হাত রাইখা ঢঙ না কইরা জলদি এগুলা পরিষ্কার করো!’
অর্থির গলা ফাটিয়ে কাঁদতে ইচ্ছে করলো। মানুষ কি আদৌও এতো পা’ষাণ হয়! তার হাত পু’ড়ে গেছে এটা একবারও না দেখে ভাতের ফ্যানটাই চোখ পড়লো! নিপা বেগম তখনো নিজের মতো বলতেই আছেন। অর্থি এক হাতে চোখ মুছে নিয়ে পু’ড়া হাত বের করে নেয়। দাঁতে দাঁত চেপে পুরো জায়গাটা পরিষ্কার করে। যতটা স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করে ঠিক ততটাই কান্না আসে। নিজের বাড়ির কথা ভীষণ মনে পড়ে তার! সব মেয়ে সত্যিই তার বাবার বাড়িতে রাজকন্যার মতো বড় হয় আর সে তো স্বয়ং জমিদার কন্যা। ৩ ভাইয়ের একমাত্র আদরের বোন ছিলো। কখনো একটা কুটোও যার নাড়তে হয়নি তাকে পুরো সংসার সামলাতে হয়। যে মেয়েটা একটু ব্যাথা পেলেই মায়ের আঁচল ধরে কেঁদেছে কিছুদিন আগেও সেই মেয়েটার চোখের জল দেখার মতো কেউ নেই। অর্থি নিজের ভেতরের দীর্ঘশ্বাস গুলো নিজের মাঝেই গিলে নেয়। চুপচাপ পো’ড়া, ক্ষ’ত হাতটা নিয়েই সব কাজ করতে থাকে। এর মাঝেই সন্ধ্যার আযান হয়। অর্থি সব গুছিয়ে ঘরে তুলে হাত মুখ ধুয়ে ওজু করে নেয়। পো’ড়া হাতে পানি ঠেকলেই মনে হচ্ছে জান বের হয়ে যাবে কিন্তু কিছু করার নেই। নামাজ আদায় করে ঘরের মাঝেই চুপচাপ বসে থাকে। কতক্ষণ পরই নিবিড় ঘরে আসে। অর্থি পো’ড়া হাতটা ওড়নার আড়ালে রাখে। ঘামে ভেজা চুপচুপে, ক্লান্ত শরীরটা টেনে এনে অর্থির পাশে বসে। ক্লান্ত গলাতেই বলে,
‘এক গ্লাস পানি দিবে অর্থি!’
অর্থি মাথা নাড়িয়ে ব্যস্ত গলায় বলে, ‘এক্ষুণি আনছি!’
অর্থি ছুটে গিয়ে কলপাড় থেকে এক গ্লাস পানি এনে দেয়। নিবিড়কে দিয়ে হাত পাখা দিয়ে বাতাস করতে থাকে। নিবিড় ক্লান্ত ভঙ্গিতেই হাসে। অর্থি চিন্তিত গলায় বলে,
‘অনেক ক্লান্ত লাগছে মাষ্টারমশাই?’
নিবিড় সন্তুষ্ট চিত্তে হেঁসে বলে, ‘উহু একদমই নাহ। এই বোকা মেয়েটার বোকা বোকা মুখ দেখলেই আমার সকল ক্লান্তি উবে যায়।’
অর্থি মাথা নিচু করে নেয়। এই যে সারাদিন এতোকিছুর পর সেও তো এই মানুষটার নীড়েই শান্তি পায়! সকল য’ন্ত্রণার সমাপ্তি হয়ে যায় এই মানুষটার দিকে তাকালেই। নিবিড় এক হাতে অর্থির হাত টেনে পাশে বসিয়ে দেয়। উচ্ছ্বসিত কন্ঠে বলে,
‘এই যে মেয়ে! তোমার মাষ্টারমশাইয়ের চাকুরী হয়ে গেছে। এবার দুজনের ছোট্ট একটা শান্তির নীড় হবে। যেখানে সুখ উড়ে বেড়াবে চারপাশে!’
অর্থি হাসে। নিজেও উচ্ছ্বসিত হয়ে বলে, ‘আলহামদুলিল্লাহ।’
‘কিন্তু একটা সমস্যা আছে!’
নিবিড়ের দমে যাওয়া গলা শুনে অর্থির মুখ থেকেও হাসি মিলিয়ে যায়। অর্থি জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালে নিবিড় বলে, ‘শহরে হয়েছে। আমার ওখানেই থাকতে হবে। আপাতত তোমাদের নিয়ে যেতে তো পারবো নাহ।’
‘এতে মন খারাপ করার কি আছে? বাড়িতে কি আসবেন না নাকি!’
‘আসবো তাও মাস শেষে। হয়তো ২/১ দিনের জন্য।’
অর্থি দৃষ্টি অন্যদিকে সরিয়ে নেয়। মুখে যত যায় বলুক তার মন শায় দেয় না নিবিড়কে দুরে পাঠাতে! এ সংসার তার জন্য এমনিই ভ’য়ং’কর এরওপর নিবিড় না থাকলে তার তো ম’রে যেতে হবে! কত কত দিন সে তার মাষ্টারমশাইকে দেখতেও পাবে নাহ। এসব ভেবেই ভীষণ কান্না,
পেলো তার। কোনো মতে নিজেকে সামলে ‘আপনাকে খাবার দিচ্ছি’ বলে উঠে যেতে নিলে নিবিড় অর্থির পো’ড়া হাতটাই চেপে ধরে৷ ব্যাথায় অর্থির মুখ থেকে আর্তনাদ বেড়িয়ে যায়। নিবিড় হঠাৎ এমন আর্তনাদে ভয় পেয়ে হাত ছেড়ে দেয়। অর্থি হাত আগলে নিয়ে চোখ মুখ খিঁচে থাকে। নিবিড় এগিয়ে এসে আগে হাতটাই দেখে। পো’ড়া জায়গা দেখে চমকে যায়! খপ করে হাত ধরে বলে,
‘তোমার হাতে কি হয়ছে? পু’ড়ে গেছে? কিভাবে? এতক্ষণ বলোনি কেনো?’
অর্থি কোনো কথার জবাব না দিয়ে হাত সরিয়ে নেয়। হাত অনবরত কাঁপতে থাকে। নিবিড় আঁকড়ে ধরে অর্থিকে৷ আদুরে হাতে মাথায় হাত বুলায়। অর্থি ঠোঁট চেপে কান্না আটকায়। নিবিড় ফের প্রশ্ন করে,
‘হাত পু’ড়লো কিভাবে?’
অর্থি ভাঙা গলায় ছোট্ট করে জবাব দেয়, ‘হাতে ভাতের ফ্যান পড়েছিলো!’
‘কিভাবে পড়লো? আম্মা ছিলো না? তুমি তো এসব পারো নাহ। আম্মাকে বললেই তো আম্মা করে দিতো!’
অর্থি জবাবে কোনো টু শব্দই করে নাহ। নিবিড় অর্থিকে বিছানার ওপর বসিয়ে দিয়ে বলে, ‘তুমি বসো! আমি আম্মার সাথে কথা বলে আসি!’
আতঙ্কে সাথে সাথেই নিবিড়ের হাত চেপে ধরে অর্থি। চট করে বলে, ‘কি বলবেন?’
নিবিড় কপাল কুঁচকে উত্তর দেয়, ‘কি বলবো আবার? এমনিই কথা বলবো। তুমি এমন করতেছো কেন? কি হয়ছে বলো তো!’
অর্থি হাত ছেড়ে দেয়। নিবিড় দুমিনিট ওভাবেই দাঁড়িয়ে থাকে অর্থির উত্তরের আশায়। কিন্তু অর্থি জবাব দেয় না। তাই দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিজেই এগিয়ে যায় নিপা বেগমের ঘরের দিকে। নিপা বেগমের ঘরের দরজায় টোকা দিতেই তিনি দরজা খুলে দেন। নিবিড় হাসি মুখে বলে,
‘আম্মা খাইছো? আব্বা খাইছে?’
নিপা বেগম ছেলের গালে হাত বুলিয়ে দেন। বলেন, ‘নাহ আব্বা খাইছি নাহ এহনো। তুই খাইবি নাহ?’
‘হুম খাবো। আসো! একসাথে খাই!’
নিপা বেগম মাথা নেড়ে সম্মতি দিলেন। নিবিড় হাত মুখ ধুতে গেলে নিপা বেগম ৩ জনের জন্য খাবার বাড়েন। এরপর নিপা বেগম, নিবিড়ের বাবা শামীম আহমেদ আর নিবিড় খাওয়া শুরু করে। খাওয়ার এক পর্যায়ে কথায় কথায় নিবিড় নিচু গলাতেই বলে,
‘আম্মা! অর্থি তো জমিদার বাড়ির মেয়ে। ‘ও’ কখনো রান্না ঘরে যায় নাই ওরে একটু কম কম কাজ দিয়ে সব না হয় শিখিয়ে নেও। মেয়েটা আজ হাত পু’ড়িয়ে ফেলেছে। তুমি একটু সব কাজ….’
এটুকু বলতেই নিপা বেগম খাওয়া ছেড়ে ফুঁসে উঠলেন। তার ছেলে বউয়ের হয়ে কথা বললো বিষয়টা তিনি মানতে পারলেন নাহহ। গলার স্বরের জোড় বাড়িয়ে বললেন,
‘তোর বউরে কি জোড় কইরা কাম করাই নি আমি? হেই নিজ ইচ্ছাতেই তো করে! এহন নিজে হাত পু’ড়াইয়া আবার নিজেই আমার পোলার কানে আমার নামো বি’ষ ঢালা শুরু করছে! আমার সংসারে আয়ছে ১৫ দিনও হয় নাই আর হেই মাইয়া এহনই আমার পোলারে আমার থেইকা ছিন্না নিতাছে!’
নিবিড় শান্ত হয়ে বলে, ‘আম্মা এমন কিছু নাহ। অর্থি আমারে কিছু বলে নাই৷ তুমি একটু আস্তে বলো! শুনতে পেলে মেয়েটা কষ্ট পাবে।’
নিপা বেগম শুনলেন না। শামীম আহমেদ ধমক দিলেও কোনো কাজ হলো নাহ। আরো জোড়ে তিনি যা তা বলতে থাকলেন। ঘর থেকে সবকিছুই শুনে অর্থি। চোখের কোণ বেয়ে জল গড়ায় আপনমনেই। বিড়বিড় করে আওড়ায়,
‘ভালোবাসা পাওয়ার এতো সুখ!’
চলবে..
(আসসালামু আলাইকুম। ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।)