#চৈত্রিকা (৪৮)
#বোরহানা_আক্তার__রেশমী
__________________
২৮.
জমিদার বাড়িতে বৈঠক বসেছে। নীরার বাপের বাড়ির লোকজন এসেছে তাকে নিতে। নীরার সাথে সবাই কথা বলার মাঝেই চৈত্রিকা পল্লবীকে এক পাশে টেনে নিয়ে নীরার প্রেগন্যান্সির কথা বলে। পল্লবী অবাক হয়। সে জানে নীরা কেমন! তাই নীরাকে সন্দেহ করার প্রশ্নই আসে নাহ। পল্লবী ভরা বৈঠকে কথাটা তুলতেই পরিবেশ গম্ভীর হয়ে গেলো। চয়ন গম্ভীর মুখ নিয়ে বসে রইলো মেঝের দিকে তাকিয়ে। নীরা নিঃশব্দে চৈত্রিকার হাত ধরে রেখেছে। নীরার বাবা মা একটু নড়েচড়ে বসলেন। এক পলক মেয়ের দিকে তাকিয়ে চয়নকে উদ্দেশ্য করে নীরার বাবা বলেন,
‘দেখেন বেয়াই সাহেব! আমার মেয়ের বয়স কম। ওদের বিয়েরও তো যুগ যুগ পার হয়নি। আমরা শিক্ষিত পরিবারের মানুষ। এভাবে মেয়েকে কষ্ট পেতে দেখতে পারি নাহ।’
‘আমরাও চাই নাহ নীরা কষ্ট পাক। আপনাদের মেয়ে আপনারা কি করবেন তা আপনাদের ব্যাপার!’
চয়নের কথায় নীরার বাবা মা স্বস্তি পেলেও চৈত্রিকা, নীরাসহ বাড়ির বাকি লোকজন গুলো স্বস্তি পেলো নাহ। অস্থির হয়ে গেলো। অর্পিতা বার বার নীরার দিকে তাকাচ্ছে৷ নীরার মা নীরার উদ্দেশ্য বললেন,
‘নীরা মা! তৈরী হয়ে আয়। আমরা ফিরবো!’
নীরা জবাব দিলো না তবে নিজ জায়গা থেকে সরলোও নাহ। শুধু শক্ত করে চৈত্রিকার হাত চেপে ধরে থাকলো। বড় বড় শ্বাস নিয়ে নিজেকে সময় দিলো। নীরার বাবা ভারী কন্ঠে বলে,
‘যাচ্ছো না কেনো?’
নীরা মাথা নিচু করে ছোট্ট করে উত্তর দেয়, ‘আমি যেতে চাই নাহ আব্বাজান। আমি আবার বিয়ে করতে চাই নাহ। আমি… আমার অ-অনাগত বাচ্চাকে নিয়েই বাকিটা জীবন কাটিয়ে দিতে চাই।’
নীরার কথা শুনে বেশ অবাক হয় তার বাবা মা। চৈত্রিকা ঠোঁট প্রসারিত করে হাসে। নীরার ধরে রাখা হাতটা নিজেও শক্ত করে ধরে আশ্বাস দেয়। অর্পিতা, শায়লা, পল্লবীও ভীষণ খুশি হয়। নীরার বাবা রাগী কন্ঠে বলে,
‘আব্বাজানের মুখের ওপর কথা বলা শিখেছো কবে থেকে? কে শিখিয়েছে তোমাকে এসব?’
পল্লবী মুখ খোলে। মাথার আঁচল টা আরেকটু টেনে নিয়ে শান্ত কন্ঠে বলে, ‘শিখানো কি আছে ভাইজান? মেয়ে নিজের সিদ্ধান্ত জানানোটা মুখের ওপর কথা বলা নয়। তাছাড়া ওর সন্তান আসছে তাহলে ‘ও’ তাকে বিসর্জন দিয়ে নতুন বিয়ে করবে কেনো? ওর কি নিজের সন্তানের প্রতি মায়া নাই? নাকি আপনি আপনার সন্তানকে ভালোবাসেন আর ‘ও’ বাসে না?’
নীরার মা ক্যাটক্যাটে গলায় বলে, ‘আপনি আর আমার মেয়েকে বিগড়ে দিয়েন না বেয়াইন সাহেবা! আমার মেয়ের পুরো জীবন পড়ে আছে৷ এই সন্তান দিয়ে ওর কি হবে? আজীবন এমনি যুবতী হয়ে ঘরে পড়ে থাকবে! এতো সহজে কি আমি আমার মেয়ের জীবন ন’ষ্ট করবো! আজ আপনার মেয়ে হলে আপনি কি করতেন? রাখতে দিতেন এই বাচ্চা? যে বাচ্চার বাপ জন্মের আগেই মা’রা গেছে!’
‘আমি আমার মেয়েকে অন্তত তার বাচ্চা বিসর্জন দিতে বলতাম না। ওর মতামত নিতাম। ওর ইচ্ছেকে সম্মান করতাম। তাও যদি হয় এমন বুঝদার, লক্ষী একটা মেয়ে তাহলে কোনো কথা-ই নেই।’
পল্লবীর শান্ত গলার কথা শুনে মহিলা মুখ বাঁকালেন। চয়ন ধমকে থামিয়ে দেয় পল্লবীকে। নীরার মা উঠে নীরার কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। বাহু চেপে ধরে বলে,
‘চলো! তৈরী হবে তুমি।’
নীরা যাবে নাহ। চৈত্রিকা নীরার বাহু থেকে হাত সরিয়ে দেয়। নীরার মা ভ্রু কুঁচকে তাকাতেই চৈত্রিকা হেঁসে বলে, ‘নীরা বুবু যখন যেতে চায় না তখন তো আপনি উনাকে নিয়ে যেতে পারবেন না আম্মা!’
নীরার মা ফুঁসে উঠলেন। রেগে গলা উচু করে বললেন, ‘তুমি বলার কে? আমি আমার মেয়েকে নিয়ে যাবো নাকি রেখে যাবো তা আমাদের ব্যাক্তিগত বিষয়। ছাড়ো তুমি ওকে! আর ভাই সাহেব! আপনি থাকা অবস্থাতে বাড়ির বউরা কথা বলে কেমন করে?’
চৈত্রিকা কিছু বলার আগেই চয়ন এবার ধমকে দেয়। দাঁতে দাঁত চেপে বলে, ‘দুজন যদি আর একটাও শব্দ করেছো তাহলে ভালো হবে নাহ।’
কথা শেষ হওয়ার সাথে সাথেই নীরার মা চৈত্রিকার হাত নীরার থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে সিড়ির দিকে টেনে যেতে নেয়। নীরা বার বার ‘না’ বলতে থাকে। চৈত্রিকা এগিয়ে গিয়ে কিছু বলার আগেই সদর দরজার কাছ থেকে প্রহরের ভারী, গম্ভীর কন্ঠ কানে আসে। নীরার মা সহ সবাই সেদিকেই তাকায়। প্রহর ভরাট গলায় বলে,
‘আমাদের বাড়ির বউ যেতে না চাইলে আপনি জোড় করে নিয়ে যেতে পারবেন না। অতএব উনার হাত ছাড়ুন!’
নীরার মায়ের হাত আলগা হয়ে যায়। এতক্ষণ প্রহর ছিলো না বলেই তিনি এতো বড় বড় কথা বলতে পেরেছেন। কারোরই অজানা নয় প্রহর সম্পর্কে। জমিদার বাড়ির বড় ছেলে সবার কাছে আতঙ্ক। যতটা ভালো, বুদ্ধিমান ততটাই নি’কৃষ্ট হয় এরা। প্রহর সরাসরি এসে বসে পড়ে চয়নের পাশে। চয়নের দিকে না তাকিয়ে নীরার বাবাকে সরাসরি প্রশ্ন করে,
‘নীরার বিয়ে দিতে চান ভালো কথা! ওর অনুমতি নিয়েছেন?’
নীরার বাবা ভ্রু কুঁচকে উত্তর দেয়, ‘ওর অনুমতি কেনো নিতে হবে? ‘ও’ আমার মেয়ে। ওর বিষয়ে সব ধরনের সিদ্ধান্ত আমি নিতে পারি।’
‘বলা শেষ? আসতে পারেন!’
নীরার বাবা অবাক হয়ে বসা থেকে দাঁড়িয়ে পড়ে। চৈত্রিকা হা করে তাকায় প্রহরের দিকে। প্রহর স্বাভাবিক। যেনো সে খুবই সাধারণ একটা কথা বলেছে। নীরার বাবা রেগে চয়নকে বলে,
‘জমিদার বলে যা তা! বাড়িতে বসিয়ে অ’পমান করে তাড়াবেন! বড়দের সাথে কিভাবে কথা বলতে হয় এটুকু শিক্ষাও নেই?’
চয়ন কপাল কুঁচকালেন। সে বরাবরই মানুষের কথা সহ্য করতে পারে নাহ। তাই ছেলেকে চুপ না করিয়ে চুপচাপ বসে রইলেন। ভাবটা এমন ‘প্রহর যা করছো তা ঠিক! পারলে ঘা’ড় ধা’ক্কা দিয়ে বের করে দে!’ নীরার বাবা চয়নের গা ছাড়া ভাব দেখে আরো রেগে গেলেন। নীরাকে ফের যাওয়ার কথা বললেন। নীরা শুধু ভেজা নয়নে তাকিয়েছিলো। সে এই বাড়ি থেকে বের হওয়ার সাথে সাথেই তার সন্তানের অস্তিত্ব যে দুনিয়া থেকে মিটে যাবে তা সে হাড়ে হাড়ে জানে। তাই না গিয়ে উল্টো দু পা পিছিয়ে যায়। নীরার বাবা মা রেগে বেড়িয়ে গেলেন। প্রহরের ওপর বিশাল ক্ষো’ভ জন্মালো তাদের। নীরা কান্না চেপে নিজের ঘরে চলে যায়। চৈত্রিকা এক পলক প্রহরের দিকে তাকায়। প্রহরের দৃষ্টি তখন মেঝেতে। চৈত্রিকা আর অর্পিতা দুজনেই নীরার পিছু যায়।
নীরা ঘরে এসে কান্না শুরু করে। হাজার হলেও উনারা তার বাবা মা ছিলেন কিন্তু এটা ছাড়া তারও তো কোনো উপায় ছিলো নাহ। অর্পিতা আর চৈত্রিকা ঘরে এসে নীরাকে কাঁদতে দেখে দুজনে দু পাশে বসে। অর্পিতা আলগোছে নীরার চোখের পানি মুছিয়ে দিয়ে বলে,
‘কাঁদবেন না মেজো ভাবীজান। সব ঠিক হয়ে যাবে। দেখবেন উনারাও ঠিক এই বাচ্চাটাকে স্বাভাবিক ভাবে নিবে।’
নীরা নিঃশব্দে কাঁদে। চৈত্রিকা নীরার থুতনীতে হাত রেখে মুখটা উপরে তোলে। শান্ত কন্ঠে বলে, ‘কাঁদছেন কেনো বুবু্? আজ যা করেছেন তা তো সব মেয়ে পারে নাহ। ক’জন পারে নিজের সুখ বিসর্জন দিয়ে সন্তানকে আঁকড়ে ধরতে!’
অনেকক্ষণ বুঝিয়ে দুজনে নীরাকে স্বাভাবিক করে। নীরা একটু স্বাভাবিক হয়ে দুজনের দিকে কৃতজ্ঞতার দৃষ্টিতে তাকায়। চৈত্রিকার হাত নিজের হাতের মুঠোয় এনে চৈত্রিকার চোখে চোখ রেখে বলে,
‘মেয়ে হলে চৈত্রিকা বানাবো আর ছেলে হলে প্রহর রেনওয়াজ! যে অ’ন্যায়ের সঙ্গী না হয়ে অ’ন্যায়ের বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলবে।’
নীরার ঠোঁটে প্রশান্তির হাসি। অর্পিতাও হাসে। চৈত্রিকা হাতের মুঠো থেকে নিজের হাত দিয়ে নীরার দু হাত আঁকড়ে ধরে। শীতল কন্ঠে আওড়ায়,
‘নিজে আগে চৈত্রিকা হন বুবু! তারপর দেখবেন ছেলে মেয়ে একাই চৈত্রিকা নয়তো প্রহর হয়ে উঠবে।’
২৯.
ইদানীং নাসিমা ঘর থেকে বের হয় নাহ। মনের মাঝে একটা ভয় ঢুকে গেছে। সেই আতঙ্ক থেকেই চৈত্রিকাকে দেখলে তার পা’গল পা’গল লাগে। বার বার বলতে থাকে ‘আমাকে মা’রিস নাহ!’ এইসব কিছুর জন্যই সে আর ঘর থেকে বের হয়,নাহ। খেতে পারে না, ঘুমাতে পারে না। সবসময় মনে হয় ‘এই তো চৈত্রিকা! তাকেই মা’রার জন্য ধেয়ে আসছে তলোয়ার হাতে!’ তখনই মাথায় প্রচন্ড ব্যাথা শুরু করে। নাসিমার অদ্ভুত ব্যবহার দুদিন লক্ষ্য করেছিলো চৈত্রিকা কিন্তু বিষয়টা বুঝতে পারেনি। তাই নীরাকে রেখে ঘরে আসার সময় এক বার নাাসিমার ঘরে উঁকি দেয়। সেখানে নাসিমা মাথা চেপে বসে আছে। চৈত্রিকা ঘরে ঢুকে ছোট্ট করে ডাকে,
‘মা!’
নাসিমা লাফিয়ে ওঠে। চট করে তাকায় দরজার দিকে। আঁতকে উঠে সরে যায়। বার কয়েক ফাঁকা ঢোক গিলে বিড়বিড় করে বলে, ‘আসবি না চৈত্র। আমাকে মা’রবি নাহ। আমি মা হই তোর!’
একই কথা সে বেশ কয়েকবার আওড়ায়। চৈত্রিকা শুধু তাকিয়ে দেখে। নাসিমার পা’গলামি বেড়ে যায়। চৈত্রিকা বের হওয়ার আগে শুধু এটুকুই বলে,
‘এগুলো তোমার পা’পের শা’স্তি! তবে আরো অনেক বাকি।’
এরপর চুপচাপ চলে আসে নিজের ঘরে৷ এক মিনিট এক মিনিট করে রাত বাড়ে। প্রহর আসে। তবে একটাবারও চৈত্রিকার দিকে তাকায় নাহ। চৈত্রিকার দিকে তাকালে তার ভেতরটা হাহাকার করে। যে মেয়ের মুখে জমিদার সাহেব শুনলে সে শান্তি পেতো! যে চোখের দিকে তাকালে ভালোবাসা খুঁজে পেতো এখন তার চোখে তাকাতে ভয় হয়। ভালোবাসাময় দুটি চোখে ঘৃ’ণা! চৈত্রিকা প্রহরকে দেখলো। সন্তর্পণে তাকে এড়িয়ে যাওয়াটাও দেখলো! শুধু দেখা পর্যন্তই সীমাবদ্ধ রইলো। ঘড়ির কাটা ঘুরতে ঘুরতে গভীর৷ রাত হলো। চৈত্রিকা তখনো চেয়ে আছে। প্রহরের দিকে তাকিয়ে দেখে প্রহর ঘুমে। সে আস্তে করে প্রহরের কাছে এগিয়ে আসে। মুখটা এগিয়ে প্রহরের কপালে ছোট্ট করে চুমু এঁকে দেয়। কাঁপা কাঁপা হাতে প্রহরে গাল দুটো আগলে নিয়ে নিজে কিছুক্ষণ মাথাটা ঠেকিয়ে রাখে প্রহরের কপালে। চোখের কোণা বেয়ে এক ফোটা জল গড়ায়। মাথা সরিয়ে এনে প্রহরের বুকে রাখে। প্রহরের গায়ের গন্ধ শুঁকে নিয়ে ভাঙা ভাঙা ভাবে আওড়ায়,
‘আমি আর পারছি না জমিদার সাহেব। আপনি নেশার মতো টানেন কেনো? বোঝেন না কেনো আপনার চৈত্র বাঁচতে পারছে না? অ’পরাধবোধে ভেতরটা ক্ষ’য় হয়ে যাচ্ছে। সাথীকে হারানোর পর আমার আর বেঁচে থাকতে ইচ্ছে করে না জমিদার সাহেব। আপনি কেনো আগেই ওই জা’নো’য়া’রটা কে শা’স্তি দিলেন না? কেনো দিলেন না জমিদার সাহেব!’
ফুঁপিয়ে উঠে নিজেই নিজের মুখ চেপে ধরে। নিজেকে সামলে ফের বলে, ‘আমাকে বাঁচান জমিদার সাহেব! আমি ম’রে যাচ্ছি! আমি তো আপনার থেকে মুক্তি চাইনি। তবুও কেনো বার বার আপনার থেকে সরে যাওয়ার সময় হয়? আমি তৃষ্ণায় ম’রে যাচ্ছি। আমাকে একটু ভালোবাসুন না!’
চৈত্রিকা চুপ করে যায়। নিঃশব্দে কেঁদে যায়। কি করবে আর কি করবে না ভাবলেই তার পা’গল পা’গল লাগে। সাথীর মৃ’ত্যুর পর তার নিজেকে দো’ষী মনে হয় বেশি। এতো কিছু করেও, এতো চেষ্টা করেও সে প্রহরের থেকে সরতে পারে নাহ। তার কান্নার মাঝেই পিঠে হাতের ছোঁয়া পায়। প্রহর শক্ত করে জড়িয়ে ধরেছে। এক ফোঁটা ঠান্ডা কিছুর স্পর্শ পায় কাঁধে!
৩০.
হাত পু’ড়ে যাওয়ায় অর্থির সারা রাত জ্বর ছিলো। নিবিড় সারারাত একটুও ঘুমায়নি। অর্থির মাথার কাছে বসে ছিলো। মেয়েটা ঘোরের মধ্যে বার বাার প্রহরকেই স্মরণ করছিলো। অর্থির এই অবস্থা দেখে নিবিড় চিন্তিত হয়ে পড়ছে। এখানে অর্থিকে রেখে যাওয়াটা যে যুক্তিযত নয় তা সে বুঝে গেছে। কিন্তু করবে টা কি সে? নিপা বেগম সকাল থেকে চেচাচ্ছেন। অর্থি পড়ে পড়ে ঘুমাচ্ছে আর নিপা বেগম সব কাজ করছেন! বিষয়টা মানতে পারছে নাহ। চেঁচামেচিতে বিরক্ত হয়েই নিবিড় এগোয় রান্নাঘরের দিকে। সেখানে শামীম আহমেদ নিপা বেগমকে থামানোর চেষ্টা করছেন। এক পর্যায়ে তিনি বিরক্ত হয়ে তেঁতো গলায় বললেন,
“সমস্যা ডা কি তোমার? মাইয়াডার লগে এমন করো ক্যান? তুমি কি ভুইলা যাও ওয় জমিদারের মাইয়া! তুমি যে ওর লগে এমন করো! ওয় যদি বাপ ভাইরে কইয়া দেয় তাইলে আমাগো শু’লে চড়াইবো!’
নিপা বেগম চোখ মুখ কুঁচকে জবাব দেন, ‘ওই মাইয়া রে আমার সহ্য হয় নাহ। আমার পোলাডারে ফা’সাইয়া বিয়া করছে! ওয় যা বোকা তাতে বাড়িত কিছুই কইবো না। নিশ্চিত থাহো!’
‘তোমার পোলা কোথাকার কোন রাজপুত্তুর যে ওর ফা’সাাইয়া বিয়া করা লাগবো?’
নিপা বেগম উত্তরে শামীম আহমেদ আর অর্থিকে যা তা শুনিয়ে দিলেন। এই অ’ত্যা’চা’র সে থামাবে না তা ঢের বুঝে গেলো নিবিড়। কোনো কথা না বলে সরাসরি নিজেদের ঘরে গিয়ে এক টানে অর্থিকে শোয়া থেকে তুলে দেয়। অর্থি ঘুম ঘুম চোখে অবুঝের মতো তাকায়। নিবিড় শক্ত কন্ঠে বলে,
‘এক্ষুণি তৈরী হও! তোমাকে তোমার বাপের বাড়ি দিয়ে আসবো!’
চলবে..
#চৈত্রিকা (৪৯)
#বোরহানা_আক্তার_রেশমী
________________
নিবিড়ের হঠাৎ এমন কথার কিছুই মাথা গেলো না অর্থির। শুধু ঘুমে, জ্বরে লাল টকটকে হওয়া চোখে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রয় নিবিড়ের মুখপানে। বেঝার চেষ্টা করে নিবিড় তাকে কি বললো আর কেনোই বা বললো! অর্থিকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে নিবিড় ফের গম্ভীর স্বরে বলে,
‘তোমাকে কিছু বলেছি আমি?’
অর্থি উপর নীচ মাথা নাড়ায়। তারপর কন্ঠের আওয়াজ নিচু করে বলে, ‘কিন্তু বাবার বাড়ি রেখে আসবেন মানে কি মাষ্টারমশাই?’
‘মানে বোঝো না? তোমার এখানে থাকা লাগবে নাহ। তুমি এখন থেকে নিজের বাবার বাড়ি থাকবে। সংসার করা লাগবে নাহ।’
অর্থি আঁতকে ওঠে। তার পুরোপুরি ঘুম ছুটে যায়। এতক্ষেণে সে খেয়াল করে রান্নাঘর থেকে ভেসে আসছে নিপা বেগমের চেঁচামেচি। নিবিড়ের দিকে ভালো মতো তাকিয়ে বুঝতে পারে নিবিড়ের চোয়াল শক্ত। তার মানে সে রেগে আছে। ছোট্ট অর্থি ভয় পেয়ে যায়। সাথে ভীষণ কান্না পায়৷ তার মাষ্টারমশাইও বুঝি তার ওপর বিরক্ত হয়ে গেছে? তার ভাবনার মাঝেই নিবিড় ধমকে ওঠে। দাঁতে দাঁত চেপে বলে,
‘কথা কানে যায় না? জলদি ওঠো!’
অর্থি চমকে ওঠে। অনেক কষ্টে কান্না গিলে নিয়ে মাথা নিচু করে মিনমিনিয়ে বলে, ‘আমাকে রেখে আসবেন না মাষ্টারমশাই। আমি সব কাজ এখন থেকে ভালো মতো করবো। আম্মাজানকেও কোনো কিছু অভিযোগ করতে দেবো নাহ।’
নিবিড় তেতে উঠলো। মেয়েটা এতো অবুঝ কেনো? বাহির থেকে নিপার কন্ঠের জোড় আরো জোড়ালো হচ্ছে যেনো! কখন যে আশে পাশের লোকজন এসে হাজির হবে তার ঠিক ঠিকানা নেই। নিবিড় অর্থির হাত আঁকড়ে ধরে কোনো কিছু নেওয়ার সুযোগ না দিয়েই ঘর থেকে বের হয়। অর্থি বার বার ‘না’ বলতে থাকে কিন্তু নিবিড় শোনে নাহ। হাত টেনে উঠোনের মাঝে যেতেই নিপা বেগম আর শামীম আহমেদ ছুটে আসে। নিবিড় তাদের সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে অর্থির হাত টেনে চলে যায়। পেছন থেকে তারা ডাকলেও তা কানে নেয় না সে। অর্থি নিঃশব্দে শুধু কান্না করে। তার প্রতি কি মাষ্টারমশাইয়ের ভালোবাসা ফুরিয়ে গেছে? এই একটা চিন্তাই যেনো তার মনকে উথাল-পাতাল করে দিচ্ছে। নিবিড় চারদিকের কিচ্ছু দেখলো না, মানলো নাহ। শুধু টেনে নিয়ে চলে আসলো। অর্থির শাড়ির আঁচল মাটিতে গড়াগড়ি খাচ্ছে। চুলগুলো এলোমেলো ভাবে পিঠের ওপর পড়ে আছে। এক গুচ্ছ চুল সামনে মুখের ওপর আছড়ে পড়ছে। শরীরে এক ফোঁটা শক্তিও নেই। কাঁদতে কাঁদতে নিজেও ক্লান্ত হয়ে যায়। তবুও মুখ দিয়ে কোনো শব্দ বের হয় নাহ। চোখ দিয়ে অনবরত পানি ঝড়তে থাকে। নিবিড় একটা বার তাকায়ও না তার দিকে। ঢের বোঝে তার বোকা বউটা কাঁদছে। কিন্তু তবুও তাকায় নাহ। দাঁতে দাঁত চেপে শুধু এগোতে থাকে। চোখের জল মুছিয়ে না দিলেও হাতে যেনো ব্যাথা না পায় ঠিক সেভাবেই ধরেছে নিবিড়। জমিদার বাড়ির সামনে এসে নিবিড় একটু দাঁড়ায়। কোনো রকম ভয় ভীতি ছাড়াই জমিদার বাড়িতে ঢুকে যায়। সদর দরজায় পা রাখতেই পল্লবীর নজরে পড়ে। পল্লবী হেঁসে এগিয়ে আসে। নিবিড়কে কিছু বলতে গিয়েও অর্থির দিকে নজর পড়ে গেলে চুপ মে’রে যায়। মেয়ের এলোমেলো, দুর্বল অবস্থা, চোখে জল দেখে তিনি বুঝে গেলেন কিছু হয়েছে। দ্রুত মেয়ের কাছে এগিয়ে গেলেও নিবিড় হাত ছাড়ে না অর্থির। অর্থি মাথা নত করে দাঁড়িয়ে আছে। চেষ্টা করছে কান্না না করার! পল্লবী শুধু কাঁপা কাঁপা গলায় শুধালো,
‘কি হয়ছে অর্থি? তোরে এমন লাগে কেন মা? কাঁদছিস কেন? নিবিড় বাবা কি হয়ছে?’
নিবিড় কোনো প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে সরাসরি বলে, ‘প্রহর ভাইজানকে ডাকেন আম্মাজান!’
পল্লবী কিছু জিজ্ঞেস করতে গেলে চয়ন চলে আসে। অর্থির এই অবস্থা দেখে তিনি ভ্রু কুঁচকান। শান্ত গলায় বলে, ‘সকাল সকাল আমার মেয়েরে কান্নারত অবস্থায় নিয়ে আমার বাড়ি আসছো কেনো? ওর চোখে পানি কেন?’
শেষের কথায় ঝাঁঝ প্রকাশ পেলো। নিবিড় এবারও অগ্রাহ্য করে গেলো। মাথা নত করে শুধু দাঁড়িয়েই থাকলো। ২য় বারের মতো পল্লবীকে বললো প্রহরকে ডেকে দিতে। চয়ন রেগে গেলো। রেগে নিবিড়কে উদ্দেশ্য করে বলতে থাকলেন,
‘আমার মেয়ের কষ্টের কারণ তুমি হইলে তোমারে কা’ইটা টু’করা টু’করা করে ফেললবো নিবিড়! আমার যে মেয়েরে আমি এক ফোঁটা আঁ’চ’ড়ও লাগতে দেইনি এই মেয়েকে তুমি কষ্ট দিলে তোমারে আমি কু’র’বা’নী দিতে দুইবারও ভাববো নাহ। প্রহর কোথায় পল্লবী? এই ছেলেকে বলেছিলাম এরকম ছেলের কাছে আমার মেয়েকে না দিতে! তাও দিছে। আমার মেয়ের কষ্টের কারণ যদি এরা হয় তাইলে এদের আমি একদম পু’তে ফেলবো।’
নিবিড় এবারও একটা কথাও বললো নাহ। কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো শুধু। এর মাঝে চৈত্রিকা আর প্রহরও চলে আসে। চয়নকে চেচামেচি করতে দেখে দুজনেই ভ্রু কুঁচকায়। প্রহর এগিয়ে এসে শান্ত স্বরে শুধায়,
‘সকাল সকাল চেচাচ্ছেন কেনো আব্বাজান? কি হয়েছে?’
চয়ন রেগে গেলো। চৈত্রিকা ততক্ষণে অর্থির কাছে এসে দাঁড়িয়েছে। একপলক অর্থির বি’ধ্বস্ত অবস্থা আর পু’ড়ে যাওয়া হাত দেখে সে চমকায়। আঁতকে তাকায় নিবিড়, অর্থি দুজনের দিকেই। চয়ন ততক্ষণে বলতে শুরু করেছে,
‘কি হয়নি জিজ্ঞেস করো! তোমাকে মানা করেছিলাম না ছোট’লো’কটার সাথে আমার মেয়ের বিয়ে দিতে! শোনোনি! এখন দেখো আমার মেয়ের অবস্থা!’
প্রহর শান্ত চোখে তাকালো ছোট বোনের দিকে। বোনের গাল বেয়ে শুকিয়ে যাওয়া চোখের পানি, বি’ধ্বস্ত অবস্থা দেখে চোয়াল শক্ত হয়ে গেলো তার। নিবিড় এতক্ষণে মাথা উচু করে তাকিয়ে অর্থির হাত ধরেই প্রহরের সামনাসামনি এসে দাঁড়ায়। প্রহরের হাত মুষ্টিবদ্ধ হয়ে যায়। অর্থি তখনো একবারের জন্যও চোখ তুলে তাকায়নি। দেখেনি বাবা, ভাইয়ের ক্রোধান্বিত দৃষ্টি। নিবিড় সবটাই দেখলো। শান্ত ভাবে কাঁপা কাঁপা হাতে অর্থির হাতটা প্রহরের হাতে দিয়ে একটা ফাঁকা ঢোক গিললো। জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে নিয়ে অপরাধী ভঙ্গিতে মাথা নত করে। মলিন কন্ঠে বলে,
‘আমি ব্যর্থ ভাইজান। আপনি আপনার বোনকে আমার হাত তুলে দিয়েছিলেন তাকে সুখী রাখার জন্য কিন্তু আমি পারিনি। আমি জানতাম আমি ওকে জমিদার বাড়ির মতো সুখ দিতে পারবো নাহ তবে নিজের মতো করে সুখী রাখার চেষ্টা করবো। কিন্তু আমি ততটুকুও পারিনি। আপনার বোন ছিলো চাঁদ আর আমি সামান্য বামন তবুও আমার ভালোবাসার প্রতি বিশ্বাস রেখে, আমাকে ভরসা করে আপনার বোনকে আমার সঙ্গে বেঁধে দিয়েছিলেন। আমি ভেবেছিলাম আমি ওকে আগলে রাখতে পারবো কিন্তু আমি পারিনি। আমি জানিনি, বুঝিনি যে এই ছোট্ট মেয়ের প্রতি আমার মায়ের মনে বিশাাল ক্ষো’ভ! যা এই মেয়েটাকে কষ্ট দিবে। আমি সত্যিই ব্যর্থ ভাইজান। আমি শুধু ভালোইবেসেছি! আগলে রাখতে পারিনি৷ ভালোবাসার মানুষকে যদি সুখীই না করতে পারি, যদি তাকে মানসিক শান্তিই না দিতে পারি তবে আমি স্বামী তো দুর প্রমিক হওয়ারও যোগ্যতা রাখি নাহ। এমনিতেও আমি ওর যোগ্য না তবে এই ১৫ দিনে এটাও বুঝলাম যে আমি স্বামী হওয়ারও যোগ্যতা রাখি নাহ। আমার এ মাসে শহরে চাকুরী হয়ে গেছে। আমি ওকে এমন কোথাও রেখে যেতে চাই নাহ যেখানে ওর অশান্তি হবে! ওর কষ্ট হবে! আমি আপনার বোনকে আপনার কাছে আমানত হিসেবে রেখে যাচ্ছি। শহরে গিয়ে নিজেকে একটু গুছিয়ে নিয়ে আমি ওকে নিতে আসবো। ওকে ছোট্ট একটা সংসার দেবো। সে পর্যন্ত ওকে একটু রাখবেন ভাইজান? আপনি যদি বলেন পরবর্তীতেও অর্থিকে আমার কাছে ফিরিয়ে দেবেন না তবে আমি একবারও এর প্রতিবাদ করার ক্ষমতা রাখি নাহ। কিন্তু আমি জানি আপনি আমার থেকে আমার বেঁচে থাকার কারণ কেড়ে নিয়ে আমাকে নিঃস্ব করবেন নাহ। আমি জানি আপনি আপনার বন্ধুসুলভ ভাইকে আরো একটা সুযোগ দিবেন। আমি ঠিক জানি তো ভাইজান?’
পরিবেশ শান্ত হয়ে গেছে। অর্থি নিবিড়ের দিকে চেয়ে ঠোঁট কামড়ে কাঁদছে। প্রহর গম্ভীর হয়ে তাকিয়ে আছে নিবিড়ের দিকে। সে জানে নিবিড় মিথ্যা বলছে নাহ। বলবেও নাহ। অর্থিকে কতটা ভালোবাসে তা বোধহয় সেও জানে। চয়ন নিজেও শান্ত হয়ে গেছে। তবে দমে যাওয়ার পাত্র সে নয়। পল্লবী আর চৈত্রিকা শুধু পুরোটা সময় অবাক হয়ে কাটালো। নিবিড় প্রহরের জবাব না পেয়ে ক্ষীণ হাসলো৷ তবে এই হাসিতে প্রাণ নেই। নিজের হাত জোড়া গুটিয়ে নিয়ে ছোট্ট করে বলে,
‘আমি আসবো আবার! আপনার কাছে আপনার বোনকে আরো একবার চাইতে আসবো! হাত পেতেই দাঁড়াবো আপনার কাছে। আপনি কিন্তু আমাকে ফিরাতে পারবেন না ভাইজান।’
বলেই সে দু কদম পিছিয়ে গেলো। অর্থি ‘মাষ্টারমশাই’ বলে এগোতে নিলে প্রহর হাত ধরে ফেলে। পু’ড়া জায়গায় ব্যাথা পেয়ে আর্তনাদ করে। চট জলদি প্রহর হাত সরিয়ে নিজের বোনকে বুকে আগলে নেয়। অর্থি কাঁদতে কাঁদতে নিবিড়কে ডাকতে থাকে। নিবিড় শোনে নাহ। ডাক অগ্রাহ্য করে সদর দরজা ত্যাগ করে। বুকে পাথর চাপা দিয়ে হাসার চেষ্টা করে বলে,
‘কিছু সাময়িক বিচ্ছেদ সুন্দর বোকা মেয়ে! পরের বার আমি তোমাকে কষ্ট পেতে দেবো নাহ। সব চাইতে সুখী সংসার, সুখগুলোই তোমাকে দেবো। এটা তোমার মাষ্টারমশাইয়ের প্রতিজ্ঞা রইলো।’
নিবিড় এগোনো শুরু করে। শরীরের ভার কোনো মতে টেনে নিয়ে চলে নিজেদের বাড়ি পর্যন্ত। এলোমেলো পায়ে বাড়িতে ঢুকতেই সামনে পড়ে নিপা বেগম আর শামীম আহমেদ। নিবিড় এক পলক তাদের দিকে তাকিয়ে চলে যেতে নিলে পিছু ডাকে নিপা বেগম। জিজ্ঞেস করেন,
‘বউ কই?’
নিবিড় গভীর দৃষ্টিতে তাকায় নিজের মায়ের দিকে। খানিকটা হেঁসে বলে, ‘রেখে এসেছি জমিদার বাড়িতে!’
নিপা বেগম এবার তেতে উঠলেন। ঝাঁঝালো স্বরে বললেন, ‘জমিদারের মাইয়ারে রে যে তার বাড়িত রাইখা আইলি তার কি সংসার করন লাগবো না? রাইখা আসছোস যহন তহন শুইনা নে! ওই মাইয়ার পা জানি আর এ বাড়িত না পড়ে!’
নিপা বেগমকে ধমক লাগিয়ে দিলেন শামীম আহমেদ। চোখ রাঙিয়ে বললেন চুপ থাকতে। এরপর ছেলের দিকে তাকিয়ে বললেন,
‘বাড়িত যায় ই হউক না ক্যান? তুমি কি বউমারে বাপের বাড়িত দিয়া আইসা ভালা করলা নিবিড়? তোমার মা আর বউমার লাগছে দেইখাই কি তোমার উচিত হয়ছে বউ রে রাইখা আসার?’
নিবিড় এবারও হাসলো। হাতটা আড়াআড়ি ভাবে বুকের ওপর রেখে শান্ত কন্ঠে বললো, ‘আব্বা! আমি ওরে সুখ দিতে পারবো ভেবেই সাথে এনেছিলাম কিন্তু এমন সুখ তো দিতে চাইনি। তাই ওর জন্য ওর বাপের বাড়িই ঠিক আছে। আর আম্মা! চিন্তা কইরো না। ‘ও’ আসবে নাা আর এখানে। আমার চাকুরী হয়েছে শহরে। ওইখানেই যাবে ‘ও’। বউয়ের জন্য মায়ের সাথে কিংবা মায়ের জন্য বউয়ের সাথে! কারোর সাথেই আমি অ’ন্যায় করতে পারি নাহ।’
নিপা বেগম অবাক হলেন। হাায় হায় করে বললেন, ‘দেখছো তোমার পোলা আমাগো ছাইড়া বউ নিয়া শহরে গিয়া থাকবো! আমরা যে ওর বাপ মা আমাগো ভুইলাা গেলো বউ আসতে না আসতেই! আল্লাহ গো! এই মাইয়া কি জাদু টোনা করছে যে আমার পোলারে! আমার পোলারে ফাঁ’সা’ই’য়া বিয়াও করলো আর অহন আমার থেইকা কা’ইড়াও নিলো!’
‘আম্মা অর্থি আমারে ফাঁ’সা’ই বিয়ে করে নাই। আমি ভালোবাসতাম ওরে। ওর কোনো কারণ ই ছিলো আমারে ফাঁ’সা’নো’র। ‘ও’ আমার থেকে অনেক ভালো ছেলে পাইতো এটা কোনো ব্যাপারই ছিলো নাহ আম্মা। আমার জ্বর কমাতে এসে নিজেই নিজের গায়ে ক’ল’ঙ্ক লেপ্টে নিলো। এতোকিছুর পরও ‘ও’ আমাকে ফাঁ’সি’য়ে’ছে বলো!’
নিবিড়ের শান্ত কথায় নিপা বেগম কপাল চাপড়ালেন। নিবিড় নিঃশব্দে জায়গাা ত্যাগ করে। নিপার এই বাড়াবাড়ি সহ্য করতে না পেরে শামীম আহমেদও দু কথা শুনিয়ে দিয়ে বের হয়ে যায় বাড়ি থেকে।
৩১.
বিকেলে অর্থিকে ওষুধ খাইয়ে শুইয়ে দিয়ে নিজের ঘরে আসে চৈত্রিকা। প্রহর তখন টান টান হয়ে শুয়েছিলো বিছানার ওপর। উ’ন্মুত্ত বুক! চৈত্রিকা আড়চোখে একবার সেদিকে তাকিয়ে চোখ সরিয়ে নেয়। প্রহরের চোখ বন্ধ। চৈত্রিকা আয়নার সামনে বসে চুল আঁচড়াতে আঁচড়াতে প্রহরের প্রতিবিম্ব দেখে। উসখুস করতে থাকে কিছু বলার জন্য। চৈত্রিকা তখনো তাকিয়েই আছে। প্রহর হুট করে চোখ মেলে তাকায়। চৈত্রিকা থতমত খেয়ে আয়না থেকেই চোখ সরিয়ে নেয়। প্রহর ঘাড় বাঁকিয়ে সেদিকে তাকিয়ে বলে,
‘আড়চোখে কিংবা আয়নার প্রতিবিম্বের দিকে না তাকিয়ে সরাসরি আমার দিকে তাকালেও আমি কিছু মনে করবো নাহ প্রিয় বউজান।’
চৈত্রিকা লজ্জায় মাথা নত করে নেয়। প্রহর ঠোঁট কামড়ে হেঁসে সে লজ্জাবতী মুখের দিকে তাকিয়ে রয়। এক হাত বুকের বাম পাশে রেখে বিড়বিড় করে বলে,
‘লজ্জাবতী চৈত্র!’
চৈত্রিকা দৃষ্টি এদিক ওদিক করে। তবে সরাসরি তাকায় না প্রহরের দিকে। কিন্তু প্রহর ঠিকই তার দিকে পলক না ফেলে তাকিয়ে থাকে। চৈত্রিকা বুঝতে পারে প্রহর তার দিকে গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। সাথে সাথে তার কান গরম হয়ে আসে। ওই ভাবে থেকেই বলে,
‘চোখ সরান জমিদার সাহেব!’
প্রহর ঠোঁট প্রসারিত করে হাসে। উঠে বসে বিছানার সাথে হেলান দেয়। নির্নিমেষ চৈত্রিকার দিকে তাকিয়ে কন্ঠে দুষ্টুমি এনে বলে, ‘বাহ রে! আমি তাকালেই দোষ! আর ওদিকে যে কেউ একজন রাতের আঁধারে আমার কপালে চুমু খায়, আমার বুকে মুখ লুকায়! সে বেলা আমি কিছু বলি?’
চৈত্রিকা লজ্জায় আরো নুইয়ে পড়ে। লোকটা কি রাতে জেগে জেগে তার কান্ড দেখে? কি লজ্জাজনক একটা ব্যাপার। মনে মনে বলে ‘ইয়া রব এই আয়নার মাঝেই একটা রাস্তা করে দেন আমি চলে যাই!’ কিন্তু তা তো সম্ভব নাহ। তাই বড় বড় শ্বাস নেয়। মনে মনে ভাবে সে তো অ’ন্যায় করেনি। নিজের স্বামীর কপালেই তো চুমু খেয়েছে! তার জন্য হালাল হওয়া বুকেই তো মাথা রেখেছে! তবে লজ্জা কিসের? তবুও কোথায় যেনো একটা কিছু থেকে যায়! প্রহর চৈত্রিকাকে চুপ থাকতে দেখে আর নিজের জায়গায় বসে নাহ। চুপচাপ এগিয়ে এসে চৈত্রিকার পিছে দাঁড়ায়। চৈত্রিকার নত মুখের প্রতিবিম্ব স্পষ্ট তার সামনে ভাসে। প্রহর আলগোছে চৈত্রিকার ঘাড় থেকে চুল সরিয়ে নিজের থুতনী রাখে। চৈত্রিকা খানিকটা কেঁপে উঠে। শক্ত হাতে নিজের শাড়ি চেপে ধরে। চোখ মুখ খিঁচে পড়ে রয়। প্রহর হাসে। চৈত্রিকার ঘাড়ে ঠোঁট ছুঁইয়ে নাক ডুবিয়ে দেয় গভীর ভাবে। চৈত্রিকার মুখের কথা হাওয়া হয়ে যায়। প্রহর ফিসফিস করে বলে,
‘তোমাকে মুক্তি দিতে গেলে আমি আরও তোমাতে বাঁধা পড়ে যাই প্রিয় বউজান। আমি ভীষণ স্বা’র্থ’প’র। তাই তুমি না চাইলেও তোমার এই জমিদার সাহেবের বক্ষে থাকতে হবে আর না চাইলেও থাকতে হবে। এটাই তোমার নিরাপদ আর ভ’য়ং’কর স্থান।’
চলবে..