#ছদ্মবেশে_লুকানো_ভালোবাসা
#মৌমি_দত্ত
#অন্তিম_পর্ব
আজকের রান্নাবান্না ছিলো রাজকীয়। ইনায়াত একা হাতে সবটা সামলালেও সার্ভ করবার সময় রুহি আর আফরা জোর করেই আসলো। আর ইনায়াত গেলো ফ্রেশ হতে। ওয়াসরুমে এসে শাওয়ার ছেড়ে দাঁড়াতেই কাঁধের দিকে জ্বলে উঠলো ইনায়াতের। ” আহহহ ” করে মৃদু আওয়াজ করে সড়ে এলো শাওয়ার থেকে। ওয়াসরুমের আয়নায় ঘাড় ঘুরিয়ে কাঁধে দেখতেই চমকে উঠলো ইনায়াত। জ্বলজ্বল করছে আফিমের দেওয়া লাভ বাইট। আফিম তাকে রান্নাঘরে কাজের সময় জড়িয়ে ধরেছিলো বলে বার বার পিছিয়ে যাচ্ছিলো কাজে । তাই ইনায়াত দুই একটা ধমক দিয়ে আফিমকে রান্নাঘর থেকে তাড়িয়ে ছিলো সেই সময়। কিন্তু বাচ্চাদের মতো মুখ ফুলিয়ে আফিম নিজের অভিমান প্রকাশ করেও যখন ইনায়াতের মন গলাতে পারলো না। তখন রান্নাঘর ছেড়ে বের হবার আগে ইনায়াতের ঘাড়ে শক্ত করে কামড়ে দিয়েছে। ইনায়াতের মুখ লাল হয়ে এলো লজ্জায়। শুকনো একটা ঢোক গিলে কোনোমতে শাওয়ার নিয়ে আরেকটা লাল রঙ্গের শাড়ি পড়ে বের হয়ে এলো। নিচে নেমে দেখলো ছেলেরা বসে পড়েছে টেবিলে। সিড়িতে থাকাকালীনই নজরে এলো আফিমকে। চোখাচোখি হতেই মুখের রক্তিম আভা আরো গাঢ়ো হয়ে এলো। ইনায়াত ধীর পায়ে এসে নিজের চেয়ারে বসে পড়লো।
এদিকে স্পন্দন খানিক বাদে বাদেই ঠোঁট কামড়ে হাসছে। দৃষ্টি তার আফরার দিকে নিবদ্ধ। তখন আফরা স্পন্দনকে কাছে টেনে নিলেও খানিক বাদে স্পন্দনকে ছেড়ে দিয়েছিলো হালকা ধাক্কা দিয়ে। স্পন্দনকে ধাক্কা দিয়ে ওয়াসরুম থেকে বের করে দিয়েছিলো। স্পন্দনের সামনে এরপরে আর যায়নি আফরা। সামনে পড়লেই আফরাকে চোখের ইশারায় লজ্জায় ডুবিয়ে মারছে স্পন্দন ।
আর তাহজিব বিমর্ষ হয়ে বসে প্লেইটে আঁকিবুঁকি করছে চামচ দিয়ে। রুহির দিকে একবার তাকাতেই বিরক্তিতে ভ্রু কুঁচকে এলো তাহজিবের। মেয়েটা মানুষের সামনে হাজারো কষ্ট,, চিন্তা চেপে এতো স্বাভাবিকতার নাটক করে কেন?? আর করেই বা কিভাবে??
.
.
ছেলেরা সকলে খাওয়ার পর সিদ্ধান্ত নিলো ছাদে চায়ের কাপ নিয়ে বসবে। তিনজন ছেলেরই কখনো কফি ছাড়া আয়েশ করে চা খাওয়া হয়নি। তাই মেয়েরাই বলেছে আজকে চায়ের মজা উপভোগ করতে। ছেলেরা ছাদে বসে আছে। খেলা,, বিজনেস এসব নিয়ে কথা বলছে।
মেয়েরা বসে আছে একরাশ চিন্তা নিয়ে সোফায়।
– রুহি?? ঐ মানুষ তো এলো না।
ভয় নিয়ে বললো ইনায়াত। আফরা বললো,,
– এখন ছেলেরা উপরে থাকতেই কাজটা শেষ করে নিলে ভালো হতো। একবার ওরা নিচে নামলে তো ধরা পড়ে যাবো। এরপর কি যে হবে!! বুঝতে পারছিস তো তোরা??
রুহির নিজেরও চিন্তায় অবস্থা কাহিল। এমন সময় বাইকের আওয়াজ শোনা গেলো। দাঁড়িয়ে পড়লো তিনজন মেয়েই। ইনায়াতের পাশে তিনজনেরই ডকুমেন্টস রেডি করা ছিলো প্যাকেটে। ওটা হাতে তুলে নিলো পূর্বপ্রস্তুতি স্বরুপ।
ছাদের কিনারায় দাঁড়িয়ে তিনজন ছেলেই আড্ডা দিচ্ছিলো। তখনই নিচে গেইট দিয়ে একটা বাইক ঢুকতে দেখে তিনজনেই অবাক হলো।
– এই ভরদুপুরে মেয়েরা আবার কি আনালো??
তাহজিব প্রশ্ন করলো।
– চল,, নিচে গিয়ে দেখি।
স্পন্দন বললো। তিনজন ছেলেই নিচে নেমে আসলো। সিড়ি বেয়ে নামার সময় দেখলো তিনজন মেয়েই কথা বলছে ডেলিভারি ম্যানের মতো দেখতে লোকটার সাথে।
– এরা ডেলিভারি ম্যানের সাথে এতো কি কথা বলছে??
অবাক হয়ে নিচে নামতে নামতে প্রশ্ন করলো আফিম। তিনজন ছেলেই সবে শেষ সিড়ি পার করে নেমেছে। তখনই দেখলো ইনায়াত একটা বড়সড় প্যাকেট এগিয়ে দিচ্ছে ডেলিভারি ম্যানটার দিকে। স্পন্দন ভ্রু কুঁচকে এগিয়ে গেলো। পিছন পিছন আফিম আর তাহজিবও আছে।
– এটা কিসের প্যাকেট??
ভারী গলায় প্রশ্ন করলো স্পন্দন। চমকে উঠলো তিনজন মেয়ে। আফরা ভয়ে রুহির হাত খামচে ধরলো। ইনায়াতের হাত থেকে পড়ে গেলো প্যাকেটটা। ছেলেরা ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে। আফিম এসে তুলে নিলো প্যাকেট মাটি থেকে। তিন ছেলে পাশাপাশি থেকে প্যাকেটের ভিতরের জিনিস বের করে দেখতেই মুখ হা হয়ে গেলো তাদের। মেয়েদের বার্থ সার্টিফিকেট,,রুহির মেডিক্যাল রিপোর্টস থেকে শুরু করে সব ধরনের ডকুমেন্টস আছে। সাথে মোটা একটা টাকার বান্ডিলও আছে। ছেলেরা অবাক হয়ে মেয়েদের দিকে তাকাতেই দেখলো মেয়েদের চোখে ভয় স্পষ্ট। যেন চুরি করে চোর ধরা পড়েছে এমন ভাব। স্পন্দন কঠোর মুখে ডেলিভারি ম্যানটার দিকে তাকালো। যে ইতোমধ্যেই ভয়ে কাঁপছে। আফরা তাকে আসতে তো বলেছিলো। কিন্তু দি তাহজিব খান আর বিজনেস টাইকুন আফিম আহসান। আবার ডাক্তার ও বিজনেস টাইকুন স্পন্দন আজাদ আছে তাদের সাথে এই কথা জানায়নি।কিছু না জেনে এসে গিয়েছে বলেই বোকামো করেছে,,,ভাবছে সেই লোকটা।
– আপনি যাবেন?? নাকি কিছু নেবেন??
কঠোর গলায় প্রশ্ন করলো আফিম শার্টের হাতা গুঁটাতে গুঁটাতে। লোকটি বোকা বোকা হেসে দিলো এক দৌড়। কোনোমতে বাইকে উঠে তা স্টার্ট দিয়ে পালালো। স্পন্দন দরজা লাগাতে গিয়েই দেখলো আসিফ আর কামাল আসছে।সাথে আরভিদ সাহেবও আছে। স্পন্দন তাদের নীরবেই ভিতরে আহবান জানালো। ভিতরে ঢুকে কিছু বলবার আগেই থেমে গেলো আসিফ,, কামাল আর আরভিদ সাহেব। সবার মুখ থমথমে। আফরা রুহিকে জড়িয়ে নিঃশব্দে কাঁদছে ভয়ে। ইনায়াত মাথা নিচু করে হাত কঁচলে যাচ্ছে। আরভিদ কিছু বলতে যাবে এর আগেই তাহজিব ইশারায় থামালো।
– এখন এই রুমে আমরা মেয়েদের কিছু প্রশ্ন করবো। আর মেয়েরা সেই প্রশ্নের উত্তর দেবে। এর বাইরে এখন কেও কথা বলবে না।
স্পন্দন সবাইকে ইশারায় সোফা দেখিয়ে দিলো। সবাই গিয়ে নীরবে সোফায় বসলো মেয়েরা ছাড়া। মেয়েরা এখনো ভয়ে আছে। মেয়েরা যাচ্ছে না দেখে চিৎকার করে উঠলো তাহজিব।
– হোয়াট?? এখন কি কাহিনি করবে???এখানে দাঁড়িয়ে??
মেয়েরা এই হুংকারে সুড়সুড় করে গিয়ে সোফায় পাশাপাশি বসলো। ছেলেরা গিয়ে তাদের অপজিট সোফায় পাশাপাশি বসলো।
– এখন কি মুখ খুলবে তোমরা?? নাকি…
প্রশ্ন করলো আফিম। আফরার কান্নার আওয়াজ বেড়ে উঠলো খানিকের জন্য।
– ডকুমেন্টস কেন দিচ্ছিলে??
প্রশ্ন করলো স্পন্দন।
– আর টাকা কেন দিচ্ছিলে??
তাহজিব প্রশ্ন করলো। এর মাঝেই আবার আফিম চিৎকার করে উঠলো। রুহি আর ইনায়াত কিছু বলবে না বলে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হলো মনে মনেই। একে অপরের দিকে চোখের ইশারায় বললোও কথাটা। কিন্তু আফরার অতোকিছু খেয়াল নেই। আফরা হিঁচকি হিঁচকি তুলতে তুলতে বললো,,
– আমি সব বলবো। শুধু বকিস না ভাইয়া প্লিজ। আই এম সরি।
আফিমের দিকে তাকিয়ে বললো আফরা। আফিম শান্ত চোখে তাকালো আফরার দিকে। স্পন্দন বললো,,
– আফরা,, কেউ রাগ করবো না যদি সবটা বলো।
রুহি আর ইনায়াত চমকে তাকালো আফরার দিকে। মাথা নাড়িয়ে ইশারায় না জানালো। কিন্তু আফরার সেদিকে খেয়াল নেই।
আফরা এক এক করে সব প্ল্যানিং বলে ফেললো। তাহজিবের বাসায় চুরির কথাও বললো। সবটা শুনে আরভিদ সাহেব,, আসিফ আর কামাল চমকে তাকালো মেয়েদের দিকে। আরভিদ সাহেবের মুখ আজ কঠোর হয়ে আছে। এতোদিন মেয়েকে সব কিছুতে ছাড় দিলেও এবার তার সহ্যের সীমা পেরিয়ে গেছে। মেয়ের থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলেন আরভিদ সাহেব। রুহি অসহায় চোখে তাকালো আফরার দিকে। আফরা কেঁদেই চলেছে। কঠোর হয়ে এলো তিনটি ছেলেরই মুখ। আফিম উঠে দাঁড়ালো। মোবাইল বের করে কিছু একটা করতে লাগলো। স্পন্দন আর তাহজিব ভ্রু কুঁচকে আফিমের দিকে তাকালো। আফিম আসিফ আর কামালের দিকে তাকিয়ে বললো,,
– আসিফ,, কামাল,,কাজী আর উকিল ডাকো। মালা আনো,, মিষ্টি আনো। আর হ্যাঁ আমাদের রুহির ডকুমেন্টস নিয়ে পাসপোর্ট অফিস যাও। আজকেই আমাদের তিনজনের বিয়ে হবে। আর এরপর আমরা সবাই এব্রোড যাচ্ছি রুহির চিকিৎসার জন্য।
– কিইইইই??
তিনজন মেয়ে একসাথে চিৎকার করে উঠলো। কিন্তু তাহজিব আর স্পন্দনের যেন বিষয়টা পছন্দ হলো খুবই। আরভিদ সাহেব তাহজিবের দিকে তাকালো।
– বাবা,, এখনো ৮ মাস বাকি রুহির ১৮ হতে।
তাহজিব উঠে দাঁড়িয়ে পকেটে হাত গুঁজে বললো,,
– চিন্তা করবেন না। বিয়ে এখন হবেই তবে আপনার মেয়ের বয়সের খেয়াল আমি সবদিক দিয়েই রাখবো।
আরভিদ সাহেব আর কিছু বললেন না। রুহি দ্রুত উঠে দাঁড়িয়ে বললো,,
– বাবা,, আমি বিয়ে করবো না বলে দাও।
আরভিদ সাহেব অভিমানে মেয়ের দিকে তাকালেন না। আফরা উঠে দাঁড়িয়ে বললো,,
– আমিও বিয়ে করবো না।
– আমিও করবো না।
ইনায়াতও তাল মেলালো। তখনই রুহি বলে উঠলো,,
– আমার এখনো ১৮ হয়নি। এই বিয়ে হবে না।
– আর আমার এই বিয়েতে মত নেই আপাতত।
ইনায়াত বললো। আফরা বললো,,
– কোনো লেহেঙ্গা নেই,, ফটোগ্রাফার নেই,, সাজ নেই,, মজা নেই। ধ্যাত!!
আফরার কথা শুনে অবাক হলো সবাই। সবাই ভেবেছিলো কোন সিরিয়াস কারনে বিয়ে করবে না বলছে আফরা। স্পন্দন হালকা কেশে গলা পরিষ্কার করে বললো,,
– রুহিকে ট্রিটমেন্ট করাতে বিদেশ নিয়ে যাবো। এরপর সুস্থ হয়ে দেশে ফিরলে ধুমধাম করে বিয়ে হবে সবার এক স্টেজে।
খুশীতে লাফিয়ে উঠে বললো আফরা,,
– আমি রাজি তাহলে।
ইনায়াত আর রুহি কটমট করে তাকালো আফরার দিকে। আফরা মিইয়ে গেলো মূহুর্তে।
আসিফ গিয়ে কাজি আর উকিল আনলো। কামাল গিয়ে মিষ্টি আর মালা আনলো,, সাথে ফটোগ্রাফার। আফিম জোসেফ আর লাবিবাকে কল দিয়ে ভিডিও কলে বিয়েতে সামিল করলো। হাতে গোণা দু’ এক ঘন্টার মাঝেই বিয়ে হয়ে গেলো তিন জুটির। ইনায়াত আর আফরার ধর্মীয় আর আইনগত ভাবে বিয়ে হলেও,,রুহির শুধু ধর্মীয় মতে বিয়ে হয়েছে।আইনগত ভাবে না হওয়ার কারণ,, এখনো ১৮ বছর হয়নি তার । আরভিদ সাহেব বেশিক্ষন অভিমান করে থাকতে পারলেন না। মেয়ে ও মেয়েজামাইকে মন ভরে দোয়া দিলেন। জোসেফ আর লাবিবাও খুশী। তারা দ্রুতই ফিরে আসবে জানিয়েছে।
পরিশিষ্ট:
রুহি-তাহজিব,, স্পন্দন-আফরা আর আফিম-ইনায়াত জুটি গেছে জার্মান৷ রুহির ট্রিটমেন্টের জন্য। যদিও না চাইতেও এটাকে ছেলেরা হানিমুনের পিচ্চি ভার্সন হিসেবে নিয়েছে। প্রায় ৬ মাসের ট্রিটমেন্টের পর রুহি সুস্থ হলে সবাই দেশে ফিরে এলো। রুহির ১৮ বছর হতেই আবারও খুব ধুমধাম ভাবে বিয়ে হলো তিন জুটির। তাদের জন্য সবাই মন থেকে দোয়া করবেন।
সমাপ্ত,,,