#ছায়া_হয়ে_থাকবো_পাশে_2
#Part_09
#Ariyana_Nur
—আমি আমাদের অতীত জানতে চাই।কেনো আর পাচটা পরিবারের মত আমাদের পরিবারটা না।কেনো তোমরা এক সাথে থাকো না।আর কেনই বা মা আপির সাথে এমন ব্যবহার করে।আমি সব জানতে চাই বাবা।
আশুর কথা শুনে মিঃখান কিছুক্ষন আশুর মুখের দিকে আবাক হয়ে তাকিয়ে থেকে বলল….
—এসব তুই কি বলছিস মা?এখন এসব কথা উঠছে কেন?থাক না এসব কথা।
আশু গম্ভীর গলায় বলল….
—না বাবা আজকে তোমাকে বলতেই হবে সব।আমি কোন বাহানা শুনতে চাই না।
মিঃখানঃপাগলামী করিস না মা।নুহা জানতে পারলে আনেক কষ্ট পাবে।বাবা তুমি ওকে একটু বোঝাও (নীল কে উদ্দেশ্য করে)
নীলঃআশু থাক না এসব।বাবা যখন বলতে চাচ্ছেন না তাহলে কেনই বা জোর করছো।
আশু নীল এর দিকে চোখ রাঙিয়ে তাকিয়ে বলল….
—চুপ করে বসে থাকুন।বাবা তুমি যদি আজ আমাকে সবকিছু না বল তাহলে আমি আর কখনো তোমার সাথে কথা বলবো না।
মিঃখানঃএসব পাগলামোর কোন মানে আছে বল আমায়।অতীত না ঘেটে বর্তমান নিয়েই থাক না।শুধু শুধু অতীত টেনে এই সুন্দর বর্তমানটা কেন নষ্ট করবি?
আশুঃকি করবো বল,অতীতের তিক্ততা যে বার বার আমার সুন্দর এই বর্তমানটাকে তিক্ত করে দিচ্ছে।তাই আমি চাই অতীতের সব জানতে।যাতে তার তিক্ততা আর কখনো আমাদের সুন্দর বর্তমান আর ভবিষ্যতটাকে বিষাক্ত করতে না পারে।
মিঃখান কোন ভাবেই আজ আশুকে হার মানাতে পারলো না।আশুর জেদ এর কাছে হার মেনে মিঃখান বাধ্য হয়ে বলতে লাগল….
—আসফিয়া আর আমার লাভ মেরেজ ছিল।আমি আসফিয়াকে হারানোর ভয়ে দু’ পরিবারের কাউকে না জানিয়েই বন্ধুদের সাহায্যে ওকে বিয়ে করি।আমাদের দু’পরিবার এরই অনেক নাম ডাক ছিল।তাই তারা প্রথমে একটু রাগ করলেও পরে তারা মেনে নেন।
আসফিয়ার পরিবারে ওর দু ভাই আর মা ছিল।আমাদের বিয়ের ৬মাস আগেই ওর বাবা মারা যায়।আতিক ভাই দেশে তার বাবার বিজনেস দেখাশুনা করতো আর আসলাম বাহিরে থাকতো।আমার পরিবারে শুধু তোর দাদু ছিল।আসফিয়া অল্প কিছু দিনের মধ্যেই বাবার অনেক আপন হয়ে যায়।বিয়ের দু বছরের মধ্যে আমাদের কোল জুড়ে নুহা আসে।নুহাকে পেয়ে সবাই অনেক খুশি হয়।সব থেকে বেশি খুশি হন তোর দাদু আর নানু।নুহাই ছিল দুই পরিবারের বংশের বড় নাতনী।তাই তারা এতো বছর পর তাদের পরিবারের ছোট সদ্যস্য আগমনে খুশি হয়ে নিজেদের সম্পত্তির অর্ধেক নুহার নামে লিখে দেন।কিন্তু তারা আমাদেরকে সেটা তখন জানান নি।পরে আমি উকিলের কাছ থেকে জানতে পারি।
নুহা খুব আদরেই বড় হতে লাগলো।আতিক ভাইও (আসফিয়ার বড় ভাই)নুহাকে অনেক আদর করতেন।নুহার সাথে যদি আসফিয়া কখন তার সামনে জোরে কথা বলত তখন তিনি আসফিয়ার খবর নিয়ে ছাড়তো।
আমার আর আসফিয়ার চোখের মনি আমাদের এন্জেল নুহা সবার আদরে ধীরে ধীরে বড় হতে লাগল।নুহার যখন ৬বছর বয়স তখন আমাদের ঘর আলো করে তুই এলি।তোকে পেয়ে নুহা সব থেকে বেশি খুশি হয়েছিল।সারাদিন তোর সাথে আঠার মত লেগেই থাকতো।নুহাই তোকে বেশি রাখতো।আর তুইও তখন থেকেই নুহাকে পেলে সবাইকে ভুলে যেতি।তুই ও আস্তে আস্তে বড় হতে লাগলি আর আরো বেশি নুহার বাধুক হতে লাগলি।নুহা যতক্ষন স্কুলে থাকতো ততক্ষন কেচর মেচর করে আসফিয়াকে পাগল করে ছাড়তি।আর নুহা আসলেই ভালো মেয়ের মত বোনের কাছে গিয়ে চুপ করে থাকতি।এই জন্য আসফিয়া মাঝে মাঝে রাগ করতো আবার খুশিও হত।ও সব সময় আমাকে বলল,আমি যদি মরে যাই তাহলে তুমি আমার কলিজার টুকরা নুহাকে কখন কাদতে দিবে না, কখন অবহেলা করো না।আমার মেয়েটাকে সমান্য মন খারাপ দেখলেই আমার কলিজা ছিরে যায়।আর যদি বেচে থাকি তাহলে আমার মেয়েকে আমি বিয়েই দিব না।আমার কাছেই রেখে দিব।আজ কাল যা নিউজ দেখি শশুর বাড়িতে গিয়েও মেয়েদের শান্তি নেই।স্বামী ভালো হলে শাশুড়ি খারাপ।শাশুড়ি ভালো হলে স্বামী খারাপ।আল্লাহ্ না করুক বিয়ের পর যদি ওরা আমার মেয়েকে অত্যচার অবহেলা করে।তখন তো আমি আমার মেয়ের চোখের জল সহ্য করতে পারবো না।তাই আমি আমার মেয়েকে বিয়েই দিও না তাই ভালো।আমিও তখন মিছে মিছে অভিমান দেখিয়ে বলতাম,বাচলে মরলে কি করবে না করবে তা সব চিন্তা তোমার বড় মেয়েকেই নিয়ে।আমি আর ছোট মেয়েকি বানের জলে ভেসে এসেছি?ও তখন কপট রাগ দেখিয়ে বলত,একদম আমার কলিজার টুকরোকে নিয়ে হিংসে করবে না।নুহা থাকতে আমার আশুর জন্য চিন্তা করার কোন দরকারি নেই।ওই ওকে মানুষ করতে পারবে।আমি জানি ও সব সময় আশুকে ছায়ার মত আগলে রাখবে।আর তুমি তো বুড় হয়ে গেছো।আমি আবার বুড়দের প্রতি বেশি মায়া দেখাই না।
কথাগুলো বলে মিঃখান মুচকি মুচকি হাসতে লাগল।তার পর কিছুক্ষণ চুপ থেকে আবার বলতে লাগল….
—হাসি মজাতে আমাদের দিন ভালোই যাচ্ছিল।কিন্তু একদিন এক ঝড় হাওয়া এসে আমাদের সুখের সংসারটাকে উলটপালট করে দিন।
তুই তখন ছোট ছিলি।একদিন তোর নানু ফোন করে বলল,কাল থেকে নাকি ভাবি(আতিক ভাইয়ের এর বউ)কে পাওয়া যাচ্ছে না।সব জায়গায় খোজ নিয়েছে কোথাও পাচ্ছে না।কথাটা শুনে আমরা দেরি না করে সে বাসায় চল যাই।নুহার শরীর অসুস্থ ছিল বিধায় নুহাকে ওর নানুর কাছে রেখে আমরা আশে পাশে সব আত্মীয় এর বাসায় খোজ নিতে যাই।তুই আমাদের সাথে যাবার জেদ ধরায় আমরা তোকে সাথে নিয়ে যাই।মান সম্মানের ভয়ে আমরা আর পুলিশকে জানাইনি।আমরা খোজ খবর নিয়ে যখন বাড়িতে ফিরে আসি তখন দেখি নুহা সোফার পিছে লুকিয়ে থরথর করে কাপছে।আসফিয়া তাড়াতাড়ি নুহার কাছে গিয়ে জিগ্যেস করল কি হয়েছে।নুহা এতো ভয় পেয়ে ছিলো যে,কথা বলতেই পারছিলো না।কিছুক্ষন পর নুহাকে কিছুটা সান্ত করিয়ে কি হয়েছে জিগ্যেস করলে নুহা ভয়ে ভয়ে বলে,
—মা…বড় মামা না মামিকে আগুনে পুড়িয়ে মেরে ফেলেছে।
কথাটা শুনে আমি আর আসফিয়া একে অপরের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকি।আমরা প্রথমে কথাটা বিশ্বাস করি নি।আমরা দুজনি নুহাকে বুঝাতে থাকি তার কোথাও ভুল হচ্ছে।আমাদের কথা শুনে নুহা তখন আতিক ভাইয়ার মোবাইল বের করে একটা ভিডিও ওপেন করে দেখিয়ে বলে,
আমার কথা তো বিশ্বাস করছো না এটা দেখো।আমি যখন মামার রুমে যাই তখন দেখি মামার ফোনটা তার বেডে পরে আছে।একা একা ভালো লাগছিলো না দেখে মামার ফোন নিয়ে আমি গেমস খেলতে থাকি।তখন একটা ভিডিও আসে মামার ফোনে।আমি কাটটে গিয়ে ভিডিওটা চালু করে ফেলি।তার পরেই এটা দেখি।
ভিডিওতে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল আতিক ভাই ভাবিকে হাত পা বেধে তার উপরে পেট্টোল ঢালছে।তারপরে তার শরীরে আগুল লাগিয়ে দিয়েছে।ভিডিওটা দেখে আমি আর আসফিয়া স্তব্দ হয়ে বসে থাকি।আমরা যেন আমাদের চোখকেই বিশ্বাসই করতে পারছিলাম না।
সেদিন আতিক ভাই অনেক রাতে নেশা করে বাসায় আসে।বাসায় আসতেই আসফিয়া তাকে ঝেকে ধরে ভাবির কথা জিগ্যেস করতেই তিনি নেশার ঘোরে সব সত্যি বলে দেয়।তিনি বলে,তিনি অবৈধ কাজে জরিয়ে পরেছিলেন।ভাবি জানতে পেরে তাকে অনেক বার বুঝিয়ে বলেছে সেই কাজের থেকে ফিরে আসতে।কিন্তু সে শোনেনি।ভাবি তাকে ওয়ার্ন করে যদি সে তার ঐ কাজ ছেড়ে না দেয় তাহলে সে তাকে পুলিশে দিবে।ভাবির কাছে নাকি বেশ কিছু প্রমান ও ছিল।তাই সে ভাবিকে তার পথ থেকে সরিয়ে ফেলে।
আমি পরের দিন সকাল বেলা পুলিশকে সব জানাতেই পুলিশ বাড়িতে চলে আসে।তোদের নানু সব জেনেও আতিক ভাইকে বাচাতে চায়।এবং সে তাকে পালাতে সাহায্য করে।পুলিশ এসে পুরো বাড়ি তন্ন তন্ন করে খুজেও যখন আতিক ভাইকে পায় না।তারা ব্যর্থ হয়ে যখন বসে আমাদের সাথে কথা বলছিল,তখন নুহা হাপাতে হাপাতে নিচে এসে বলে,নানু মাএই মামাকে পিছনের গেট দিয়ে বাহিরে পাঠিয়েছে আমি দেখেছি।পুলিশরা কথাটা শোনা মাএই আতিক ভাইকে ধরতে ছুটে চলে।পুলিশ পিছন থেকে আতিক ভাইকে তাড়া করতেই তিনি পুলির এর ভয়ে দৌড়ে রাস্তা পাড় হতে গিয়ে চলন্ত ট্রাকের সাথে এক্সিডেন্ট করে।হাসপাতালে নিতে নিতে তিনি মারা যান।তার মৃত্যুর খবর শুনে তোদের নানু সাথে সাথে স্টক করে মারা যায়।ভাই,মা হাড়িয়ে আসফিয়া পুরো তব্দ খেয়ে ছিল।কারো সাথেই কোন কথা বলতো না।
তাদের মৃত্যুর পরে আসলাম দেশে চলে আসে।আর এসে যখন জানতে পারে তাদের সম্পত্তি অর্ধ্যেক নুহার নামে তখন থেকেই সে আসফিয়ার ব্রেন ওয়াস করতে থাকে।আস্তে আস্তে আমাকে আর নুহাকে আসফিয়ার কাছে কাল বানিয়ে তোলে।আসলাম এর মতে আমাদের বাবা মেয়ের জন্যই তারা অনাথ হয়েছে।সাথে এটাও বলে আমি নাকি জালিয়াতি করে তাদের অধ্যেক সম্পত্তি মেয়ের নামে করে নিয়েছি।আসলাম আসফিয়াকে এমন ভাবে ব্রেন ওয়াস করে যে,আসফিয়া আমাদেরকে দেখতেই পারতো না।আসলামের সাথে আসফিয়াও আমাদের দোষারোপ করতে থাকে।ও আমার নামে কেস করে।আমার কাছে ডিভোর্স চায়।কিন্তু আমি ডিভার্স দিতে নারাজ ছিলাম।ও নিজেই আমার কাছে ডিভোর্স পেপার পাঠায়। সাথে তোদেরকেও আমার কাছেই রেখে যায়।আমি ডিভোর্স পেপারে সাইন করি নি।আমার বিশ্বাস ছিলো ও একদিন ফিরে আসবে।কেস করার পরেই জানতে পারি তোর দাদু আর নানু স’ইচ্ছায় সম্পত্তি নুহার নামে লিখে দিয়েছে।কিন্তু এটা জানার পরেও আসফিয়া তা মানতে নারাজ।তার কথা মতে আমি তাদের টাকা খাইয়ে মিথ্যে বলাচ্ছিলাম।
কিছুদিন পর ও আমার বাড়িতে আসে।আমি বাড়িতে না থাকায় ও তোকে তার কাছে নিয়ে যায়।ও আমাকে ফোন করে জানায় আমাদেরকে কষ্ট দেবার জন্যই ও তোকে আমাদের কাছ থেকে নিয়ে গেছে।আমি তোকে আমার কাছে নিয়ে আসা জন্য আইনের সাহায্য নিতে চাইলে আসলাম তোর ক্ষতি করবে বলে আমাকে হুমকি দেয়।আমি তার হুমনি না শুনে কেস ফাই করে বাড়িতে আসতেই শুনি তুই নাকি সিড়ির থেকে পরে মাথা ফাটিয়ে ফেলেছিস।তোর কথা শুনে আমি আমি আর নুহা হাসপাতালে চলে যাই।চোট বেশি লাগার কারনে দুদিন পর তোর জ্ঞান ফিরে।এই দুদিন নুহা খেয়ে না খেয়ে হাসপাতালেই পরে ছিল।তোর জ্ঞান ফিরতেই আসফিয়া তোকে বাড়িতে নিয়ে যায়।হাসপাতালে তোকে রাখলে আমরা তোকে দেখতে পাব তুই আমাদের চোখের সামনে থাকবি। কিন্তু বাড়িতে নিলে দেখতে পাবো না,আর তাতেই আমাদের বেশি কষ্ট হবে তার জন্যই তোকে বাড়িতে নেওয়া।আর এই সুন্দর বুদ্ধিটা আসলাম তোর মাকে দিয়েছিল।যা আমি নিজের কানে শুনেছি।
নুহা তোর মায়ের কাছে গিয়ে অনেক কান্না কাটি করে তোর কাছে থাকার জন্য।আসফিয়া নুহাকে প্রথমে রাখতে রাজি হয় না।নুহাকে সে কিছুতেই তার কাছে রাখবে না বলে দেয়।আসলাম আসফিয়া সাইডে নিয়ে কিছু একটা বোঝাতেই আসফিয়া ফিরে এসে নুহাকে বলে,সে নুহাকে তোর কাছে রাখতে রাজি আছে যদি নুহা তাদের সম্পত্তি তাদের ফিরিয়ে দেয়।আর ও যা বলবে সব কথা নুহাকে শুনতে হবে। এমনকি বড় হলে ওর পছন্দের ছেলেকেই বিয়ে করতে হবে।১১বছরের একটা মেয়েকে এমন সব শর্ত দিতে দেখে আমি অবাক হয়ে দাড়িয়ে ছিলাম।নুহা তড়িঘড়ি তার সব কথাই মেনে নেয়।তোর কাছে যে নুহাকে থাকতে দেবার জন্য আসফিয়া রাজি হয়েছে এটাই নুহার কাছে অনেক ছিল।আমি সেদিন মানা করেও নুহাকে আমার সাথে নিয়ে আসতে পারিনি।নুহার জেদের কাছে হার মেনে আমাকে একাই বাড়ি ফিরতে হল।এমনকি আমাকেও তোদের সাথে দেখা করতে দিত না।
সেই ঘটনার ১৫দিন পর নুহার স্কুল থেকে আমাকে ফোন করে জানালো যে নুহা আজ ১৫দিন ধরে স্কুলে যাচ্ছে না।কথাটা শুনে সাথে সাথেই আমি ঐ বাড়িতে চলে গিয়েছিলাম।সারা রাস্তায় আমার মাথায় ঘুরপাক করছিলো ওর কোন ক্ষতি হয় নি তো।ও সুস্থ আছে তো।কিন্তু সেখানে গিয়ে আমার পায়ের নিচের মাটি সরে যায়।নুহাকে আসফিয়া মারছে তাও আবার সামান্য একটা গ্লাস ভাঙার জন্য।আমি অবাক হয়ে আসফিয়ার দিকে তাকিয়ে ছিলাম আর মনে মনে নিজেকেই প্রশ্ন করছিলাম,এই কি নুহার সেই মা?যে নুহাকে একটা মশা কামড় দিলেও মনে হতো সে ব্যথা পাচ্ছে।আর আজ সে তার গায়ে হাত তুলছে?তখন আমার মন একটাই উওর দিয়েছিলো,না এটা নুহার সেই মা না।তার মা বদলে গেছে অনেক বদলে গেছে।
সেদিন আসফিয়ার সাথে রাগারাগি করে তোদের নিয়ে আসার জন্য জোর দেই তখন আসলাম আমাকে ধাক্কা দিয়ে বের করে দিয়ে বলে,সেদিন নাকি সেই তোকে সিড়ি থেকে ফেলে দিয়েছিলো।এর পর যদি তোদেরকে আমি আমার কাছে নিয়ে আসার জন্য জোর করি তাহলে নাকি তোদের মেরে ফেলবে।তখন আমি তোদের কথা ভেবে মুখ বুজে চলে এসেছিলাম।তোদের কে বাচিয়ে রাখার জন্য আমার কাছে এই ছায়া কোন পথ খোলা ছিল না।যার নাকি ছোট একটা বাচ্চাকে সিড়ি থেকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিতে হাত কাপে নি সে যে কি কি করতে পারবে তা আমার জানা হয়ে গিয়েছিল।
আসফিয়া নুহার পড়া লেখা বন্ধ করে দিয়েছিলো।নুহাকে দিয়ে বাড়ির কাজ করাতে থাকে সাথে তো অবহেলা ছিলোই।আমি ঐ সব সহ্য করতে না পেরে সার্থপরের মত নুহাকে আমি সেখান থেকে চলে আসতে বললে নুহা বলতো,আশুর জন্য আমি এই সামান্য কাজ কেনো আরো কিছু করতে পারবো।আর বাবা তুমি কেন এমন চিন্তা কর?আমি না আশুর ঐ হাসিখুশি মুখের দিকে তাকালেই সব ভুলে যাই।আমার সব কষ্ট নিমিশেই দূর হয়ে যায়।জানো বাবা আমার না আমার জন্য কষ্ট হয় না কষ্ট হয় আশুর জন্য।মা না আশুকেও আর আদর করে না।একটুও ভালোবাসে না।এখন আমি যদি তোমার সাথে চলে যাই তাহলে বল কে আশুকে আদর করবে?কে ওকে ভালোবাসবে?তুমি ওর জন্য একদম চিন্তা করো না আমি সব সময় ওর খেয়াল রাখবো।আমি ছায়ার মত ওর পাশে থাকবো।
আমি একটা বছর অনেক কষ্ট করে নুহা আর তোর পড়াশুনার জন্য আসলামকে দিয়ে আসফিয়াকে রাজি করেয়েছি।কিন্তু তার জন্য প্রতি মাসে মাসে ওর একাউন্টে মোটা আঙ্কের টাকা পাঠাতাম।আসলাম কেও এর জন্য মোটা অঙ্কের টাকা দিয়েছিলাম।একদিন আসলাম আমার অফিসে এসে আবার মোটা অঙ্কের টাকা চাইল।আমি দিতে মানা করে দিতেই সে রাগে গরগর করে শুরু থেকে সব বলতে লাগলো।কিভাবে আমাকে আসফিয়ার জীবন থেকে সরিয়েছে।কিভাবে ও আসফিয়ার ব্রেন ওয়াস করেছে সব বলতে লাগলো।সাথে সেদিন এটাও বলে গেছে আমাদের না কি সান্তিতে থাকতে দিবে না।
আস্তে আস্তে তোরা বড় হতে লাগলি আর নুহা আসফিয়ার এন্জেল থেকে চাকরানীতে পরিনত হতে লাগল।আর আসফিয়াও পাথর হতে লাগলো। বাকি সব তো তুই জানিস।যাকে হারানোর ভয়ে হুট করেই বিয়ে করেছিলাম তাকে তো হারিয়েছি সাথে সাথে মেয়েদের কেও আমি হারিয়েছি।
কথাগুলো বলে মিঃখান বড় করে একটা নিশ্বাস নিয়ে চশমা খুলে চোখ মুখে আশুর দিকে তাকালো।আশু মূর্তির মত চুপচাপ নিচের দিকে তাকিয়ে বসে আছে।নীল সব শুনে থ’মেরে বসে রইল।নীল ওকিছু বলার ভাষা খুজে পাচ্ছে না।
(ব্রেন ওয়াস যাকে আমরা কান পরা বলে থাকি তা মারাত্মক খারাপ একটা রোগ।এই কান পরার মধ্যমে যদি কেউ একবার কারো জন্য কারো অন্তরে বিষ ঢালতে পারে তাহলে তার থেকে বের হয়ে আসা খুবই কঠিন।কিছু কিছু মানুষ আছে যা একম ভাবে মানুষের ব্রেন ওয়াস করে, যাদের ব্রেন ওয়াস করে তাদের কাছে মনে হয় ঐ লোক যা বলছে তাই সত্য তাই ঠিক।বাকি সব মিথ্যে সব ভুল।সেই ব্যক্তিই তার শুভাকাক্ষী।বাকি সবাই তার শক্র।যাদের ব্রেন ওয়াস করা হয় তাদের তখন হিতাহিত কোন জ্ঞান থাকে না।তাদেরকে যেভাবে বুঝানো হয় তারা ঠিক সেই ভাবেই বুঝে।
নুহাকে ছোট থেকে আসফিয়া যে কাজের জন্য দোষারোপ,অবহেলা করছে সে কি সত্যিই সে দোষের উপযোগি ছিল?আসফিয়াকে কে আসলাম এমন ভাবে ব্রেন ওয়াস করেছে যে,সে তার প্রিয় স্বামী,সন্তান কে সে ঘৃনা করতে লাগলো।এমন দোষারোপ তাদেরকে দিল, যেটার জন্য তারা দায়ী নয়।আসলাম এমন ভাবেই আসফিয়ার মনে ওদের প্রতি বিষের বিজ বপন করেছে যে,আসফিয়া যেই কলিজার টুকরা মেয়ের চোখের পানি সহ্য করতে পারতো না তাকেই সে বার বার আঘাত করতো।
আসলে দোষ ছিল কার?পরিস্থিতির,আসলামের,আসফিয়ার নাকি নুহা আর মিঃখানের???
#চলবে,
#ছায়া_হয়ে_থাকবো_পাশে_2
#Part_10
#Ariyana_Nur
সূয্যী মামা তার রক্তিম আভা চারোপাশে ছড়িয়ে দিয়ে ডুবু ডুবু করছে।পাখিরা দল বেধে বেধে তাদের নীড়ে চলে যাচ্ছে।পার্কের মানুষজনের সোড়গোড় আস্তে আস্তে কমতে লাগছে।সবাই হয়তো পাখিদের মত সন্ধ্যায় আগেই তাদের নীড়ে ফিরতে ব্যস্ত।
আশু মিঃখান এর মুখে সব শোনার পর থেকে স্তব্ধ হয়ে রয়েছে।মিঃখান এর বাসা থেকে আশু কিছু না বলেই বেড়িয়ে যায়।গাড়িতে উঠেও আশু নীলের সাথে কোন কথা না বলে চোখ বন্ধ করে বসে থাকে।নীল আশুর অবস্থা বুঝতে পেরে আশুকে সাভাবিক করার জন্য একটা পার্কে নিয়ে আসে।পার্কের সামনে গাড়ি থামার পরেও আশুর মধ্যে কোন কৌতূহল দেখা দিল না।সে একবার চোখ খুলে চারোপাশ দেখে আবার চোখ বন্ধ করে বসে রইল।নীল গাড়ি থেকে নেমে আশুকেও গাড়ি থেকে নামিয়ে ওর হাত ধরে হাটা ধরল।একটু নিড়িবিলি জায়গা দেখে সেখানে গিয়ে একটা টুলে বসল।
কিছুক্ষন চুপ করে থাকার পর নীল বলল….
—দেখো আমরা কিন্তু আমাদের অতীতকে পরিবর্তন করতে পারবো না। সবার অতীত তো আর সুন্দর হয় না।অতীতের ঐ তিক্ততা মনে করে নিজের সুন্দর বর্তমান আর ভবিষ্যত নষ্ট করার কোন মানে হয় না।আমাদের উচিত আমাদের পিছনের অতীতকে পিছনে ফেলে সামনে এগিয়ে যাওয়া।
কথাগুলো বলে নীল কিছুক্ষন চুপ করে থেকে আশুর মাথাটা নিজের কাধে রেখে বলল….
—নিজের কষ্ট গুলোকে নিজের মধ্যে ধরে না রেখে তাদেরকে অস্রু হয়ে বের হয়ে যেতে দাও।জানি তোমার কষ্টের ভাগ নিতে পারবো না।কিন্তু বন্ধু হয়ে তোমার কষ্টের কথা শুনতে তো পারবো।তোমাকে যদি বউমনি এভাবে দেখে তাহলে সে ভীষন কষ্ট পাবে।
কথাগুলো বলে নীল চুপ করে বসে রইল।কিছুক্ষন পর কাধে ভেজা অনুভব করলো।আশু যে কাদছে তা বুঝতে পারলো।তার পরেও নীল কিছু বলল না।নীল মনে মনে বলল,কাদুক না একটু।কান্না করে মনটাকে হালকা করুক। আশু কিছুক্ষন নিরবে কান্না করার পর ফুপিয়ে ফুপিয়ে কান্না করতে লাগলো।নীল এতোক্ষন চুপ করে থাকলেও আশুকে ফুপিয়ে কান্না করতে দেখে তার কষ্ট হতে লাগলো।আশুকে এভাবে কান্না করতে দেখে নীলের হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হতে লাগলো।নীল অনেক কষ্টে নিজেকে সামলিয়ে চুপ করে বসে থাকলো।কিছুক্ষন পর নিজেকে আর সামলিয়ে রাখতে না পেরে নীল আশুকে জরিয়ে ধরে আশুর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে করুন কন্ঠে বলল….
—আশু….প্লিজ আর কান্না করো না।যা হয়েছে ভুলে যাও।জানি ভুলা সম্ভব না।কিন্তু চেষ্টা করতে ক্ষতি কি।দেখো আমার কিন্তু তোমার এই কান্না সহ্য হচ্ছে না।আমি তোমাকে এভাবে দেখতে পারছি না।তুমি যদি এখন কান্না না থামাও তাহলে কিন্তু আমিই এখন কান্না শুরু করব।তাও আবার যেন তেন কান্না না।একেবারে হাত পা ছড়িয়ে কান্না।তখন কিন্তু তুমি আমাকে সামলাতে পারবে না বলে দিলাম।কান্নাকাটি করে এখানে কিন্তু খাল-বিল বানিয়ে ফেলবো।
নীলের এই অদ্ভুত কথা শুনে আশু কান্না বন্ধ করে নীলের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল।নীল আশুকে ওর দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকতে দেখে ভ্রু কুচকে বলল….
—বিশ্বাস হচ্ছে না আমার কথা?করে দেখাবো?
________________________
নীল আশুকে অনেক কষ্ট করে সাভাবিক করে বাসায় নিয়ে আসে।বাসায় আসার পর আশু সোজা নুহার রুমে চলে যায়।নুহা তার বিছানা গুছাচ্ছিল।আশু নুহাকে পিছন থেকে জরিয়ে ধরে দাড়িয়ে রইল।নুহা আশুর হাতের উপর হাত রেখে বলল….
—কোথায় গিয়েছিলি?ফিরতে এতো দেড়ি হল কেন?
আশু নুহার কথায় উওর না দিয়ে বলল…
—লাভ ইউ এন্ড মিস ইউ আপি।
নুহা মুচকি হেসে বলল…..
—লাভ ইউ টু, থ্রী, ফোর, ফাইভ আর মিস ইউ এত্তোগুলো।(দু হাত দুই দিকে ছড়িয়ে)
নুহার কথা শুনে আশু নুহাকে ছেড়ে দিয়ে হাসতে লাগলো।নুহা ও আশুর সাথে তাল মিলিয়ে হাসতে লাগলো।আশু হাসতে হাসতে নুহাকে জরিয়ে ধরে বলল….
—লাভ ইউ আপি….
নুহা এক হাতে আশুকে জরিয়ে ধরে আরেক হাতে আশুর মাথায় হাত বুলিয়ে বলল….
—লাভ ইউ টু।
এতোক্ষন বেলকনির দরজার সামনের থেকে সাইফ আর রুমের দরজার সামনের থেকে নীলাভ ওদের দুই বোনের কাহিনী দেখছিলো।নীল ওদের সামনে এসে সাইফকে উদ্দেশ্য করে বলল…..
—দেখ!এদের থেকে শিখ কিছু।জীবনেও তো আমাকে লাভ ইউ বলো নি।আর দেখ বউমনি আশুকে লাভ ইউ টু, থ্রী, ফোর এমনকি ফাইভ ও বলছে।(মুখ গোমরা করে)
সাইফ ওদের সামনে এসে পকেটে হাত গুজে দাড়িয়ে বলল….
—তুই কোনদিন আশুর মত সুইট করে আমাকে লাভ ইউ বলেছিস?যে আমি বলবো।বলবি কেন দিন দিন তো বাদর হচ্ছিস।
নীল নালিশের শুরে নুহাকে বলল….
—দেখো বউমনি!ভাইয়া আমাকে বাদর বলছে।তুমি কিছু বল।
কথাটা বলেই সাইফ, নুহার চোখেরে আড়ালে আশুকে একটা চিমটি কাটলো।আশু নীলের দিকে কটমট করে তাকাতেই নীল চোখের ইশারায় কিছু একটা বলতেই আশু সুর টেনে বলল….
—আপি কি বলবে,ভাইয়া যা বলেছে একদম ঠিক বলেছে।হুহ….
নীল কিছু বলার জন্য মুখ খোলার আগেই সাইফ ওকে থামিয়ে দিয়ে বলল….
—আর একটা কথা বলার চেষ্টা করবি তাহলেই মুখে টেপ লাগাবো।আমাদের সামনে ঝগড়া করো, একজন আরেকজনকে দেখতে পারো না।আর আমাদের অগোচরে যে কি কর সেই খবর কি আমরা রাখি না। এদিকে যে সারা বিকেল পার্কে একে অপরের হাত ধরে ঘুরে এলে তা কি মনে করেছো জানি না আমরা।বাকি গুলো না হয় আর নাই বললাম।
সাইফ এর এমন কথা শুনে আশু আর নীল একে অপরের দিকে অসহায় ভাবে তাকিয়ে রইল।ওরা যে পার্কে গিয়েছিল সাইফ কিভাবে জানতে পারলো তাই ওদের মাথায় আসছে না।
ওদের অসহায় ফেস দেখে নুহা সাইফ এর দিকে কপাল কুচকে তাকিয়ে বলল….
—শেখো ওদের থেকে।তোমার মত কি আমার ভাই নিরামিষ নাকি।তুমি তো শুধু পারো রাগ দেখাতে আর তো কিছুই পারো না।হুহ….
সাইফ হাত ভাজ করে বলল….
—আমি নিরামিষ?তাহলে তুমি কি?
নুহা তেজী গলায় বলল…..
—আমি কি মানে?তোমার মান ভাঙানোর জন্য আমি কি কি করেছি ভুলে গেছো?ভুলবেই তো। মন ভোলা মানুষ একটা।
সাইফঃমন ভোলা,নিরামিষ আর কি কি নাম দিবে আমার?একটা কথা কি জানো?তোমার মুখে না এসব শুনতে খারাপ লাগছে না।বরং ভালোই লাগছে।বউ যে নামেই ডাকুক না কেন সেটাতে আলাদা একটা ফিলিংস মেশানোই থাকে।
নুহা চোখ রাঙিয়ে বলল…
—ছি…কথার কি ছিড়ি।ছোট ভাই বোনদের সামনে কি সব বলছো?
সাইফঃএখন ছি বলছো কেন?একটু আগেই না তুমি বললে আমি নিরামিষ।
ওদের কথাশুনে নীলাভ আর আশু একে অপরের দিকে তাকিয়ে একসাথে বলে উঠলো….
—তোমাদের মান-অভিমান ভেঙেছে তাহলে।আর আপনি থেকে তুমিতে চলে গেছো।আমিন,ছুম্মা আমিন।
#চলবে