ছিলাম তো তোমারই পাশে পর্ব-১৭

0
2707

#ছিলাম_তো_তোমারই_পাশে
#পর্ব_17
Writer:: Shaanj Nahar Sanjida


আমাদের আসতে আসতে প্রায় রাত বারোটার বেজে গেলো।এই সম্পূর্ন রাস্তায় আমি কান্না ছাড়া আর কিছু করতে পারিনি।মা বাবা আর ছায়া সবাই সোজা বাসায় চলে গেছে।আর আমাকেও আদি আঙ্কেল তাদের বাড়ি নিয়ে এসেছে।আসার আগেই কাউকে গেস্ট রুম তৈরি করতে বলা হয়েছিল।আজ রাতে আমি গেস্ট রুমে থাকবো কালকে বুঝা যাবে আমার ঠাই কোথায় হয়।সারাদিন কিছু খাইনি,,আভি খাবার এনে দিয়েছিল কিন্তু আমিই খাইনি।কি করবো খাওয়া তো আর গলা দিয়ে নামছে না।তাই রাতে না খেয়েই ঘুমাতে চলে গেলাম।আদি আঙ্কেল আর সুমাইয়া আন্টিও জোরাজুরি করে নি।কারণ উনারা হয়তো বুঝে গেছি জোরাজুরি খাওয়াতে পেট ঠিকই ভরবে কিন্তু মন ভরবে না।আমি আর আভি দুজনই যার যার রুমে ঘুমাতে চলে গেলাম।


অন্ধকার রুমে দাড়িয়ে বেলকনিতে দাড়িয়ে দাড়িয়ে চাঁদ দেখছি।কোনো ভাবনাই আর মনে আসছে না।মনটা এতো ভার হয়ে গেছে যে এই সুন্দর চাঁদটাও আমার অসহ্যকর লাগছে।আমি বেলকনিতে দাড়িয়ে আছি তখনই সুমাইয়া আন্টি আমার রুমে ঢুকলো।ঢুকেই রুমের লাইট অন করলো।আমি রুমের লাইট অন হতে দেখেই পিছনে তাকালাম।তাকিয়ে দেখি সুমাইয়া আন্টি নুডুলসের একটা বাটি নিয়ে দাড়িয়ে আছে।
আন্টি আপনি এতো রাতে কি করছে?(আমি অবাক হয়ে)

আমার মেয়ে না খেয়ে থাকবে আর আমি তা হতে দিবো এটা কি হয়?আদি অবশ্য বলে ছিলো তোকে জোর করতে না।তবুও কেনো জানি মন মানলো না।কি করে মানবে বল তুই তো সারাদিন কিছু খাস নি।তাই আমি ভাবলাম তোর জন্য নুডুলস বানিয়ে নিয়ে আসি।ওইদিন কলি আপার সাথে দেখেছি কি মজা করে তুই নুডুলস খাস।তাই ভাবলাম হয়তো নুডুলস তোর পছন্দের।তাই বানিয়ে আনলাম।
বলেই আন্টি আমাকে নিয়ে বেডে বসলো।

আন্টি আপনাকে এইসব করার কি দরকার ছিলো?সারাদিন জার্নি করে এসেছেন এখন রেস্ট নিতেন।(আমি)

জানিস আভি যখন হলো আমি চেয়েছিলাম ওর পরে আমার একটা মেয়ে হোক।কিন্তু মেয়ে হলো না।হলো আয়ুশ।তখন আমি আয়ুশকে পেয়ে খুশি হলেও মেয়ের জন্য আফসোস করতাম।তখন আভির বাবা আমাকে বললো।উপরওয়ালা আমাদের দুটো ছেলে দিয়েছে যাতে আমরা দুটো মেয়ে পেতে পারি।আর এখন তো একটা মেয়ে পেয়েই গেছি।(সুমাইয়া আস্থার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে)

আমি উনাকে জড়িয়ে কাদতে শুরু করলাম।

আন্টি আপনার কি আমার উপর রাগ হয় না?আমার আর আভির বিয়ের পরিস্থিতির কথা ভেবে?আপনি কি করে পারেন আমাকে এত আপন করে নিতে?(আমি কাদতে কাদতে)

প্রথম একটু রাগ হয়েছে।পড়ে ভাবলাম রাগ হয়ে কি হবে সবাই তো পরিস্থিতির স্বীকার।আর আমি জানি আমার আভি এমন কিছুই করবে না।আভি যেহেতু তোর বন্ধু তুইও এইসব কিছুই করিস নি।আমার আভি আর তোর উপর সম্পূর্ন ভরসা আছে।(সুমাইয়া মুচকি হেসে)

থ্যাঙ্ক ইউ আন্টি।(আমিও মুচকি হেসে)

কী আন্টি?আমি তোর মা হই।আমাকে মা বলে ডাকবি!(সুমাইয়া)

ওকে মা।(আমি)

ওকে।এখন খেয়ে নে তো।মা মেয়ের কথা পরেও হবে কিন্ত এখন এই নুডুলস ঠান্ডা হয়ে যাবে।
বলেই সুমাইয়া আন্টি সরি মা আমাকে খাইয়ে দিল।


অন্যদিকে আভি বেলকনিতে দাড়িয়ে দাড়িয়ে ভাবছে তখনই আদি আসলো
নে নুডুলস বানিয়েছে তোর মা।খেয়ে নে।(আদি ভ্রু কুঁচকে)

বাবা তুমি কি ভালো করে কথা বলতে পারো না আমার সাথে?(আভিও ভ্রু কুঁচকে)

তাহলে আর কি করে বলবো?সেখানে তো সবার সামনে প্রমাণ করবি বলে চিৎকার করছিলি এখন এসেই হাওয়া ফুস।(আদি বেডে বসে)

তুমি কি মজা নিচ্ছো?(আভি বেলকনিতে থেকে এসে আদির সামনে দাড়িয়ে)

না।দেখ তোর আমার সম্পর্ক শুধু বাবা ছেলের না বন্ধুর ও।আমরা ঝগড়া করি আবার মিলি।সেই বন্ধুত্বের সম্পর্ক নিয়ে বলছি খাওয়ার পর ভাব।খালি পেটে বুদ্ধি বের হয় না।(আদি এক টানে আভিকে নিজের পাশে বসিয়ে)

আভি হেসে দিলো।
বাবা তুমি পারোও বটে।কখন বাবা হও কখন বন্ধু বুঝা মুশকিল।

হুম। এটাই তো বাবা।এখন খেয়ে নে।
বলেই আদি আভিকে খাইয়ে দিলো।

বাবা।আস্থা খেয়েছে?(আভি খেতে খেতে)

হুম।তোর মা গেছে।(আদি)

মা।আস্থাকে মেনে নিয়েছে?(আভি)

না নেওয়ার কি আছে?(আদি)

ওকে।তাহলে তো ভালোই।
বলেই আভি খেতে লাগলো।

সবাই আস্থাকে মেনে নিয়েছে।কখন তুই মেনে নিবি বাবা?(আদি মনে মনে)


অন্যদিকে খান বাড়িতে
ছায়া এসেই আস্থার জিনিস পত্র নিয়ে কান্নাকাটি করছে। কলিও এসে ছায়ার সাথে কান্নাকাটি করছে।তখনই জিসান আসলো
তোমরা কাদঁছো কেনো?আমাদের মেয়ে আমাদের কাছ থেকে দূরে যায় নি।ভাবো ও কিছু দিনের জন্য বেড়াতে গেছে।(জিসান চোখ মুছতে মুছতে)

আমরা তো ভাবতে পারবো বাবা কিন্তু তুমি কি ভাবতে পারবে?আপু তো তোমার প্রাণ?(ছায়া জিসানের কাছে কাদতে কাদতে গেলো)

আমাদের মেয়ে আমাদের উপর অভিমান করে আছে এটাই আমাদের সব চেয়ে বেশি কাদাচ্ছে!না জানি ও সেই নতুন পরিবেশে কেমন আছে?কিছু খেয়েছে কি না?(কলি)

জিসান দুই হাত দিয়ে কলি আর ছায়াকে জড়িয়ে ধরে
ও যেখানেই আছে ভালো আছে।সুমাইয়া আর আদি ওকে ভালোই রাখবে।আর অভিমানের কথা বলছো ওইটা ভেঙ্গে যাবে।আমাদের মেয়ে আমাদের উপর অভিমান করে থাকতেই পারবে না।আমরা থাকতেই দিবো না।(জিসান)

হুম।(কলি)


আদি আর সুমাইয়া,,আভি আর আস্থাকে খাইয়ে দাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে নিজেরাও ঘুমাতে চলে গেলো।সারাদিনের কান্না করার কারণে আস্থাও ঘুমিয়ে পড়লো।অন্যদিকে সবার উপর ধকল গেছে বলে সবাইও ঘুমিয়ে পড়লো।আভি কি করবে ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়লো।ছায়া ওর বোনের জন্য কাদতে কাদতে ঘুমিয়ে পড়লো।আয়ুশ কি থেকে কি হয়ে গেলো এইসব ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়লো।
সবার রাতটা ভাবতে ভাবতেই চলে গেলো।


সকালে আমি চোখ খুলে দেখি সাড়ে নয়টা বেজে গেছে।আমি কখনো এতো বেলা পর্যন্ত ঘুমাই না।ঘুমাই না বললে ভুল হবে বাবা ঘুমাতে দিতো না।তখন এইসবে খুব রাগ হতো কিন্তু এখন সেসব জিনিস খুব মিস করছি।কালকের ঘটনা ভাবতেই আবার মনটা খারাপ হয়ে গেল।আমি ফ্রেশ হয়ে দেখি সুমাইয়া আন্টি আমার বেডের পাশে একটা শাড়ি রেখে গেছে।আর তারউপর লিখা ফ্রেশ হয়ে পড়ে নিস।এক কাপড়ে থাকলে শরীর খারাপ করবে।আমি চিঠিটা পরেই মুচকি হাসি দিলাম।সত্যিই এই বাড়ির মানুষ গুলো খুব ভালো।আমি তাড়াতাড়ি শাড়িটা পড়ে নিচে নামলাম।
নিচে নেমেই দেখি আভি পেঁচার মতো মুখ করে সোফায় আসন পেতে গালে হাত দিয়ে বসে আছে।যেনো ওর বউ মরে গেছে।
অন্যদিকে আয়ুশকে একটু বেশি এক্সসাইটেড মনে হচ্ছে।সুমাইয়া আন্টি আর বাকি সার্ভেন্ট মিলে খাবারের টেবিলে খাবার সাজাচ্ছে।আদি আঙ্কেল সোফায় পায়ের উপর পা তুলে আভির দিকে ভ্রু উচুঁ করে তাকিয়ে আছে মনে হচ্ছে কিছু উত্তরের আশা করছে,,,

বাবা আমার আপত্তি তো তুমি শুনবে না ভেবেই রেখেছো।অন্তত আস্থাকে জিজ্ঞেস করো। ওরও তো মতামত প্রয়োজন।(আভি ঠোঁট ফুলিয়ে)

কিসের মতামত?(আমি সিড়ি দিয়ে নামতে নামতে)

আরে ভাবী যে এসো এসো।(আয়ুশ)

আভি আস্থার কথা শুনে সিড়ির দিকে তাকাতেই হা হয়ে গেলো।
এ আমি কাকে দেখছি!আস্থাকে এতো সুন্দর কবে থেকে লাগতে শুরু করলো।আমি যেনো চোখ ফেরাতেই পারছি না।

আস্থা একটা পিংক কালারের শাড়ি পরেছে। হালকা ভিজা চুল গুলো ছাড়া।মুখে কোনো কিছু দেয়া হয় নি।ঠোঁট গুলো শুকনো হয়ে আছে।এতেও আভির চোখ যেনো সরছে না।চোখ গুলো কান্না করার কারণে একটু ফুলে আছে।নাকের ডগাতে লাল হয়ে আছে।সব মিলিয়ে যেনো আভির হুশ উড়িয়ে দিলো।আভি কোনো দিন ভাবতে পারি নি আস্থাকে কোনোদিন এমনও দেখতে লাগবে।যেই চেহারা থেকে মুখ ফেরানো ওর মুশকিল হয়ে যাবে।

ভাবীকে পরে দেখিস।এখন বরং আসল কথা বল।(আয়ুশ ধাক্কা দিয়ে)

আয়ুশ এর কথায় আভির হুশ ফিরল।

আমি বলি!আস্থা আমরা আজ তোমার আর আভির বাসর রাতের ব্যাবস্থা করতে চাই!(আদি মুচকি হেসে)

কিঃ?(আমি অবাক হয়ে)

ভাবী বাসর রাত!(আয়ুশ)

ওইটা আমিও শুনছি।কিন্তু কেনো?(আমি)

কারণ আমি চাচু হতে চাই।বাবা দাদু হতে চায়।আর মা দাদী হতে চায়।তাই না মা?(আয়ুশ সুমাইয়ার কাছে গিয়ে)

অবশ্যই।(সুমাইয়া আয়ুশ কাধে কাধে হাত রেখে)

তোমরা চুপ করবে।আস্থা মা তুই তো আর সারাজীবন গেস্ট রুমে থাকতে পারিস না।এক না একদিন তো তোকে আভির রুমে যেতে হবে।সেটা না হয় এখনই হোক।তোর কোনো আপত্তি নেই তো মা?(আদি কিউট ফেস করে)

এ দেখি ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল করার ক্ষেত্রে আমার বাবার থেকেও এক ধাপ এগিয়ে।কোনো সন্দেহ নেই আমার বাবা আর আদি আঙ্কেল বন্ধু।
আমি একটা দীর্ঘ শ্বাস নিয়ে বললাম
আমার কোনো আপত্তি নেই।যদি এটাই আপনাদের ইচ্ছা হয় তাহলে আমিও রাজী।

আদি আংকেলের কথা শুনে আভি শকে ছিলো।আমার কথা শুনে বেচারা ডবল শক খেলো।আগে এক গালে হাত দিয়ে বসে ছিলো এখন দুই গালে হাত দিয়ে বসে আছে।

অন্যদিকে আয়ুশ না পারে নাগিন ডান্স দিতে।

তাহলে তো আর কথাই নেই।আয়ুশ,,তুই আর ছায়া গিয়ে বাসর ঘর সাজানোর জন্য যা যা লাগে সব কিনে নিয়ে আয়।আর শুন সব কিছু ছায়ার পছন্দ করবে টাকা তুই দিবি।তোর পছন্দের একটা জিনিসও কিন্তু আমার ভালো লাগে যদি তোর পছন্দের জিনিস এসেছিস তো খবর আছে।আমি ছায়াকে বলে দিয়েছি তুই ওকে ওর বাড়ির মোর থাকে পিক করবি।(আদি বসের মত অর্ডার দিয়ে)

এতো যখন আমায় নিয়ে সমস্যা তাহলে তুমি আর ছায়া গেলেই তো পারো।(আয়ুশ ঠোঁট ফুলিয়ে)

আমি যেতাম।কিন্তু আমাকে এইটার(আভি)দিকে নজর রাখতে হবে।(আদি সন্দেহর দৃষ্টিতে)

আমি কি করলাম?(আভি অবাক হয়ে)

তুই যদি বাসর রাত থেকে পালানোর চেষ্টা করিস।এই জন্য তোর উপর নজর রাখা হবে।(আদি সোফায় বসে)

এইটা তো আয়ুশও রাখতে পারে।(আভি)

তোদের ভাইয়ের উপর আমার ভরসা নেই।(আদি)

বাবা(আভি আর আয়ুশ অসহায়ের মতো)

যাবি তুই?(আদি)

যাচ্ছি।
বলেই আয়ুশ চলে গেলো।

অন্যদিকে ওদের বাবা ছেলের ফাইট দেখে আমার বাড়ির কথা মনে পড়ে গেলো।আমার আর বাবার তো এমনই ঝগড়া হতো।ছায়া আর মা আমাদের সামলাত।কোথায় হারিয়ে গেল আমার সেই দিনগুলো।কেনো হারিয়ে গেলো?হারানোটাকি খুব দরকার ছিলো?কোনো দিন কি আর ফিরে পাবো সেই মুহূর্ত গুলো?কোনো দিন কি আবার আমি আর বাবা এমন ঝগড়া করতে পারবো?বাবা তোমাকে খুব মিস করছি(আমি মনে মনে)


চলবে,,,^_