জলফড়িং পর্ব-০৫

0
231

#জলফড়িং
লেখনীতেঃ #রিধিমা_জান্নাত_রূপা
পর্বঃ ০৫

.
বিরবিরিয়ে উঠলো দিয়া। কথাটা ঠিক শুনতে পেল না দিহান। শুনতে না পেয়ে বোনকে জিজ্ঞেস করলো,
“কিছু বললি বুড়ি?”

“না ভাইয়া, তেমন কিছু না। দিশা কিছু বলেছে?”

“তেমন কিছু না, বললো তোর সাথে কথা বলে নিবে।”

‘হু!’ বলে চুপ করে যায় দিয়া, প্রতিত্তোরে কিছু বলতে পারে না। দিশা ফোন দিলে কি-ই বা বলবে সে? তাদের মাঝে তো অদৃশ্য এক দেওয়াল গড়ে উঠেছে, সময়ের ব্যাবধানে তা যেন বিশাল ভাবতেই আকৃতির ধারণ করছে।
কথায় আছে না বিয়ের পর মেয়েরা পরিবর্তন হয়, পাল্টে যায় সম্পর্ক। দিশার ক্ষেত্রেও ঠিক তাই ঘটেছে, তাদের বন্ধুত্বের সম্পর্কে প্রভাব ফেলেছে। যতটুকু বাকি ছিলো সেটাও ইফাজের সাথে বিচ্ছেদের পর যেন মৃ’ত হয়ে গেছে।

বোনকে চুপ থাকতে দেখে দিহান বলতে লাগলো,
“আদিবের সাথে তো এই প্রথম দেখা। ছেলেটা সত্যিই অনেক ভালো, দিশাকে অনেক ভালোও বাসে। কিন্তু ওই ছেলেটার কথা ভাবতেই ভীষণ খারাপ লাগে, চার বছরের সম্পর্ককে ভুলে যাওয়া সত্যি’ই অনেক কষ্টসাধ্য।”

একটু থামলো দিহান। জোরে নিশ্বাস টেনে আবারও বলতে লাগলো,
“দেখ না, মিথিলার সাথে আমার কত বছরের সম্পর্ক। বিয়ের আগে চাকরি ছিলো না বলে মানছিলো না ওর বাবা, ওকে হারিয়ে পেলার ভয়েই তো আমার বুক কাঁপত।”

সুপ্ত নিশ্বাস ছাড়লো দিহান, বোনের দিকে তাকালো। ভালোবাসা হারানোর যন্ত্রণা উপলব্ধি করতে পারে দিহান। যদিও সে ভালোবাসার মানুষকে পেয়েছে, হারিয়ে ফেলার আগ মুহুর্তে নিজের করে নিয়েছে। সকল ব্যার্থ প্রেমিকের জন্য খারাপ লাগে দিহানের, মায়া হয়। দিশার সেই প্রাক্তন প্রেমিকের জন্যও ঠিক একই মায়া কাজ করে। দিহান আবারও বলে উঠলো,
“চার বছর তো কম সময় নয়, সবটা ভুলে নতুনভাবে জীবন শুরু করুক ছেলেটা। দেখিস, ছেলেটা দিশার চেয়েও বেস্ট কাউকে পাবে জীবনে।”

“ভাইয়া!”

নিজেকে সামলে নিলো দিহান। বোনের মাথায় হাত রেখে, “এসব নিয়ে ভাবতে হবে না তোর, খেতে আয়।”

বলেই ঘর ছেড়ে বেড়িয়ে যাবার উদ্যোগ নিলো দিহান। এবার আর চুপ রইলো না দিয়া, চকিতেই বলে উঠলো,
“ইফাজ’ই সেই ছেলে ভাইয়া।”

দাঁড়িয়ে গেল দিহান। ঠিক বুঝতে পারলো না যেন বোনের কথা। বলে উঠলো,
“ইফাজ মানে? কার কথা বলছিস?”

“ইমতিয়াজ আহমেদ ইফাজ। যার সাথে আমার বিয়ে হবার কথা।”

“ইমতিয়াজ? ইমতিয়াজ দিশার সেই প্রাক্তন প্রেমিক ছিলো? কি বলছিস তুমি এসব, ইমতিয়াজ কেন করবে এমনটা?”

অবাকের ন্যায় জিজ্ঞেস করলো দিহান। সুপ্ত নিশ্বাস ছাড়লো দিয়া। বলে উঠলো,
“জানি না ভাইয়া ইফাজ কেন এমন করছে, তবে ইচ্ছে করেই করছে সবটা। উনি আমাকেই দিয়ার সাথে বিচ্ছেদের কারণ ভাবে।”

“তোকে ভাবে মানেএ?”

“হ্যাঁ! ভাইয়া। দিশার বিয়ের কথাটা যদি ওনাকে জানাতাম তবেই না কি দিশাকে হারাতো না। আমাকেই ব্লেম করে উনি।”

“কিন্তু তুই তো এর কিছুই জানতিস না। দিশার বিয়েটাও তো আচমকা হলো।”

“ইফাজ তো সেটা বিশ্বাস করতে চাইছে না ভাইয়া। ওনার ধারণা আমিই এর পিছনে আছি। মাসখানিক আগে যখন হঠাৎ করেই আমাকে প্রায় উঠিয়েই নিয়ে গেল, তখন…. ”

“উঠিয়ে নিয়ে গেল মানেএএ?”

বেশ উত্তেজিত কণ্ঠেই জিজ্ঞেস করলো দিহান, সহসায় চুপ করে গেল দিয়া। ভাবলো এই টপিকটা হাইড করে গেলেও পারতো। কিন্তু না, ভাইকে আজকে সবটা জানাতেই হবে। দিহানের হাত ধরে বিছানায় বসতে বললো দিয়া, একটু সময় নিয়ে বলে উঠলো,
“দিশার বিয়ের পর সপ্তাহ খানিক পাগলামো চলে ইফাজের। অনেক বোঝায় ওনাকে, কিন্তু কিছুতেই যেন কাজ হয় নি। হোস্টেলের সামনে এসে দাঁড়িয়ে থাকতো, দিশার নাগাল না পেয়ে আমাকেই রাস্তায় বিরক্ত করতো। বোঝাতাম ওনাকে, কিন্তু কখনোই শুনে নি। তারপর হঠাৎই শান্ত হয়ে যায়, দেখা মিলে না তার।”

এতটুকু বলে সামান্য থামলো দিয়া। সেকেন্ডের মতো সময় নিয়ে আবারও বলতে লাগলো,
“মাসখানিক আগে তুই রেস্টুরেন্টে যেতে বলেছিলি ভাবীকে নিয়ে তুই আসছিস বলে। সেদিন রেস্টুরেন্টে গিয়ে হঠাৎই ইফাজের সাথে দেখা। আমাকে দেখেই যেন পুরানো রাগ নতুনভাবে ধরা দিলো, এক প্রকার জোর করেই নিয়ে গেল সেখান থেকে। তোকে কল দিতেই মোবাইল ছিনিয়ে নিয়ে সুইচঅফ করে দিলো। আবারও বোঝালাম ওনাকে, নতুনভাবে সব ভুলে জীবন শুরু করতে বললাম। সবটা শান্ত ও স্থির হয়ে শুনলো, কিন্তু বুঝলো না। খুব তারাতাড়িই আমাকে সারপ্রাইজ দিতে চায় সেটা বলেই চলে গেল।”

থেমে গেল দিয়া, তাকালো ভাইয়ের দিকে। রেগে গেছে দিহান, বিবর্ষ বর্ণের চোখ দুটো যেন তাই বলছে দিয়াকে। হ্যাঁ! রেগে গেছে দিহান, বোনকে জোর করে নিয়ে যাবার কথাতেই ইফাজের প্রতি রাগ দিহান। আদরের বোনকে একটা টোকাও দিতে রাজি নয় দিহান, হোক না সেটা অন্য কারোর থেকে। ভারী কণ্ঠে দিয়াকে সুধালো,
“আমাকে আগে জানাস নি কেন?”

“এনগেজমেন্টের দিনে জানতে পেরেছি ওটা ইফাজ। ফোনে কথা বলেও বুঝতে পারি নি, তাছাড়া ওনার ইমতিয়াজ নামটাও জানতাম না আমি। সেদিন এই কথা বলতেই গিয়েছিলাম তোমার কাছে, কিন্তু ইফাজ….”

সুপ্ত নিশ্বাস ছাড়লো দিয়া। একটু থেমে মাথা নিচু করে ফেললো। দিহান বললো,
“এখন? কি চাইছিস তুই? বিয়েটা করবি না, তাই তো? আমিও চাই না ইফাজের সাথে তোর বিয়েটা হোক। কালকেই ওর সাথে দেখা করছি আমি। ওর সাহস হয় কি করে আমার বোনের সাথে এমন করার? কি চাইছেটা কি ও?”

“চাই না ভাইয়া, ওনাকে বিয়ে করতে চাই না আমি। আমার প্রতি ওনার এই অভিযোগ, ভুল বোঝাবুঝি নিয়ে নিয়ে কখনোই ওনার সাথে থাকতে পারবো না আমি। প্লিজ! ভাইয়া, তুই কিছু কর।”

“তোকে এসব নিয়ে ভাবতে হবে না বুড়ি, আমি দেখছি। কালকেই ইফাজের সাথে কথা বলবো আমি। খেতে আয় এখন।”

“তুই যা, আসছি একটু পর।”

বাঁধা দিলো না দিহান, আর না কিছু বলতে চাইলো। তাড়াতাড়ি আসতে বলে বেড়িয়ে গেল ঘর ছেড়ে। দিহান যেতেই চোখ দুটো ঝাপসা হয়ে উঠলো দিয়া। জানে না কেন, কিন্তু হঠাৎই এক অদ্ভুত শুন্যতা অনুভব করলো। এই শূন্যতার কারণ কি ইফাজ? নাআআ! তার ইফাজ হয়তেই পারে না।
মনকে কড়া শাসন করলো দিয়া, কিন্তু অবুঝ মনটা যেন কিছুতেই মানলো না। নিজের মনকে সায় না দিলেও বলতে বাধ্য দিয়া, ভালো লাগে ইফাজ কে। ইফজের অদ্ভুত সেই চাহনিতে কিছু একটা হয় দিয়ার, সেই প্রথম সাক্ষাৎয়ের মতো।

.
অনলাইনে দিশা ও ইফাজের প্রেমটা পাকাপোক্ত হলে প্রায় আট মাসের মাথায় দেখা করে তারা। তাদের কলেজের কাছেই একটা রেস্টুরেন্টে আসে ইফাজ। প্রথম সাক্ষাৎ একা করবে না বলে দিয়াকেও নিয়ে যায় দিশা। তারা যেতেই অদ্ভুত ভাবে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে ইফাজ। উঁহু! দিশার দিকে নয়, দিয়ার দিকে। তাতেই যেন অপ্রস্তুত হয়ে পরে দিয়া, মাথা নিচু করে ফেলে। কিন্তু ইফাজের দৃষ্টি হতে রক্ষা পায় না।
ইফাজকে ভালো লাগে দিয়ার, কিন্তু বান্ধবীর বয়ফ্রেন্ডের ভাবনাতেই সেই ভালো লাগাটাও চাপা দিয়ে দেয়। মনে মনে দোয়া করে, দিশা যেন এই ছেলেটার প্রতি সিরিয়াস হয়, তাদের ভালোবাসার যেন পূর্ণতা পায়। দিয়ার দোয়া লেগেও গিয়েছিলো যেন, টিকে গিয়েছিলো চার বছরের সম্পর্ক।

চার বছর পর হঠাৎই ভাঙন ধরে ইফাজ ও দিয়ার সম্পর্কের মাঝে। নানান কথা বলে ইফাজ বিয়ের জন্য চাপ দিতে থাকে দিশাকে, অভিযোগ করে অন্য সম্পর্কে জড়িয়েছে। এসব দিয়াকে বলে মুখ ভার করে থাকতো দিশা। দিয়া সত্যিটা জানতে চাইলে তা সুক্ষভাবে এড়িয়ে যেত। এরপর আর কথা বাড়াতে পারতো না।
তবে সপ্তাহ খানিক পর ঠিকই সত্যিটা জানতে পারলো দিশার দুলাভাইয়ের বন্ধুর সাথে প্রায়শই কথা হয় তার। যে কেউ নির্ধিদায় বলতে পারবে তাদের প্রণয়ের সম্পর্ক আছে। চুপ থাকতে পারে না দিয়া, বলেই ফেলে দিশাকে। এতে রাগারাগি করে দিশা, ইফাজকে গালমন্দ করে দিয়ার সাথেও কথা বলা বন্ধ করে দেয়, দূরত্ব সৃষ্টি হয় তাদের বন্ধুত্বের মাঝে। তবে কিছুদিন পর দিয়া জানতে পারে ইফাজের সাথে দিশার সবটা ঠিক হয়ে গেছে। দিয়ার সাথেও সবটা ঠিক করে নেয় দিশা, যদিও আগের ন্যায় বার্তাআলাপ হয় না।

কেটে যায় আরও মাস খানিক। রাতের প্রায় এগারোটায় হঠাৎই দিশার কল আসে দিয়ার কাছে। খানিকটা অবাক হয় দিয়া, নিজেকে সামলে রিসিভ করে কথা বলতে থাকে। কথা বলার এক পর্যায়ে দিশা বলে একটা কথা আছে। দিয়া বলে,
“আমাকে কিছু বলতে তোর কি জিজ্ঞেস করতে হবে? বলে ফেল।”

“সামনে শুক্রবারে আমার বিয়ে দিয়া।”

অবাক হয় দিয়া, নিজেকে সামনে বলে, “এত রাতে ফোন দিয়ে মজা নিস আমার? এই বলতেই ফোন দিছিস? সামনের শুক্রবার হলে মাঝে আর দু’টো দিন। আমাকে বোকা পেয়েছিস?”

“সত্যি বলছি। হঠাৎ করেই সবটা হয়ে গেছে। মাত্র কিছু কেনাকাটা শেষ করে বাসায় আসলাম, কাল সকালে আবার ছুটতে হবে।”

“কি বলছিস এসব? মাথা ঠিক আছে? ছেলে কে….”

বলতেই ইফাজের কথা ভেবে চুপ করে যায় দিয়া। মুহুর্তেই চোখ মুখে এক উচ্ছ্বাস দেখা দেয়। বলে উঠে, “সত্যি বলছিস তো? বিয়েটা হচ্ছে তোদের? ইফাজ ভাইয়া এত তাড়াতাড়ি সবটা মেনেজ করে ফেললো?”

“ছেলেটা ইফাজ নয় দিয়া।”

“মানেএ?”

মুখ ফুটে বেড়িয়ে এলো দিয়ার। যেমন উচ্ছ্বাসে মেয়ে উঠেছিলো ঠিক তেমনি নিভে গেল। দিশা বলে উঠলো,
“ভাইয়ার বন্ধু ও।”

“যার সাথে কথা বলতি সে ছেলেটা?”

“উহুঁ! ওর নাম আদিব। ভাইয়ার বন্ধু, দেশের বাইরে থাকতো। মাস খানিক আগেই দেশে এসেছে। বাসায় এসেছিলো, আমাকে দেখেই….”

“পছন্দ করেছে, তাই তো।”

“হু! আদিব অনেক ভালো ছেলে দিয়া….”

“আর ইফাজ ভাইয়া? উনি কি জানে তোর বিয়ের কথা।”

“পাগল তুই? ওকে ঘুণাক্ষরেও জানানো যাবে না। তুইও ওকে বলবি না? কথা দে আমাকে।”

দিশার কথায় সামান্য রেখে যায় দিয়া। বলে উঠে,
“আর তুই মনে করলি জানতেও পারবে না? এমন কেন করছিস ওবার সাথে?”

“হ্যাঁ! জানবে না। তোরা না জানালে ওর জানার প্রশ্নই আসে না। আর বিয়েটা তো বড় করে হবে না। একবার কবুল বলে আদিবের হাত ধরে যেতে পারলেই ইফাজ কিছু করতে পারবে না।”

সুপ্ত নিশ্বাস ছাড়লো দিয়া, কিছু বলতে চাইলো। দিশা থামিয়ে দিলো তাকে, বলতে লাগলো,
“আত্মীয়স্বজন তেমন কেউ থাকবে না। আমার কাউকে লাগবেও না, তোরা ক’জন থাকলেই যথেষ্ট।
হলুদের দিন সকালেই আসবি কিন্তু। তোকেই প্রথমে জানালাম, ওদেরও জানাচ্ছি।”

“তুই কি সত্যিই বিয়েটা….”

“হ্যাঁ! আসার পর সবটা জানাবো। ইফাজ যেন কখনোই আমার বিয়ের কথা জানতে না পারে। ওর সাথে আমার ঠিক যায় না, কোন দুঃখে যে চার বছর সম্পর্কে ছিলাম? আমার জন্য আদিব’ই ঠিক আছে দিয়া।”

.
.
চলবে…..

রি-চেক দেওয়া হয় নি। ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।