জলফড়িং পর্ব-০৭

0
313

#জলফড়িং
#রোজা_ইসলাম
#পার্ট ৭

ভোরসন্ধ্যায় আকাশে থালার মতো রুপালী চাঁদ উঠেছে একটু আগেই মাগরিবের আজানের ধ্বনিতে মুখরিত হয়েছে পরিবেশ। অম্বর পরিশ্রান্ত বলে চাঁদ মামা আকাশ জুড়ে তার দ্যুতি ছড়াতে ব্যাস্ত! একতলা বাড়িটির ড্রইংরুমের বড়সড় জানালা দিয়ে চন্দ্রসুধা চুইয়ে চুইয়ে পরছে যেন। ইরা জানালা গড়িয়ে একনজরে চাঁদ’টি দেখে নিলো।

ওর থার্ড ইয়ারের ফাইনাল এক্সামের ইতি ঘটেছে। ইদানীং বাসাতেই অলস সময় কাটে। তবে মনপিঞ্জরে বয়ে চলে তীব্র ঝড়! ড্রইংরুমে টিভি ছেড়ে ইরা উন্মনা হয়ে বসে ছিলো অথচ দৃষ্টি স্থবির শূন্যে! হঠাৎ অনুভূত হলো ক্ষুধায় পেট ঈষৎ জ্বালা করছে। প্রায় ছয় সাত’মাস হতে চলল ইরা ঠিক ঠাক খেতে পারেনা। ওর পছন্দের সসেজ পিৎজা, পছন্দের চিকেন ফ্রাই, থাই স্যুপ সম্মুখে পরে থাকলেও খেতে ইচ্ছে করে না। এখন আর সন্ধ্যে হলেই আজ এই নাস্তা, কাল ঐ নাস্তার আবদার বসে না ড্রইংরুম জুড়ে। কেমন যেন খাওয়া দাওয়া, ঘুম, আড্ডা, বন্ধুমহল, পরিবার-পরিজন, প্রিয়জন সব কিছু থেকেই মন উঠে গেছে। মন, মস্তিষ্কে শুধু একজনেরি বাস!

ইরা পেটের যন্ত্রণা আর সহ্য করতে পারলো না। অনেকটাই শুকিয়ে এবং দূর্বল হয়ে গেছে ও। শ্যামবর্ণ মুখে আগের সেই দ্যুতি যেন ম্লান হয়ে গিয়েছে। ঘন সিল্কি চুলে রুক্ষতার ছোঁয়া। নিজের প্রতি ও চরম অযত্নশীল আচরণ করছে যা ধীরে ধীরে প্রকাশিত হচ্ছে। আয়নায় তাকালে সহজেই সব চক্ষুশূল হয়। তবে এসবে বিশেষ ভাবনা চিন্তা নেই ওর। ধীরস্থির নরম পায়ে কিচেনে এলো ইরা। কিচেনে আপাদমস্তক রাতের খানা প্রিপেইড হচ্ছে। নীলা বেগম কাজে ব্যাস্ত!

মীতিও ওর নানুর বাড়ি বেড়াতে গিয়েছে! মীতির ও কিছু দিন ছুটি আছে সুযোগ বুঝে দৌড় দিয়েছে মা’কে নিয়ে। ফলস্বরূপ বড় মা এবং মীতির অনুপস্থিতে বাড়িটা নিস্তব্ধ হয়ে আছে। নাহলে ওর কাজটা মীতিই করতো কিছুনা কিছু বানাতে এই মুহূর্তে কিচেনে হৈচৈ করতো, ড্রইংরুম মাতিয়ে রাখতো।

বাড়িতে এখন শুধু ইরা ওর মা-বাবা এবং বড় বাবা এবং আদিই আছে। যদিও ওরা এখনও বাড়ি ফিরেনি। আজ ওদের কাজের মহিলাটাও আসেনি। ওর মা একাই কাজ করছে কিচেন জুড়ে এবং উনাকে একা কাজে ব্যাস্ত দেখে। মস্তিষ্কের নিউরনে অনুরণন তোলে কিছু বাক্য। সাহসা বুকটা ধ্বক করে উঠে। তখনও অভ্যন্তরে গর্জে উঠে একটি বাক্য, ‘তুমি একটিবার চেষ্টাও করোনি ইরা।’ ভীত ইরা নিজেকে ধাতস্থ করে। না ও চেষ্টা করবে! নরম পায়ে মায়ের পাশে গিয়ে দাঁড়ায় ও। নীলা একবার মেয়ের দিকে তাকিয়ে। নরম গলায় শুধালো,

—” কিছু খাবি? ফ্রিজে রসমলাই আছে দেই একটু? ”

ইরা ম্লানমুখে মাথা দুলালো। নীলা রান্নার ফাঁকে দ্রুত পদে হেঁটে ফ্রিজ থেকে রসমলাইর বক্স ইরার হাতে তুলে দিলেন। ইরা বক্স খুলে এক টুকরো মিষ্টি মুখে দিলো। আশ্চর্যজনক ভাবে মিষ্টির পরিবর্তে তিতকুটে লাগলো বড্ড। নিজের সাথে যুদ্ধ করতে করতে ক্লান্ত প্ররিশ্রান্ত ইরা ঠাস করে হাত থেকে চামচ নিচে ফেলে দেয়! হঠাৎ করেই শুষ্ক গলায় অস্ফুটস্বরে বলল,

—” তুমি বাবা’কে বলেছো? আমি কিন্তু আমার কথা রেখেছি মা পড়াশোনায় সম্পূর্ণ মনোযোগ দিয়েছি! এবার তুমি তোমার কথাটা রাখো?”

এক নিশ্বাসে রুদ্ধশ্বাসে কথা গুলো বলে থামলো ইরা। ভীত বক্ষপিঞ্জরের লাফানো তোড়ে নিজেও কেঁপে কেঁপে উঠছে ও। নীলা প্রথমে হতভম্ব, বিমূঢ় হয়ে ছিলেন ইরাকে এভাবে এই বিষয়ে কথা বলতে দেখে। পরমুহূর্তেই উনার মুখভঙ্গী ক্ষিপ্র হয়ে উঠলো। খামটি মেরে বলল,

—” বড্ড সাহস হয়ে গিয়েছে তোর? আমাকে প্রশ্ন করছিস তুই? জানিস না তুই একবার এসব কথা তোর বাবার কানে গেলে কী হবে? দেখ ভালো ভাবে বলছি ছেলেটাকে ভুলে যা। ছয় মাস যেহেতু যোগাযোগ বিহীন থাকতে পেরেছিস। বাকী জীবনেও পারবি৷ এগুলো খনিকের আবেগ যা মানুষকে ধ্বংস করে দেয়। ”

নীলা বেগমের মুখনিঃসৃত বাক্যগুলো অত্যন্ত তিক্ত, বিষাক্ত লাগে ইরার। মুহূর্তেই ধৈর্যের বাদে, সৃষ্টি হয় ভাঙ্গন! এতবড় ধোকা? সেদিন রুমে কান্নাকাটির পর যখন আজমল খাঁন বললেন ইরাকে একা ছেড়ে দিতে সবাই চলে গেলেও নীলা বেগম উনি পারেননি মায়ের মন বলে কথা! সবাই চলে যেতেই মেয়েকে পুনরায় ডাকেন উনি গলায় আদ্রতা মিশিয়ে। ইরা তখন দরজা খুলেও দেয়। মা’কে ধরে মায়ের বুকে ভগ্ন হৃদয়ে অশ্রুবিসর্জন দেয়, ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদে ও, কিন্তু মুখ ফুঁটে কিছু বলতে পারে না। নীলা বেগম মেয়েকে তখন ভরসা দেয় কী হয়েছে, উনাকে খুলে বলতে। বারবার প্রশ্ন করে নীলা বেগম। ভরসা, স্নেহ সর্বত্র দিয়ে উনি বুঝান মেয়েকে, উনাকে বললেই উনি সব ঠিক করে দিবেন। মায়ের আদুরে স্পর্শে, ভরসাময় বাক্যে নিরুপায় ইরা একটুকরো আশার দীপ্ত খুজে পায়। বিগলিত হয় ও, কাঁদতে কাঁদতে একটু সাহস নিয়ে মাকে সম্পূর্ণ খুলে বলেই ফেলে ইরা।

সব শুনে নীলা বেগম মনে মনে ভীষণ অসন্তোষ হলেও। বিচক্ষণতার সঙ্গে তিনি ব্যাপারটা সামলে নেন। উনি বলেন ইরাকে আপাদমস্তক এসব ভাবনা দূরে ঠেলে পড়াশোনায় মনোযোগী হতে। রাদ যদি ওকে সত্যি ভালোবাসে অবশ্যই ইরার অপেক্ষা করবে। এর মধ্যে ইরার থার্ড ইয়ারের ফাইনাল এক্সামের পর তিনি আজিম খানের সঙ্গে কথা বলবেন। ইরা-রাদের সম্পর্কের বিষয়ে। ইরা মায়ের কথায় ভরসা পেয়ে উৎকাণ্ঠিত হয়ে পরে। ওর মা যে এতটা সহজেই মেনে নিবে ওদের কস্মিনকালেও ভাবেনি ও। মায়ের সামনেই নীলা বেগমের কথা রাদকে জানাতে তৎপর হয় ও! কিন্তু বাদ সাধেন নীলা বেগম, ওকে থামিয়ে দিয়ে বলেন। ওর বাবার সাথে এই বিষয়ে কথা বলার আগ পর্যন্ত রাদের সাথে যোগাযোগ করার প্রয়োজন নেই। এতে রাদের ভালোবাসাও ইরা বুঝতে পারবে। সে কতটুকু ভালোবাসে ইরাকে অপেক্ষা করতে পারে নাকি ইরার জন্যে। ইরার যদিও রাদের ভালোবাসায় কোনও প্রশ্ন নেই তবু নিরুপায় ইরা আশার একমাত্র ছলকানি পেয়ে মায়ের কথা বাধ্য মেয়ের মতো মেনে নেয়। অতঃপর পর’দিন থেকেই ইরা মায়ের কথা মতো পড়াশোনায় সম্পূর্ণ মনোযোগ দিয়েছে। এবং ওর এক্সাম ভীষণ ভালো হয়েছে।

কিন্তু আজ এক মাত্র সেই আশার দীপ্ত ওর মা এভাবে নিভিয়ে দিবে। ওদের ভালোবাসা ধৈর্য অপেক্ষা’কে এভাবে কটাক্ষ বাণ শুনাবে কস্মিনকালেও ভাবেনি। ওর মা ওকে ধোকা দিবে, ভয়ংকর ভাবে ওর হৃদয়ের এক পলশা বৃষ্টিতে খড়া সৃষ্টি করবে, ওর মন কাঁচের পাত্রের নেয় ভেঙ্গে গুড়িয়ে দিবে কখনও ভাবেনি ইরা। এই মায়ের স্নেহময় স্পর্শে, ভরসা, বিশ্বাসময় বাক্যেই তো ইরা এতটাদিন আশা বুকে বেঁধে বেঁচেছে। আর আজ এভাবে কিছু ধাঁরালো বাক্য মুখনিঃসৃত করে ওকে এভাবে ঠোকাতে পারলো?

আচমকা ক্রোধে জ্বলে উঠে অভ্যন্তর! মায়ের দিকে তীব্র ঘৃণা নিয়ে তাকিয়ে। আক্রোশে ফেঁটে পরে ইরা। রুষ্ট গলায় চেঁচিয়ে বলে,

—” তুমি এটা ভালো করোনি মা। আমাকে ঠকিয়েছো তুমি! আমি এটা মেনে নিবো না। ”

মেয়ের কথায় ঘাবড়ে যান নীলা বেগম। পরপরই খলবলিয়ে উঠেন,

—” কী করবি তুই? পালিয়ে যাবি ঐ ছেলের হাত ধরে? হ্যাঁ, এটাই তো করবি! আমাদের মান-সম্মান ভাইরের মতো তুইও ধূলিসাৎ করে তবেই ক্ষ্যান্ত হবি তাই তো! মেরে ফেলবি আমাদের।”

বলেই নীলা বেগম আর্তনাদ করে ফুপিয়ে কেঁদে উঠেন। অভ্যন্তরের সমস্ত ক্রোধ, ক্ষোভ, ভগ্ন হৃদয়ে আক্রোশে ভরা দীপ্তটুকু মুহূর্তে নিভে গেলো ইরার। এই মা-বাবাকে কষ্ট দিবে না বলেই তো ইরা আজ এই অসহ্য যন্ত্রণা বিনাবাক্যে মেনে নিচ্ছে, সাথে রাদ’কেও একি যন্ত্রনায় আসক্ত করে রেখেছে। তবে ইরা যে রাদ ছাড়া কাউকে নিজের জীবন ভাবতেও পারে না। ইরা হয়তো রাদকে ছাড়া মরে যাবে না। কেউ কাউকে ছাড়া মরে যায় না। কিন্তু এভাবে বেঁচে থাকার চেয়ে মৃত্যু শ্রেয়! আচ্ছা মা-বাবা কেন এটা বুঝে না। ওদের কাছে ওদের সম্মান বড়? না মেয়ের ভালো থাকা, মানসিক শান্তি এগুলো বড়!

ইরা কিছু বলতে গিয়েও বলল না। নৈঃশব্দ্যে কিচেন ত্যাগ করে নরম পায়ে রুমে ঢুকে গেলো। একটু আগের পেটে জ্বালা ধরানো খিঁদে ম্যাজিকের মতো পালিয়ে গেছে ওর। নীলা বেগম সেদিকে তাকিয়ে রইলো গাঢ় চক্ষে। মেয়ের মতিগতি ভালো না। আজকের পর, যা করার সেটা দ্রুতই করতে হবে। একবার বিয়ে হয়ে গেলে বরের ভালোবাসায় এসব ক্ষনিকের আবেগ সব ভুলে যাবে। আর যাইহোক ছেলের মতো মেয়েকেও উনি কিছুতেই হারাতে পারবেন না। ওর বাবা-চাচারা এই সম্পর্ক কিছুতেই মেনে নিবে না।
______________

রাত প্রায় ১০টা বাজে, গোল ডাইনিং টেবিলে সবাই একসাথে খেতে বসেছে। অন্যদিন ইরা লোকদেখানোর জন্যেও একটু কথাবার্তা বলে সবার সাথে। কিন্তু আজ ওর মুখ সম্পূর্ণ ফ্যাকাসে শুকনো হয়ে আছে। নৈঃশব্দ্যে খাবার খাচ্ছে যদিও একটা ছোট্ট পাখিও এর থেকে বেশি খায়। আদি ওর খাবার দিকে তাকিয়ে। সবার সম্মুখেই সহজ গলায় প্রশ্ন করলো,

—” কিরে এভাবে খাচ্ছিস কেন? ভালো করে সবজি নিয়ে খা! এভাবে খেলে রাতে খারাপ লাগবে তো!”

ইরা ছোট্ট করে প্রতুক্তি করলো,

—” হুম। ”

হুম বললেও অন্যকোনও পদে হাত ছুয়ালো না মেয়েটা। প্লেটে মা’য়ের দেওয়া খাবার টুকু নৈশব্দে খেয়ে উঠে রুমে চলে গেলো নিরবে। আদি ওর ব্যাবহারে কিছুটা ভারাক্রান্ত হয়ে পরলো। আজ ইরার ব্যাবহার ভাবভঙ্গি একদম ভিন্ন। শ্যাম মুখশ্রী জুড়ে একরাশ বিষণ্ণতা। নীলা বেগম নিজেও এসব লক্ষ্ম করলেন তবে উনার কিছু করার নেই। আদি মাথা ঘুরিয়ে পাশে বসে থাকা নীলা বেগমের দিকে তাকাতেই উনি মুখ লুকিয়ে খেতে মনোযোগী হলেন। আজমল খাঁন আজিম খান দুই ভাই কথা বলতে বলতে নৈশভোজে ভীষণ ব্যাস্ত।

রাতে আজিম খান খানা শেষে ভাইয়ের সাথে রাতের সংবাদ দেখে আলাপ-আলোচনা শেষ করে রুমে এলেন ১২টায়। অন্যদিন এই সময়ের মাঝে নীলা বেগম ঘুমিয়ে পড়লেও আজ সে দিব্বি সজাগ বসে স্বামীর অপেক্ষায়। আজিম খান এক নিমিষেই বুঝে ফেললেন নীলা বেগম কিছু বলতে চান। হলো ও তাই উনি পাশে বসতেই নীলা বেগম ধীরস্থির, নরম গলায় বলে উঠলেন,

—” বলছিলাম কী? আদি ইরার বিয়ের কথাটা কী ভাইয়ের কাছে বলেছিলে? ”

আজিম খান মুখভঙ্গি প্রকাশে বোঝা গেলো উনার হঠাৎই কিছু মনে পরেছে। অর্থাৎ খোশমেজাজে প্রতুক্তি করলেন,

—” আরে হ্যাঁ, তোমাকে বলতেই ভুলে গেছি! দু’দিন আগেই উনি নিজেই বললেন ব্যাপারটা। তবে ভাই চান না এক্ষুণি ইরা এই বিয়ে সম্পর্কে জেনে পড়াশোনায় অমনোযোগী হয়ে পড়ুক। ইরার অনার্স শেষ হলেই। ধুমধাম করে ওদের বিয়ে হবে। ”

নীলা বেগম খালবলিয়ে রুষ্ট গলায় বললেন,

—” অনার্স শেষ করতে হবে না। দেখো ইরার বাবা ওর আচার-আচরণ মোটেও ভালো না। আমি চাই না আমাদের ছেলের মতো ভুল ও করুক। ইরা জেদি মেয়ে আদিকেই একটু ভয় পায়। তাই তো ভাইয়ের প্রস্তাব আমি সদরে গ্রহণ করেছি। এখন যতদ্রুত বিয়েটা সেরে ফেলা যায় ততটাই শান্তি আমি। ইরার অনার্স শেষে না হয় বড় করে অনুষ্ঠান হবে। তার আগেই আমি ওদের আকদ করে রাখতে চাই। তারপর আদি নিজেই ইরা’কে সামলে নিবে আর আমি নিশ্চিত হতে পারবো। তুমি প্লিজ সব ব্যাবস্থা করো। ”

স্ত্রীর কথায় আজিম খান চোয়াল শক্ত করে রাশভারী কণ্ঠে বলল,

—” কী বলতে চাইছো তুমি? কী সামলে নিবে আদি? ইরা কী কিছু করেছে? সত্যি করে বলো নীলা!”

ভীতসন্ত্রস্ত হলেন নীলা। কী বলে ফেললেন। ইরার রাদের সম্পর্কে কিছু জানতে দেওয়া যাবেনা কাউকে, এসব জানতে পারলে রক্ষে নেই। উনি অনুযোগের সুরে বললেন,

—” আমি কথার কথা বলছি কেন বুঝো না। মেয়ে, ছেলের মতো একটা ভুল করে বসলে তো কিছু করার থাকবে না। তাই আগে থেকেই সব সামলে নেওয়া ভালো না? বিয়ে যেহেতু হবেই দ্রুতই হওয়া ভালো!”

আজিম খান ধাতস্থ হলেন। বিয়ের কথা যেহেতু হয়েছে আজ হোক কাল ছেলে মেয়ে দু-জনেই জানতে পারবে। এতে ব্যাপারটা খারাপই হবে। বাড়িতে যুবতী মেয়ে ছেলে এক সাথে থাকবে। এর চেয়ে দ্রুতই বিয়ে হয়ে যাওয়াটা যুক্তিসম্মতই হবে ভেবে নিলেন তিনি। যদিও আদি ইরা দুজন দুজনকে ভাই বোনের দৃষ্টিতেই দেখেন এই বিয়ে সম্পর্কে জেনে তারা কেমন ভাবে নিবে তাও তো জানতে হবে। যদিও ভরসা আছে বড়দের কথা ওরা ফেলবে না। যাইহোক তারা তো আর ওদের খারাপ চায়না। বাড়ির মেয়ে বাড়িতেই রাখতে চান দুই-ভাই। ভেবেই স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে স্ত্রীর সিদ্ধান্তে সম্মতি প্রকাশ করলেন। নীলা বেগম স্বস্তির নিশ্বাস ফেললেন তাতে! ইরাকে ভুলিয়ে ভালিয়ে বিয়েটা সম্পূর্ণ করতে পারলেই হয় এবার। তবেই উনার আত্মা তৃপ্ত হবে। যাইহোক মেয়ে তার বাবা-মাকে ভীষণ ভালোবাসে।তপ্ত শ্বাস ফেলে শুয়ে পরেন নীলা। নিজ নিজ ভাবনায় ব্যাকুল, অথচ তারা জানেন না আগামীতে কী হতে চলেছে।
___________

আঁধারে আবৃত নিস্তব্ধ রুম! জানালা গড়িয়ে এক ফালি চন্দ্রসুধা তীর্যক হয়ে মেঝেতে পরে গড়াগড়ি খাচ্ছে। চন্দ্র দ্যুতিতে রুমের পরিবেশ কিঞ্চিৎ ঝলমল করছে অন্ধকারেও।

রোজকার মতো আজও রাদ ফোনের পর ফোন করেই যাচ্ছে ইরা’র যান্ত্রিক মুঠোফোনটিতে। ইরা ফোনের দিক নেত্রদ্বয় বিদ্ধ করে মুখে হাত চেপে কাঁদছে। চাপা কান্না যাকে বলে! এতদিন অপেক্ষা করতো মেয়েটা কবে রাদকে ফোন দিয়ে চমকে দিবে। বলবে ও ভীতু নয়! সেই ভাবনায় আজ ভাবনায় থেকে গেলো! আজ এইটুকু সাহসী হচ্ছে না এই ফোনটা ছুঁয়ে দেখার। কোন মুখে দাঁড়াবে ও রাদের সম্মুখে? কী করে ফোন ধরবে? রাদ কী ওকে আদৌ ক্ষমা করবে? হ্যাঁ করবে! ও জানে রাদ ক্ষমা করে দিবে ওকে, একটু মিষ্টি করে কথা বললেই গলে যাবে রাদের নরম, কোমল হৃদয়’টা! কিন্তু ইরা আর কতবার ঐ কোমল হৃদয়’টা খ’ণ্ডবিখ’ণ্ড করবে? এতগুলো দিন ও ছেলেটা ইগনোর করে গেলো অথচ রাদ লাগাতার ফোন দিয়েই গেলো। রাদ’কে মায়ের ধোকা দেওয়ার কথাও বলতে লজ্জা হচ্ছে ওর। আজ নিজেকে সান্ত্বনা টুকু দিতে পারছেনা ইরা।

তবে মুখোমুখি তো হতে হবে ওর রাদের সঙ্গে। এভাবে তো হয় না! আজ কোনও বাঁধাও নেই রাদের কল রিসিভ করতে। তবে মনপটে অনুশোচনা, দ্বিধাবোধ নিয়েই নাহয় ক্ষনিকের জন্যেই রাদের অস্থিরতা ব্যাকুলতা একটু সামলে নেওয়ার চেষ্টা করলো ও! এতটুকু করতেই পারে প্রিয় পুরুষ’টির জন্য।নিজের সঙ্গে যুদ্ধ করেই বাজতে থাকা ফোন রিসিভ করে কানে রাখলো। এবং সঙ্গে সঙ্গে ওপাশ থেকে বেসে আসে বড় বড় নিশ্বাসের শব্দ, যা তৎক্ষনাৎ হৃদয়স্থল নাড়িয়ে, অন্তস্তল কাঁপিয়ে দিলো ইরার। দ্বিগুণ উদ্বেগে ও নৈঃশব্দ্যে কেঁদে চলল শুধু। কেউ-ই টু শব্দ করতে সক্ষম হলো না সঙ্গে সঙ্গে! সম্পূর্ণ ১০মিনিট নিরবতায় কেঁটে গেলো প্রহর। সেই দীর্ঘ নিরবচ্ছিন্নতা ভগ্ন করে রাদ! শান্ত, পরিশ্রান্ত, গাঢ় গলায় ডেকে উঠে ওকে,

—” ইরা! ”

ইরা অস্ফুটস্বরে প্রতুক্তি করে,

—” হু!”

রাদ বিগলিত গলায় বলল,

—” আমার হৃদয়ের অস্থিরতা তুমি পর্যন্ত পৌছুতে পেরেছে কী অবশেষে?”

চলবে!