জলফড়িং পর্ব-২১ এবং শেষ পর্ব

0
527

#জলফড়িং
#Roja_islam
#part ২১ [প্রথম অংশ]

উত্তপ্ত ভোর দুপুরে রাদ ইরা’কে বাসায় পৌঁছে দিতে এলো। তবে বাসার থেকে অনেক’টা দূরে নেমে গিয়েছে ইরা। ওর চোখেমুখে এখনো রাজ্যের উৎফুল্লতা, আনন্দ। বাইক থেকে নেমে হাসি মুখে-ই রাদ’কে বিদায় জানাতে নরম গলায় বলল,

–” থ্যাংক ইউ স্যার! চিন্তিতপূর্ণ দিন’টা আনন্দ, ভালোবাসায় এভাবে বদলে দেওয়া’র জন্য। ”

প্রত্যুত্তরে রাদ সম্পূর্ণ ভিন্ন বাক্য উচ্চারণ করলো গাঢ় গলায়,

–” বিউটিফুল! ”

চকিতে ইরা অবাক গলায় শুধালো,

–” মানে? ”

–” টুডে ইউ লুকিং সো বিউটিফুল এন্ড প্রিটি, থ্যাংক ইউ ফর অল ইউর কাইন্ডনেস এন্ড লাভ। ”

ইরা চূড়ান্ত বিস্ময়কর চক্ষুদ্বয় মেলে স্থির চেয়ে রইলো রাদে’র দিকে। এ-ই কথাগুলো ওদের দেখাসাক্ষাৎ হওয়ার পর সর্বদা বলবে রাদ৷ তবে সেটা কখনো মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বলে না। বাসায় গিয়ে টেক্সট করে দিবে। ইরা ওর প্রাণপুরুষের জন্য সাজবে। ওর প্রাণপুরুষ সেটা লক্ষ্য করবে না সেটা কখনো হয়নি। কিন্তু এভাবে ঘোরলাগা নেশাক্ত চোখে চেয়ে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে অনুভূতি কখনো প্রকাশ করেনি রাদ। বরাবরই নিজেকে নিয়ন্ত্রণে পটুত্ব এবং শান্ত ছেলে’টা। আজ যে কী হলো পুরোটা দিন চমকপ্রদ করে গিয়েছে ইরা’কে রাদ। হয়তো ইরা যেখাবে সর্বদা ওর প্রাণপুরুষ’কে কল্পনা করতো। সেগুলোই পরিপূর্ণ করেছে একে একে আজ। এতটা কিভাবে বুঝে ওকে রাদ? নিজেও ভেবে পায়না মেয়ে’টা। কিঞ্চিৎ লজ্জিত আড়ষ্ঠ মুখে স্মিত হাসলো ইরা। আর্দ্র গলায় বলল,

–” এমন সারপ্রাইজ আমি প্রতিদিন চাই স্যার। একদিন সারপ্রাইজ দিয়ে পাগারপার হলে কিন্তু চলবে না। ”

রাদ ঝরা হাসে। ফিচলে গলায় শুধালো,

–” এতো প্রিটি স্টুডেন্ট’র চাওয়া পাওয়া অপূর্ণ রাখা বড্ড কঠিন ম্যাডাম। ”

ইরা খিলখিল করে হাসলো রাদে’র কথা বলার ভঙ্গি দেখে। বাঁক ফিরে সম্মুখে হাঁটতে হাঁটতে হাস্যোজ্জ্বল রসিকতাপূর্ণ চঞ্চল গলায় শুধালো,

–‘ স্যার এখন বিদায় নিন। হবু শ্বশুর দেখতে পেলে খবর করে ছাড়বে। ”

রাদ কিঞ্চিৎ গলা উঁচু করে দৃঢ় গলায় আওড়াল,

–” ভয় দেখাবেন না ম্যাডাম, আজ চলে যাচ্ছি। কাল শ্বশুরবাবা যখন মেয়ে’কে আমার হাতে তুলে দিবেন তখন এ-ই রাস্তা দিয়ে-ই আপনাকে তুলে নিয়ে যাবো। ”

ইরা’র বক্ষঃস্থলে তুমুল কম্পন শুরু হলো তুলে নিয়ে যাবো বাক্যটুকু শুনে। প্রাণপুরুষ’টা হঠাৎ যেন স্বপ্নের মতো লাগামহীন হ’য়ে গেলো। লজ্জায় ইরা’র কপোল টুকটুকে লাল বর্ণ ধারণ করলো। আবার কোথাও মনে হচ্ছে সত্যি ও কাল রাদে’র সঙ্গে চলে যাবে? হঠাৎ কোথাও একটু কষ্টও হচ্ছে। ভারাক্রান্ত অস্থির হৃদয় নিয়ে ইরা বাড়ি’তে পৌঁছে গেলো। ইরা’কে বাড়ির মোড়ে ঢুকে যেতে দেখে হাস্যোজ্জ্বল মুখে রাদ বাইক স্টার্ট দিলো, এ-ই তো শুরু হলো ব্যাস্ততা। এ-ই মুহূর্ত থেকে তরী’র বিয়ে পর্যন্ত ব্যাস্ততম একটা সময় কাঁটবে ওর। লং-টার্ম জার্নি অবশ্যই স্ট্রং থাকতে হবে কেননা আমাদের পরিকল্পনা থেকে-ও বাস্তবতা ভিন্ন এবং সম্পূর্ণ আলাদা ভাবেই সম্মুখে এসে উপস্থিত হয়। অর্থাৎ সকল কিছু’র জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে অবশ্যই!
___________

ইরা মুখে বিস্তৃত হাসি নিয়ে মাত্রই ফ্রেশ হয়ে এসে বেডে বসলো। হাতের ঝকঝকে রিংটা বারবার দেখছে। যতবার দেখছে অজান্তেই ঠোঁটে ফুঁটে উঠছে মোহনীয় এবং তৃপ্তির হাসি। বক্ষঃস্থল জুড়ে তীব্র ভালোলাগা এবং শান্তি। অনুভূতিটুকু যতদিন বেঁচে থাকবে ইরা কখনো ভুলতে পারবেনা। হঠাৎ দরজায় নক পরতেই ইরা দাঁড়িয়ে গেলো। আজমল খান ওর দরজায় দাঁড়িয়ে ইরা তড়িঘড়ি গলায় শুধালো,

—” বাবা কিছু লাগবে? ”

—” তোমার সঙ্গে কিছু কথা আছে আম্মা!”

—” তাহলে এসো না ভেতরে এসো। ”

আজমল খান ভেতরে ঢুকে মেয়ে’র দিকে এক নরজ চাইলেন। ইরা কিঞ্চিৎ ভীতসন্ত্রস্ত হ’য়ে বাবা’কে বসতে দিলো এবং নিজেও মুখোমুখি বেডে বসলো। আজমল স্বাভাবিক শান্ত গলায় বলে উঠলেন,

—” রাদে’র মায়ের সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। কাল আমরা রাদে’র সঙ্গে দেখা করবো। মনে রেখো পছন্দ হলে খুব দ্রুত ওর হাতে তোমাকে তুলে দিবো আনন্দের সাথে। কিন্তু তোমার বাবা’র অপছন্দ হলে আমি কোনো রিকুয়েষ্ট রাখবো না। বরং তোমার বাবা’র পছন্দের ছেলে’র সঙ্গেই তোমার বিয়ে হবে। আর সেটা তোমাকে বাধ্য মেয়ে’র মতো মেনে নিতে হবে!”

ইরা কিয়ৎপ্রহর নিরবে কিছু ভাবলো। আজমল খান প্রশ্নবিদ্ধ চোখে ওর দিক চেয়ে ইরা ভীত গলায় শুধালো,

—” আমার তোমাকে কিছু বলার আছে বাবা!”

আজমল খান আস্বস্ত গলায় আওড়ালেন,

—” অবশ্যই বলো কী বলতে চাও।”

ইরা আমতা-আমতা করে বলল,

—” বিষয়’টা, রা..হুল আদি ভাইয়া’কে নিয়ে। ”

একপর্যায়ে কিঞ্চিৎ গম্ভীরমুখে আজমল খান বললেন,

—” খুলে বলো!”

ইরা রাহুলের ব্যাপারে সমস্তটা খুলে বলল। আজমল খান বিস্ময়ে কিংকর্তব্যবিমুঢ় ছিলেন লম্বা একটি সময়। বাড়ি’র আদরের ছোট ছেলে অন্যায় না করেও এতগুলো দিন বাড়ির বাহিরে ছিলো বিতারিত হ’য়ে। নাহ্ বিতারিত হ’য়ে না! সম্পূর্ণ নিজ ইচ্ছায়, অভিমানে বাবাদের উপর রাগ থেকে। এটা তো হওয়ার ছিলো। এবার অংক মিলছে রাহুল স্পষ্ট ভাষি ছেলে অন্যায় করলে সর্বদা ক্ষমা চেয়ে নেওয়া ওর যেন কর্তব্য ছিলো। সেখানে এত বড় অন্যায়ের পর একটি বার বাড়ি মুখি হয়নি ছেলে’টা এ-ই তাহলে এ-র কারণ। উনারাই ছেলের উপর বিশ্বাস রাখতে পারেননি। এটা যেন ভাবতে পারছেন না তিনি। আজীম খাম সন্তানের সাথে কিঞ্চিৎ তেজীয়ান, রাগান্বিত, গম্ভীর স্বভাবের হলেও আজমল খান এর সম্পূর্ণ বিপরীত নিজের সন্তানদের নিকট। উনি ছেলেমেয়েদের ভীষণ স্নেহ করেন। উপর উপর শক্ত কঠোরতা দেখালেও ভেতর ভেতর উনি ছেলেমেয়েদের উপর বেশীক্ষণ রাগান্বিত থাকতে পারেন না। রাহুলের জন্য উনি কতটা কষ্ট পেয়েছেন এতগুলো দিন এটা উনার অসুস্থতা প্রমান দেয়। অথচ সকলে ভাবে উনি সম্মানহীনতায় অসুস্থ হয়েছেন আসলে এটা মিথ্যে উনি অসুস্থ হয়েছেন এ-ই ভেবে ছেলেটা এতটা বদলে গেলো কী করে, একটিবার ক্ষমাও চাইতেও বাড়ি ফিরে এলো না। আজমল খান ও বলতে পারলেন না ছেলে’কে বাড়ি ফিরে এসো যা হওয়ার হয়েছে। লম্বা একটি দীর্ঘ শ্বাস বেরিয়ে এলো বুক চিরে। হতাশাজনক ভারী নিশ্বাস। আর এক মুহুর্ত না ভেবে উনি দৃঢ়ভাবে বললেন,

—” আদিত্য’কে বাড়ি ফিরে আসতে বলো। আমি আজকেই যাবো রাহুল’কে বাড়ি ফিরিয়ে আনতে। ইন শা আল্লাহ সকালে রাদের সঙ্গে দেখা করতে বাড়ির সকল পুরুষ যাবে। ”

ইরা কেঁদে ফেলল। এক ছুটে বাবা-র পা জড়িয়ে নিয়ে ফ্লোরে বসে পড়লো। আজমল খানের চোখেও পানি। কেউ জানলোনা। একা ঘরে বাবা মেয়ে মিলেমিশে কেঁদে হাল্কা হ’য়ে নিলো। কিয়ৎকাল পর ভয়ে ভয়ে হঠাৎ-ই ইরা সাবলীল ভাবে কিছু’টা অস্বস্তির সাথে নিজের হাতের রিংটা দেখিয়ে কম্পিত গলায় বলল,

—” এটা রাদ আজ আমাকে পড়িয়ে দিয়েছে বাবা। বলেছে এটা আমাদের এনগেজমেন্ট রিং। আমি এটা এখন তোমাকে দিয়ে দিতে চাই। যদি কাল তোমার রাদ’কে পছন্দ হ’য় আমি চাই তুমিও এমন একটা রিং ওকে পড়িয়ে দিবে। যদি অপছন্দ হয় তাহলে এ-ই রিংটা ওকে ফিরিয়ে দিবে। ”

বাক্যটুকু শেষ করে ইরা লম্বা একটা শ্বাস ফেলে আবারও বলল,

—” বাবা কাল যদি তোমার ওকে পছন্দ হয়। তাহলে রাদ তোমার কাছে এমন কিছু চাইতে পারে যেটা তোমার কাছে অসম্ভব মনে হতে পারে। কিন্তু আমি চাই তুমি ওর কথাটা রাখো প্লিজ।”

আজমল খান চোখে আস্বস্ত করলেন মেয়ে’কে মুখে বললেন,

—” তোমার পছন্দের উপর আমার ভরসা আছে আমি নিজের সর্বোচ্চ চেষ্টা করবো আম্মা তোমার খুশি সবচেয়ে উর্ধ্বে রাখার। তুমি আদিত্য’কে বাড়ি ফিরতে বলো। আমি তোমার ছোট বাবা’র সঙ্গে কথা বলে আসছি। আমি চাই কাল রাহুলও ওর বোনের জন্য ছেলে দেখতে যাবে। ”

এক মুহূর্তে জন্য বাবা-র বক্তব্য শুনে ইরা’র শ্বাসপ্রশ্বাস অস্বাভাবিক হ’য়ে এলো খুশিতে। ও বাবা-র কথায় সায় জানালো, প্রশ্বস্ত হেসে মাথা দুলালো। আজমল খান স্মিত হেসে উঠে বেরিয়ে গেলেন। ইরা শূন্য চেয়ে রইলো সব কেমন স্বপ্নের মতো হচ্ছে। ধ্যাৎ চ্যুত হতে দ্রুত আদি’কে কল লাগালো। দু’বার রিং হতে-ই রিসিভ হলো। ইরা কান্নারত গলায় আওড়ালো,

—” আদি ভাইয়া? ”

—” হ্যাঁ বলো। নিশ্চয়ই কেঁদেকেটে ন্যাকামি করে বাবা’কে সব বলে ফেলেছিস?”

ভ্রুঁদ্বয় কুঁচকে গেলো ইরা’র। মেকি গম্ভীর গলায় শুধালো,

—” আমি ন্যাকামি করিনা। ”

—” সেটা আমি জানি তুই কী করিস। ”

—” বড়বাবা আজ-ই রাহুল ভাইয়া’কে যাবে। তোমাকে এক্ষুণি বাসায় ফিরতে বলছেন বাবা। ”

কিয়ৎকাল নিস্তব্ধতার পর। আদি চিন্তিত গলায় শুধালো,

—” এখন অলরেডি দুপুর ২-টা বাজে। বল কাল সকাল সকাল বেরিয়ে যাবো আজ কোনো ভাবে সম্ভব না!”

এপর্যায়ে ইরা ভীতসন্ত্রস্ত নিরীহ গলায় শুধালো,

—” কাল বাবা রাদের সঙ্গে দেখা করতে যাবে। ডেট চেঞ্জ করা যাবে না প্লিজ। ”

ওপাশে আদি নিশ্চুপ। ইরা আবারও বলল,

—” প্লিজ আদি ভাইয়া..!”

—” এতো তাড়া বিয়ে করার? ”

—” এটা শুধু বিয়েনা ভাইয়া অনেক কিছু তুমি বুঝবে না। ”

—” আমি দোকান থেকে গাড়ি নিয়ে আসছি ওদের বেরুতে বল। ”

ইরা উচ্ছ্বসিত গলায় শুধালো,

—” আই লাভ ইউ ভাইয়া, ইউ আর দ্যাবেষ্ট। তুমি দ্রুত রাহুল ভাইয়া’র এড্রেসটা লিখে নাও আমি বলছি। ”

আদি এড্রেস লিখার অবস্থায় আর ছিলো না। আই লাভ ইউ ভাইয়া শব্দটুকু ঘূর্ণিঝড় বইয়ে দিয়ে গেলো আদি’র বক্ষঃস্থলে। অস্বাভাবিক হৃদস্পন্দনের সঙ্গে আদি ইরা’র সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করলো আচমকা। ফোন রেখে আদি নিজেকে সংযত করতে পারলো না। ওর পুরুষালী কান্নায় ভার হলো আশপাশ।

সম্মুখে বসে থাকা নাহিদ অবাক চক্ষুদ্বয় স্থির নিবদ্ধ করে রাখলো গম্ভীরমুখো সল্পভাষী আদি’র কান্নারত মুখশ্রীর উপর। তবে আদি’র মনে হচ্ছে এটাই শেষ নয় সারাজীবনের জন্য ইরা নামক মেয়েটি ওকে দূর্বল করে দিয়ে গেলো।

নাহিদ উঠে এসে আদি’র কাধে হাত রাখতেই থেমে গেলো আদি। নাহিদ বলল,

—” ঠিক আছিস ভাই? ”

আদি মাথা দুলালো। ঘন ঘন শ্বাস ফেলে নিজেকে সংযত করে প্রত্যুত্তরে বলল,

—” হ্যাঁ। আন্টি’কে একটু চা দিতে বল না। মাথাটা ধরেছে। ”

—” তুই শান্ত হ আমি এক্ষুণি চা নিয়ে আসছি৷ ”
__________

ইরা’র বাড়িতে কয়েক মুহূর্তে’র জন্য হইচই বেঁধে গেলো যখন রাহুমের ব্যাপারটা বাড়ির দুই কর্তীর কানে পৌঁছালো। ড্রইংরুমে বাড়ি’র দুই মা ইতিমধ্যে কেঁদেকেটে একাকার। একি সঙ্গে খুশিতে বিলাপ করে যাচ্ছেন। ইরা নিজের বাবা-র মুখে অন্যরকম একটা ঝলক দেখতে পারছে যেটা কিছুক্ষণ আগেও ছিলো না। মৃদু হাসলো ইরা। ওর বিশ্বাস কাল রাদ’কে দেখার পর বাবা’র মুখে পরিপূর্ণ হাসি ঝলমল করবে। ইতিমধ্যে আদি গাড়ি নিয়ে বাড়ি’র সম্মুখে চলে এসেছে। দুই ভাইও তখন টিপটপ রেডি এক্ষুণি বেরিয়ে পড়বে। ইরা হাত থেকে আংটিটা খুলে বড় বাবা’র হাতে তুলে দিলো। আজমল খান ইরা’র মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে সবার থেকে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে গেলো বাড়ি’র ছোট ছেলে ছেলে’র বৌ’কে ফিরিয়ে আনতে। ইরা মনে মনে আরেকটু হাসলো আদি’কে হয়তো একবার বলেছিলো তবে বাসার কেউ জানেনা। ওর ভাই দুই সাপ্তাহ হলো বাবা হ’য়ে গিয়েছে। ইশ যখন গিয়ে দুইভাই দেখবে ওরা দাদা হ’য়ে গিয়েছে কী খুশি হবেন। ওদের সারপ্রাইজ দিতেই মূলত ইরা এটুকু লুকিয়ে গিয়েছে।

ইরা মিটমিটিয়ে হাসলো। পাশ ফিরে দেখলো নীলা বেগম ওর দিক ভ্রু কুঁচকে চেয়ে ইরা থতমত খেয়ে দৌড়ে ঘরে চলে গেলো। মা মেয়ে’র এহেন কাণ্ডে মীতি হাসতে হাসতে শেষ। বড় মা এ-র কিছু-ই বুঝলেন না তিনি চোখে পানি মুখে অবাকতা নিয়ে ফ্যাল ফ্যাল চেয়ে রইলেন।

ইরা রুমে এসে বসতেই খালি আঙুল’টা দেখে মন খারাপ হ’য়ে গেলো। মনে পরে গেলো রাদের নিষেধাজ্ঞা। ও মানা করে দিয়েছিলো আংটিটা কখনো খুলতে। অথচ আজ পরিয়ে দিয়েছে আজকেই ইরা আংটিটা খুলে ফেলেছে। রাদ’কে এ-ই কথা ভুলেও বলা যাবেনা। ইরা আবারও ওর কথা রাখেনি। ওর বিশ্বাস কাল সব ঠিক হয়ে যাবে। মন ভালো করতে ইরা ঘুরেফিরে রাদ’কে ফোন দিলো। রিং হয়ে কেঁটে গেলো রিসিভ হলো না। হতাশার একটা নিশ্বাস নির্গত হতেই আচমকা ফোনের রিংটোন বেজে উঠলো। রাদ কল ব্যাক করেছে। ইরা ফোন রিসিভ করতেই শুনতে পেলো প্রাণপুরুষের ব্যাস্ত, ক্লান্ত পুরুষালি ভরাট গলা,

—” হ্যালো, কী করছো? আমি তোমার জন্য শপিংয়ে ব্যাস্ত। সাথে আম্মু কাশিশ। ওরা আমাকে জাস্ট পাগল করে দিচ্ছে। তোমাকে আমাকে কিনে দেওয়া বদলে আমার পকেট ফাঁকা করে নিজেরা শপিং করে নিচ্ছে ভীষণ অন্যায় হচ্ছে আমার সাথে। ”

রাদ এক নিশ্বাসে অভিযোগ শেষ করে দিলো। ইরা খিলখিল করে হেসে উঠলো। রাদ’কে ভীষণ প্রফুল্ল এবং সজীব লাগছে। ও আজ কতটা খুশী সেটা হয়তো ওর কথা বলার ভঙ্গি কিংবা ওর সুদর্শন তৃপ্ত মুখশ্রী’টা দেখে যে কেউ ব’লে দিতে পারবে ইরা’র বিশ্বাস। কিন্তু এতটা খুশি কপালে সইবে তো৷ কাল সব উলোটপালোট হ’য়ে যাবে না তো? হঠাৎ এহেন ভাবনায় ঘাবড়ে গেলো ইরা খানিকটা ভীত গলায় শুধালো,

—” রাদ? ”

রাদ ইরা’র এহেন কণ্ঠে ঠিক টের পেলো প্রেয়সীর বক্ষঃস্থলের উদ্বিগ্নতা, ভয়। আশ্বস্ত, নরম গলায় বলল,

—” তোমার আমার উপর বিশ্বাস আছে তো ইরানী? ”

ইরা এক মুহূর্ত না ভেবে প্রত্যুত্তরে বলল,

—” নিজের থেকেও বেশী! ”

রাদে’র গলায় প্রবল আত্মবিশ্বাস,

—” তাহলে নিশ্চিন্তে থাকো, আমি আমার সবটুকু দিয়ে, সব ঠিক করে দিবো। ”

একমুহূর্তের জন্য কথা গুলো এতো স্বস্তি এনে দিলো ইরা’র মনকুঠুরিতে যে ও আবেগপ্রবণ মোলায়েম গলায় আনমনে আওড়ালো,

—” ভালোবাসি! ”

এপর্যায়ে রাদ কিঞ্চিৎ বিচলিত গলায় আওড়ালো,

—” ইয়ে মানে, আই এম ইন পাবলিক প্লেস সো ট্রাই টু আন্ডারস্ট্যান্ড। ”

ইরা দুষ্টু হাসলো। কঠোর বিরোধিতা করে বলল,

—” নোপ! এক্ষুণি উত্তর দাও। বলো ভালোবাসি ইরানী। ”

—” ইরা! ”

—” বলতেই হবে! ”

চক্ষুদ্বয় বুজে রাদ স্বাভাবিক ভাবেই বলল,

—” ভীষণ ভালোবাসি ইরা, তুমি আমার প্রশান্তি। কখনো আমার হাত ছেড়ে দিও না। ”

স্থির হয়ে রইলো ইরা। মনে পড়ে গেলো বাবাকে দেওয়া কথা। পরপর মনে পড়লো রাদে’র আশ্বাস। একটু থেমে ইরা প্রত্যুত্তরে বলল,

—” দিবো না। কখনো না। ”

ফোন রেখে ইরা স্তব্ধীভূত হ’য়ে গেলো। ওর দ্বারা ভুল হয়ে গিয়েছে সবাইকে মানিয়ে বিয়ে করার চেষ্টায় শেষে না সবাই’কে দ্বিগুণ কষ্ট দিতে হয়। বাবা’কে কথা দেওয়া একদম উচিৎ হয়নি ওর৷ তবে যা হওয়ার হয়ে গিয়েছে। এখন শুধু নিজের জন্য পার্থনা করতে পারে ইরা। আর কিছু নয়। মাথা চেপে ধপ করে বেডে শুয়ে পড়লো ও।
______________

রাদ ফোন রেখে স্মিথ হাসলো। ওরা ইরা’র জন্য বিয়ের শপিং করতে এসেছে। যদিও রাদ ঢাকা থেকে সব শপিং করেছিলো ইরা’র জন্য। কিন্তু জুহা মানতে নারাজ। উনি পুত্রবধূর জন্য নিজে পছন্দ করে শপিং করতে চান ফলাফল পুনরায় শপিংয়ে বেরিয়েছে ওরা। শাড়ী’র দোকান বসে শাড়ি চুজ করছিলো তিনজন। রাদ ইরা’র ফোন পেয়ে দূরে গিয়ে কথা বলছিলো বোকা মেয়ে’টা সেটা টের পায়নি হয়তো আশেপাশে ক্রাউড একটু বেশি বলে। রাদ পুনরায় দোকানের দিকে এগিয়ে গিয়ে দেখলো। কাশিশ এবং জুহা দু’জনে মধ্যে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই চলছে রীতিমতো মতো। কাশিশ চুজ করেছে টকটকে লাল লেহেঙ্গা এবং জুহা চুজ করেছে টকটকে লাল শাড়ি। দু’জনের তেজী চোখ ওর উপর পড়তেই দু’জন চেপে ধরলো ওকে। জুহা আবেগ অনুভূতি মিশিয়ে বলে উঠলেন,

—” তুই বল বাবা। শাড়িটা বেশি সুন্দর না? ”

কাশিশ ও থেমে নে-ই জোর গলায় বলল,

—” হ্যাঁ হ্যাঁ রাদ তুই বলো। শাড়িটা ওল্ড ফ্যাশন। লেহেঙ্গা’টা জোস না? ইরা’কে জোস লাগবে। ইনফেক্ট মেয়েরা এখন ট্রেন্ডি লেহেঙ্গা পছন্দ করে। ”

জুহা ক্ষেপে গেলো,

—” এ-ই তুই কী ইনডিরেক্টলি আমাকে ওল্ড ফ্যাশন বললি?”

কাশিশ হেসে বলল,

—” ইনডিরেক্টলি বলবো কেন। আমি ডিরেক্টলি বলছি শাড়িটা ওল্ড ফ্যাশন। ”

—” গুরুজন’কে সম্মান দিয়ে কথা বল। রাদ তুই বল না বাবা শাড়িটা বেশি সুন্দর না? ”

কাশিশ ও অধীর আগ্রহ নিয়ে চেয়ে বন্ধুর পানে। রাদ পড়েছে বিপদে দুই জেনারেশনের মধ্যে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই। যেটাই চুজ করুক একটা বাঁশ ওকে খেতেই হবে নিশ্চিত। দোকান দার রাদে’র দিক চেয়ে হাসছে৷ হয়তো ওর অবস্থা টের পেয়েছিলো। রাদ নিজেও বোকার মতো একটু হাসলো। তবে বরাবরই রাদ বিচক্ষণ, ও বুদ্ধিমান ফলাফল ও এমন একটা ভাণ করলো যে শাড়ি এবং লেহেঙ্গা’টা দুটোই মনোযোগ দিয়ে দেখছে অতঃপর একটু হেসে স্বাভাবিক গলায় বলল,

—” দুটোই আমার ভীষণ পছন্দ হয়েছে। শাড়ি’টা নাহয় ইরা কাল পড়বে। আর লেহেঙ্গা’টা তরী’র বিয়েতে। ওর বিয়ের থীম তো লেহেঙ্গা। এ-ই লেহেঙ্গা’টা তরীর বিয়ের দিন পড়ার জন্য পার্ফেক্ট। আমাদের এ-ই দুটোই প্যাক করে দিন প্লিজ। ”

জুহা কাশিশ দু’জনেই একটা যুদ্ধজয়ের হাসি দিলো। রাদ হাফ ছেড়ে বাঁচলো। মা বন্ধু’কে দেখলে রাদের কখনো কখনো মনে হয় ওরা ছোট বেলায় হারিয়ে যাওয়া দুইবন্ধু একে অপরের পিছনে লেগে থাকবে। আবার একে অপর’কে ছাড়া চলবেও না।

সম্পূর্ণ শপিংয়ে ওরা এভাবেই যুদ্ধে নিযুক্ত ছিলো কিছু-ই রাদ পছন্দ করে কিনতে পারেনি দু’জনে লড়াই করে নিজেদের পছন্দ অনুযায়ী কিনেছে। রাদ শুধু পেমেন্ট করেছে, কখনো বা শাড়ির মতো ডাবল পেমেন্ট করতে হয়েছে। কিছু বলতেও পারেনি বেচারা। ভাগ্যিস রাদ নিজে আগেই পছন্দ করে ইরা’র জন্য কিছু শপিং করেছিলো নাহলে আফসোস হতো বৌয়ের জন্য নিজে কিছু কিনতে পারলো না। তবে আজকের শপিং গুলোর মধ্যে যে-ই আবেগ, ভালোবাসা, স্নেহ মিশে আছে সেটা রাদ ইরা কোথায় বা খুঁজে পেতো? এ-ই ভালোবাসা গুলো-ই তো থেকে যাবে চিরকাল। মানুষের অস্তিত্ব যে শুধু কয়েক মুহূর্তে’র মধ্যে বিলিন হ’য়ে যায়।
______________

রাজশাহী টু ঢাকা রোড। গাড়ি চলছে আপন গতিতে আদি চোয়ালদ্বয় শক্ত করে ক্রমশ দ্রুত গতিতে ড্রাইভ করে যাচ্ছে। শা শা করে অসংখ্য গাড়ি ক্রসিং করে যাচ্ছে। আজমল খান দীর্ঘশ্বাস ফেলে ছেলে’র দিক চাইলেন। আদি’র চোখে স্পষ্ট হতাশার ছাপ, নির্ঘুম রাতে’র সাক্ষী চোকের নিচে কালো দাগ। ঘাড় ঘুরিয়ে ছোট ভাইয়ের দিকে চাইলেন উনি। আজীম খান সীটে মাথা ফেলে ভাত ঘুমিয়ে দিয়েছেন। মোক্ষম সুযোগ পেয়ে গলা পরিষ্কার করে হঠাৎ ছেলে’র উদ্দেশ্যে গম্ভীর গলায় বলে উঠলেন,

—” সেদিন ইরা’র গায়ে হাত উঠিয়ে ভুল করেছো তুমি। আশাকরি ইরা’র বিয়েতে ঝামেলা করা’র বিন্দুমাত্র চেষ্টা করবেনা তুমি। তোমার মনের অবস্থা আমি বুঝি। তা-ই বলে নিজের ব্যাক্তিত্ব নিচু করে ফেলবেনা আশাকরি। কাল রাদ’কে দেখতে তুমিও যাবে আমাদের সাথে অবশ্যই ইরা’র ভাই হিসেবে। ”

আদি দাঁতে দাঁত নিষ্পেষণ করে দ্রুত মাথা ঘুরিয়ে জানালা দিয়ে বাহিরে চাইলো। চক্ষুদ্বয় বন্ধ করে নিজেকে ধাতস্থ করতে ব্যাস্ত হলো। ওর অস্থিরতা দেখে আজমল খান পুনরায় ওকে সাবধান করলেন,

—” নিজেকে সামলাও আদি। রাদ সম্পর্কে এখনো জানা, দেখা বাকি আমাদের। মনে রেখো দেখলে-ই বিয়ে হ’য়ে যায় না। ইরা কথা দিয়েছে আমাকে আমাদের রাদ’কে পছন্দ না হলে। ও আমাদের পছন্দেই বিয়ে করবে। এবং আমাদের পছন্দ’টা অবশ্যই তুমি। ”

আদিত্য বিস্ফোরিত চোখে বাবা-র দিক চাইলো। আজমল খান উনার শান্ত চক্ষুদ্বয় দ্বারা ছেলে’কে আশ্বস্ত করলেন। অস্বাভাবিক ভাবে আদি সম্পূর্ণ শান্ত হ’য়ে গেলো। বাবা-র কথার উপর ওর বিশ্বাস রাখতে হবে।

চলবে!

#জলফড়িং
#Roja_islam
#part ২১ [শেষ অংশ]

আদর বাবু’কে খাওয়াচ্ছিলো বেডে বসে অসময়ে কলিংবেল বাজতেই চিন্তিত নজরে ফোনের দিক নজর বোলালো। অসময়ে বাড়ি এলে রাহুল অবশ্যই ফোন দিয়ে বাড়ি আসতো। অন্যকেউ এলে-ও রাহুল’কে কল দিয়ে লাইনে রেখে-ই দরজা খুলতে বলে দিয়েছে অতি সতর্ক ছেলে’টা। একা একটা গ্রামের মেয়ে ঢাকা শহরে বাসায় একা থাকে বলে চিন্তায় থাকে সর্বদা রাহুল। ফলাফল এ-ই পন্থা অবলম্বন করতে বলে দিয়েছে আদর’কে। দু-তিন বার কলিং বেল বাজতেই দ্রুত বাবু’কে শুইয়ে রেখে ফোন লাগায় রাহুলের কাছে। সব সময়ের মতো একবার রিং হতে-ই রিসিভ হলো অতঃপর ওপাশ থেকে রাহুলের মৃদু উৎকাণ্ঠিত গলার স্বর ভেসে এলো তৎক্ষনাৎ,

—” কী হয়েছে? বাবু বিরক্ত করছে? আরেকটু সহ্য করো। ৫-মিনিটে বেরিয়ে যাবো অফিস থেকে…!”

রাহুলের কথার মধ্যেই আদর বিরক্ত হ’য়ে শুধালো,

—” থামবে একটু। আমাকেও একটু বলতে দাও বাবা। দরজায় কেউ আছে আমি খুলছি তুমি কলে থাকো। ”

স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে রাহুল একটু হেসে বলল,

—” ঠিক আছে খুলো, আমি আছি। ”

এটুকু ব’লে থামলেও চিন্তা হতে লাগলো’কে এলো এ-ই ভোর সন্ধ্যায়? এদিকে আদর দরজা খুলে হতবিহ্বল হলো তিন দাম্ভিক গম্ভীর পুরুষ’কে সম্মুখে দন্ডায়মান দেখে। তবে প্রত্যেকেই পূর্ব পরিচিত। ছবি দেখেছে ও রাহুলের পরিবারের প্রতিটি সদস্যদের। ওরা ওকে না চিনলেও আদর ঠিক-ই সবাইকে খুব ভালো করে চিনে। রোজ ওদের কারো না কারো গল্প করে রাহুল। আদরের চক্ষুকোল ভরে এলো। মাথা নিচু করে দ্রুত সালাম দিলো। পরপর মোলায়েম ক্ষীণ আওয়াজে বলল,

—” ভেতরে আসুন বাবা….!”

মিষ্টি একটা কণ্ঠে বাবা বলে ডাকতেই যেন কিছু’টা থমকে গেলেন দুইভাই। পরমুহূর্তেই আজমল খান দীর্ঘশ্বাস শ্বাস ফেলে ভেতরে এসে সাবলীল গলায় শুধালেন,

—” আলাইকুম আসসালামু মা। রাহুল আছে ভেতরে…? ”

রাহল আর শুনতে পারলো না, সে-ই অবস্থায় ও নে-ই। ফোন পকেটে পুরে এক দৌড়ে অফিস ছেড়ে বেরিয়ে এলো তটস্থ ভঙ্গিতে। এক্ষুণি বাড়ি ফেরা অত্যন্ত প্রয়োজন ও ঠিক বুঝতে পেরেছে’কে এসেছে বাড়িতে।
_________

আজীম খান ঘুরে ঘুরে দেখছেন ছেলের বাসা। খুব সুন্দর ছিমছাম গোছানো একটা ফ্ল্যাট বেশ বড়সড়-ই বটে। নিশ্চয়ই ভালো এমাউন্টের মাসিক চার্জ দিতে হয়। ফ্ল্যাট’টাও সুন্দর গুছিয়েছে। অদেখায় খুব দ্রুত বড় হ’য়ে গেলো ছেলে’টা। একা একা ঠিক সামলে নিয়েছে নিজেকে পরিস্থিতি’কে। দীর্ঘ শ্বাস বেরিয়ে এলো বুক চিরে।

আদর শ্বশুরদের ড্রইংরুমে বসিয়ে দ্রুত শরবতের ব্যাবস্থা করতে ব্যাস্ত হলো কতদূর থেকে এসেছে। এ-র মধ্যে শুনতে পেলো বাবুর আকস্মিক চিৎকার। রীতিমতো গলা ফাটিয়ে ফেলছে মেয়ে’টা। উফফ, ব’লে মৃদু ক্ষোভ ঝেড়ে আদর দৌড়ে যেতে লাগলো বেড রুমে। পেছন থেকে আদি ডেকে উঠলো ওকে। সন্ধিহান গলায় আওড়ালো,

—” কে কাঁদছে? ”

আদর স্মিত হাসলো কিছু বলল না। রুমে ঢুকে মেয়ে’কে কোলে তুলে বেরিয়ে এলো। হতভম্ব প্রস্ফুটিত চক্ষে চেয়ে থাকা আদি’র কোলে ওর এবং রাহুলের অংশ তুলে দিলো। আদি রীতিমতো কাঁপছিলো বাবুটা’কে কোলে তুলে, যেন আস্ত তুলোর বল একটা। ওর ধ্যাৎ চ্যুত হয় বাঁচ্চা’র কান্নাকাটি’তে নতুন কারো কোলে বাচ্চা’টা আরাম পাচ্ছেনা বুঝা-ই যাচ্ছে। আদি একটু হেসে দ্রুত পায়ে ড্রইংরুমে এলো বাচ্চা কোলে আজীম খান এ-ই দৃশ্য দেখে দাঁড়িয়ে গেলেন সোফা ছেড়ে। উনার বুঝতে বাকি নে-ই উনি দাদা হ’য়ে গিয়েছেন। ঠোঁটে হাসি ফুটলেও অক্ষিকোটর বেয়ে উনার অশ্রুজল গড়াচ্ছে এতগুলো দিনের শক্ত দ্বার বুঝি আজ ভাঙলো। আদি ছোট বাবা-র কোলে তুলে দিলেন উনার নাতিন’কে। আজমল খান স্তব্ধ হয়ে বসে তখনো। ছোট ছেলে’টা এত পর করে দিলো বাবা-মা’কে বিশ্বাস হচ্ছে না উনার।

এ-র মধ্যে হন্তদন্ত হয়ে ফ্ল্যাট ঢুকলো রাহুল। বাবার কোলে ওর ছোট ইশা’কে দেখে একদম ভেঙে পড়লো ছেলে’টা। পাথরের মতো দাঁড়িয়ে রইলো ও। আদি এতদিন পর ছোট ভাই’কে দেখে কোনো দ্বিধাবোধ ছাড়া গিয়ে তৎক্ষনাৎ জড়িয়ে ধরলো। আবেগপ্রবণ মোলায়েম গলায় শুধালো,

—” মেয়ে’টা একদম আমাদের ছোট্ট ইরা। আমি ভাবতে পারিনি এভাবে এসে..! আমাকে ক্ষমা করে দিস ভাই আমার জন্য এতো কিছু হ’য়ে গেলো…!”

রাহুল নিজেও ভাই’কে জড়িয়ে ধরেছিলো কিন্তু ক্ষমা চাইতে-ই একটু দুরে সরে এলো। নরম গলায় বলল,

—” ধুর ভাই, ক্ষমা করার মতো কী হয়েছে। ”

এবার মুখ খুললেন আজমল খান,

—” কিছু না হলে অবশ্যই ভালো ব্যাপার। আজকেই ফিরতে হবে। বাড়ি চল। ”

রাহুল ছলছল চোখে হালকা হেসে স্মিথ গলায় বলল,

—” এভাবে হয়নাকি বাবা, আমার অফিস আছে না। ”

—” তো এখন তোর জন্য এপয়েন্টমেন্ট বুক করতে হবে আমাদের? এতবড় অফিসার হয়ে গিয়েছিস তুই? ”

রাহুল থতমত খেয়ে একবার আদি’র দিক চাইলো। আদি ভ্রুঁ নাচালো শুধু। রাহুল হতাশার শ্বাস ফেলে কোনো রকম বলল,

—” কী বলছো, তেমন কিছু না। ”

এ পর্যায়ে আজমল খান দাঁড়িয়ে গর্জে উঠলেন আচমকা,

—” তো কী বলতে চাইছিস তুই। খান বাড়ি দেউলিয়া হয়ে গিয়েছে? খান বাড়ির বংশধর এভাবে একা একা অনাদরর, অবহেলায়, ভাড়াবাসায় পরে পরে বড় হবে। আমরা কী মরে গিয়েছিলাম আমাদের একাবার জানাতে পারলিনা তুই। বাপের এত শক্ত জাতের হয়ে গিয়েছিস তুই। ”

এ পর্যায়ে রাহুল গলায় রাগ ঢেলে শুধালো,

—” আমার তো বাড়িঘর পরিবার নে-ই। আমি কাকে জানাবো? তোমরা-ই বের করে দিয়েছিলে একদিন আমাকে ভুলে যাইনি আমি কিছু এখন কাকে ধমকাতে এসেছো। ”

আজমল খান ভাইয়ের দিক ক্রুদ্ধ চোখে চাইলেন। সব নষ্টের গোড়া উনার ছোট ভাই আর উনার ছেলে অল্পতেই মাথা গরম করে ফেলেন দুজন। বড় ভাই’কে চাইতে দেখে আজমল খান বাবু কোলে ফ্ল্যাট ছেড়ে বেরিয়ে এলেন। এহেন কাণ্ডে উপস্থিত সকলে স্তব্ধ। আজমল খান যেতে যেতে-ই বলছেন,

—” না হয় রাগে একটু বকেছি। তাই বলে দামড়া ছেলের কাছে ক্ষমা চাইতে আমি পারবো না। আমি আমার নাতিন’কে নিয়ে বাড়ি যাচ্ছি কেউ গেলে যাবে না গেলে নে-ই। ”

আবার একটু থেমে পিছন ফিরে আদরের উদ্দেশ্যে উঁচু গলায় শুধালেন,

—” বৌ মা তুমি চলে এসো আমার সাথে। তুমি এলে এ-ই ছাগলের প্রয়োজন নে-ই আমার। ”

আদর ঠোঁট চিপে হাসলো। রাগুল রাগী দৃষ্টিতে চাইলো ওর দিক। আদর মাথা দুলালো। রাহুল করুণ চোখে চাইলো এবার। এতে স্পষ্ট যেওনা প্লিজ। আদর স্বামীর করুণ মুখশ্রীতে একবার চেয়ে চলে গেলো শ্বশুরের পেছনে। ও না এগুলে হয়তো রাহুল নিজে’কে নরম করবে না। লোকটা কতটা অভিমানী কেবল ঐ সাক্ষী। রাহুল আশাহত দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো স্তিমিতনেত্র জোড়া ঘোলাটে করে। ওর বৌ, বাবা ওকে পাত্তা-ই দিলো না। গম্ভীর বদমেজাজি মানুষ’টা কেমন নাতীন কলে তুলে বাচ্চা হ’য়ে গেলেন। আজমল খান এসে রাহুল’কে জড়িয়ে ধরলেন বুকে। কান্না জড়িত গলায় শুধালেন,

—” ক্ষমা করেদে বাবা’দের। রাগের মাথা কী বলতে কী বলেছি। ফিরে চল! মেয়ে’টা আমাদের ভালোবাসা থেকে আর বঞ্চিত করিস না নিজের মতো। ”

রাহুলের আর কিছু বলার ছিলো না। কী বা বলতো ছেলেটা। পরিবার পরিজন থেকে-ও একাকী জীবন কতটা যন্ত্রণা’র এটা তারাই বুঝবে যারা এভাবে থেকেছে। আর আজ যখন সে-ই মানুষ গুলো সম্মুখে এসে দাঁড়ালো এতগুলো দিনের রাগ, অভিমান, অভিযোগ গুলো আজ দলা পাকিয়ে উঠলো গলায়। শক্ত মনটা যেন ঝরঝর করে গলে যাচ্ছে। রাহুল বড় বাবা’র কাধে মাথা ফেলে অবরুদ্ধ ক্ষীণ আওয়াজে বলল,

—” আরও আগে কেন এলেনা বাবা। আমি ভীষণ কষ্ট পেয়েছি। ”

এ-ই দৃশ্য দেখে রাহুল নিজের স্থির রাখতে পারলোনা কেন যেন। নিজেকে মনে হলো অপরাধী। ভাইয়ের কাঁধে ভরসার হাত চাপড়ালো দু’বার৷ আজমল খান রাহুলের সঙ্গে অনেক কথা বললেন বুঝালেন। এ-র মধ্যে সব ভেঙে বললেন রাদে’র কথা, যদিও রাহুল আগে থেকে-ই সব জানে। এবং সব অভিমান অভিযোগ হিসেব নিকেশ শেষে বাবা-র কথা অনুযায়ী ও অফিস থেকে ইমার্জেন্সি ছুটি নিয়ে বাবুর জন্য প্যাকিং করে তৎক্ষনাৎ বেরিয়ে পড়লো রাজশাহীর উদ্দেশ্য।

রাহুল নিচে নেমে দেখলো মেয়ে’র ছোট্ট হাতে হাজার টাকা’র অসংখ্য নোট! মনে মনে একটু হাসলো এবার ওর মেয়েটা’কে আর একা একা থাকতে হবে না। ভালোবাসায় ভরিয়ে রাখবে সকলে ওর রাজকন্যা’কে। ও আদরের চোখে একবার চাইলো। আদর ওকে চোখে আশ্বস্ত করলো। রাহুলে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে রওনা হলো প্রায় তিন সারে তিন বছর পর নিজ বাড়ির উদ্দেশ্যে। যে-ই বাড়িতে একটু একটু করে বড় হয়েছে ও। এবার বড় হবে ওর মেয়ে।

____________

রাতে’র শেষ চমক বুঝি বাকি ছিলো। খান বাড়ি’র সকলের জন্যে। সেটা হচ্ছে বাড়ির নতুন এবং ছোট্ট সদস্য ইশা খান। ভোর রাত পর্যন্ত বাড়িময় ছিলো কান্নাকাটি, হাসাহাসি, আবেগঘন এক ভিন্ন পরিবেশ যেন এক লাহুমায় বাড়িটি তার প্রাণ ফিরে পেয়েছে।

নীলা বেগম মেয়ে’র উপর আজ আর চটপাট করেননি। বরং একটু খারাপ-ই লাগছিলো মেয়ে’র সঙ্গে এতগুলো দিন খারাপ ব্যাবহার গুলোর জন্য। আচমকাই উনার মন’টা কেমন করে উঠলো মেয়ে’র জন্য। উনি ইশা’র দিক গভীর ভাবে চাইলেন। মেয়ে’টা ফুপিকে কেড়ে নিয়ে এসেছে। তবে আগের রঙ ফুপির মতো চাপা নয়। মা’য়ের মতো ধবধবে ফর্সা। এইটুকুই ভিন্নতা। উনার মেয়েটার হয়তো খুব দ্রুত চলে যাওয়ার সময় এসেছে। তা-ই উনার কোলে এ-ই ছোট্ট ইশা রূপে ইরা আবারও ফিরে এসেছে। উনার কষ্ট কিছু’টা হয়তো বা কম লাগবে। সত্যি কী তাই? চিনি ছাড়া কী সত্যি চিনির স্বাদ মেটানো যায়।

ইরা, মীতি, আদি, রাহুল এক সঙ্গে প্রাণ খুলে কথা বলছে। কতগুলো দিন পর এ-ই দৃশ্য দেখা গেলো খান বাড়িতে। সকলের মন গুলো এক মুহূর্তে পরিপূর্ণ হ’য়ে গেলো যেন। হঠাৎ আজমল খান উঠে দাঁড়ালেন, ড্রইংরুমে ত্যাগ করতে করতে হাক ছাড়লেন,

—” বাকি কথা সময় মতো বলিস। কাল আমাদের সকাল সকাল বেরুতে হবে অনেক কাজ বাকি। দিন-টা ভীষণ লম্বা যাবে। সকলে এবার শুয়ে পর। রাদ আমাকে সকাল ৯-টায় শপে উপস্থিত থাকতে বলেছে..! ”

আরও কী কী বলতে বলতে উনি ভেতরে চলে গেলেন। এ-ই মুহূর্তে সকলের দৃষ্টি ইরা’র চকিত মুখে। সবার এহেন দৃষ্টিতে ইরা লজ্জা পেয়ে বলল,

—” এভাবে কী দেখছো তোমরা! ”

মীতি ফিসফিস করে বলল,

—” রাদ ভাইয়া’র হবু বৌ। ”

আদি’র হৃদপিণ্ডটা ঝলসে গেলো বোনের এহেন কথায়। হাসিখুশি মুখ’টা মুহূর্তে চুপসে গেলো। সেটা লুকাতেই উঠে দাঁড়ালো ও। কোনরকম স্বাভাবিক গলায় শুধালো,

—” আসলেই কাল অনেক কাজ, ইরা’র হবু বর দেখতে যাবো ব’লে কথা। আমি ঘুমুতে যাচ্ছি তোরাও শুয়ে পর এবার। ”

ইরা এক নজর আদি’র মুখশ্রীতে চক্ষুদ্বয় স্থির করলো। পর পর মাথা নিচু করে নিলো। এতক্ষণ গম্ভীর মানুষ’টা হাসিখুশি প্রাণবন্ত ছিলো। হুট করেই বদলে গেলো। খান বাড়ি’র সবচেয়ে কনফিউজড চরিত্র যাকে আজ পর্যন্ত ইরা বুঝতে পারলো না। দীর্ঘশ্বাস গোপন করে উঠে দাঁড়িয়ে আনমনে আওড়ালো,

—” আমিও যাচ্ছি ভাইয়া ভাবী’কে নিয়ে তুইও এবার একটু রেস্ট কর এবার। ”

আদি ইরা’র মন পড়তে পারলো যেন। ও চলে গেলো নিজ রুমে। মীতি উঠে আদরের কাছে গেল। যাকে বড় মা তখন থেকে খাইয়ে যাচ্ছে শুকনো বলে বলে। বেচারী আদর ভাবী’কে হেল্প করা দরকার। বলা বাহুল্য আদর’কে সবাই ভালোবাসা’র সঙ্গেই বরণ করে নিয়েছে বাড়ি’র নতুন সদস্য হিসেবে। মেয়েটার মুখে এমন-ই মায়া কেউ অগ্রাহ্য করতেই পারবে না ওকে।

মীতি মা’কে পীড়াপীড়ি করতে শুরু করলো আদর’কে ছেড়ে দিতে এক দিনেই তো আর মোটা বানিয়ে ফেলতে পারবে না ওর ভাবী’কে। আদর যেন এতক্ষণে একটা ভরসা পেলো। নতুন এবং চাপা স্বভাবের ব’লে মুখ ফুটে বলতেও পারছেনা। আমার পেট ফেটে যাচ্ছে বড় শ্বশুড়ি এবার প্লিজ আমাকে ছেড়ে দিন।

ইরাও রুমে চলে যেতে নিলে। রাহুল বৌয়ের নাজেহাল মায়াবী মুখশ্রী’টা দেখতে দেখতে বোনের হাত চেপে ধরে আঁটকিয়ে আশ্বস্ত করে, মোলায়েম গলায় বলল,

—” কারো কথা কানে তুলিস না। তোর ভাই এখন তোর একদম কাছে আছে। কোনো অন্যায় মেনে নিবো না। চিন্তা করিস না। আজকের দিনটা তুই যেমন চেয়েছিস ভাই তোকে ঠিক তেমনই করে দিবে ইন শা আল্লাহ। ”

নীলা বেগম ছেলে’র মুখের দিকে পূর্ণ দৃষ্টিতে চেয়ে রইলেন স্তিমিতনেত্র জোড়া মেলে৷ এ-ই মুহূর্তে ড্রইংরুমে ইরা নীলা বেগম এবং রাহুল বসে৷ ইরা ভাইয়ের কথা গুলো মায়ের সম্মুখে শুনে লজ্জিত মুখে মাথা দুলিয়ে চলে গেলো নিজ রুমে। রাহুল মা’য়ের কোল থেকে মেয়ে’কে কোলে তুলে আদর করলো মন ভরে, সবার পর একটু আদর করার সুযোগ পেলো এতক্ষণে। পরপর মায়ের কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়লো সোফায় হাত-পা টান টান করে মেলে। নীলা বেগম নরম গলায় শুধালেন,

—” ছেলেটাকে তুই চিনিস বাবা? দেখেছিস কখনো? কেমন ছেলে’টা জানিস কিছু? ইরা বাচ্চা মানুষ কতটুকুই বা বুঝে? ও ভালো থাকবে তো বাবা ঐ ছেলে’র সাথে? ”

রাহুল মৃদু হেসে আশ্বস্ত গলায় বলল,

—” আমার উপর ভরসা আছে তোমার মা? ”

—” তোর উপর থাকবে না তো কার উপর থাকবে বাবা! আমি সব সময় জানি তুই কখনো ভুল কিছু’র পাশে থাকবি না। ”

—” তাহলে বিশ্বাস করো মা ইরা রাদে’র সঙ্গে ছাড়া কারো সঙ্গে ততটা ভালো থাকবে না। তাছাড়া ছেলে’টা আময়িক। ”

রাহুল ফোন থেকে মা’কে রাদে’র ছবি দেখালো। অতঃপর গাঢ় গলায় শুধালো,

—” রাদে’র সম্পর্কে যতটুকু খোঁজ নিয়েছি আমি। এতে এটাই বুঝিনি কী করে তোমার মেয়ে’কে এ-ই ছেলে পছন্দ করলো। ”

নিজ মনের দ্বিধাবোধ থেকে-ই নীলা বেগম আমতা আমতা করে বলে উঠলেন,

—” আদি’র থেকে-ও…! ”

মা’কে শেষ করতে না দিয়ে রাহুল বিরক্ত গলায় শুধালো,

—” মা প্লিজ, আমি কারো তুলনা কারো সাথে করতে চাইনা। আমি শুধু জানি আমার বোন যার সঙ্গে ভালো থাকবে। আমি তাকে-ই বেস্ট ভেবে নেবো। তবে তুলনা যদি করতে-ই চাও। তাহলে বেস্ট অবশ্যই রাদ। এটা শুনতে ভালো না লাগলেও এটা-ই সত্যি। ”

নীলা বেগম একপর্যায়ে থেমে গেলেন। উনি যানেন ইরা’র বড়বাবা ইরা’র জন্য বেস্টটাই চুজ করবেন সর্বদার মতো। তাছাড়া রাহুল নিজেও যখন বলছে তার মানে উনার মেয়ে’র পছন্দ উনি ফেলে দেবেন না। অনেক কষ্ট দিয়ে ফেলেছে মেয়ে’টাকে। এতটাও করা উনার উচিৎ হয়নি মনে মনে উনি অনুতপ্ত। কিন্তু কোথাও একটা কেমন লাগে মেয়েটার জন্য। রাহুল চিন্তান্বিত মা’য়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে শুধালো,

—” চিন্তা করোনা মা, যাও শুয়ে পরো। কাল মেয়ে’র বিদায় দিতে হবে প্রস্তুত হও। ”

নীলা বেগম কাঁদতে শুরু করলেন। রাহুল বুঝিয়ে সুঝিয়ে রুমে দিয়ে এলেন। ইশা’কে বড় মা সাথে নিয়ে গেলেন উনি আজ নাতিনের সঙ্গে ঘুমাতে ভীষণ উৎসাহী। রাহুল আদর’কে নিয়ে নিজের রুমে গেলো প্রায় তিন বছর পর। পুরনো রুমটা ঠিক আগের মতোই গুছানো পরিপাটি। আদর রুমে ঢুকে-ই ধপাস করে শুয়ে পড়লো বিছানায়। ওর পেট ফেটে যাচ্ছে মনে হচ্ছে। রাহুল ওর পাশে শুয়ে ধীরে বলল,

—” শ্বশুর বাড়ি’র আদর পেয়ে কেমন লাগছে আদর ম্যাডাম? ”

আদর কিঞ্চিৎ রাগান্বিত গলায় শুধালো,

—” ঢং করবানা। আমি জানি আমার শ্বশুর বাড়ি সকলে ভীষণ ভালো। শুধু মাত্র তুমি ছাড়া। কতবার ইশারায় হেল্প চাইলাম। আমাকে তুমি বাঁচাতে এলে না। মীতি না এলে আমি হয়তো এখন দাঁড়াতেই পারতাম না। ”

রাহুল মৃদু হেসে বলল,

—” তখন তুমি আমার ইশারা পাত্তা দিয়েছিলে? তোমার জন্য বাবা আমাকে একবারও স্যরি পর্যন্ত বলল না সেটার বেলায়। ”

—” অসভ্য ছেলে একটা। বাবা’র মুখে স্যরি শুনতে চায়। ”

রাহুল ছোট ছোট চোখে চেয়ে বলল,

—” আমি অসভ্য? ”

—” হ্যাঁ! ”

—” বাহ্, শ্বশুর বাড়ি এসে ভালো-ই পাওয়ার বেড়েছে দেখছি আমাকে মুখের উপর অসভ্য বলছো তুমি? ”

এবার আদর সতর্ক চোখে চাইলো প্রিয় পুরুষটির সুন্দর অতিপরিচিত চোখ দু’টোতে। আজ রাহুলের চোখে যেন অন্য এক দ্যুতি ছড়াচ্ছে। এটা মিলনমেলার বর্ণাঢ্য খুশি। আদর আচমকা নরম তুলতুলে গলায় শুধালো,

—” আপনি ভীষণ ভালো রাহুল। আপনি আমার জীবনে না এলে আমি কত কত ভালোবাসা মিস করে যেতাম। সেই আমার জন্যে আপনি কত কত ভালোবাসা থেকে কতগুলো দিন বঞ্চিত। তা-ই প্রথম বারের মতো আপনার কথা শুনিনি। এ-র জন্য আমি স্যরি। ”

রাহুল বৌয়ের আদর আদর মুখশ্রীতে মুগ্ধতার দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো শুধু। ওর দৃষ্টিতে আদরের গাল দু’টোতে লালাভ আস্তরণ পরে গেলো, তৎক্ষনাৎ উল্টো ঘুরে শুয়ে পড়লো মেয়েটা। রাহুল মৃদু হেসে ফিচলে গলায় আওড়ালো,

—” পালাচ্ছো কোথায় ম্যাডাম শ্বশুর বাড়ি’তে হাসবেন্ডের আদর খাবে না!”

এবার আদর লজ্জিত গলায় শুধালো,

—” অসভ্য একটা। ”

পেছন থেকে আদর’কে ঝাপটে ধরে রাহুল দুষ্টু গলায় বলল,

—” চলো একটু অসভ্যতা করে দেখাই। ”

রাহুল কাতুকুতু দিতে শুরু করলো আদরের উদরে। আদর খিলখিল করে হাসতে শুরু করলো। আদর’কে প্রাণ খুলে হাসতে রাহুল শিখিয়েছে। মেয়ে’টার প্রাণখোলা হাসি রাহুলের ভীষণ পছন্দ প্রায়শই ও নানা আহানা বাহানায় আদর’কে হাসায়। মেয়েটার হাসিতে-ই যে লুকানো ওর পরিপূর্ণতা।

_______________

সকাল সকাল রাদ আয়নার সম্মুখে দাঁড়িয়ে। নিজেকে দেখছিলো সে সূক্ষ্মভাবে। রাতে ঘুমিয়ে পরেছিলো ক্লান্তিতে। ইরা কল ম্যাসেজ করেছিলো ও ধরতে পারেনি। এখন ও কল দিয়েছে মেয়ে’টা ধরেনি। ওর ভারাক্রান্ত চিন্তার মধ্যে হঠাৎ ঘুমঘুম কণ্ঠে কাশিশের গলা ভেসে এলো কর্ণধারে। ওর ফিচলে গলা,

—” কিরে তুই কী নার্ভাস তোকে তোর দুই শ্বশুর পছন্দ করবে নাকি না? ”

রাদ থতমত খেয়ে চমকে উঠলো। আরশি’র মধ্যে কাশিশের দিক চেয়ে স্বাভাবিক গলায় শুধালো,

—” মোটেও তেমন কিছু না। আমি শুধু ভাবছিলাম ইরা কল রিসিভ করছে না কেন? ”

ঠিক তখনই রাদে’র ফোন শব্দ করে বেজে উঠলো। কাশিশ দাঁত কেলিয়ে বলল,

—” পিরিতের আঠা লাগলে বড় ছাড়ে না। প্রেমের মরা জলে ডুবে না। ”

রাদ রাগান্বিত চোখে বন্ধু’কে শাসিয়ে। ফোন হাতে বারান্দায় চলে গেলো। কল রিসিভ হতে-ই ইরা ওপাশ থেকে বলে উঠলো,

—” স্যার, ইন্টারভিউ এ-র জন্যে রেডি তো? বস কিন্তু চারজন! ”

রাদ হাসলো। হঠাৎ কী ভেবে ভ্রুঁদ্বয় কুঁচকে বলল,

—” চার জন্য বসের হিসেবটা কিন্তু বুঝলাম না। ”

—” অভিমান ফেলে রাহুল ভাইয়া বাসায় ফিরেছে রাদ। ভাইয়ার সাথে আদি ভাইয়াও যাবে। বড় বাবা স্পষ্ট বলে দিয়েছেন। ”

রাদ একটু ভেবে বলল,

—” আচ্ছা আমাদের কী রাহুল ভাইয়া হেল্প করতে পারতেন না? আমাদের এতটা প্যারা কেন নিতে হলো? ”

—” নিতে হলো কারণ। ভাইয়া নিজেই বাসায় ছিলো না কিভাবে হেল্প করতেন। ”

—” তা-ও ঠিক। উনার বিয়েই বাসায় এতদিন পর মেনে নিলো। তাহলে আমাদের তো প্যারা নিতেই হতো! ”

ইরা হাসলো। রাদ সম্পূর্ণ ঘটনা জানে না কেন রাহুল বাড়ি ছেড়েছিলো। শুধু জানে লাভ ম্যারেজ করার জন্যেই রাহুল’কে বাসায় মেনে নেওয়া হয়নি। ইরা একটু হেসে বলল,

—” যা-ও ব্রেকফাস্ট করে রেডি হ’য়ে নাও। ৬-টা বেজে গিয়েছে। এখন বায়। ”

—” ওকে ম্যাডাম, আপনিও আমার বৌ হওয়ার জন্য তৈরী হয়ে থাকুন বাই। ”

যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হতে-ই ইরা লাজুক হাসলো। ইশ ও রাদে’র বৌ হবে। ওর প্রাণপুরুষের সঙ্গে আজ থেকে এক সাথে থাকবে। নাহ্ ও এতো দূর ভাবা ঠিক হচ্ছে না। আগে সবাই রাদ’কে পছন্দ তো করেনিক। আরেকটু মাত্র অপেক্ষা।

_________

ঘণ্টা খানেক পর ইরা রুম ছেড়ে বেরিয়ে এলো। এলাহি আয়োজন চলছে খান বাড়িতে। সকাল সকাল তোড়জোড় শুরু হ’য়ে গেলো কিসের এতো আয়োজন? ইরা কিচেনে উঁকিঝুঁকি দিতেই দেখলো কেউ নেই বাহির থেকে শব্দ আসছে। মীতি ইরা’কে দেখে এগিয়ে এলো বোনের গলা জড়িয়ে ধরলো নিভৃতে। ঘুম ঘুম কাঁদ কাঁদ গলায় বলল,

—” আপু তোমার সত্যি মনে হয় আজ রাদ ভাইয়ার সাথে বিয়ে হ’য়ে যাবে। বড় বাবা সকাল সকাল বাড়িতে বিশ জন মানুষের আয়োজন করতে বলেছেন ইবরাহীম কাকু’কে। বাহিরে বড়সড় একটা আয়োজন হচ্ছে। ”

ইরা’র বুকটা ধ্বক করে উঠে বোনের এহেন কথায়। হাত-পায়ে অস্বাভাবিক কম্পন অনুভব করে ও। হৃদস্পন্দন স্পন্দিত হচ্ছে অস্বাভাবিক মাত্রায়। ভয় নাকি উত্তেজনা কিংবা খুশী কিছু টের পাচ্ছেনা। আবার হুট করে নিজ শরীরের কন্ডিশন উপেক্ষাও করতে পারলো না। মীতির উপর সমস্ত ভার ছেড়ে দিলো মেয়ে’টা। মীতি ভয় পেয়ে গেলো। হন্তদন্ত হয়ে ওকে শক্ত করে ধরে চেঁচিয়ে উঠলো,

—” আপু ঠিক আছো? কী হলো? ”

ওর গলা শুনে আদি রুম থেকে দৌড়ে এলো সঙ্গে সঙ্গে ইরা’কে কোলে তুলে নিলো। মীতি নিজেও ভাইয়ের পিছনে পিছনে গেলো। ইরা’কে বেডে শুইয়ে দিয়ে আদি মীতির উদ্দেশ্যে রাগান্বিত গলায় বলল,

—” কী বলেছিস ওকে? ”

মীতি আমতা আমতা করে ভীতসন্ত্রস্ত নিরীহ গলায় বলল,

—” আমি তো শুধু বলছিলাম। আজ আপুর বিয়ে। ”

আদি চোখ বন্ধ করে দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বোনের উদ্দেশ্যে বিরক্ত গলায় শুধালো,

—” যা পানি নিয়ে আয়, আর কাউকে বলবি না ও প্যানিক হ’য়ে গিয়েছে। যা! ”

মীতি মাথা দুলিয়ে চলে গেলো৷ আদি ইরা’র মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে ওর পাশে বসলো। ওর দিকে একটু ঝুকে ফিসফিস করে বলল,

—” বিয়ের করার এতো তারা ছিলো। এখন যখন বিয়ে হচ্ছে তখন খুশি হওয়ার বদলে অসুস্থ কেন হচ্ছো? ”

ইরা চোখ পিটপিটিয়ে চক্ষুদ্বয় মেলে স্থির চাইলো আদি’র দিকে। এক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে ওর চোখে আদি। ইরা নরম গলায় থেমে থেমে বলল,

—” অনাকাঙ্ক্ষিত দিন’টা হুট করে জীবনে চলে এলে-ও তোমাদের ছেড়ে যেতে হবে এটাও তো কখনো ভাবিনি। কষ্ট হচ্ছে হুট করে বাস্তবতার মুখোমুখি হ’য়ে। ”

আদি ভ্রুঁদ্বয় উঁচিয়ে অদ্ভুত ভঙ্গিতে আওড়ালো,

—” তোর এতটা বিশ্বাস বিয়ে’টা রাদের সঙ্গে হবে? রাদ’কে অপছন্দ হলে আমার সাথেও হতে পারে। ”

ইরা তৎক্ষনাৎ দৃঢ়ভাবে শুধালো,

—” উহুম, আমার জন্ম হয়েছে রাদের জন্য আদি ভাইয়া। ওকে ছাড়া আমার বিয়ে হতে-ই পারেনা। ”

আদি নিষ্পলক চেয়ে রইলো ইরা’র শ্যামবর্ণ মায়াবী গড়নের মুখ’টায়। বিয়ের সময় মেয়েরা কী একটু বেশী সুন্দর হ’য়ে যায়। পূর্বে শুধু শুনেছিলো ইরা’কে দেখে সেটি পুরোপুরি বিশ্বাস হলো। কেমন অন্যরকম লাগছে আজ মেয়েটাকে যেন এক রাতেই আরেকটু রূপ ঢেলে দেওয়া হয়েছে মায়াবী মুখটায়।

আদি হাত বাড়িয়ে ছুঁয়ে দিতে চায় প্রেয়সীর মুখটা। বাধাগ্রস্ত হয় বোনের আগমনে। তৎক্ষনাৎ উঠে দাঁড়ায় ইরা’র পাশ থেকে। মীতি পানি এনে খাইয়ে দিলো ইরা’কে। পানি খেয়ে একটু স্বাভাবিক হয় ইরা। আদি এক নজর গাঢ় চোখে সেদিকে চেয়ে বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে যায়। আজ আর বাড়ি ফিরবে না ও। নিজ বাড়ি থেকে প্রেয়সী’কে অন্য একটা রাজপুত্র তুলে নিয়ে যাবে এটা আদি কেন পৃথিবীর কোনো প্রেমিক পুরুষ সহ্য কর‍তে পারবে না। আদিত্যের এভাবে চলে যাওয়া আজমল খান দেখলেন দূর থেকে কিন্তু কিছু বললেন না। মনে মনে ছেলে’র এ-ই কাজ’কে উনি উত্তম কাজ ভেবেনিলেন।

_______

কখনো কখনো ভীষণ জীবনের কঠিন পরিস্থিতির গুলো খুব সহজে মিটে যায়৷ অনেক কষ্টের পর আল্লাহতালা আমাদের জীবন এতটা সহজ করে দেন। যে আমরা খুশি হ’য়ে যাই। এটা হয়তো আল্লাহতালার রহমত। তেমনি রহমতের সাথে ইরা এবং রাদে’র বিয়ে’টা ঠিক হ’য়ে গেলো অত্যন্ত সহজভাবে।

এবং এ-ই কাজ রাহুল সম্পূর্ণ করেছে শুধু মাত্র বোনের জন্য। রাদে’র সম্পর্কে আজমল খান, আজীম খান আগেই খোঁজখবর নিয়েছিলেন। ফলস্বরূপ আজমল খান ছিলেন জলের মতো শান্ত। আজীম খান একটু অসন্তুষ্ট ছিলেন। এ-র কারণ রাদ ভীষণ সম্ভ্রান্ত পরিবারের ছেলে হলে-ও সে নিজের বাবা-র সহায়সম্পদের জন্য নিজের বাপ চাচাদের নিকট শত্রুর ন্যায়। ফলাফল রাদ মাকে নিয়ে দূরে থাকে। কিন্তু রাহুল যখন বাবা’কে রাদ সম্পর্কে ভালো করে বুঝায় তখন। আর দুই পরিবারের কেউ দেখাদেখিতে যায়নি। ফোনের মাধ্যমে আজকেই বিয়ে সম্পূর্ণ হবে বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন জুহা এবং ইরা’র বাবা। ফলাফল খান বাড়িতে এতো আয়োজন।

ইরা সব জানতে পেরে বিমূর্ত ছিলো। ভাইয়ের প্রতি ভালোবাসা দ্বিগুণ বেড়ে গিয়েছিলো। ও ভাবতেও পারেনি ওর ভাই ওকে এতটা বিশ্বাস করে। যে ওর চাওয়ার বিপরীতে আরেকটি ঘটনাও ঘটতেও দেয়নি।

অতঃপর রাদে’র বাড়ি থেকে ইরা’র জন্যে সকল তথ্য পাঠিয়ে দেওয়া হলো। ইরা রাদে’র মা’য়ের এবং একমাত্র বন্ধু কাশিশের পছন্দের শাড়ি, গহনা দিয়ে সাজল লাল টুকটুকে বৌ। অপেক্ষায় প্রিয় প্রাণপুরুষের সঙ্গে সারাজীবনের জন্য বেঁধে যাওয়ার। বলাবাহুল্য এতদ্রত সব আয়োজন হয়েছে বলে বাড়তি ঝামেলা করতে পারেনি সময়ের অভাবে। ফলাফল নিজে-ই নিজেকে সাজিয়েছে ইরা। অবশ্য পাশে ছিলো আদর ভাবী এবং মীতি।

____________

দুপুর ঠিক ২-টায় রাদ নিজের পরিবার প্রিয়জন নিয়ে এলো। প্রেয়সীকে নিজের নামে করে নিতে। রাদ ইরা’র বাড়ি’র সম্মুখে যখন এসে পৌঁছালো ওর পুরনো স্মৃতি গুলো দৃশ্যপটে ভেসে উঠছিলো। বারবার মনে হচ্ছিলো আর লুকিয়ে চুড়িয়ে এ-বাড়ি আসতে হবেনা কখনো। ইরা আজকের পর ওর সাথে সারাজীবন থাকবে।

কাশিশ অত্যন্ত খুশি ছিলো বন্ধুর জন্য, হৈ-হুল্লোড় করে রাদ’কে ভেতরে নিয়ে এলো কাশিশ৷ আজমল খান আজীম খান সহ বাড়ি’র সকলে সরাসরি রাদ’কে দেখে মুগ্ধ হলেন। জামাতা হিসেবে রাদ’কে অপছন্দ করা’র ভাষা নাই কোনো। বিয়েতে রাদ সাদা পাঞ্জাবি’র উপর লাল কটি পরেছে, পায়ে সু, হাতে ঘড়ি সর্বদার মতো নিখুঁত এবং সাধারণের মধ্যেও অসাধারণ।

অতঃপর দুপরিবারের সকলে সকলের সাথে পরিচিত হলো। রাদে’র সঙ্গে এসিছিলো ওর দাদি, ফুফু, জুহা, কাশিশ। পারিবারিক ঝামেলার বেশ ধরে চাচারা কেউ রাদের বিয়ে আসেনি৷ ইরা’র পরিবারের থেকেও কিছু ঘনিষ্ঠ আত্মীয় স্বজন ছিলো বিয়েতে। সব মিলিয়ে বিশজন-ই হবে। দুই পরিবারের সন্তুষ্টি’র সাথে-ই বিকেল ৪-টায় দু’জনের বিয়ে সম্পূর্ণ হয়। অদ্ভুত বিষয় তখনো ইরা রাদ একে অপরকে দেখেনি। বিয়ে পড়ানোর পর দু’জন’কে পাশাপাশি বসানো হয় ইরা’র রুমে। সুন্দর আয়নার দু’জনের মুখ দেখানোর আয়োজন হলো কাজিনরা মিলে।

রাদ মুগ্ধ চোখে চেয়ে ছিলো ইরা’র চোখেমুখে। ইরা লজ্জায় রাঙা হ’য়ে উঠছিলো বারবার। রাদ সকলের আড়ালে ফিসফিস করলো,

—” মেয়ে পাগল তো সে-ই কবে থেকে করছো। পাগল সামলানোর জন্য তৈরী তো? ”

ইরা’র কান গরম হ’য়ে গেলো। রাদ এভাবে কথা বলতে পারে বিশ্বাস হচ্ছিলো না। ইরা’কে ঢোক গিলতে দেখে রাদ আড়ালে হাসে। ওদের নিয়ে তখন সবাই ছবি তুলতে ব্যাস্ত। হাসি মজায় আনন্দে শেষ মুহুর্ত ঘনিয়ে এলো। বিদায় বেলা ইরা’র কান্না দেখে মনেই হয়নি ওর এ-ই বিয়েতে মত ছিলো। রাদ বিস্ফোরিত চোখে চেয়ে ছিলো ইরা’র চোখেমুখে, জলরাশীর আবাদ বিচরণ মেয়েটার চোখে মুখে। প্রথমে চমকে উঠলেও দুই বাবা’কে ধরে ইরা’র কান্না রাদে’র বুকে যেন কেউ ছুড়ি চালালো। আড়ালে নিজেও চোখ মুছলো। মেয়েদের বিদায়ে কতটুকু কষ্ট হয় হয়তো সত্যি অনুধাবন করতে পেরেছিলো। বাড়ি’র সকলের কান্নারত অবস্থায় শেষে অনেকটা জোর করে ইরা’কে গাড়িতে তুলেদেয় ইরা’র ছোট্ট ফুপি।

ইরা গাড়িতে উঠেও কাঁদছিলো। দূর থেকে আদি সে-ই শব্দ স্পষ্ট শুনতে পারছিলো। মনে মনে বলল,

—” এটুকু কষ্ট তোর পাওয়ারই ছিলো। শুনেছি কাউকে কাঁদিয়ে কেউ সুখী হতে পারেনা। কিন্তু আমি দোয়া করি তুই ভীষণ সুখী হ ইরাবতী। ততটুকু সুখী যতটুকু সুখী থাকতে দেখলে আমি তোকে না পাওয়ার কষ্ট ভুলে যেতে পারবো। ”

_______

শা শা গতিতে গাড়ি চলছে ঢাকা’র পথে। কাশিশ ড্রাইভ করতে ব্যাস্ত। ইরা রাদে’র বুকে মাথা রেখে এখনো ফুপিয়ে যাচ্ছে। রাদ ওর কাপালে বেশ কিছু চুমু খেলো। বিড়বিড়িয়ে আওড়ালো,

—” প্লিজ কেঁদো না ইরানী, তোমার কান্না আমার সহ্য হয়না। ”

ইরা কাঁদতে কাঁদতে-ই শুধালো,

—” এটুকু শুনতেই আমি চিরজীবন কাঁদতে চাই। ”

—” তোমাকে কাঁদতে দিলে তো কাঁদবে? ”

—” ভালোবাসি হাসবেন্ড! দাঁড়াও একটা ছবি তুলে নে-ই। ”

অতঃপর শুরু হ’য়ে গেলো ইরা’র ফটোগ্রাফি। ইরা রাদ এবং ওর হাতে সুন্দর আংন্টি দুটো ফোকাস করে একটা ছবি তুললো। এরপর সেলফি তখনো ওর চোখে পানি তবে এবার সুখের নাকি দুঃখের বোঝাগেলো না। রাদ হাসলো ইরা’র বাচ্চামি দেখে। এ-ই বাচ্চা মেয়েটা ওর ইরানী আজ থেকে ওর এটা ভাবতেই যেন রাদে’র খুশি’র ঠিকানা থাকছেনা। কিন্তু ও সেটা প্রকাশ করতে পারছে না। শান্ত গম্ভীর মানুষ কিনা। হঠাৎ ইরা ওর চোখে চোখ রেখে দৃঢ় গলায় শুধালো,

—” এবার আপনি খুশি স্যার? ”

রাদ কিছু বলতে পারলো না। হঠাৎ ইরা’কে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলল। ইরা হতভম্ব প্রস্ফুটিত চক্ষে চেয়ে রইলো শূন্যে ছেলেরাও এভাবে কাঁদতে পারে ওর জানা ছিলো না। কাশিশ সম্মুখে বসে একটু হাসলো সত্যি ভালোবাসা দেখতেও ভালোলাগে। অবশেষে রাদে’র তীব্র খুশি’টা কান্না রূপেই বেরিয়ে এলো। ইরা ভীষণ ভাগ্যবতী নাহলে পুরুষ মানুষের সুখের কান্নার কারণ হতে পারতোনা।

ইরা রাদ কাঁদতে কাঁদতে-ই এগিয়ে চললো নতুন এক জীবনে’র আশায়। যেখানে একে অপর’কে হারিয়ে ফেলার ভয় নে-ই। শুধু আছে একে অপরের নিয়ে বাঁচা হাজারো স্বপ্ন।

_______

রাহুল আদি’র কাঁধে ভরসার হাত রেখে পাশাপাশি হেঁটে বাড়ির দিক একগুচ্ছে। নিশ্চল হাঁটার ভঙ্গি রাহুলের যেন শরীরে প্রাণ নে-ই কিন্তু মানুষ’টা বেঁচে আছে। রাহুল যেন নিরবে ভাই’কে বুঝাচ্ছে এক গল্পে কখনো সকলে ভালো থাকতে পারেনা। ভালো খারাপ মিলিয়েই জীবন।

ইরা রাদের একে অপর’কে পাওয়ার যুদ্ধ আজ শেষ হলে-ও। আদি’র নিজেকে পাওয়ার লড়াই হয়তো আজ থেকে শুরু। কেননা ও তো হারিয়ে গিয়েছে ইরা’তে। হয়তো একদিন ও নিজেকে নিজে খুজে পাবে, চাওয়া পাওয়ার যুদ্ধ শেষ হবে, শুরু হবে আরেকটি পরিপূর্ণতার গল্প….!

ততক্ষণ ভালোবাসার অপরাধে পুড়তে হবে ওকে, হয়তো নিজেকে কখনো খুঁজেই পাবেনা আদি। এটাই হয়তো হবে ওর ভালোবাসা’র পরিপূর্ণতা। কখনো কখনো অপূর্ণতাও সৌন্দর্য সৃষ্টি করে।

সমাপ্ত!