এমন দিনে তারে বলা যায় পর্ব-০১

0
386

এমন দিনে তারে বলা যায়
পর্বঃ০১
সানজিদা মাহি
__________________________________________

দেখতে দেখতে আকাশ ঘন কালো মেঘে ছেয়ে গেল। শুরু হলো মেঘের তুমুল গর্জন। কিছুক্ষণ আগেও ফকফকা রোদ ছিল। অথচ বলতে বলতেই শুরু হলো আকাশের হম্বিতম্বি। আষাঢ় মাসের এই এক মিশ্র রূপ। কখনো রোদে ঝলমল করে, কখনো দেখা যায় আকাশ জুড়ে নীল সাদা মেঘের ভেলা। আবার কখন বলতে বলতেই আকাশ ভেঙে অশ্রু নামে। হঠাৎ ঝপাঝপ করে মুশলধারে বর্ষন শুরু হলো। জানালা দিয়ে বৃষ্টির ছাঁটা এসে বোরকা অনেকখানি ভিজে গেল। জানালাটা অর্ধেক টেনে দিলাম। বৃষ্টি ছোটবেলা থেকেই আমার ভারী পছন্দের। হাত মোজা জোড়া খুলে ডান হাত বাড়িয়ে দিলাম বাইরে। এমন শান্তি লাগছে! বৃষ্টি যাদের অপছন্দনীয় বস্তু তারা কিছুতেই এই শিহরিত অনুভূতি উপলব্ধি করতে পারবে না। ট্রেনের গর্জন আর মেঘের বর্ষন দুটো মিলে অন্যরকম এক পরিবেশ।

কেবিনের দরজা খুলে উনি ভিতরে প্রবেশ করলেন। শার্ট ঝাড়তে ঝাড়তে সামনের সিটে বসলেন। নিশ্চিত বাইরে থেকে সিগারেট খেয়ে এসেছেন। গন্ধটা যেমন বিরক্তিকর তেমনি অপছন্দের। আমি চুপচাপ বসে বাইরের প্রকৃতি দেখছি। ছোটবেলায় দলবেঁধে বৃষ্টিতে ভিজতাম। বাড়ির উঠানে ইচ্ছাকৃতভাবে ঝুপঝাপ করে আছার খেতাম। আর একজন আরেকজনের পড়ে যাওয়া দেখে হাসতে হাসতে নিজেরাই পুনরায় আছার খেতাম। এরপর ফের দলবেঁধে পুকুরে ঝাপ দিতাম। কে কার আগে এ পাড় থেকে ওপাড়ে যেতে পারে সে নিয়ে চলতো প্রতিযোগিতা। ইশ কি সুন্দর ছিল শৈশবের সে দিনগুলি! মূলত যতদিন নানুবাড়ি ছিলাম ততদিন আমার জীবনটা অন্যরকমের ছিল। গ্রামের সেই গন্ধটা বোধ হয় এখনো কাটিয়ে উঠতে পারিনি। গ্রামের সেই প্রাণোচ্ছল, সতেজতায় মাখা, সবুজে আচ্ছাদিত যাপিত জীবন। তাই তো সেই গন্ধের তাড়নায় ট্রেনের সাথে সাথে আমার মনটাও ছুটে চলেছে নির্দিষ্ট গন্তব্য ছুঁয়ে দিতে।

সামনের মানুষটা একটু গলা খাঁকারি দিয়ে জিজ্ঞেস করলো, ‘চা খাবেন?’
জানালার বাইরে থাকা হাতটা গুটিয়ে নিয়ে বললাম,
‘ জ্বি নাহ ‘
চা খাব নাহ শুনে তিনি আবার বেরিয়ে গেলেন। চা খাবেন কিনা জানি না তবে সিগারেট একটা না খেয়ে আসবেন বলে মনে হয় না। আমি সিটে পা উঠিয়ে আরাম করে বসলাম। বর্ষাকাল আমার বরাবরই প্রিয় ঋতু। বর্ষা এলেই মনের মধ্যে ভেজার জন্য কাতুকুতু শুরু হয়ে যায়। মনে হয় মাথার ভেতর পোকাগুলো কুটকুট করে কামড়াতে থাকে। যতক্ষণ না ভিজছি ততক্ষণ অবধি শান্তি নেই। পোকাগুলো ক্রমাগত তাড়া দিতে থাকে। বাইরে বৃষ্টির ছন্দপতন ঘটছে। একবার বেশ জোরেশোরে তো একবার গতি কমে আসছে। আমি হাতটা আবারও আপনাতেই বাইরে বের করে দিয়েছি। ফোঁটায় ফোঁটায় মুক্তগুলো টুপ টুপ করে হাতের উপর পড়ে গড়িয়ে পড়ছে নিচে। খানিকক্ষণ বৃষ্টি বিলাস সেরে জানালাটা টেনে দিয়ে বিরাট সাইজের সুটকেসটা খুলে একটা বই বের করলাম। এতো বড় একটা সুটকেস কিন্তু জামাকাপড় নিতান্তই। বেশিরভাগ জায়গা জুড়ে বই এ ঠাঁসা হয়ে আছে। এমন একটা অজপাড়াগাঁয়ে যাব। বেশিরভাগ সময় একা একা থাকতে হবে সেই চিন্তা থেকে যত পেরেছি বই নিয়ে নিয়েছি।

কেবিন খুলে তিনি আবার এসে সামনের সিটে বসলেন। যা ভেবেছিলাম আবারও সিগারেট খেয়ে এসেছেন। ভদ্রলোকের সিগারেট খাওয়ার বাতিক আছে দেখা যাচ্ছে। এ পর্যন্ত ছয়-সাতবার বাইরে গেলেন আর যতবার ফিরে এলেন ততবার সিগারেটের উটকো গন্ধ তীব্র থেকে তীব্রতর হলো।

বৃষ্টি থেমেছে অনেকক্ষণ হয়েছে। গাছপালা বৃষ্টির পানি পেয়ে কেমন সতেজতায় ছেয়ে গেছে, যেন প্রতিবার তারা প্রাণ ফিরে পায়।
‘সব গুছিয়ে নিন। আমরা প্রায় এসে পড়েছি।’

চট করে বইটা ব্যাগে ঢুকিয়ে হাত মোজা পরে নিলাম। ট্রেনের গতি ক্রমশ কমতে লাগলো। একসময় স্থির হয়ে এলো। তিনি একহাতে তার ব্যাগ আরেক হাতে আমার সুটকেস নিয়ে হাঁটা শুরু করলেন। আমিও পিছু পিছু তাকে অনুসরণ করতে লাগলাম।

গৌরীপুর জংশন। ছোট্ট একটা রেলওয়ে স্টেশন। একপাশে লাল রঙের টিকিট ঘর। ঘরের দেয়াল জায়গায় জায়গায় রঙ ওঠা, পেলেস্তার খসে গেছে কয়েক জায়গায়।আরেকপাশে একটা ছোট খাটো আধ ভাঙা চায়ের দোকান। ট্রেন থেকে নেমে স্টেশনের টিকিট ঘরের সামনে এসে দাঁড়ালাম। অবাক হওয়ার বিষয় হচ্ছে আমরা দুজন ছাড়া আর কোনো যাত্রী নামেনি। অবশ্য যাত্রীর সংখ্যাও খুব একটা বেশি ছিল নাহ। কোথা থেকে দশ-এগারো বছরের একটা ছেলে দৌড়ে এসে উনাকে উদ্দেশ্য করে বলল, ‘স্যার আইসা পড়ছেন!’
উনি জবাব নাহ দিয়ে আমাকে বললেন, ‘আপনি ভিতরে গিয়ে বসুন আমি আসছি।’ তারপর ছেলেটার দিকে ঘুরে বললেন, ‘নজু আয় তো আমার সাথে।’

আমি ভিতরে নাহ গিয়ে বাইরের সিমেন্টের বেঞ্চিতে বসলাম। আবারও বৃষ্টি পড়া আরম্ভ হয়েছে। রেললাইনের ওপর পাশে মোটামুটি বিরাট সাইজের একটা গাছ। গাছে অসংখ্য ছোট ছোট জলপাই রঙের ফুল। অফুরন্ত ঘ্রাণ আসছে ফুলগুলো থেকে। ঠিক মাতাল হয়ে যাওয়ার মতো। নাম নাহ জানা গাছটার একটা নাম দেয়া উচিত। অন্তত যে গাছে এত মাতাল ঘ্রাণের ফুল থাকে, নাম ছাড়া কি তাকে মানায়? ঘ্রাণের সাথে মিলিয়ে গাছটার নাম রাখলাম সুবাসিনী। দোকানের দিকে তাকিয়ে দেখলাম তিনি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে চা খাচ্ছেন আর কিসব বলছেন দোকানদারকে। ছোট ছেলেটাও পাশে দাঁড়িয়ে শুনছে৷ আমি আবার বৃষ্টি দেখায় মন দিলাম। ছোটবেলাটা দাদু বাড়িতে কাটলেও বাবার চাকরির সূত্রে বড় হয়েছি মফস্বলে। সেখানে এতো সবুজের সমারোহ নেই। বর্ষাকালের সৌন্দর্য উপভোগের সুযোগ নেই। অবশ্য নিম্ন মধ্যবিত্তদের অতো শৌখিনতা দেখিয়ে কি লাভ? বৃষ্টি বরং তাদের বিরক্তির কারণ। কতকিছুর লোকসান গুনতে হয়। মাকে দেখেছি বৃষ্টি এলেই মুখটা বিরক্তে ছোট হয়ে যেত। আর বাবা সবসময় যে অখুশি হতেন তা কিন্তু নয়। বরং মাঝে মাঝে বৃষ্টির দোহাই অফিস কামাই করা যেত। সেদিন তার মুখ থাকতো বেশ উৎফুল্ল। মাকে ডেকে বলতেন,
” কিগো ভাজাপোড়া কিছু টিছু হবে নাকি? ”
মা শুনতে পেয়েও না শোনার ভান করতেন। তবে বাবা একই কথার পুনরাবৃত্তি করলে বলতেন,
” চুলায় রান্না বসিয়েছি। পারব না এখন ওসব। পারলে নিজে করে খাও গে ”
অগত্যা কি আর করা! বাবাকে আমার দ্বারস্থ হতে হতো। আমার অবশ্য খারাপ লাগতো না বরং বেশ লাগতো৷ আমি ভাজাপোড়া তেমন পছন্দ না করলেও বাবার সাথে গল্প করতে করতে টুকটাক খেতাম। মধ্যবিত্তদের এসব স্বাভাবিক, অতি সাধারণ মুহূর্ত গুলোও একেকটা অসাধারণ ঘটনা। অন্তত ওদেরকে এতটা পিছনে ফেলে এই অপরিচিত জায়গায় বসে আমার তা-ই মনে হচ্ছে।

উনি ফিরে এসে বললেন, ‘চলুন বৃষ্টিতে ভিজেই যেতে হবে । নয়তো নৌকা পাওয়া যাবে নাহ। আপনার অসুবিধা হবে না তো?’
‘না। কিসের অসুবিধা?’

কাঁদামাখা মাটির রাস্তায় হেঁটে জুতা-বোরকা সবকিছুর বেহাল দশা। বোরকা যতটা সম্ভব ধরে ধরে হাঁটছি। তারপরও নিচের অংশ পুরো কাঁদায় মাখামাখি হয়ে গেছে৷ দশ মিনিট হাঁটার পর নদীর পাড়ে পৌছালাম। একজন মাঝি নৌকা নিয়ে বসে আছে দেখা যাচ্ছে। আমি উনার পিছু পিছু নৌকায় উঠে বসলাম। সেই ছোট ছেলেটা নজু যার নাম, সেও এসেছে ব্যাগ বহন করে এগিয়ে দিতে। আমাদের নৌকা ছাড়ার বেশ কিছুক্ষণ পরও সে পাড়ে দাঁড়িয়ে ছিল। নৌকার মাঝের ছাউনিতে বসেছি আমি। ভেজা বোরকা, জামা কাপড় সব মিলিয়ে যাচ্ছেতাই অবস্থা। আমার আবার সেঁতসেঁতে ভাব পছন্দ না। গা কেমন কেমন করে। মনোযোগ অন্যদিকে নিতে সামনে তাকালাম। নদীতে দলবদ্ধভাবে ভেসে বেড়াচ্ছে কচুরিপানার দল। ঝিরিঝিরি বৃষ্টির ফোঁটা গুলো পানিতে পড়ছে। তাতে সমতল পানির মাঝে খুঁত সৃষ্টি হচ্ছে৷ মাঝি ধীরে সুস্থে নৌকা চালাচ্ছে আর তার কাছাকাছি বসে আছেন উনি। পাড়ের দিকে তাকিয়ে আছেন উদাসীন হয়ে।

আমাদের বিয়ে হয়েছে সবে পাঁচদিন। উনার ছুটি শেষ বলে আজই চলে আসতে হলো। আমার অবশ্য এ নিয়ে কোনো মাথাব্যথা নেই। বিয়ের সময়ই কথা হয়েছে উনার সাথে এখানে থাকব। আমি নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে। মাকে হারিয়েছি চার বছর বয়সে। সৎ মায়ের কাছে মানুষ হয়েছি। তিনি কখনো অন্য চোখে দেখেননি তবে মায়ের ভালোবাসাটা মা ছাড়া আর কারও কাছ থেকে পাওয়া যায় নাহ। ছোটবেলায় মাকে জড়িয়ে ঘুমালে মায়ের গা থেকে একটা মা মা গন্ধ পেতাম। সে গন্ধ এখনো যেন আমি অনুভব করতে পারি। সৎ মাও আমাকে কাছে টেনে নিয়েছিলেন তার অন্য সন্তানদের সাথে। চারটে ছেলেমেয়ে মানুষ করা চাট্টিখানি কথা নয়। মা চলে যাওয়ার পর তিনি এসে সংসারের হাল ধরলেন৷ বাবার সামান্য বেতন দিয়েই চলতো পুরো সংসার এবং চার ভাই-বোনের পড়াশুনো। ছোটবোনটার পড়ার প্রতি কোনো ইচ্ছে ছিল নাহ বলে আমার দু বছর আগেই তার বিয়ে হয়ে যায়। ভাইয়েরা একজন গ্র্যাজুয়েশন শেষ করে চাকরির পাওয়ার জন্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে আরেকজন এবার নবম শ্রেণিতে পড়ে৷ আমি স্নাতক দ্বিতীয় বর্ষে পরীক্ষা দিয়েছি। এখনো ফলাফল বের হয়নি। এরমধ্যে সম্বন্ধ এলো। ছেলের নাম মাহমুদ। স্নাতক পাশ করেছে। স্টেশন মাস্টার। সরকারি চাকরি করে এরকম ছেলেকে কি করে ফিরিয়ে দেয়া যায়? এতো ভালো সম্বন্ধ পেয়ে বাবা-মা যারপরনাই খুশি হলেন। কিন্তু আমার চিন্তা ছিল অন্যরকম। বিয়ে নিয়ে আমার উচ্চাকাঙ্ক্ষা ছিল না। এমনকি বিয়ে নিয়ে কখনো স্বপ্ন দেখাও হয়নি। একদিন বিয়ে হবে এটা জানতাম। ভাবতাম বিয়ে করলে অন্তত ধার্মিক ছেলেকে করব যে আমার ধর্মীয় কাজে বাঁধা দেবে নাহ বরং এরকম একজনকে পেলে রবের সান্নিধ্য পাওয়া সহজ হবে। তবে সে আশায় পড়লো গুড়ে বালি।

ছেলে যেদিন দেখতে এলো দেখেই বুঝেছি এ ছেলে ঠিকমতো নামাজই পড়ে নাহ আর বাকিগুলো তো বাদই। মুখে চাপ দাঁড়ি থাকলেও প্যান্ট পরা ছিল টাকনুর নিচে৷ আমার কেন জানি ছেলের আচরণে মনে হলো আমাকে তার পছন্দ হয়নি। তার উদাসীনতা দেখে ভরসা পেলাম। মনে মনে দুআ করতে লাগলাম যাতে পছন্দ নাহ হয়। দেখে যাওয়ার পর তিনদিন কোনো খবর নেই দেখে আমি নিশ্চিন্ত মনে ঘুরে বেড়াতে লাগলাম। যাক সম্বন্ধ তাহলে বাতিল হলো। বাবা-মাকে মুখ ফুটে নাহ করার মতো অবস্থা না আমার। আমি কখনোই তাদের উপর কোনো কথা বলিনি। তাদের সিদ্ধান্তই ছিল আমার সিদ্ধান্ত। আর ভাই-বোনদের মধ্যে সম্ভবত ভালোবাসা, স্নেহের চেয়ে সম্মানটাই অতিমাত্রায় ছিল। যার ফলে যেকোনো কথা অকোপটে তাদের সাথে বলা যেত না। তিনদিন পর বাবা হাসিমুখে বাড়িতে এসেই আমাকে ডাক দিয়ে খুশিতে গদগদ হয়ে বললেন, ‘মা তোর সম্বন্ধ পাকাপাকি করে এলাম। ওদের তোকে পছন্দ হয়েছে আলহামদুলিল্লাহ। এই শুক্রবারে কাজি নিয়ে আসবে।’

দেখতে দেখতে নৌকা তীরে এসে থামলো। উনি ভাড়া দিয়ে নামতেই আমিও নেমে গেলাম। নামতে একটু বেগ পেতে হলো। কিন্তু আমি নেমেছি কি নামেনি তা দেখার অপেক্ষা নাহ করেই মশাই আপন খেয়ালে হাঁটতে লাগলেন।

নদীর প্রায় কিনারা ঘেঁষে উল্টো মুখ করে একটা একতলা বাড়ি। উপরে সিমেন্টের ঢেউ খেলানো ছাদ। ঘরের সামনের অংশ নিচু দেয়াল দিয়ে ঘেরা। মাঝে একটা উঠানের মতো জায়গা। আমার হাতে ব্যাগ দিয়ে সুটকেসটা একপাশে রেখে উনি ঘরের তালা খুললেন। ভিতরে অন্ধকার হয়ে আছে। সামনের রুমে ঢুকেই আগে বোরকা খুললাম। ভিজে বোরকা নিয়ে আর পারছি না। গোসল করাটা খুব দরকার। উনাকে বাথরুমের কথা জিজ্ঞেস করাতেই দেখিয়ে দিলেন। রুম পরে দেখা যাবে। আগে গোসল করে নেই বলেই বাথরুমে ঢুকলাম। ছোট একটা বাথরুম। ভেন্টিলেটর দিয়ে খানিকটা আলো আসছে। মনে আসা স্যাতস্যাতে ভাবটা কোনো রকমে চাপা দিলাম। মনকে বোঝালাম, এরচেয়ে খারাপ অবস্থা হতে পারতো!

দুই কামরার একটা ঘর। মাঝখানে লম্বা বারান্দার মতো। বারান্দার এক পাশে রান্নার ব্যবস্থা, অন্য পাশে বাথরুম। ঘরে আসবাবপত্র বলতে এক রুমে একটা খাট, একটা আলনা, একটা টেবিল, দুটো চেয়ার। আরেক রুমে একটা চৌকি আর বসার জন্য একটি পিঁড়ি। আসার পর ঘর অনেক অগোছালো ছিল। চুলায় ভাত বসিয়েই ঘর গোছানো শুরু করেছি। আশ্চর্যের বিষয় হলো ঘরে একটাও সিগারেটের প্যাকেট পাইনি৷ মাথার ভেতরের পোকাগুলো ফের কুটকুট করতে লাগলো। তাহলে কি উনি ঘরে সিগারেট খান না? উফ! উত্তরটা না জানা পর্যন্ত স্বস্তি পাচ্ছি না। মনকে অন্যদিকে ফেরানো প্রয়োজন।

তরকারি কিছু নাহ পেয়ে আলু দিয়ে ডিমের সালুন করেছি। তিনি সেই যে স্টেশনে গেলেন তাড়াতাড়ি ফিরবে বলেও এলেন নাহ। নদীর ওপার থেকে মাগরিবের আজান ভেসে এলো। নামাজ পড়ে সামনের রুমের জানালার পাশে এসে দাঁড়ালাম। বৃষ্টি নেই তবে শো শো বাতাস হচ্ছে। সেই সাথে ডেকে ডেকে হয়রান হচ্ছে ব্যাঙ মশাইরাও। ক্ষিদেয় পেট চোঁ চোঁ করছে। একা একা খেয়ে ফেললে অভদ্রতা হবে। উনি কখন আসেন কে জানে। হারিকেনের আলোয় ঘরের ভেতর মায়া মায়া একটা দৃশ্যপট তৈরি হয়েছে। নদীর ওপারে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র আলোর ফোটা দেখা যাচ্ছে। দূরের কোনো ঘর বা দোকান থেকে আসছে হয়তো। ভুলে গিয়েছিলাম যে এই বিস্তীর্ণ জনশূন্য জায়গায় আমি একদম একা। আমি মাঝে মাঝে ভাবি আরণ্যক উপন্যাসের প্রধান চরিত্রের জায়গায় আমি হলে কি করতাম? যদিও অতটা সাহস আমার নেই। তবু ভাবতে ভালো লাগে। চারদিকে সবুজের রাজত্ব। আর তার মাঝে আমার একার বাস….

চোখ প্রায় লেগে এসেছিল। এমন ঠান্ডা শীতল পরিবেশে ঘুম ভালো হয়। এমন সময় দরজায় ঠকঠক আওয়াজ হওয়ায় উঠে যেতে হলো। দরজা খুললাম। উনি ভেতরে এসে অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে বললেন, ‘আসতে একটু দেরি হয়ে গেল সরি। খেয়ে ফেলেছেন?’
‘নাহ। আপনি হাত-মুখ ধুয়ে নিন। আমি খাবার বারছি।’

উনি খুব তৃপ্তির সঙ্গে ভাত খাচ্ছেন। তার খাওয়া দেখে আমার কেমন মায়া লাগলো। ঘরে আর কিছু ছিল নাহ বলে এক পদ করতে হলো। একা একা এমন নিরিবিলি একটা জায়গায় থাকেন। নিজে রেঁধে কি না কি খান। গল্প করার সঙ্গী না হোক রান্না করার জন্য হলেও একজনের দরকার আছে। খাওয়া শেষ করে আমার দিকে তাকিয়ে একটা লাজুক হাসি দিলেন।
‘ইয়ে মানে…রান্না ভালো হয়েছে’
‘ধন্যবাদ’

খাওয়া শেষ করে উনি গুটিসুটি মেরে খাটের এক কোনায় গিয়ে শুয়ে পড়লেন। আমিও সমস্ত কিছু গুছিয়ে শুয়ে পড়লাম। জানালাটা খোলাই থাকুক। বাতাসটা ভালো লাগছে। তন্দ্রা ছুটে যাওয়াতে এখন আর ঘুম আসছে না। বাইরে ঘুটঘুটে অন্ধকার। এক কাপ চা খেতে পারলে ভালো হতো। আমার আবার ঘন ঘন চা খাওয়ার বাতিক আছে। ঘর গুছানোর সময় গুঁড়া দুধ পাইনি তবে চা পাতি আছে। উনার দিকে একবার তাকিয়ে দেখলাম, ঘুমিয়ে গেছেন। চুপিসারে উঠে গিয়ে চুলা জ্বালালাম। চায়ের পানি ফুটছে। সারা ঘরের অন্ধকারের মধ্যে চুলার হালকা আগুন মৃদু আলো দিচ্ছে। চা বানানোর পর চুলা বন্ধ করে দেয়ার আগে হারিকেনটা জ্বালিয়ে আঁচ কমিয়ে দিয়ে ঘরের এক কোণায় মেঝেতে রাখলাম। চা নিয়ে দাঁড়ালাম জানালার সামনে। চুলের খোঁপা খুলে দিলাম, বাতাসে উড়ুক। চা টা কড়া হয়েছে, খেতে ভালো লাগছে। কোথা থেকে যেন একটা জোনাকি পোকা এসে জানালা দিয়ে ঘরে প্রবেশ করলো। এই অতি সামান্য ও আবছায়া আলোর মাঝে জোনাকিটা জ্বলছে, নিভছে। আমার একেবারে সামনে দিয়ে গিয়ে ঘরময় ঘুরতে লাগলো। অদ্ভুত সুন্দর!

চলবে ইন শা আল্লাহ….