জলফরিং পর্ব-০১

0
503

#জলফরিং
#রোজা_ইসলাম
#পর্ব_১

—” রাদ আজ ৭ দিন হয়ে গেলো তুমি আমার ফোন তুলছ না! ম্যাসেজ সিন করছ না। রিপ্লাই দূর! কোনও প্রকার যোগাযোগেই আসছ না। কেন এমন করছ? কী করেছি আমি আবার?”

রাদের শান্ত, স্বাভাবিক জবাব,

—” আ’ম টায়ার্ড ইরা। ইম্পর্ট্যান্ট কিছু বলার হলে বলো। আদারওয়াইজ রাখো। আ’ম টু ম্যাচ বিজি! ”

ইরা স্তম্ভিত রাদের জবাবে! একটা পুরা উইক ধরে একটা মানুষ এত ব্যাস্ত যে একটা ছোট্ট টেক্স করে বলতে পারে না, আমি ব্যাস্ত! তাকে নিশ্চয়ই এতটুকু ইমপোর্টেন্স দিয়ে ইরা বলতে পারবেনা। আমি চিন্তিত ছিলাম পাশাপাশি তোমার সাথে একটু কথা বলার জন্য আমি মরে যাচ্ছিলাম। আমার প্রাণটুকু কেরে নিও না রাদ! আমার সাথে দুদণ্ড একটু ভালোবেসে কথা বলো প্লিজ! আমাকে বাঁচাও। এই য’ন্ত্র’ণা অনুভূত থেকে!

দীর্ঘশ্বাস ফেলে ইরা সাবলীল ভাবে বলল,

—” তুমি রেস্ট করো! রাখছি!”

বাক্যশেষে রাদ’কে কিছু বলতে না দিয়ে হাতের যান্ত্রীক লাইন বিছিন্ন করলো ইরা। ও জানে এমন না রাদ আর কিছু বলতো ও ওকে। তাই নিজেই রেখে দিয়েছে। শুধু শুধু নিজেকে কে ছোট করতে চায়?

৩ বছরের সম্পর্ক রাদের সাথে ইরার। প্রণয়ের শুরুটা ইরা’ই করেছিলো। ধীরে ধীরে তাল মিলাতে থাকে রাদ নিজেও। তবে রাদ বরাবরই একটু রাশভারী, গম্ভীরমুখো মানুষ এবং সল্পভাষী। যেটা প্রথমে ভালো লাগলেও ধীরে ধীরে রাদের এই অভ্যাস তীব্র যন্ত্রণার কারণ হচ্ছে ইরার কাছে৷ এই যেমন চাপা অভ্যাসের জন্য রাদ তার সকল কিছু নিজের মনে রাখতেই পছন্দ করে। বলতে গেলে স্বাচ্ছন্দ্যে বোধ করে। এতে ইরার কোনও সমস্যা নেই। কিন্তু সমস্যা তখনই হয়ে দাঁড়ায় যখন রাদ ওর উপর রেগে যায়৷ তখনও রাদ অভ্যাস বসত ইরাকে কিছুই বলে না। যে কী কারণে সে ইরার উপর রেগে আছে। শুধু ফোন দেয় না, টেক্স করে না। বলতে গেলে যোগাযোগি বিচ্ছিন্ন করে দেয়৷ রাদ বুঝেনা ও যদি নিজের ভেতরের কিছু প্রকাশই না করে তাহলে ইরা বুঝবে কী করে! যে সমস্যা কোথায়। কী ভুল ও করেছে? ওতো অন্তরজামি নয় যে এমনই মানুষের মন বুঝে যাবে। রাদের মন পরে ফেলবে!

ইরা এটুকু বুঝতেই পারছে রাদ আবার কোনও কারণে রেগেছে ওর উপর! সেজন্যে এতদিন যোগাযোগ করেনি। আর আজ এভাবে কথা বলেছে। কিন্তু ইরাও এবার ঠিক করেছে। এমন বদের সাথে ও আর সম্পর্কই রাখবেনা।

আত্মসম্মান নদীতে বাসিয়ে নিজের ভুল কী না জেনেই ও বারবার স্যরি বলে রাদের রাগ ভাঙিয়েছে। আর না এবার হয় রাদের মুখ খুলতে হবে। না হয় ও এই সম্পর্কের মুখই একেবারে ভেঙে দিবে ইরা! অনেক হয়েছে সাইলেন্ট টর্চার ওর উপর এবার ও আর একটি বার ও কল দিবে না ওই বদের বদকে!

কান্নার ফলস্বরূপ ফুলে যাওয়া ডাগর আঁখি দুটো শেষ বারের মতো মুছে নিলো ইরা তারপর ছাদ থেকে ধুপধাপ পা ফেলে নিচে নেমে গেলো। মনে মনে একটা কথাই ভাবছে ইরা রাদ কেন আর পাঁচটা ছেলের মতো হলো না। রাগ উঠলে ছেলে মানুষ গালাগালি করে, চেঁচামেচি করে, ঘরে ভাঙ্গচুর করে, তারপর আবার ঠিক হয়ে যায় আর রাদ! এই বদ একটা এলিয়েন কেমনে পারে যাকে ভালোবাসে তার সাথে এতগুলো দিন কথা না বলে থাকতে? রাদ যেহেতু পারে ও কেন পারেনা! সব আবেগ কেন ওর। কেন ওর আবেগ এত বেশি হতে হবে! ভেবে ভেবে নিজেকেই গালি দেয় ইরা।

রুমে এসে বসতেই দেখে ওর মা রুম ঝাড়ু দিচ্ছে এবং রেগুলার বক্তব্য উচ্চস্বরে পেশ করছে,

—” ৫ টা বাজে ঘুমিয়ে ২ টা বাজে উঠবে। পড়ালেখা নাই, খাওয়া-দাওয়া নাই। গোসলটাও দেয় না এ কেমন মেয়ে পেটে ধরলাম আমি? খচ্চর! নিজের ঘর গোছাবে মেয়েকে দেখবো ওতো বিলাসিতা। হ্যাঁ এসব আমার কপালে নাই। মীতি মেয়েটা কত লক্ষ্মী ওকে দেখে একটু শিখলেও মানুষ হতো। ”

আর পারলো না ইরা চোখ বন্ধ করে শ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে বলল,

—” হ্যাঁ তো মা এক কাজ করো মীতিকে নিজের মেয়ে বানিয়ে নাও আর বড় বাবাকে বলো আমায় নিয়ে নিতে। তাহলে অন্তত রোজ রোজ তোমার ঘ্যানের ঘ্যানের আমাকে শুনতে হবেনা। আর তাছাড়া বলে রাখা ভালো আজ শুক্রবার বলেই আমি একটু দেড়িতে ঘুমিয়েছি এবং উঠেছি। রোজ আমি এমন করিনা! প্রতিদিন সকাল ১১টায় আমার ক্লাস নিশ্চয়ই তুমি করে দেও না!”

বলেই ও ধুপধাপ পা ফেলে বাহিরে চলে আসলো। ইরার মা “হা” করে তাকিয়ে আছে ওর যাওয়ার দিকে! আজকাল মেয়েটা মুখের উপর কথাও বলে। বেয়াদব, বেয়ারা হচ্ছে স্পষ্ট ওর ব্যাবহারে! মেয়ের উল্টাপাল্টাও ব্যাবহার ঠিকি চোখে পরে ইরার মায়ের কিন্তু একমাত্র মেয়ে বলে খুব একটা কিছু বলতে পারেনা। তাছাড়া খাল কেটে কুমির’কে ডাকবেন! দীর্ঘশ্বাস ফেলে ঘর গুছাতে মনোযোগী হলেন তিনি।

ইরা বাহিরে গিয়ে দেখলো ড্রইংরুমে মীতি হাসছে নিশ্চয়ই ওর ঘরে বলা কথা শুনেই এভাবে হাসছে। মীতির হাসি দেখে ইরার রাগ তুঙ্গে উঠে গেলো, সোফায় উঠে কুসুন হাতে নিয়ে মীতির উপর আচমকা আক্রমন করে বসলো ইরা! এতে মীতির হাসির মাত্রাই বাড়লো আর কিছুই হলো না। কেননা কুসুনের বাড়িতে তেমন কিছুই ওর হচ্ছে না। ইরা রাগান্বিত কণ্ঠে বলল,

—” ফাজিল মেয়ে কী তাবিজ করছিস আমার মাকে বল। সারাদিন তোর নাম জপতে জপতে আমার কান ঝালাপালা করে দেয়। আজ তোকে মেরেই ফেলবো আমি। ”

মীতির হাসির মাত্রা আরো বাড়লো ইরার কথা শুনে। ঠিক তখনই কর্নকুহরে এলো এক স্তম্ভিত গম্ভীর কণ্ঠস্বর,

—” এখানে কী হচ্ছে? ইরা থামো! ”

ইরা থেমেছে শুধু থামে’নি৷ যে শরীরের সর্বশক্তি দিয়ে মীতিকে মারছিলো সে এখন পাথর হয়ে দাঁড়িয়ে! আর যে এতো সময় খ্যাক, খ্যাক করে হাসছিলো সে মূর্তি হয়ে বসে। যেন ও নড়াচড়া করতেই জানেনা। দুজনের এহেন অবস্থা দেখে ইরার বড় মা আফরোজ কিচেনে ঠোঁট চেপে হাসছেন। পেছনে এসে যোগ হলো ইরার মা নিলাও৷

—” আমার ছেলে এসেছে না। এখন দেখবা সব ঠিক! ”

—” আদি বাবাই এই বাড়ির জন্য একদম ঠিক আছে। প্রত্যেকটাকে মানুষ করতে পারে!”

এদিকে আদি একবার ইরা, একবার মীতির দিকে তাকিয়ে প্রায় চিৎকার করে বলল,

—” ইরা, মীতি তোমার থেকে গুণে গুণে ‘দু’ বছরের ছোটো হয়েও তোমার থেকে ম্যাচিউর। আর তুমি! কবে বড় হবা তুমি?”

ইরার মন এমনেই ভালো ছিলো না। প্রথমে রাদ এবং মা এখন আদি সবার কথায় এবার কষ্টে ওর কান্না চলে এলো। চক্ষু গলা সব জ্বলছে। কান্না আঁটকে ঝটপট ক্ষীণ স্বরে বলল,

—” স্যরি ভাইয়া। ”

আর এক মিনিট দাঁড়ালো না ইরা ড্রইংরুমে দৌড়ে নিজের রুমে ঢুকে গেল। ইরার জন্য খারাপ লাগলেও মীতি কিছু বলতে পারলো না। কারণ ও নিজেই যমের মতো ভয় পায় তার ভাইকে। ও কেন বাড়ির সবাই আদিকে মেনে চলে। ওর বাবা এবং ছোট্ট বাবাও আদির কথাই শুনে চলে সেখানে ও তো পুচকে। নিজের ভাবনার মাঝেই মীতি খেল আরও একটা রাম ধমক!

—” মীতি সন্ধ্যে হয়েছে পড়তে যা! এক্ষুনি! ”

মীতি ধমকে লাফিয়ে উঠে তড়বড় করে বলল,

—” যাচ্ছি ভাইয়া! ”

মীতি দৌড়! আদি ইরার রুমের দিকে রীতিমতো ক্ষুব্ধ চক্ষু মেলে তাকিয়ে আছে। মেয়েটা বড্ড বেপরয়া। বাড়ির সবাই ওকে ভয় পেলেও ইরা ওকে মানতেই চায়না!

—” একবার বাগে পাই চরম শিক্ষা দেব তোমায় ইরা। দেখবে বেপরয়া স্বভাব জানালা দিয়ে পালিয়েছে। আমার ষষ্ঠ ইন্দ্রয় জানান দিচ্ছে তোমাকে একটা সঠিক শিক্ষা দেওয়ার একটা সুন্দর সুযোগ আমার জীবনে খুব দ্রুতই আসবে৷ ”

চলবে!