#জল-ফড়িঙের খোঁজে ❤
#লেখিকা: অনিমা কোতয়াল
#পর্ব- ২৩
.
বিহানের সাথে অনাথ আশ্রমে বেশ অনেকটা সময় কাটিয়েই ফ্লাটে ফিরেছে রিখিয়া। বিহানই ড্রপ করে দিয়েছে ওকে। ওর জীবনের সেরা দিনগুলোর মধ্যে একটা ছিল আজকে। অনাথ বাচ্চাগুলোর সাথে কিছুটা সময় কাটানোতে যে কতটা শান্তি আর আনন্দ থাকে সেটা এর আগে বোঝেনি। ফ্লাটে এসে রুমে এসে দেখে তুর্বী নেই এখানে। ও বেশ অনেকটা অবাক হল। তুর্বী কী আসেনি এখনও? এসব নানা কথা ভাবতে ভাবতে ব্যালকনি তে তাকিয়ে ওর মেজাজটা খারাপ হল। কারণ তুর্বী রেলিং এ পা ঝুলিয়ে বসে আছে। এতো করে বারণ করে এরকম করতে, মেয়েটাকে কিন্তু মেয়েটা শোনেই না। হুটহাট কোন দুর্ঘটনা ঘটে গেলে কী হবে? রিখিয়া ব্যাগটা রেখে ব্যালকনিতে গিয়ে তুরের হাত ধরে টেনে রেলিং থেকে নামিয়ে বলল,
” এসব কী তুর? কতবার বলেছি তোমাকে এরকম করবে না?”
তুর্বী মাথা চুলকে বিরক্তি নিয়ে বলল,
” আরে আমি ভালোভাবেই ধরে রেখেছিলাম তো।”
” দুর্ঘটনা জানিয়ে ঘটেনা।”
” আচ্ছা তোর এতো দেরী কেন হল? কোথায় গিয়েছিলি?”
” বিহানের সাথে দেখা করতে।”
তুর্বী ভ্রু বাঁকা করে বলল,
” বাহ! ভালোই তো শুরু হয়েছে তোদের।”
রিখিয়া হেসে রেলিং এ হেলান দিয়ে বলল,
” হ্যাঁ হ্যাঁ মজা নিতে থাকো। আজ তোমার প্রেজেন্টেশন ছিল না? কেমন হল?”
” জানিনা। কিন্তু আমার প্লানটাই এপ্রুভ হয়েছে।”
” আরেহ বাহ! দ্যাটস লাইক মাই গার্ল।”
তুর্বী কলারটা উঠিয়ে একটু ভাব নিয়ে বলল,
” দেখতে হবে কে করেছে বুঝলি।”
” তো তোমার বস কথা বলেছে পরে তোমার সাথে?”
” বলতে চেয়েছিল ইগনোর করে চলে এসছি। মামাবাড়ি নাকি হ্যাঁ? যখন ইচ্ছে সবার সামনে অপমান করবে। আবার ইচ্ছে হলে ডেকে মিষ্টি কথা বলবেন। আর আমিও সেভাবে নাচবো? হতেই পারেনা।”
রিখিয়া তুর্বীর পিঠে চাপড় মেরে বলল,
” বড় হও এবার।”
তুর্বী খিলখিলিয়ে হেসে দিয়ে বলল,
” তো আমাকে দেখে কী বাচ্চা লাগে? আমার কথা ছাড় তুই এটা বল যে বিহানের জন্যে কিছু ফিল করিস। ”
রিখিয়া হাসি থামিয়ে দিল। ও নিজেও বুঝতে পারছেনা আদোও বিহানের জন্যে ও কিছু ফিল করে কী না। তবে বিহানের আশেপাশে থাকতে ওর ভালোলাগে। বিহানের করা দুষ্টুমিগুলো ও এনজয় করে। যেই বিহানকে একদিন ওর অসহ্য লাগত সেই বিহানকেই একদিন না দেখলে ওর কাছে দিন অসম্পূর্ণ মনে হয়। এই অনুভূতির নাম ওর জানা নেই। তবে এটুকু জানে যে ওর অনুভূতি আছে। অবশ্যই আছে।
___________
আরো দুটো দিন কেটে গেল, এরমধ্যে সৌহার্দ্য তুর্বীর সাথে কথা বলতে চাইলেও তুর্বী ইগনোর করে চলেছে। শুধুমাত্র অফিসিয়াল কথা ছাড়া কোন কথাই বলে না। সৌহার্দ্য অফটপিক কোন কথা বললেই তুর্বী এড়িয়ে যায়। এমনিতেই সৌহার্দ্য রায়হান পরিচয়ে অফিস, S.R. পরিচয়ে রেডিও স্টেশন সামলাতে সামলাতে বেচারা হিমসীম খাচ্ছে তারওপর এই মেয়েটা। কী করবে সেটাই বুঝে উঠতে পারছেনা। এই মেয়েটাকে কে বোঝাবে যে ওর বাড়তি বকবক, দুষ্টুমি, বাচ্চামো এসব না দেখলে ওর ভালোলাগেনা। একদম ভালোলাগেনা।
মিসেস নাহার আজ রান্নাঘরে জমিয়ে রান্না করছেন। মেয়ে আর জামাই এসছে। তার চেয়ে বড় কথা বিহানও এসছে। শফিক রায়হান তো আপাতত আর এই বাড়িতে নেই তাই সৌহার্দ্য জোর করেই নিয়ে এসছে। তিন ভাইবোন আর দুলাভাই মিলে আড্ডা দিচ্ছে এখন। কিন্তু সৌহার্দ্যর মনোযোগ আড্ডায় কম অন্যদিকে বেশি। বিহান ব্যাপারটা লক্ষ্য করে হালকা করে একটা ধাক্কা মেরে বলল,
” সমস্যা কী? কী ভাবছিস।”
সৌহার্দ্য হালকা চমকে উঠল, এরপর মাথা নেড়ে ‘কিছুনা’ বোঝালো। নুসরাতের হাজবেন্ড ইকবাল বলল,
” আরে শালাবাবু বলে ফেলতো। আমরাইতো।”
বিহান বলল,
” ওয়ান সেকেন্ড, তুর্বীকে নিয়ে কিছু হয়নিতো।”
নুসরাত একটু অবাক হয়ে বলল,
” তুর্বী?”
সৌহার্দ্য বাঁধা দেওয়া সত্ত্বেও বিহান ওদের সবাইকে সবটা খুলে বলল। সবটা শুনে নুসরাত বলল,
” বাপড়ে আমার ভাইটাও তাহলে প্রেমে পরতে পারে?”
সৌহার্দ্য কিছু না বলে হাসল। কিন্তু নুসরাতকে বলল না ‘এমন কিছুই না’। কেন বলল না নিজেও জানেনা। তবে কী সত্যিই প্রেমে পরেছে? এসব ভাবনার মাঝে বিহান বলল,
” কী হয়েছে সেটাতো বলবি এবার?”
ইকবাল আর নুসরাতও বারবার জোর করছে বলার জন্যে তাই বাধ্য হয়ে সৌহার্দ্য বলেই দিল সবটা। সবটা শুনে বিহান আবার ওর সেই বিখ্যাত দমফাটা হাসি দিল। ইকবাল আর নুসরাতও মিটমিটিয়ে হাসছে। সৌহার্দ্য বলল,
” হাসিস না ইয়ার। ঝামেলায় আছি।”
এরমধ্যেই মিসেস নাহারের ডাক পরল আর নুসরাত আর ইকবাল উঠে চলে গেল। বিহান কোনমতে হাসি থামিয়ে দিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে সৌহার্দ্যর কাঁধে হাত রেখে বলল,
” ব্রো। নিজের ফর্মে গিয়ে ট্রায় কর, ঠিক হবে।”
বলে ডাইনিং এ চলে গেল। সৌহার্দ্যও চুপচাপ ভাবতে বসল।
____________
সন্ধ্যার পর তুর্বী সব গুছিয়ে নিয়ে তুর্বী ঠিকভাবে রেডি হয়ে বেড় হল অফিস থেকে। পার্কিং এরিয়া পাস করার সময় পেছন থেকে ‘তুর্বী বলে ডেকে উঠল’। তুর্বী পেছনে তাকিয়ে দেখল সৌহার্দ্য দাঁড়িয়ে আছে। তুর্বীকে দাঁড়াতে দেখে সৌহার্দ্য এগিয়ে আসল। তুর্বী স্বাভাবিকভাবে বলল,
” কিছু বলবেন স্যার?”
” চল আমার সাথে।”
” কোথায়?”
” কাজ আছে।”
” অফিসিয়াল কিছু?”
” না।”
” আমি এখন কোথাও যাবোনা স্যার। আমার লেট হয়ে যাচ্ছে ফিরতে হবে।”
সৌহার্দ্য পকেটে হাত ঢুকিয়ে তুর্বীর দিকে এগিয়ে গিয়ে বলল,
” তুমি আমাকে না করছ?”
তুর্বী ইতস্তত করে একটু পিছিয়ে গিয়ে বলল,
” দেখুন স্যার। আপনি আমার বস, সেটা অফিসের ভেতরে। এখন অফিস টাইম শেষ হয়ে গেছে। সো ইউ কান্ট ওর্ডার মি নাও।”
” আরে আমার কথাটাতো শোন?”
” সরি, বাট আমার সময় নেই।”
অন্যসময় হলে তুর্বী ঠিক শুনতো কিন্তু এখন তো ও সৌহার্দ্য ওপর যথেষ্ট রেগে আছে। তাই ইচ্ছে করেই কথা শুনছেনা। শুনবেও না। সেদিন এভাবে সবার সামনে অপমান করার সময় মনে ছিল না। তুর্বী চলে যেতে নিলেই সৌহার্দ্য সামনে দাঁড়িয়ে পথ আটকে বলল,
” কথাগুলো ইমপর্টেন্ট।”
তুর্বী ত্যাড়াভাবে জবাব দিল,
” আমার ফেরাটা আরও বেশি ইম্পর্টেন্ট।”
সৌহার্দ্যর এবার একটুখানি রাগ লাগছে। মেয়েটা তো কোন কথাই শুনতে চাইছে না। এসবের কোন মানে হয়? ও নিজের রাগটা কন্ট্রোল করে আঙ্গুল দিয়ে নাক ঘষতে ঘষতে বলল,
” লাস্ট টাইম বলছি। যাবে কী না?”
তুর্বী ঘাড়ত্যাড়ার মত করে বলল,
” নাহ মানে হল নাহ।”
সৌহার্দ্য হঠাৎ করেই তুর্বীকে কোলে তুলে নিল। তুর্বী বোকার মত তাকিয়ে আছে সৌহার্দ্যর দিকে। ও ভাবেও নি সৌহার্দ্য এমন কিছু করবে। সৌহার্দ্য তুর্বীকে গাড়িতে বসিয়ে সিটবেল্ট বেঁধে দিয়ে নিজে ড্রাইভিং সিটে বসল। ব্যাপারটা এত দ্রুত ঘটল যে তুর্বী কিছু বুঝে উঠতে পারল না। ও সবটা ঠিকভাবে বুঝতে বুঝতে সৌহার্দ্য গাড়ি স্টার্ট করে ফেলেছে। তুর্বী সৌহার্দ্যকে এটা ওটা জিজ্ঞেস করেই যাচ্ছে কিন্তু ও কোন উত্তরই দিচ্ছে না ও ওর মত গাড়ি চালাচ্ছে।
পার্কের একটা বেঞ্চে পাশাপাশি বসে আছে সৌহার্দ্য আর তুর্বী। তুর্বী দুইহাত এক করে থাই এর ওপর রেখে অন্যদিকে তাকিয়ে আছে। আসলে পার্কে এনে বসানোর পরেও তুর্বী কিছুক্ষণ চেঁচামেচি করেছে। সৌহার্দ্য ‘সরি’ বলায় শান্ত হয়েছে। বেশ কয়েকবার ‘সরি’ বলার পর তুর্বী বলেছে ভেবে দেখছে। আর সেই ভাবা এখনও চলছে। সৌহার্দ্য এবার একটু গলা ঝেড়ে বলল,
” ম্যাম? ভাবা হয়নি?”
তুর্বী আড়চোখে একবার সৌহার্দ্যর দিকে তাকাল কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে বলল,
” সরি এক্সেপ্ট করতে পারি একটা শর্তে।”
সৌহার্দ্য অবাক হল। সরি এক্সেপ্ট করার জন্যেও শর্ত? তবুও বলল,
” সেটা কী?”
তুর্বী সৌহার্দ্যর দিকে ঘুরে বসে উচ্ছসিত কন্ঠে বলল,
” আমার বয়ফ্রেন্ড হবেন? বিয়ে কমিটমেন্ট কিচ্ছু দরকার নেই। জাস্ট বয়ফ্রেন্ড। হ্যাঁ?”
সৌহার্দ্য বোকার মত কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলল,
” জাস্ট ফ্রেন্ড শুনেছিলাম। জাস্ট বয়ফ্রেন্ড কী জিনিস?”
তুর্বী হাসি মুখেই চঞ্চলতার সাথে বলল,
” মানে হল আমরা রিলেশন এ থাকব। কিন্তু কোন কমিটমেন্ট, ন্যাকামো, সিরিয়াসনেস লাইক ‘তোমায় ছাড়া এ জীবন ব্যর্থ’ এসব লেইম জিনিস থাকবেনা। শুধুই টাইম পাস ওয়ালা রিলেশনশীপ। এগ্রি? নাকি অন্য ছেলেদের মত আপনিও এটা শুনে ইউটার্ন মারবেন?”
#চলবে…
#জল-ফড়িঙের খোঁজে ❤
#লেখিকা: অনিমা কোতয়াল
#পর্ব- ২৪
.
তুর্বীর এরকম অফার শুনে সৌহার্দ্য হতভম্ব হয়ে গেল প্রায়। মেয়েটা এরকম কেন? এর আগে কেউ নিজেরই বসের সামনে এধরণের কথা বলার সাহস কেউ দেখিয়েছে কী-না ওর জানা নেই ওর। সৌহার্দ্য চোখ তুর্বীর দিকে পরতেই তুর্বী ভ্রু নাচাল। অর্থাৎ ও উত্তর শোনার জন্যে উৎসাঝঝহি। সৌহার্দ্যও গম্ভীরমুখে তুর্বীর দিকে কিছুক্ষণ তুর্বীর দিকে তাকিয়ে থেকে বলল,
” একটু ভেবে বলছি।”
তুর্বী মাথাটা দুলিয়ে ভাবুক হয়ে বলল,
” হুম ভাবুন ভাবুন।”
বলে অন্যদিকে মুখ করে বসে গুনগুনিয়ে গান গাইতে শুরু করল। সৌহার্দ্য তুর্বীর দিকে তাকিয়ে থেকে একটু হাসল। ব্যাপারটা বেশ হল। মেয়েটার কাছাকাছি থাকার জন্যে এরচেয়ে ভালো সুযোগ আর কী হতে পারে। তুর্বীকে ভালোবাসে কীনা জানেনা ও কিন্তু মেয়েটার কাছাকাছি থাকতে চায়। ওকে ভালোবাসতে চায়। ওর সাথে সময় কাটাতে চায়। তুর্বীর নিজের অজান্তেই সৌহার্দ্যর হাতে চাঁদ দিয়ে দিল। এবার তুর্বীর কাছাকাছি থেকে ও এটাও বুঝতে পারবে যে আদোও ও তুর্বীকে ভালোবাসে কি-না। আর যদি বুঝতে পারে যে ও তুর্বীকে ভালোবাসে। তাহলে? তুর্বীতো বলেই দিয়েছে ও সিরিয়াস না। তখন কী তুর্বী রাজি হবে ওর হতে? কেন হবেনা? আর যদি নাও হয় তাহলে বিয়ে করবে। হয়ত রিলেশন সিরিয়াসলি করতে চায়না কিন্তু বিয়েতো করবে কখনও না কখনও। তাহলে ওকে করতে নিশ্চয়ই অাপত্তি করবে না। এসব কথা মনে মনে আওরে নিয়ে সৌহার্দ্য হালকা গলা ঝাড়ল। তুর্বী ঘুরে তাকাতেই সৌহার্দ্য মুখটা একটু নির্দোষ টাইপ করে বলল,
” একটা জিনিস ভেবে দেখলাম যে ভুল যখন করেছি তখন সরি তো এক্সেপ্ট করাতেই হবে, এখন সরি এক্সেপ্ট করার শর্ত যদি এটাই হয় দেন কী আর করার? আই এগ্রি।”
তুর্বী চোখ বড় বড় করে তাকাল সৌহার্দ্যর দিকে। সৌহার্দ্য যে এভাবে মেনে নেবে সেটাও। নিজের কানকেও বিশ্বাস করতে পারছেনা। অবাক হয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে সন্দিহান কন্ঠে বলল,
” সিরিয়াসলি?”
সৌহার্দ্য একটু ঝুকে তুর্বী নাক আঙ্গুল দিয়ে ঘষা দিয়ে বলল,
” সিরিয়াসলি?”
তুর্বীকে আর কে পায়? এতোটাই খুশি ব্যাপারটাতে ও যে উত্তেজনায় সৌহার্দ্যকে জড়িয়ে ধরল। সৌহার্দ্য অবাক হয়নি কারণ তুর্বীকে এখন ও মোটামুটি চেনে। তাই ও কী করতে পারে আর না পারে সেটা সৌহার্দ্য জানে। তাই সৌহার্দ্য তুর্বীর পিঠে একহাত রেখে বলল,
” তুর্বী সবাই দেখছে।”
তুর্বী সৌহার্দ্যকে না ছেড়ে জড়িয়ে ধরে রেখেই বলল,
” তাতে কী? এখন তো আমরা গার্লফ্রেন্ড বয়ফ্রেন্ড রাইট?”
” হ্যাঁ কিন্তু এভাবে দেখলে লোকে খারাপ ভাববে।”
তুর্বী সৌহার্দ্যকে ছেড়ে দিয়ে বলল,
” ভাবুব গে। আই ডোন্ট কেয়ার।”
সৌহার্দ্য তুর্বীর দিকে তাকিয়ে আছে। ওর ঠোঁটে হালকা হাসি ঝুলে আছে। তুর্বী সৌহার্দ্যর দিকে তাকিয়ে ভ্রু নাচাল। সৌহার্দ্য হাসিটাকে প্রসারিত করে মাথা নেড়ে ‘কিছু না বোঝাল’। তুর্বী একটু আড়মোড়া ভেঙে বলল,
” প্রপোজ করুন।”
সৌহার্দ্য অবাক হয়ে বলল,
” কী?”
” এতে অবাক হওয়ার কী আছে? প্রেম করবেন না? সেটা হয়? আগে তো প্রপোজ করতে হয়। সেরকমটাইতো জানি। করুন!”
” আমি?”
” নয়ত কী আমি?”
” না..”
সৌহার্দ্যকে কথাটা শেষ করতে না দিয়ে তুর্বী রেগে গিয়ে বলল,
” আপনি করবেন নাকি?”
সৌহার্দ্য বোকার মত কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল তুর্বীর দিকে। এই মেয়ে নিজেই অফার টা দিল, এখন ওকে বলছে প্রপোজ করতে? বাহ রে বাহ। আর কী কী দেখতে হবে ওকে। ছোট্ট একটা শ্বাস ফেলল এরপর তুর্বীর দিকে তাকাল। লাইটের আলোয় উজ্জ্বল হয়ে আছে মুখটা, অজস্র চঞ্চলতা যেন ভর করেছে ওর মুখে, এক অদ্ভুত মায়া, সৌহার্দ্য সেই মুখের দিকে বেশ অনেকটা সময় তাকিয়ে থেকে নেশাক্ত কন্ঠে বলল,
” আই লাভ ইউ।”
তুর্বীর হঠাৎ করে কেমন যেন উঠল। কারণটা জানেনা কিন্তু ওর মনে হল ওর হৃদপিণ্ড এক সেকেন্ডের জন্যে থেমে গেছিল। পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নিয়ে বলল,
” হুম।”
তুর্বীর আওয়াজে সৌহার্দ্যরও হুস এল। ও ভ্রু কুচে বলল,
” শুধু হুম?”
তুর্বী অসহায় চোখে তাকিয়ে বলল,
” আই লাভ ইউ টু কী বলতেই হয়?”
সৌহার্দ্যর খুব হাসি পাচ্ছে এখন। মেয়েটা বেশিই অদ্ভুত। কিন্তু ওকে দিয়ে বলিয়ে ছেড়েছে তুর্বীকে তো ও ছেড়ে দেবেনা তাই মেকী হেসে মাথা ঝাকাল অর্থাৎ ‘ হ্যাঁ বলতে হয়’। তুর্বী মুখ ফুলিয়ে তাকাল সৌহার্দ্যর দিকে তারপর বলল,
” আই লাভ ইউ টু।”
তুর্বীর মুখে কথাটা শুনতে বেশ ভালো লাগল সৌহার্দ্যর। ও জানে তুর্বী মন থেকে বলেনি কিন্তু তবুও ওর ভালোলেগেছে। খুব বেশি ভালোলেগেছে। তুর্বী বলল,
” তারমানে আমারও আজ থেকে বয়ফ্রেন্ড আছে রাইট?”
সৌহার্দ্য হেসে দিয়ে বলল,
” হ্যাঁ। পুরো কিডন্যাপ করে নিয়েছো।”
” আর সেটা অাপনি?”
” দুঃখজনকভাবে।”
তুর্বী কিছু না বলে মুচকি হাসল। দুজনেই চুপ করে রইল বেশ অনেকটা সময়। তবে মনটা যথেষ্ট চঞ্চল হয়ে রয়েছে দুজনেরই। নিরব ভেঙ্গে তুর্বী বলে উঠল,
” আইসক্রিম খাবেন?”
সৌহার্দ্য কয়েকসেকেন্ড তুর্বীর দিকে তাকিয়ে থেকে ঠোঁট বাঁকিয়ে হেসে বলল,
” আজকে দিনটা আপনার মিস ভয়ংকরী। যা চাইবেন তাই হবে।”
তুর্বী চোখ ছোট ছোট করে তর্জনী আঙ্গুল উঁচু করে বলল,
” পাক্কা?”
সৌহার্দ্য তুর্বীর আঙুলের সাথে নিজের হাতের আঙ্গুল লাগিয়ে ধরে বলল,
“পাক্কা।”
______________
এলোমেলো বিছানাটা নিজের হাতে যত্ন নিয়ে ঠিক করছে রিখিয়া। মন খুব একটা ভালো নেই। বাড়ির অবস্থা তেমন ভালোনা। ওর ভাই একদমই টাকা পাঠায়না। ও একা চাকরি করে, শহরে থেকে চাকরী করে তারপর সেখান থেকে আবার পরিবারের জন্যে পর্যাপ্ত টাকা পাঠানো যে কত কঠিন সেটা শুধুমাত্র তারাই বোঝে যাদের এটা করতে হয়। মানুষের সুখ নামক জলফড়িং বড্ড অধরা রকমের। যখনই মনে হয় যে হাতে চলে আসবে উড়ে কোথাও একটা চলে যায়। তবুও আবার সেটাকে খুঁজতে তার পেছনেই ছোটে মানুষ। মানুষযে বড্ড সুখপ্রিয়। তুর্বী এসে পেছন থেকে দুইহাতে জড়িয়ে ধরল রিখিয়া। প্রথমে অবাক হলেও পরে মুচকি হাসল রিখিয়া। তুর্বীর দুইহাতের ওপর হাত রেখে বলল,
এসছো?”
” কী ব্যাপার এত খুশি যে? কার বারোটা বাজিয়ে এসছো?”
তুর্বী রিখিয়াকে ছেড়ে বিছানায় বসে ব্যাগটা রেখে বলল,
” তো তোর কী মনে হয়? আমি শুধু মানুষের বারোটা বাজাই।”
রিখিয়া একটু অবাক হওয়ার ভান করে বলল,
” বাপড়ে! তুমি আরও কিছু করো? গুড ভেরী গুড।”
” রিখু!”
” আচ্ছা বলো কী হয়েছে?”
তুর্বী টেনে রিখিয়াকে নিজের পাশে বসিয়ে বলল,
” অবশেষে আমার ইক্সপিরিমেন্ট সফল হবে।”
” কীসের?”
” কীসের আবার? প্রেমের!”
রিখিয়া বড়বড় চোখ করে তাকাল তুর্বীর দিকে।কথাটা ঠিক হজম হয়নি ওর। ও অবাক কন্ঠেই বলল,
” কোন অসহায় ছেলেটাকে এভাবে বলির বাকরা বানালে বলোতো?”
তুর্বী কলার ঠিক করতে করতে বলল,
” কে আবার সৌহার্দ্য। তোর চয়েজ আছে জানিস। তুই সেদিন ওনার নাম না নিলে আমার তো মাথাতেই আসতোনা ওনার কথা।”
” উনি রাজি হলেন?”
” বলেছে কে?”
” তুমি।”
” তাহলে? রাজি না হয়ে উপায় আছে।”
রিখিয়া অসহায় ভাবে তুর্বীর দিকে তাকিয়ে একটা শ্বাস ফেলল। এখন নিজের ওপরই রাগ হচ্ছে যে কেন মজা করে বেচারার নামটা বলেছিল সেদিন, অকারণেই ফাসল। রিখিয়া চিন্তিত কন্ঠে বলল,
” উনি জানেন তো তোমার দিক থেকে তুমি সিরিয়াস নও?”
তুর্বী বিছানায় শরীর এলিয়ে দিয়ে বলল,
” হ্যাঁ! আমি কিছু লুকিয়ে করিনা। তুইও বিহানকে বলে দেখ। তোদেরও একটা এক্সপিরিয়েন্স হয়ে যাবে।”
” আমার এসবের দরকার নেই। আমি ভালোবাসলে একজনকেই বাসব নিজের সবটা দিয়ে। আর এমন কাউকেই বাসব যার সাথে আমি সারাজীবন কাটাতে পারব। আর সেও শুধু আমাকেই ভালোবাসবে। বুঝলি?”
” হ্যাঁ সেই শুরু থেকেই শুনে আসছি। একটু কফি দে না প্লিজ।”
রিখিয়া যথেষ্ট চিন্তিত মুখ নিয়ে কিচেনে গেল।সৌহার্দ্যকে যেটুকু দেখেছে আর বিহানের মুখ থেকে যতদূর শুনেছে তাতে করে সৌহার্দ্য যথেষ্ট সিরিয়াস একটা ছেলে। আর জীবনের এত গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয়কে এত লাইটলি সে নেবে না। কিছু তো ব্যাপার আছে। সৌহার্দ্য তুর্বীর জন্যে কিছু ফিল করে না তো? তাহলেতো সর্বনাশ! তুর্বীর মনে কখনও এত সহজে অনুভূতি জাগবে না সেটা রিখিয়া জানে। যদি সেরকম কিছু হয় তো এটাতো নিশ্চিত যে সৌহার্দ্য কষ্ট পাবে।
_____________
রাত বারোটা চার বাজে। বিহান ধীরহাতে বোর্ডের ওপর রাখা সাদা কাগজে তুলি চালিয়ে যাচ্ছে। তীক্ষ্ম চোখে তাকিয়ে আছে কাগজটার দিকে আর গুনগুনিয়ে গান গেয়ে যাচ্ছে। অর্ধেক আঁকা হয়েছে সবে। এরমধ্যেই ওর ফোন বেজে উঠল। ফোনের দিকে তাকিয়ে দেখল রিখিয়া ফোন করেছে। একটু অবাক হল ও। কারণ রিখিয়া ওকে নিজে থেকে ফোন কোনদিনও করে না। হঠাৎ আজ করল যে? ফোনটা হাতে নিয়ে একটা বাঁকা হাসি হাসল ও। তারপর রিসিভ করে বলল,
” বাহবা। মহারানির আজ নিজে থেকে আমার কথা মনে পরল যে।”
রিখিয়া ঠোঁট চেপে একটু হেসে বলল,
” কেন পরতে পারেনা?”
” পারে। কিন্তু অবাক হলাম।”
” মাঝে মাঝে অবাক হওয়া ভালো। স্বাস্থ্যের জন্যেই।”
” তো এটা কে আবিষ্কার করল? ডক্টর রিখিয়া ইসলাম?”
বলে বিহান হেসে দিলো, রিখিয়াও হাসল খানিকটা। বিহান হাসি থামিয়ে বলল,
” খেয়েছো?”
” হম আপনি?”
”হুম।”
দুজনেই বেশ অনেকটা সময় চুপ ছিল। নিরবতা ভেঙ্গে বিহান বলল,
” দেখা করবে।”
রিখিয়ার আজ কী হল জানেনা কোনরকম সংকোচ ছাড়াই বলে দিল,
‘হুম।’
বিহান আবারও ঠোঁটে বাকিয়ে হাসল। লম্বা একটা শ্বাস ফেলে বলল,
” আচ্ছা কাল অফিস থেকে বেড় হওয়ার সময় পিক করে নেব।”
এরপর দুজনেই প্রয়োজনীয় অপ্রয়োজনীয় টুকিটাকি কিছু কথা বলল। বেশির ভাগই ছিল অপ্রয়োজনীয় কথা। এমনিই বলা হয় যেগুলো। ফোনটা রেখে মুচকি হাসল বিহান। ফোনটা পাশে ফেলে রেখে আবার তুলি চালানো শুরু করল। একটা বাজ পাখির চোখ টাইপ কিছু একটা আঁকছে ও। এবার ওর চোখের দৃষ্টি আরো তীক্ষ্ণ হল, হাত আরও দ্রুত চলছে। আবারও গুনগুনিয়ে গাইছে, ”আমাকে খুঁজে দে জলফড়িং”। পেন্টিং শেষ করে লম্বা একটা নিশ্বাস নিলো বিহান। এরপর বাজপাখির সেই চোখটার দিকে তাকিয়ে একটু হেসে বলল, “রিখিয়া ইসলাম?” বলে আবারও একই ভঙ্গিতে তাচ্ছিল্যের এক হাসি হাসল।
#চলবে…