জল-ফড়িঙের খোঁজে পর্ব-২১+২২

0
478

#জল-ফড়িঙের খোঁজে ❤
#লেখিকা: অনিমা কোতয়াল
#পর্ব- ২১
.

রাত বেশ হয়েছে। মার্চ মাস তাই হালকা গরম গরম ভাব আসছে। রিখিয়া আর তুর্বী পাশাপাশি শুয়ে আছে। রিখিয়া শান্ত হয়ে একপাশ হয়ে শুয়ে আছে মন খারাপ করে। কিন্তু তুর্বী তখন থেকে ছটফট করেই যাচ্ছে। কখনও এদিক ঘুরছে, কখনও ওদিক। এভাবেই চলছে। বেশ অনেকটা সময় পর রিখিয়া বলল,

” এমন করছ কেন? মন খারাপ?”

” তোরও তো মন খারাপ।”

রিখিয়া তুর্বীর দিকে ঘুরে বলল,

” হবেনা? বিহানের সাথে অকারণেই মিসবিহেভ করে ফেলেছি।”

তুর্বী লম্বা একটা শ্বাস ফেলে বলল,

” করার আগে মনে ছিলনা? আর তোর এত জ্বলছিল কেন হুম হুম?

” প্লিজ এখন আবার শুরু করিস না।”

” সরি বলে দে। তাহলেই তো হয়।”

” আরে ফোনটাই তো ধরছে না।”

” ডিরেক্ট দেখা করে নে।”

” হ্যাঁ এখন দেখছি সেটাই করতে হবে। তোমার কী হয়েছে?”

তুর্বী রিখিয়ার দিকে ভালোভাবে ঘুরে বলল,

” কিছুনা।”

রিখিয়া তুর্বীর চুলে আঙ্গুল নাড়তে নাড়তে বলল,

” এমনি এমনি মন খারাপ তুমি করবে না। আই নো। কিন্তু হয়েছেটা কী? অফিসে কিছু হয়েছে?”

তুর্বী মুখ গোমড়া করে উঠে বসে বলল,

” ঐ খবিশ মার্কা বসটার জন্যেই সব হয়েছে।”

রিখিয়া বেশ অবাক হল। সৌহার্দ্য আবার কী করল? ও ভ্রু কুচকে উঠে বসে বলল,

” কেন উনি আবার কী করল?”

” আমাকে সবার সামনে অপমান করেছে। সেটা করলেও ভালো ছিল। আমার ওয়ার্কিং স্কিলকেও ইনসাল্ট করেছে। আমি নাকি এই কাজের যোগ্য না।”

রিখিয়া চোখ ছোট করে বলল,

” তুমি কী করেছিলে? সে তো শুধু শুধু এসব বলবে না রাইট?”

” এবার আমি কিচ্ছু করিনি। আই সোয়ার?”

” উনি এমনিই বকলো?”

তুর্বী মুখ ছোট করে মাথা হালকা চুলকে বলল,

” আমাদের নেক্সট প্রযেক্টে বিল্ডিং এর ডিজাইনে একটু চেঞ্জেস্ আনতে বলেছিলাম। কিন্তু আমার আইডয়া ওনাদের ভালো লাগেনি। বাট আই সোয়ার আমার প্লানটা সবচেয়ে বেস্ট ছিল।”

রিখিয়া হাত ভাজ করে বলল,

” তুমি নিশ্চয়ই ঠিকভাবে প্রেজেন্ট করোনি। কিংবা এমন কিছু বলেছ যার জন্যে সৌহার্দ্য রেগে গেছিল।”

তুর্বী অনেকটা অবাক হয়ে বলল,

” বাঃ রে এখন আমার দোষ হয়ে গেল? এই তুই আমার বন্ধু নাকি ঐ সৌহার্দ্য রায়হানের?”

রিখিয়া হালকা হাসল তারপর বলল,

” আমি মিঃ সৌহার্দ্যকে না চিনলেও তোমাকে খুব ভালোভাবে চিনি। তাই তুমি উল্টোপাল্টা কিছু করতেই পার।”

” দূর!”

বলে চুপচাপ শুয়ে পরল। রিখিয়াও শুয়ে পরে বলল,

” আচ্ছা শোন আমার কথা। তুমি সৌহার্দ্যর সাথে কথা বল। আমার মনে হয় লোকটা একটু ফরমাল টাইপ। কাজ নিয়ে জোকস্, হাসি-মজা এসব পছন্দ করেন না। তুমি তোমার প্লানটা একটু ফর্মাল টাইপে প্রেজেন্টেশন এর মাধ্যমে ওনাকে বোঝাও, দেখবি ঠিক পছন্দ করবে। এবং এপ্রিশিয়েট ও করবে।”

তুর্বী অনেকটা অবাক হয়ে রিখিয়ার দিকে ঘুরে বলল,

” মানে যেই কথাটা আমি নরমালি, আনন্দের সাথে, একটু মজা নিয়ে বললে ভালো লাগতো না সেই একই কথা আমি ফরমাল ওয়েতে বললে ভালো লাগবে? কী অদ্ভুত রুলস ইয়ার।”

” এতো কথা না বলে যা আমি বললাম তাই করে দেখ।”

” পারবোনা। ওনার চেয়ে S.R. অনেক গুন বেশি ভালো। অন্তত এত রুড না।”

” বাহবা! এখন S.R. ভালো হয়ে গেলো?”

” হ্যাঁ হয়েছে। এখন ঘুমা তো।”

রিখিয়া ছোট্ট একটা শ্বাস ফেলে চোখ বন্ধ করল। কাল গিয়ে বিহানের সাথে ভালোভাবে কথা বলতে হবে। আজ শুধু শুধুই উল্টোপাল্টা বলে ফেলেছিল। বারবার ছেলেটাকে ভুল বুঝে হার্ট করে ফেলে। কিন্তু ওর কেন এত রাগ হচ্ছিল তখন? বিহানতো শুধুই ওর ফ্রেন্ড। তাহলে অন্য মেয়ের সাথে দেখে ও এতো রিঅ‍্যাক্ট কেন করল? এরকম করার তো কোন কথা ছিল না।

______________

বিহান আর সৌহার্দ্য লং ড্রাইভে বেড়িয়েছে। আজ ওদের দুজনেরই মন খারাপ। আর ওদের মন খারাপ হলে আর খুব ভালো হলে ওরা দুজন মিলে লং ড্রাইভে যায়। এখন একটা বড় মাঠে বসে আছে দুজন। বিহান বিয়ারের বোতলে চুমুক দিয়ে যাচ্ছে বারবার। অনেকটা সময় পর সৌহার্দ্য বলল,

” পিচ্চু অনেক হয়েছে এবার থাম।”

” নেশা হচ্ছেনা ব্রোহ!”

সৌহার্দ্য বিরক্ত হয়ে বলল,

” নেশায় টলছিস তুই টলরেডি।”

বিহান একটু হাসল। সৌহার্দ্যও চুপচাপ আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। বিহান বোতলে লম্বা একটা চুমুক দিয়ে বলল,

” ওরা এমন কেন ব্রো? আমার গোটা লাইফটা শেষ করে দিয়েছে। আমার বাবা, মা, মামু সবাইকে কেড়ে নিয়েছে। আমার সব সুখ কেড়ে নিয়েছে। আমার জীবন থেকে সব কেড়ে নিয়েছে। দে আর উইচ। আই হেইট ডেম। আই জাস্ট হেইট দেম।”

সৌহার্দ্য স্হির দৃষ্টিতে তাকাল বিহানের দিকে। বিহানের চোখে চিকচিক করা পানিটা স্পষ্ট দেখতে পেল ও। একহাতে নিজের সাথে জড়িয়ে ধরে বসে রইল। ছেলেটাতো এরকম ছিল না। সত্যিই কী এরকম একটা জীবন ওর পাওনা ছিল? আজ ও পুরো মেয়ে জাতটাকেই ঘৃণা করে। যদিও ওর জায়গায় দাঁড়ালে ভাবাটা অস্বাভাবিক কিছুই না। হঠাৎ কিছু একটা ভেবে সৌহার্দ্য বিহানের দিকে তাকিয়ে বলল,

” পিচ্চু তোর মনে এখনও এই ধারণা থাকলে রিখিয়ার সাথে ফ্রেন্ডশীপ কেন করেছিস? ওও তো একজন মেয়ে।”

বিহান আরেকটু হেসে বলল,

” ও তো.. ওকে তো..”

এটুকু বলতে বলতে বিহান ঘুমিয়ে পরল। সৌহার্দ্য ‘ পিচ্চু, পিচ্চু’ বলে কয়েকবার ডেকেও সাড়া পেলনা। দুহাতে বিহানকে ভালোভাবে জড়িয়ে ধরে বসে রইল। কিছুক্ষণ বিহানের ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল,

” এমন কিছু করিস না পিচ্চু যার জন্যে সবার মত আমাকেও তোকে ছেড়ে দিতে হয়। তোকে ছেড়ে দেওয়া আমার কাছে মৃত্যুর চেয়েও বেশি কষ্টকর হবে। মেরে ফেলিস না আমায়।”

কিছুক্ষণ ওখানে বসিয়ে রেখে সৌহার্দ্য বিহানকে ধরে উঠিয়ে গাড়িতে তুলে নিজে ড্রাইভিং সিটে বসে ড্রাইভ করতে শুরু করল। মনটা প্রচন্ড রকম খারাপ হচ্ছে। প্রথমত বিহান। আর দ্বিতীয়ত তুর্বী সারাদিনেও ওর ফোন ধরেনি। কাল অফিসে আসবে তো? নাকি জব ছেড়ে দেবে? এসব কিছু ভাবতে ভাবতেই মাথা যন্ত্রণা হচ্ছে ওর।

_____________

সৌহার্দ্য অফিসে বসে কাজ করছে আর বারবার সিসি টিভিতে স্টাফ রুম চেক করছে। কিন্তু তুর্বীর দেখা নেই। মনটা অস্হির হয়ে উঠছে। তুর্বী কী সত্যিই আর আসবেনা? না আসলে ওর কী? ওর কেন এত খারাপ লাগছে? তুর্বীতো একটা সামান্য স্টাফ। এরচেয়ে বেশি কিছুতো না। এসব ভাবতে ভাবতেই তুর্বীকে দেখতে পেল ও। সবে ডেস্কে এসে বসেছে। সাথেসাথেই মুখে হাসি ফুটে উঠল ওর। দ্রুত পিওন দিয়ে ডেকে পাঠালো তুর্বীকে। বেশ অনেকটা সময় পর দরজায় কেউ নক করে বলল,

” মে আই কাম ইন?”

সৌহার্দ্য সাথে সাথেই বলল,

” ইয়াহ কাম।”

তুর্বী গম্ভীর মুখে ভেতরে এলো। সৌহার্দ্য ইশারা করতেই চেয়ারে বসে বলল,

” কিছু বলবেন স্যার?”

সৌহার্দ্য দুইহাত একত্র করে তার ওপর থুতনি রেখে বলল,

” তুমি কী শিওর যে আমাদের প্লানে তুমি যেই চেঞ্জেস আনতে চাইছিলে সেটা পার্ফেক্ট?”

তুর্বী একটা তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বলল,

” সেটাকি এখন মেটার করে?”

” অবশ্যই করে। তাইতো জানতে চাইছি।”

” আমি আমার কাজের ব্যাপারে যথেষ্ট সিরিয়াস স্যার। তাই আমি অবশ্যই কোন ইউলেস কথা বলব না।”

” কাল মিটিং ক্যান্সেল করে দিয়েছি। আজ বিকেলে আবার হচ্ছে। তুমি যেই চেঞ্জগুলোর কথা বলছ সেটা প্রেজেন্টেশন আকারে অফিসিয়াল ওয়েতে সবার সামনে প্রেজেন্ট করবে।”

তুর্বী একই ভঙ্গিতে হেসে বলল,

” কেন? এবার কী ঘটা করে অপমান করবেন?”

” ভেবে নাও আমার করা আপমানের যোগ্য জবাব দেওয়ার একটা সুযোগ পাচ্ছ।”

তুর্বী ভ্রু কুচকে তাকাল। স‍ৌহার্দ্য হেসে বলল,

” ইয়েস। সরি বলবনা তোমাকে। কারণ সরি বললেই সবকিছু ঠিক হয়ে যায় না। তাই একটা সুযোগ দিচ্ছি। প্রুভ ইউর সেলফ। এন্ড প্রুভ দ্যাট আই ওয়াজ রং।”

সৌহার্দ্যর কথা শুনে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে তুর্বী। সৌহার্দ্য আবার বলল,

” তোমার হাতে সময় খুব কম আছে। যাও আর প্রেজেন্টেশন রেডি কর।”

তুর্বী কিছু না বলে চুপচাপ উঠে চলে গেল। সৌহার্দ্য তুর্বীর যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থেকে লম্বা করে একটা শ্বাস ফেলল। ও এখন বুঝতে পারছে তুর্বী অন্তত অফিসিয়াল ব্যাপারে কোন ভুলভাল কথা বলবে না। আর ওর মন বলছে আজ বিকেলে তুর্বী যোগ্য জবাব দেবে। সরি বলার চেয়ে এই অপরচুনিটি দেওয়াটাই বেশি ভালো ছিল বলে ওর মনে হয়।

___________

বিকেলের দিকে রিখিয়া বিহানের সাথে দেখা করতে একটা জায়গায় যাচ্ছে। কোথায় যাচ্ছে নিজেও জানেনা। কিছুদিন আগে ওকে একটা জায়গার ঠিকানা দিয়ে বিহান বলেছিল প্রতি রবিবার এখানে আসে। বিহান ফোন ধরছেনা তাই না বলেই চলে এলো। ঠিকানা অনুযায়ী এসে দেখে এটা একটা অনাথ আশ্রম। রিখিয়া বেশ অবাক হল। এখানে বিহান কেন আসবে? অবাক হয়েই ভেতরে ঢুকলো। ভেতরে ঢুকে আশ্রমের বড় মাঠের দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে গেল রিখিয়া। দুচোখে এমনিতেই মুগ্ধতা এসে ভর করল। বিহানের এক নতুন রূপের সাথে পরিচিত হল ও।

#চলবে…

#জলফড়িঙের খোঁজে ❤
#লেখিকা: অনিমা কোতয়াল
#পর্ব- ২২
.

কিছু কিছু মানুষের বাইরের রূপের সাথে ভেতরেও সুপ্ত একটা রূপ থাকে। যেটা সে সবাইকে দেখাতে চায় না। সকলের আড়ালে রাখতে চায়। রিখিয়াও আজ বিহানকে আলাদাভাবে আবিষ্কার করল। রিখিয়া অবাক দৃষ্টিতে দেখতে দেখতে ভেতরে এলো। বিহান অনেকগুলো বাচ্চাদের সাথে কানামাছি খেলছে। বিহান নিজের চোখ বেঁধে রেখেছে আর বাচ্চাগোলোকে খুঁজছে। বাচ্চাগুলোও মজা করে যাচ্ছে বিহানের সাথে। রিখিয়া বিষ্মিত দৃষ্টিতে দেখতে দেখতেই বিহানের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। এগোতে এগোতে ওর খেয়ালই নেই কখন বিহানের কাছে চলে গেছে। হঠাৎ করেই বিহান রিখিয়াকে বাচ্চা ভেবে ধরে ফেলল। ঘটনার আকষ্মিতায় রিখিয়া চমকে উঠল। সব বাচ্চারাও থেমে গেল। বিহান সাথেসাথেই বুঝতে পারল এটা কোন বাচ্চা না। একহাতে রিখিয়াকে ধরে রেখেই আরেক হাত দিয়ে চোখ থেকে কাপড় সরিয়ে রিখিয়াকে দেখে অবাক হয়ে গেল। রিখিয়া এখানে চলে আসবে ও বুঝতে পারেনি। এখানে কেন আসল মেয়েটা। ও দ্রুত রিখিয়াকে ছেড়ে দিয়ে বলল,

” তুমি এখানে?”

রিখিয়া কানের পিঠে চুলগুলো গুজে নিয়ে বলল,

” আসলে আপনার সাথেই দেখা করতে এসছিলাম।”

বিহান বাচ্চাদের দিকে তাকিয়ে দেখল ওরা তাকিয়ে আছে। বিহান মুচকি হেসে বাচ্চাগুলোর কাছে গিয়ে ওর সামনে হাটু গেড়ে বসে বাচ্চাদের ভেতরে যেতে বলল। আর এটাও বলল যে ওদের জন্যে খাবার চলে আসছে তাড়াতাড়ি। বাচ্চাগুলো হাসিমুখে ভেতরে চলে গেল। বাচ্চারা ভেতরে যেতেই বিহান রিখিয়ার দিকে তাকিয়ে বলল,

” হঠাৎ এখানে দেখা করতে এলে যে?”

” আপনি বলেছিলেন প্রতি রবিবার বিকেলে এখানে আসেন তাই..”

” কিছু বলবে?”

” আমার সেদিনের বিহেভিয়ারের জন্যে রেগে আছেন তাইনা?”

বিহান ঠোঁট চেপে একটু হাসল তারপর রিখিয়ার দিকে এগিয়ে গিয়ে বলল,

” সেটা ফ্যাক্ট না। ফ্যাক্ট ইজ আমার যদি অন্য মেয়ের সাথে সম্পর্ক থেকেও থাকে তাতে তোমার কেন এত রাগ হচ্ছিল? তোমার কী যায় আসে?”

রিখিয়া একটু অস্বস্তিতে পরল। কী উত্তর দেবে ও? উত্তরটাতো ওর নিজেরই অজানা। তাই মাথা নিচু করে ওড়নায় আঙ্গুল পেচাচ্ছে। বিহান রিখিয়ার দিকে আরেকটু ঝুঁকে বলল,

” বাই এনি চান্স তুমি আমায় ভালো-টালো বেসে ফেলোনি তো?”

রিখিয়া ভ্রু কুচকে তাকাল বিহানের দিকে। বিহান গলা ঝেড়ে বলল,

” নাহ পরতেই পারো। আফটার অল এতো হ্যান্ডসাম একটা ছেলে য‍দি আশেপাশে থাকে তো প্রেমে পরে যাওয়াটাই স্বাভাবিক। বরং না পরাটাই অস্বাভাবিক।”

রিখিয়া হাত ভাজ করে বলল,

” তাইনা?”

বিহান নিজের কলারটা ঠিকভাবে সেট করে বলল,

” হ্যাঁ তাইতো।”

রিখিয়া হেসে দিয়ে বিহানের বাহুতে একটা ধাক্কা মারল। বিহানও হাসল। হাসিটা থামিয়ে রিখিয়া বলল,

” এখানে কী করতে আসেন?”

” আসলে এখানে বাচ্চাগুলো খুব প্রিয় আমার। ওদের সাথে খেলতে, মজা করতে, খাওয়াতে। তাই প্রতি রবিবার এখানে আসি। ওদের সাথে খেলি, খাওয়াই, মাঝেমাঝে ওদের নিয়ে শপিং করতেও যাই।”

রিখিয়ার মনে পরল আগে একবার বিহানকে দেখেছিল শপিংমলে বাচ্চাদের সাথে। ও একটু না, অনেকটাই অবাক হল। বিহানের এমন রূপে ও সত্যিই ভীষনরকম অবাক হয়েছে। বিহানের যে এরকম একটা রূপ আছে সেটা ও জানতোই না। কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল,

” আচ্ছা। আপনি ওদের এত ভালোবাসেন কেন? কোন বিশেষ কারণ?”

বিহান মলিন হেসে বলল,

” হয়তো ওদের সাথে আমার বিশেষ মিল আছে তাই।”

রিখিয়া অবাক হয়ে বলল,

” কী মিল?”

” ওরাও এতিম। আমিও কোথাও না কোথাও এতিম। ওদের বাবা-মা নেই তাই এতিম। আমার থেকেও নেই তাই আমি এতিম।”

রিখিয়া বিহানের কথার আগামাথা কিছুই বুঝতে পারছেনা। বাবা-মা থাকতেও রিখিয়া নিজেকে এতিম বলছে কেন? রিখিয়া কিছু বলবে তার আগেই একটা লোক বড় বড় দুটো বক্স নিয়ে এলো যার মধ্যে খাবার এলো। বিহান একগাল হেসে বলল,

” চল ওদের খাবার দিয়ে দেই। তুমিও হেল্প কর আমাকে।”

রিখিয়া মাথা নেড়ে উঠে গেল। ভেতরে গিয়ে সব বাচ্চাদের খাবার দিল দুজন মিলে। এই এতিম বাচ্চাদের নিজের হাতে খাবার দিতে পেরে আর ওদের এই হাসি মুখটা দেখে তৃপ্তিতে দুচোখ ভরে যাচ্ছে রিখিয়ার। এক অদ্ভুত শান্তি। এরজন্যে সারাজীবন বিহানের কাছে কৃতজ্ঞ থাকবে ও। এর মধ্যে রিখিয়ার সাথেও বাচ্চাদের ভালো বন্ডিং হয়ে গেল। কারণ রিখিয়া খুব ভালোবেসে মিশেছে ওদের সাথে। একটা বাচ্চাতো বলেই বিহানকে বলেই ফেলল,

” ভাইয়া এই আপুটা কী আমাদের ভাবী হন?”

কথাটা শুনে রিখিয়া চমকে গেল। চরম অস্বস্তিতে পরে গেল ও। বিহান ঠোঁটে কামড়ে হেসে রিখিয়ার দিকে তাকিয়ে বাচ্চাটাকে কোলে নিয়ে বলল,

” কেন? ভাবী হিসেবে মানাচ্ছে না?”

বাচ্চাটা বোকলা দাঁতে হেসে বলল,

” পার্ফেক্ট আছে।”

রিখিয়া চরম অবাক হল। আজকালকার বাচ্চাগুলো কী বিচ্ছু। খাওয়া শেষে আবারও খেলল ওরা। এবার রিখিয়াও যোগ দিল। সব মিলিয়ে সুন্দর একটা দিন কাটলো রিখিয়ার। আজ বিহানকে সে নতুনভাবে দেখল। নতুনভাবে চিনল। এক অদ্ভুত ভালোলাগা কাজ করছে বিহানের প্রতি যা আগে কখনও হয়নি।

_____________

স‍ৌহার্দ্য চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে আছে। বাকি সবাই তাকিয়ে আছে তুর্বীর দিকে। এখন ওর প্রেজেন্টশন দেওয়ার পালা। যেখানে ও ওর প্লানটা সবার সামনে দেখাবে। মনে মনে ভীষণ ভয় করছে ওর। কারণ ওর লাইফের প্রথম প্রেজেন্টেশন এটা। সৌহার্দ্য কিছুক্ষণ তুর্বীকে পর্যবেক্ষণ করে বলল,

” স্টার্ট কর।”

তুর্বী একটু গলা ঝেড়ে নিজেকে স্বাভাবিক করে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বলল,

” আপনি ঠিকই বলেছিলেন স্যার। কাজের জায়গাটা মজা করার জায়গা না। সেরকম করা উচিতও না।”

এটুকু বলে একটু থামল। চারপাশে একবার চোখ বুলিয়ে আবার সৌহার্দ্যর দিকে তাকিয়ে বলল,

” কিন্তু, যদি কাজের জায়গাটায় আমরা নিজেদের জন্যে কমফরটেবল করে তুলতে পারি দেন আই থিংক ইটস গুড ফর আস। কারণ তাহলে প্রত্যেকটা স্টাফ নিজের মত করে আনন্দ নিয়ে কাজ করতে পারবে। কারণ কাজের প্রেশার বা একটানা কাজ করা যেকারো জন্যেই বোরিং। সো যদি প্রত্যেকটা স্টাফ নিজের কাজের মধ্যে রিলাক্স করার বা নিজেকে কমফরটেবল রাখার একটা সুযোগ পায় তাহলে তারা কাজটা যেমন ভালোভাবে করতে পারবে একইসাথে তাদের ওপর স্ট্রেসটাও কম পরবে।”

সৌহার্দ্য তুর্বীর বচনভঙ্গিতে মুগ্ধ হয়ে গেছে। কে বলবে এই মেয়েটা এতটা ইনফরমাল, ছটফটে। তুর্বী স্লাইড চেঞ্জ করে বলল,

” সো, যদি আমাদের আগের প্লানের স্টাফ রুমে কোওয়ার্কিং স্পেসটা আরেকটু বাড়াতে পারি। তাহলে সেটা যেমন স্টাফদের কমফর্ট জোন দেবে। স্টাফদের লম্বা সময় অফিসে কাজ করতে ইচ্ছা হবে। দে উইল এনজয় দেয়ার অফিস। ভিসিটরদের ভিসিট করতেও সুবিধা হবে। ”

একজন কলিগ বলল,

” কিন্তু এতটা জায়গা তো নেই।”

আরেকজন বলল,

” এনড হোয়াট এবাউট বাজেট?”

তুর্বী আবার স্লাইড চেঞ্জ করে বলল,

” যদি আমরা আমাদের আগের প্লানে রাখা মাঝখানের এই পার্টিশনটা বাদ দিতে পারি। তাহলে অনেকটা জায়গা বেঁচে যাবে। আর সেইজায়গাটাকেই আমরা ইউস করতে পারি লাইক দিস।”

বলে তুর্বী পরের স্লাইডে ওর বানানো মডেলটা দেখালো আর সেই মডেলের বেসিকটা ব্যাখা করে বলল,

” হ্যাঁ এতে করে বাজেট একটু বেড়ে যাবে ঠিকই কিন্তু যদি আমরা একটু ভালো করে দেখি তাহলে এখানকার কোওয়ার্কিং স্পেস এন্ড চাহিদা দুটোই বাড়বে। এন্ড উইথ দ্যাট উই ক্যান কভার আপ। এতে আমাদের লস হবেনা। কজ উইস্টান চার্চিল সেইড, ‘ We shape our building, and thereafter they shape us”

সবাই হাততালি দিয়ে উঠল তুর্বীর অসাধারন প্রেজেন্টেশন দেখে। অথচ কালকে তারাই ওর ওপর হাসছিল। সৌহার্দ্য একদৃষ্টিতে দেখছে তুর্বীকে। তুর্বী একপলক সৌহার্দ্যর দিকে তাকিয়ে বলল,

“আই থিংক আপনারা এটা ভেবে দেখবেন।”

বলে তুর্বী চলে গেল। সৌহার্দ্য মুচকি হাসল। আজ প্রথমবার ও ভুল প্রমাণিত হয়েছে। কিন্তু ওর একটুও আফসোস হচ্ছেনা। বরং ভালো লাগছে। যেন এটাই চাইছিল ও। সৌহার্দ্য আনমনেই বলে উঠল,

” সি ইজ ইম্প্রেসিভ!”

#চলবে…