#জোনাকি_প্রদীপ (পর্ব ২০)
নুসরাত জাহান লিজা
“তোমার এই জব এতটাই জরুরি? সবে আমরা নতুন সংসার শুরু করলাম। তুমি এখন রাজশাহীতে চলে যেতে চাইছ? তোমার কীসের অভাব? আমি কিছুর কমতি রেখেছি?”
নিলয়ের কথায় প্রথমদিকে নিজের নেয়া সিদ্ধান্ত বিবেচনা করা যায় কিনা ভেবে দেখতে চাইছিল আনিকা। কিন্তু শেষের কথায় ওর মেজাজ খিচড়ে গেল।
“আমি কি অভাবের জন্য, নিজের বেসিক নিডস ফুলফিল করার জন্য তোমাকে বিয়ে করেছি নিলয়? আমার বাবা মাকেও তুমি অসম্মান করলে। তারা কিন্তু বিয়েতে রাজিই ছিল না।”
“তাদেরকে কোথায় অসম্মান করলাম? একটা সামান্য কথাকে এতবড় করছ শুধু শুধু।”
“শুধু শুধু? এটা সামান্য কথা? তুমি আমাকে আজ এটা বলতে পারছ, দু’দিন পরে আরও বড় কথা বলবে না তার নিশ্চয়তা কী? ভাগ্যিস জবটা হলো, নইলে তোমার ভেতরে ঘাপটি মেরে থাকা কিছু পুরুষের মতো মেল ইগো আছে, সেটাকে আবিষ্কারই করতে পারতাম না।”
“অনু, প্লিজ, তুমি যেভাবে ভাবছ আমি মোটেও এতকিছু ভেবে কিছু বলিনি। তবে এই জব তুমি করবে না। ঢাকায় হলে আমি মোটেও বাঁধা দিতাম না। বুঝতে চেষ্টা করো।”
আনিকা প্রাণপণ চেষ্টায় কান্না চেপে রেখেছে। সে নিলয়ের কাছ থেকে এমন কথা আশা করেনি। বহু বছর ধরে সে নিলয়কে চেনে। বিয়ের পর থেকেও তো ঠিকই ছিল। কিন্তু আজ ওকে মারাত্মক অসম্মান করতে পারল! তার উপরে নিজের সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিচ্ছে। না না, সে রাজশাহী যাবে। দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হলো আনিকা।
“তোমার কাছে আজ এটা খুব সামান্য বলে মনে হচ্ছে। সামান্য থেকেই শুরু হয় নিলয়। তুমি যদি আমাকে মিস করবে বলতে, আমাকে দূরে যেতে দিতে চাও না সেজন্য, বলতে। আমি হাসিমুখে মেনে নিতাম। কিন্তু তুমি আমার আত্মসম্মানে আঘাত করেছ। আজ এটা মেনে নিলে দু’দিন পরে আরও বড় কিছু বলবে না তার নিশ্চয়তা দিতে পারো?”
নিলয়েরও এবার রোখ চেপে গেল, সে দাঁতে দাঁত চেপে বলল, “তোমার যা খুশি করো। আমি আর কখনো দেখতে যাব না।”
বলেই বেরিয়ে গেল, স্তব্ধ হয়ে বসে রইল আনিকা। আজ এপয়েনমেন্ট লেটার পেয়ে চাপা টেনশন হচ্ছিল, একবার মনে হচ্ছিল এত ভালো একটা সুযোগ, পরক্ষণেই মনে হলো নিলয় যে কীভাবে নেয়! হয়তো পাগলামি করবে, যেতে দিতে চাইবে না। সে প্রায় সিদ্ধান্ত নিয়েই নিয়েছিল জয়েন করবে না। তবুও সঙ্গীর ভালোবাসাটুকু চাক্ষুষ করতে ইচ্ছে হয়েছিল। সবসময় তো ভালোবাসা প্রকাশ করা হয় না!
কিন্তু এমন কিছু হবে সে ঘুণাক্ষরেও ভাবতে পারে নি। চেপে রাখা কষ্ট এখন কান্না হয়ে ঝরতে লাগল গাল বেয়ে। নিলয়কে কি সে ভুল চিনেছে! সব পুরুষই কি একইরকম!
***
নীরা নিলয়ের বাসায় এসেছে চারদিন হলো। আজ নিলয়ের ঘরে আসছিল আফনানের ব্যপারে জানতে। একদিন কথা উঠতে একটা সামারি শুনে নিয়েছিল। বেশি প্রশ্ন করতে পারেনি সংকোচে। তবে আজ ভাবল, এভাবে হবে না। ভাইয়া যা ভাবার ভাবুক, ওকে সব আগাগোড়া জানতেই হবে। তারপর অন্তত একবার হলেও আফনানের সামনে গিয়ে দাঁড়াবে। আর কিছু না পারলেও পাশে দাঁড়িয়ে একবার কিঞ্চিৎ সাহস তো দিতে পারবে!
কিন্তু ওদের ঘরের কাছাকাছি এসে পা থেমে গেল। ভাই ভাবির মতানৈক্য না চাইতেও ওর কানে এলো। এরপর নিলয়কে বেরিয়ে যেতে দেখল। নীরা একবার ভাবল ভেতরে গিয়ে আনিকার সাথে একবার কথা বলবে কিনা। পরমুহূর্তেই চিন্তাটা বাতিল করে দিল। এটা এখনো অব্দি তাদের ব্যক্তিগত সমস্যা। ওর নাক গলানো মানে অনধিকার চর্চা। অন্তত এখন তো নয়ই। পরে একসময় কথা বলা যাবে ভেবে ফিরে গেল নিজের ঘরে।
বকুল ফুপু কল করেছে। নীরা রিসিভ করল না। রাগ হচ্ছে ভীষণ। ফুপুর উপরে নয়, সায়মনের উপরে। সেদিন আসার সময় সায়মন ওকে বন্ধুত্বের প্রস্তাব দিয়েছিল আবার। নীরা ভাবলেশহীন গলায় প্রত্যাখ্যান করেছে।
“কেন সম্ভব নয় নীরা?” মরিয়া গলায় প্রশ্ন করেছিল সায়মন।
নীরা উত্তরে বলেছিল, “দেখুন, আমনার মনে যেই অনুভূতি, বন্ধুত্ব হলে সেটা আপনি ভুলতে পারবেন? আমিও সহজ হতে পারব না। আপনার মনে একটা হোপ তৈরি হবে আবারও। এটা কোনোভাবেই সমীচীন নয়। আমি জানি আপনি বুঝবেন।”
“কারণটা…”
সায়মনকে থামিয়ে দিয়ে নীরা শক্ত গলায় বলেছিল, “সব কিছু সবার জানতে নেই সায়মন। আশা করি এধরণের প্রশ্ন করে নিজেও বিব্রত হবেন না, আমাকেও বিব্রত করবেন না।”
সায়মন অনেকক্ষণ পরে ওদের মধ্যকার নিস্তব্ধতা কাটিয়ে বলেছিল, “কী নিষ্ঠুর তুমি নীরা।”
সেই বলায় রাগ, ক্ষোভ, হতাশা কত-শত আবেগের একটা অদ্ভুত সম্মীলন ছিল তা নীরা উপলব্ধি করলেও এড়িয়ে গিয়েছিল। কারণ সে নিরুপায়।
বকুল ফুপু আবার কল করছেন। নীরা এবার কলটা ধরল। সে জানে, না ধরা পর্যন্ত তিনি ক্ষান্ত হবেন না। ধরতেই ওপাশ থেকে ভেসে এলো বকুল ফুপুর প্রায় ক্ষুব্ধ গলা,
“তুই কী রে নীরা? যেই ছেলেটা সারাক্ষণ হাসিখুশি থাকে সবাইকে মাতিয়ে রাখে, ওকে ফোন করলে এখন ভালো করে কথাই বলতে চায় না।”
“একেবারে সরাসরি ওদিকে চলে গেলে ফুপু? আমি কেমন আছি তাও জানতে চাইলে না?”
“আমি জানি তুই কথা ঘুরিয়ে ফেলতি। তোকে আমি চিনি নীরা। তোকে অনেক ভালোবাসি আমি। তাই অধিকার বোধ থেকে কথাগুলো বললাম।”
নীরা হাসিমুখে শান্ত গলায় বলল, “ফুপু, আরও অনেকেই তো আমাকে প্রপোজ করেছে। রিজেকশনে তাদের মনও খুশিতে নাচেনি। তাদের সকলকে ভালো রাখতে চাইলে তো সবাইকে এক্সেপ্ট করতে হবে। সেটা কি সম্ভব?”
“কিন্তু সায়মন অন্যদের মতো না, ও…”
“উনি তোমার খুব আদরের, তাই এভাবে বলছ ফুপু। আমি তোমাকে খুব পছন্দ করি। প্লিজ এমন করে বলো না। তোমার মন খারাপ করে দিতে চাইছি না।”
“নীরা, প্লিজ একবার…”
“ফুপু আমার ভীষণ মাথা ব্যথা করছে। পরে কথা বলি, প্লিজ।”
এরপর কেটে দিয়ে বসল বিছানায়। এই পাশের বারান্দা থেকে আকাশ দেখা যায় না। নীরার ভীষণ ইচ্ছে হলো আকাশটা দেখতে। আকাশের বিশালতায় নিজের কষ্টগুলোকে ভাসিয়ে নিজেকে হালকা করতে। কিন্তু সেটা হবার নয়। তাই শুয়ে চোখ বুঁজল।
***
নি র্বা চ নী প্রচারণা চলছে জোরেশোরে। আজমল খান, আরিফসহ দলের সকলেই ভীষণ ব্যস্ত। আগামী পরশুর পর আর প্রচারণা করতে পারবে না, নিষেধাজ্ঞা শুরু হবে।
এরমধ্যে ওদের একজন কর্মী বে ঈ মা নি করেছে। বি রো ধী শি বি রে ওদের ভেতরের কিছু গো প ন কথা ফাঁ স করেছে। অথচ এতদিন সে এদের জন্য কত ঝুঁ কি নিয়েছে প্রাণের। তবুও সেসবের এখানে মূল্য নেই। তাকে সরিয়ে দেয়া হয়েছে পৃথিবী থেকে। এখানে স্বা র্থ ই শেষ কথা, তাতে টান লাগলে আপন পর হয়ে যায় নিমিষেই।
মনটা বিষিয়ে গেল মনিরের। ফয়েজ তার কাছের লোক ছিল। কোনোদিন যদি ওকেও… আর ভাবতে চায় না সে।
“আজকে আমার মেয়েটার জন্মদিন ভাই। বাচ্চা মেয়ে, বায়না করতেসে সারাদিন আমার সাথে থাকার। আজ সন্ধ্যাটা যদি ছুটি দেন।”
“তোর মেয়ের বয়স কত হলো রে?”
“পাঁচ, ভাই।”
“তোর বয়স কত?”
আরিফের প্রশ্নের কোনো মাথামুণ্ডু বুঝতে পারে না মনির, দ্বিধাবিভক্ত হয়ে বলল, “সঠিক হিসাব জানি না, তবে চব্বিশ, পঁচিশ।”
“তুই তো বাল্যবিবাহ করছিস তাইলে রে শা লা। শোন, এই বয়সটা কাজের। দুই হাত ভরে টাকা কামাই করার। বুঝলি। ফালতু ইমোশনে ভাসার না। আজকে সন্ধ্যায় কাজ আছে, জানিস না? যা, বলছিস যখন, রাত দশটার পরে যাইস।”
“ভাই, বাচ্চা মানুষ তো, তখন ঘুমায়ে পড়তে পারে।”
“কোন অযাচিত দুর্বলতা তৈরি হইলে কী করা হয় ভুলে গেলি মনির?”
সহসা গা হিম হয়ে গেল মনিরের, তার স্ত্রী আর সন্তানই তো তার একমাত্র পিছুটান। না না, একটা জন্মদিন স্যাক্রিফাইস করলে আরও অজস্র জন্মদিন তো সামনে আসবে ওই ছোট্ট নিষ্পাপ মেয়েটার। ওর হৃদয়ের একটা অংশের। মনে হলো সপাটে চাবুক হেনেছে কেউ, শিরদাঁড়া সোজা হয়ে গেল ওর। অভিনেতা সত্তা জেগে উঠল, বলল,
“দুর্বলতা না ভাই, জন্মদিন তো পরে আরও আসব। আমি আছি আপনার খেদমতে। নিজের জান হাজির, ইমোশন টিমোশন কিচ্ছু না ভাই।”
আরিফ পৈশাচিক হেসে বলল, “এই তো সুবুদ্ধি হইসে। যা তাইলে বের হ।”
বেরিয়ে আসতে আসতে মনিরের মনে হলো আফনানের কাতর মুখটা। প্রিয়জনের জন্য আশঙ্কা যে কতটা ভয়াবহ অসহায় করে দেয়, আজ মর্মে মর্মে উপলব্ধি করল মনির। তবুও কেমন অকুতোভয় চিত্তে ঘুরতে পারে আফনান। আপোষ করতে নারাজ। কিন্তু সে ফিরতে পারবে না! একবার এখানে জড়িয়ে গেলে সেই জাল কেটে বের হওয়া অসম্ভব। তবুও কেন যেন আফনানের সেদিন সন্ধ্যার চেহারাটা তার প্রস্তাব ভুলতে পারে না।
প্রথম দিকে কাঁচা পয়সা আসত হাত ভরে, জীবন রঙ্গিন লাগত। এখন লাগে না। সে ওদের কাছে কীটপতঙ্গের মতোই মূল্যহীন। এটা ফয়েজ ভাইয়ের পরিণতি ওকে বুঝিয়ে দিয়ে গেছে। সে জানে আফনানের প্রস্তাব সে গ্রহণ করতে পারবে না। মনিরকেও পুরোপুরি বিশ্বাস করে না আরিফ খান। ওর পিছনেও ঠিক টিকটিকি লেগে আছে। যদি ওই সাহসী ছেলেটাকে সাহায্য করতে চায় সেটাই মনিরের শেষ দিন।
***
আফনান আজ অফিসে যায়নি। দু’দিন আগে একটা আউটলেটে চুরি হয়েছে। চুরি হয়েছে বলাটা ঠিক নয়, বরং বলা যায় চোর ঢুকেছিল। কিন্তু কিছু নেয়নি। অল্প যা টাকা ছিল, সেগুলো সেভাবেই আছে। তবে সবগুলো ড্রয়ার ভাঙা। কিন্তু কিছুই খোয়া যায়নি। এটাতে প্রথমে বিস্মিত হয়েছিল। তবে বুঝতে পেরেছে কাদের কাজ।
নিলয়ের বদান্যতায় মিডিয়ায় আবার তোলপাড় শুরু হয়েছে বিষয়টা নিয়ে। অনেক রকম বিশ্লেষণের মধ্যে আফনানের নিজের মনে ঘুরতে থাকা একটা সম্ভাবনা মিলে গেছে। তাই তড়িঘড়ি করে ছুটে এসেছে।
রবিনের নিখোঁজ হবার দিন সে সকালের পরে আর বাসায় যাবার সুযোগ পায়নি। তার মানে এমন একটা কিছু আছে, যেটায় কোনো স্বাক্ষ্য পাওয়া যাবে ওদের বি রু দ্ধে। সেটাই খুঁজতে এসেছিল। পেয়েছে কী?
আফনান চুরি যাওয়া আউটলেটের সব ঘেঁটে কিছু পেল না। পরে অন্যটায় এলো। এটা একটু ভেতরের দিকে এখানে তারা আসেনি। কারণ সুযোগ পায়নি।
আফনান সেখানে আঁতিপাঁতি খুঁজল। দুটো পেনড্রাইভ পেল। ল্যাপটপে সংযোগ করে দেখল কিছু আছে কী না! কিন্তু ব্যবসায়িক কিছু ডকুমেন্টস বাদে অন্যকিছু নেই। এরপর একটা কসমেটিকস এর খোলসে পড়ল ধাক্কা লেগে। তাতে আরেকটা পড়ল।
এটা লুকিয়ে রাখা, আবার যাতে চেনা লোকের চোখে পড়ে সেটাও নিশ্চিত করেছে। এটা কানেক্ট করে কাঙ্ক্ষিত জিনিস পেয়ে গেল। হার্টবিট বেড়ে গেল আফনানের! এই জন্যই তাহলে এতকিছু!
……..
(ক্রমশ)
#জোনাকি_প্রদীপ (পর্ব ২১.১)
নুসরাত জাহান লিজা
একটা সাতচল্লিশ সেকেন্ডের ভিডিও ক্লিপে স্পষ্ট করে বোঝা না গেলেও ওইটা যে আরিফ খান, তা বুঝতে অসুবিধা হলো না। লোকটার মুখে পৈশাচিক হাসি, সামনে চা পাতি দিয়ে কু *পি *য়ে হ* *ত্যা করার পর সেই লা শ ব স্তা ব ন্দি করা হচ্ছিল। এটা নিয়ে কিছুদিন আগে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছিল। কিন্তু এরপর সব ঠান্ডা।
এবার আফনান অনুধাবন করল শুধু চাঁ দার জন্য একটা লোককে কি ড ন্যা প করার কথা তাদের মতো রাঘব বোয়ালদের নয়। ওর আগে থেকেই এটা মনে হচ্ছিল এর পেছনে নিশ্চয়ই বড় কোনো জটিল রহস্য আছে। এবার সবটা ঝকঝকে দিনের আলোর মতোই স্পষ্ট।
প্রমাণ লোপাট করতেই তাদের এই প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা। প্রথমে হয়তো তারা ভেবেছিল রবিন কেবল স্বাক্ষী, তাই আটকে রেখেছে। এমনিতেই ওই মা র্ডা র নিয়ে তাদের উপরেই আঙুল উঠেছে, জনরোষ তৈরি হয়েছে এই এলাকায়। তাই নি র্বা চ ন সামনে রেখে আরেকটা হঠকারিতা তারা করতে চায়নি।
রবিনের কাছ থেকে বা অন্যকোনোভাবে হয়তো তারা এই ভিডিওর কথাটা আঁচ করতে পেরেছে। আগে জানলে আরও আগেই এই চুরির ঘটনা ঘটত। রবিনকে মুখ খোলাবার জন্য নিশ্চয়ই ট র্চা র করা হয়েছে, যেহেতু পায়নি, এখনো হচ্ছে সেটা বলাই বাহুল্য।
আফনানের আচমকা ভয় করল। জটিল এক গোলকধাঁধায় আটকে গেছে রবিন, সাথে ওর পুরো পরিবার। গতকালও সে একটা হু ম কি পেয়েছে। আফনানের একবার মনে হলো, এই ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আপলোড করে দেয়, কিন্তু নিজেকে সংবরণ করল। এখন মাথা ঠান্ডা রাখতে হবে। এটাই সবচাইতে বেশি প্রয়োজন। নইলে রবিনের ক্ষতি হয়ে যাবে। আফনান জেনে বুঝে একজনের প্রাণকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলতে পারে না।
তবে এতদিন পরে খানিকটা স্বস্তি পেল। কয়েকবার শ্বাস টেনে নিজেকে ধাতস্থ করল। স্নায়ুক্ষয়ী একটা মনস্তাত্ত্বিক খেলা ওর সামনে অপেক্ষমাণ। এই খেলার সবচাইতে বড় ট্রাম্প কার্ড এখন ওর হাতে। কাউকে কিচ্ছু না জানিয়ে পেনড্রাইভটা লুকিয়ে ফেলল। তার আগে সেটা মোবাইলে কপি করে নিল। গুগল ড্রাইভেও সেভ করে ফোন থেকে গুগল একাউন্ট সরিয়ে ফেলল। যাতে ফোন পেলেও প্রমাণ একেবারে লোপাট না হয়ে যায়। নিজের হোয়াটসঅ্যাপ থেকে ওর বাসায় থাকা স্বল্প ব্যবহৃত মোবাইলেও পাঠাল।
এরপর মনে মনে পরিকল্পনা সাজিয়ে নিল। তবে আরও ঢেলে সাজাতে হবে। ছক কষতে হবে অনেক। গুণে গুনে অঙ্ক সাজাতে হবে। জটিল সমীকরণ নিজের পক্ষে আনতে হবে। তার জন্য একবার নিলয়ের সাথে কথা বলা প্রয়োজন।
একবার মনিরের সাথেও কথা বলা আবশ্যক। যদিও ছেলেটাকে এখনো আফনান পুরোপুরি মন থেকে বিশ্বাস করতে পারেনি। তবুও দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে লোকে যেমন মরিয়া হয়ে খড়কুটো আগলে ধরে, সেভাবেই আফনান তাকে দলে টানতে চাইছে।
বাড়িতেও নিরাপত্তা দরকার। ওর সেই ক্ষমতা নেই, তাই এটার জন্যও নিলয়ের শরণাপন্ন হতে হবে। যদি জোরদার পাহারার ব্যবস্থা করা যায়। এখন ওরা চেষ্টা করছে ওদের দুর্বল জায়গায় হাত দিতে। সেটা রবিনের জন্য যে তার সন্তান সম্ভবা স্ত্রী তা জানতে ওদের বেগ পাওয়ার কথা নয়। আফনানের জন্যও একই কথা প্রযোজ্য।
সে জানে প্রতিপক্ষ ভয়ংকর। কোনদিন থেকে কী আসবে সে জানে না। মুহূর্তের ভুলেই ঘটে যেতে পারে মহাবিপদ।
………….
#জোনাকি_প্রদীপ (পর্ব ২১.২)
নুসরাত জাহান লিজা
নিলয়ের সাথে আনিকার দু’দিন থেকে কথা বলা প্রায় বন্ধ আছে। একবার নিলয় ভেবেছিল ওর বলা কথার জন্য দুঃখ প্রকাশ করবে। কিন্তু আনিকা জানালো,
“আমি ফাইনাল ডিসিশন নিয়ে নিয়েছি। সামনের মাসের এক তারিখেই জয়েনিং। ওখানে সুমি থাকে, আমার ফ্রেন্ড। ওর একটা মহিলা হোস্টেলের ব্যবস্থা করে দেবে বলেছে।”
নিলয়ের মন তেতো হয়ে গেল। নিজের সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসে বলল, “ডিসিশন যখন নিয়েই ফেলেছ, যা খুশি করো।”
এরপর ওদের নতুন শুরু করা দাম্পত্যে শীতলতা শুরু হয়েছে। বরফ জমছে দু’দিকেই।
নীরার সামনে যেন তা প্রকাশ না পায়, সেজন্য অবশ্য খাবার টেবিলে বসছে একসাথেই। এরমধ্যে আফনানের কল আসায় ওপাশের কথা শুনে নিলয়ের কপালে ভাঁজ পড়েছে। নীরার চোখ এড়ায় না। ফোন রাখতেই সে প্রশ্ন করল,
“ভাইয়া, আফনান ভাইয়ের ওদিকের পরিস্থিতি এখন কেমন?”
“পরিস্থিতি জটিল হচ্ছে। আমার তো ওর বোনের জন্য টেনশন হচ্ছে বেশি। শায়লার ডেলিভারির সময় ঘনিয়ে এসেছে। আমি কাল একবার যাব।”
নীরা নির্লিপ্ততা বজায় রেখে শুরু করলেও এবার আর তা পারল না, উৎকণ্ঠা নিয়ে বলল, “আমাকে তোমার সাথে নিয়ে যাবে?”
নিলয় এক ঝটকায় নাকচ করে দিল, “তুই ওখানে গিয়ে কী করবি?”
নীরা এবার অপ্রস্তুত হলো। মনে মনে একটা যুৎসই অযুহাত খুঁজতে চেষ্টা করল। এরপর বলল,
“শায়লা আপুর যেকোনো সময় পেইন শুরু হতে পারে। আন্টি বয়স্ক মানুষ, আফনান ভাই তো আছে ছুটোছুটির মধ্যে। একজন নিজেদের মানুষ তাদের সাথে থাকা দরকার।”
ওর কথা যে নিলয়ের যুক্তিগ্রাহ্য মনে হয়নি, তা বোঝা গেল বেশ।
“না না, ওখানে যাওয়া রিস্কি এখন। আমি একজন নার্স এপয়েন্ট করে দিয়েছি কাল।”
কিন্তু নীরা সেখানে যাওয়ার জন্য, একবার সামনা-সামনি আফনানকে দেখবার জন্য কতটা ব্যকুল হয়ে আছে, এটা কী করে ভাইকে বলবে।
“লাইফ রিস্ক আছে?”
“তা তো আছেই। ওরা ভীষণ ডেঞ্জারাস।”
“লাইফ রিস্ক আছে, তাহলে তুমি যাচ্ছ কেন?”
“আরে, তুই আর আমি এক? আফনান আমার বেস্ট ফ্রেন্ড। তাছাড়া আমার প্রফেশনে এমন অনেক রিস্ক ফ্যাক্টর হ্যান্ডেল করতে হয়।”
“কিন্তু সে তো আমার জীবনের সাথে জড়িয়ে। তার ওমন ক্রাইসিসে তার হাতটা ধরে একবার বলতে যে ভীষণ ইচ্ছে করে, ‘আমি তোমার পাশেই আছি। তুমি একা নও।’ আমি কি আর তাকে দেখতে পাব না?”
মনে মনে আওড়ায় নীরা। যেদিন ওদের বাড়ি থেকে আফনান চলে গেল, সেদিন একবার যদি সামনা-সামনি কথা বলত! চিঠিটা পুড়িয়ে ফেলার জন্য এক পৃথিবী অনুশোচনা হচ্ছে এখন। অনুতাপে পুড়ছে ভেতরটা। চাপা স্বভাবের মানুষটা তার হৃদয়ের দ্বার উন্মোচিত করে দিয়েছিল চিঠির ভাষায়। এখন তা বারবার পড়ার লোভ হচ্ছে। সে এত করে চেষ্টা করেও যে পুরোনো ক্ষত মুছতে পারছিল না, তা এখনকার অভিমান গলা জলে যেন নিমিষেই ধুয়েমুছে গেল।
শঙ্কিত গলায় নীরা বলল, “তুমি সাথে নিয়ে না গেলে আমি একাই যাব ভাইয়া। প্লিজ নিয়ে যাও!”
আফনানের জীবনের ঝুঁকি আছে জেনেও সে কী করে বসে থাকবে! লোকে যদি ওকে বেহায়া বলে তো বলুক, সে কারোর পরোয়া করে না। সদ্য কৈশোরোত্তীর্ণ সময়ের যে প্রগাঢ় ভালোবাসার জোয়ার ওর হৃদয়কে ভাসিয়ে নিয়ে গিয়েছিল, নিষ্ঠুরতম প্রত্যাখ্যানে তাতে ভাটা পড়েছিল অভিমানের পলি জমে। এই পরিণত তারুণ্যে তার কাছ থেকেই পেয়েছিল আহ্বান, যা সে গ্রহণ করতে পারেনি। আজ তার আশঙ্কায় বুকে কম্পন হচ্ছে ভয়াবহ। প্রলয়ঙ্কারী ভূমিকম্প হচ্ছে হৃৎপিণ্ডে। রিখটার স্কেলও তার মাত্রা নির্ণয় করতে ব্যর্থ হবে।
নিলয় সন্দিগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে জরিপ করল বোনকে। আনিকা এতক্ষণ চুপচাপ খাচ্ছিল। একটা কথাও বলেনি ভাইবোনের কথার মধ্যে। এবার সে-ও নিরার দিকে একই দৃষ্টিতে তাকিয়েছে।
“আমার কথার কোনো গুরুত্ব তো নেই। যার যা খুশি তাই কর তোরা৷ আমি নির্বাসনে যাই।”
নিলয় কথাটা নীরাকে বললেও, তা আনিকার জন্যও ছিল এটা সকলেই উপলব্ধি করল।
নিলয়ের মনে হলো নীরাকে সে নতুন করে দেখছে। আফনানের আর বাড়িতে না আসা, চপলা নীরার শান্ত হয়ে যাওয়া, সব যেন দুইয়ে দুইয়ে চার হয়ে মিলেমিশে গেল।
কিন্তু বাড়িতে মা যে সায়মনের সাথে সম্বন্ধ জুড়তে চাইছেন। নীরা আর মা দু’জনেই এক কথার মানুষ। নানামুখী চিন্তার মধ্যে নতুন আরেকটা শঙ্কা যুক্ত হলো।
আনিকার সাথে মা এখনো ঠিক প্রাণ খুলে কথা বলেন না। স্বাভাবিক কথা বললেও অন্যদের সাথে যতটা প্রাণবন্ত আনিকার সাথে ততটা নয়। সে বোঝে কারণটা।
আর আফনান, সে নিলয়ের প্রাণের বন্ধু। অত্যন্ত লড়াকু, যার প্রায় সারাজীবন কেটেছে লড়াই করে। সামাজিকভাবে, পারিবারিকভাবে। অত্যন্ত সৎ। পরিবার অন্তপ্রাণ। তবুও আরও অনেক বিষয় আছে। তারমধ্যে এখন যে পাঁকে আটকেছে, তারপর তো…
সবাই নিলয়ের ভালোবাসার মানুষ। কিন্তু একটা ঝড় সামনে উঠবে। সে কোনদিকে যাবে! কোনদিকে যাওয়া উচিত! ওদিকে আনিকা…
***
আফনানের সাথে দেখা করতে এসেছে রায়হান, সে ওয়াহেদ মির্জার এ্যাসিট্যান্ট। তারা আজমল খানের প্রতিপক্ষ। আফনানকে দলে টানতে চায়।
“দেখুন আফনান সাহেব। আমরা আপনার আর আপনার ফ্যামিলির পুরোপুরি নিরাপত্তা নিশ্চিত করব। আমাদের নিজস্ব লোক আপনাদের প্রটেকশন দেবে। আপনি সরাসরি মিডিয়ায় স্ট্যাটমেন্ট দিন। রবিন সাহেব এই এলাকার ছেলে। তার জন্য যারা দায়ী, তাদের যথোপযুক্ত শাস্তি হওয়া উচিত।”
আফনান স্মিত হেসে বলল, “দেখুন, আমি আপনাদের এসব প লি টি ক্যা ল ইস্যুর মধ্যে নেই। আমরা নিরীহ জনসাধারণ। রবিনের সাথে অনেকগুলো জীবন জুড়ে আছে। এটার সাথে অন্য ইস্যু জড়াবেন না প্লিজ।”
“দেখুন, এটা আপনার জন্যই ভালো হবে। এত ভালো প্রস্তাব আর পাবেন না।”
আফনান সরাসরি প্রত্যাখ্যান করতে চাইলেও করল না। বলল, “ভেবে দেখব।”
এই প্রস্তাব যে কেবলই স্বার্থের জন্য, এটা সে জানে। রবিনকে নিয়ে পাবলিকের সিম্প্যাথি আছে। চলমান ইস্যু। তার পক্ষ নিলে যে ওদের লাভ।
পৃথিবীটা এত স্বার্থপর কেন! তবুও এত স্বার্থান্বেষীর ভিড়ে কিছু মানুষের নিঃস্বার্থ স্নেহ ছায়া, ভালোবাসা ওর ভাগ্যে জুটেছিল। কতদিন পরে নীরার মুখটা স্পষ্ট হলো ওর মানসপটে। ভাগ্যিস সেদিন মেয়েটা ওর সাথে দেখা করেনি। ভালোই হয়েছে। চিঠিটা কি নীরা পড়েছে! না, চিঠিটা লেখা একদম উচিত হয়নি। খুব ভুল হয়েছে। ওর ভাঙাচোরা জীবন আরও গুড়িয়ে গেছে। কেন যে আবেগকে প্রশ্রয় দিল। নির্ভেজাল ভালোবাসা মাখা আবেগ ওর জন্য নয়। একদম নয়।
দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো বুক বেয়ে। কত সহস্র দীর্ঘশ্বাস জমে আছে সেখানে সঙ্গোপনে! তা কেউ জানে না। সমস্ত যন্ত্রণা ওর একার, একান্তই একার।
***
মনিরের সাথে আজ আবার দেখা করতে এসেছে আফনান।
“আপনার সাথে দেখা করতে আসা রিস্কি। চোখ ফাঁকি দিয়ে আসা লাগে।”
“মনির, তুমি মেসেজ দিয়েছ, রবিনকে নিয়ে খবর আছে। ভণিতা না করে আগে সেটা বলো।”
“বলতেসি, রবিনরে মানে রবিন ভাইরে আরকি, মাইরে ফেলতে চাইতেসিল। তখন উনি বলসে উনি ম র লে ও প্রুফ থাকবে, ভিডিও লুকায়ে রাখসে। আজমল স্যার বলল, ওই ঘটনার পরে রবিন বাড়ি যায় নাই। কোথাও থাকলে সেটা ওর দোকানে। তাই…”
আফনান বলল, “মনির, ওই ভিডিও আমার কাছে আছে।”
আফনান জেনে-বুঝে কথাটা বলল। কিছু জিনিস যাচাই করা অত্যন্ত প্রয়োজন। প্রথম চাল দেয়া কমপ্লিট। এবার দেখার ওদিক থেকে কী আসে।
……….
(ক্রমশ)