জোনাকি প্রদীপ পর্ব-২২+২৩

0
229

#জোনাকি_প্রদীপ (পর্ব ২২)
নুসরাত জাহান লিজা

নিজের দলের কেন্দ্রীয় কমিটিতে আজমল খানকে নিয়ে এক ধরনের অনাস্থা তৈরি হয়েছে। এটা তিনি বুঝতে পারেন। দু র্নী তিসহ বিভিন্ন অনৈতিক ইস্যুতে তার নাম সরাসরি জড়িয়ে প্রকাশ্যে আসায় দল বিব্রত এখন। বস্তির বস্তা বন্দী টুকরো লা শ নিয়ে বিষয়টা ধামাচাপা দিলেও তাতে জনতার আঙুল যে তার আর তার ছেলের উপরে, তা প্রকাশ্য। তার মধ্যে ইন্ধন জুগিয়েছে রবিনের নিখোঁজ হওয়া।

সবমিলিয়ে তার অবস্থা টালমাটাল। তিনি যেকোনো উপায়ে নিজের হারানো ইমেজ পুনরুদ্ধার করতে মরিয়া। এখন সবচাইতে গলার কাঁটা হয়ে বিঁধে আছে আফনান নামের ছেলেটা। রবিনকে সরিয়ে দিয়ে এর শোধ তিনি তুলবেন বলে ঠিক করলেন। নির্বাচন শেষ হলে এই ছোকরাকেও তিনি দেখে নেবেন। হাঁটুর বয়সী একটা ছেলে, যার কোনো শক্ত ব্যাকআপ পর্যন্ত নেই। অথচ মেরুদণ্ড টনটনে সোজা।

আজমলের বয়স হয়েছে, অভিজ্ঞতায় পরিপূর্ণ একজন মানুষ। তার চুল দাড়ি বাতাসে পাকেনি। একে ঝাড়ে-বংশে নির্মূল করে তবে তিনি থামবেন। এভাবে এত সাহস যারা তার সাথে দেখিয়েছে, তাদের তিনি কড়ায় গন্ডায় বুঝিয়েছেন, আজমল খান আসলে কে।

হুইস্কির গ্লাসে আয়েসি চুমুক দিতে দিতে আগাগোড়া ভাবছিলেন, তখনই আরিফের কল এলো।

“বাবা, একটা গণ্ডগোল হয়েছে।”

“এটা ছাড়া আর কোনো সংবাদ দেবার মুরোদ তো তোমার নাই। বলো, শুনি কী গণ্ডগোল!”

“ওই রবিন যে স্বীকার করছিলো, ওর কাছে ভিডিও ক্লিপ আছে, ওইটা এখন ওর শালা না সৌম্বন্ধি, তার কাছে আছে। মনির খবর দিল।”

“ওর সাথে কথা হইসে তোমার?”

“না আব্বা, আপনেরে আগে জানাইলাম।”

“ভালো। ওই ছোকরার নম্বর দাও।”

ফোন কাটার প্রায় ত্রিশ সেকেন্ডের মধ্যে টেক্সট মেসেজে নম্বর চলে এলো আফনানের। তিনি গ্লাসের পানিয়তে শেষ চুমুক দিয়ে ডায়াল করলেন।

“ওই ছোকরা, তোমার কাছে যা আছে, চুপচাপ ফেরত দাও।”

“আপনি কে? কী ফেরত দেবার কথা বলছেন?”

“আমি আজমল খান। বেশি চালাকি করার চেষ্টা করবা না।”

“সেটা আপনাদের ডিপার্টমেন্ট। ধোঁকা দেয়া, আমার নয়।”

“কথা প্যাঁচাবি না, হা রা ম জা দা। তুই বুঝস না?”

তিনি ভব্যতার ধার ধারলেন না এবার। ঠান্ডা ইমেজ পরিহার করলেন।

“বুঝলাম, খুব ভালো মতো বুঝলাম।”

“আজকের মধ্যে ওইটা ফেরত দিবি। নাইলে তোর বোন জামাইরে আর দেখবি না।”

“আমাকে আপনি যত বোকা মনে করেছেন, ততটা বোকা কিন্তু আমি নই। শুনুন, ওই জিনিসটা আপনাদের কাছে এখন প্রাণভোমরার মতো। সেটা আমি জানি। এটা পেলেও রবিনকে ছাড়ার মতো উদার মন আপনার নেই। তাই চলেন, একটা অন্য পলিসিতে হাঁটি। গিভ এন্ড টেইক। রবিনকে অক্ষত অবস্থায় ছাড়বেন। এই জিনিসটা পেয়ে যাবেন। তখন আমার আপত্তি থাকবে না।”

“ওই বা** বাচ্চা, তুই দিবি, নাইলে পস্তাবি।”

“হতাশ হলাম। এসব ভাষা আপনার মুখে শোভা পায় না। আপনি একজন জনপ্রতিনিধি। এই রূপটা দেখলে লোকের আস্থা থাকবে?” গা জ্বালানো হাসির সাথে আফনানের এমন কথায় মেজাজের পারদ কয়েক সেন্টিগ্রেড চড়ল আজমলের।

“ছোকরা, বেশি বাড়লে কিন্তু…”

“সেটা আপনার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য স্যার। শুধু পেতে চাইলে তো হবে না, কিছু না দিলে ওমন একটা জিনিস যে আমি হাতছাড়া করব না।”

“তোর কাছ থেকে ওইটা হাতাইতে বেশি সময় লাগব না আমার।”

“আপনি তো বোকা নন স্যার। সেটা আরও অনেক জায়গায় আছে, আমার বা রবিনের কিছু হলে সাথে সাথে ওই ভিডিও পাবলিক হয়ে যাবে, প্রেস, সোস্যাল মিডিয়া সব জায়গায় আপনার মুখোশ খুব সুন্দরভাবে খুলে যাবে। সওদা করতে রাজি হলে আমিও রাজি।”

আজমল খান অতিশয় ধূর্ত মানুষ, পরিস্থিতি বুঝতে তিনি সময় নেন না। এবার তাই নরম গলায় বললেন,
“ঠিক আছে। রবিনরে ছাড়ব। কিন্তু তোমার কাছে আরও যে অনেক জায়গায় সেভ থাকবে না, তার গ্যারান্টি কী?”

“আমি আপনাদের মতো নই। ছা-পোষা মানুষ। রবিনরে অক্ষত পেলে, ওই ক্লিপের আর কাজ কী আমার। আমি ডিলিট করে দেব।”

“আচ্ছা, আগামীকাল রাত তিনটায়। রেডি থেকো ছোকরা।”

“একটা ছোকরাকে ভয় পাচ্ছেন? তাহলে বলতে হয় আমি ছোকরা নই, তাই না স্যার?”

আজমল খান কল কাটলেন। এভাবে ঘোল তিনি খাবেন না, প্ল্যান বি রেডি রাখতে হবে। প্রমাণ আর দুই স্বাক্ষী সবই যেন ঠান্ডা হয়। তিনি হারতে জানেন না।

***
আফনান ভেবেছিল হয়তো আরিফ ওকে ফোন করবে কিংবা দেখা করবে। কিন্তু আজমল খান স্বয়ং কথা বললেন। কথা বলার সময় হু ম কি তে সে ভয় পেয়েছে, কিন্তু এসব মানুষের সামনে দুর্বলতা দেখাতে নেই। তাই স্নায়ু শক্ত করে তার মোকাবিলা করেছে।

আফনান আরেকটা জিনিস নিশ্চিত হলো, মনিরকে বিশ্বাস করা যায় না। মনিরকে পেনড্রাইভের কথা বলার পেছনে আফনানের দুটো কারণ ছিল। এক, মনিরের বিশ্বাসযোগ্যতা যাচাই করা। দুই, জিনিসটা যে ওর কাছে এটার জানান দেয়া। তাতে ওদের পরবর্তী পদক্ষেপ সে জানতে পারবে।

প্রথমটা যদি পজিটিভ হতো, তাহলে চালটা অন্যভাবে দিতে হতো। যাই হোক, এত সহজে যে ওরা হাল ছাড়বে না এটা তো সহজেই অনুমেয়। প্রথম চাল দেয়া হয়ে গেছে। এবার ওর লোকবল লাগবে। এই বাজি জিততেই হবে। কারণ এতে জীবন জড়িয়ে আছে। ওর, রবিনের, ওর পরিবারের, সাথে একটা অনাগত নিষ্পাপ শিশুর।

আফনান বাসায় আসতে আসতে মাথায় এক আকাশ অনিশ্চয়তার খেলা চলছিল। আকাশে আজ এই মেঘ এই রোদ্দুর। ঠিক ওর মনের মতো।

বাসায় কলিংবেল বাজানোর মিনিটখানেক সময় লাগল দরজাটা খুলতে। তবে দরজার ওপাশে যাকে দেখল, তাকে দেখবার আশা সে দূরতম সুখ স্বপ্নেও এখন ভাবেনি।

অস্ফুটস্বরে নামটা মুখ দিয়ে বেরিয়ে এলো, “নীরা…”
…….
ক্রমশ

#জোনাকি_প্রদীপ (পর্ব ২৩)
নুসরাত জাহান লিজা

“তুই, এখানে… মানে কী করে..”

অনেকক্ষণ পরে কথাটা মুখ থেকে নিসৃত হলো আফনানের। এত বিষাদের মাঝেও হৃদয়ের কোথাও যেন একরাশ দমকা হাওয়া আচমকা পাওয়া এই খুশিতে দুলে উঠতে চাইল। চরম আরাধ্য কাউকে অপ্রত্যাশিতভাবে দেখলে এমন করেই বুঝি দোলা লাগে, নেচে উঠতে চায় সমস্ত অন্তর। সুখ সুখ তৃপ্তিতে আলোড়িত হয় মানুষ!

“অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে এটা আমার বাড়ি, তুমি মেহমান। তোমাকে প্যাম্পার করে ভেতরে ডাকতে হবে?”

নীরার উচ্ছ্বসিত গলায় সম্বিত ফিরল আফনানের। কতদিন পরে সেই কৈশোরে দেখা হাসিখুশি প্রাণচাঞ্চল্যে ভরা নীরাকে দেখল। হেসে ফেলল আফনান।

“নিলয় এসেছে?” উত্তরে কথা খুঁজে না পেয়ে ভেতরে আসতে আসতে প্রশ্ন করল আফনান। ততক্ষণে নীরা দরজা ছেড়ে জায়গা করে দিয়েছিল।

“হ্যাঁ। ওর সাথেই এলাম। তুমি রাগ করেছ? না বলে এসেছি বলে?”

“না, ছিঃ ছিঃ! এটা কেন মনে হতে যাবে! আমার কেন যেন ভীষণ ভালো লাগছে। বাড়ির সবাই কই?” রাখঢাক না রেখে বলল আফনান।

“এখন ফ্রেশ হয়ে এসো। আন্টি রান্না করছেন। একেবারে হুলস্থুল কাণ্ড করছেন। নিষেধ মানছেন না। শায়লা আপুকে এসবের মধ্যে আসতে দিইনি। আমি হাতে হাতে সাহায্য করছি।”

অনেকদিন বাড়িতে নিজেরা রান্না করেনি। ময়নার মা যা রান্না করে দেয়, তাতেই খাবার খাওয়া হয়। মা অতিথি আপ্যায়ন করতে ভীষণ ভালোবাসতেন একসময়। বহুদিন তেমন অতিথি বাড়িতে আসেই না। আজ সুযোগ পেয়েছেন। পরিস্থিতি যেমনই থাকুক, তিনি সমাদর করবেনই।

আফনান শায়লার বাসায় যেই রুমে থাকে সেখানে এসে দেখল নিলয় ঘুমুচ্ছে। হাত মুখ ধুয়ে আসতে দেখল জেগেছে।

“লম্বা জার্নি, ক্লান্ত লাগছিল। তাই একটু শুতেই ঘুম জড়িয়ে এলো।”

“কতক্ষণ আগে এসেছিস?”

“এই ঘণ্টা দুয়েক আগে। ওদিকের কী খবর? বলছিলি জরুরি আলাপ আছে।”

“হ্যাঁ। আজমল খান কল করেছিল।”

“কী বলে ব্যাটা?” আড়মোড়া ভেঙে উঠে বসল নিলয়। আচমকা যেন টানটান হয়ে গেল অবয়ব।

“তুই নিজেই শোন।” বলে আজমল খানের সাথে হওয়া কথোপকথনের কল রেকর্ডিং চালু করল আফনান।

সব শুনে নিলয় বলল, “ব্যাটা অসম্ভব ধূর্ত মাল। ওর ঠিক করে দেওয়া জায়গায় আমরা যাব না। পরেরবার কল দিলে তুই নিজে একটা জায়গার কথা বলবি।”

“হ্যাঁ, সেটা আমিও ভেবেছি। এক ফাঁদ থেকে বাঁচতে আরেকটা ফাঁদে পা দেবার কোনো মানেই হয় না।” বলল আফনান৷

এরমধ্যেই মা ডাকলেন, খাবার দেয়া হয়েছে।

“চল, আগে খাই। এরপর বাকিটা ভাবা যাবে।”

নিলয় বলল, “হ্যাঁ, ক্ষুধা পেয়েছে ভীষণ। যা সুস্বাদু গন্ধ আসছে, তাতে খিদে বেড়ে যাচ্ছে।”

আফনান হাসল। ওর আজ বহুদিন পরে মন যেন কিছুটা ভালো।

***
খাওয়া শেষে ঘরে এসে আবারও পরিকল্পনা করতে বসল দুই বন্ধু। তবে খাবার পরে নীরা সবার অলক্ষ্যে আফনানকে বলেছে ছাদে দেখা করতে কথা শেষে।

“ওসি সাহেবকে একবার বলা যায়?” আফনানের প্রস্তাব নিলয় নাকচ করে দিল।

“তাকে জানালে কোনোভাবে কথাটা যদি আজমলের কানে যায়! তাকে বিশ্বাস করাটা ঠিক হবে না। শোন, আমার ঢাকার প্রফেশনাল জায়গা থেকে একজনের সাথে সখ্যতা হয়েছিল, অত্যন্ত সৎ। উনাকে বলেছিলাম বিষয়টা। তার তদবিরেই তোর বাসায় সিকিউরিটি এসেছে। উনি যদিও বলেছেন এটা উনার আওতার মধ্যে নয়। তবে উনার প্রফেশনাল জায়গা থেকে না হলেও ব্যক্তিগত উদ্যোগে আমাদের সাহায্য করবেন বলেছেন।”

“তাহলে তো ভালোই হয়। আমি তাহলে মনিরের সাথে যোগাযোগ করে বলি, আমি আজমল বা আরিফের সাথে কথা বলতে চাই। ওদের সাথে সময়টা একটু পিছিয়ে দেই। আর জায়গাটা আমাদের ঠিক করা যেন হয়। তবে এখনই সেটা জানাব না। আধাঘন্টা আগে জানিয়ে দেব।”

নিলয় উত্তরে কিছু বলতে যাচ্ছিল, তখন রোকেয়ার কল এলো। সে জানে নীরাকে এখানে আনার জন্য কিছু অপ্রীতিকর কথা শুনতে হবে। যা আফনানের জন্য কষ্টকর। তাই উঠে বারান্দায় চলে গেল।

“মা, কেমন আছো?”

“ভালো আর থাকতে দিলি কই তোরা? নীরা নাহয় ছেলেমানুষ, কিন্তু তুই?”

“মা, নীরা এখন যথেষ্ট বড় হয়েছে।”

“শোন নিলয়, সত্যি কথা বল, নীরা বিয়েতে রাজি হচ্ছে না। কারণটা কি তোর বন্ধু আফনান?”

নিলয় জানে লুকোনো যাবে না। এই পরিস্থিতিতে কোনো বন্ধুর বোন ছুটে যায় না। তাই বলল, “তাই তো মনে হয়।”

“নিলয়, তোর মাথায় বুদ্ধিশুদ্ধি নেই? কই সায়মন আর কই আফনান? আমাদের পরিবারের সাথে আত্মীয়তা করার মতো মনে হয় আফনানকে? তোর বন্ধু বলে বাসায় আসত। আমিও সেভাবেই দেখেছি ওদের। তাছাড়া ওর মা ডিভোর্সি। ওমন ব্রোকেন ফ্যামিলিতে যারা বড় হয় তারা স্বার্থপর হয়৷ নিজেরটা ছাড়া কিচ্ছু বোঝে না৷ তুই এক্ষুণি চলে আসবি।”

“মা, এসব কী বলছ? ব্রোকেন ফ্যামিলি, তাতে আফনানের কী দোষ? নীরা ওকে পছন্দ করে।” যতটা সম্ভব গলা নামিয়ে কথা বলার চেষ্টা করছে নিলয়।

“ওসব পছন্দ আমি মানি না। সায়মনকে আমাদের পছন্দ। তোর বন্ধুকে স্পষ্ট করে বলে দিস আর যেন আমাদের বাড়িতে না আসে। তুই না এলেও নীরাকে এখনি পাঠিয়ে দে।”

“মা এখন রাত। আফনানকে আমি চিনি।”

“সায়মন খুব ভালো ছেলে। সবাইকে সম্মান করে। মিশুক, হাসিখুশি। নীরাকে কত পছন্দ করে। আর আফনান?”

“মা, প্লিজ, বারবার আফনানের সাথে সায়মনের তুলনা করো না তো। একেকজন একেক রকম। সায়মন ভালো বলে আফনান খারাপ, তোমাকে কে বলল?”

“একটা অশান্তি করব আমি দেখিস। আমি কোনোভাবেই নীরার সাথে আফনানকে মানবো না।”

“শুধু শুধু অশান্তি কেন করবে মা? নীরা যথেষ্ট বড় হয়েছে। ওর সিদ্ধান্ত ওকেই নিতে দাও।”

“ওর বড়ত্বের নমুনা তো দেখলামই। তোরা দুইজনই এক। আমার পছন্দের তো গুরুত্ব নেই কারো কাছে। তোরা কেউ আমার তোয়াক্কা করিস না।” বলতে বলতে কেঁদে ফেললেন রোকেয়া।

“মা, কেঁদো না, প্লিজ। এখন একটা ঝামেলার মধ্যে আছি। পরিস্থিতি একটু স্বাভাবিক হোক। আমি আফনান আর নীরাকে তোমার দিকটা বুঝিয়ে বলব। এখন একটু শান্ত হও। প্লিজ!”

কথা শেষে ভেতরে এলো নিলয়। খেয়াল করার চেষ্টা করল আফনান কিছু শুনেছে কিনা! তেমন কিছু মনে হলো না বলে এ যাত্রায় স্বস্তি পেল।

“মনিরের সাথে কথা হলো?”

“না, এসএমএস করেছি। ও টেক্সটেই জানালো চেষ্টা করবে।”

আফনানের গলা যেন খানিকটা বিমর্ষ ঠেকল নিলয়ের কাছে। তবে বাকি জরুরি আলোচনা শুরু করল আফনান, আর কিছু ভাবা হলো না।

***
রোকেয়ার নিলয়ের সাথে কথা বলা শেষ হতেই মঈদুল ঘরে এলেন।

“কী ব্যাপার? কী ভাবো?”

“আমার ভাবনার কী আর শেষ আছে! তোমরা বাপ, ছেলে আর মেয়ে মিলে আমাকে ব্যতিব্যস্ত রাখো সবসময়।”

“এভাবে কথা বলছ কেন রোকেয়া?”

“তুমি কোনো খোঁজখবর রাখো? নীরা এখন কই জানো?”

“কেন? নিলয়ের বাসায়!”

“না, তোমার আদরের মেয়ে এখন আফনানের বাসায়। ছিঃ ছিঃ! লজ্জায় আমার মাথা কাটা যাচ্ছে।”

এবার মঈদুল বিচলিত গলায় বললেন, “ঘটনা কী বলবে তো।”

রোকেয়া গজগজ করতে করতে সব বললেন।

“সাথে নিলয় আছে। সমস্যা কী?”

“তোমার মতো মুক্তমনা আমি হতে পারিনি নিলয়ের বাবা। আমার চিন্তা হয়। সায়মনের সাথে ওর বিয়ে হবে কয়দিন পরে। সে এখন ছি ছি!”

“রোকেয়া, তুমি মুক্তমনা বলে আমাকে যে খোঁচাটা দিলে আমি কিন্তু সেটা নই। তবে নীরাকে চিনি। সে অন্তত ভুল কিছু করবে না।”

“তোমার মতো সবাই তো চিন্তা করে না। সায়মনের বাড়ির লোকের কানে গেলে কী হবে!”

“নীরা যদি আফনানকে পছন্দ করে, তাহলে সায়মনের প্রসঙ্গ আসবে কেন?”

“কারণ পাত্র হিসেবে সায়মন যথেষ্ট যোগ্য। আফনানের কী যোগ্যতা?”

“সেটা নীরার ভাবা উচিত। ছেলেটা যদি খারাপ হতো তবে আপত্তি করতাম৷ আফনান ভালো ছেলে। শিক্ষিত, মার্জিত।”

“কিন্তু ব্রোকেন ফ্যামিলির সন্তান। তুমি ছেলেমেয়ের সিদ্ধান্তে এত লিবারেল, তাহলে নিলয়ের বেলায় কী বলবে? আমার আপত্তি শুনলে না। বিয়ে দিলে ওর পছন্দের মেয়ের সাথেই৷ এখন সে চাকরি পেয়ে রাজশাহী চলে যাচ্ছে৷ আমি ভুল দেখি না।”

“তুমি এত উত্তেজিত হয়ো না। ওর চাকরি হয়েছে সেখানে। করবে না? আর এখনই এত না ভাবি আমরা। নীরা ফিরুক। এরপর ওর সাথে বসে সিদ্ধান্ত নেয়া যাবে।”

“ওরা আমারও সন্তান। আমি নয় মাস যন্ত্রণা সহ্য করে পেটে ধরে ওদের জন্ম দিয়েছি৷ ওদের ভালো-মন্দের সিদ্ধান্ত নেবার সুযোগ আমারও আছে।” এই বলে প্রচণ্ড ক্ষিপ্ত ভঙ্গিতে আর একপ মুহূর্ত না দাঁড়িয়ে বেরিয়ে গেলেন রোকেয়া।

মঈনুলের কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ল।

***
রাত সবে সাড়ে দশটা। নীরার ডাকে ছাদে এসেছে আফনান। আজ রাতটা যেন গুমোট হয়ে আছে। আকাশটা যেন অজস্র বিষাদ জমিয়ে রেখেছে তার চাদরে।

“বল নীরা!”

নীরা চোখে কাজল দিয়েছে। পাশের বাড়ির ছাদ থেকে মৃদু আলো আসছে এদিকে। এক চোখের কাজল এলোমেলো হয়ে আছে। তাড়াহুড়োর ছাপ। তবে এই মৃদু আলোয় ভারি মোহনীয় লাগছে। এক পৃথিবী মায়া ওর গভীর চোখ দুটোতে। এই চোখের সমুদ্রে ডুব দিয়ে হাজারটা কবিতা লেখা যায়। আফনান কবি হলে হয়তো লিখতে পারত। জীবনে প্রথমবার কবি না হতে পারার অক্ষমতায় আফসোস হলো।

“রবিন ভাইকে কীভাবে রেসকিউ করবে, প্ল্যান করা শেষ?”

“প্ল্যান কতটা কাজে লাগবে সেটার উপরে সব ডিপেন্ড করছে নীরা। হাজারটা প্ল্যানও অর্থহীন, যদি না এক্সিকিউট করা যায়।”

“তোমরা পারবে আফনান ভাই। আমি দোয়া করি খুব। রবিন ভাই তার সন্তানের সাথে হাসবে খেলবে। শুধু একটু বিশ্বাস রেখো নিজের উপরে। আমার বিশ্বাস এটা।”

আফনান যেন কিছুটা সাহস পেল। নীরা প্রসঙ্গ পরিবর্তন করে বলল,

“আমি তোমার চিঠিটা পুড়িয়ে ফেলেছি, জানো। ভেবেছিলাম আর কোনোদিন তোমার সামনে আসব না। আমি যে যন্ত্রণা সয়েছি, তুমিও একই যন্ত্রণায় দগ্ধে মরো। কিন্তু এখন অনুশোচনা হচ্ছে। ওমন আবেগ মাখা চিঠিটা আমি কী করে পোড়ালাম! আমাদের বিয়ের পরে তুমি আমাকে রোজ একটা করে চিঠি লিখবে কিন্তু।”

নীরার কথায় আফনান চমকে উঠে বলল, “কার বিয়ে?”

“আফনান, কার আবার? তোমার আর আমার। আমাদের বিয়ে।”

আফনানের মনে একটু আগে নিলয় আর ওর মায়ের কথা মনে পড়ল। যত আস্তেই বলুক নিলয়, ওর কানে এসেছে। তখন থেকেই সে ভেতরে ভেতরে নিভে যাচ্ছে। এখন মনে হচ্ছে, ওর সামনে যেই অপার্থিব রমনী দাঁড়িয়ে আছে, তার আহ্বান হাত বাড়িয়ে গ্রহণ করে। কী ক্ষতি হবে একটু স্বার্থপর হলে! ওরা তো পরস্পরকে ভালোবাসে। বাকি দুনিয়া কী বলল, তাতে কিচ্ছু এসে যায় না। কিন্তু আফনান পারে না।

ওর জীবন বর্তমানে আরও জটিল হয়ে গেছে। আগামীকাল সে বেঁচে ফিরবে কিনা, তারই নিশ্চয়তা নেই। যদি বেঁচেও ফিরে, রবিনকে সুস্থভাবে নিয়ে। তবুও ওরা তাকে ছেড়ে দেবে না। ঠিকই বিপদ ওঁৎ পেতে থাকবে প্রত্যেকটা ক্ষণে। সেখানে একটা রাতের জন্য একজন মেয়েকে কেন মিথ্যে স্বপ্নে ভাসাবে! নীরার সুন্দর একটা ভবিষ্যৎ আছে। আফনান নীরার যোগ্য নয়।

“নীরা, আমি অপারগ। পারব না রে। তুই ফিরে যা।”

নীরার হাসি মিলিয়ে গেল সহসাই।

“তুমি আবার আমাকে ফিরিয়ে দিচ্ছ?”

আফনানের গলা বুঁজে আসছে, তবুও সে কোনোমতে বলল, “কেউ মানবে না। এমন ছেলেমানুষি সিদ্ধান্ত নিস না। তাছাড়া সায়মন খুব ভালো ছেলে।”

নীরা সেই মৃদু আলোতে আফনানের অভিব্যক্তি পর্যবেক্ষণ করার চেষ্টা করছে। ওর চোখে অন্তর্ভেদী দৃষ্টি। শুধু চোখে চোখ রেখেই যেন আফনানের ভেতরটা পড়ে ফেলতে চাইছে।

“জীবনটা আমার। আমার কীসে ভালো, কীসে মন্দ সেটা তোমাকে ভাবতে হবে না। কাউকেই ভাবতে হবে না। সেই অধিকার শুধু আমার। তুমি শুধু বলো, তুমি আমাকে ভালোবাসো? মিথ্যে বলার চেষ্টা করবে না খবরদার। কারণ সত্যটা একবার তুমি জানিয়ে এসেছ আমাকে।” নীরা গলা অসম্ভব কঠিন, পাথুরে।

উত্তর দেবার আগে নিলয়ের ওর মাকে বলা কথাটা চোখ রাঙিয়ে গেল। ‘ব্রোকেন ফ্যামিলি, তাতে আফনামের দোষ কী?’ না, আফনান স্বার্থপর হতে পারবে না।

“ভালোবাসি। মিথ্যে বলব না। কিন্তু আমি তোর অযোগ্য। অবিবেচক নই। আমার জীবনটা খুব কঠিন।”

“আজ ফিরিয়ে দিলে আমাকে আর কোনোদিন পাবে না। এবার উত্তর দাও।”

সময় নিল আফনান। নীরাকে গভীর আবেগে আলিঙ্গনে আবদ্ধ করে নিজের সমস্ত না পাওয়াকে পূর্ণ করে নিতে ইচ্ছে হলো আফনানের। এমন সুতীব্র ভালোবাসার আহ্বান সে ফিরিয়ে দিতে পারবে না। কিছুতেই না।

পরক্ষণেই বাস্তবতার মাটিতে আছড়ে পড়ে নিজেকে ধাতস্থ করে নিয়ে সে উত্তরে বলল,

“ফিরিয়ে দিলাম।” গলাটা কী তবুও কেঁপে উঠল!

“তুমি একটা কাপুরষ।”

“এটাও মানলাম।” নির্লিপ্ত থাকার চেষ্টা বারবার ব্যর্থ হচ্ছে আফনানের।

“কেন মানলে? তোমার সাহস নেই?”

“যদি বেঁচে না ফিরে আসি?”

“আমি অপেক্ষা করব, তোমার বেঁচে ফিরে আসার আমার সমস্ত শুভকামনা আর দোয়া নিয়ে।”

“করিস। এই মুহূর্তে দোয়াটুকু ভীষণ প্রয়োজন। তবুও তুই এই সিদ্ধান্তে অটল থাক আমি চাই না। জীবনটা আমারও নীরা। সেটার সিদ্ধান্ত তোকে জানিয়ে দিলাম।”

নীরা আর একটা কথাও বলল না। গভীর চোখ দুটো দিয়ে আর একবার আফনানের দিকে তাকাল। এরপর সেই গুমোট আকাশে দৃষ্টি সরিয়ে নিল। নিরার চোখের বিষাদটুকুর ভার আকাশ আর সইতে পারল না যেন। টুপটাপ ফোঁটা পড়তে শুরু করল বৃষ্টির।

নীরা ধীরে ধীরে ছাদ থেকে নেমে যাচ্ছে, যেন হেরে যাওয়া মানুষ সে। কিন্তু চোখে জল নেই একফোঁটা। যখন ছাদে এসেছে তখন দূর থেকে উচ্চশব্দে গান ভেসে আসছিল। এতক্ষণ খেয়াল হয়নি। এখন কথাগুলো কানে এলো আফনানের,

“কেউ কোথাও ভালো নেই যেন সেই
কতকাল আর হাতে হাত অবেলায়
কতকাল আর ভুল-অবসন্ন বিকেলে
ভেজা চোখ দেখাইনি তোমায়।
সেই কবেকার ভায়োলিন, বেজে যায় কতদিন
প্রাণে চাপা ঢেউ, দেখেনি আর কেউ!
কখনো অভিমান, অবাধ্য পিছুটান
জানি না কী কষ্টে এই অবেলায়,
তবুও নির্বাসন বাসর সাজিয়ে
ঠোঁটে চেপে ধরা থাক ভালোবাসায়।
ঘুণে খাওয়া মেঘে কালো হয়ে যায় এ হৃদয় যখন
একা একা শুধু অকারণেই ঝরে বৃষ্টি এমন….
ভীষণ কালো মেঘ পুড়ে ছাই আবেগে আজও তাই
অবাক জোছনায় পোড়া চোখ তবুও সাজাই… কেউ কোথাও ভালো নেই…

নীরা মনে হলো, আসলেই কেউ কোথাও ভালো নেই। আফনান, নীরা, শায়লা রবিন, নিলয়, আনিকা, আফনানের মা। কেমন দমচাপা দুর্বোধ্য এক যন্ত্রণা, সবার টুঁটি চেপে ধরে রেখেছে। সিঁড়ি বেয়ে নামতে নামতে ওর পোড়া চোখ দুটো বেয়ে এতক্ষণে কয়েক ফোঁটা জল গড়ায়। গভীর বিষাদে! কান্নার কোনো রঙ না থাকলেও ভীষণ পোড়ায়। এক সমুদ্র কান্না বুকে নিয়েও ভেতরটা কেমন পুড়ছে, দগ্ধ হচ্ছে আগুনে। কান্নার জলের কীসের এত বড়াই, যদি হৃদয়ের তপ্ত আগুনই না নেভাতে পারে!
……….
(ক্রমশ)