#জোনাকি_প্রদীপ (পর্ব ৩২)
নুসরাত জাহান লিজা
সেদিন নীরাকে সায়মনের সাথে দেখার পর থেকে অদ্ভুত এক অস্থিরতা গ্রাস করেছে আফনানকে। ভুলে যাওয়ার জন্যই এত কসরত করে পালিয়ে বেড়ানো, অথচ কিছুতেই ভোলা হলো না। বরং মনের মধ্যে উচাটন হচ্ছে। এই নক্ষত্রের নিচে ওর এই অসহ্য যন্ত্রণার কোনো উপশম নেই যেন। আজ মনে হলো একটু স্বার্থপর হলে কী এমন ক্ষতি হয়ে যেত। সে তো এটুকুই চেয়েছিল নীরা সুখী হোক। সুখীই তো মনে হলো, তবুও অন্য কারোর সাথে সেই সুখ থেকে আফনান কেন এতটা দগ্ধ হচ্ছে! এমনটা তো হবার কথা ছিল না।
ঘুম বিদায় নিয়েছে ওর চোখ থেকে। নীরার কি সত্যিই বিয়ে হয়ে গেছে! ওর কোনো আশাই কী আর অবশিষ্ট নেই! নিজের এমন ভাবনায় নিজেকেই শাসায় আফনান। নীরার জন্য এমন ভাবনার অধিকার ওর আর নেই। তবুও হৃদয় বড্ড অবোধ। সে মস্তিষ্কের কথা শোনে না। তবে ওর একবার জানতেই হবে নীরার বিয়ে হয়ে গেছে কি-না। যদি না হয়ে থাকে সে একবার শেষ চেষ্টা করে দেখব।
মনের কোনো এক কোন থেকে ধিক্কার আসে, “নীরা কোনো খেলনা নয়। অমূল্য রত্নকে হেলায় ফেলে রাখলে তাকে আর ধরা যায় না। আর তুই ভাবছিস এতবার করে অপমানিত হবার পরেও সামনে দাঁড়ালে সে হাসতে হাসতে তোর গায়ে ঢলে পড়বে? ভুল, তুই মস্ত বড় ভুল।”
নিজের সাথে নিজেরই যু দ্ধ হয় আফনানের। যাকে পেতে অনন্ত সাধনা প্রয়োজন, সে যখন নিজেই ওর কাছে নিজেকে সঁপে দিয়েছিল, সে ফিরিয়ে দিয়েছিল। আজ আর কিচ্ছু বাকি নেই।
সকালে আয়েশা এলেন আফনানকে ডাকতে। কপালে হাত দিতেই উপলব্ধি করলেন জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে ছেলের। গত একবছর থেকেই তিনি ছেলের মধ্যে পরিবর্তন দেখছেন৷ কেমন যেন ছাড়াছাড়া ভাব। ছন্নছাড়া চলাফেরা। অথচ আফনান ছেলেবেলা থেকে ভীষণ গোছানো স্বভাবের। যা করে একাগ্রতা দিয়ে করে। অবশ্য এমন আচরণের কারণ সম্পর্কে তিনি অবগত।
নীরাকে তার ভারি পছন্দ হয়েছিল। আফনানের প্রতি মেয়েটার প্রবল টান তার চোখ এড়ায়নি। এর মধ্যেও তো তেমনই দেখেছিলেন। তবুও কিছু হলো না।
আফনানকে ডেকে তুলে খাইয়ে দিলেন, ওষুধ খাইয়ে মাথায় পানি দিয়ে দিলেন। দুপুরের দিকে জ্বর নামল খানিকটা।
শায়লা এলো বিকেলে। কোলে ছোট্ট রায়া। আফনান জ্বর গায়েও ওকে কোলে নিয়ে বসে রইল। এই পুচকেটাকে সে ভীষণ ভালোবাসে। কী মিষ্টি করে হাসে। দাঁড়াতে শিখেছে, হাত ধরলে এক পা দুই পা হাঁটে। অস্পষ্ট বুলিতে কী বলতে চায় কিছুই বোঝা যায় না, তবুও ভালো লাগে ভীষণ। এক চিলতে হাসি ফুটে।
শায়লা ওর মোবাইলটা রেখে গেছে। হঠাৎ বেজে উঠল। শায়লা মায়ের সাথে রান্নাঘরে কী যেন করছিল, সেখান থেকে বলল,
“কলটা ধর আফনান। রবিন মনে হয়।”
আফনান মুঠোফোন হাতে নিয়ে নামটা দেখল। রবিন নয় নীরা। কোন নীরা! সে শায়লাকে আর ডাকল না। কৌতূহল নিয়ে কল রিসিভ করে কানে ধরল।
“শায়লা আপু, রায়া সোনামণি কেমন আছে?”
এপাশ থেকে আফনান নীরব। ওর যেন ভাষা বিস্মৃতি ঘটেছে। একটা কথাও বের হচ্ছে না।
“হ্যালো, হ্যালো….. হ্যালো শায়লা আপু, শুনছ?”
“কেমন আছিস নীরা?”
অবশেষে প্রায় অস্ফুটস্বরে বলল আফনান।
“খুব ভালো আছি। শায়লা আপুকে বোলো, ফ্রি হলে কল দিতে।”
বলেই রাখল নীরা। আফনান আচ্ছন্নের মতো বসে রইল। রায়ার ছোট্ট হাতের খামচি খেয়ে সম্বিৎ ফিরল।
“কী রে, রবিন কী বলল?”
“তোর নীরার সাথে যোগাযোগ আছে?” গলায় অস্থিরতা ওর।
“ওর সাহসিকতার জন্য আমি আর রায়া অক্ষতভাবে বেঁচে আছি আফনান। ওর সাথে যোগাযোগ থাকবে না?”
“হ্যাঁ, তাই তো। আমাকে বলিসনি তো!” অনেকটা বোকা বোকা মনে হলা নিজেকে।
“ওর সাথে কথা হয়, সেটা তোকে বলে কী হবে?”
উত্তর না দিয়ে পাল্টা প্রশ্ন করল সে, “আচ্ছা শায়লা, ওর কি বিয়ে হয়ে গেছে?”
“আফনান, এসব জিজ্ঞেস করার প্রয়োজন আছে কী এখন? তুই তো ওকে তোর ডিসিশন চাপিয়েই দিয়েছিস।” কঠোর শোনায় শায়লার গলা। নীরার সাথে এই বিষয়ে ওর কথা হয়নি। কেবল সেই সময় খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে আফনানের কাছ থেকে শুনেছিল। জানার পরে ভাইয়ের উপরে কিঞ্চিৎ রাগও হয়েছিল। সেই রাগ এখনো বহাল তবিয়তে আছে।
“বল না প্লিজ।”
“জেনে কী লাভ? বিয়ে হয়ে গেলে কী করবি? এক বোতল মদ নিয়ে ওর শ্বশুরবাড়ির সামনে গিয়ে মাতলামো করে মরবি? দেবদাস হবি?”
“ভুল করেছি। সেটা একবার শুধর নেবার চেষ্টা করব।”
“না বিয়ে হয়নি। তবে সারাজীবন নিশ্চয়ই তোর জন্য বসে থাকবে না।”
বলে শায়লা আফনানের কপালে হাত দিয়ে দেখল জ্বরের উত্তাপ তেমন একটা নেই। রায়াকে নিয়ে বেরিয়ে গেল সে। আফনান বসে রইল। নতুন পাওয়া এই তথ্যটা ওকে প্রশান্তি দিল খানিকটা। তবে সামনে হয়তো সায়মনকে বিয়ে করবে।
আফনান নিলয়কে কল দিয়ে প্রশ্ন করার ভাবনা শুরুতেই বাতিল করে দিল। কন্টাক্ট লিস্ট ঘেটে দেখল ওর কাছে ইরার নম্বর আছে। সে ডায়াল করল।
“ইরা, আমি আফনান।”
“আমাকে মনে পড়ল তোমার? কোনোদিন কল দাও না।”
“তোর হেল্প লাগবে রে। এই ভাইটাকে হেল্প করবি না?”
“তার বিনিময়ে কী পাবো?”
“কী চাস তুই?”
“চকলেট। ভয় নেই, তোমার সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করব না।”
“পেয়ে যাবি। তোকে চকলেটের পুকুরে চুবিয়ে রাখব।”
“তোমার মতলব কী আফনান ভাই? ঝেড়ে কাশো তো!” হেসে বলল ইরা।
সংকোচ নিয়ে বলল আফনান, “নীরা আর সায়মন….
ওকে শেষ করতে না দিয়ে ওই প্রান্তে ফিঁক করে হেসে ফেলল ইরা, “তাই তো বলি, তোমার এতদিনে আমার কথা কেন মনে পড়ল। শোনো, সায়মন ভাইয়ার বিয়ে হয়ে গেছে গতকাল। নীরা আপু সাফ জানিয়ে দিয়েছে সে চিরকুমারী সংঘের লাইফটাইম মেম্বারশিপ নেবে। তোমার চান্সও খুব কম।”
“এরকম কোনো সংস্থা আছে নাকি দেশে?”
“না থাকলে নীরা আপু বানাবে। সে হবে পাইওনিয়ার। যদি নীরা আপুকে রাজি করাতে না পারো তবে তুমিও ওখানকার মেম্বারশিপ নিয়ে নিও।”
“এত ফাজিল হয়েছিস তুই? সামনে থাকলে মাইর দিতাম। এখন একটা উপায় বল, কী করা যায়?”
“আমাদের বাড়িতে যাও। বাঘ আর সিংহের মোকাবেলা করে দেখো। যদি জিততে পারো, তাহলে কেল্লাফতে। আমরা একটা বিয়ে খেতে পারব। নীরাপুর বিয়ে নিয়ে মনে মনে কত প্ল্যান ছিল, বেচারি বিয়ে না করলে সেসব কিচ্ছু হবে না।”
“তোদের বাড়িতে আমাকে ঢুকতে দেবে?”
“দাঁড়াও, আমি ইলার সাথে কথা বলি। আমি বাড়িতে এসেছি আজই। তোমাকে কিছুক্ষণ পরে জানাচ্ছি।”
“ইলা? ও ছোট মানুষ।”
“ভুল আফনান ভাই। বলো ছোট মরিচ। সাইজে ছোট, কিন্তু ঝাল বেশি।”
এর প্রায় আধাঘণ্টা পরে ইরা আর ইলার সাথে আবার কথা হলো। আফনান ঠিক করল, আগামীকালই সে যাবে। মেয়ে বাঘ, মা সিংহ। বনের রাজত্ব দখল করতে চাইলে এই দুটো পরাক্রমশালী প্রতিপক্ষকে জয় করতে হবে। ভীষণ কঠিন এক লড়াই।
নীরাকে সে চেনে। জানে সহজ হবে না শুধরানো। হয়তো কিছুই হবে না। তবুও ভাগ্য যেহেতু ওর জন্য এখনো চেষ্টা করার সুযোগ রেখেছে, সে এবার হাল ছাড়তে চায় না। আরেকটা বাঁধা আছে, নিলয়। বন্ধু হলেও সে নীরার বড় ভাই। কীভাবে নেবে সে। ভুল বুঝবে না তো!
***
রোকেয়া রান্নাঘরে ছিলেন। এখনো রান্নাটা তিনি আর মরিয়মই করেন। সেখানে ইলা এসে দাঁড়ালো। হাতে আচার। ওর আচার খাওয়া দেখে মনে হচ্ছে এরচাইতে মজার কোনো খাবার পৃথিবীতে নেই।
“তোর পড়াশোনা নেই?”
“মা, আমি একটা কথা ভাবলাম। তুমি বলতে না, পড়াশোনা না করলে বিয়ে দিয়ে দেবে? তাই দাও। পড়তে ভালো লাগে না। ফেল্টু মেয়েকে কে বিয়ে করবে। পরে দেখা যাবে নীরাপুর মতো থাকতে হবে।”
রোকেয়া বললেন, “নীরার রেজাল্ট জানিস তুই?”
“নীরাপুকে ফেল্টু বলিনি। চিরকুমারী থাকার ব্রত নেয়া লাগবে, তাই বললাম।”
মরিয়ম বুঝতে পারছেন পাজি মেয়েটা কথা অন্যদিকে নিতে চাইছে। রোকেয়া রেগে যাচ্ছেন। তাই সামলানোর জন্য মেয়েকে ধমক দিলেন,
“ইলা, যা তো। কানের মধ্যে ফ্যাচফ্যাচ করিস না।”
“নীরাপু কোনোদিন বিয়ে করবে না। বলেছে তো। আচ্ছা আমার মনে হয় এর একটা ওষুধ আছে। আফনান ভাইকে দিয়ে একবার চেষ্টা করা যায় না? বেচারা দু’টোর একটা গতি হয়। নইলে নীরা আপু সারাজীবন একাই কাটিয়ে দেবে।”
বলে দৌড়ে বেরিয়ে এলো। ওর কাজ শেষ। বেড়ালের গলায় ঘণ্টি বাঁধা কমপ্লিট। এখন সেটা বাজার অপেক্ষায়। রোকেয়াকে ইলা ভয় পায় কিছুটা। তবে এটুকু করতেই হতো। দেখা যাক কতটা কাজ হয়।
………
(ক্রমশ)
#জোনাকি_প্রদীপ (পর্ব ৩৩)
নুসরাত জাহান লিজা
রোকেয়া নীরার উপরে মনে মনে বীতশ্রদ্ধ হয়ে আছেন। পারলে ঠাঁটিয়ে গালে কয়েকটা চড় মেরে দিতেন। বাবার জন্য তেমন শাসন করা হয়নি বলে মাথায় চড়ে বসেছে। দুনিয়াটা ওর ইচ্ছে মতো চলবে নাকি! যার জন্য চুরি করা সেই যখন চোর বলে সাব্যস্ত করে তখন দুঃখের শেষ থাকে না।
জেদ ধরেছে বিয়ে করবে না। দুনিয়াটা এতই সহজ! দুদিন আগে যাকে তিনি অস্বীকার করে নানানরকম কথা শুনিয়ে নিরস্ত করেছেন এখন তাকেই ডেকে নিয়ে আসতে হবে, এটা ভাবতেই তার গায়ে জ্বালা ধরে যাচ্ছে। ওই ছেলে নীরাকে রাজি করাতে পারলে তাকে জামাই আদর করতে হবে। তার সাথেই কেন এমন হয়!
তিনি একজন মানুষ, তার ইচ্ছে অনিচ্ছা, পছন্দ অপছন্দের মূল্য কারোর কাছেই নেই। যাদের পেটে ধরে জন্ম দিয়েছেন, তাদের কাছেও নয়। নিলয়কে তিনি বুকে আগলে মানুষ করেছেন, অথচ ছেলে বিয়ে করল নিজের ঠিক করা মেয়েকে। ওদের বাবাও সারাজীবন চলেছেন নিজের মতো করে। তিনি যেন সংসারে ব্রাত্য।
তিনি মঈদুলকে বললেন, “নীরার বাবা, মেয়ের বিয়ের উদ্যোগ নিতে হবে না? তোমার তো কোনো হেলদোল নেই।”
“এসব তোমার ডিপার্টমেন্ট। তাছাড়া মেয়ে তো আর অবুঝ নয়। অবিবেচকও নয়।”
“তাহলে নিলয়ের বন্ধুকে বাড়িতে নিয়ে এসো।”
“সে কী? ওকেই যদি ডাকতে হয়, তবে মিছেমিছি জল ঘোলা করার কী দরকার ছিল?”
স্বামীর কটাক্ষ তার জ্বালা বহুগুণে বাড়িয়ে দিল। তবে তিনি পাকচক্রে পড়েছেন। এখন গায়ে এসে কাদা মাখবেই। আজ ইলার কথা শুনে তার রাগ হলেও কথাগুলো তাকে ভাবিয়েছে। মেয়েটার যা জেদ, যা বলেছে তার নড়েচড় হবার কোনো সম্ভাবণা নেই বললেই চলে। তবে নিলয়ের বন্ধুকেই যেহেতু বিয়ে করার জন্য উদগ্রীব হয়েছিল, সে চেষ্টা করলে হয়তো মেয়ের মতি ফিরতেও পারে।
তিনি মঈদুলের কথার পৃষ্ঠে বললেন, “খুব মজা, তাই না? মেয়ে সারাজীবন তপস্বী হোক, তাই চাও?”
“দেখো, তুমি ছেলেটাকে যেভাবে বলেছ, তা ভীষণ অপমানজনক। মা তার দুর্বল জায়গা। সেটা নিয়েও কথা শুনিয়েছ। আমি বললেই সে আসবে এমনটা ভাবা অবান্তর।”
“তুমি বলবে না?”
“আগে তুমি কথা বলো। পরে দেখা যাবে।”
স্বামীর দিকে কটমটিয়ে তাকালেন রোকেয়া। এরপর নিলয়কে কল দিলেন।
“নিলয়, তুই একটু তোর বন্ধুর সাথে কথা বলিস তো।”
“আমার কোন বন্ধু?”
“ওইযে নীরার সাথে…”
“আফনানের কথা বলছ?”
“হ্যাঁ, ওই আফনান।” নামটা তার মনে ছিল, কিন্তু মুখে আনতে ইচ্ছে করেনি।
“কেন?”
“কেন মানে? বুঝিস না তুই? নীরার জন্য চিন্তা খালি আমার?”
“খুলে বলো তো মা তোমার প্ল্যান কী?”
“এত বলতে পারব না। তুই ওকে ডাক। বাড়িতে আসুক। তোর আদরের বোনের বৈরাগ্যের ভূত নামুক।”
“মা, এটা ছেলেমানুষি না?”
“হলে হোক। তুই কথা বল। এখনি বল। আগামীকালের মধ্যে এই বাড়িতে যদি পৌঁছাতে পারে, তবে আমি আপত্তি করব না। কিন্তু তারপর আর মানব না।”
রোকেয়া একেবারেই মন থেকে মানতে পারছেন না। তবুও তিনি চাইছেন, মেয়েটা এগিয়ে যাক। কখনো কখনো প্রতিকূলতার সাথে আপোষ করতে হয়, তিনি নাহয় আপোষ করলেন।
***
নিলয় আফনানকে কল করল, “আফনান, মা তোকে আগামীকালের মধ্যে আমাদের বাড়িতে যেতে বলেছে।”
“কারণ?”
“আফনান, শালা গাট্টা খাবি। ডুবে ডুবে জল খাওয়ার জন্য আমার বোনকেই তোর চোখে পড়ল।”
“নিলয়, তুই আমাকে ভুল বুঝিস না, আমি নীরাকে সত্যিই ভালোবাসি।”
“ঘোড়ার ডিম। এখন যদি বলি আমার আপত্তি আছে। আমি নীরার বিয়ে তোর সাথে দেব না?”
“আগে বললে ভেবে দেখতাম। এখন নীরার উপরে সব, তোর কথায় কাজ হবে না। এমনিতেই অনেক বড় ভুল করেছি। আর করতে চাই না।”
“তাইলে কালকের মধ্যেই আমাদের বাড়িতে চলে যা। মা’র এই অফার কিন্তু সীমিত সময়ের জন্য প্রযোজ্য।”
“তুই থাকবি?”
“নীরাকে রাজি করা। বিয়েতে লম্বা ছুটি নিতে চাইলে এখন আর হবে না। তুই ভালোই ভালোই যা। তবে তোর সাথে হিসেব-নিকেশ তোলা রইল৷ এতবড় কথাটা আমাকে জানাসনি।”
“তাই না?”
“আচ্ছা, তোর ব্যাপারটা কী? তুই যেন আগে থেকেই রেডি হয়ে ছিলি মনে হচ্ছে। এক পায়ে খাড়া, একবার সাধিলেই যাইব টাইপ?”
“পরে বলব। তোর বাড়িতে গিয়ে সফল হই আগে।”
“উইশ ইউ অল দ্যা ভেরি বেস্ট।”
নিলয় খুশি। এমন কিছুর জন্য সে অপেক্ষা করছিল। আফনান অসাধারণ ছেলে। অতি সাধারণ হয়েও ভীষণ অসাধারণ। নীরার মতো। মানাবে দুটোতে।
***
আফনান শঙ্কিত চিত্তে এসেছে বন্ধুর বাড়িতে। সদর দরজায় ইরা আর ইলার দেখা পেল। এরা একেকটা বিচ্ছু। অসাধ্য সাধন করে ওকে রোকেয়ার আমন্ত্রণে এখানে নিয়ে এসেছে।
“আগে চাচির সাথে দেখা করো। নীরাপু এই সময় ভাতঘুমে থাকে।”
“তোরা কী করে ম্যানেজ করলি?”
ইলা গর্বিত ভঙ্গিতে বলল, “আমি বলেছি নীরাপু তো চিরকুমারী থাকবে, আমাকে এখনি বিয়ে দিয়ে দাও।”
ইরা বলল, “এখন যদি তোকে সত্যি সত্যি বিয়ে দিয়ে দেয়?”
“এ্যাহ্! এত্ত সহজ? আমি কিশোর পাশা ছাড়া আর কাউকে বিয়ে করব না।”
“স্বপ্নে। এটাও বল।”
“স্বপ্নেই করলাম নাহয়।”
ঝগড়া থাক, শান্তি বিরাজমান হোক।” আফনানের কথায় বিচ্ছু দুইটা শান্ত হলো। সিংহের গুহার সামনে চলে এসেছে ওরা।
“আফনান ভাই, আমরা তোমাকে রাস্তা দেখিয়ে এই পর্যন্ত নিয়ে এসেছি। আমরা যাই। এটুকু তোমরা করো।”
আফনান একবার দোয়া পড়ে বুকে ফু দিয়ে নিল। সত্যি কথা বলতে রোকেয়া আন্টির মুখোমুখি হবার ইচ্ছে ওর একদমই ছিল না৷ যেসব কথা তিনি বলেছিলেন তা এখনো ওর মনে দগদগে ক্ষত হয়ে আছে। তবে এসবের উর্ধ্বে এখন ওর ভালোবাসা। যাকে ছাড়া সে আর পালিয়ে বেড়াতে পারবে না। কেমন যেন বোকা বোকা ভাবনা বলে মনে হলো। মন যে কখন কী চায়! কেউ কী তা জানে!
“ভেতরে এসো।”
“আসসালামু আলাইকুম আন্টি। কেমন আছেন?”
“ওয়ালাইকুম আসসালাম। আমি তোমাকে নীরার জন্য ডেকেছি। আমার কাছ থেকে এরচাইতে নমনীয়তা আশা করো না।”
“আমিও আপনার মেয়ের জন্যই এসেছি আন্টি। তবুও আপনি মাতৃসম। আমার পারিবারিক শিক্ষা কিছুটা হলেও আছে।”
“আমাকে ইমপ্রেস করার চাইতে আমার মেয়েকে ইমপ্রেস করো। যাও, রেস্ট নাও। খাবার পাঠিয়ে দিচ্ছি। খাও। এরপর কাজে নেমে পড়ো।”
“সেটা আমি নিজের তাগিদেই করব আন্টি। তবে আপনার কথাগুলো কেমন যেন ব্যবসাদার মানুষের মতো লাগছে। জীবনটা লেনদেনের নয় কিন্তু শুধু।”
“সেটা আমি জানি। তোমার চাইতে বয়সে বড় আমি ছোকরা। বেশি ফটফট করো না তো৷ যাও।”
“আপনি হঠাৎ মত বদল…”
“তোমাকে আমি সেদিন যে কথাগুলো বলেছিলাম, তার জন্য আমি লজ্জিত নই আফনান। তুমি যখন বাবা হবে আল্লাহ না করুন, সেই সন্তান যদি তোমার অমতে এমন একজনকে বিয়ের জন্য নিয়ে আসে, যাকে তোমার পছন্দ নয়, সেদিন তোমার ভূমিকা কেমন হবে আমি তা দেখার জন্য বেঁচে থাকতে চাই। আল্লাহ ততদিনে পর্যন্ত আমাকে বাঁচিয়ে রাখলে আমি দেখতে চাই।”
রোকেয়া থেমে আফনান কিছু বলার আগেই বললেন, “আমার যা সঠিক মনে হয়েছে করেছি, এখনো তাই করছি। আমি আমার সন্তানদের ভালোই চেয়েছি।”
“সন্তানদের ভালো চাওয়ার সাথে সাথে তাদের ইচ্ছের গুরুত্বটুকুও মাঝেমধ্যে ভাবতে হয় আন্টি।”
এরপর আফনান আর কথা বাড়ায় না। ওর জন্য নির্ধারিত ঘরে নিয়ে যাওয়া হয়। ইরার কাছে শুনেছে নীরা বিকেলে ছাদে হাঁটাহাঁটি করে। তাই চিলেকোঠার ঘরেই সে থাকল।
একটা ফ্রেস ঘুম দিয়ে উঠল সন্ধ্যার আগে আগে। ছাদের এসে দেখল কেউ নেই। ভাবল ঘুমটা বেশি হয়ে গেল কি-না। নীরা কী ছাদে হেঁটে ফিরে গেছে! না, ধারণা ভুল, মিনিট খানেক পরেই নীরা এলো। ঘুমের জন্য চোখ ঈষৎ ফোলা। তবে ওকে ভীষণ সুন্দর লাগছে। আফনানের মন ফুরফুরে হয়ে গেল।
“কেমন আছিস নীরা?”
নীরা ওকে এখানে দেখে যে আশ্চর্য হয়েছে তা স্পষ্ট হলো ওর খানিকটা চমকে উঠা দেখেই। তবে দ্রুতই সামলে নিয়েছে।
“তুমি এখানে কেন?”
“আসতে নেই?”
“কেন এসেছ?”
“তোর কাছে।”
“কারণ?”
“ভুল শোধরাবার জন্য।”
“সব ভুল শোধরানো যায়?”
“চেষ্টায় সব হয়।”
“কীভাবে ভুল শোধরাবে?”
“নীরা, পুরোনো তিক্ত অতীত পুড়িয়ে নিঃশেষ করে একবার নতুন করে সবটা শুরু করা যায় না?”
এবারের প্রশ্নের উত্তর দিতে নীরা কিছুক্ষণ সময় নিল। এরপর আফনানের চোখে চোখ রেখে আশ্চর্য দৃঢ়তায় সে বলল,
“ইউ আর লিভিং ইন এ ফুল’স প্যারাডাইজ।”
……..
(ক্রমশ)