#ঝরা_বকুলের_গল্প
#পর্ব_২০
#মেহা_মেহনাজ
.
.
.
উঠোনে মানুষের সমাগম। আশেপাশের আর কেউ বোধহয় আসা বাকি নেই। ছেলে-বুড়ো সকলেই উপস্থিত। মহিলাদের ভেতর চাপা গুঞ্জন। গতরের আগ্রহ বাড়তে লাগল। সে কোঁচের ভেতর চিঠিখানা চেপে রেখেছে। ওখানে একবার হাত দিয়ে নিশ্চিত হলো চিঠিটা আছে কীনা। তারপর বাড়ির ভেতরের দিকে এগিয়ে চলল। দুয়ারে এসে মুখোমুখি হলো মকবুলের। তিনি ভাঁজ যুক্ত কপালের ঘাম মুছছেন। দেখেই বোঝা যাচ্ছে, বড় পেরেশানিতে আছেন। গতর বলল,
“ও কাক্কু, কি হইছে?”
মকবুল উদাস নয়নে তাকালেন।
“পোড়া কপালে যা অয়, তাই অইবো। আমরা তো একটা তাউরাশ হইয়া গেছি সকলের ধারে। দেহো না, দুনিয়ার সব আইয়া পড়ছে এইনে।”
বলতে বলতে মকবুল উঠোনে নেমে এলেন।
“এইনে কি ছবি চলে? কি দেখবার ভীড় জমাইছো? কেউ ম*রে নাই। আমগো ভিত্রের ব্যাপার, আমরাই সমাধান করমু। সব যাও এইহান দিয়া।”
কেউ নড়লো, কেউ নড়লো না। চাপা গুঞ্জন এখন শব্দে পরিণত হলো। একজন বলল,
“ও মকবুল, মাইয়ারে পাডাইয়া দাও। ও রাইক্ষা কি করবা?”
আরেকজন আগ বাড়িয়ে কি যেন বলতে আসলো, মকবুল চেতে গেলেন। গাঁকগাঁক করে চেঁচিয়ে উঠলেন,
“তোমগো কাউরে পরামর্শ দিবার কইছি? আমার বাড়ির উডান খালি করো। ঘরের ভাত খাইয়া পর লইয়া পইড়া থাকো ক্যান? বাইর হও মিয়ারা।”
উনার চিৎকার চেঁচামেচিতে টিকতে না পেরে একে একে মুখ বাঁকিয়ে যে যার মতো চলে গেল। মকবুল বিরক্তিতে নাক মুখ কুঁচকে এক দলা থুতু ফেললেন মাটিতে। জীবনটা বড় দুর্বিষহ লাগে। গতর দুয়ারের কাছেই দাঁড়িয়ে ছিল। এ পর্যায়ে সে নেমে মকবুলের পাশে এসে দাঁড়াল। চিন্তিত কণ্ঠে জানতে চাইলো,
“ও কাক্কু, কি হইছে? একটু খুইলা কইবা?”
মকবুল দুর্বল কণ্ঠে বললেন,
“গতকাল রাইতে মোরশেদ আইছিল।”
গতর যেন ছোটখাটো একটা বৈদ্যুতিক ঝটকা খেলো।
“ক্যান?”
“ও বকুলরে আবার ফিরায়ে নিতে চাইয়। তওবা কাইটা বকুলরে আবার বিয়া করতে চায়। ঐ বউ নাকি ডাইনি। ওর মায়রে মারছে। এখন ওরেও মারার ফন্দী করছে। ও সব বুজতে পারছে। ঐ মাইয়া জাদুটোনা করে। এক কথায়, পিচাশ।”
“জাহান্নামে যাক ওই বেডা। আমগোর বকুলের জীবনডা শেষ কইরা দিয়া এখন নাটুক মারায় কিলিগা? যারে এত শখ কইরা উডাইয়া আনছে, তোমারে ডাইকা বকুলরে বাইর কইরা দিছে, হেয় ডাইনি না পিচাশ, ওইয়া জাইনা আমরা কি করুম? বেডারে বাইর কইরা দাও নাই?”
“ঘরে আছে। কইয়া দিছি মাইয়া দিমু না। তাও যাইতে চাইতাছে না। আমার পায়ে ধইরা মাফ চায়।”
“তোমার মতলব কাক্কু ভালো ঠেহে না। তুমি কি বকুলরে আবার ওই বেডার ঘরে পাডাইতে চাইতাছো?”
মকবুল হতাশ নয়ন মেলে চাইলেন।
“এই সমাজে তালাক খাওয়া মাইয়ার গলায় ফাঁস দেওন ছাড়া উপায় থাহে না। কত দিক দিয়া বাঁচাইয়া রাখুম ওরে? আমার তো টেহাপয়সাও নাই যে আবার বিয়া দিমু।”
গতরের ইচ্ছে করল, তুষারের ব্যাপারটা বলে দিতে। বলে দিতে, কেউ একজন পাগলের মতো তার মেয়েকে ভালোবাসে। রাজরাণীকে রাখবে আজীবন। কিন্তু উভয় পক্ষের অনুমতি ছাড়া কোনো কিছু বলা ঠিক নয়। তাই গতর অনেক কষ্টে নিজের মুখ সামলে চলল।
“বকুল কই?”
প্রশ্ন করে গতর। মকবুল হাত দিয়ে দেখালেন,
“ঘরে।”
“ওয় কি কয়?”
“ওয় বোবা হইয়া বইয়া রইছে।”
মকবুলের হঠাৎ মেজাজ বিগড়ে গেল। উনি বকুলকে উদ্দেশ্য করে কতক্ষণ গজগজ করলেন। নিজের পোড়া কপালকে একশো একটা শাপশাপান্ত করে কোথায় যেন চললেন। গতর দাঁড়িয়ে রইলো একলা। ওর হাতটা কোঁচের জায়গায়। চিঠিটা জায়গা মতোই আছে।
★
বকুল পাথরের মূর্তির মতো বসে রয়েছে। যা হচ্ছে, সবকিছু ওর মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে। গতকালের সন্ধ্যা তখন। রাতের আহার শেষে কল তলায় এঁটো বাসন গুলো মাজছিল ও। এমন সময়ে শব্দ করে কেউ একজন হেঁটে এলো। হাঁক ছেড়ে ডাকলো ভরাট কণ্ঠস্বরে,
“বকুল…বকুল!”
বকুলের অন্তরাত্মা সেই ডাকে কেঁপে ওঠে। হাত গুলো ওখানেই জমে যায়। সেই যে জমলো, এখন তো জমে গেছে সম্পূর্ণ শরীর। এতদিন পর মোরশেদের মুখখানা দেখে ওর কোনো অনুভূতি হয়নি। এই উঠোনে যার পায়ের উপস্থিতির অপেক্ষায় ছিল ও, সে বাদে অন্য কেউ এলো। মোরশেদ বকুল কে দেখতে পেয়েই লাজ-লজ্জা সব ভেঙে শক্ত হাতে তাকে টেনে বুকের ভেতর জড়িয়ে নিলো। বকুল তখন কুঁকড়ে গেছে। ওর সারা শরীর রি রি করে ওঠে ঘৃণায়। এই শরীরটা এখন আর মোরশেদের নয়, তুষারের। তুষার ওর কল্প সংসারের কর্তা। সে ব্যতীত অন্য কারো অধিকার নেই ওকে স্পর্শ করার। সঙ্গে সঙ্গে নিজেকে ধাক্কা দিয়ে ছাড়িয়ে নেয় ওঁর বাহুডোর থেকে। মোরশেদ অবাক হলেও বোঝে, এটাই তো স্বাভাবিক। ওঁ যে বড় অন্যায় করে ফেলেছে বকুলের সঙ্গে।
বকুলের দু’হাত জড়িয়ে সঙ্গে সঙ্গে আকুতিপূর্ণ গলায় বলে ওঠে,
“আমারে মাফ কইরা দাও বউ। তুমি আমার বউ। তোমারে আমি বুজি নাই, চিনি নাই। আমি খাঁটি সোনা থুইয়া তামার পিছে ঘুরছি। আমারে মাফ কইরা দাও। ঘরে ফিরে চলো। তোমার মায়ের কবর তোমার লিগা কান্দে।”
বকুল জানত না। যখন শুনল রুনু বেগম আর নেই, ওর দু’চোখের পানি বুক স্পর্শ করে। মানুষটা গাল দেক, মন্দ বলুক, ভালোও তো বাসতো! তাঁর হৃদয়ের কোথাও না কোথাও তো ছিল বকুল! তাঁর এহেন করুণ সমাপ্তির কথা শুনে অস্থির হয়ে যায় ও। শাহজাদির উপর রাগ লাগে। ক্ষোভ জমে। কিন্তু কাউকে কিচ্ছু বুঝতে দিলো না। মোরশেদের আকুতি ওর হৃদয় স্পর্শ করে না। বরং কোথাও না কোথাও একটুখানি শান্তি মিলে। লোকটা ওর সঙ্গে কম অন্যায় করেনি। জুতা মে*রে পরে এসেছে গরু দান করতে? বকুল কি পুতুল? মাটির তৈরি একটা পুতুল ওর শরীর? যেভাবে চাও সেভাবেই নাচাও? ভালো লাগল না, বের করে দিলো। আজ যখন প্রয়োজন, তখন আবার নিতে এসেছে! ও তো কখনো কারো প্রয়োজন হতে চায়নি। প্রিয়জন হতে চেয়েছিল। হয়েছেও। ওর প্রেমিক পুরুষের। কিন্তু কোথায় সে… সেই যে গেল, আর এলো না। তার নামের কোনো মেঘও এলো না চাঁদ রাণীর আকাশে। তবে কি মেঘের এখন নতুন ঠিকানা? কার জন্য অপেক্ষা করবে সে?
কারো উপস্থিতি টের পেয়ে বকুল চট করে নিজের চোখের জল মুছে নিলো। তাকিয়ে দেখল মোরশেদ এসেছেন। বকুলের শরীর আরও শক্ত হয়ে ওঠে। মানুষটাকে দেখলেই কেমন দমবন্ধ লাগে ওর।
মোরশেদ বকুলের পাশে বসে। বকুল গুটিয়ে একটুখানি সরে যায়। মোরশেদ মুচকি হাসে তা দেখে। যেন সদ্য বিবাহিত দম্পত্তি ওরা- স্বামীর সামনে লজ্জা পাচ্ছে নব বিবাহিতা স্ত্রী!
মোরশেদ বললেন,
“আইজকা যাবা না দুইডা দিন থাকবা?”
বকুল পাথর কণ্ঠে বলল,
“আর কত কমু, আমি যামু না?”
“তোমার যাইতে হইবো, তুমি আমার বউ।”
“আপনে আমারে তালাক দিছেন!”
“রাগের মাতায় দিছি। ও তালাকের গুণতি নাই।”
“তালাক যেমতেই দেন, ওইডা হইয়া গেছে। আমি আপনের বউ না।”
“আবার বিয়া করমু।”
“আপনে পাগল হইয়া গেছেন!”
“আমি আমার ভুল বুঝতে পারছি। আমার ম*রনের সময় আইয়া পড়ছে। ম*রার আগে তোমার লগে করনের অন্যায় গুলার প্রায়শ্চিত্ত করতে চাই। তুমি আমার ঘরে রাণী হইয়া থাকবা বকুল। আর তোমারে বকুম না, গায়ে হাত তুলুম না, তোমার মন খুশি মতো চলবা। কথা দিতাছি।”
বকুল একটা দীর্ঘশ্বাস টেনে নিলো।
“আপনে আমার লগে করা অন্যায়ের প্রায়শ্চিত্ত করতে চান? এই লিগা আমারে নিবার আইছেন। ভালোবাসার টানে আহেন নাই?”
মোরশেদ এহেন কথার পিঠে কি জবাব দেবে বুঝে উঠতে পারল না। ভালোবাসা কি জিনিস, তাই তাঁর অজানা।
বকুল অল্প একটু হাসে। হাসতে গিয়ে তার চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়ল। ভাবুক স্বরে বলল,
“জানেন, ভালোবাসা নামের একটা জিনিস আছে। কঠিন জিনিস। যার হয়, হের সব ভাইঙ্গা চুইরা হয়। ভেতর-বাহির সব মানুষটার নামে হইয়া যায়। মানুষটার লিগা পরান পুড়ে। লাগে যেন এই বুকটার মধ্যে কেউ আগুন ধরাই দিছে। খালি জ্বলে আর পুড়ে। এই আগুন নিভানোর পানি নাই গো। কোনো জলেই এই জ্বালাপোড়া থামবো না।”
মোরশেদ বোঝে না। সে অবাক নয়নে দেখে বকুল হাউমাউ করে কাঁদছে। তাঁর বুকের ভেতর কেমন যেন করে উঠল। বকুল নিজেই দু’হাতে চোখ মুছে নিলো। নিজেকে সামলে বলে উঠল,
“আমি ভাইঙ্গা গেছি। জ্বইলা পুইড়া ছারখার হইয়া গেছি। আমার এই দেহ, আমার মন, আমার রুহ আর আমার নাই। চুরি হইয়া গেছে। সব চুরি হইয়া গেছে। এরম একটা মাইয়ারে নিয়া সংসার করবেন? কন? করবেন সংসার?”
মোরশেদ জবাব না দিয়ে উঠে চলে গেলেন। বকুল দু’হাতে মুখ ঢেকে কেঁদে ফেলে। বিড়বিড় করে স্বগতোক্তি করল,
“আপনে কই? আপনের মেঘ কেন আমার আকাশে আর আহে না?”
★
শাহজাদি উদ্ভ্রান্তের মতো বসে রয়েছে। মোরশেদ সব কিছু জেনে ফেলেছে। যেদিন রুনু বেগম মৃত্যুবরণ করলেন, সেদিন থেকেই মোরশেদ অদ্ভুত রকমের চুপচাপ হয়ে পড়েন। শাহজাদির প্রতি অথবা অনাগত সন্তানের প্রতি আর কোনো আগ্রহ তিনি দেখালেন না। এমনকি ঘর সংসারের প্রতিও কেমন বেখেয়ালি হয়ে পড়লেন। বাইরে থাকা বাড়িয়ে দিলেন। ঘরে যতক্ষণ থাকেন, চুপচাপ বসে বসে কি যেন ভাবেন। শাহজাদির সঙ্গে প্রয়োজনের বেশি কথা বলেন না। অদ্ভুত রকম ভাবে পরিবর্তন হয়ে গেলেন। প্রথম প্রথম শাহজাদি মনে করল মায়ের মৃত্যুর শোকে মোরশেদ বদলে গেছেন। কিন্তু একসময় তার কাছে বিষয়টা বিরক্তের ঠেকে। যে মরার সে মরেছে, তাতে ঘর-সংসার বাদ দিয়ে দিলে তো চলবে না। শাহজাদি ভাবে এবার মোরশেদকে নিজের দিকে আরো ফেরানোর জন্য কিছু করতে হয়। তাই সে বাড়িতে ডেকে আনে তার পিচাশ কর্মের আরেক সঙ্গীকে। যেহেতু মোরশেদ বাড়িতে অবস্থান করেন না, তাই অনায়াসে খোলামেলা আলোচনা করতে বসে সে। শাহজাদির দূর্ভাগ্য, পেট খারাপ হওয়ার দরুন পেটের ব্যথায় টিকতে না পেরে মোরশেদ বাড়ি চলে এসেছিলেন। ঘরে ঢোকার মুখেই তিনি তাঁর মায়ের মৃত্যু সম্পর্কিত কিছু কথা শুনতে পেয়ে থমকে দাঁড়ান এবং সাবধানতার সহিত সব কথা শুনতে শুরু করেন। একে একে যা বেরিয়ে এলো, সবকিছু শোনার পর গোটা আকাশটা মাথার উপর ভেঙে পড়ল তাঁর। তিনি দিকদিশা হারিয়ে ফেললেন। ঝড়ের বেগে ঘরের ভেতর ঢুকেই শাহজাদির চুল চেপে ধরেন। খিস্তি দিয়ে বলে উঠেন,
“খা*** ঝি, তুই এতবড় ডাইনি! আমার মা-রে মা*ইরা ফেলছোস!”
শাহজাদি আকস্মিক আক্রমণ সামলে উঠতে পারে না। অসহনীয় ব্যথায় গুঙিয়ে ওঠে। সঙ্গে যে ছিল, সে পালিয়ে যায়। মোরশেদ হঠাৎ করেই অশুরের মতো হয়ে ওঠেন। জিদে, রাগে, ক্ষোভে, দুঃখে- শাহজাদিকে পি*টিয়ে জখম করে তোলেন। শাহজাদির কপাল ফাটে, নাক ফাটে, শরীরের বিভিন্ন জায়গা কে*টে যায়, ছড়ে যায়। ওর চিৎকারে আকাশ পাতাল এক হয়। আশপাশ থেকে দৌড়ে আসে মানুষজন। সবাই অবাক চেয়ে রয়। গর্ভবতী বউকে এভাবে কেন মা*রছে মোরশেদ! বউ পে*টানো ওর স্বভাব ঠিক, কিন্তু এতোটাও নিষ্ঠুর আগে কখনো হয়নি। মোরশেদের হিংস্রতা দেখে কেউ এগিয়ে শাহজাদিকে টেনে আনার সাহস করে না। শুধু দূরে দাঁড়িয়ে যে যার মতো থামাতে বলল এই যুদ্ধক্ষেত্র। মোরশেদ শোনেন না। ইচ্ছেমতো নিজের শরীরের সবটুকু শক্তি দিয়ে শাহজাদির জীবন নরকে পরিণত করে দেন। এক সময় হুশ খুঁইয়ে লাথি মে*রে বসেন পেট বরাবর। শাহজাদি ‘ও আল্লাহ গো’ বলেই মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। সঙ্গে সঙ্গে ভিজে যায় ওর গায়ের কাপড়। রক্ত ভাঙতে শুরু করে। আর কেউ দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না। দু-চারজন মহিলা ছুটে এসে শাহজাদিকে জাপটে ধরেন। কয়েকজন পুরুষ মিলে টেনে সরান মোরশেদকে। মোরশেদ তখনও ফোঁসফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলছে। এত মে*রেও ওর মনের রাগ কমেনি।
সদরে নেওয়া হলো। পেটের সন্তান আর বেঁচে নেই। পাড়ার মহিলারা দা-ঈ ডেকে এনেছিল। অযোগ্য দা-ঈ বাঁশের কঞ্চি দিয়ে গর্ভপাত করাতে গিয়ে কীসব তালগোল পাকিয়ে বসে আছে। শেষে রক্ষা হলো বড় ডাক্তারের কাছে এসে। এই এত মা*র খেয়ে, অবশ ছাড়া গর্ভপাত করাতে গিয়ে সহ্য করল অসহনীয় তীব্র যন্ত্রণা, বড় ডাক্তারের কাছে পুনরায় এসে একই ব্যথার পুনরাবৃত্তি, এরপর জানা গেল শাহজাদি আর কখনোই মা হতে পারবে না, মানসিক এবং শারীরিক ধকল মিলিয়ে দিনের পর দিন সহ্য করতে হলো অস্বাভাবিক কষ্ট! তারপরও ওর মৃ*ত্যু হলো না। হয়তো এখানেই ওর পাপের শাস্তির শেষ নয়। বরং এই যেন শুরু….
মোরশেদের ঘরে ফিরে এলেও মোরশেদ একেবারেই শাহজাদির দিকে খেয়াল দেওয়া বন্ধ করে দিলো। লোকে লোকে কানাকানি হতে হতে আসল ব্যাপারটা জানাজানি হয়ে গেল। কেউ বিশ্বাস করল, কেউ করল না, কিন্তু মোরশেদের পাল্লা ভারী। তারাও একটা অদ্ভুত বিভৎস পুতুল দেখেছিল রুনু বেগমের কবর খুঁড়তে গিয়ে। একে একে প্রায় সকলেই ঘরকুনো করে দিলো শাহজাদিকে। দূর থেকে ওর ছায়া দেখলেও ভয় পায় লোকে। দ্রুত চলে যায়। ও ডাকলে কেউ আর কাছে আসে না। এমনকি যাদের বাড়িতে ওর নিত্য যাতায়াত ছিল, অনেকেই এসব জানার পর, ঘরে মিলাদ পড়িয়েছে এবং ওকে শক্ত কণ্ঠে বলে দিয়েছে, যেন ওসব বাড়ির ত্রিসীমানাতেও শাহজাদির ছায়া না পড়ে। শাহজাদি লজ্জায় নিজেকে গৃহবন্দী করে নিয়েছিল বেশ কিছুদিন। তারপর নিজেই আর টিকতে না পেরে বেরিয়ে আসে। মোরশেদের কাছে ক্ষমা চায়, পা ধরে মাফ চায়। মোরশেদ দ্বিতীয় বার ওকে ভেঙেচুরে আঘাত করলে আর তাঁর চারপাশেও আসার সাহস হয় না শাহজাদির। মোরশেদকে দেখলেই ঘরের দরজা আঁটকে একা একা বসে থাকে। বোঝে, জীবনের করা সমস্ত পাপের শাস্তি এক এক করে শুরু হয়ে গেছে। কিন্তু তবুও সে আরও একবার এইসব পাপের সামিল হতে চায়। মোরশেদকে নিজের দিকে ফেরাতে, এই সংসারে নিজের রাজত্ব পুনরায় স্থাপন করতে সে আরও একবার হাতে তুলে নেবে মৃত মানুষের খুলি!
শাহজাদি জানে মোরশেদ বকুলদের বাড়ি গেছে। গত রাতে বেশ কথা কাটাকাটি হয়েছিল। মুখে মুখে তালাকও দিয়ে দিয়েছে মোরশেদ ওকে। তবুও ও এবাড়ি ছেড়ে কোথাও যাবে না। যাবেই বা কই? বাজারের খারাপ মেয়ে ও। পরিবারহীন জীবন কেটেছে যার,তার নতুন করে যাওয়ার জায়গা কই? শাহজাদি ভেবেই রেখেছিল, আজ থেকে সতীনের ছায়া সহ্য করতে হবে। কিন্তু না…মোরশেদ ফিরে এলো খালি হাতে, একা! কেমন স্তব্ধ, বরফের ন্যায় চোখ দুটি তাঁর। মানুষটাকে দেখে মনে হচ্ছে সে মৃ*ত। যেন এই মাত্রই তার সামনে এমন কিছু ঘটে গেছে, যা সে কল্পনাও করতে পারেনি।
শাহজাদি ভীত পায়ে তবুও এগিয়ে আসে। মোরশেদ এসেই দাওয়ার উপর চুপটি করে বসে পড়লেন। শাহজাদি এগিয়ে এসে উনার পাশে চুপ করে বসল। প্রশ্ন করার সাহস পেল না। অন্য সময় হলে ওর সামনে আসার জন্যই মোরশেদ গালাগাল করে একাকার করতেন। আজ করলেন না। যেন খেয়ালই করেননি। কোনো এক ভাবনায় একেবারেই ডুব মে*রেছেন। অবশেষে শাহজাদি সাহস করে। আস্তে সুরে বলল,
“ব…বকুল… বকুল আহে নাই?”
মোরশেদের ভাবনার সুতো ছিঁড়ে যায়। সে চট করে পাশে তাকিয়েই শাহজাদির উপর আক্রমণ করে বসলেন। হুট করে তার চেহারায় পরিবর্তন চলে আসে। শান্ত নদীতে ঝড় উঠলে সবকিছু যেমন ভেঙেচুরে দিয়ে চলে যায়, মোরশেদ ও শাহজাদির ভাঙা হাড়গোড় আবার ভাঙতে শুরু করলেন। শাহজাদি বুঝে উঠতে পারে না। আকাশ পাতাল এক করে চেঁচানো শুরু করল। যদিও কেউ আসবে না, সে জানে। একজন ডাইনি মা*রা গেলে কারো কিছুই যাবে আসবে না। তাও শাহজাদি চিৎকার করে। সাহায্য চায়। কেউ যদি এসে একটু বাঁচায় তাকে!
মোরশেদ আক্রোশ মিটিয়ে পে*টালেন। বাম হাতটা এমন ভাবে উলটে ধরলেন, যেন আর কোনোদিন ওই হাত সোজা করতে পারবে না ও। শাহজাদি চেতনা হারানোর আগে শুনতে পায়, মোরশেদ চিৎকার করে বলছেন,
“তুই আমার বকুলরেও মা*ইরা ফেললি?”
(চলবে)