টক্সিক রিলেশনশীপ পর্ব-০২

0
770

#টক্সিক_রিলেশনশীপ
||২য় পর্ব||
-ঈপ্সিতা শিকদার
“মাত্র বিশ হাজার টাকা মাইনে পাওয়া তোমার আছেটা কী আমাকে রাখার মতোন? তার উপর জুটিয়েছো একখান প্যারালাইজড মা আর উড়নচণ্ডী এক বোন। আমার ভরা যৌবন তোমার সংসারে খেটেখুটে শেষ করতে পারব না ফাহিম। আমি তোমার চেয়েও ভালো কিছু ডিজার্ভ করি।”

চৈতালির কথায় ক্ষিপ্ত হয়েও নিজেকে শান্ত রাখার অদম্য প্রচেষ্টা ফাহিমের। সে বেশ শান্ত সুরেই শুধায়,
“বিয়ে করার সময় বা প্রেম করার সময় তো সবই জানতে। আমি তো কিছুই লুকোইনি তোমার থেকে। সব জেনে-শুনে নিজ ইচ্ছেতেই আমার ঘরে এসেছিলে। তবে কেন…?”

“তখন বয়স কম ছিল বুঝতে পারিনি। এখন দেখো সব বুঝতে শিখেছি, ভালো থাকতে শিখেছি, আরাম-আয়েশে থাকছি।”

“ওহ তাই বুঝি? আরেক জনের জামাইয়ের টাকায় তার সংসারে জায়গা নিয়ে আরাম-আয়েশে থাকছো। মানে তোমার সামান্য টুকু লজ্জা বোধও নাই?”

বেশ চড়া মেজাজেই এইবার বলে ফাহিম। চৈতালিও বিপুল রেগে যায়। কলটা কেটে নাম্বার ব্লকলিস্টে ফেলে দেয়। অথচ, সে চাইলেই নিজের পক্ষে কিছু শুনাতে পারত। হয়তো সে জানে তার নিকট বলার যুক্তি নেই কিংবা যুক্তি থাকলেও বলার ইচ্ছে ফুড়িয়ে গেছে।

কল কাট হয়েছে টের পেতেই আবারও কল দিতে উদ্যোত হয় ফাহিম। কিন্তু ব্লক করে রাখায় আর তা সম্ভব হয়নি। নিজেকে আজ বড় বেশিই অসহায় বোধ হচ্ছে ফাহিমের।

পুরুষ হয়েও তার হাত-পা মেলে কাঁদতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু কাঁদতে আর পারল কই? এমনিতেই সংসারজীবনে ব্যর্থ সৈনিক সে, এ নিয়ে পাড়া-পড়শি ও বন্ধু-বান্ধবদের ঠাট্টার শেষ নেই, কাপুরুষের ছাপটা আর যোগ করতে চায় না সে।

ক্রিংক্রিং আওয়াজে বেল বেজে উঠে। ফাহিমের মা ফারজানা রহমান শয্যাশায়ী, ডান হাতের আঙুলগুলোই শুধু কিছুটা কার্যকর। কোনো প্রয়োজনেই সেই আঙুলগুলোর দ্বারাই কোনোরকম বেল বাজায়।

“মায়ের হয়তো কিছু লাগবে।”
ভেবেই যেতে তৎপর হয় ফাহিম। আজ প্রায় সপ্তাহ চাকরি থেকে ছুটি নিয়েছে সে, কাল বাদেই ছুটি শেষ জয়েন করতে হবে কিন্তু মাকে দেখবে কে। তার বোন সাজিয়া বেশ কিছুদিন ছিল, কিন্তু তারও তো স্বামী-সংসার আছে।

___

নায়িম স্টুডিওতে এসেছে গান রেকোর্ড করাতে। কিন্তু অবাককর বিষয় হলো সে একবারেই কাজ শেষ করে ফেলা আর্টিস্ট, আজ চারবারেও ঠিক-ঠাক রেকর্ড করতে পারল না। কখনো তাল ভুল হচ্ছে, তো কখনো সুর।

এবার মিউজিক কোম্পানির মালিক বেশ বিরক্তি ভরা চেহারা নিয়ে,

“শোনো নায়িম, আমার মনে হয় তুমি অনেক স্ট্রেস্পড্। আজ বাদ দাও, কাল নাহয় করা যাবে। প্যাক আপ গাইস।”
বলে চলে যায়।

নায়িম সুগভীর এক শ্বাস ফেলে। তার আরও বেশি রাগ জমছে বাসন্তীর উপর। হুট করেই একবার মনে হলো,
“মেয়েটাকে এভাবে মারা আমার বোধহয় ঠিক হয় নাই। ইশ্ কেমন জানোয়ারের মতোন মেরেছিলাম!”

পরক্ষণেই ভাবে,
“না, না, ও যা করেছে সেটারই ফল এটা। মেয়েটা আজকাল বড় বেশিই অবাধ্য হতে শুরু করেছে। আমার কথা অমান্য করে প্র্যাগনেন্ট হলো। আজকাল যখন তখন ছাদে যায়।

আবার আমার নিষেধ থাকা সত্ত্বেও আমার কথা অমান্য করে ঐ মহিলা আর মহিলার স্বামীর সাথে দেখা করতে গেছে। আল্লাহই জানে কী এত দরকার ঐ বেটির। ঐ বেটির না, বেটির জামাইয়ের সাথে দরকার তাও একটা প্রশ্ন।”

নিজ মনেই সিদ্ধান্ত নিয়ে ড্রাইভারকে কল করে গাড়ি বের করার জন্য। বাড়ি যাওয়ার এখন বড়ো বেশি প্রয়োজন তার, মাথা ধরেছে, সূক্ষ্ম এক ব্যথার সঞ্চার হচ্ছে কপালের দুই কোণে।

___

ফাহিম মাকে ঘুম পাড়িয়ে বাড়ি থেকে বের হয়। মাকে সে কিছুই বলেনি, কিন্তু তিনি নিজেই হয়তো বুঝতে পেরেছেন, তাই তো অকারণেই নীরব নোনাজল বেয়ে যায় তার আঁখিজোড়া হতে। হয়তো বোন আর তার তর্ক থেকেই জেনেছে

তার খাণিক খোলা হাওয়ায় শ্বাস নেওয়ার প্রয়োজন, কাউকে নিজের মনের কথাগুলো বলার প্রয়োজন। সামনের মোড়েই টম দোকান, এই রাতে সেখানেই এলাকার বন্ধুদের সিগরেট-চায়ের আসর জমে। অনেকদিন যায় না, প্রিয়তমার নিষেধ ছিল যে, কিন্তু আজ প্রিয়তমা নেই যখন তখন কীসের নিষেধ আর কীসের কী?

“কী রে? এমন দেখা যাইতেসে কেন তোরে? বউ বুঝি ঠিকমতো ঠিক মতো খাইতে দেয় না…”

দ্বীপ প্রথম কথাটা সিরিয়াস হয়ে বললেও শেষ বাক্যটায় ঠাট্টার শ্লেষ ছিল। ফাহিম বুঝল কিন্তু কিছুই বলল না। তার শব্দ ভাণ্ডারে অভাব পড়েছে বেশ আগেই।

“কী রে? এমন হয়ে আছিস কেন? কিছু হয়েছে না কি?”

এবার তিন বন্ধুর ললাটেই সূক্ষ্ম ভাজ দেখা গলা চিন্তার। ফাহিম নিজের ঠোঁট ভিজিয়ে নিল। মৃদু হেসে বলল,

“আসলেই ভালো নেই রে।”

“কী বলিস?”

“অনেকদিন ধরেই চৈতালির সাথে আমার মনোমালিন্য চলছিল। মাস কয়েক হবে হুট করেই অফিস এসে দেখি ও চলে গেছে।”

“আরে এ আর তেমন কী? সব বউরাই একটু-আধটু রাগ করে, একটু ঠাণ্ডায় মাথায়, ভালোবাসার সহিত বুঝা, কিছু গিফট্ দে ঠিক হয়ে যাবে।”

“তার তো এসব চাই না। তার আমার বিশ হাজার টাকা মাইনেতে সমস্যা, আমার মা তে সমস্যা, আমার বোন থেকে সমস্যা।”

মৃদু হেসে ফাহিম একে একে খুলে বলতে শুরু করে সবকিছু। তিন বন্ধুরই চেহারায় ক্রোধ স্পষ্ট। তা শুধুমাত্র চৈতালির উদ্দেশ্যে নয়। ফাহিমের উদ্দেশ্যেও বটে।

“তুই কেমন পুরুষ এমন মেয়েকে আজও ঘরে আনতে চাস। আমি হইলে তো উষ্টা দিয়া তালাক দিতাম।”

খাণিক ব্যগ্র করেই শুধায় মিন্টু।

“সংসার, পরিচিত মায়া ছাড়া কি এতই সহজ রে?”

“কেমন কাপুরুষের মতোন কথা বলছিস? তোর কি কোনো দিক দিয়ে কমতি আছে? মাইয়া না কি তুই, একখান মেয়ে খুঁজে এই মেয়ের মুখে ঝামটা দিয়া বিয়া কইরা দেখায় দে।”

একদম নিঃশ্চুপ হয়ে গেল ফাহিম। এখন প্রতিটি বন্ধু তাদের চেনা-জানা ভালো মেয়েদের ইতিহাস শুনাচ্ছে। আনমনেই ভাবল,

“সংসার, মানুষের মায়া ছাড়া বুঝি এতই সহজ, যেমনটা সবাই বলে? পুরুষ হলেই কী মায়া থাকতে নেই, ভালোবাসা থাকতে নেই কারো প্রতি! সব ভালোবাসা, মায়া বুঝি মেয়েদেরই অধীনে থাকে?

না, মিথ্যে বলে এবং বলছে সবাই। নিজেকে আড়াল করতে ব্যস্ত সকল পুরুষ। পুরুষ ভালোবাসতে জানে, মায়ায় আটক হয় তারাও। তবে ঐ যে ছোট থেকেই তাদের আশেপাশে সমাজ তৈরি করে দেয় শক্ত এক খোলস।

কঠোরতা, নিষ্ঠুরতা, ক্রুর স্বভাবের খোলসে বন্দী তারা। কচ্ছপ যেমন খোলসের বাহিরে বের হলেই অসহায় হয়ে যায়, ঠিক তেমনই পুরুষ এই খোলসের বাহিরে বের হলে লোকসমাজে জ্ঞাত হয় কাপুরুষ হিসেবে। পুরুষ কঠোর হয় না; আমরা তাদের কঠোর বানাই।”

___

বাসন্তী বিছানায় শায়িত হয়ে ঘুমানোর চেষ্টা। তারপরও রমণীর চোখ জোড়া ঘুম হানা দিচ্ছে না একদম। বরং, গভীর এক ভাবনা বুনে চলেছে তার মস্তিষ্ক। তার মনে পড়ছে বিখ্যাত ফ্রানকোইস ডি লা রোচেফউকোল্ডের বিখ্যাত এক উক্তি। তা ভেবেই অন্যমনস্ক সে।

“ফ্রানকোইস ডি লা রোচেফউকোল্ড তো বলেছেন, ‘আমরা তাকেই বেশি সন্দেহ করি, যাকে আমরা সবচেয়ে বেশি ভালোবাসি।’ তবে কি নায়িম আমাকে অনেক ভালোবাসে? ভালোবাসলে বুঝি এমন পশুর মতো টর্চার করতে পারত? ভালোবাসা, সম্পর্ক বুঝি এমনই বিষাক্তকর হয়।”

চলবে…