টক্সিক রিলেশনশীপ পর্ব-১৮+১৯

0
540

#টক্সিক_রিলেশনশীপ
||১৮তম পর্ব||
-ঈপ্সিতা শিকদার
“চৈতালির মায়ের থেকে চাচ্চু আমাকে নিয়ে যায়। আমার ইচ্ছে অনুযায়ীই হোস্টেলে থাকার ব্যবস্থা করে। অবশ্য হোস্টেল নয়, তুই তো গিয়েছিসই। এক কামরার ছোট্ট ফ্ল্যাট। কিন্তু সেখানে রেখে আসার আগে কোনো শোধন ছাড়াই জানা সত্যি আরও স্পষ্ট করে তুলে ধরে আমার সামনে।”

থামে নায়িম। কথা বলতে আজ এত কেন কষ্ট হচ্ছে বোধগম্য হচ্ছে নায়িমের। গলাটাও ভার ভার লাগছে। কেমন বিরক্ত বোধ হচ্ছে নিজের অনুভূতির প্রতিই! মুখশ্রী গম্ভীর রেখেই অতীতে হারিয়ে গেল সে।

অতীত,
নায়িম একদম চুপচাপ, গাম্ভীর্যপূর্ণ হয়ে গিয়েছিল সম্পর্কের এই টানাপোড়নের পরে। নায়িমের দুঃসম্পর্কের চাচা তাকে ঢাকায় নিয়ে আসে। তার থাকার জন্য নির্ধারিত স্থানে দিয়ে আসার পূর্বে একটা নামীদামী রেস্টুরেন্টে নিয়ে যায়।

“চিকেন ফ্রাই আর সাব স্যান্ডউইচটা খুব ভালো এখানকার। খাবে?”

বিনয়ী বাণীতেও নায়িমের কণ্ঠ শোনা যায় না। ছেলেটার এমন খামখেয়ালি আচারণ যে একদম অস্বাভাবিক নয় তা খুব করে জানা তার চাচার। সেও আর জোর দেয় না, বরং খাবার অর্ডার করে।

“তুমি কি জানো তোমার মায়ের সাথে আসা ঐ লোকটা কে? প্রশ্ন উঠে না তোমার মনে যদি নুসরাত ভাবী যদি ঐ লোকটাকেই ভালোবাসতো তাহলে তোমার বাবাকে কেন বিয়ে করলে?”

জিজ্ঞেসু দৃষ্টিতে তাকায় জন্মদাত্রীর বেঁচে থাকাতে সর্বহারা হওয়া কিশোরটি।

“তোমার মা নুসরাত মোস্তফা হলেন খানদানি জমিদার বংশের মেয়ে, বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ বনি মোস্তফা তার বাবা। বনি মোস্তফার বাবা যে কি না তোমার নানার বন্ধু ছিলেন, তিনি বিয়ের বাহিরেও অবৈধ সম্পর্ক গড়ে ছিলেন এক যাত্রাপালার মেয়ের সাথে। সেই ঘরেই জন্ম হয় তোমার নানা বনি মোস্তফার একমাত্র সৎ বোন বাতাসী। প্যাঁচের শুরুয়াতটা এখান থেকেই।

বাতাসীকে ঐ মেয়ে মোস্তফা বাড়িতে দিয়ে গেলে বনি মোস্তফার মায়ের মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ে। তা নিজ চোখেই দেখেছিল তোমার নানা বনি মোস্তফা। সেই থেকে তাঁর বাতাসীর প্রতি তিক্ততা। তবে খারাপ আচারণ করেনি কখনো শুনা যায়, বন্ধ দরজার আড়ালে কী হতো কে জানে? যাকগে বাতাসীকে বিয়ে দেওয়া হয় মোস্তফা বাড়িরই এক কর্মচারী শামসুর মিয়ার সাথে। তিনি স্বভাবে ছিলেন লোভী, নজর ছিল বংশের সহায়-সম্পদ আর পার্টির চেয়ারপার্সনের কুরসিটার দিকে।

বনি মোস্তফা খুব ভালোভাবেই জ্ঞাত ছিলেন এ নিয়ে। তাই নিজের বাবাকে পটিয়ে সকল সম্পত্তি আগেই নিজের নামে করিয়ে নিয়েছিলেন। তাতে যেন আরও ক্ষুব্ধ হন শামসুর মিয়া। নিজের ছেলে সাদিককে লেলিয়ে দেন নুসরাত মোস্তফার পিছনে। নুসরাত মোস্তফাও প্রেমে পড়েন সৎ ফুপাতে ভাইয়ের। কিন্তু এ বিষয়টি এক কান দু’কান হয়ে বনি মোস্তফার কানে যেতেই বাতাসী মোস্তফার বাসায় যেয়ে তাকে এবং শামসুর মিয়াকে জঘন্য ভাবে অপমান করেন তিনি। তারপর তোমার মায়ের বিয়ে দেন তোর মায়ের দাদার মানে তোমার নানুর ঠিক করা পাত্র তোমার বাবার সাথে।

নুসরাত মোস্তফা বাঙালি নারী, বিয়ের পর স্বামীই সব, এ যুক্তিতেই সংসার করে যাচ্ছিলেন। বেশ ভালোই চলছিল সবকিছু। কিন্তু হঠাৎ করে উনার কী যে হলো! সাদিক কীভাবে তোমার মায়ের জীবনে ফিরে এলো জানি না। তবে তোমার নানা মোস্তফা সাহেব বেঁচে থাকলে সব ঠিক রাখতেন। তোমার বাবা খুব ভালোবাসতেন তোমার মাকে। এত বড় ধাক্কা সামলে নিতে পারেননি। তোমার কষ্ট লাগবে জেনে, কিন্তু তিনি তোমার অস্তিত্ব নিয়েও স্বন্দেহ পোষণ করতেন। এজন্যই তুমি তার জীবনের বিষ হয়ে গিয়েছিলে। কিন্তু মৃত্যুর আগের দিন তোমার ডিএনএ টেস্ট করেই ফেলেন। আর রিপোর্ট দেখে অনুতাপে আরও বেশি ড্রিংক করেন। এত চাপ নিতে না পেরে… উনি নেই, উনার দোষ আর নাই বলি।

যাকগে এবার সবই তোমার জানা হলো। খান বংশের ছেলে তুমি, মুক্তিযোদ্ধার বংশধর, বিচারক বাড়ির ছেলে, মোস্তফা সাহেবের নাতি। তোমার এমন শিকারীর ছোট্ট আঘাতেই হরিণ বনে গেলে হবে না, ওসব কিছু তোমার। তোমাকে সবকিছুর অধিকার নিতে হবে। সিংহের মতোন, বাঘের মতোন গর্জনে কাঁপিয়ে রাখতে হবে সবাইকে। মনের মধ্যে কষ্ট পুষলে হবে না, কষ্টকে রাগ বানাও, রাগকে অগ্নি। সেই রোষানলে তোমার অপরাধীদের ঝলসে দিতে হবে, যা তোমার তা তোমার করতে হবে। তুমি রাজা, এই হিংস্র বনের রাজার পদবি তোমায় ঠিক রাখতে হবে ছেলে।”

ক্রোধানল তো আগে থেকে জ্বলছিল নায়িমের হৃদয়ে, চাচার শেষের কথাগুলোতে অগ্নি যেন আরও তীব্রতর হলো। অস্বাভাবিকতা ছেড়ে বেশ আয়েশের সাথে পায়ে পা তুলে চিকেন ফ্রাইটা হাতে তুলে নিয়ে খেতে লাগল সে।

বর্তমানে,
নায়িমের মুখ থেকে নুসরাত মোস্তফা ও তার শত্রু সাদিক সম্পর্কিত সব শুনে শুকনো ঢোক গিলল অনিমেষ। তার কাছে শুনতেই কতটা জটিল লাগছে। আর এই ছেলেটা কেমন নির্বিঘ্নতার সাথে সব বলে যাচ্ছে।

“তোর মা…” এই শব্দ উচ্চারণ করতে নায়িমের আঁখি জোড়ার রোষানলে পড়ল সে। নিজেকে শুধরে নিল।

“আই মিন নুসরাত মোস্তফা আর সাদিক মিলে তো তোর থেকে খান এম্পায়ারের অধিকার ছিনিয়ে নিয়েছিল, ফিরে পেলি কী করে? আর নুসরাত মোস্তফা কোথায় এখন? উনিও কী মিলে আছে সাদিকের সাথে?”

“একদিন হুট করেই চাচ্চু কল করে জানায় নুসরাত মোস্তফার জানাজা আমাকে আসতে হবে এখানে। কিন্তু চাচ্চু বলে নিজের জিনিস নিজের অধীনে করতে বাঘকে শত্রুর আস্তানায় যেতেই হয়, নিজ গুহায় থাকলেই হয় না। রাজি হলাম। কিন্তু আশ্চর্যজনক লাগল যখন চাচ্চু আমাকে সবার চোখের আড়াল করে নিয়ে যায়। একদম নিজের আর আমার মুখ-টুখ ঢেকে।

না, জানাজায় যাওয়া হয় না আমাদের। গোপণ এক জায়গায় নিয়ে যায় চাচ্চু। আমার বাবার উকিল উইল মোতাবেক আমাকে সব বুঝিয়ে দেয় সেখানে। তারপর আসে বনি মোস্তফার বিশ্বস্ত লোক জামশেদ আলী আঙ্কেল এবং মোস্তফাদের পারিবারিক উকিল। উইলে এমন কিছু ছিল যা শোনার জন্য আমি প্রস্তুত ছিলাম না। যা চাচ্চুর আমাকে আড়াল করার কারণটিও ব্যাখ্যা করে।”

“কী?”

“আমার নানাজানের উইল অনুযায়ী, পুরো মোস্তফা বংশের সম্পত্তির মালিক তার একমাত্র নাতি নায়িম ফাজ খানের স্ত্রী হবে। মানে আমার স্ত্রী, বাসন্তী। আর পার্টির চেয়ারপার্সনের উত্তরাধিকারী হলো একমাত্র নাতি নায়িম ফাজ খানের সন্তান। মানে আমার মেয়ে নাহিবা।

জমশেদ আঙ্কেল আমাদের বলেন, ‘নুসরাতের মৃত্যুতে কোনো ঘাপলা তো আছে, বাবা। আমার মনে হয় উইলের কথা জানতে পাইরাই সাদিক আর সাদিকের বাপে তোমার মাকে… যেহেতু বুঝতে পারছিল সে কোনো কাজেই আসবে না। তোমার নানাজান আগেই আঁচ করেছিল এমন কিছু একটা হতে পারে, তাই মৃত্যুর আগেই এমন উইল তৈরি করে যায়। বাবা, তোমাকে তোমার শত্রুগো মতো শক্তিশালী, দমদার আর ক্ষমতাশীল হওয়া অবধি সাবধানে নয়, সবার আড়ালে পরিচয় গোপণ করে থাকতে হবে। কারণ তাগো চোখ তোমার আর তোমার স্ত্রী-সন্তানের জানের দিকেই।’

সেদিন যা বুঝার বুঝে নিয়েছিলাম। বুঝে নিয়েছিলাম স্ত্রী করা মানে কাউকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেওয়া, তার উপর আবার নারী জাতি এত সহায়-সম্পদ পেলে মাথায় উঠে বসবে, ঠিক-বেঠিক ভুলে যাবে। বুঝতে পেরেছিলাম আমার সন্তানের জীবন আমার চেয়েও জটিল, পাষণ্ড, ক্রূর হবে। তবে দৈহিক, মানসিক চাহিদা তো ছিল? এর জন্যই এমন মেয়ের খোঁজ করি যে দিন-দুনিয়ার জ্ঞানহীন, মোহ-মায়া থেকে পবিত্র। ঠিক যেমনটা আমার বসন্ত কুমারী।”

অনিমেষ একটা ব্যাপার খেয়াল করে শেষ বাক্যটি বলার সময় নায়িমের ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে উঠেছিল, যা অতি দ্রুততার সাথেই গম্ভীরতায় মুছিয়ে ফেলে সে। আবার ভাবছে এই ছেলেটা সব কিছুর মাঝেও কত স্বাভাবিক! কিন্তু এতটা স্বাভাবিক কী অস্বাভাবিক পরিস্থিতির মাঝে স্বাভাবিক মানুষের হওয়া উচিত? অসম্ভব প্রায়, তাহলে এই ছেলেটি কেন?

নিজের তিক্ত ভাবনাগুলো গলাধঃকরণ করে পুনরায় মুখ খুলে সে।

“কিন্তু মাফিয়া-টাফিয়া এসব? আবার রাজনীতি এগুলোতে কী করে বা কখনই জড়ালি তুই?”

“একদিনে সারা মাসের ভোজন করত্ব হয় না রে পাগল। আজ এটুকুই জেনে রাখ, পরে আবার যা জানার জানা যাবে।”

___

ঘুম থেকে উঠেই এত সুন্দর একটা সারপ্রাইজ পাবে বাসন্তী ভাবেনি কখনো। চোখ মেলতেই দেখতে পায় নায়িম নাহিবাকে কোলে নিয়ে খেলছে। হুড়মুড়িয়ে উঠে দাঁড়িয়ে নাহিবাকে নায়িমের কোল থেকে তুলে নেয়।

নায়িম প্রথমে রাগ হলেও কী একটা ভেবে যেন বেড়িয়ে যায় ঘর থেকে। বাসন্তী আনমনেই ভাবে,

“লোকটার মাথায় কুবুদ্ধি থেকে এত সুবুদ্ধি হলো কবে?”

চলবে…

#টক্সিক_রিলেশনশীপ
||১৯তম পর্ব||
-ঈপ্সিতা শিকদার
দুপুর হতেই সকলে ঢাকায় চলে আসে। বাসন্তীর মন ভিষণ ভালো মেয়েকে পেয়ে। সারাটা ক্ষণ তার মুখে হাসি ছেয়ে আছে।

এপার্টমেন্টের সামনে গাড়ি থামতেই গলা ফাটিয়ে কাঁদতে শুরু করে নাহিবা। বাসন্তী ব্যস্ত হয়ে পড়ে কান্না থামাতে।

“আরে মেয়ে, বাবুর ক্ষুধা লেগেছে তাই কাঁদছে। ফিডার দাও মুখে।”

“ফিডার তো খালি। শেষ হয়ে গেছে।” নত চোখে শুধায় বাসন্তী।

“তো আমার এখানে বসে আছো কেন? যাও, বাসায় যাও।” বিরক্তের সাথে বলে নায়িম।

বাসন্তী তাড়াতাড়ি গাড়ির দরজা খুলে বাবুকে নিয়ে নেমে যায়। তাদের ফ্ল্যাট চার তলায়, সিঁড়ি বেয়েই উঠতে নেয় বাসন্তী। কারণ এলিভেটর ফোবিয়া আছে তার। কিন্তু নায়িম আটকায় তাকে।

“এমনিতেই অসুস্থ এখন সিঁড়ি বেয়ে উঠা যাবা না। লিফটে চলো।”

“আমার ভয় লাগে তো।” বাচ্চাদের মতোন মিনমিনিয়ে বলে বাসন্তী।

নায়িমের হৃদয় শীতল হয়ে যায়। মেয়েটা তার অগ্নিময় জীবনে এক দমকা পবিত্রতা শীতল হওয়ার মতো। সে তার বসন্ত কুমারীর কোমর আঁকড়ে ধরে গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আত্মস্থ করে বলে,

“আমি আছি না, কিচ্ছু হবে না।”

আর কী চাই বাসন্তীর? সবচেয়ে বিশ্বস্ত হাতটি তাকে আঁকড়ে এখন। কিন্তু সত্যিই কি সবচেয়ে বিশ্বস্ত না কি একমাত্র বিশ্বস্ত সেও এক প্রশ্ন। সায় জানিয়ে লিফটে উঠে পড়ে বাসন্তী।

ফ্ল্যাটে পৌঁছে বাসন্তী সোজা নিজের ঘরে চলে যায়। সে ঢোলা গোল জামার উপরে খিমারের উপরাংশ পরেছিল তা খুলে বাবুকে খায়িয়ে ঘুম পাড়াতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। প্রথমবার মা হলেও বাচ্চা লালমপালন ১করতে ভিষণ পটু সে। কারণ প্রতিটি মামাতো, খালাতো ভাইবোনের সন্তানের অঘোষিত আয়া তো সে-ই ছিল।

আনমনেই ব্যপারটি ভেবে মন খারাপ হয়ে যায় তার। একটু খোলা হাওয়া প্রয়োজন ভেবে পা বাড়ায় বারান্দার দিকে। বা’দিকে তাকাতেই চোখে পড়ে খোলা বারান্দাটি, স্পাইডার লিলির মিষ্টি সুবাস আসছে সেখান থেকে। মনে পড়ে যায় মৈত্রী ও সায়মানের কথা। আনমনেই ভাবে,

– এতকিছুর মাঝে তো জানাই হলো না উনারা আমাকে পেলো কীভাবে? আর মৈত্রী ভাবী, সায়মান ভাই-ই বা কই? এত বড় পাপ করতে যেয়েও কী করে স্বস্তিতে আছে এই মানুষরূপী জানোয়ারগুলো?

বেডরুমে নায়িমের আগমনের আভাষ পায় সে, সেই সাথে নাহিবার কান্নার শব্দ। দ্রুতপদে যেয়ে নাহিবাকে কোলে তুলে নেয়। কোলে তুলতেই শান্ত মেয়ে, মিটমিটিয়ে হাসছে।

অন্যমনস্ক হয়েই সে প্রশ্ন করে উঠে,

“আচ্ছা, মৈত্রী ভাবী আর সায়মান ভাইকে দেখছি না। উনারা কোথায় কিছু জানেন?”

কথাটা বলতে দেরি নায়িমের উগ্র হতে নয়। যুবক প্রায় ভুলেই বসেছিল সেসব ঘটনা বাসন্তীর কথায় মনে পড়ে গেল। মনে পড়ে গেল সে কীভাবে একজন পরপুরুষের হাত ধরে বাসা ছেড়েছিল, এসকর্ট সার্ভিসে যেয়ে সে কীভাবে একজন পরপুরুষের প্র‍তি সহানুভূতিশীল হয়ে পড়েছিল।।শক্ত হাতের বন্ধনে চেপে ধরে তার দু’কাঁধ।

“অনেক মিস করতাসোস তোর আশিক আর গুরুরে মনে হচ্ছে! এত পিরিত জাগে সায়মানের জন্য? তোর আশিক আর গুরু এখন হয় কোনো খানে বান্দি খাটছে, নয় মরে পড়ে আছে। বুঝলি!”

নিজের বচন শেষ করেই ঠিক-বেঠিক জ্ঞান শূণ্য হয়ে ধাক্কা দেয় বাসন্তীকে। বাসন্তীর সহ কোলে থাকা ছোট্ট নাহিবার পড়ে যাওয়ার দশা। কিন্তু সৌভাগ্যবশত তখন দরজার সম্মুখে দাঁড়িয়ে ছিল অনিমেষ। সে ধরে ফেলে বাসন্তীকে।

“নায়িম তোর মাথা ঠিক আছে? এখনই তো নাহিবা পড়ে যেতো!” বেশ ভড়কে উঠেছে অনিমেষ। সে নায়িমের সব টুকু আক্রোশ মেনে নিয়েছে। তবে ছোট্ট শিশুটির ক্ষতি কোনো ক্রমেই হতে দিবে না।

বড় দুটো শ্বাস নিয়ে শান্ত গলায় শুধায়,

“তুই এখনই আমার সাথে সাইকাইট্রিস্টের কাছে যাবি! তোর সব কিছু মেনেছি, কিন্তু ছোট্ট বাচ্চাটার সাথে অন্যায় মেনে নিব না।”

ঘটনার আকস্মিকতায় নায়িম নিজেই থতমত হয়ে গেছে। কিন্তু তবুও রাগ ও গম্ভীরতার আড়ালে নিজের অনুভূতি লুকানোর অপ্রাণ চেষ্টা।

“আমি কি পাগল না কি যে পাগলের ডাক্তার দেখাব? আজাইরা কথা বাদ দে অনি।”

অনিমেষ বিরক্তের সহিত ভাবে,

– বাঙালির এই এক মূর্খতা, মানসিক স্বাস্থ্য বলতে যে কিছু আছে ভুলেই যায়। মানসিক সমস্যা মানেই বুঝা হয় পাগল হয়ে গেছে। আর মনোবিশেষজ্ঞ মানেই পাগলের ডাক্তার। তাই তো রোগ পুষে রেখে রোগ বাড়ায়, তবুও মান-সম্মানের ভয়ে ডাক্তার দেখায় না।

“যাবি না মানে কী? তোর এত এক্সট্রিম রাগ বা অতিরিক্ত ডমিনেটিং নেচার বা আচারণ তোর স্বাভাবিক লাগে? আমি কিছু শুনছি না তুই আমার সাথে এখনই মিস্টার ভট্টাচার্যের কাছে যাবি।”

“হোয়াদ্দা হেল! বলছি না যাব না, তোর মন চাইলে তুই যা। আ’ম টোটাল্লি ফাইন।” তেঁতে উঠে নায়িম।

“বাংলাদেশের মানুষদের মানসিক স্বাস্থ্যের উপর করা ২০১৮ সালের জরিপ অনুসারে, ১৮ বছর বা তার বেশি বয়সের মানুষের মধ্যে মানসিক ব্যাধিগুলির সামগ্রিক বিস্তার ছিল ১৮.৭%। আর এরা সবাই-ই মনে করে তারা সুস্থ ও স্বাভাবিক। কারণ সুস্থতা খালি একটাই শরীরের ভালো থাকা, মানসিক অসুস্থতা যাক তেল নিতে।”

ব্যঙ্গাত্মক বচন অনিমেষের। নানাভাবে নায়িমকে বোঝাতে তৎপর হয় সে, কিন্তু তবুও নায়িম মানতে নারাজ। শেষে উপায়হীন হয়ে নায়িমকে হুমকিই দিতে হয় অনিমেষের। এমন হুমকি যার দরুণ হাজারবার নত হবে যুবক।

“দেখ তুই যদি আমার কথা না মানিস। তাহলে ভাবী আর নাহিবাকে আমি আমার বাসায় নিয়ে যাব।”

“তুই কিন্তু অতিরিক্ত করছিস অনি!”

“কী! এখন মারবি আমায়? এই প্রতিদান আমার পবিত্র বন্ধুত্বের? এত বছর রোদ হোক, বৃষ্টি হোক সবসময় ছায়ার মতো তোর পাশে থেকেছি তার বিনময়ে এই কাজ তোর!” আবেগপ্রবণ ভঙ্গিতে বলে অনিমেষ। কখনো এই কপটতাও কাজ করতে পারে।

“আচ্ছা, সেন্টি খাইস না। যাব আমি। কিন্তু আজকেই ফার্স্ট আর আজকেই লাস্ট।”

অনিমেষ নিজের কথায় রাজি করানোর উত্তেজনায় জড়িয়ে ধরে নায়িমকে। নায়িম মৃদু ধাক্কায় সরিয়ে বারান্দায় চলে যায়৷ সে বিপুল রেগে আছে।

নায়িমের আচারণের তোয়াক্কা করল না অনিমেষ। বরং, চেঁচিয়ে বলল,

“বিকেলে বের হব, রেডি হয়ে থাকিস ভাবী আর তুই। গুলশানে বাপির এক পরিচিত মনোবিশেষজ্ঞ আছে, তাকেই দেখাব।”

(📣বিঃদ্রঃ অনেকে নায়িম আর সাদিক সাহেবের সম্পর্ক বুঝতে পারেননি। নায়িমের মা নুসরাত মোস্তফার দাদুর বিয়ে বাদেও অবৈধ সম্পর্ক ছিলই। তার ফল হলেন নুসরাত মোস্তফার সৎ ফুপি বাতাসী। মিসেস বাতাসীর ছেলেই হলেন সাদিক মিয়া। সম্পর্কে সাদিক নুসরাত মোস্তফার কাজিন এবং নায়িমের দুঃসম্পর্কের মামা। বাতাসীর স্বামী এবং সাদিক মিয়ার বাবা শামসুর মিয়া প্রচণ্ড অর্থ লোভী ব্যক্তি। মোস্তফা বংশের গোটা সম্পত্তি হাসিলেই তিনি সাদিক ও নুসরাত মোস্তফার বিয়ে দিতেই চেয়েছিলেন। নুসরাত মোস্তফার বাবা তথা নায়িমের নানা তা জানতে পেরে বাতাসী ও শামসুর মিয়াকে অপমান করে আসেন এবং নুসরাত মোস্তফার সাথে নায়িমের বাবার বিয়ে দেন। সরি, ভুলটা আমার ছিল। বুঝাতে পারিনি, ক্ষমাসূচক দৃষ্টিতে দেখবেন)
___

অরবিন্দ ভট্টাচার্যের সামনে বসে আছে নায়িম, অনিমেষ ও বাসন্তী। নায়িমের বিরক্ত লাগছে। কারণ আসার পর থেকে একদৃষ্টিতে সবাইকে পর্যবেক্ষণ করে যাচ্ছে, স্বাগতম জানানো ছাড়া একটা শব্দও উচ্চারণ। ডাক্তার তো ডাক্তার, সাথের মেয়েটির আসক্তিকর, ফ্লার্টি চাহনি আরও বিরক্তিকর লাগছে।

“এত বিরক্ত বা রাগ হওয়ার কিছু নেই, ইয়াং ম্যান। আমার মেয়ে তোমার গানের ভক্ত তাই এমন করছে। আর আমায় তো তোমার চাল-চলন, অঙ্গভঙ্গি, আচার-আচারণ পর্যবেক্ষণ করতেই হবে নাহলে রোগ কী করে ধরব?”

নায়িম বিস্ময়কর দৃষ্টিতে তাকায়। তা দেখে যেন বেশ মজা পায় প্রায় চল্লিশ উর্ধ্ব লোকটি। গা দুলিয়ে হেসে উঠে।

“একটু বেশি আত্মবিশ্বাস আর অহংকার তোমার।এত অহং ভালো না যুবক, কখন ভেঙে গুঁড়িয়ে যায় কে জানে? সবই উপরওয়ালার খেলা।”

অনেক কষ্টে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করছিল নায়িম, ঐ যে ইমেজ, তা রক্ষার্থেই। কিন্তু এ কথায় একদম তেলে বেগুনে জ্বলে উঠে সে।

“গো টু হেল উইথ ইউর জাজমেন্ট। আই ডোন্ট কেয়ার! আর অনি এই ডাক্তার না তুই-ই দেখা, আ’ম নট ইন্টারেস্টেড।”

হনহনিয়ে বেরিয়ে যায় সে। যাওয়ার আগে ঠাশ করে দরজাটা লাগিয়ে যায়। কেঁপে উঠে বসে থাকা সকলেই।

“ইশ! কী এটিটিউড নায়িম বাবুটার!”
অরবিন্দ ভট্টাচার্যের মেয়ে অনামিকা যেন এতেও অভিভূত হয়েছে। বাসন্তীর এবার বিরক্ত লাগছে মেয়েটাকে।

দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য গলা খাঁকারি দিয়ে উঠে অরবিন্দ ভট্টাচার্য।

“পেশেন্ট সম্পর্কে আমার কিছু জানার আছে আপনাদের থেকে। আমি যা যা প্রশ্ন করব তার ঠিক ঠিক উত্তর দিবেন। কিচ্ছু লুকাবেন বা হোয়াইট ওয়াশ দেওয়ার চেষ্টা করবেন না।”

“নায়িম কি পারফেকশনিস্ট? মানে খুবই স্পেসিফিক সবকিছু নিয়ে বা কোনো কিছু ঠিক-ঠাক না থাকলে এবং ঘরের কাজে ত্রুটি থাকলে খুব খ্যাঁচম্যাচ করে?”

বাসন্তীকে বলতে না দিয়েই অনামিকা উত্তর দেয়,

“কী যে বলো না বাপি শি ইজ দ্য মোস্ট ডিজায়ারেব্যাল ব্যাচেলর নায়িম! অভিয়াসলি তার সবকিছুই পারফেক্ট।”

এবার একমাত্র বাসন্তী নয় উপস্থিত সবাই-ই বিরক্ত হয়।

“অনা, তুমি বাহিরে যাও তো। বাপি কাজ করছি।”

অনামিকা মুখ গোমড়া করে চলে যায়। বাসন্তী বলে,

“হ্যাঁ, উনার সবকিছু খুবই পারফেক্ট চাই। চামুচের স্থানে চামুচ থাকতে হবে, কাপড়ের জায়গায় কাপড়। এগুলোতে ঝামেলা হলে খুবই রেগে যান।”

“ওহ, আই গ্যাসড সো। আচ্ছা, এখন কিছু পার্সোনাল প্রশ্ন করব। আপনি তো নায়িমের ওয়াইফ তার ব্যবহার আপনার সাথে কেমন? খুবই পজেজিভ, প্রোটেক্টিভ, সন্দেহপ্রবণ এমন কিছু কী? হুট-হাট রেগে যাওয়া আপনার উপর? ছোট ছোট বিষয়ে ভায়োলেন্ট হয়ে যাওয়া?”

বাসন্তী ছোট্ট এক শ্বাস ফেলে। তার দৃষ্টি পায়ের দিকে স্থির। সেভাবেই নায়িমের আচারণ কেমন কোনোরকম কপটতা ছাড়াই বলতে শুরু করে। সব শুনে ডাক্তার যা বলে তা শুনতে কেউ-ই প্রস্তুত ছিল না।

“নায়িমের সুপিরিয়রিটি কমপ্লেক্স আছে। এটা কিছুই না, বরং একটা অন্ধ বিশ্বাস মাত্র যা কিছু মানুষের জীবনে ওতপ্রোত ভাবে জুড়ে। মানে এই মানুষগুলো সর্বদা বিশ্বাস করে এবং মানে তারা সবদিক দিয়ে হোক সেটা গুণ, ইমেজ অথবা সাক্সেস সবকিছুতেই অন্যান্যদের চেয়ে ভালো এবং সবসময় সবার চেয়ে ভালো থাকতে হবে। এ ধরনের মানুষ সাধারণত খুব বেশি প্রতিযোগিতামূলক হয়। একদমই পরমতসহিষ্ণু হয় না। ভুল করলেও মানতে চায় না। বরং, কারো মতামত নিতে পারে না, মন্দ আচারণ করে। ইমেজ নিয়ে খুবই সতর্ক হয়। কার্যক্ষেত্রেও সবসময় প্রথম থাকতে চায়।

সত্যি বলতে এটা একটা বিশ্বাস। সাধারণত সুপিরিয়রিটি কমপ্লেক্স কোনো অফিশিয়াল ডিজঅর্ডার না। এটার তেমন কোনো চিকিৎসাও নেই। হ্যাঁ, সাধারণত কিছু টকিং সেশন বা থেরাপির দ্বারা শুধরানোর চেষ্টা করা হয়। তবে তাতেও নিশ্চিত নয় ঠিক হবে কি না এবং এক্ষেত্রে পেশেন্টের কোওপারেশন অনেক জরুরি। যা মনে হয় না নায়িমের ক্ষেত্রে সম্ভব।”

ধক্ করে উঠে বাসন্তীর বুকটা। তবে কি হবে না তার সুখের সংসার নায়িমের সাথে? স্বাভাবিক হবে না নায়িমের চিন্তাধারা, আচারণ একটুও?

চলবে…