টুকরো স্মৃতির অতলে পর্ব-০৯ + বোনাস পর্ব

0
584

#টুকরো_স্মৃতির_অতলে❤
#পর্ব_০৯
লেখনীতেঃআহানিতা

ভার্সিটি ক্যান্টিনে বসে আড্ডা দিচ্ছিলাম আমি আর মেঘা। মাঠে তখন চকচকে রোদের আভা।আর সেই রোদের উত্তাপেই ঘেমে একাকার হয়ে সামনে এসে দাঁড়াল রায়হান।আমি আর মেঘা ভ্রু জোড়া কুঁচকে তাকাতেই ও বলে উঠল দ্রুত,

‘ দোস্ত উঠ উঠ।এক জায়গায় যেতে হবে।প্লিজ।’

আমি আর মেঘা থম মেরে বসে রইলাম।ওর দশা দেখে আমি বলে উঠলাম,

‘ এত তাড়া নিয়ে বলছিস যেন হাসপাতালে গিয়ে কোন মুমূর্ষ রোগীকে রক্ত দিয়ে আসতে হবে?’

‘ তার থেকেও গুরুত্বপূর্ণ।চল না দোস্ত।’

আমি সরু চোখে তাকালাম। মেঘা কপাল কুঁচকে প্রশ্ন ছুড়ল,

‘ আহির কাছে? ‘

রায়হান অসহায় চোখে তাকাল।তারপরই বলল,

‘হু,প্লিজ।বন্ধুর জন্য এটুকু করতে পারবি না তোরা?কি স্বার্থপর রে!’

আমি আর মেঘা হাসলাম।তারপর দুজনই একসাথে বলে উঠলাম,

‘ কিন্তু আমরা গিয়ে ওখানে কি করব?’

‘ কিছুই করতে হবে নাহ।জাস্ট যাবি।কি হল। যাবি না?’

আর কোন উত্তর দেওয়ার প্রয়োজন হলো নাহ।উঠে দাঁড়িয়ে ছুটতে হলো ওর পিঁছু পিঁছু।তারপর রিক্সায় চেপে আহিদের বাসার সামনে এসেই থমকে গেলাম।ওখানে তো নিশ্চিত অর্কভাই থাকবে। উনার সামনে পরে গেলে?আমি শুকনো ঢোক গিলে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে লাগলাম।মেঘা কানের সামনে হাজার বকবক করলে ও আমার চিন্তা কেবল ঐ এক জায়গায়।অর্কভাইয়ের চোখের সামনে কোনভাবে পড়া যাবে নাহ।কোনভাবেই না।সেই চিন্তায় জোরে জোরে নিঃশ্বাস ফেলে দরজান সামনে যেতেই দরজা খুলল আহি।আহির গায়ের রং ধবধবে ফর্সা।তার উপর খোলা চুল।বেশ সুন্দরই লাগছিল।রায়হান কিছু বলতে যাওয়ার আগেই ও রায়হানকে উদ্দেশ্য করে চটফট বলে উঠল,

‘ দেখুন, আপনি যে বিষয়ে কথা বলতে এসেছেন সেই বিষয় নিয়ে আমার বাসার এক কিলোমিটারের মধ্যেও কোন কথা বলবেন না বলে দিচ্ছি।তাহলে কিন্তু ভালো হবে না একদম।’

রায়হানের মুখ এবার চুপসে গেল।বেচারা বেশ ভালোই জব্দ হয়েছে দেখা যাচ্ছে।আমি আর মেঘা তা দেখেই হেসে উঠলাম।পেছন থেকে আন্টি এগিয়ে আসতে আসতেই বলে উঠল,

‘ ওমাহ।মেহুল? তুই?হঠাৎ কি মনে করে আসলি মা?’

আন্টির প্রশ্নের উত্তরে আমি কিছু বলার আগেই আহি বলে উঠল,

‘ ভাইয়া কোথায়?ভাইয়াকে খুঁজতে এসেছে।এটাও বুঝো নাহ তুমি আম্মু।কি যে করি তোমায় নিয়ে।’

আমি চোখ বড়বড় করে তাকালাম।আহি কি মিথ্যা বলেরে!এরা ভাই, বোন, বাবা সবাই দেখি একদলের সদস্য।কি সাংঘাতিক রে।আহি আমার দিকে ফিরেই চোখ টিপল।মুচকি হেসে বলল,

‘ ভেতরে এসো।ভাইয়া শাওয়ার নিচ্ছে। বেরিয়ে দেখা করবে।এখন বসো।’

তার পরপর আন্টিও বলল,

‘ এতদিন পর আসলি , আয় বস মা।তোকে অনেকদিন দেখিনি।’

আমি পা বাড়ানোর আগেই মেঘা পা বাড়িয়ে ডুকে গেল।রায়হান ইশারায় বাই বলে চলে গেল হতাশ মন নিয়ে।আমি সেদিকে একবার তাকিয়ে পা বাড়ালাম অর্কভাইদের বাসায়।আন্টিকে সালাম দিয়ে সোফায় বসে এদিক ওদিক তাকাচ্ছিলাম।বেশ কয়েকমিনিটি বসে আহি, মেঘার সাথে বকবক করার মধ্যেই হঠাৎ পেঁছন থেকে কেউ বলে উঠল,

‘ আম্মু আজকে দুপুরে বাসায় খাব।অফিসে যাব নাহ।’

আকস্মিক সেই কন্ঠ কানে আসতেই আমি স্তব্ধ হয়ে বসে রইলাম।অতি কষ্টে তাকে দেখার লোভ সামলে পেছন না ফিরে সামনে সেভাবেই তাকিয়ে রইলাম।তবে তার কন্ঠ শুনেই অদ্ভুত আনন্দ হচ্ছে।কিসের আনন্দ জানা নেই।আমি সেই আনন্দে জোরে জোরে নিঃশ্বাস ফেললাম।তার পর পরই মেঘার হাত ধরে ফিসফিসিয়ে বললাম,

‘ মেঘা, চল।চলে যাই।যে কাজের জন্য এসেছিলি সেই কাজ তো হয় নি।এখন তাহলে চল?’

মেঘা আমার কথায় কেমন যেন বিরক্তি প্রকাশ করল।আমি চুপচাপ সেভাবেই বসে রইলাম।তার পরপরই আন্টি আমাদের সামনে হাজির করল নাস্তার ট্রে।আমি আগেভাগেই বলে উঠলাম,

‘ আন্টি ক্যান্টিনে খেয়ে মাত্রই আসলাম।পেট একেবারেই ভর্তি।’

উনি কথাটাকে কানে না নিয়েই বললেন,

‘ অতো কিছু তো জানি নাহ।খেতে হবে।’

আমি অসহায় চোখে তাকালাম।উনি আবারও পিঁছু হেঁটে কিচেনে গেলেন।মেঘাকে খেতে ইশারা করেই উঠে দাঁড়ালাম।এভাবে কি বসে থাকা যায়? উফস!সম্ভব নাহ।ছোট ছোট পা ফেলে এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখছিলাম।আহি মৃদু হেসেই বলল,

‘ মেহুল আপু?তোমার জন্য একটা গিফ্ট আছে আমার রুমে। দেখে আসো।’

আমি সরু চোখে তাকিয়েই প্রশ্ন ছুড়লাম,

‘ কিসের গিফ্ট?’

‘ কি জানি,ভাইয়ার দেওয়া গিফ্ট।আমার রুমে বিছানার এক কোণে আছে। দেখো গিয়ে পেয়ে যাবে।’

‘ মানে?’

আহি কিছুটা বিরক্ত নিয়েই বলল,

‘ সবকিছুতে এমন মানে মানে করো কেন তুমি? যাও গিয়ে দেখো।’

আমি ওর দিকে ছোটছোট চোখ করে তাকালাম।তারপর শুকনো ঢোক গিলেই বললাম,

‘ গিফ্টের দরকার নেই আমার। মেঘা তোর হয়েছে?যেতে হবে তো।’

আহি এবার ঠাই উঠে দাঁড়াল।আমার হাত ধরে টানতে টানতে ওর রুমের দিকে নিয়ে যেতে যেতেই বলল,

‘ তুমি নাহ, একদম ত্যাড়া মেহুল আপু।কত সুন্দর করে বললাম।রাজি হলে নাহ তো।এখন জোরে করেই গিফ্ট দিব তোমায়।আচ্ছা আমায় বলো তো,গিফ্ট কি কখনো জোর করে দেয়?কি একটা বিচ্ছিরি কান্ড।’

আমি অবাক হয়ে চেয়ে রইলাম কেবল।আহি ওর রুমে নিয়ে গিয়েই তড়িগড়ি করে একটা গিফ্টের প্যাকেট হাতে ধরিয়ে দিয়েই বলল,

‘ এটাই।তুমি এসে নিলে কি এমন মহাভারত অশুদ্ধ হতো আপু?যায় হোক।এটার ভেতর কিছু আছে।মন দিয়ে দেখবে সেটা।ওকে?’

কথাটা বলেই ও রুম থেকে বেরিয়ে গেল।আমি গিফ্টের প্যাকেটটার উপর তীব্র অনীহা প্রকাশ করে ঠিক সেখানেই আবার রেখে দিলাম যেখানে ওটা ছিল।গিফ্ট দেওয়ার হলে উনি এসে কি দিতে পারতেন নাহ?আহিকে দিয়ে এত আদিক্ষ্যাতা দেখানোর তো কোন মানেই হয় নাহ।কথাগুলো ভেবেই ছোট ছোট পা ফেলে পা বাড়ালাম।আহির রুমের পাশের রুম পাশ কাঁটিয়ে যাওয়ার আগেই আবারো সেই কন্ঠেই কিছু কথা কানে এল,

‘ দোস্ত!ইমিডিয়েটলি হসপিটাল যেতে হবে মনে হচ্ছেরে।নিঃশ্বাস যেন আমার বেরই হচ্ছে নাহ।হৃৎপিন্ডের চলাচল থেমে যাচ্ছে।হুটহাট যে কোন সময় মারা যাব আমি।’

আমি অবাক হয়ে পাশ ফিরে চাইলাম।পর্দার এক ফাঁকেই অর্কভাইয়ের খালি আর হালকা ভেজা বুক চোখে পড়ল প্রথমেই।কোমড়ে তোয়ালে পেঁছানো ছাড়া আর কিছুই নেই শরীরে।আমি শুকনো ঢোক গিললাম।উনাকে এভাবে কখনো দেখা হয় নি।ভেজা চুল থেকে টপাটপ পানি পড়ছে কপালে।মুখের খোচা দাঁড়ি গুলোও ভেজা।বুকের বা পাশটা এক হাত দিয়ে চেপে রেখেই কথা গুলো কাউকে বললেন উনি।আমি আড়ালে দাঁড়িয়ে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইলাম কেবল।উনি আবারও বললেন,

‘ এতদিন দূরে ছিল বেশ ছিল।এখন যে একেবারে কাছাকাছি।কি এক মুশকিল ভাই!’

আমি চোখ বড়বড় করে চাইলাম।উনাকে এতদিন পর হুট করে দেখেই খু্ব যে আনন্দ হচ্ছে নাহ তাই নয়।তবে সেই আনন্দের প্রকাশ ঘটাতেই বোধ হয় হৃৎপিন্ডটা এমন তীব্র গতিতে লাফাচ্ছে।কান পেতে উনার আর বাকি গুলো কথা গুলো শোনার জন্যই দাঁড়িয়ে ছিলাম।হঠাৎ পর্দার ওপাশ থেকে বলে উঠলেন উনি,

‘ লুকিয়ে লুকিয়ে কথা শুনছিস?’

আমি কেঁপে উঠলাম উনার কথা শুনে। ধরা খেয়ে গেলাম অবশেষে?শুকনো ঢোক গিলেই কাঁপা কন্ঠে বললাম,

‘ ক্ ক্ কই নাহ তো আহির রুম থেকে যাচ্ছিলাম আ্ আর তখন্, তখ্ তখন্…’

উনি বাকিটা বলার সুযোগ না দিয়েই পর্দা সরালেন।আমার দিকে একনজর তাকিয়েই চোখ রাঙ্গিয়ে বললেন,

‘ আর তখন কি?’

আমি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। তারপরই একটা মিথ্যে বলে বসলাম,

‘ আপনার পর্দায় একটা প্রজাপতি ছিল।ওটা দেখতেই দাঁড়িয়েছিলাম।’

উনি ভ্রু কুঁচকে এদিক ওদিক তাকালেন।খাটের উপর থেকে শার্টটা নিয়ে পরতে পরতে এগিয়ে এসেই পর্দার দিকে ভালোভাবে তাকিয়ে পর্যবেক্ষন করলেন।ভ্রু জোড়া কুঁচকে নিয়ে বললেন,

‘ এখন কোথায় তবে প্রজাপতিটা?’

আমি শুকঁনো ঢোক গিললাম। মিনমিনে চোখে এদিক সেদিক তাকিয়ে বা পাশে একটা জানালা দেখেই বলে উঠলাম,

‘ ঐ যে, ঐ যে জানালা দিয়ে বাইরে চলে গেল ওটা।’

উনি বাঁকা হেসে বললেন,

‘ আই নো দ্যাট, তুই মিথ্যে বলছিস।এবার সত্যিটা বল।কেন দাঁড়িয়েছিলি?’

আমি কপাল কুঁচকে অসহায় চোখে তাকিয়েই বললাম,

‘ এর জন্যই অর্কভাই।আর কোন কারণ নেই।সত্যিই!’

উনি আনমনে কিছু ভাবলেন।তারপরই আবারো বাঁকা হাসলেন।ফিসফিস করেই বললেন,

‘ ভালো টালো বেসে ফেলেছিস নাকি আমায়?’

এবার আরেক ধপা কেঁপে উঠলাম আমি।ধরা পড়ে যাওয়ার ভয়।হাত পায়ে মৃদু কম্পন বইতেই গলা শক্ত করে বলে উঠলাম,

‘ কক্ষোনই নাহ।জীবনেও নাহ।’

উনি উল্টো প্রশ্ন ছুড়লেন,

‘ বাট ইউ নো হোয়াট মিস মেহুলতা?চোখজোড়া অন্য কথা বলছে তোর।’

আমি আর এক পা ও দাঁড়ালাম না ওখানে।দ্রুত পা ফেলে মেঘার সামনে এসেই বলে উঠলাম,

‘ মেঘা?হয়েছে তোর?প্লিজ চল।আমায় যেতে হবে।’

মেঘা ভ্রু জোড়া কুঁচকে নিয়েই বলে উঠল,

‘ যাব মানে? কোথায় যাব?ইহান ও আসবে।ওর সাথে একসাথে বাসায় যাব।আন্টি লাঞ্চ করে যেতে বলেছে। ‘

আমি এবার রেগে তাকালাম ইচ্ছে করছে ওর চুলগুলো টেনে ছিড়ে নি।তবুও নিজেকে সংযত রেখেই বলে উঠলাম,

‘ ওকে!তাহলে তুই থাক।আমি আসছি। বাই।’

কথাটা বলেই কাঁধের ব্যাগটা ভালোভাবে কাঁধে নিয়ে পা বাড়িয়ে চলে যেতে নিতে লাগলেই কেউ বলে উঠল,

‘ আরেহ আরেহ, ভাবি এন্ড শালি সাহেবা।যাচ্ছেন কোথায় আপনি?’

আমি ভ্রু কুঁচকে তাকলাম।ইহান ভাই।বলতে না বলতেই চলে আসল এত তাড়াতাড়ি?কি অদ্ভুত!উনার অফিস আর এখানের দূরত্ব কি দুই মিনিটের? দুই মিনিট বললেও ভুল।মেঘা আমাকে কথাটা বলেছে এক মিনিটও হয় নি।আর ইহান ভাই এসে হাজির হয়ে গেল মুহুর্তেই?আমি ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থাকার মাঝেই উনি জুড়োজোড়া খুলে ভেতরে ডুকলেন।মুচকি হেসে বলে উঠলেন,

‘ এত তাড়া কিসের যাওয়ার আপনার?’

আমি উনার প্রশ্নের উত্তর না দিয়েই বলে উঠলাম,

‘ আপনি এত তাড়াতাড়ি কিভাবে পৌঁছালেন ইহান ভাই?’

উনি হাসলেন। তারপর বললেন,

‘ কেন গাড়িতে করে।’

আমি ভ্রু জোড়া কুঁচকে নিয়ে বললাম,

‘ আমরা এখানে আসলাম বিশ কি পঁচিশ মিনিট।এরমধ্যে আপনি এত ফার্স্ট চলে আসলেন?জানতেন আগে থেকে আমরা এখানে আসব?’

‘ বাহ!ট্যালেন্টেড ভাবি।’

‘ প্রশ্নের উত্তর তো দিলেন নাহ।’

উনি হালকা হেসেই বললেন,

‘ থাক ওটা না জানা।’

আমি অসহায় চাহনিতে তাকালাম।মেঘা তো এখন আরো যাবে না শিউর।আমি মিনমিনে চোখে তাকিয়ে আন্টির কাছে গেলাম উদ্দেশ্য সালাম দিয়ে, বিদায় জানিয়ে ফুস করে বাসা থেকে বেরিয়ে পড়া।কিন্তু তা হলো নাহ।আন্টি আমায় দেখেই বলে উঠলেন,

‘ শোন? দুপুরে খেয়ে যাবি।বুঝলি?তোর বাসায় বলে দিয়েছি তোর ফিরতে দেরি হবে।’

আম অসহায় চোখেই চেয়ে রইলাম। বললাম,

‘ কিন্তু আন্টি আমাকে… ‘

উনি আমার কথা শেষ না হওয়ার আগেই বলে উঠলেন,

‘ বড়দের কথা শুনতে হয় জানিস তো?যা গিয়ে চুপচাপ বসে থাক।বাসায় ভালো না লাগলে ছাদে গিয়ে ঘুরে আয়।কিন্তু আমি এক্ষুনি তোকে ছাড়ছি নাহ।’

আমি হতাশ হলাম।কিচেন থেকে বেরিয়ে এসেই ব্যাগটা রাখলাম সোফায়।তারপর পা বাড়ালাম ছাদের উদ্দেশ্যে।ওখানে গেলে অন্তত অর্কভাইয়ের থেকে দূরেই থাকা হবে।আমি মৃদু নিঃশ্বাস ফেলর একের পর এক সিঁড়ি গুনতে গুনতে উনাদের ছাদে পৌঁছালাম।দুপুরের উত্তপ্ত রোদ ছাদের পুরোটাই।ছাদের গাছগুলোও রোদের উত্তাপে কিছুটা নেতিয়ে পড়েছে।খসখসে ফ্লোরটা গরম হয়ে আছে।যেন পা ফেলা মাত্রই পায়ের পাতা পুড়ে যাবে।তবুও আমি পা রাখলাম ছাদের গরম খসখসে জমিনে।

.

বেশ অনেক্ষন ছাদে থাকার পরই হঠাৎ ঐ মনে হলো আমার পেঁছনে যেন কেউ আছে।কেউ যেন আমাকে পেছন থেকর দেখছে।এই সন্দেহে বার কয়েক পেছন ঘুরে তাকালেও আমি কাউকেই দেখতে পেলাম নাহ।ভ্রু জোড়া কুঁচকে নিয়ে স্থির সেভাবে দাঁড়িয়ে থাকতেই কেউ পেছনে এসে দাঁড়াল।এবার বুঝতে বাকি নেই এটা অর্কভাই।এতক্ষন কি উনার উপস্থিতিই টের পাচ্ছিলাম?মিনমিনে চোখে উনার দিকে তাকিয়েই বললাম,

‘ আপনি এখানে চলে আসলেন আবার?’

উনি বাঁকা হেসেই জবাব দিলেন,

‘ আমি তো নিজেকে সামলেই নিয়েছিলাম।এখন যখন তুই এসে দেখা দিলি তখন তো আর সামলানো যায় নাহ।’

আমি দ্বিধা ভরা চাহনিতে তাকিয়ে রইলাম।উনার কথার কিছু বুঝতে না পেরেই বললাম,

‘ মানে?কি বলছেন?বুঝলাম নাহ।’

উনি বুকে হাতজোড়া গুঁজে ছাদের রেলিংয়ে ঠেস দিয়ে দাঁড়ালেন।তারপর গম্ভীর কন্ঠে বললেন,

‘ কিছুই নাহ।’

আমি তার দিকে এক নজর তাকালাম কেবল।কালো রংয়ের চেইকের শার্ট আর টাইজার।ঘন চুলগুলো কিছুটা কপালে ঝুকেছে।মুখের খোচা দাঁড়িতে অপূর্বই বোধ হচ্ছিল উনাকে।এক নজরে উনাকে পর্যবেক্ষন করতেই মনে পড়ল রিহান ভাইয়ের কথাটা মনে পড়তেই প্রশ্ন ছুড়লাম,

‘ রিহান ভাইয়ের সাথে কি করেছেন?উনাকে এভাবে মেরেছেন কেন?হোয়াই?’

উনি হাসলেন।যেন আমার কথাটার মধ্যে কোন সিরিয়াসন্যাস ই নেই।হাসতে হাসতেই বলে উঠলেন,

‘ আমি মেরেছি?কে বলল?’

আমি শক্ত কন্ঠে বললাম,

‘ জানি আমি।বলুন কেন মেরেছেন উনাকে?এভাবে কেউ কাউকে মারে? হৃদয় বলে কিছু থাকলে এভাবে মারা যায় না কাউকে।’

‘ তোর কাছে তো আমি চিরকালই হৃদয়হীন মানুষই রইলাম। থাকলাম না হয় হৃদয়হীন মানুষ।তোর সেই ঘৃণা টুকু নিয়ে বিবেকহীন, হৃদয়হীন মানুষ হয়ে বাঁচলাম না হয়।ক্ষতি কি বল?’

কথাটা বলেই উনি চলে গেলেন।আমি উনার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেললাম কেবল।

#চলবে….

#টুকরো_স্মৃতির_অতলে❤️
#বোনাস_পর্ব
লেখনীতেঃআহানিতা

বারবার ঘড়ির দিকে তাকিয়ে সময়টুকু দেখছিলাম কেবল।কখন এই বাসা থেকে বেরোনো যায় সেটাই একপ্রকার চিন্তা এখন।হঠাৎই খাবার খাওয়ার জন্য ডাক পড়তেই সবাই গিয়ে খাওয়ার টেবিলে হাজির হলো।আমিও একটা চেয়ার টেনে বসে পড়লাম।টেবিলে ঠিক আমার মুখোমুখি বসলেন অর্কভাই।এবার যেন অস্বস্তিতে দমে উঠল আমার মন।উনার দিকে তাকানোর সাহস করে উঠতে না পেরেই খাবার খাওয়ায় মনোযোগী হওয়ার চেষ্টা চালালাম দ্রুত।কিন্তু অবাধ্য চোখ জোড়া কি এত সহজে হার মানে?আমি না চাওয়া স্বত্ত্বেও চোখজোড়া উনার দিকেই দৃষ্টি ফেলল।তখন ও কোন সমস্যা ছিল নাহ কিন্তু যখন দেখলাম উনিও আমার দিকেই তাকিয়ে আছেন তখনই অস্বস্তিতে হাত পা ঘেমেউঠল।খাবার যেন আর গলা দিয়ে নামছে নাহ।চোখজোড়া চোখাচোখি হতেই আমি তৎক্ষনাৎ চোখ সরালাম।যেন কোন এক যুদ্ধ থেকে পলাতক কোন যোদ্ধা আমি।জোরে জোরে শ্বাস ফেলে মুখে এক গ্রাস খাবার দিয়েই আবারো তাকালাম উনার দিকে।উনি ঠিক সেভাবেই স্থির ভাবে তাকিয়ে ছিলেন।আমি দ্বিতীয়বার অস্বস্তিতে চটফটিয়ে উঠলাম।বিরক্ত যেন মাথার মধ্যে ভনভন করে উঠল। খাবার নিয়ে ঠিক সেভাবেই বসে রইলাম।আর কোন খাবার গলা দিয়ে নামল না আমার।উনি যে ঠিক সেভাবেই চোখ স্থির করে আমার দিকে তাকিয়ে আছে তা বুঝতে পেরেই চোখ নামিয়ে তাকিয়ে রইলাম।জোরে জোরে শ্বাস ফেলে কেবল এই চেয়ারটা ছেড়ে উঠার অপেক্ষা!

ঠিক তখনই আহি বলে উঠল,

‘ এমাহ!মেহুল আপু?খাচ্ছো না কেন তুমি?’

আমি ড্যাবড্যাব করে তাকালাম আহির দিকে।আড়চোখে অর্কভাইয়ের দিকে তাকিয়ে উনাকে সেভাবেই থাকতে দেখে দ্রুত চোখ সরালাম আবার।হালকা কেঁশেই বলে উঠলাম,

‘ এমনি, এমনিই।’

মেঘা বা হাত দিয়ে গুতা দিয়েই পাশ ফিরে চাইল আমার দিকে।ভ্রু কুঁচকে বলল,

‘ এমনিই?’

আমি কোনভাবে উত্তর দিলাম কেবল,

‘ হু।’

তারপর অবশ্য মেঘা আর কোন কথা বলল না।ও ওর মতো খেতে লাগল।অর্কভাই আমার অবস্থাটা বুঝতে পেরেই হয়তো মুচকি হাসলেন।আমি আরেকবার তাকাতেই চোখ টিপে ভ্রু উঁচিয়ে তাকিয়েই বাঁকা হাসলেন উনি।আমি আর এক মুহুর্তও বসে না থেকে সোজা উঠে দাঁড়ালাম।লজ্জ্বা পাচ্ছি কিনা বোধগম্য নয় আমার। কিন্তু হাত পা হালকা কাঁপছে আমার।অস্বস্তি, লজ্জ্বা সব যেন একসাথেই কাজ করতে লাগল।তাই উঠে পড়েই হাত ধুঁয়ে অন্য পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম আমি।আন্টিকে গিয়ে কিচেনে খুঁজেই বলে উঠলাম,

‘ আন্টি খাওয়া শেষ।আমি যাচ্ছি তবে?দেরি হয়ে যাবে।’

উনি মৃদু হেসেই বলে উঠলেন,

‘ উহ! এত তাড়া কীসের তোর?মেঘা তো ইহানের সাথে যাবে তাহলে তুই তো একা।’

আমি দ্রুত বললাম,

‘ সমস্যা নেই আন্টি।আমি পারব। পারব যেতে।’

আন্টি আমার কথাটাকে সেভাবে না নিয়েই বলে উঠলেন,

‘ উহ।চুপ করে বস তো গিয়ে।মাত্র তো খেলি।একটু বসে তারপর যাবি।অর্ক পৌঁছে দেবে।ওর তো আজ অফিস নেই।ফ্রীই আছে।তুই একা যাওয়ার থেকে অর্ক পৌঁছে দেওয়াই বেটার না মা?’

আমি মুখ কালো করেই বলে উঠলাম,

‘ নাহ আন্টি।আমি একা যেতে পারব আন্টি।’

‘ চুপ কর তো।গিয়ে বস।অর্ক পৌঁছে দেবে।বড়দের কথার উপর কথা বলতে নেই জানিস তো?’

আমি অসহায় চোখে চাইলাম কেবল।তারপর ধীর পায়ে এগিয়ে বেরিয়ে এলাম সেখান থেকে।

.

দুপুরের তড়তড়ে রোদটা এখন আর নেই।হালকা পিনপিনে বাতাস বইছে চারপাশে।পাশেই অর্কভাই বেশ আরাম করে বসে ড্রাইভ করছেন।হেলেদুলে থাকা সূর্যের একটু আলো গাড়ির গ্লাস ভেদ করে এসে পড়ল উনার মুখে।আমি স্তব্ধ হয়ে সেদিকেই তাকিয়ে ছিলাম।এক ধ্যানে তাঁকিয়ে উনার কপালে পড়া চুল, খোঁচা দাঁড়ি আর চোখজোড়া দেখতেই ব্যস্ত হয়ে পড়লাম।কিন্তু হঠাৎ ঐ ব্রেক কষে গাড়ি থামালেন অর্কভাই।বাইরে তাকিয়ে বুঝলাম চলে এসেছি। নেমে পড়ার আগেই উনি আমার দিকে তাকিয়েই কড়া গলায় বলে উঠলেন,

‘ এভাবে হাবার মতো তাকিয়ে আছিস কেন তুই?’

আমি দ্রুত চোখ সরালাম।কাঁপা কন্ঠে দ্রুত মিথ্যে বলে উঠলাম,

‘ ক্ ক্ কী বলছেন?আমি?’

উনি বাঁকা হাসলেন।ভ্রু উঁচু করে বললেন,

‘ অবশ্যই তুই।এখানে কি অন্য কাউকে দেখতে পাচ্ছিস তুই?’

‘ ক্ কই নাহ তো।আমি তো ওপাশের রাস্তাটার দিকেই তাকিয়ে ছিলাম।’

উনি সেভাবে থেকেই বললেন,

‘ তাই নাকি?লুকিং গ্লাসে বেশ ভালোই বোঝা যাচ্ছিল তুই যে ওপাশের রাস্তাটা দেখছিলি।কিন্তু আই হ্যাভ এ ডিপ কোইশ্চেন মিস মেহুলতা।কোনভাবে আমার প্রেমে টেমে পড়ে যান নি তো?তাহলে কিন্তু সাংঘাতিক বিষয় হয়ে যাবে।খুব সাংঘাতিক।’

কথাটা বলেই দাঁত কেলিয়ে হাসলেন উনি।আমি চোরের মতো দৃষ্টি সরিয়ে লজ্জ্বায় কাচুমাচু করে বসে রইলাম।আমি যে বারংবার ধরা পড়ে যাচ্ছি তা বেশ বুঝতে পারছি।মাথা নিচু করে বসে থাকার এক পর্যায়েই উনি ফিসফিসিয়ে কানের কাছে বলে উঠলেন,

‘ এত লজ্জ্বা কি তোকে মানায়?’

আমি বিস্ফোরিত চোখে চাইলাম।আমতা আমতা করে বলে উঠলাম,

‘ ল্ লজ্জ্বা?’

উনি মৃদু হাসলেন।হাতের ঘড়িতে সময় দেখেই আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,

‘ হ্যাঁ।লজ্জ্বা। লজ্জ্বায় তোর মুখ লালরাঙ্গা হয়ে আছে।বিশ্বাস করিস না?আয়নায় দেখ।’

আমি চোখ তুলে সামনের আয়নাটায় তাকালাম।উনি লুকিং গ্লাসে নিরন্তর ভাবে চেয়ে আছেন।উনার দৃষ্টির এই চাহনিতে বারবার আমার হৃদয় কম্পিত হলো যেন।বারবার উনার চোখে চোখ পড়তেই যেন এক গাঁধা অস্বস্তি এসে ভর করল আমার মধ্যে।আমি হাত জোড়া বারংবার কছলে নিয়ে মাথা তুলে বললাম,

‘ ক্ কই নাহ তো।মিথ্যে বলছেন আপনি।’

উনি নিঃশব্দে হাসলেন।তারপরই বললেন,

‘ মিথ্যে তো তুই বলছিস।ভালোবাসা কি মিথ্যে বলতে শেখায় মিস মেহুলতা?শেষ পর্যন্ত প্রেমে ট্রেমে পড়ে গড়গড় করে মিথ্যা বলা শিখে গেলি মেহুল?তাও পাক্কা মিথ্যুকের মতো মিথ্যে বলা?আ’ম ভেরি শক্ড!’

‘ মিথ্যা?কি মিথ্যে বলছি আমি?’

উনি আমার দিকে হালকা ঝুকলেন।তৎক্ষনাৎ নিঃশ্বাস যেন বন্ধ হওয়ার প্রয়াস আমার।চোখ তুলে উনার দিকে তাকাতেই উনি বলে উঠলেন,

‘ যদি বলি সব মিথ্যে? যদি বলি এতক্ষন পর্যন্ত বলা সব কথা মিথ্যে তোর?যদি বলি তুই সবটা মিথ্যে বলছিস?সত্যতার কোন প্রমাণ কি অাধো আছে তোর কাছে?আমার কাছে কিন্তু সবটার প্রমাণ আছে।’

আমি তৎক্ষনাৎ কাঁপা কন্ঠে বলে উঠলাম,

‘ প্ প্রমাণ?কি প্রমাণ আছে আপনার কাছে?কি প্রমাণ?কোন প্রমাণ নেই আপনার কাছে।’

উনি হাসলেন।আমার দিকে আরেকটু ঝুকেই কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বললেন,

‘ এই যে আমার চোখজোড়া।এই যে আমার হৃদয়।এই যে তোর অনুভূতি।তোর লালাভ মুখটা কিন্তু আমার চোখজোড়া একমুহুর্তেই ধরে নিয়েছে।তুই কি ঐ চোখজোড়াকে প্রমাণ হিসেবে ধরবি না?এই যে তুই আমার দিকে তাকিয়ে ছিলি সবটা পথ তাও কিন্তু আমার ঐ চোখজোড়ায় ধরে নিল।তুই কি বলতে চাস আমার চোখজোড়া প্রত্যক্ষ সাক্ষী নয় তার?এই যে তুই ভালো্…’

কথাটা বলতে লেগেই উনি থেমে গেলেন আবার।তারপর একটা নিঃশ্বাস নিয়েই আবার বললেন,

‘ এই যে তুই আমায় ভালোবাসিস। এটা কিন্তু আমার হৃদয় বেশ ভালোই বুঝে। বুঝলি?এই যে আমাকে নিয়ে তোর অনুভূতি তাও তো আমি বেশ বুঝে নিয়েছি।অথচ তুই বললি আমায় ভালোবাসিস নাহ।এটা কি ঢের মিথ্যে বলা নয়?তাও বলবি আমার কাছে কোন প্রমাণ নেই?এসব প্রমাণ কি যথেষ্ট নয় তোকে মিথ্যুক প্রমাণ করতে?’

আমি স্থির চোখে চেয়ে রইলাম।উনি একটু বেশি ঝোকায় উনার উষ্ণ নিঃশ্বাস এসে পড়ল আমার ঘাড়ে।কানের কাছে উনার ফিসফিসানো কন্ঠটা বারংবার বাঁজতে লাগল কেবল।উনি লুকিং গ্লাসে একইভাবে আমার দিকে তাকিয়ে থেকে কয়েক সেকেন্ড পর চোখ বন্ধ করেই সিটে হেলান দিয়ে বসলেন।আমি উনার দিকে সেভাবেই তাকিয়ে রইলাম।উনি চোখ বন্ধ রেখেই বলে উঠলেন মৃদু কন্ঠে,

‘ একবার বলবি ভালোবাসি?’

আমি নির্বাক হয়ে তাকালাম।উনি করুন চাহনিতে তাকিয়েই বললেন আবারও,

‘ বলবি একবার? “ভালোবাসি” শব্দটা?’

আমি হতবিহ্বল চাহনি নিয়ে তাকিয়েই বললাম,

‘ মানে?’

উনি শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন,

‘ ওকে নো প্রবলেম। বলিস নাহ।জোর করছ নাহ।কিন্তু একদিন আসবে অবশ্যই যেদিন তুই আমায় ভালোবাসি বলবি।রাইট? ‘

আমি আর এক মুহুর্তও সেখানে বসে রইলাম নাহ।দ্রুত গাড়ি থেকে নেমে তড়িগড়ি করে পা বাড়ালাম ওখান থেকে।যার ফলে অর্কভাইকে বাই বলার প্রয়োজন বোধ ও করলাম না।উনার দিকে পেছন ফিরে দ্বিতীয়বার তাকালাম ও না।

#চলবে…..

[কেমন হয়েছে জানাবেন❤️❤️]