ডাহুক নদীর তীরে পর্ব-১২+১৩

0
275

#ডাহুক_নদীর_তীরে (পর্ব-১২)
#হালিমা রহমান

সকাল সকাল গোসলটা সেরে ফেললো সোনালী। কাল রাতে সুযোগ পেলে রাতেই করে ফেলতো।কত কিছুর ভিতর দিয়ে কাল পথ চলতে হয়েছে।মাটিতে শুতে হয়েছে,ঝোপঝাড়-কাটাগাছের ভিতর দিয়ে হামাগুড়ি দিতে হিয়েছে,হাঁটার সময় শুকনো পাতা ভাঙার শব্দ যাতে না হয় সেজন্য খালি পায়ে হাঁটতে হয়েছে।হাম্মামখানার এককোনে একটা বড় জানলার মতো আছে।আগে হয়তো জানলাটা আরো ছোট ছিল।কিন্তু এখন দেয়াল ভেঙে, কাঁচ ভেঙে তার আকার দ্বিগুণ হয়েছে।ইউসুফ ও মামুনের চোখ বাঁচিয়ে জানলা দিয়েই বাড়িতে ঢুকেছে সোনালী।হাম্মামখানার পাশেই এক বিশাল কাঠাল গাছ আছে।সেই কাঠাল গাছের ডাল থেকে জানলায় লাফ দিয়ে বিড়ালের মতো বাড়িতে ঢুকতে হয়েছে।কনুইয়ের দিকটায় ব্যাথা পেয়েছে খুব।জানলায় গ্রিল না থাকায় রক্ষা। গ্রিল থাকলে খবর ছিল কালকে।কাঠাল পাতার ফাঁক দিয়ে কি যেন একটা পোকা পড়েছিল ঘাড়ের উপর। পোকাটাকে সাথে সাথে মেরে ফেললেও ঘাড়ে কেমন যেন চিনচিনে ব্যাথা অনুভব হয়েছে।সকাল থেকেই ঘাড়ের ব্যাথাটা বেড়েছে।ব্যাথার সাথে সাথে চুলকানিও আছে।মনে হচ্ছে এলার্জি হয়ে গেছে ঘাড়ের উপর।সোনালীর সারা শরীর ব্যাথা।এই প্রথম এতো কাজের চাপ একসাথে নিতে হচ্ছে।এটা সোনালীর জন্য গোল্ডেন চান্স।সঠিকভাবে কাজটা শেষ করতে পারলেই হলো।আর পিছু ফিরে তাকাতে হবে না। এরপর সোনালীর নাগাল আর কে পায়!

সোনালী ব্যাথা কমার মলম লাগিয়ে নিলো ঘাড়ে।কনুইয়েও একটুখানি দিলো।খাওয়ার পর ব্যাথার ঔষধ খেতে হবে।নাহয় আজ আর চলতে পারবে না সে।হাম্মামখানা থেকে বেরোলেই এক বিশাল বারান্দা সামনে পড়ে।দোতলার ঘরগুলো বারান্দার এককোনে।সোনালীর কাছে বাড়িটাকে অনেকটা হাসপাতালের মতো লাগে।তথার চোখে এটা যত সুন্দর,সোনালীর চোখে এটা ততোটাই সাদামাটা।একদম হা করে দেখার মতো কোনো বাড়ি এটা না।বারান্দার সর্বশেষের ঘরটা ইউসুফের। তাদের পাশের ঘরটা সোনালীদের।সোনালী গুনগুন করে গান গাইতে গাইতে বারান্দা দিয়ে হাঁটে।বিশাল বারান্দায় কয়েকটা ফুলের গাছ লাগালে মন্দ হতো না।বারান্দার রেলিং ধরে একবার নিচের দিকে তাকায়।যে যার মতো হাঁটছে,কথা বলছে,ছবি তুলছে।ডিরেক্টরও দেখা যাচ্ছে এককোনে।বসে বসে ইউসুফের সাথে কথা বলছে।উপর থেকেই ইউসুফের দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসে সোনালী।সে নিজেও জানে না কিসের মধ্যে ফেসে গেছে ।রেলিঙের উপর দু-হাতে ভর দিয়ে নিচের দিকে ঝুকে দাঁড়ায় সোনালী।মনে মনে কিছু হিসাব কষে।কাঙ্ক্ষিত একজনকে চোখে পড়তেই মুখের হাসিটাকে আরেকটু চওড়া করে।একচোখ বন্ধ করে ইউসুফের দিকে কনিষ্ঠ আঙুলের সাহায্যে ইশারা করে।ঠোঁট গোল করে ফিসফিসিয়ে বলেঃ” ওই যে,হারামীটা ওখানে।”

কয়েক সেকেন্ড পড়ে আবারো সোজা হয় সোনালী। তার কাঙ্ক্ষিত মানুষটা দৃষ্টিসীমার বাইরে চলে গেছে।চুল থেকে তোয়ালে খুলে চুলগুলোকে একবার ঝেড়ে নেয় মেয়েটা।নরম তোয়ালেতে আলতোভাবে চুলগুলো মুছে পিঠের মাঝ বরাবর ছুঁড়ে মারে।গলায় তুলে গানের সুর।

_” আধোরাতে যদি ঘুম ভেঙে যায়..”

_” ছোট্ট মেয়ে রাত আর নেই।এখন সকাল।সবার ঘুম ভেঙেই গেছে।”

চমকে পিছু ফিরে সোনালী।তার পিছনেই মামুন দাঁড়ানো।তার হাতে খাবারের ট্রে।মামুনের আগে খাবারের দিকে চোখ যায় সোনালীর।অমনিই পেটের ক্ষুধা তাদের অস্তিত্ব জানান দেয়।খুব ক্ষুধা পেয়েছে তার।তাছাড়া মেয়েটা খুব ভোজনরসিক। সেকেন্ডে সেকেন্ডে তার ক্ষুধা পায়।

_” ছোট্ট মেয়ে,আপনারও কি ক্ষুধা পেয়েছে?”

_” হ্যাঁ, খুব।আপনারা খাবার দিতে খুবই দেরি করেন।”

অকপট অভিযোগ। মনে মনে হাসে মামুন।মেয়েটা ভীষণ সহজ-সরল।হাঁটতে হাঁটতে বলেঃ” খুব ক্ষুধা পেলে এতোক্ষণ বলেননি কেন?”

_” কাকে বলতাম?আপনারা দুজন ছাড়া এখানে সবাই নতুন।একটাও কাজের লোক নেই এখানে।এতোবড় বাড়িতে কোনো কাজের লোক নেই কেন?”—মামুনের সাথে সোনালীও পা বাড়ায়।

_” কখনো প্রয়োজন হয়নি তাই।তবে আপনাদের আর সমস্যা হবে না।আজকেই একজন নতুন কাজের লোক আসবে।রান্নাবাড়ার সব দায়িত্ব তার।”

_” এগুলো কার জন্য নিয়ে যাচ্ছেন?”

_” তথা ম্যামের জন্য।”

_” নিশ্চয়ই মি.ইউসুফ পাঠিয়েছেন।”

_” হ্যাঁ। ”

_” হায় আল্লাহ! সকাল সকাল কি একটা দৃশ্য দেখলাম।আমার ক্রাশ তার প্রেমিকার জন্য আমার চোখের সামনে দিয়ে খাবার পাঠাচ্ছে।ইশ! কি নিষ্ঠুর। আমাকে কি তার চোখে পড়ছে না?”

_” তথা ম্যামকে স্যার পছন্দ করেন,তা আপনি জানলেন কি করে?”

মামুনের কথায় মনে মনে হাসে সোনালী।তার মানে ও যা ভেবেছে তাই ঠিক।তথা সত্যিই আহমেদ ইউসুফের পছন্দের মানুষ।কথার প্যাঁচে কথা আদায় করতে খুব ভালো জানে মেয়েটা।

_” আপনার স্যারের চোখ-মুখই বলে দেয় যে সে তথা আপুর প্রতি দূর্বল।”

_” কিন্তু তথা ম্যাম তো বুঝতে পারেনি।”

_” আপনার ম্যামের চোখ নেই তাই বুঝতে পারেনি।আমার ক্রাশ সুন্দর হলে কি হবে,তার রুচি খুবই খারাপ।আপনার তথা ম্যামের চাইতে আমি বেশি সুন্দর,হুহ।”

_” আপনি তথা ম্যামকে হিংসা করছেন নাকি?”

_” মোটেও না।আমার রুচি অতোও খারাপ নয় যে পরের গোয়ালের গরুর দিকে নজর দেব।পরের গরু কখনো আমার গান গাইবে?”

_” স্যার শুনলে খবর আছে আপনার।”

_” আপনি না বললে কিভাবে শুনবে?আপনার আবার কথা লাগানোর স্বভাব আছে নাকি?”

মামুন অবাক হয়ে যায় সোনালীর কথা শুনে।মেয়েটার কি ভয়-ডর নেই?

_” আপনি খুব ইঁচড়েপাকা, ছোট্ট পেয়ে।অকালে পেকে গেছেন।আপনার বয়স আর কত হবে?বড়জোড় সতেরো-আঠারো।এই বয়সের মেয়েরা এতো বেশি বুঝে না।”

_” আপনি জানেন না, মেয়েদের বয়স নিয়ে কোনো কথা বলতে নেই?কিন্তু আপনি যেমন ভাবছেন আমি তেমনটা নই।”

_” আপনি তবে কেমন?”

_” আমি ভীষণ অন্যরকম।”—অকারণেই খিলখিল করে হেসে উঠে সোনালী।
মামুনের শরীরে ঠান্ডা স্রোত বয়ে যায়।অনেকটা কালবৈশাখির দমকা হাওয়ার মতো শীতল বাতাস আচমকাই তাকে ছুঁয়ে দিয়ে যায়।তার হৃদমাঝারের বন্ধ কপাটে অস্বচ্ছ এক প্রতিচ্ছবি কড়া নাড়ে।মামুন অপলক চেয়ে থাকে সোনালীর দিকে।মেয়েটা কেমন যেন।চেহারায় তীব্র কৈশোরের ছাপ।তার চলন-বলনে চঞ্চলতা যেন চুয়ে চুয়ে পড়ে।সোনালীর সবকিছু সুন্দর।পায়ের আঙুল থেকে শুরু করে মাথার চুল–সবকিছু।একটুখানি সূর্যের আলো মেয়েটার কমলার কোয়ার মতো নরম ঠোঁট দুটোকে ছুঁয়ে দিচ্ছে।এই সাধারণ দৃশ্যটাও নজর কাড়ে মামুনের।সবুজ রঙের জামায় সোনালীকে একদম অপ্সরীর মতো লাগে মামুনের চোখে।সে দ্রুত চোখ ফিরিয়ে নেয়।তার হাসফাস লাগছে খুব।মামুন সোনালীকে রেখেই হাঁটা ধরে।প্রেমে-ট্রেমে পড়ার ইচ্ছে নেই তার।নিজের অবাধ্য মনকে ধমক দিয়ে শান্ত করে মামুন।হতচ্ছাড়া মন কি ভুলে গেছে, মামুনের সন্যাস জীবন পালন করার ইচ্ছে আছে ?সোনালীকে পিছনে রেখেই আপনমনে বিড়বিড় করে মামুন।মেয়েটা ভীষণ ফাজিল।এতো ঢং করে কথা বলার দরকার আছে কোনো?বেয়াদব পাকনা মেয়ে।

মামুনের অবস্থা দেখে প্রাণ খুলে হাসে সোনালী।জাল বিছানো শুরু সবে।সেও দেখবে এই জাল কেটে মামুন আর ইউসুফ কিভাবে বের হয়।

***

_” আসব ম্যাম?”

তথা শুয়ে ছিল।পুরুষের কন্ঠ পেয়ে হকচকিয়ে উঠে বসে।বালিশের পাশ থেকে ওরনা টেনে গায়ে দেয়।মাথা বাড়িয়ে দরজার দিকে তাকায়।মামুন দাঁড়িয়ে আছে।

_” জ্বি,আসুন ভাইয়া।”

নিচের দিকে তাকিয়ে ঘরে ঢুকে মামুন।বিছানার পাশের টেবিলে খাবারের ট্রে রাখে।মাথা নিচু করেই বলেঃ” স্যার পাঠিয়েছেন। ”

_” আমার জন্য?”

_” জ্বি।”

একটু অবাক হয় তথা।সকালে কথা কাটাকাটি হওয়ার পর ইউসুফের সাথে আর দেখা হয়নি।সকালে তথার কথাগুলো একটু কটুই ছিল।এতো কটু কথার পরেও যেচে খাবার পাঠালো! আশ্চর্য! এ নিছক অতিথিপরায়নতা নাকি অন্যকিছু?

_” আপনার কি আর কিছু লাগবে ম্যাম?”

_” জ্বি, না। এখন থেকে কি সবার খাবার ঘরেই পাঠানো হবে?”

_” জ্বি, না।আপনার ক্ষুধা পেয়েছে বলেই।স্যার পাঠিয়ে দিলেন।”

_” ওহ,আচ্ছা।আমার রুমমেটকে কোথাও দেখেছেন?”

_” হ্যাঁ। ঘরেই আসছে বোধহয়। আমি তাহলে আসছি।”

_” জ্বি,আচ্ছা।”

মাথা নিচু করেই ঘর থেকে বেরিয়ে যায় মামুন।খুব অদ্ভুত লাগে তথার।খাবারের ট্রের দিকে একনজর তাকায় সে।পাউরুটি,কলা,জেলী আর একগ্লাস জুস।সব বাইরের খাবার।নিজেকে খুব বিশেষ একজন মনে হচ্ছে।কলার খোসা ফেলে এক কামড় বসায় তথা।ইউসুফের এই আচরণটুকু ভাবাচ্ছে খুব।এতো যত্নের কারণ কি?সবার প্রতি কি একই আচরণ করে সে?নাকি এসব শুধু তথার জন্যই বরাদ্দ?

_” একা একা খাচ্ছ কেন?আমার মতো ক্ষুধার্ত মানবীকে চোখে পড়ছে না?”

_” জ্বি,না।যে সবসময় ক্ষুধার্ত থাকে,তাকে আমার চোখে পড়ে না।”

আবারো হাসে সোনালী।মেয়েটার হাসি সুন্দর বলে অকারণেই হাসে সে।ডানহাত দিয়ে একটা পাউরুটিতে একটুখানি জেলি মেখে নেয়।মুখে পুরতে পুরতে বলেঃ” তোমার সাথে থেকে সুবিধাই হচ্ছে আমার।তোমার বদৌলতে বেশ যত্ন-আত্তি পাওয়া যাবে।”

_” বুঝলাম না।”

_” কালকে বাস স্টেশনে তোমার একজন প্রণয় ভিক্ষুককে দেখেছিলাম।কি যেন নাম,ইরফান না?”

_” হ্যাঁ।”

_” আরেকজন পাগল ইরফানকে দেখার জন্য প্রস্তুত হও।তোমাকে দেখলে একজনের চোখের ভাষা বদলে যায়।খেয়াল করলেই দেখতে পাবে।”

ভাবলেশহীনভাবে কলা চিবোয় তথা।সোনালী কি ইঙ্গিত করেছে তা বোঝার মতো যথেষ্ট বয়স তার হয়েছে।সোনালীর কথা ফেলে দিতে পারে না সে।সত্যিই কি আরেকটা পাগল প্রেমিকের দেখা মিলবে এখানে?এখানেও একটু স্বস্তি পাবে না সে?আহ! যন্ত্রণা।ভালো লাগে না এসব আর।

***

রুবাইদা-মাহাদী স্কুলে চলে গেছে।তথা নেই।আকলিমা খাতুনের ঘর পুরো খালি।ঘরে থাকতে তার ভালো লাগে না। ইচ্ছে করে সব ছেড়েছুড়ে একদিকে চলে যেতে।তথাকে একটু বেশিই ভালোবাসেন তিনি।রান্নাঘরে বসে বসে একমনে রান্না করছেন আকলিমা খাতুন।একচুলায় ভাত আর অন্য চুলায় ডাল বসিয়ে দিয়েছেন।রান্নাঘরের ফ্লোরে লেপ্টে বসে লাউ কুটছেন। তার পাশেই ছোট বাটন ফোনটা।তথাকে দু’বার কল করেছেন।মোবাইল বন্ধ বলছে।ওখানে নেট নেই বোধহয়।

_” লিমা,একটু শুইনা যাও তো।”

ইকবাল মিয়া এখনো কাজে যাননি।পেশায় একজন আদমবেপারি তিনি।কম খরচে বিদেশে লোক পাঠান।আগে এই পেশায় আয় খুব বেশি ছিল।কিন্তু এখন কমছে।ইকবাল মিয়ার হাতে কাজ এখন খুব কম।তাই এদিক-ওদিক টইটই করেন বেশি।চুলার আঁচ কমিয়ে শোবার ঘরে ছুটে যান আকলিমা খাতুন।ইকবাল মিয়া খাটে বসে আছেন।তার সামনে একতাড়া নোট।হাতেও অনেকগুলো টাকা।সেগুলো গুণে গুণে সামনে রাখছেন।আকলিমা খাতুনের সামনেই সবগুলো টাকা গুণে শেষ করলেন ইকবাল মিয়া।কিছু টাকা পকেটে রেখে বাকি টাকা স্ত্রীর দিকে এগিয়ে দেন।

_” এই টাকাগুলো রাখো লিমা।যত্ন কইরা রাইখো।কয়েকদিন পরেই কাজে লাগব এগুলা।নব্বই হাজার আছে এখানে।আলাদা কইরা রাইখো টাকাগুলা।আজ বিকালে আরো নব্বই হাজার দিমু।”

এতো টাকা দেখে খুব আশ্চর্য হয়ে যান আকলিমা।খাতুন।গলায় সন্দেহের সুর তুলে প্রশ্ন করেনঃ” এতো টাকা কই পাইছেন আপনে?এডি তো কাজের টাকা না।আপনে কহনো আমার কাছে কাজের টাকা রাখতে দেন না।তাইলে? কিসের টাকা এগুলা?”

চলবে….

#ডাহুক_নদীর_তীরে (পর্ব-১৩)
#হালিমা রহমান

আকলিমা খাতুন কপাল কুঁচকে চেয়ে থাকেন স্বামীর দিকে।রিনরিনে গলায় বলেনঃ” আমি আপনেরে কিছু জিগাইছি।”

_” হু,কি যেন জিগাইছিলা?”

_” এতো টাকা কই পাইছেন আপনে?”

_” এডি তথার টাকা।তথার কামের টাকা আমার কাছে দিছে।”

_” এতো টাকা! এতো ছোট একটা কাজের লেগা এতো টাকা দেয়?”

_” কি জানি! দিলো তো।”

_” কে দিছে?”

_” ডিরক্টর আখতার হোসেন।”

_” এডা ওই যে ওই ব্যাডা না,আপনেগো গ্রামে যে থাকে।গড়ের পুকুরের পাশে যে একটা বড় বাড়ি আছে।হেয়নি?”

_”হ।”

_” ওই ব্যাডার তো শুনছি অনেক দোষ। কিসব দুই নাম্বারি কাজ-কাম করে।হের লগে কাম করতাছে তথায়! কি কন এডি।মাইয়া তো যাওয়ার আগে হের নাম কয় নাই আমারে।কইলে আমি কহনো যাইতে দিতাম না।”—- শেষের দিকে আকলিমা খাতুনের গলা কেঁপে উঠে।মেয়ে তার কোন গর্তে পড়েছে আল্লাহ মালুম!

_” আরে লিমা, তুমি শুধু শুধু দুঃশ্চিন্তা করতাছো।আমগো তথার রাজ কপাল।ওয় অনেক ভালো জায়গায় পড়ছে।ডিরেক্টর স্যার ওরে ঠিক জায়গায় পৌঁছায় দিব।চিন্তা কইরো না।”

_” ঠিক জায়গা আবার কি,হ্যাঁ? ওই ডিরেক্টর দুই বছর আগে কি করছে,শুনেন নাই?গ্রাম থেকা দুইডা মাইয়ারে কামের কথা বইলা ঢাকায় আনছিল।পরে মাইয়াগোরে বিদেশে পাঠায় দিছে।মাইয়ার বাপ-মায় কি হেরে এই কামের অনুমতি দিছিলো?তবুও পাকনামি কইরা করছে। কত বড় হারামজাদা!”

_” চুপ কর, লিমা।যা বুঝো না, তা নিয়া কথা কইবা না।তুমি কি বুঝো এগুলির?মাইয়া মাইষের লগে কথা কওনই ভুল।দেও টাকাডি দেও।সবকিছু তে বাড়াবাড়ি।যত্তসব।পন্ডিত আইছে এক্কারে।সব জানে।”

ইকবাল মিয়া চোখে-মুখে একরাশ বিরক্তি নিয়ে টাকাগুলো আলমারিতে সংরক্ষণ করেন।আকলিমা খাতুনকে বিড়বিড় করে কয়েকটা গালি দেন।আর আকলিমা খাতুন? তিনি বিস্ফোরিত চোখে চেয়ে থাকেন স্বামীর দিকে।এই ইকবাল মিয়াই এক বছর আগে আখতার হোসেনকে দেখতে পারতেন না।কত নিন্দা করতো এই লোকের।আখতার এটা করেছে, ওটা করেছে,সে একটা কুলাঙ্গার –এরকম আরো কত কি।আজ কি হলো? ইকবাল মিয়া কবে থেকে ডিরেক্টরের এতো ভক্ত হয়ে গেলেন? এতো বড় মেয়েকে এরকম খারাপ একটা লোকের সাথে কাজে পাঠাতে একটুও দ্বিধা করলেন না!হিসাব মেলাতে পারেন না আকলিমা খাতুন।তার মাতৃহৃদয়ের এককোনে দুর্ভাবনারা বাসা বাধে।মনের কোনে ভয় জমে। মেয়েটা ভালো থাকবে তো?ইকবাল মিয়াকে আর কোনো প্রশ্ন করেন না আকলিমা খাতুন।কেবল জ্বিভ নাড়িয়ে পরম দয়াময় সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করেন। ” আমার মাইয়াডারে সুস্থভাবে ঘরে ফিরায়া দেও আল্লাহ।আমার তথারে আমার বুকে ফিরায়া দেও।”

ঘর থেকে এলোমেলো পায়ে বেড়িয়ে যান আকলিমা খাতুন।তিনি এখন তথার ফোনে হাজারবার কল করবেন।তথার সাথে কথা না বলা অবধি তার ছটফটানি কমবে না।

এই ডিরেক্টরকে নিয়ে গ্রামে অনেক কথা প্রচলিত আছে।বলাবাহুল্য, সেগুলো মোটেও ভালো কথা নয়।একদম নিম্নবিত্ত ঘড় থেকে উঠে এসেছে আখতার হোসেন।বয়স হলেও কাজ করতো না সে।বিশ বছর বয়সে চুরির দায়ে গ্রামছাড়া হয়েছিল।তারপর বহুদিন আর দেখা পাওয়া যায়নি তার। বছর সাতেক আগে বহু বছর পর আখতার হোসেন যখন আবার গ্রামে ফিরলেন, তখন তার রমরমা অবস্থা।মাস তিনেকের মাঝেই পুরোনো ভিটায় নতুন করে বিশাল এক বাড়ি করলেন।গড়ের পুকুরে নতুন করে চকচকে ঘাট তৈরি করলেন।গ্রামবাসীর চক্ষু চড়কগাছ।চোরা আখতার এতোদিন কোথায় ছিল,কি করতো, সৎ কাজ নাকি অসৎ কাজ–এসব নিয়ে গবেষণা শুরু হয়ে গেল সবার মাঝে।এসব খবরে বেশ কয়েকদিন চায়ের দোকান সরগরম থাকতো। কেউ কেউ বলতো আখতার হোসেন শহরে যেয়ে ভালো কাজই করেছে।সৎ কাজ করেই এতো টাকা কামাই করেছে।এসব কথা শুনে আরেকদল মুখ ভেংচি দিলো।হুহ! সৎভাবে কেউ এতো তাড়াতাড়ি এতো টাকা কামাতে পারে।এসব অসৎ কাজের ফল নিশ্চয়ই। কতদিন এই দুই দলের মাঝে তর্কাতর্কি,কথা-কাটাকাটি চলেছে।চায়ের কাপে ঝড় উঠতো এসব আলোচনাকে ঘিরে।

ডিরেক্টর আখতার হোসেন কিন্তু এসব কথায় বিন্দুমাত্র পাত্তা দিলেন না।বাড়ি করার পর একপাল ছেলে-মেয়ে নিয়ে গ্রামে ঘুরতে গেলেন।রক্ষণশীল গ্রাম্য সমাজকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে হৈ-হুল্লোড় করে আবার কিছুদিন পর ফিরে এলেন।যারা পূর্বে আখতার সাহেবের পক্ষে ছিল তারা মাথা নিচু করে ভুল স্বীকার করলো।না,আখতার সাহেবকে তারা যতটা ভালো-ভদ্র ভেবেছিল ততোটা সাধু-সন্যাসী সে নয়।এতো বছরে তার অনেক নৈতিক অধঃপতন হয়েছে।অনৈতিক মানুষেরা আবার সৎপথে চলতে পারে নাকি?

***

বিকালের নরম আলোতে সবকিছু উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে।সবদিকে কেমন একটা শান্ত-স্নিগ্ধ ভাব।কোনো আওয়াজ নেই,হৈ-হুল্লোড় নেই,গাড়ি-ঘোড়ার অযাচিত শব্দ নেই,আশেপাশে দূষিত বায়ু নেই।বারান্দায় দাঁড়িয়ে সবটা আনমনে দেখে সোনালী।সে মনে মনে একটা সিদ্ধান্ত নেয়।শেষ বয়সে সে গ্রামে থাকবে।কোনো অজপাড়া এক গায়ে।যেখানে যানবাহনের শব্দে কান ঝালাপালা হবে না,দূষিত বায়ুর কারণে শ্বাসকষ্ট হবে না,ফরমালিনের খাবার খেয়ে পেট খারাপ হবে না।রিটায়ার্ড করার পরেই গ্রামে চলে আসবে।দো-চালা ঘর করবে একটা।ছোট্ট ঘরের সামনে একফালি উঠোন থাকবে।উঠোনে বুনবে লাল শাকের চারা,লাউশাক,কুমড়ো শাকের চারা।এককোনে একটা বাতাবি লেবুর গাছও থাকবে। ছোট একটা পুকুর করবে সোনালী।সেখানে শুধু তেলাপিয়া মাছ ছাড়বে।যখনই মাছ খেতে ইচ্ছে করবে,তখনই পুকুরের শেষ ঘাটে পিড়ি পেতে বসে বড়শি ফেলবে। সাধ মিটিয়ে পছন্দের মাছ ধরে ছোট লালশাক দিয়ে রাঁধবে। মাটিতে লেপ্টে বসে সস্তা স্টিলের প্লেটে গরম তরকারি দিয়ে গরম ভাত খাবে। আহ! ভাবতেই জ্বিভে পানি চলে আসে সোনালীর।হাত ঘড়ির দিকে একবার নজর বুলায় সে।বিকাল চারটা বাজে।আজকে তারা ডাহুক নদীর তীরে ঘুরতে যাবে। এই নদীর পাড়ে নাকি শুটিং হবে।শুটিংয়ের কথা মনে করে হাসে সোনালী।শুটিং নয়,দুধ-ভাতের লোভ দেখিয়ে এ পর্যন্ত তাদেরকে টেনে আনা হয়েছে।
সোনালী ঘরের দিকে পা বাড়ায়।ওর তৈরি হতে দু-মিনিট সময় লাগেনি।অথচ সবার কতো সময় লাগছে। কতো কিছু মাখছে এরা মুখে? বিয়ে বাড়িতে দাওয়াত খেতে যাবে নাকি?আশ্চর্য! বিরক্তিতে কপাল কুঁচকে আসে সোনালীর।তথাকে একপ্রস্থ কথা শোনাতে ঘরের দিকে যায়।

কুচকুচে কালো রঙের একটা শাড়ি গায়ে জড়িয়েছে তথা।সুতির শাড়িতে সোনালী রঙের আঁচল। নিচু করে একটা খোপা করে নেয় সে।চোখে মোটা করে কাজলের রেখা আঁকে।আসার পথে ব্যাগে করে দুই ডজন রেশমি চুড়ি এনেছিল।কালো রঙের ছয়টা চুড়ি হাতে গলায় তথা।সামনের চুলগুলো খানিক অগোছালো হয়েছিল।সেগুলোতে আরেকবার চিরুনি চালিয়ে আয়নায় নিজেকে দেখে। সব ঠিক আছে।শুধু খোপায় একটা টকটকে লাল রঙের কৃষ্ণচূড়া গুজতে পারলে ষোলকলা পূর্ণ হতো।নিচে নেমে একটা ফুল কুড়িয়ে খোপায় গোজার সিদ্ধান্ত নেয় সে।আয়নার দিকে চেয়ে সন্তুষ্টির হাসি হাসে তথা। দারুন লাগছে দেখতে।নদীর তীরে ঘুরতে যাওয়ার ক্ষেত্রে সাজটা একটু বেশিই হয়ে গেছে।কিন্তু,তাতে কি?তথা খুব সাজতে ভালোবাসে।মেয়েরা না সাজলে সাজবে কারা?এই কাজল,শাড়ি কারা ব্যবহার করবে?এসব তো মেয়েদের জন্য।

_” তথাপু করেছো কি তুমি?তোমায় যা লাগছে না।ইশ! ছেলে হলাম না কেন?আমি ছেলে হলে এক্ষুনি কাজি অফিসে নিয়ে জোর করে বিয়ে করতাম তোমায়।”

_” খুব বেশি সুন্দর লাগছে নাকি?”

_” তা আবার বলতে।তোমায় ঠিক রাতের আকাশের এক টুকরো চাঁদের মতো লাগছে।উজ্জ্বল সুন্দর চাঁদ।আসো আসো একটু থু থু ছিটিয়ে দেই।তাহলে কারো নজর লাগবে না।”

চওড়া হাসি দেয় তথা।প্রশংসায় কে না খুশি হয়?

_” আর চাপাবাজি করতে হবে না।চলো নিচে যাই।সবাই বোধহয় তৈরি হয়ে নিচে অপেক্ষা করছে।”

_” হাহ! সত্যি কথার ভাত নাই আজকাল।আমি মোটেও চাপা মারছি না।”

_” আচ্ছা মানলাম।এখন নিচে যাই চল।”

নিচে শুধু শাফিন, খোকন ও দুটো মেয়েকে চোখে পড়লো সোনালীর।মেয়ে দুটোকে চিনে না সে।দুজনের মাঝে একজন তথার দিকে একবার চাইলো মাত্র।তারপর আবার ফোনে ডুব দিলো।কিন্তু আরেকটা মেয়ে এগিয়ে এলো তথার দিকে।মিষ্টি হেসে বললঃ” আপনাকে খুব সুন্দর লাগছে,আপু।”

_” ধন্যবাদ।”– মৃদু হেসে উত্তর দেয় তথা।

_” আপনার নামটা কি জানতে পারি?”

_” আমি তথা।তুমি?”

_” মালিহা খানম।আপনিই কি নায়িকা?”

_” না।আমি সহকারী চরিত্র।তুমি কোন চরিত্রে আছো?”

_” কাজের মেয়ে”—মন খারাপ করে মাথা নিচু করে ফেলে মেয়েটা।বরাদ্দ চরিত্র নিয়ে সে মোটেও খুশি নয়।

_” মন খারাপ করো না আপু। তুমি তো তাও পুরো নাটকে ঝাড়া-মোছা করবে।আর আমি কি করব, জানো? বোবার মতো মাঝে মাঝে নায়কের পাশে দাঁড়িয়ে থাকব।আমি নায়কের বোবা ভাগনীর চরিত্রে আছি। সারা নাটকে আমার কোকিল কন্ঠ শুনবে না কেউ।দর্শকদেরকে আমার সমধুর কন্ঠ শোনার সুযোগ থেকে বঞ্চিত করছে এরা।হুহ!”

সোনালীর কথায় হেসে উঠে তথা।তা দেখে গর্জে উঠে সোনালী।

_” খবরদার তথা আপু,হাসবে না।নিজে ভালো চরিত্র পেয়েছ বলে আমার দূর্ভাগ্যে হাসতে হবে কেন?”

তথা নাটকীয় ভঙ্গিতে ঠোঁটের উপর আঙুল রাখে।ইশারায় বলেঃ” আচ্ছা,আর কথা বলব না।”

_” আচ্ছা মালিহা আপু,আপনি এখানে চান্স পেয়েছেন কিভাবে?মানে কার মাধ্যমে এ পর্যন্ত এসেছেন?”

_” আমি আমার………

ওদের কথার মাঝে আর দাঁড়ায় না তথা।সোনালী ভীষণ কৌতূহলী।মেয়েটা সেকেন্ডের মাঝে ভাব জমাতেও পারে।কোনো জড়তা কাজ করে না ওর মাঝে।তথা কৃষ্ণচূড়া গাছের কাছে যায়।নিচে অনেক ফুল পড়ে আছে।বেশিরভাগ নেতানো।খোপায় দেওয়ার মতো উপযুক্ত ফুল খুঁজে পায় না তথা।

_” আপনি কি কিছু খুঁজছেন,মিস তথা?”

শাফিনের কন্ঠে পাশ ফিরে তাকায় তথা।সে এতোক্ষণ অশ্বত্থ গাছের নিচে বেঞ্চিতে বসা ছিল।

_” হ্যাঁ, আমি একটা সুন্দর ফুল খুঁজছি।”

_” আমি কি সাহায্য করতে পারি?”

প্রশ্ন করলেও উত্তরের অপেক্ষা করে না শাফিন।গাছ থেকে সুন্দর একটা ফুল পেড়ে দেয়।তথার হাতে দিয়ে বলেঃ” এটা খোপায় দিলে আরো বেশি সুন্দর লাগবে আপনাকে।”

অপ্রস্তুত হাসি হাসে তথা।শাফিনকে সে দেখতে পারে না।তাই কথা বলতে একটু জড়তা কাজ করে ভিতরে।তবে শীঘ্রই তা কাটিয়ে উঠে তথা।হুটহাট অকারণে কাউকে এড়িয়ে যাওয়া যায় না।

_” মিস তথা,আপনাকে কিছু বলার ছিল।”

_” জ্বি,বলুন।”

_” আসলে প্রথম দেখার কথা আমি এখনো ভুলতে পারিনি।হয়তো আপনিও পারেননি।সেদিন একটু বেশিই বাজে ইঙ্গিত করেছিলাম। ক্ষমা করবেন প্লিজ।আমি আমার আচরণের জন্য লজ্জিত।আমার এরকম করা মোটেও ঠিক হয়নি।আমার ঘরেও মা-বোন আছে।তারাও এরকম আচরণের স্বীকার হতে পারতো।আমার নিশ্চয়ই তখন ভালো লাগতো না।আমি খুবই লজ্জিত।”

_” আপনি যে বুঝতে পেরেছেন এটাই অনেক।যান ক্ষমা করে দিলাম আপনাকে।”

_” সত্যি?”

_” হ্যাঁ, সত্যি।”

তথার কথার বিপরীতে চওড়া হাসি দেয় শাফিন।আশেপাশে একনজর দেখে নিচু স্বরে বলেঃ” বাঁচালেন।সুন্দরী মেয়েরা রাগ করে থাকলে আমার মোটেও ভালো লাগে না।নিজেকে নরাধম মনে হয়।”

_” তাই নাকি?”

_” হ্যাঁ। আরে সেদিন আমার মেজাজ খুব খারাপ ছিল।গার্লফ্রেন্ডের সাথে একচোট ঝগড়া করে ডিরেক্টরের অফিসে গিয়েছিলাম। তাই না চাইতেও খারাপ আচরণ করে ফেলেছি।বুঝতেই পারছেন আমার দোষ ছিল না সেদিন।সব দোষ আমার দজ্জাল প্রেমিকার।”

তথা শাফিনের দিকে তাকিয়ে মুখ বাকায়।

_” আপনারা ছেলেরা শুধু মেয়েদের উপর দোষ চাপাতে পারলেই বেঁচে যান।খারাপ ব্যবহার করলেন আপনি আর দোষ হলো ওই বেচারির?”

_” হ্যাঁ জানি জানি।আপনি মেয়ে তাই আরেকটা মেয়ের কোল টানবেন।তারচেয়ে চলুন পুকুরের দিক থেকে একটু ঘুরে আসি।ওদিকের পরিবেশটা আমার খুব ভালো লাগে।”

_” চলুন।ওদিকটা আমারো খুব পছন্দ। ”

শাফিনের সাথে হাঁটা ধরে তথা।বিকেলের নরম আলো গায়ে মাখতে চায় সে।আজকে খুব ভালো লাগছে তথার।তবে তথা ও শাফিনের একসাথে পথ চলার দৃশ্য ভালো লাগলো না ইউসুফের।সে দাঁড়িয়ে ছিল বাড়ির দরজার সামনে।সানগ্লাসের ঢেকে আছে তার রক্তচক্ষু। তাই,কুঁচকানো কপালের নিচে একজোড়া চোখ তথা ও শাফিনের দিকে অগ্নিদৃষ্টিতে চেয়ে ছিল তা কেউ বুঝতে পারলো না।

***

_ ” ছোট্ট মেয়ে,এটাই সেই প্রাচীন ডাহুক নদী।এটা বাংলাদেশ -ভারতের আন্তঃসীমান্ত নদী।এই নদীতে সারাবছর পানি থাকে।এখানে বর্ষায় বন্যা হয় না আবার নদীর পাড় ভাঙেও না।এর দৈর্ঘ্য…..

_” ধুর ব্যাঙ।আপনাকে একটা ছবি তুলে দিতে বলেছি।এতো লেকচার কে শুনতে চেয়েছে?”

_” আমার কাছে ছবি তুলতে হলে লেকচার শুনতেই হবে।”

_” দিন আমার মোবাইল দিন।আপনার ছবি তোলা লাগবে না।”

মুখ ঝামটা দিয়ে মামুনের হাত থেকে নিজের মোবাইল কেড়ে নেয় সোনালী।অন্যদিকে চলে যায়।মামুন সেদিকে অপলক চেয়ে থাকে।মেয়েটার কাছ থেকে পালিয়ে থাকতে চায় সে।কিন্তু সোনালী যেন পিছুই ছাড়ছে না।এই যে এদিকে পা দেওয়ার সাথে সাথেই মামুনের দিকে ছুটে এসে তার হাতে মোবাইল ধরিয়ে দিল।মিষ্টি হেসে বললঃ” একটা ছবি তুলে দিন তো।আমি ডানপাশে হেলে দাঁড়াব,আপনি বামপাশ থেকে ছবি তুলবেন।ঠিকাছে?”

হাহ! মেয়েটা কি বুঝতে পারছে না মামুন তাকে এড়িয়ে যেতে চাইছে।যেচে কোনো ভয়ংকরীর ফাঁদে পা দিতে চায় না মামুন।

_” হ্যালো তথা,কই আছোস মা?”

_” নদীর পাড়ে ঘুরতে এসেছি কাকি।জানো জায়গাটা খুব সুন্দর।”

_” এইসব বাদ দে।তুই এক্ষনি ঢাকা চইলা আয়।এক্ষন মানে এক্ষন।”

তথা অবাক হয়ে যায়।এটা আবার কি কথা!

_” কাকি,কাজ শেষ না হওয়া অবধি বাড়ি ফিরতে পারব না আমি।”

_” আমার ভালো লাগতাছে না মা।আয়া পড় না।”

_” তুমি বুঝতে চাইছো না কেন কাকি,আমি ওদের সাথে চুক্তিবদ্ধ। টাকা নিয়েছি আমি।কাজ তো করতেই হবে।”—খানিক বিরক্ত হয় তথা।এক কথা কতবার বলতে ভালো লাগে।

_” আসবি না তুই?”

_” কাজ শেষে আসব।”

_” আসা লাগব না তোর।আল্লাহ তোরে আমার সংসারে আর ফিরায়া না আনুক।আমার কথা না শুনলে আমার সংসারেও আর ঢুকবি না।”

খট করে লাইন কেটে দেন আকলিমা খাতুন।তথা স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।কাকি কি সুন্দর করে সম্পর্কের মাঝে সীমারেখা টেনে দিল! চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল, তথা ওই সংসারে কেবল বহিরাগত।অনেকদিন পরে নিজের মনেই প্রশ্ন করে তথা।আচ্ছা, আপন মা হলে এমন কথা বলতে পারতো?সৃষ্টিকর্তার কাছে নিজের মেয়েকে নিয়ে এমন দোয়া করতে পারতো?কে জানে! তথা তো আর মা দেখেনি।

নদীর তীরের শীতল বাতাসে তথার প্রাণ জুড়িয়ে যায়।জলজ বাতাস ছুঁয়ে দেয় তথার ঘাড়,গলা, মুখ,ঠোঁট, নাক,সবকিছু।তথার মনটা ভালো নেই।নদীর পাড়ে একা দাঁড়িয়ে থাকে সে।আশেপাশে সবাই ছবি তুলছে,কথা বলছে, আনন্দ করছে।তথার চোখ বেয়ে একফোটা পানি গড়িয়ে পড়ে।অতি সন্তর্পণে তা মুছে নেয় সে।

_” মিস তথা,এদিকে দাঁড়িয়ে আছেন কেন?ওদিকে চলুন।সবাই কত আনন্দ করছে আর আপনি….

_” আমার ভালো লাগছে না শাফিন।আমি এখানেই ঠিক আছি।”

তথার ভারী কন্ঠ কানে বাজে শাফিনের।সে খানিকক্ষণ চিন্তা করে তথার সামনে যেয়ে দাঁড়ায়।মেয়েটার চোখ-মুখ পরখ করে বলেঃ” আপনি কাঁদছেন, তথা।”

_” মোটেও না”—পুরোপুরি অস্বীকার করে তথা।

_” মিথ্যা বলবেন না প্লিজ।আপনি চাইলে আপনার সমস্যাগুলো আমার সাথে শেয়ার করতে পারেন।”

বলবে না চিন্তা করেও বলেই ফেলে তথা।সে কথা চেপে রাখতে পারে না।শাফিনের দিকে একবার নজর বুলিয়ে বলেঃ” আমার পরিবার চাইছে না আমি এখানে থাকি।আমার কাকি একটু আগেও ফোন করে ঢাকা চলে যেতে বলল। খুব জোর করছে কাকি।আমি বুঝতে পারছি না কি করব।”

শাফিন সোজা হয়ে দাঁড়ায়।মুহূর্তেই তার চোখ-মুখ শক্ত হয়ে যায়। সে গলা শক্ত করে বলেঃ” আপনার কাকি ভুল কিছু বলছে না।ঢাকায় চলে যাওয়া উচিত আপনার।আমিও বলছি চলে যান।পারলে আজকেই ঢাকা চলে যান।সেখানেই আপনি নিরাপদ থাকবেন,এখানে নয়।”

চলবে….