#তবু_সুর_ফিরে_আসে
৩২ পর্ব
এই ঘরের দেয়ালে কোন ঘড়ি দেখতে পাচ্ছে না হেরা । মোবাইল টা কোথায় সেটাও খেয়াল নেই। বুঝতে পারছে না কয়টা বাজে। নওশাদ যথারীতি সকাল সকাল উঠে গেছে। সে কখনো মানুষটার আগে উঠতেই পারে না! পাশ ফিরতেই ওর মাথার কাছে একটা চিরকুট রাখা দেখলো । নওশাদ রেখেছে। হাতে চিরকুট টা নিয়ে গত রাতটার কথা চিন্তা করছে হেরা । যা হলো এর পর ওর খুব লজ্জা লাগছে , কিভাবে যাবে সে নওশাদের সামনে !
চিরকুট টা পড়া শুরু করলো হেরা,
” হেরা , তোমাকে কিভাবে ধন্যবাদ দিব বলোতো ? পাথর চাপা বিবর্ণ ঘাসের মতো আমার জীবনটাকে আর দীর্ঘ শ্বাসে মাখা আমার রাত গুলোকে হঠাৎ উৎসবের রাতে পরিনত করে দিলে তুমি। তার জন্য আমি কৃতজ্ঞ । জানি না তোমার মনে, তোমার সবকিছুতে কতটুকু পরিপূর্ণতা আনতে পেরেছি ? তুমি শুধু নাদিয়া আর মিলা কে বলে দিও তাদের ভাইয়া বিড়াল সহ আত্মসমর্পণ করেছে । নিরীহ প্রাণী টিকে মারার কি দরকার বলো ?
তোমার নওশাদ ”
হেরা বিড়ালের কাহিনী আজকেও বুঝলো না শুধু এইটুকু বুঝলো কালকে রাতের ঘটনার সঙ্গে এর একটা সংশ্লিষ্টতা আছে হয়তো। তার ভালো লাগছে শেষে নওশাদ লিখেছে ‘তোমার নওশাদ’ এই দুই টা শব্দ ওর বুকের আবেগে আগুন ঢেলে দিল। চিরকুট টা হাতে নিয়ে সে একটা ভালো লাগায় অস্থির হচ্ছে ।
টালির ছাদ বলেই সে বুঝতে পারছে না বাহিরে বৃষ্টি হচ্ছে নাকি ? জানালায় ভারি পর্দা ঝুলানো আলোও আসছে না ।
হেরা কম্বলের নিচে শুয়ে আবার চিরকুট টা পড়ছে।
হঠাৎ খুট করে দরজায় শব্দ হতেই সে চোখ বন্ধ করে মাথা ঢেকে ফেলল কম্বলের নিচে।
নওশাদ খুব সাবধানে রুমে এসে ঢুকলো। তারপর বিছানার কাছে এসে দাঁড়ালো । দুই চার সেকেন্ড দাঁড়িয়ে কেবিনেটের কাছে কিছু একটা করলো। আবার এসে দাঁড়ালো হেরার কাছে !
তারপর বলল,আমি কি আসব কম্বলের নিচে ? অভিনয় করে লাভ নেই আমি জানি কাঠবিড়ালী লজ্জায় লুকিয়ে আছে !
হেরা কঠিন ভাবে নিজের হাসি নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করছে কম্বলের তলায় লুকিয়ে। নওশাদ কম্বলের একটা অংশ তুলে কম্বলের ভেতরে ঢুকে নিজের মাথা ঢেকে ফেলল। কি ব্যাপার ?
হেরা কম্বল মাথার উপর থেকে সরালো । কিভাবে বুঝলেন আমি জেগে আছি ?
যার ক্লাস্টোফোবিয়া আছে সে কখনো কম্বলের নিচে মাথা ঢেকে ঘুমাবে না ম্যাডাম ।
লজ্জা পাচ্ছিলে কেন ?
জানি না।
নওশাদ হেরাকে নিজের দিকে টেনে নিলো । অবশ্য তোমার লজ্জা মাখা মুখটা দেখতে খুব ভালো লাগে।
কখন উঠেছেন আপনি ?
অনেক সকালে । উঠে অনেকক্ষণ তোমার পাশেই শুয়ে ছিলাম । তুমি বেহুঁশ হয়ে ঘুমাচ্ছিলে ।
আমি টের পাইনি ।
হুম আপনি অনেক কিছু টের পাননি ম্যাডাম !
কি হয়েছে?
আমি আপনার ঠোঁটের নিচের তিলে কত গুলো চুমু খেয়েছি টের পাননি । বলেই নওশাদ আবার হেরার ঠোঁটের নিচে চুমু খেলো ।
আপনি নিশ্চয়ই ব্রেকফাস্ট করেননি, আমি ফ্রেশ হয়ে আসি বলে হেরা উঠতে নিলো।
নওশাদ জড়িয়ে ধরে আটকে রাখলো।তোমাকে এত্তো গুলো চুমু খেয়েই ব্রেকফাস্ট করলাম সকালে । তুমি তোমার ব্রেকফাস্ট টা করে নিতে পারো হেরা , নওশাদ ঠোঁট উঁচু করে দিল ।
তাই বুঝি? হেরা হি হি করে হাসছে !
আমি কিন্তু অনেক দুষ্টুমি করবো হেরা গত তিন মাসের বকেয়া সব উসুল করবো একটা একটা করে !
আমি পালাচ্ছি এখন !
কোথায় পালাবে কাঠবিড়ালী, পালাতে দিলে তো তোমাকে ! নওশাদ হেরা কে দুই হাতে জাপটে ধরে ফেলল।
ডীপ গ্রীন আর মেরুন পাড়ের একটা সফট সিল্ক ইক্কত শাড়ি পড়ে হেরা আয়নার সামনে ভেজা চুল গুলো যখন চিরুনি করছে নওশাদ পিছনে এসে দাঁড়ালো।
বাহিরে কি বৃষ্টি হচ্ছে?
হুম ঐতিহাসিক সিলেটের বৃষ্টি , নওশাদ বলল।
তাহলে ?
তাহলে আর কি , টাপুর টুপুর বৃষ্টি নূপুর/জলছবিই গাঁয়ে/তুই যে আমার একলা আকাশ/মেঠো সুরের ছায়। রঙ বেরঙের বেলোয়ারি/ সাত রঙ্গা রং মুখ/ তোর মুখেতেই লুকিয়ে আছে/ জীবন ভরের সুখ । রে জীবন ভরের সুখ/ যখন শিমুল পলাশ ঝড়বে পথে/ দুলবে হাওয়া বুকে । থাকব দুজন দুজনাতে শপথ নিয়ে সুখে/ গাইবো তোরই দৃষ্টি পানে এক সুরেরই গান।
অদ্ভুত সুন্দর গানটা তো ! কার গান?
আমি যখন গাইছি আমার গান । জানি না কার ?
তাহলে বৃষ্টির জন্য ঐ নদীর কাছে যাওয়া যাবে না এখন কি করব তাহলে আমরা?
থাকব দুজন দুজনাতে হেরা ! নওশাদ হেরার কপালে একটা সবুজ রঙের টিপ পড়িয়ে দিল।
বৃষ্টি থামলে তারপর যাব আমরা। নৌকা ঠিক করা আছে শুধু বৃষ্টি থামার অপেক্ষা।
বারান্দায় এসে হেরা অবাক হয়ে গেল। বারান্দার একটা কর্নারে ইজেলের উপর ক্যানভাস পাশে রং, ব্রাশ সব রাখা।
হেরা চিৎকার দিয়ে উঠলো, আপনি ছবি আঁকবেন ? দারুন ! এসব কিছু সঙ্গে নিয়ে এসেছেন?
হুম। ভাবলাম তোমাকে সামনে বসিয়ে আঁকার চেষ্টা করি কিছু একটা।
প্লিজ প্লিজ শুরু করেন। হেরা খুব এক্সাইটেড।
এক কাজ করো তুমি শুরু করে দাও আমাকে ! এখান থেকে যেকোন একটা রঙ দিয়ে আঁকিবুঁকি করে দাও আমি তারপর হাতে নিব।
হেরা লাল রঙ দিয়ে ক্যানভাসে একটা দাগ দিয়ে দিলো।
তারপর নওশাদ ব্রাশ ঘষার কাজ শুরু করলো।
হেরা দুই মিনিট পাশে দাঁড়িয়ে বলে উঠলো , ছবি কোথায় ফুটে উঠেছে না তো কিছুই?
বোকা মেয়ে এত তাড়াতাড়ি হবে নাকি অনেক সময় লাগবে। আর অনেক দিন আঁকি না, কি হবে আই এম নট শিওর।
এখন তো আপনি ফ্রি আছেন সারাক্ষণ চেষ্টা করতে থাকেন দেখবেন পারবেন।
তাই না আমি এখানে ছবি আঁকার জন্য এসেছি শুধু, আমার আর কোন কাজ নেই ? নওশাদ বলল।
এখানে কি কাজ আপনার ? আপনি না বললেন অফিসের কোন কাজ করবেন না!
নওশাদ ঝাট করে হেরাকে টান দিয়ে বুকের কাছে নিয়ে এলো , দেখাবো কি কাজ আমার ? তারপর হেরার নাকে নাক ঘষে দিলো ।
আচ্ছা ঠিক আছে আপনি শুরু তো করবেন তারপর ছবি যতটুকু ই হয় ঢাকায় নিয়ে বাকিটা করবেন।
সুমনা সেদিন রঙ গুলো দিলো বলেই সঙ্গে নিয়ে এলাম । তা না হলে ভুলেই গিয়েছিলাম ছবি এঁকেছি কোন এক সময়।
হেরা নওশাদের কাছ ঘেঁষে দাঁড়ালো আপনার এত গুণ আমি যত দেখি মুগ্ধ হয়ে যাই। সেজন্যই নাদিয়া ভাবি আর মিলা ভাবি বলে আপনি অলরাউন্ডার। আমার ও মনে হয় আপনার মত মানুষ খুব কম হয় । সবচেয়ে বড় গুণ হলো আপনি খুব ভালো একজন মানুষ। আমি আপনাকে দেখি আর মুগ্ধতায় বিভোর হয়ে থাকি। জানেন কালকে যখন আপনি ঘুমিয়ে গেলেন আমি অনেক রাত পর্যন্ত জেগে রইলাম মুগ্ধ হয়ে আপনাকে দেখেছি শুধু । এরকম একটা মানুষের এত ভালোবাসা পাওয়ার ও যোগ্যতা কি আমার আছে ! আমার ভাগ্যে এই ভালো মানুষটা কে রেখেছেন আল্লাহ সে জন্যই কি আমার জীবনের শুরু টা খুব কষ্টে কেটেছে ? আল্লাহ পরীক্ষা করেছেন ? রাতভর তাই ভেবেছি।
সেরকম কিছু না হেরা আমি চেষ্টা করি আমার প্রিয়জনদের ভালো রাখতে, ভালোবাসতে। তারপর হাসতে হাসতে বলল, আমি খুব বাধ্যগত, গৃহপালিত স্বামী বউ এর কাছে পরাধীন থাকতেই ভালোবাসি কারণ আমি জানি ঘটনা যাই হোক সরি আমাকেই বলতে হবে মাঝখান থেকে ক্যাজুয়েল্টি বাড়ে সম্পর্কে র ভেতরে।
হেরা হেসে দিল। আমাদের মাঝে সেরকম কিছু নিশ্চয়ই হবে না ।
হবে না হেরা , তুমি তো আমার অবুঝ বালিকা বধূ যে শুধু মুগ্ধতা নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে। যতদিন মুগ্ধতা থাকবে তুমি আমাকে শাসন করবে না।
তাহলে সারাজীবন শাসন করা হবে না। আপনার প্রতি আমার মুগ্ধতা কমবে না কখনো ।
ওদের কথার মাঝখানে ঝলমলে রোদ দেখা গেল আকাশে।
নওশাদ , হেরা কে নিয়ে নৌকায় উঠার জন্য বের হলো। পুরো দুপুর নৌকায় করে ওরা ভোলাগঞ্জ ঘুরলো।পরিচিত বিজিবির অফিসারের কল্যাণে জিরো পয়েন্ট পর্যন্ত ঘুরে এলো। পাহাড় দেখে মুগ্ধ হেরা। পাথরের নদীতে নীল জল দেখে বারবার চাইছিল সে পানিতে পা ভিজাতে । নওশাদ আটকে রাখলো ওকে । তোমার এজমার কথা ভুলে যাচ্ছো হেরা ?
প্লিজ একটু নামি ।
না আমার কথা শুনো। ঠিক আছে পাথরের উপর বসে থাকি কিন্তু পানিতে নামবে না।
কটেজে এসে লাঞ্চ করে দুটো হ্যামক ঝুলানো ছিলো গাছের সঙ্গে দুইটাতে শুয়ে দুজনে দোল খেতে খেতে গল্প করলো হাত ধরাধরি করে।
হেরা একটা কথা বলব ?
আমি শুনছি বলুন ।
থ্যাংকস আমার জীবনে এতো আলো নিয়ে আসার জন্য। এত ছন্দ নিয়ে আসার জন্য। হেরা দশ বছরের একটা ছেলেকে নিয়ে হুট করে এক সন্ধ্যায় একা হয়ে গেলাম। যে মানুষ টার উপর নির্ভর করে ছিলাম পনের বছর বিবাহিত জীবনে তার আগে আরো প্রায় সাত বছর হঠাৎ একদিন সে কোন কথা বার্তা নেই চলে গেল । আমি ব্যাপার টা বুঝে উঠতে ই কয়েক মাস সময় লাগলো। আমি গীতির জন্য যতটা পাগল ও বেঁচে থাকতে ছিলাম তারচেয়েও বেশি পাগল গীতি মারা যাওয়ার পর হয়ে গেলাম। রাতে শোয়ার সময় ভাবতাম গীতি পাশে শুয়ে আছে। কথা বলতাম ওর সঙ্গে। আমি সব সময় গীতিকে আশেপাশে ফীল করতাম কিন্তু বেশ অনেক দিন আমি গীতিকে সেভাবে ফীল করে পাই না। আমি আমার পাশে তোমার অস্তিত্ব টাকে চাওয়া শুরু করলাম। শারীরিক ব্যাপার টা যে ছিল না অস্বীকার করব না তারচেয়ে ও বেশি মানসিক ভাবে আমি তোমার প্রতি অনুভব করা শুরু করলাম। তোমাকে ভালোবাসা শুরু করলাম।
কথা বলতে বলতে ওরা দুজন নিজের ঘরে এসে ঢুকলো।
তোমার কাছে থাকতে , তোমাকে দেখতে তোমার সঙ্গ টা উপভোগ করতে ভালো লাগা শুরু হলো হেরা।
হেরা এই জায়গাটা আমি গীতির জন্য কিনেছিলাম ভেবেছিলাম ওকে দিয়ে চমকে দিব। কিন্তু কিছু করার আগেই গীতি চলে যায়। তোমাকে নিয়ে আমি এখানে আসার প্রধান কারণ এখানে গীতি কখনো আসেনি । আমার আর তোমার কাছাকাছি আসার জন্য এই জায়গাটা সে জন্যই বেছে নিয়েছি। আমি তোমাকে পুরোপুরি পেতে চেয়েছি এমন কোথাও যেখানে আমার আর গীতির কোন সৃত্মি নেই । আমি চাইনি গীতির কিছু আমার সামনে চলে আসুক। হেরা এই প্রোপার্টি টা আমি তোমার নামে যদি করি তুমি কি কষ্ট পাবে ?
আমার নামে করে দিতে হবে কেন ? আপনার নামে থাকলে কি সেটা আমার হবে না ?
আমি চাই তোমার আমার জীবনের বিশেষ এই জায়গাটা তোমাকে উপহার দিতে ।
মুখে বলেছেন এতেই হবে আমি পেলাম উপহার ধন্যবাদ।
কাগজে কলমে হলে সমস্যা কিসের হেরা? আমি আমার স্ত্রীকে ভালোবেসে উপহার দিতেই পারি !
আমার কাছে উপহারের চেয়ে ভালোবাসা টাই বড় প্রাপ্তি।
উপহার ও ভালোবাসার চিহ্ন বুঝলে ।
হেরা নওশাদের দিকে তাকিয়ে হাসলো শুধু।
ডিনারের পর দুজন কফি নিয়ে কটেজের সামনে এসে বসলো। নওশাদ হেরার কে বলল, তুমি কিন্তু মনোযোগ দিয়ে পড়াশোনা টা করবে। আমি চাই তুমি খুব ভালো ভাবে পড়াশোনা টা শেষ করবে। নিশালের পড়াশোনা শেষ হলে নিশাল আর তুমি আমার বিজনেস সামলাবে আমি রিটায়ার্ড করব ।
কি বলেন এসব আপনি ! আমি আপনার বিজনেস দেখব আমি দশটা মানুষের সামনে গেলেই নার্ভাস হয়ে যাই আমি করব বিজনেস !
তোমাকে আমি সেভাবেই তৈরি করে তুলব !
কিন্তু আমি যে আপনার আর আমার সংসার টা সামলাতে চাই ।
তোমাকে নিশ্চয়ই বাজার করা রান্না করে সংসার সামলাতে হবে না ?বাচ্চাও সামলাতে হচ্ছে না । কথাটা বলেই নওশাদ তাকালো হেরার দিকে । হেরার মুখটা কি একটু গম্ভীর হয়ে গেল কথাটা শুনে। নওশাদ চুপ করে রইলো । তারপর দুই জন বেশ অনেক্ষণ চুপচাপ বসে রইল।
ওরা ঘরে গিয়ে ঢুকতেই নিশালের ফোন এলো !
হ্যালো পাপা ।
নিশাল কি খবর তোমার বাবা পরীক্ষা কেমন হচ্ছে ? হেরা কাছে এসে দাঁড়ালো । নওশাদ ফোনটা স্পিকার মুডে দিল।
আমার খবর ভালো পরীক্ষা ও ভালো হচ্ছে । মামনি কোথায় ?
এই যে আমি, কেমন আছো তুমি ? হেরা বলল।
মামনি কি করো ?
কিছু না তোমার পাপার সঙ্গে গল্প করছি।
নিশাল তোমার মামনির সঙ্গে ছুটি কাটাতে সিলেটে এসেছি ।
গ্রেট পাপা মামনি কে খুব ভালো করে সব ঘুরিয়ে দেখাবে ।
নিশাল তোমার পাপা আমাকে নদীতে নামতে চেয়েছিলাম দেয়নি , তুমি থাকলে ভালো হতো তোমার সঙ্গে পানিতে নামতাম।
পাপা ঠিক কাজ করেছে এসব নদীতে সাপ থাকে মামনি ।
কি ? চিৎকার দিয়ে উঠলো হেরা । তোমার পাপা তো সেই কথা বলেনি । আমি সাপ খুব ভয় পাই।
নিশাল হাসছে । মনে রেখো তুমি মামনি । নওশাদ ছেলের বুদ্ধি দেখে মুচকি মুচকি হাসছে। হেরা কে এক কথায় শান্ত করে দিলো।
নিশাল পাপার চেয়ে বেশি তার মামনির সঙ্গে কথা বলল।
ফোন রাখার পর নওশাদ বলল, ছেলে তো দেখি আমার চেয়ে বেশি তার মামনির সঙ্গে কথা বলে।
হুম নিশাল আমার ফ্রেন্ড হয়ে গেছে বুঝলেন। হেরা নওশাদের দিকে হেসে বলল।
ভালো।
আমার ছেলেটা কত তাড়াতাড়ি বড় হয়ে গেছে ! বড় সে মা মারা যাওয়ার পরই হয়ে গিয়েছিল। নিজে হাতে খেতে পারতো না গীতি আর আনারের মা খাইয়ে দিতো । গীতি যাওয়ার পর আনারের মায়ের কাছেও খাবে না একাই খেতো।
বলেছে আনারের মা আমাকে। নিশালকে খুব ভালোবাসে ও ।
হুম ও ই তো বড় করেছে । ওর কাছে রেখে গীতিকে নিয়ে দেশের বাহিরে চলে গেছি । আনারের মায়ের কাছে থাকলে নিশ্চিন্তে থাকতাম আমরা।
হেরা একটা কথা বলব? নওশাদ হেরা কে বুকের কাছে টেনে নিলো।
বুবু যাওয়ার সময় আমাকে কিছু কথা বলেছে তোমাকেও কি কিছু বলেছে ?
কোন ব্যাপারে ?
নওশাদ কিছুক্ষণ চুপচাপ হয়ে রইলো কিভাবে বলবে কথাটা ভেবে পাচ্ছে না।
হেরা বুবু নিশালের আরো ভাই বোন হোক তাই চায় !
হেরা চুপ করে শুনছে ।
তোমাকে কিছু বলেছে , আমার ধারণা তোমাকেও বুবু বলেছে এই কথা ।
হুম।
কি বলেছো তুমি ?
আমি কি বলব ?
তোমার কি ইচ্ছে?
আপনার ইচ্ছে ই আমার ইচ্ছে । আমি বুবুকেও এই কথা বলেছি।
হেরা তোমাকে পড়াশোনা শেষ করতে হবে, বাচ্চা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে থাকো আমি সেটা চাই না।
আমাদের তো অবশ্য একটা ছেলে আছেই এটাই যথেষ্ট । কি বলেন ?
নওশাদ হেরা কে জড়িয়ে ধরলো , ওর মনে হচ্ছে হেরা কি মন খারাপ করলো ওর কথায় । কষ্ট পেলো না তো !
হেরা প্রসঙ্গ পরিবর্তন করে অন্য গল্প শুরু করলো।
ওরা পুরো সাত দিন সিলেটে কাটালো। হেরার স্বপ্নের মতোই কাটলো দিন গুলো। নওশাদ ওকে ভালোবাসা দিয়ে , আদরে ভরিয়ে রাখলো।
মানুষটা যে এত রোমান্টিক সে সিলেট না গেলে জানতেই পারতো না । গিটার বাজিয়ে গান শুনিয়েছে , ওর ছবি এঁকেছে । চা বাগানে দুজন ঘুরে বেড়িয়েছে। বাগানের মালিক নওশাদের বন্ধু ওরা সারাদিন বাগানে ঘুরলো, কিভাবে চা পাতা তৈরি হয় ম্যানেজার তাদের ঘুরে ঘুরে দেখালো । হেরা খুব উৎসাহ নিয়ে দেখলো।
চা বাগানে বেড়ানোর সময় ওর কুষ্টিয়া ইউনিভার্সিটির এক ক্লাসমেটের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। মেয়েটা হাজব্যান্ড আর ফ্যামিলি নিয়ে এসেছে। আগের হেরা আর এখনকার হেরা কে দেখে সে চমৎকৃত। প্রথমে চিনতেই পারেনি।
হেরা নওশাদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিল।
নওশাদ যখন বাগানের ম্যানেজারের সঙ্গে সামনে এগিয়ে গেল ।হেরা রিমা নামের তার সেই বান্ধবীর সঙ্গে হেঁটে হেঁটে গল্প করছে।
আমি তো ভেবেছিলাম বিয়ে হয়ে গেছে তোমার তাই পড়াশোনা ছেড়ে দিয়েছো হেরা ?
বিয়ের পরই পড়াশোনা আবার শুরু করলাম। ঢাকায় ভর্তি হয়েছি প্রাইভেট একটা ভার্সিটিতে।
তুমি কি ঢাকায় থাকো রিমা?
হুম আমার বর একটা প্রাইভেট কোম্পানিতে অনেক ভালো চাকরি করে । আমি এখন আর ক্লাস করি না সামনে গিয়ে শুধু পরীক্ষা দিয়ে চলে আসব। তোমার বর কি করে হেরা ?
বিজনেস !
কিসের?
আমি জানি না এত কিছু।
কেন জানো না ?
জানার ইচ্ছে হয়নি তাই।
এটা কেমন কথা ! তোমার বর কি করে , কিসের বিজনেস তোমার জানা দরকার না ?
আমি সব কিছু নিয়ে এত উৎসাহি না রিমা !
অবাক হয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল রিমা হেরার দিকে। তুমি ভালো আছো তো হেরা ?
খুব ভালো আছি রিমা ! একদিন বাসায় এসো বেড়াতে।
আসব ,বাসা কোথায় তোমার হেরা ? ঢাকায়ই থাকো ?
ঠিকানা টা উনার কাছ থেকে নিয়ে দিতে হবে ।
তুমি জানো না তোমার বাসার ঠিকানা ?
জায়গাটা র নাম জানি শুধু বনানী আর কিছু জানি না।
তুমি সব সময়ই একটু কেমন জানি ছিলে হেরা । এখনও তাই আছো । কিন্তু তোমার সাজ পোশাকের পরিবর্তন দেখে ভালো লাগছে।
হেরা হাসলো রিমার দিকে তাকিয়ে।
আমরা সিলেট শহরে একটা হোটেলে উঠেছি তোমরা কোথায় উঠেছো ? কালকে চলো ঘুরতে যাই এক সঙ্গে ।
জায়গাটা র নাম জানি না কিন্তু এখান থেকে অনেক দূরে উনার একটা রিসোর্ট আছে সেখানেই আছি। আমরা কালকে চলে যাব ঢাকায় ।
তোমার বরের রিসোর্ট ! রিমা অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে হেরার দিকে।
নওশাদ হেরার নাম ধরে ডাক দিতেই হেরা ঐ দিকে তাকালো , তাই দেখতে পেলো না কতটা বিস্ময় ভরা দৃষ্টিতে ওকে দেখছে রিমা!
রিমা তোমার মোবাইল নাম্বার টা দাও ঢাকায় বাসায় এসো কেমন।অনেক বছর পর দেখা হয়ে ভালো লাগছে । ভালো থেকো আমি আসছি।
হেরা নিজের মোবাইল এ রিমার নাম্বার সেইভ করে নিলো । রিমা অবাক হয়ে দেখছে, যে হেরাকে সে আগে একটা মাত্র মলিন বোরখা পড়া দেখতো। অতিসাধারণ মেয়ে হিসেবে খুব একটা পাত্তা দিত না, আজ তার হাতে দামী ফোন, ব্যাগ, গয়না সাজে একদম অন্যরকম এক হেরা ! ওর স্বামী কে দেখেও অবাক হলো কত স্মার্ট, গুড লুকিং ওর বিস্ময়ের ঘোর কাটার আগেই দেখতে পেল হেরা আর নওশাদ বিশাল এক গাড়িতে করে ওদের সামনে দিয়ে চলে গেল !
মানুষ আসলে নদীর মত কখনো উত্তাল ঢেউ তরঙ্গ আবার কখনো কচুরিপানা ভরা এক মৃত জলাশয়।
সাত দিনের জায়গায় নয় দিন কাটিয়ে নওশাদ হেরা কে নিয়ে ঢাকায় ফিরে এলো।
বিকালে গলফ খেলতে গিয়ে রেজোয়ানের সঙ্গে দেখা।
আপনি হানিমুন শেষ করে আসলেন শেষ পর্যন্ত নওশাদ আজমী।
আসলাম। তুই কি ভেবেছিলি ?
ভেবেছিলাম এক মাস অন্তর থাকবি !
শালা তোর মত নাকি আমি ! কাজ কাম নাই আমার ! হাসছে নওশাদ।
আমার মত না তুই তাই বললাম নওশাদ । কেমন ছিল হানিমুন?
যেমন ভাবছিস সেই রকম।
তুই সিলেট গেলি কেন, ওখানে রিসোর্ট তো এখনো অনেক দেরি আছে রেডি হতে?
একমাত্র ওখানেই গীতিকে নিয়ে যাই নি কখনো। আমি গীতির সৃত্মির বাহিরে গিয়ে হেরাকে গ্রহণ করতে চাইছিলাম।
ভালো করেছিস। খুব ভালো লাগছে বন্ধু তুমি শেষ পর্যন্ত এগিয়ে যেতে পেরেছো । খুব খুশি হয়েছি হেরার প্রাপ্য অধিকার তুই তাকে দিয়েছিস । তোর ভালোবাসার দরকার ওর, তা না হলে কিরকম অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটে দেখলি তো।
রেজোয়ান বীথি হেরা কে সহ্য করতে পারছে না । ওর ধারনা আমি ওর জীবনটা নষ্ট করেছি ?
মানে ?
ও নাকি আমার সঙ্গে তুলনা দিতো ফয়সাল কে সেই থেকে তার আর ফয়সালের সংসারের অশান্তি শুরু তারপর তো ডিভোর্স হলো।
তুই শিখিয়ে দিয়েছিলি তোর সঙ্গে তুলনা দিতে ? পাগল নাকি!
সেটাই তো! আমার খুব অশান্তি লাগছে এটা শোনার পর থেকে।আর সবচেয়ে বড় কথা ও হাসিবের সঙ্গেও এরকম করছে !
তোকে বিয়ে করতে চেয়েছিল কিন্তু তুই না করেছিস ও তো নিজেই রাজি হলো হাসিব কে বিয়ে করতে।
সেটাই । ও কেন বুঝতে পারে না আমি আপোস করতে পারতাম ওকে বিয়ে করে কিন্তু গীতির বোনকে কিভাবে স্ত্রী র জায়গা দেই ! যাদের ছোট থেকে দেখে আসছি ছোট বোনের মত !
এত অবুঝ বীথি !
আমার ওকে নিয়ে ভয় হয় হেরার না কোন ক্ষতি করে আবার।
চিন্তা করিস না হেরা অনেক বুদ্ধিমতী মেয়ে, ও ঠিকই সামলে নিবে সব কিছু।
হেরা প্যাচ বোঝে না রে।
এটাই ভালো বয়স তো কম সংসার করতে করতে সব বুঝে যাবে ।
দেখা যাক।
নওশাদ খুব ভরসা পায় না বীথির উপর সব সময় একটা বিষয় কাঁটা হয়ে থাকে ওর। হেরা এতটা সহজ সরল ভালো করে দুটো কথা বললেই ওকে ভুলিয়ে ফেলা যায়।
ইদানিং খুব এক্সাইটেড হয়ে আছে সামনে ওর ক্লাস শুরু হবে। ছেলেদের সঙ্গে পড়তে যাবে সে জন্য আবার খুব নার্ভাস। প্রথম দিন নওশাদ কে সঙ্গে যাওয়ার জন্য আবদার করেছে।
নিশালও আবার ফোনে বারবার বলছে পাপা তুমি মামনি কে দিয়ে আসবে।
নওশাদ হাসতে হাসতে বলেছে, তোমার মামনি প্লেগ্রুপের বেবি বাবা যে হাত ধরে ক্লাসে ঢুকিয়ে দিয়ে আসতে হবে ?
একথা শুনে হেরা গাল ফুলিয়ে রেখেছে নওশাদের উপর। নওশাদের খুব মজাই লাগছে ওর অভিমান দেখে। কত বছর পর কেউ একজন তার উপর অভিমান করে আছে। এখন কিভাবে এই অভিমান ভাঙ্গাবে তাই ভাবছে সে। কিন্তু খুব উপভোগ করছে বলেই অভিমান টা জিয়ে রাখছে সে।
( চলবে )
#তবু_সুর_ফিরে_আসে
৩৩ পর্ব
হেরা খুব আবদার করেছে নওশাদ যেন তাকে প্রথম দিন ক্লাসে নিয়ে যায়। নওশাদ ওর একা যাওয়ার পক্ষেই যুক্তি দেখাচ্ছে।
আপনি সঙ্গে গেলে আমি সাহস পাব।
হেরা আমার যেতে তো কোন সমস্যা নেই কিন্তু আমি চাই তুমি নিজের আত্মবিশ্বাস নিয়ে যাও। তোমার জন্য ওটাই সবচেয়ে বেশি দরকার।
প্রথম দিন আপনি যাবেন বলেন প্লিজ, প্লিজ। হেরা নওশাদের হাত ধরলো।
নওশাদ হাত টা শক্ত করে ধরলো হেরা আমি চাইছি তুমি নিজের উপর আত্মবিশ্বাসী হবে, তুমি পারবে অবশ্যই ।
আপনি খুব ভালো করেই জানেন আমার সব আত্মবিশ্বাস, মানসিক শক্তি আপনি। আপনি সঙ্গে থাকলে আমি পারব।
আর আমি সঙ্গে না থাকলে ?
আপনি সঙ্গে থাকবেন না কেন ?
ধরো আমি নেই তোমার আশেপাশে তখন কি করবে ?
আমি জানি আপনি সব সময় আমার সঙ্গে সঙ্গে থাকবেন। আমাকে একা ছাড়বেন না। আপনি কথা দিয়েছেন আমাকে কোথাও একা যেতে দিবেন না।
আমার জান , সেটা নিশ্চয়ই তোমার ভার্সিটি নয় ? প্রতিদিন তোমাকে ভার্সিটিতে দিয়ে আসব বুঝি ?
প্রতিদিন দিয়ে আসতে কে বলেছে , বিড়বিড় করে বলল হেরা?
আপনি যাবেন না তাই তো ?
না তুমি সেলফ ডিপেন্ডেবল হবে এটা হবে তার ফাস্ট স্টেপ।
হেরা অভিমানে উঠে দাঁড়ালো থাক আর কিছু বলতে হবে না । মুখ ঘুরিয়ে হেরা অন্য দিকে তাকিয়ে আছে।
নওশাদও উঠে দাঁড়ালো হেরার ঘাড়ে চুমু খেয়ে বলল, তোমার ইচ্ছে করে না সেলফ ডিপেন্ডেবল হতে ?
আমার আপনার উপর ডিপেন্ড হয়ে থাকতে ভালো লাগে। আপনার ছায়ার নিচে।
উহু এসব বললে হবে না আমি চাই তুমি এতটাই শক্তিশালী হও মানসিক শক্তি নিজেই নিজেকে দিবে।
হয়েছে থাক আর কিছু বলতে হবে না। হেরা গাল ফুলিয়ে ফেলল। সেই থেকে অভিমান করে আছে নওশাদের উপর।
নওশাদ খুব মজা পাচ্ছে এত দিন পর কেউ তার উপর অভিমান করে আছে। বাচ্চারা যেরকম অভিমান করে হেরাও ঠিক তাই করছে, কথাবার্তা বলছে কিন্তু সব ভাব বাচ্যে ।
নওশাদের এত মজা লাগছে। হেরার কান্ড কারখানায় হাসি পাচ্ছে খুব।
এই যেমন সেদিন সন্ধ্যায় নওশাদ অফিস থেকে এসে দেখে লিভিং রুমে বসে আনারের মা ওর মাথায় তেল ম্যাসাজ করে দিচ্ছে। নওশাদ কে দেখেই হেরা আনারের মা কে বলল, বুঝলে আনারের মা রবিন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চলো রে। তুমি যদি তেল লাগাতে না আসতে তাহলে আমি একাই লাগাতাম। আড় চোখে নওশাদের দিকে তাকালো।
আম্মা এইডা কি কন আপনে কইবেন আর আমি তেল দিমু না সব কাম ফালায় রাখব তাও দিয়া দিব !
তোমার মত আর কেউ তো আমার কথা ভাবে না গো আনারের মা।
নওশাদ হাসতে হাসতে রুমে ঢুকে গেল।
একটু পর রুমে এসে ঢুকলো হেরা, নওশাদ ফ্রেশ হয়ে বেডে কাত হয়ে শুয়ে মোবাইল টিপছে হেরা ওকে দেখে কিছু বললো না চুপচাপ আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল বেনী করছে ।
নওশাদ নিজে নিজেই গেয়ে উঠলো, যদি কেউ কথা না কয়/ ওরে ওরে ও অভাগা কেউ কথা না কয়/ যদি সবাই থাকে মুখ ফিরায়ে সবাই করে ভয়। ও তুই মুখ ফুটে তোর মনের কথা একলা বলো রে। যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চলো রে।
তারপর নিজে নিজেই বলল,
থাকুক সবাই অভিমান করে আমি একা একাই কথা বলব।কি আর করা অফিস থেকে আসলাম না দেখতে পেলাম একটা হাসি মুখ, না পেলাম এক কাপ চা।
হেরা আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে দেখছে নওশাদকে। কাছে এসে বেড সাইড ড্রয়ার খুলে মোবাইল চার্জার বের করলো নওশাদ হাত ধরে টান দিয়ে বেডে বসালো।
এত অভিমান ?
আমি কোন অভিমান করিনি । আর করলে কি লাভ ? আমার অভিমানের কি দাম আছে ?
ওমা এত বড় কথা !
নয়তো কি ?
ঠিক আছে আমি হার মানলাম নিয়ে যাব তোমাকে প্রথম দিন ক্লাসে। হলো তো এখন মুড ঠিক করো।
হুম।
হুম বললে হবে না হাসো । নওশাদ বালিশের পাশ থেকে এক গোছা বেলী ফুলের মালা বের করলো । এটা পড়িয়ে দেই?
কি সুন্দর মিষ্টি ঘ্রাণ !
আমার খুব পছন্দ বেলী ফুল নওশাদ বলল।
কোথায় পেলেন ?
আসার পথে সিগন্যাল এ একটা বাচ্চা বিক্রি করছিল ভাবলাম বউ অভিমান করে বসে আছে নিয়ে যাই যদি মনের বরফ গলে ।
আপনি যেহেতু বলেছেন আমার সঙ্গে ভার্সিটিতে যাবেন তাহলে মন খারাপ কেন থাকবে আর ।
হুম বুঝলাম। দুটো দিন খুব পানিশমেন্ট দিলে হেরা।সুন্দর করে কথা বলো নি , কাছে আসোনি রাতে অন্য পাশ ফিরে ঘুমিয়ে গেলে আমি বাবা এসব খুব ভয় পাই তাই ভাবলাম থাক শুধু শুধু বউ এর অভিমান বাড়িয়ে লাভ নেই। যার হাসি মুখটা দেখতে এতো ভালো লাগে তার অভিমানে গাল ফোলানো মুখটা দেখতে কি ভালো লাগে বলো ?
হেরা ওর নার্ভাসনেস এর কথা এলিন নাহিনের কাছে বলল।
এত নার্ভাস হওয়ার কি আছে বৌমনি?
এলিন আমার তো তিন টা বছর পড়াশোনার গ্যাপ গিয়েছে যাদের সঙ্গে পড়ব ওরা বয়সে ছোট এটার জন্য অস্বস্তি লাগছে। আবার এত গুলো ছেলে থাকবে কিছু কারণে আমি ছেলেদের এড়িয়ে চলি।
শোন বৌমনি তোমাকে একটা বুদ্ধি দেই নিজেকে স্ট্রং ভাবো তাহলেই দেখবে তুমি নার্ভাসনেস কাটিয়ে উঠেছো।
তুমি যে সুন্দরী, ক্লাসমেট থেকে শুরু করে সিনিয়র সব ছেলে তোমার সঙ্গে ভাব জমাতে চাইবে এড়িয়ে যাবে কিভাবে ছেলেদের?
আর একটা কথা তোমরা সেদিন আমাকে বৌমনি বলো নি এটা কেমন কথা?
জনে জনে জানানোর কি আছে তুমি আমাদের বৌমনি ?
নাহিন আমার নার্ভাস লাগছে এই কারণেও, আমি ছেলেদের সঙ্গে কমফোর্টেবল হতে পারি না।
জানি বৌমনি তুমি তো শোয়েব মামার সঙ্গেও কথা বলো না !
হেরা একটু চুপ করে গেল । আসলে উনার সঙ্গে খুব একটা দেখা হয় না তাছাড়া কি কথা বলব সেটাও একটা ফেক্ট।
এলিন নাহিনের সঙ্গে কথা বলে হেরা শ্বশুরের রুমে ঢুকলো। আজকে উনাকে নিজের বাসায় নিয়ে যাবে মেঝ ছেলে। নওশাদ প্রতি বার নেয়ার কথা বললেই বাঁধা দেয় । কিন্তু আরমান কিংবা ফারহান বুবুকে বলে , তাই নওশাদকে বুবুর কথা মেনে আব্বা কে ভাইদের বাসায় পাঠাতে হয়।
আব্বা কি করেন ?
এসো বড় বৌমা । আমি একটা হিসাব করছি ।
কিসের হিসাব আব্বা হেরা অবাক হলো !
তোমার আম্মা কতদিন থেকে জান্নাতে র কাছে ফ্লোরিডা তে সেটাই ।
ও আচ্ছা ।
আপনি কখন যাচ্ছেন আব্বা ?
কোথায় ?
আজ না আপনি আরমান ভাইয়ার বাসায় যাবেন।
না না আমি কোথাও যাব না !
আব্বা আপনার মেঝ ছেলে মন খারাপ করবে ।
না কোন মন খারাপ করবে না । তুমি ফোন দাও বাবুকে বলো, ও ধমক দিলেই ওরা ভয় পাবে । আমি যাব না বৌমা বাবুকে রেখে যেতে আমার ভালো লাগে না।
আব্বা দুই দিন থাকেন তারপর আমি আর আপনার বাবু গিয়ে নিয়ে আসব আপনাকে।
বৌমা তোমার ছেলে কোথায় ? ওকে আসতে বলো !
আব্বা ও তো ক্যাডেট কলেজে ।
আমার নিশাল দাদু ভাই কে খুব দেখতে ইচ্ছে করছে ।
আব্বা ওর পরীক্ষা চলছে শেষ হলেই চলে আসবে আর মাত্র কয়দিন ।
বৌমা তুমি বাবুকে রেখে বাবার বাড়ি যাবে না ছেলেটা একা থাকলে আমার কষ্ট হয় খুব।
আব্বা আমি কোথাও যাবো না আপনার ছেলে কে রেখে আপনি চিন্তা করবেন না। আপনার ছেলে ছাড়া আমার কেউ নেই আব্বা । এই বাড়িই আমার সব।
হেরা মুগ্ধ হয়ে দেখছে বৃদ্ধ বাবা সবকিছু ভুলে গেলেও ছেলের কষ্ট টা খুব মনে রাখেন । বড় ছেলের জন্য কত ভালোবাসা উনার বুকে ।
মনটা খারাপ করে সে নিজের ঘরে বসে আছে। তার খারাপ লাগছে নওশাদ মানুষ টা তাকে কতটা মানসিক শক্তি দেয়, নিরাপত্তা দেয় কিন্তু কতটা একা ছিল মানুষটা। হেরা আসার পর এখন নিশ্চয়ই তিনি আর একা নন। নাকি এখনো বুকের ভেতরে একাকিত্ব নিয়ে ঘুরেন জানেনা হেরা।
সন্ধ্যায় নওশাদ বাসায় ফিরে দেখে হেরার মন খারাপ।
কি হয়েছে তোমার?
কিছু না খারাপ লাগছে ।
কেন?
হেরা নওশাদের পাশে বসে ছিল ওর হাত টা জড়িয়ে ধরলো। একটা কথা বলবেন আমাকে ?
কি কথা ?
আপনি এত বছর একা ছিলেন আচ্ছা আপনার একাকিত্ব টা দূর হয়েছে এখন ?
নওশাদ হেরার দিকে তাকালো । হঠাৎ এই প্রশ্ন করছো কেন ?
কথাটা মনে হতেই খারাপ লাগছিল ।
নওশাদ হেরা কে বুকের কাছে টেনে নিলো । আমি তোমাকে বলেছি আমি ভালো আছি হেরা তুমি যখন আছো আমার সঙ্গে একা ফীল করার তো কোন প্রশ্নই আসে না আর।
সত্যিই তো ?
সত্যি। হঠাৎ এই কথা কেন আসলো মনে ?
আব্বা বলছিল আমি যেন আপনাকে রেখে কোথাও না যাই আপনি একা হয়ে যাবেন। আব্বা আপনাকে খুব ভালোবাসেন।
গীতি যাওয়ার পর আব্বা আমাকে দেখেই অসুস্থ হয়ে গেল বেশি। তখন আব্বার এলজাইমার টা ছিল না। খুব কান্নাকাটি করতো নিশাল আর আমার জন্য। কয়েক বার অসুস্থ হয়ে হসপিটালে ভর্তি করাতে হয়েছে। এলজাইমার হয়ে ভালো হয়েছে ভুলে যায় সব কিছু। কষ্ট গুলো ও সেই সঙ্গে ভুলে থাকে।
তাহলে তো সব মানুষের এই রোগ কম বেশি থাকা ভালো সব কষ্ট ও ভুলে থাকা যাবে।
তোমার কিসের কষ্ট হেরা ?
আমি আছি তোমার কাছে তারপরেও কষ্ট !
না আমার কোন কষ্ট নেই ।
না মনে হচ্ছে আছে কষ্ট । দেখি কোথায় কষ্ট বুকের ভেতরে কষ্ট হেরা ? দেখি দেখি ।
না না কষ্ট নেই বললাম তো । নওশাদ হেরার সঙ্গে দুষ্টামিতে মেতে উঠলো। হেরা কিছুক্ষণ হুড়োহুড়ি করে দৌড়ে পালালো ।
পেছন থেকে নওশাদ বলে উঠলো রেডি হও চলো তোমাকে নিয়ে এলোমেলো ড্রাইভে যাব খুব সুন্দর চাঁদ উঠেছে বাহিরে।
আজ প্রথম ভার্সিটিতে যাবে হেরা। নওশাদ ডাইনিং টেবিল এ ব্রেকফাস্ট করছে আব্বার সঙ্গে বসে। হেরা সেই তখন থেকে রেডি হচ্ছে।
আনারের মা তোমার আম্মাকে ডাকো দেরি হয়ে যাবে।
যাইতাছি স্যার বলে আনারের মা দৌড়ে উপরে উঠে গেল।
মামা আমাদের আজ গাজীপুর যাওয়ার কথা , শোয়েব বলল।
মনে আছে শোয়েব ,হেরাকে ভার্সিটিতে নামিয়ে দিয়ে চলে যাব। সবুজ কে বলো পুরো সময়টা যেন গাড়ি নিয়ে ভার্সিটিতে ই থাকে কোথাও যেন না যায়।
জ্বি মামা আমি বলে দিচ্ছি বলে শোয়েব খাওয়া শেষ করে উঠে গেল।
বাবু ।
নওশাদ আব্বার দিকে তাকালো ।
বলো আব্বা ।
আমি এ বাসা ছেড়ে আর কোথাও যাব না ।
কি হয়েছে আব্বা ?
ওদের বাসায় আমার ভালো লাগে না । নিজের ঘরে থাকতেই ভালো লাগে।
ঠিক আছে আর যেতে দিব না তোমাকে ।
আমাকে একবার জান্নাতের বাসায় নিয়ে যাবি ?
প্লেনে এত লম্বা জার্নি করতে পারবে তুমি আব্বা?
পারব।
আচ্ছা নিয়ে যাব তোমাকে ।
আমার বাবুই সবচেয়ে ভালো কোন কিছুতেই না করে না । আরমান আর ফারহান শুধু না করে আব্বা এটা করো না এটা খাওয়া যাবে না। সেদিন আইসক্রিম খাচ্ছি আরমান না করলো । দুই বাটি আইসক্রিম খেলে কি হয় ?
আব্বা গতবছর নিউমোনিয়া হয়ে হসপিটালে ভর্তি ছিলে ভুলে গেলে তুমি । তোমার কি কষ্ট হলো তখন ।
বড় বৌমা কে বললাম কথাটা শুনে সঙ্গে সঙ্গে আইসক্রিম কিনে এনে মুখে তুলে খাইয়ে দিল আমাকে ।
তোমার বড় বৌমা তো জানে না কি অবস্থা হয়েছিল তোমার।
দুই বাটি আইসক্রিম খেলে কিছু হয় না বাবু। তুই যখন বুড়ো হয়ে যাবি নিশাল দাদু ভাই আইসক্রিম খেতে না করলে দেখবি কত কষ্ট লাগে ।
নওশাদ আব্বার কথা শুনে হো হো করে হাসছে।
হেরা রেডি হয়ে উড়তে উড়তে নিচে নেমে এলো।
তাড়াতাড়ি করো হেরা তোমাকে নামিয়ে দিয়ে আমাকে ফ্যাক্টরি তে যেতে হবে ।
আমি রেডি চলেন ।
না খেয়ে যাবে ?
খেতে ইচ্ছে করছে না।
কিছু একটা খেয়ে নাও ।
হেরা নওশাদের কাপ থেকে চা নিয়ে চুমুক দিলো । হয়েছে।
এটা কি কথা। ঠিক ভাবে ব্রেকফাস্ট করো।
দেরি হয়ে যাবে আমার নার্ভাস লাগছে কালকে থেকে খেতে পারব না । নিশাল কালকে ফোন দিয়েছিল আমাকে উইস করেছে।
সাজগোজ করতেই এত সময় লাগালে তুমি।
হেরা শ্বাশুরের কাছে গিয়ে পায়ে হাত দিয়ে সালাম করলো।
কোথায় যাচ্ছো বাবার বাড়ি যাচ্ছো না তো ?
আব্বা হেরা ভার্সিটিতে ভর্তি হয়েছে আজকে প্রথম দিন তাই তোমাকে সালাম করছে।
ও আচ্ছা অনেক দোয়া করি ।
আসি আব্বা ?
যাও বৌমা সাবধানে থেকো।
হেরা নওশাদের হাত ধরে টানলো । এদিকে আসুন তো একটু ।
চলো বের হই ।
আগে আসুন আমার সঙ্গে।
হেরা নওশাদ কে ড্রয়িং রুমের দিকে নিয়ে গেল। তারপর নওশাদের পায়ে হাত দিয়ে সালাম করলো।
নওশাদ অবাক হয়ে গেল!
আমাকে কেন ?
আপনার দোয়া টা সবচেয়ে বেশি ইফেক্টিভ আমার জন্য।
নওশাদ হেরার কপালে চুমু খেলো। কনফিডেন্ট নিয়ে চলাফেরা করবে সব সময়। যেকোনো সমস্যায় পড়লে প্রথমে ই আমাকে ফোন দিবে। আমি কিন্তু টেনশনে থাকি । ড্রাইভার থাকবে সারাক্ষণ পার্কিং এ ওর নাম্বার টা সেইভ করে রেখো।
ঠিক আছে। হেরা জড়িয়ে ধরলো নওশাদ কে আমার এত ভয় লাগছে কেন ?
তুমি বোকা মেয়ে তাই তোমার ভয় লাগছে।
ভয়ের কিছু নেই হেরা সবাই তোমার ক্লাসমেট। ওদের বন্ধু ভাববে দেখবে সব সহজ হয়ে গেছে।
হুম।
এখন চলো।
শোয়েব ড্রয়িং রুমের দিকে ঢুকতেই মামা মামিকে দেখে লজ্জা পেয়ে গেল । আসতে করে সরে গেল সে।
গাড়িতে বসে হেরা নওশাদের হাত ধরে রাখলো। জানেন কুষ্টিয়াতে যখন ভর্তি হয়েছিলাম তখন নানা ভাই আমাকে সঙ্গে করে নিয়ে গিয়েছিল প্রথম দিন। সেদিনও আমার খুব ভয় লাগছিল। নানা ভাইয়ের হাত ধরে ছিলাম। নানা ভাইও আপনার মত আমাকে সাহস দিচ্ছিল। হেরার চোখ ভিজে উঠলো।
তোমাকে একটা কথা বলব হেরা , আমি যেদিন ক্যাডেট কলেজের ভর্তি পরীক্ষা দিতে গিয়েছিলাম তোমার নানা ভাই আমাকে সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিল। আমিও স্যারের হাত ধরে ছিলাম এরকম। স্যার বারবার বলছিলেন , ভয়ের কিছু নেই রে বেটা ।
হেরা মানুষের জীবন টা একটা বৃত্তের মত । বৃত্তের যেমন শেষ নেই শুধু ই চক্রের মত ঘুরে জীবনটাও সেরকম ঘুরছে। আমাদের সেই চক্রের ভেতরেই ভালো থাকতে হবে, কখনো খারাপ সময়ের সঙ্গে লড়াই করতে হবে কিন্তু আশাহত হওয়া যাবে না। মনে রাখবে যেখানেই সমস্যার শুরু সমাধান তার আশেপাশেই আছে । ভয় পাবে না । মানুষ কে পরিস্থিতি কাবু করতে পারে না । মানুষকে হারিয়ে দেয় তার ভেতরের ভয়।
হেরার চোখ দিয়ে পানি পড়ছে। নওশাদের কথা গুলো তাকে সাহস দিচ্ছে তারপরও সে নার্ভাসনেস টা কাটাতে পারছে না।
নওশাদের হাত ধরে চার মাস আগে যে পরিবর্তন এসেছে তার জীবনে, আজকে সেই জীবনের আরেক পরিবর্তনের পথে এগিয়ে যাচ্ছে আবারও। নওশাদ তার জীবনটাকে আলোয় যেভাবে ভরে দিচ্ছে সে সেই আলোয় আলোকিত হয়ে যাচ্ছে। নওশাদের প্রতি ভালোবাসায়, কৃতজ্ঞতায় সে বারবার নুয়ে যায়।
চোখের পানি কেন হেরা ?
এমনি ।
নওশাদ টিস্যু এগিয়ে দিল ।
গাড়ি থেকে নামতেই এলিন, নাহিন এগিয়ে এলো হেরার কাছে। ওদের সকালে ক্লাস ছিল তাই আগেই চলে এসেছিল।
নওশাদ হেরার মাথায় হাত রাখলো । আমার কি আরও যেতে হবে তোমার সঙ্গী সাথী তো চলে এসেছে ?
থাক আর লাগবেনা ।
নার্ভাস লাগছে এখনও হেরা ?
একটু ।
নওশাদ হেরার মাথায় হাত রাখলো অনেক দোয়া আর শুভকামনা রইল তোমার জন্য, যাও ভেতরে গেলেই দেখবে সব নার্ভাসনেস গায়ের হয়ে যাবে । আজ তোমাদের জন্য কত আয়োজন থাকবে। ভালো লাগবে তোমার।
হেরা তাকিয়ে আছে নওশাদের দিকে। যে মুখাটা দেখলে সে ভেতর থেকে সাহস পায়, অন্যরকম একটা শক্তি পায় ।
চলো বৌমনি , এলিন এসে হেরার হাত ধরলো ।
হেরা নওশাদের দিকে আবার তাকালো । নওশাদ সানগ্লাস টা খুলে হেরার চোখের দিকে তাকিয়ে পলক ফেলল।
হেরা এতেই অনেক ভরসা পেলো।যা তার এগিয়ে যাওয়াতে অনেক শক্তি জুগিয়ে দিলো।
নওশাদ তাকিয়ে দেখছে হেরা এগিয়ে যাচ্ছে। একটু পর পর পিছন ফিরে দেখছে ওকে। নওশাদ হাত তুলে নাড়লো দুই বার।
নওশাদ মুগ্ধ হয়ে দেখছে হেরা কে ভীড়ু ভীড়ু পায়ে এগিয়ে যাচ্ছে সে।
( চলবে )