তবু সুর ফিরে আসে পর্ব-৪৪+৪৫

0
1616

#তবু_সুর_ফিরে_আসে

৪৪ পর্ব

জীবনের পরিস্থিতি গুলো মানুষকে গড়ে নেয় তার মতো করে। হেরা নিজের পড়াশোনা, নিজের সংসার সব সামলে নিচ্ছে। ন‌ওশাদের উৎসাহ তাকে শক্তি দেয় সব কিছুতে। পারুলকে দিয়ে বীথি যে কষ্ট ওর জীবনে দিয়েছে সেই কষ্ট ভুলিয়ে দিয়েছে ন‌ওশাদের আর নিশালের ভালোবাসা। নিশালকে সে নিজেও অনেক ভালোবাসে। একটা সময় যখন প্রথম বিয়ের পর এই বাসায় এসেছিল নিশালেকে দেখার আগে সে অনেক ভয়ে ভয়ে ছিল ছেলেটা ওকে হয়তো মনে নিতে পারবে না ভেবে। কিন্তু এই নিশাল ওকে এতটা সন্মান, ভালোবাসা দিয়েছে যার কল্পনাও সে করেনি। আজ তার মনে হয় তার জীবনে ন‌ওশাদের পর পরম পাওয়া হলো নিশাল।
বীথির সঙ্গে ঐ ঘটনার পর নিশাল বীথির সঙ্গে কোন যোগাযোগ করে না। হঠাৎ হঠাৎ ওর খুব খারাপ লাগে কারন বীথির নিশালের প্রতি ভালোবাসা টাতে তো কোন খাদ ছিল না। বীথির সঙ্গে সম্পর্ক টা নিশালের রাখলে তো সমস্যা নেই। একদিন এই কথাটা সে ন‌ওশাদের সামনেও তুলেছিল। ন‌ওশাদ কিছুক্ষণ খুব গম্ভীর হয়ে থেকে বলল, হেরা বেইমানি কখনো দূরের মানুষ করে না বেইমানি করে সব সময় কাছের মানুষ। আর কাছের মানুষদের কাছ থেকে এমন ব্যবহার আমি সহ্য করতে পারিনা। তাদের এরকম আচরণের কোন ক্ষমাও করতে পারি না। তুমি আশাকরি আমাকে এরকম কোন অনুরোধ করবে না যা আমি রাখতে পারব না।
সেদিনের পর থেকে হেরা বীথির প্রসঙ্গ আর তুলে না।
আজ প্রায় সাত আট মাস হয়েছে বীথি এই ফ্যামিলির সঙ্গে যোগাযোগ বিহীন। তবে যুথীর সঙ্গে নিশালের যোগাযোগ আছে। ছুটিতে আসলে নিশাল যায় যুথীকে দেখতে নিশাল‌ও যথাসম্ভব যোগাযোগ রাখে যুথীর সঙ্গে। যুথী ফোন দিয়ে খোঁজ খবর নেয় নিশালের ন‌ওশাদের। মাঝে যুথীর অসুস্থ শ্বাশুড়ি মারা গেছে হেরা আর ন‌ওশাদ গিয়েছিল তখন। ন‌ওশাদ যত ব্যস্ত‌ই থাকুক আত্মীয় স্বজনদের আনন্দ, বেদনায় পাশে থাকার চেষ্টা করে। আগে পারতো না । কিন্তু গীতি মারা যাওয়ার পর সে নিজেই সব দ্বায়িত্ব পালন করে।
যুথীর বাসায় হেরার সঙ্গে দেখা হয়েছিল বীথির, হেরা‌ই নিজের থেকে খোঁজ খবর নিলো। নিশালের কথা বলল। সামনে নিশালের পরীক্ষা সেটাও বলল। হেরার মায়া লাগে নিজের ভুলে কত সুন্দর একটা সম্পর্ক নষ্ট করলো বীথি।
সেদিন‌ই হেরা ন‌ওশাদকে বলেছিল বীথির কথা তখন‌ই ন‌ওশাদ বলেছে দরকার নেই দূরত্ব‌ই ওর উপযুক্ত শাস্তি। তারপর হেরা আর কখনো এই প্রসঙ্গ তুলে নাই।
নাহিন, এলিন বীথি পারুলকে দিয়ে যে জঘন্য কাজ করিয়েছে জানার পর হেরার সঙ্গে অনেক রাগ হয়েছে। বারবার বলেছে , বৌমনি তোমাকে অনেক আগেই বলেছিলাম বীথিকে শিক্ষা দেই একটা, তখন রাজি হলে না । তখন আমাদের কথা শুনলে তাহলে এত বড় দূর্ঘটনা টা ঘটতো না তোমার সঙ্গে।
হেরা দীর্ঘশ্বাস ফেলা ছাড়া আর কোন উপায় ছিল না ।
বীথি আর নিশালের যা সম্পর্ক সে জন্যেই হেরা নাহিন, এলিনদের ওসব শিক্ষা দেয়ার বুদ্ধিতে যায় নাই। পরে উল্টো পাল্টা কিছু ঘটলে নিশালের সঙ্গে ওর সুন্দর সম্পর্ক টার কি হতো। এটা তো সত্য ওর আর নিশালের সম্পর্ক টা একটা নাজুক সম্পর্ক এই সম্পর্কের মধ্যে ঝামেলা হ‌ওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি তাই হেরা কোন রিস্ক নেয়নি কখনো।
হয়তো সে জন্যেই আজ ওদের সম্পর্কটা সুন্দর, সহজ।
তবে হেরা ইদানিং খুব ফীল করে এলিন, নাহিন যদি এই বাসায় না থাকতো তাহলে ওর অনেক কষ্ট হতো। এখানে আসার কিছুদিন পর ওরা এই বাসায় এসেছে ওদের সঙ্গে থেকে কত কিছু শিখেছে । সত্যি বলতে গেলে ওরা ওকে বাহিরের জগতের সঙ্গে মিশতে সহজ করে দিয়েছে। ভার্সিটিতে ওরাই তো ওর সঙ্গে থেকে সবার সঙ্গে মেলামেশা করাটা স্বাভাবিক করে তুলেছে। তা না হলে ও কত গুটিয়ে থাকতো।
এত বড় বাসায় সারাদিন ওদের সঙ্গে সময় কাটাতে ওর ভালো লাগে। ন‌ওশাদ যখন দেশের বাহিরে যায় সব সময় তো আর ও যেতে পারে না ক্লাস থাকে পরীক্ষা থাকে সেই সময়টা এই দুই বোনের সঙ্গে থাকলে ওর খারাপ লাগে না।
কিন্তু প্রায় সময় যখন ওর মনে হয় ওদের বাবা ঢাকায় বদলি হয়ে চলে এলেই তো ওরা চলে যাবে নিজের বাসায়, তখন ওর খুব খারাপ লাগবে।
মাঝখানে ওরা দুই বোন শোয়েবের জন্য পাত্রী দেখতে গিয়েছিল । হেরাকেও সঙ্গে নেয়ার জন্য খুব জোরাজুরি করেছে কিন্তু হেরার ইচ্ছে করেনি।
শোয়েব ও বলল মামি আপনি যান সঙ্গে আমার ছোটবোন আর এই ভাগ্নিরা কতটুকু আর বুঝবে বলেন ?
হেরা হাসতে হাসতে বলেছে, ওদের থেকে আমার বুদ্ধি, স্মার্টনেস কম তাই আমার চেয়ে ওরা অনেক ভালো পরখ করতে পারবে।
মেয়ে পছন্দ হ‌ওয়ার পরেও কেন জানি আর বিয়েটা হলো না ওখানে। তারপর থেকে এলিন, নাহিন‌ আক্ষেপ করে বলে তাদের মামা আসলে খুবই খুঁতখুঁতে স্বভাবের। কত সুন্দর সুন্দর মেয়ে দেখানো হয় কিন্তু সব শেষে এসে মামা রিজেক্ট করে দেয়। কি যে চায় আল্লাহ্ জানে ?
দুপুরে খেয়ে হেরা আজ চুপচাপ নিজের ঘরে বসে আছে। গতকাল তার পরীক্ষা শেষ হয়েছে। আজ বাসায় ছিল তাই রান্না করেছে। ন‌ওশাদের জন্য লাঞ্চ পাঠিয়েছে। তারপর শ্বশুরের সঙ্গে বসে লাঞ্চ করেছে। শ্বশুরের শরীর আজকাল খারাপ যাচ্ছে। হেরা খাওয়ার সময় কাছে থাকে । ইদানিং অল্পতেই ঠান্ডা লেগে শ্বাস কষ্ট হচ্ছে উনার।
মাঝে ন‌ওশাদ গিয়েছিল ফিলিপাইন তখন একদিন রাতে শ্বশুর অনেক অসুস্থ হয়ে গিয়েছিল ,হেরা দুই দেবর কে খবর দিলো সবাই ছুটে এলো তারপর বাসায় ই অক্সিজেন দেয়ার ব্যবস্থা করে ফারহান দুই দিন পর কিছুটা সুস্থ হয়ে উঠলেন তিনি।
আজকে হেরাকে খাওয়ার সময় বলল, বৌমা বাড়িটা কেমন খালি খালি লাগে তোমার শ্বাশুড়ি থাকলে বাড়িটা এত খালি লাগে না।
হেরা মাছের কাঁটা বেছে দিতে দিতে বলল, আব্বা আম্মার কথা মনে পড়ছে আপনার?
তার কথা তো সব সময়ই মনে পড়ে অনেক দজ্জাল মহিলা ছিলেন তাকে ভুলা যায় না।
আব্বা কি যে বলেন আম্মার গল্প শুনেছি মোটেও দজ্জাল ছিলেন না অসুস্থ থাকতেন আর দজ্জাল হলে আপনি এত মিস করতেন না ! হেরা হাসতে হাসতে বলল।
ঐ অসুস্থ অবস্থায় বিছানায় শুয়ে থেকেই আমার সঙ্গে ঝগড়া করতো তুমি জানো না। আমি অনেক ভয় পেতাম।
হেরা হাসছে শ্বশুরের কথা শুনে।
তুমি তো তোমার শ্বাশুড়ি কে দেখোনি বাবু দেখতে ওর মায়ের মত।
জ্বী আব্বা ছবি দেখেছি আম্মার।
হেরা সব সময় শ্বশুর যখন শ্বাশুড়ির গল্প করেন সেটা খুব উপভোগ করে।

হঠাৎ আনারের মা এসে ঘরে ঢুকল । আম্মা কি করেন একলা একলা ?
কিছু না এমনি বসে আছি । আচ্ছা আনারের মা রানু কেমন কাজ করছে বলো ?
আম্মা আইলো তো মাত্র দেখাযাক কি কতটা করতে পারে।
পারুল যাওয়ার পর আনারের মায়ের উপর কাজের চাপ বেশি পড়ে গিয়েছিল। তাই গ্রামের বাড়ি থেকে একটা নতুন মেয়ে আনা হয়েছে। এই রানুর মা আগে এই বাসায় কাজ করেছে তার বাচ্চা রা ছোট তাই বেশিদিন থাকে নাই তখন ।
মেয়েটা কাজে ভালোই কিন্তু খুব টিভি পাগল।‌ এটা নিয়ে আনারের মায়ের সঙ্গে মতের অমিল হচ্ছে।
আম্মা পারুলের সাহস বেশি আমি জানতাম কিন্তু এত সাহস হ‌ইব কোন দিন বুঝি নাই, আনারের মা হেরার পায়ের কাছে রাখা কাঠের ছোট টুলে বসে বলল !
পারুলের কথা বাদ দাও ঐ প্রসঙ্গ আবার আসছে কেন, ও সাহস কোথা থেকে পেয়েছে সেটা তো জানোই তুমি।
আম্মা একটা কথা ক‌ই কিছু মনে করিয়েন না !
কি কথা ?
আগের আম্মা মারা যাওয়ার পর বীথি খালাম্মার কি ইচ্ছা ছিল ঐদিন তো শুনলেন । স্যাররে জন্য পাগল হেয়ে গেছিল ! স্যার কোন দিন তার দিকে তাকায়‌ও নাই। আমি এই বাড়িতে আজ এত বছর সব দেখি তো । আপনে তো এখন সব শুনলেন আমি সব বুঝতাম, দেখতাম কিন্তু চুপ ক‌ইরা থাকতাম। ভাইয়ার জন্য খালাম্মা দিনের পর দিন এই বাসায় থাকতো না , খালাম্মা থাকতো স্যাররে দেখার জন্য। স্যার আম্মার জন্য মন খারাপ করে থাকতো খালাম্মা শুধু বলতো আর কত দিন এভাবে থাকব দুলাভাই?
স্যার রাতে আসলে একা খাইতে ই আরাম পাইতো কিন্তু খালাম্মা অপেক্ষা করতো স্যার খুব বিরক্ত হ‌ইতো। খাওয়ার সময় খালাম্মা আমাদের কাউরে টেবিলের কাছে থাকতে দিতো না আবার স্যার ডাকতো খাওয়া দিয়ে চলে যাও কেন আনারের মা ?
খালাম্মা ক‌ইতো আমাকে বলেন দুলাভাই কি লাগবে?
স্যার ক‌ইতো যার কাজ তাকে করতে দাও।
স্যার উনার এই গায়ে পড়া কথা বার্তা র জন্য খুব ত্যক্ত হ‌ইতো কিন্তু কিছু ক‌ইতো না ।
তুমি সব জানতে আমি জানি আনারের মা ।
কি করমু কন আম্মা চোখ কান বন্ধ ক‌ইরা তো হাঁটাচলা করা যায় না। তয় মুখ বন্ধ ক‌ইরা থাকা যায় ।
হেরা তাকিয়ে বলল, বাহ্ দারুন কথা বললে তো ,মুখ বন্ধ ক‌ইরা থাকা যায় !
আম্মা মুখ বন্ধ ক‌ইরা না থাকলে উপায় আছে কন ? তারা হ‌ইলো আত্মীয় মানুষ স্যারের।
তোমার একটা জিনিস আমার ভালো লেগেছে আনারের মা বীথি আপুর কথা তুমি আমাকে আগ বাড়িয়ে আগে বলোনি । তুমি চাইলেই আমি এই বাড়িতে আসার পরেই বলতে পারতে । বললেই বা কি হতো ?
আম্মা যে ঘটনা পার হ‌ইয়া গেছে আপনে আসার বহু আগে তা আপনেরে ক‌ইয়া আমার কি লাভ হ‌ইতো কন ?
সেটাই ,কথা টা ভালো লাগলো আনারের মা । এই বাড়িতে তুমি, আর এলিন, নাহিন ছিলে বলে আমি কত কিছু যে শিখতে পেরেছি জানো।
আম্মা আমি মুর্খ মানুষ আমি কি শিখামু আফনারে কন !
পৃথিবীতে কার কাছ থেকে কখন কি শিখা যায় এইটা কে জানে বলো ?
আনারের মা হাসছে হেরার কথা শুনে।‌

অনেক দিন পর ন‌ওশাদ রাতের বেলা হেরার সঙ্গে বারান্দায় এসে বসেছে। হেরার পরীক্ষা আর ন‌ওশাদ দেশের বাহিরে থাকার জন্য নিজেরা বসে যে একটু গল্প করবে সেটাও হয়ে উঠেনি।
হেরা বারান্দায় গোলাপের কিছু গাছ লাগিয়েছিল ন‌ওশাদ বিরক্ত হয়েছিল মনে মনে শুধু শুধু গাছ গুলো লাগিয়েছে ফুল টুল কিছুই হবে না। কিন্তু আজ বেশ কিছু দিন পর বারান্দায় এসে দেখে সত্যি ছাদ ভরে আছে গোলাপে। ন‌ওশাদ মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে আছে।
হেরা কফির মগ হাতে পাশে এসে বসতেই ন‌ওশাদ বলে উঠলো, তুমি তো দারুন কাজ করেছো ছাদটাকে তো সম্পূর্ণ বদলে ফেলেছো ! গোলাপ গুলো দেখে মনটা ভালো হয়ে গেল।
হেরা হেসে বলল, আমি কিছুই করিনি যা করার নতুন মালি করেছে। লোকটা খুব আগ্রহ নিয়ে কাজটা করে। আসলে ফুল নিয়ে আমার ‌ও খুব একটা আগ্রহ ছিল না কিন্তু লোকটা এত যত্ন নিয়ে সব করছে দেখেই ভালো লাগে। পিছনের লনের খুব সুন্দর ফুল ফুটেছে একবার গিয়ে দেখবেন।
আজ বাসা এত খালি কেন হেরা ?
দুই বোন ওদের নানু বাসায় গেছে ওখানে ওদের আত্মীয় স্বজনদের কোন গেট টুগেদার আছে। জানেন আজকে আমার কি মনে হচ্ছিল?
কি?
এই দুই বোন যদি এই বাসায় না থাকতো আমি সত্যি খুব একা হয়ে যেতাম।
আমি সেজন্যই তো ওরা থাকবে শুনে খুশি হয়ে ছিলাম। একটা নতুন পরিবেশে তুমি এসেছিলে সমবয়সী দুজন মানুষ থাকলে ভালো লাগবে ভেবেছিলাম এবং তোমরা দারুন আছো সেই থেকে।
ওদের কাছে আমি সত্যি কৃতজ্ঞ ওরা আমাকে চলতে ফিরতে অনেক কিছু শিখিয়েছে।
আল্লাহর কাছে শুকরিয়া ওরা যদি এ যুগের ওভার স্মার্ট মেয়েদের মত হতো, অস্থির মানসিকতার হতো তাহলে তো আমার ব‌উকে সেরক‌মই বানিয়ে ফেলতো । তাহলে আমার কি অবস্থা হতো ন‌ওশাদ কফির মগে চুমুক দিতে দিতে বলল ?
হেরা হেসে দিলো সত্যি ই কি ওদের মধ্যে কিছুটা অস্থিরতা নেই ? আপনি জানেন না ওরা কতটা অস্থির কিন্তু আমি মনে হয় বেশি বুঝদার তাই অস্থিরতা গুলো না নিয়ে ভালো বোধ গুলোই বেছে নিয়েছি ।
তাই কেমন অস্থির ওরা ?
বাদ দিন ! হেরা হেসে বলল।
ন‌ওশাদ হেরার হাত ধরে বলল, শুনি না কেমন অস্থির ?
এই ধরুন ওরা বীথি আপুর বিষয়টা নিয়ে আমাকে আগে থেকেই খুব প্রেসার দিতো ভাইয়া কে বলো দাও বৌমনি, তুমি উত্তর দাও না কেন? এই করো তাহলে আচ্ছা জবাব দেয়া হবে এসব বলতো ।এটা অস্থিরতা নয় ? তারপর যখন যা খুশি করছে !
ন‌ওশাদ হাসলো শুধু তারপর বলল, তুমি তোমার মত থাকো তাহলেই হবে।
আমি আমার মতোই আছি।
আজ বাসায় ফিরে মনে হলো তুমি কিছু একটা নিয়ে চিন্তায় ডুবে আছো হেরা ?
হেরা উঠে এসে ন‌ওশাদের ঘাড়ে জড়িয়ে ধরলো তারপর কানের কাছে ফিসফিস করে বলল, আমি আপনাকে একটা কথা বলতে চাইছি কিন্তু আমি চাই কথাটা আপাতত আমার আর আপনার মাঝেই থাকুক আপনি কারো কাছে বলবেন না ।
ন‌ওশাদ খুব অবাক হলো ! কি কথা হেরা ?
হেরা ফিসফিস করে বলল, আমার মনে হচ্ছে আমি কনসিভ করেছি ।
ন‌ওশাদ ঘাড় ঘুরিয়ে হেরার দিকে তাকালো , শিওর হেরা ?
আমার মন বলছে ।
মন বললে তো হবে না শরীর কি বলছে সেটা বুঝতে হবে ।
সব মিলিয়ে আমার ধারণা ঘটনা সত্যি ঘটেছে ।
চলো তাহলে ডাক্তারের কাছে যাই ।
আর কয়েকটা দিন যাক তারপর যাই । আপনি কিন্তু কাউকে কিছু বলবেন না।
কাউকে কিছু না জানানোর পিছনে কারণ কি হেরা ? তুমি কি আবার ভাবছো কেউ তোমার ক্ষতি করবে?
না সেরকম কিছু না ,আমার খুব ভয় হচ্ছে সবাই জানবে আবার যদি খারাপ কিছু হয় তখন আবার সবাই মন খারাপ করবে আমাকে স্বান্তনা দিবে আমার তখন অনেক কষ্ট হয়।
ন‌ওশাদ হেরাকে বুকে টেনে নিয়ে বলল, কিছু হবে না এবার । ইনশাআল্লাহ সব ঠিক থাকবে । ঠিক আছে আমি কাউকে কিছু বলব না কিন্তু ডাক্তারের পরামর্শ তো নেয়া উচিত মিলার সঙ্গে কথা বলো ।
আমি ভাবির কাছ থেকে আগেই জেনে নিয়ে ছিলাম কেমন সতর্কতা নিয়ে চলতে হবে । এই মাসটা সেভাবেই থাকি তারপর ডাক্তারের কাছে যাব।
ঠিক আছে।
ন‌ওশাদ হেরার হাত ধরে বলল, আমার মনটা কোন কারণ ছাড়াই খুব খারাপ ছিল আজ তুমি এত খুশির একটা খবর দিলে আমার মন ভালো হয়ে গিয়েছে হেরা।
আমি সারাদিন বসে চিন্তা করলাম কাউকে বলব না এখন আমরা।
আচ্ছা তোমার কথাই মেনে নিলাম কেউ জানবে না।

হেরা ন‌ওশাদকে ছাড়া এই খবর আর কাউকে বলেনি। এমনকি এলিন, নাহিনকেও না। খুব সাবধানে হাঁটাচলা করছে। ক্লাস ছাড়া বাসার বাহিরে যাচ্ছে না। এমনকি সিঁড়ি পর্যন্ত উঠানামা কমিয়ে দিয়েছে। নাহিনরা দুই বোন সেমিষ্টার ফাইনাল দিয়ে ওদের বাবা-মা সহ দেশের বাহিরে ঘুরতে গিয়েছিল এসেই কোন আত্মীয়ের বিয়েতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে তাই ওদের চোখে পড়েনি হেরার হঠাৎ করে সংকুচিত দৈনন্দিন জীবন।
শুধু আনারের মা একদিন বলেই ফেলল, আম্মা আপনার কি খবর আছে কিছু ?
হেরা আনারের মায়ের হাত ধরে বলল তুমি আমার জন্য দোয়া করো আর আমি চাইছি না কেউ জানুক এখুনি ।
আনারের মায়ের চোখের কোন ভিজে উঠলো আম্মা আমি আল্লাহর কাছে খুব দোয়া করছিলাম আল্লাহ যেন আপনার কোল তাড়াতাড়ি ভ‌ইরা দেয়। আল্লাহ আমার ডাক শুনছে আমি খুব খুশি। আপনে চিন্তা ক‌ইরেন না আমি কাউরে কমু না। আমি ঐদিন দেখলাম স্যার আপনারে ধ‌ইরা ধ‌ইরা সিঁড়ি দিয়া তুলে তখন‌ই মনডা ক‌ইলো এই কথা। আল্লাহ ভরসা আম্মা চিন্তা ক‌ইরেন না সব ঠিক থাকব । কারো খারাপ নজর লাগব না।
হেরার চোখ ও ভিজে উঠেছে।
হেরার কনসিভ করার কথা শুনে ন‌ওশাদ যথেষ্ট চিন্তিত। গত এক মাস ধরে অনেক চিন্তা করে সে একটা কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়েছে কথাটা হেরাকে সে বলেনি । কিভাবে বললে হেরা সহজ ভাবে বুঝবে সেটাই চিন্তা করছে।
সেদিন রাতে হঠাৎ ঘুম ভেঙ্গে গেলে তাকিয়ে দেখে হেরা বিছানায় হেলান দিয়ে বসে আছে। মুখ দেখেই বুঝেছে খুব টেনশনে আছে ।
ন‌ওশাদ উঠে মাথায় হাত রেখে প্রশ্ন করলো খারাপ লাগছে তোমার?
শরীর ঠিক আছে কিন্তু মনটা খারাপ লাগছে ।
কেন?
আজ সকালে যখন আপনি চলে গেলেন তখনই এত একা লাগা শুরু হলো তারপর থেকে কিছুই ভালো লাগছিলো না।
এখন তো আমি সঙ্গে আছি তাহলে কেন খারাপ লাগছে তোমার?
না ভাবছি আপনি দেশের বাহিরে গেলে কিভাবে থাকব ? এই নয় মাসে আপনি বাহিরে তো অবশ্যই যাবেন কাজ তো ফেলে রাখতে পারবেন না তাই না তাহলে ?
ন‌ওশাদ হেরাকে কাছে টেনে বলেছে আমি কোথাও যাচ্ছি না। তোমাকে চিন্তা করতে হবে না।
কিন্তু তারপর থেকে ন‌ওশাদ খুব টেনশন করছে কারণ এলিন, নাহিনের বাবার ঢাকায় পোস্টিং হয়েছে ওরাও ওদের বাসায় চলে যাবে কিছুদিনের মধ্যে । হেরা এই নাজুক শারীরিক মানসিক অবস্থায় সারাদিন বাসায় থাকবে কিভাবে একা !
বুবুকে এই মুহূর্তে দেশেও আনা যাবে না কারণ দুলাভাই পায়ে ব্যথা পেয়েছে বুবু এখন কিভাবে আসবে ? সব কিছু চিন্তা করে ন‌ওশাদ অস্থির কয়েকদিন থেকে।
কয়েকদিন হয়েছে সবাই জেনেছে খবর টা। নিশালকে বলা হয়েছে, ওর এখন পরীক্ষা চলছে। এইচএসসি পরীক্ষা শেষ হলে ওকে চলে আসতে হবে বাসায়।
সব মিলিয়ে ন‌ওশাদ ডিসিশন নিয়েছে হেরাকে বুবুর কাছে ফ্লোরিডায় রেখে আসবে। ওর আর নিশালের ভিসা করাই আছে । সে একা হেরার খেয়াল রাখতে পারবে না। ইদানিং তার কাজের চাপ বেড়েছে। সবচেয়ে বড় কথা খালি একটা বাসায় রেখে সারাদিন অফিসে কিংবা কখনও কখনও ঢাকার বাহিরে, দেশের বাহিরে টেনশন ফ্রি হয়ে থাকতে পারবে না সে। হেরার ও মানুষের মাঝে থাকলে ভালো লাগবে। তাই সবচেয়ে ভালো হয় বুবুর ওখানে গিয়ে থাকলে। বুবুও বলল, তুই শুধু নিয়ে আয় ওকে বাকি দ্বায়িত্ব আমার।
শুধু এই দীর্ঘ সময় ফ্লাইটে জার্নি করার উপযোগী সময় এলেই ন‌ওশাদ হেরাকে নিয়ে বুবুর কাছে দিয়ে আসবে। নিশালের পরীক্ষা শেষ থাকবে ততদিনে, তখন নিশাল‌ও যেতে পারবে তার মামনির সঙ্গে।
কিন্তু এই কথাটা হেরাকে বুঝিয়ে বলতে হবে, ওকে মন থেকে রাজি করাতে হবে। সে জানে সে বললেই হেরা কোন কথা বলবে না যাওয়ার প্রস্তুতি নিবে কিন্তু ন‌ওশাদ চায় হেরা মন থেকে রাজি হোক। কোন রকম কষ্ট মনে নিয়ে হেরা ওর সঙ্গে এই দীর্ঘ সময়ের দূরত্ব টা মেনে নিক এটা সে চায় না ।‌সকল পরিস্থিতি বিবেচনায় সে রাজি হোক এটাই সে চায়।
হেরাকে বোঝানোর আগে নিজেকেই বোঝাতে তার কেমন যেন কষ্ট হচ্ছে।
দিন গুলো কিভাবে পরিবর্তন হয়ে গেল তাই না? একটা সময় সে মেয়েটিকে নিজের জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে তীব্র দ্বিধায় ভুগেছে আজ সেই মানুষটাকে কিছুদিনের জন্য নিজের থেকে দূরে করতে কত কষ্ট হচ্ছে । মনে হচ্ছে চারপাশ টা সত্যিই অনেক অন্ধকার হয়ে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে দিন গুলো ওর কাটবে কিভাবে?
বাসায় ফিরে খালি ঘরে কিভাবে সে থাকবে? বাসাটা আগের মত চুপচাপ হয়ে যাবে। অফিস থেকে ফিরে হেরার হাসি মুখটা দেখে স্বস্তি পাওয়া একটা অভ্যাস হয়ে গিয়েছিল গত দুটো বছরে, কিন্তু কয়েক মাসের জন্য দূরে থাকাটা এখন এত কষ্টের এত যন্ত্রণার হবে ন‌ওশাদ ভেবেই শক্তিহীন হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু তাকে হাসি মুখে কাজটা করতে হবে । হেরার জন্য ওদের অনাগত সন্তানের ভালোর জন্য।

( চলবে)

#তবু_সুর_ফিরে_আসে

৪৫ পর্ব

ন‌ওশাদ এখন আর ছুটির দিনে গলফ খেলতে যায় না। ছুটির দিন পুরো সময়টা বাসায় থাকার চেষ্টা করে। হেরার শরীর খারাপ । খেতে পারে না কিছুই। মিলা দুই একদিন পর পর এসে দেখে যায়। ন‌ওশাদ এখনো তার সিদ্ধান্তের কথা হেরাকে বলেনি।
দুপুরের খাওয়ার পর হেরা কি একটা ম্যাগাজিন উল্টে পাল্টে দেখছে শুয়ে শুয়ে। ন‌ওশাদ পাশে শুয়ে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ।
হেরা ম্যাগাজিনের পাতা উল্টাতে উল্টাতে বলল, কিছু বলবেন?
আমি একটা কথা অনেক চিন্তাভাবনা করে ঠিক করেছি ভাবছি তোমাকে কিভাবে বলি ?
হেরা ম্যাগাজিন টা পাশে সরিয়ে রেখে অবাক হয়ে তাকালো ন‌ওশাদের দিকে !
কি কথা নিশালের পাপা ? আপনি আমাকে বলতে এত চিন্তা করছেন !
হ্যাঁ । তার আগে বলো প্লিজ তুমি কথাটা শুনে মন খারাপ করবে না হেরা ।
তাড়াতাড়ি বলেন আমার টেনশন হচ্ছে।
ন‌ওশাদ উঠে বসে হেরার হাত ধরলো , আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি তোমাকে বুবুর কাছে রেখে আসব ।
মানে , হেরা বিস্ময় ভরা চোখে তাকিয়ে আছে !
এই সময়টা তুমি বুবুর কাছে থাকবে আমি তোমার যত্ন ঠিক ভাবে নিতে পারব না আমার সেরকম অভিজ্ঞতা নেই হেরা। নিশাল হ‌ওয়ার সময় আম্মা বেঁচে ছিল, গীতির মা ছিল , গীতির বোনরা এসে থাকতো আর গীতি নিজেও যথেষ্ট বুঝতো এসব বিষয় । আমার গীতিকে নিয়ে ভাবতে হয়নি । কিন্তু তোমার এবং আমার কেউ নেই হেরা তাই বলছি তুমি বুবুর কাছে থাকলে আমি নিশ্চিন্তে থাকব দেখবে তোমার ও ভালো লাগবে ।
কিন্তু আপনি তো এখানে থাকবেন আপনাকে ছেড়ে আমি ওখানে কিভাবে থাকব ? হেরার চোখ দিয়ে পানি পড়া শুরু হয়ে গেল ।
এই দেখো কান্না শুরু হয়ে গেল তোমার , ন‌ওশাদ হেরার চোখের পানি মুছিয়ে দিতে দিতে বলল।
বাড়ি ভর্তি লোকজন আপনি আছেন এখানে তাও আমি ভালো থাকব না ?
আমি তো সারাক্ষণ তোমার সঙ্গে থাকতে পারব না আবার কয়দিন পর পর দেশের বাহিরে যেতে হচ্ছে । আমার কথাটা বোঝার চেষ্টা করো আমি চাই সারাক্ষণ তুমি একজন দ্বায়িত্বশীল কারো কাছে থাকো । বুবুর চেয়ে ভালো আর কেউ নেই আমার হেরা।
কিন্তু আমার তো ইচ্ছে আপনার কাছে থাকি ।
দেখো এখন তো আর যেতে পারবে না যেতে হবে চার মাস কমপ্লিট হলে । আমি গিয়ে দিয়ে আসব। থাকব সপ্তাহ দুই । তারপর বেবি হ‌ওয়ার এক মাস আগেই তোমার কাছে চলে যাব । মাঝখানে দুটো মাস তুমি আমাকে ছাড়া থাকবে আমি চেষ্টা করবো এর মধ্যে একবার গিয়ে সপ্তাহ খানেক থেকে আসতে।
আমার জান আমি তোমার জন্য আর বাচ্চা টার কথা চিন্তা করেই সিদ্ধান্ত টা নিয়েছি। আর তোমার সঙ্গে নিশাল থাকবে । যখন ইচ্ছা হবে তোমার, আমরা ভিডিও কলে কথা বলব । দেখবে চোখের পলকে দিন কেটে যাবে ,ন‌ওশাদ হেরাকে জড়িয়ে ধরে বলল।
এই দেশে বুঝি মানুষের বাচ্চা হয় না !
হয় আমি চাইছিলাম আমার বাচ্চা ওখানে হোক সবচেয়ে বড় কথা আমি খুব টেনশনে আছি একা একা তোমাকে বাসায় রেখে। কিসের টেনশন বলতে পারব না তোমাকে বুঝিয়ে হেরা।
ঠিক আছে কবে যেতে হবে ?
এখনো দেরি আছে আরো এক মাস । তোমার চার মাস শেষ হলে।
হেরার খুব খুব মন খারাপ হলো কিন্তু সে ন‌ওশাদের সিদ্ধান্ত মেনে নিলো। সে জানে ওর ভালো ন‌ওশাদের চেয়ে বেশি আর কেউ জানে না।
ন‌ওশাদ হেরাকে আদর দিয়ে বলল, মন থেকে রাজি হয়েছো তো ?
মন খারাপ হয়েছে কিন্তু আমি জানি আপনি যা ঠিক তাই করবেন ।
প্লিজ কাঠবিড়ালী মন খারাপ করো না। বেবিটা হ‌ওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমরা চারজন চলে আসব এখানে। তখন দেখবে এই বাসাটা আনন্দে ভরে থাকবে। তখন নিশাল‌ও থাকবে বাসায় । বাচ্চাদের নিয়ে আমরা অনেক ভালো থাকব ইনশাআল্লাহ।
হেরা ন‌ওশাদের বুকে মাথা রেখে বলল, আপনি পারবেন আমাদের থেকে দূরে থাকতে ?
পারতে হবে আমাকে । আমাকে নিয়ে চিন্তা করো না তুমি ,আমি অফিসের ব্যস্ততায় মন খারাপ হ‌ওয়ার কথা ভুলেই যাব ।
আর যখন বাসায় আসবেন , এই ঘরে একা থাকবেন তখন?
ন‌ওশাদ দুই সেকেন্ড চুপ থেকে বলল, তখন তোমাকে ভিডিও কল দিব । গল্প করব ভিডিও কলে।
যদিও এখন হাসছে ন‌ওশাদ কিন্তু ওর নিজের‌ই খারাপ লাগছে সেই সময়টার কথা চিন্তা করে।

কয়েকদিন পর নিশাল এইচএসসি পরীক্ষা শেষ করে ফাইনালি ক্যাডেট কলেজ থেকে চলে এলো। সেদিন ন‌ওশাদ খুব খুশি হলো। এখন থেকে তার ছেলে তার কাছে থাকবে সব সময়। আর সে ছেলেকে চোখের আড়াল হতে দিবে না।
রাতে ডিনারের সময় ন‌ওশাদ নিশালকে জিজ্ঞেস করলো এখন কি প্ল্যান বাবা ?
পাপা যেহেতু আর্মিতে যাচ্ছি না তাহলে তোমার মত আর্কিটেক্ট হলে কেমন হবে ?
আমার মতো কেন ?
পাপা ইউ আর মাই আইডল আমি তোমার মত হতে চাই । তুমি নিজের চেষ্টায় নিজেকে কোথায় নিয়ে এসেছো আমি তোমার মত না পারি চেষ্টা তো করতেই পারি ! এক্সকিউজ মী , বলে নিশাল হাত ধোয়ার জন্য উঠে গেল।
ন‌ওশাদ কখনো ভাবেনি নিশাল কোনদিন তাকে এই কথা বলবে , সে ছেলের আইডল। এটা তার কাছে যে কত বড় একটা পাওয়া সে কল্পনাও করতে পারছে না ! ওর চোখ ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে।
হেরা খেতে খেতে খেয়াল করলো ন‌ওশাদের চোখ ভিজে গেছে । সে উঠে এসে ন‌ওশাদের পাশে ঝুঁকে গালের সঙ্গে গাল লাগিয়ে বলল, দেখলেন তো ছেলে কতটা ভালোবাসে আপনাকে । তার জীবনে আপনার স্থান কোথায় ! শুধু শুধু একটা সময় মন খারাপ করতেন আপনি ।
ন‌ওশাদ বাম হাত দিয়ে চোখের পানি মুছলো তারপর হেরার দিকে তাকিয়ে হাসলো।
খাওয়া শেষে নিশাল লিভিং রুমে বসে টিভি দেখছে।
হেরা এলিন, নাহিন এসেছে ওদের সঙ্গে গল্প করছে ।
ন‌ওশাদ পাশে বসতেই নিশাল বলে উঠলো, পাপা জিসান ভাইয়ার বিয়ে আমি কি যাব ? রিসান আমাকে বারবার বলছে যাওয়ার জন্য ।
অবশ্যই যাবে বন্ধুর ভাইয়ের বিয়েতে যাবে এটা তো ভালো কথা। আমাকেও কার্ড নিয়ে নিজে এসে বলে গেছে মেহবুব ভাই । যুথীও বারবার বলছে।
পাপা তুমি আর মামনি যাবে না ?
আমি সিঙ্গাপুর যাচ্ছি একটা কাজে আসব কবে তার উপর নির্ভর করবে, আর তোমার মামনি আমাকে ছাড়া যাবে এই অবস্থায় মনে হয় না। কিন্তু তুমি যাও মজা করো বাবা।
হেরা এসে পাশে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞাসা করলো কার বিয়েতে যাওয়ার কথা হচ্ছে?
তুমি চিনো হেরা যুথীর বড় ভাসুরের ছেলে জিসানের বিয়ে । ছোট ছেলে রিসান তো নিশালের ফ্রেন্ড তাই বলছি, আমরা যাই না যাই ও যাক।
আপনি যাবেন না ?
আমি সিঙ্গাপুর যাচ্ছি পরশু দিন, আসব কবে তো এখনো শিওর না এমন‌ও হতে পারে বিয়ের পরদিন আসছি । তুমি তো আবার আমাকে ছাড়া যাবে না। নিশাল যাক আমাদের পক্ষ থেকে আমি আসলে তখন আমরা গিয়ে একদিন ব‌উ দেখে আসব।
আমি কোন বিয়েতে যাব না এত মানুষের মধ্যে গেলে আমার দম বন্ধ হয়ে আসবে এখন, হেরা বলে উঠলো।
পাপা জানো গায়ে হলুদ হবে একটা রিসোর্টে সারাদিন খুব হৈচৈ হবে রং খেলা হবে।
আজকাল তো তাই দেখছি হলুদের অনুষ্ঠান একেকজন একেক রকম করার চেষ্টা করে ।
কোথায় রিসোর্ট টা ?
পাপা কাছেই পুবাইল এর দিকে ।
ঠিক আছে তুমি বন্ধুদের সঙ্গে ফান করো আবার তোমাকে মামনির সঙ্গে ফুপির ওখানে গিয়ে থাকতে হবে বাবা।
সমস্যা নেই পাপা তুমি চিন্তা করো না আমি এবার খেয়াল রাখবো মামনির।
হেরা নিশালের গাল টিপে বলল, আমার মুরুব্বি আসছে তাই না ?
হুম তোমাকে আমার কথা শুনতে হবে মামনি।
আচ্ছা আচ্ছা শুনব।
ন‌ওশাদ হাসছে ওদের দেখে।

পরের সপ্তাহে ন‌ওশাদ সিঙ্গাপুর চলে গেল। হেরা কনসিভ করার পর এই প্রথম ন‌ওশাদ দেশের বাহিরে গেল। হেরার সত্যি খুব খারাপ লাগছে রাতে একা ঘুমাতে, কিন্তু সে ন‌ওশাদ যখন ফোন দিয়েছে কিছুই বলেনি। বলল, সব ঠিক আছে। নিশাল বন্ধুদের সাথে বাহিরে গিয়েছিল যথা সময়ে চলে এসেছে। ন‌ওশাদ নিশ্চিন্ত মনে ‌ফোন রেখেছে।
কিন্তু হেরার সারারাত ঘুম হলো না। ভোরের দিকে ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে গেল।
এভাবে তিন রাত তার কাটলো। আজ সকালে ন‌ওশাদ ফোন দিয়ে ওর ঘুম ভাঙ্গালো।
এখনো ঘুমাচ্ছো যে , রাতে জেগে ছিলে ?
হুম ঘুম আসছিল না ঘুম ঘুম কন্ঠে বলল হেরা।
ঠিক আছে তাহলে ঘুমাও আমি এসে ঘুম ভাঙ্গাচ্ছি !
কি আপনি চলে এসেছেন হেরা অবাক হয়ে বলল!
এখনও আসিনি আজ বিকেলে র‌ওনা হব ঢাকা পৌঁছাতে পৌঁছাতে সন্ধ্যা পার হয়ে রাত হয়ে যাবে।
ঠিক আছে।
ফোন রেখে হেরা উঠে বসলো ন‌ওশাদ আজ আসছে শুনেই ওর মন ভালো হয়ে গেল।
ফ্রেশ হয়ে ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে দেখে আনারের মা ঘর গোছাচ্ছে। ওকে দেখে বলল,
আম্মা যুথী খালাম্মা আসছে ?
হেরা মাথার চুল ঠিক করে নিজের ঘর থেকে বের হয়ে দেখে যুথী দোতলায় লিভিং রুমে বসা।
সুন্দর করে সেজে আসছে, এই সকালে সাজ গোজের কারণ আজ ওর ভাসুরের ছেলের গায়ে হলুদ।
হেরা কাছে যেতেই বলল, তুমি তো যাচ্চো না হলুদে হেরা ।
আপু আপনার দুলাভাই নেই আর আমার শরীটাও ভালো না । পরশু বিয়ে তো আপনার দুলাভাই যাবে বিয়েতে।
হেরা তুমি কনসিভ করেছো শুনলাম ।
জ্বি আপু।
আম্মা ফোনে বলল !
জ্বি মা সেদিন ফোন দিয়েছিল তখন বললাম খবরটা উনাকে।
শুনলাম চার মাস তোমাকে দেখে তো বোঝাই যাচ্ছে না !
হেরা এই কথার কি উত্তর দিবে বুঝতে পারছে না ! সে নিজেও কিছুটা অবাক হয় নিজেকে দেখে আগের মতই আছে সে দেখতে। লজ্জা লাগছে তাই মিলাকে কিছু প্রশ্ন করেনি এ ব্যাপারে।
আনারের মা আর রানু ট্রে তে করে চা নাস্তা নিয়ে এলো।
যুথী বলল আমি শুধু চা খাব আর কিছু না আনারের মা নিশালকে গিয়ে বলো তাড়াতাড়ি রেডি হতে ।
হেরা প্রশ্ন করল, নিশাল আপনার সঙ্গে যাচ্ছে ?
হ্যাঁ ওকে নিতেই এলাম ।
ও আচ্ছা।
নিশাল একটা ব্যাগে করে কিছু কাপড় গুছিয়ে নীল রঙের পাঞ্জাবি সাদা সেলোয়ার পড়ে নিজের রুম থেকে বের হয়ে এলো।
হেরাকে দেখে বলে উঠলো, মামনি আমি যুথী খালামনির সঙ্গে যাচ্ছি।
গাড়ি নিবে না বাবা ?
ওর আবার আলাদা করে গাড়ি নিতে হবে কেন হেরা , আমার সঙ্গে যাচ্ছে আমার সঙ্গে আসবে রাতে , যুথী বলে উঠলো।
না তারপরও গাড়ি আর ড্রাইভার সঙ্গে থাকলো কখন দরকার হয়।
মামনি ওখানে গাড়ি লাগবে না আমার, তুমি চিন্তা করো না তো। বলেই নিশাল আবার কিছু একটা আনতে নিজের ঘরে চলে গেল।
হেরা বলল, আপু আপনার দুলাভাই নিশালকে একা ছাড়তে না করেছে ড্রাইভার থাকলে উনি নিশ্চিন্তে থাকে।
হেরা নিশাল কে নিয়ে তোমার এত টেনশন করার দরকার নেই তুমি আসার আগে আমরা ওর খেয়াল ঠিক ভাবেই রেখেছি। ও তো ফিডার খাওয়া বাচ্চা না তাই না ? তুমি তোমার পেটে যে আছে তাকে নিয়ে থাকো আমি যতক্ষন আছি নিশালের মা হ‌ওয়ার দরকার নেই তোমার।
যুথীর খোঁচা দেয়া কথাটা শুনেই সঙ্গে সঙ্গে হেরার চোখে পানি এসে গেল। সে অন্য দিকে ফিরে চোখের পানি আটকালো।
আনারের মা হেরার দিকে তাকিয়ে আছে। অসহায় চোখে দেখছে সে হেরাকে।
খালাম্মা স্যার ভাইয়া একা কোথাও গেলে রাগ হয় তাই আম্মা ক‌ইতাছে আরকি।
একা কোথায় নিশাল আমার সঙ্গে যাচ্ছে ? তোমাদের আদিখ্যেতা দেখলে অবাক হ‌ই ছেলেটাকে বড় হতে দিবে না। কয়দিন পর ভার্সিটিতে যাবে নাকি সেখানেও দুলাভাই গিয়ে বসে থাকবে !
নিশালকে আসতে দেখে যুথী চুপ করে গেল। তোমার হয়েছে নিশাল আমাদের দেরী হয়ে যাচ্ছে ।
হ্যাঁ চলো খালামনি ।
মামনি পাপার মেসেজ এসেছিল, পাপার ঢাকায় আসতে রাত হবে আমরা তার আগেই চলে আসব তুমি সাবধানে থেকো ।
আমি সাবধানে থাকব তুমি নিজের খেয়াল রেখো বাবা।
নিশাল তার পাপার মতোই সুন্দর একটা হাসি দিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামছে।
হঠাৎ পিছন ফিরে বলল, তোমাকে নিচে আসতে হবে না মামনি ।
এসো তো নিশাল তোমার মামনি নিজের ভালোটা জানে আমাদের দেরী হয়ে গেছে তোমার খালু বারবার ফোন দিচ্ছে , যুথী নিশালকে তাগাদা দিতে দিতে নেমে গেল।
আনারের মা সিঁড়ির কাছে দাঁড়িয়ে বলল, আম্মা মন খারাপ করিয়েন না তো নানি এদের দুই ব‌ইনের মুখে জন্মের পর মধু দিতে ভুইলা গেছে তাই মুখ দিয়া ভালা কথা ক‌ইতে তাগোর কষ্ট হয়।
হেরা আনারের মায়ের কথা শুনে হেসে দিলো।
তোমার স্যার আসবে রাতে বুয়াকে বলো স্যারের জন্য মাছের কোন আইটেম রান্না করতে ।
আপনে কি খাইবেন বলেন আপনে তো খাননা কিছু।
তোমার স্যার যা খাবে তাই খাব ।
কন তো পরে তো দেখি কিছুই খাইতে পারেন না। পরে কিন্তু অসুস্থ হ‌ইয়া পড়বেন আম্মা।
হেরা আনারের মায়ের কথার উত্তর না দিয়ে নিজের ঘরে ঢুকে গেল।
আজ সারাদিন সে একা বাসায়। শ্বশুর আছে আর কেউ নেই। এলিন, নাহিন ওর আম্মুর কাছে । ওরা ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়েছে বসুন্ধরায় ওর আব্বু চলে এসেছে ঢাকায়। সব জিনিস এখনো নিয়ে যায় নি এই বাসা থেকে আস্তে আস্তে নিচ্ছে। বাসা গোছানো চলছে ওখানে।

সন্ধ্যায় হেরা সুন্দর দেখে একটা সেলোয়ার কামিজ বের করে পড়লো। চার পাঁচ দিন আগে সুমনা এসেছিল ওকে দেখতে । এক গাদা আচার নিয়ে এসেছিল। আর বেশ অনেক গুলো কামিজ এগুলো নাকি মেটার্নিটি কামিজ, হেরাকে বলল সঙ্গে নিয়ে যেতে ফ্লোরিডা, ওর কাজে লাগবে।
হেরা অবাক হয়ে বলল, ভাবি আমি আচার খেতে পারি না!
সমস্যা নেই ন‌ওশাদকে খেতে দাও ও পছন্দ করে। বাবা মা একজন খেলেই হলো বলেই অনেক হাসলো সুমনা।
সুমনা বলল, ন‌ওশাদ বেস্ট ডিসিশন নিয়েছে তোমাকে ওখানে পাঠানোর। এই সময় তোমার কেয়ার দরকার এই বাসায় কোথায় এসব?
ভাবি আমি জানি কেয়ার টেয়ার কিছু না উনি বীথি আপুর ঐ ঘটনায় ভয় পেয়েছেন যার জন্য আমাকে এখানে রাখতে চাইছেন না।
তুমি তো তাহলে বুঝেছো মন খারাপ করে থেকো না হেরা।
আমি ঠিক আছি খারাপ লাগছে এটা ভেবে উনি একা থাকতে পারবেন তো ?
পারবে তুমি চিন্তা করো না ।
হুম হেরা দীর্ঘ শ্বাস ফেলল।
হেরা এর মাঝে দুই বার নিশালের সঙ্গে ফোনে কথা বলেছে প্রোগ্রাম সন্ধ্যায় শেষ হবে তারপর সবাই এক সঙ্গে ফিরবে ঢাকায়।
রাত নয়টার দিকে হেরাকে ফোন দিলো আরমান । তখন হেরা ন‌ওশাদের আসার অপেক্ষায় বসে আছে। যেকোনো সময় উনি এয়ার পোর্টে ল্যান্ড করে ফোন দিবে ওকে। ড্রাইভার চলে গেছে এয়ার পোর্টে।
হেরা আরমানের ফোন দেখে অবাক হলো না কারণ প্রায় সময়ই শ্বশুরের খোঁজ নিতে হেরাকে ফোন দেয় আরমান।
ফোন রিসিভ করে হ্যালো বলতেই ওপাশে আরমান বলল,
ভাবি তুমি কি বাসায়?
হ্যাঁ ভাইয়া আপনার ভাইয়া তো একটু পরেই চলে আসবে অপেক্ষা করছিলাম।
ও আচ্ছা।
ভাবি তুমি নার্ভাস হয়ে যেও না কাউকে নিয়ে একটু এপ্যোলো তে আসো নিশালের একটা এক্সিডেন্ট হয়েছে ।
হেরা চিৎকার দিয়ে উঠলো ভাইয়া কি হয়েছে নিশালের !
এই যে নার্ভাস হয়ে যাচ্ছ আমরা সবাই এখানে আছি তুমি আসো কিছু হয়নি তেমন ।
না আপনি আমাকে সত্যি কথা বলেন নিশালের সঙ্গে কথা বলতে দেন।আমি নিশালের সঙ্গে কথা বলব।
হেরা চিৎকার করতে করতে নিজের ঘর থেকে বের হলো।
ভাবী নিশাল ঠিক আছে ফরহান আছে ওর সঙ্গে প্লিজ তুমি এভাবে চিৎকার করো না।
হেরার কান্না আর চিৎকার শুনে দৌড়ে উপরে উঠে এলো আনারের মা।
আম্মা কি হ‌ইছে ?
আনারের মা আমাকে তাড়াতাড়ি হসপিটালে যেতে হবে নিশালের এক্সিডেন্ট হয়েছে বলে হেরা কাঁদতে কাঁদতে নিচে নেমে এলো।
ও আল্লাহ গো ও আল্লাহ বলে আনারের মা পুরো বাড়ি কাঁপিয়ে আহাজারি শুরু করে দিল।
বাসার সব কাজের মানুষ ছুটে এসেছে।
হেরা গাড়িতে উঠতে উঠতে বলল, আমি ওর পাপা কে কি উত্তর দিব বলো আনারের মা। উনি কিভাবে এই খবর সহ্য করবে?
হেরা পুরো রাস্তা জুড়ে দোয়া পড়তে পড়তে এলো। আনারের মা কাদছে ব্যাকুল হয়ে । জন্ম থেকে বড় করেছে নিশালকে। আজ এক্সিডেন্টের খবর শুনে কাঁদছে আর আল্লাহকে ডাকছে।
আল্লাহ আমি সিন্নি বিলামু তুমি আমার ভাইয়ারে ভালা ক‌ইরা দাও।
ভাইয়া না খালাম্মার সাথে গেল তাইলে কেমনে এক্সিডেন্ট করলো আম্মা?
আমি কিছু জানি না আনারের মা। সবুজ তাড়াতাড়ি চালাও বলে হেরা ড্রাইভার কে তাগাদা দিল।
হেরার গাড়ি হসপিটালের গেটে থামতেই শোয়েব ছুটে এসে দরজা খুলে দিল।
নিশাল কোথায় শোয়েব মামা?
মামি ওটি তে।
কত বড় এক্সিডেন্ট হয়েছে বলেন তো হেরা কাঁদতে কাঁদতে প্রশ্ন করলো।
আমি কিছু জানি না মামি, মামারা বলল, বাইক‌ এক্সিডেন্ট করেছে । যুথী খালাম্মা ফোন দিয়েছিল ফারহান মামাকে। ওর বন্ধুরা এখানে এনেছে।
হেরা অবাক হয়ে গেল শোয়েবের কথা শুনে , ও তো যুথী আপুর সঙ্গে গাড়িতে আসার কথা তাহলে বাইকে উঠলো কখন?
আমিও তো কিছুই বুঝতে পারছি না মামি, যুথী খালাম্মা নাকি আগেই চলে এসেছিল ঢাকায় জরুরি কাজ ছিল। নিশাল ওর বন্ধুদের সঙ্গে ফিরছিল।
হেরা আনারের মা ওটির সামনে এসে দেখে ফ্যামিলির সব লোকজন চিন্তিত মুখে দাঁড়িয়ে আছে। ওকে দেখে মিলা ছুটে এলো,
ভাবি তুমি এত উত্তেজিত হয়ো না নিশাল ঠিক আছে অপারেশন চলছে আল্লাহ ভরসা।
হেরা অবাক হয়ে তাকালো কত বড় এক্সিডেন্ট হয়েছে ভাবি আমাদের ছেলেটা বাঁচবে তো ? ওর পাপা মরে যাবে ছেলের কিছু হয়ে গেলে। হেরা চিৎকার দিয়ে উঠলো।
মিলা আর নাদিয়া এসে হেরাকে ধরলো।
ওর পাপাকে খবর টা দিতে হবে ভাবি !
রেজোয়ান ভাই গিয়েছে এয়ার পোর্টে ভাইয়াকে আনতে মিলা বলল।
সুমনা এসে হেরাকে জড়িয়ে ধরলো । হেরা তুমি এভাবে ভেঙে পড়লে ন‌ওশাদকে কিভাবে সামলাবে বলো ?
ভাবি আমি পারবো না উনার সামনে যেতে আপনি তো জানেন ছেলে উনার জান ! আমার কাছে রেখে গিয়েছিল আমি কি বলব উনাকে ? ছেলেটা আমার দ্বায়িত্বে ছিল।
হেরা প্লিজ আল্লাহ কে ডাকো সব ঠিক হয়ে যাবে।
যুথী, বীথি দাঁড়িয়ে আছে একটা কোনায় সঙ্গে ওদের হাজব্যান্ড। আরো অনেক লোকজন হেরা সবাইকে চিনে না । যার বাইকের পিছনে বসে ছিল নিশাল তার অপারেশন ও চলছে ওর অবস্থা নাকি খুব খারাপ। আত্মীয় স্বজন কান্নাকাটি করছে।

হেরার খুব অস্থির লাগছে কিছুক্ষণ পর চেয়ার ছেড়ে উঠে গিয়ে যুথীর সামনে গিয়ে দাঁড়ালো।
আপনি দ্বায়িত্ব নিয়ে, নিয়ে গিয়েছিলেন আমার ছেলেকে তাহলে আমার ছেলে এখন ওটিতে কেন বলেন যুথী আপু?
যুথী কিছু একটা বলতে গিয়েছিল হেরা চিৎকার দিয়ে উঠলো একটা কথাও আজ বলবেন না আপনি। আমি যখন সকালে বললাম নিশাল গাড়ি নিয়ে যাবে। আপনি বললেন আপনার সঙ্গে যাচ্ছে আপনার সঙ্গে আসবে , আমি যেন ওর মা না হ‌য়ে যাই। এই আপনার দ্বায়িত্ব জ্ঞান ?
আমার ছেলেটাকে ওখানে রেখে আপনি চলে এলেন আমাকে জানানোর প্রয়োজনও বোধ করলেন না ? আমি তাহলে গাড়ি পাঠিয়ে দিতাম ওকে বন্ধুদের সঙ্গে বাইকে আসতে হতো না । আপনি জানেন না আজকালের ছেলেরা কিভাবে বাইক চালায়?
আপনার জন্য আমার ছেলেটার আজ এই অবস্থা । ওর কিছু হয়ে গেলে আমি আপনাকে ছেড়ে দিব না মনে রাখবেন ?
আর বারবার বলেন না আপনারা দুই বোন আমি ওর মা না । আসলে আমিই ওর মা আপনারা কেউ না । কেউ হলে এভাবে ছেলেটাকে রেখে চলে আসতে পারতেন না ঢাকায়। হেরা কান্নায় ভেঙে পড়লো। ছেলেটাকে এই অবস্থায় দেখে ওর পাপার কেমন লাগবে জানেন !
সুমনা আর নাদিয়া এসে হেরাকে ধরলো।
হেরা তুমি এভাবে চিৎকার করো না তোমার নিজের ই শরীর ভালো না , সুমনা বলল।
ভাবি শান্ত হ‌ও প্লিজ এভাবে চিৎকার করা তোমার জন্য ঠিক না।
নাদিয়া হেরাকে জড়িয়ে ধরে চেয়ারে বসালো।
আরমান বলে উঠলো ভাবি ঠিক কথাই বলেছে, যুথী তুমি যখন সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলে ছেলেটাকে তোমার সঙ্গে আনলে না কেন ? আর নয়তো ভাবিকে ফোন দিলেই ভাবি গাড়ি পাঠিয়ে দিতো। ভাইয়া ছেলেকে নিয়ে কি রকম টেনশনে থাকে আমরা জানি ।বড় ভাবি মারা যাওয়ার পর থেকে নিশালের দিকে তাকিয়ে ই ভাইয়া বেঁচে আছে।
নাদিয়া বলল, নিশাল কিন্তু এই বয়সী অন্য ছেলেদের মতো অস্থির না হয়তো বন্ধুরা বলেছে তাই উঠেছে বাইকে নিজে থেকে কোন রিস্ক ওর নেয়ার কথা না।
বীথি কাঁদতে কাঁদতে বলল, তোমরা যেভাবে বলছো নাদিয়া মনে হচ্ছে আমরা ইচ্ছে করে ওকে বাইকে উঠিয়েছি !
সুমনা বলে উঠলো চুপ করবে তোমরা, ন‌ওশাদ আসছে ওর কি অবস্থা হয় দেখো তোমাদের এসব ওর সামনে শুরু করে দিও না। তবে হ্যাঁ যুথীর উচিত হয়নি নিশালকে রেখে চলে আসা।
এর মধ্যে আরমান রেজোয়ান কে ফোন দিয়ে জানলো ও ন‌ওশাদকে নিয়ে চলে আসছে হসপিটালের কাছেই এসে গেছে ওরা।

পাঁচ মিনিটের মধ্যে হেরা দেখতে পেলো ন‌ওশাদ দৌড়ে ওটির সামনে আসছে।
হেরা তাকিয়ে দেখছে মানুষটার ফর্সা মুখটা কেমন রক্ত শূন্য হয়ে গেছে। দেখে মনে হচ্ছে কেউ শরীর থেকে সব রক্ত নিয়ে নিয়েছে।
তখন‌ই ওটি থেকে ফারহান বের হয়ে এলো ।
ন‌ওশাদ কোন কথা বলার আগেই ফারহান ভাইয়ের হাত ধরে বলল, ভাইয়া আলহামদুলিল্লাহ তুমি টেনশন করো না বেশি সিরিয়াস কিছু হয়নি আমাদের নিশালের। ব্রেনের বাহিরে সামান্য একটু ব্লিডিং ছিল বন্ধ করা গেছে সেই ব্লিডিং, কোন হেমারেজ হয়নি আর বাম হাত টা ভেঙে গেছে ওসব কোন ব্যাপার না। তুমি টেনশন করো না ঘন্টা খানেক এর মধ্যে সেন্স চলে আসবে । আমাদের সঙ্গে কথা বলবে দেখো।
ন‌ওশাদ তাকিয়ে আছে উদ্ভ্রান্তের মত শুধু কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, আমার ছেলেটা বাঁচবে তো ফারহান ?
ন‌ওশাদের এই কথার সঙ্গে সঙ্গে আশেপাশে সবার চোখে পানি চলে এলো।
হেরা ওড়নায় মুখ চেপে কেঁদে উঠলো।
ফারহান বড় ভাইয়ের হাত শক্ত করে ধরে বলল, ভাইয়া নিশাল আমাদের‌ও জানের টুকরা ওর খারাপ কিছু হলে আমি নিজে শক্ত থাকতে পারতাম বলো ?ওকে আইসিইউ তে নিয়ে যাচ্ছে তুমি চলো দেখবে ।
ওকে দেশের বাহিরে নিয়ে যাব এয়ার এম্বুলেন্স এর ব্যবস্থা করছি আমি ,ন‌ওশাদ বলল।
না ভাইয়া দরকার নেই সব ঠিক আছে। আর ওর অপারেশন করেছে সিঙ্গাপুর জেনারেল হসপিটালের একজন বড় নিউরো সার্জন। তিনি এসেছিলেন এখানে একটা ওয়ার্কশপে লাকীলি উনাকে আমরা পেয়েছি। তুমি চলো ছেলেকে দেখবে ।
না আমি আমার ছেলেকে ঐ অবস্থায় দেখতে পারব না ফারহান।
আসো তো আমার সঙ্গে। বলে ফারহান ন‌ওশাদের হাত ধরে আইসিইউর সামনে গিয়ে গেল। কিন্তু ন‌ওশাদ দূর থেকে দেখেই চলে এলো কাছে গেল না। অক্সিজেন লাগানো পুরো মাথায় ব্যান্ডেজ বাঁধা নিশালকে সে দেখতে পারছে না । ওর কলিজা টা ছিঁড়ে যাচ্ছে। ও ছুটে গিয়ে দূরে করিডোরের এক কোনায় চেয়ারে গিয়ে বসলো।
সবাই একে একে দূর থেকে নিশালকে দেখে এলো।
রেজোয়ান হেরার কাছে এসে বলল, তুমি একটু ন‌ওশাদের কাছে যাও হেরা ও খবর টা শোনার পর থেকে কেমন চুপ করে আছে কাঁদছেও না কথাও বলছে না কারো সঙ্গে । আমি ওকে বুঝতে পারছি না। এতটা ভেঙে পড়তে ওকে কখনো দেখিনি।
হেরা আস্তে আস্তে গিয়ে ন‌ওশাদের সামনে দাড়ালো। দূরে একটা কোনায় মাথা নিচু করে বসে আছে ন‌ওশাদ ।
হেরা ন‌ওশাদের মাথায় হাত রাখলো ।
ন‌ওশাদ শূন্য দৃষ্টিতে তাকালো হেরার দিকে ।
আপনি এরকম চুপ হয়ে আছেন কেন ?
আমার খুব কষ্ট হচ্ছে হেরা বুক ফেটে কান্না আসছে কিন্তু কাঁদতে পারছিনা কি করব বুঝতে পারছি না ।
আপনি কাঁদুন আমাকে জড়িয়ে ধরে চিৎকার করে কাঁদুন বলে হেরা কেঁদে ফেলল নিজেই।
ন‌ওশাদ উঠে হেরাকে জড়িয়ে ধরে শব্দ করে কেঁদে উঠলো আমার ছেলেটার খুব কষ্ট হচ্ছে হেরা । ওর কিছু হলে আমি বাঁচব কিভাবে? ওর মা কে কি জবাব দিব বলো ?
হেরা ন‌ওশাদকে জড়িয়ে ধরে বলল, আমাদের ছেলের কিছু হবে না ও ঠিক হয়ে যাবে ।
আমার খুব কষ্ট হচ্ছে মনে হচ্ছে কেউ আমার বুকে ছুরি চালিয়ে দিয়েছে। আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে।
আপনি শক্ত হন আমাদের নিশালের কিছু হবে না দেখবেন ও সুস্থ হয়ে যাবে।
ঘন্টা দেড়েক পর ফারহান এসে ভাইয়ের পিঠে হাত রাখলো ভাইয়া চলো নিশালের সেন্স এসেছে তোমারকে আর ভাবিকে দেখলে ওর ভালো লাগবে চলো।
ফারহান আমি নিশালকে নিয়ে বুবুর কাছে যাব কবে যেতে পারব বল ?
অবশ্যই যেতে পারবে আগে চলো ছেলে অস্থির হচ্ছে তোমাদের না দেখে।
হেরার হাত শক্ত করে ধরে ন‌ওশাদ আইসিইউতে গিয়ে ঢুকলো।

সাতদিন হসপিটালে থেকে ছেলের ভাঙ্গা বাম হাত নিয়ে বাসায় ফিরে এলো ন‌ওশাদ। এই সাত দিনে একবারের জন্য ছেলেকে রেখে বাসায় আসেনি সে। সারাক্ষণ ছেলের পাশে বসে ছিল। ছেলেকে খাইয়ে দিয়েছে। ছেলের সঙ্গে গল্প করেছে। বারবার আদর করেছে।
হেরাও মোটামুটি সারাক্ষণ হসপিটালে ছিল। ওকে জোর করে বাসায় পাঠাতে পারেনি ন‌ওশাদ। শুধু রাতে বাসায় আসতো হেরা।
প্রথম কয়েকদিন তো শুধু ছেলের মাথার কাছে বসে ন‌ওশাদ শুধু কেঁদেছে নয়তো দোয়া পড়ে ফুঁ দিয়েছে। শোয়েব কে দিয়ে নিশালের জন্য দান সদকা দিচ্ছে যে কত তার কোন হিসাব নেই।
সারারাত জায়নামাজে বসে কান্নাকাটি করেছে।
নিশাল যখন ঘুমিয়ে থাকে ওর মুখটার দিকে তাকিয়ে থাকে আর চোখের পানি ফেলে ন‌ওশাদ।
হেরা যতবার গিয়ে কাঁধে হাত রেখেছে হেরার হাতটা ধরেও কেঁদেছে ন‌ওশাদ ।
হেরা আমার সন্তানেরা ভালো থাকুক আমি আর কিছুই চাই না। আল্লাহর কাছে শুধু এই দোয়াই করি সারাক্ষণ। এয়ার পোর্টে দূর থেকে রেজোয়ান কে দেখে বুকে অজানা একটা ভয় হলো মনে হলো তোমার বা বেবির কিছু হয়নি তো। খবরটা যখন দিয়েছিল রেজোয়ান এয়ারপোর্টেই আমার মনে হচ্ছিল আমার সমস্ত পৃথিবী টা দুলে উঠেছে।
আমার দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল। ও শুধু বলল, হাত ভেঙে গেছে ওটিতে আছে বলেনি। কিন্তু আমি যা বোঝার বুঝে গিয়েছিলাম। শুধু হাত ভাঙলে রেজোয়ান আমাকে আনতে এয়ার পোর্টে যেতো না। বাইক এক্সিডেন্ট শুনেই বুঝেছি কত খারাপ হতে পারে ঘটনা।
আপনি আমাকে ক্ষমা করুন নিশালের পাপা আমি আমার দ্বায়িত্ব পালন করতে পারিনি ।
তুমি ক্ষমা চাইছো কেন ? আমি তো সব শুনেছি ঘটনা কি ঘটেছে।
আমার যুথীর উপরো রাগ নেই রাগ করে কি হবে ও তো জানতো না বন্ধুদের কথায় নিশাল বাইকে উঠবে ।
বাচ্চা মানুষ বুঝেনি বন্ধু এত স্পীডে চালাবে বাইক, আপনি আর কাঁদবেন না ছেলে আপনাকে দেখে কষ্ট পাচ্ছে। হেরা ন‌ওশাদের চোখের পানি মুছিয়ে দিলো।
তুমি বিশ্বাস করবে না হেরা ছেলেটাকে এভাবে দেখে আমার কলিজা টা ছিঁড়ে যাচ্ছে।
এখন তো ছেলে ঠিক আছে খাচ্ছে, কথা বলছে সবার সঙ্গে , হাসছে। সিটিস্কেন রিপোর্ট ভালো এসেছে ডাক্তার বলেছে তাড়াতাড়ি ছেড়ে দিবে তাহলে কাঁদছেন কেন?
আমার ছেলেটা অনেক কষ্ট পেয়েছে হেরা অনেক।
হেরা ন‌ওশাদের মাথাটা বুকের সঙ্গে জড়িয়ে ভাবছে , ছেলেকে অনেক ভালোবাসে মানুষটা সে জানতো কিন্তু সেটা যে এতটা সে নিশালের এক্সিডেন্টের পর দেখলো।
নিশালকে নিয়ে হসপিটাল থেকে বাসায় আসার পনের দিনের মাথায় ন‌ওশাদ নিশাল আর হেরাকে নিয়ে ফ্লোরিডার উদ্দেশ্যে র‌ওনা হয়ে গেল।

( চলবে )