#তবু_সুর_ফিরে_আসে
৩৪ পর্ব
হেরা বিমোহিত হয়ে নতুন এক জগৎ দেখছে ! কত রঙ্গ বেরঙের কাপড় পড়ে কত শত তরুণ মুখ। তাদের এক একজনের মুখে একেক অভিব্যক্তি। দল বেঁধে কেউ ঘুরে বেড়াচ্ছে কোথাও দুই তিন জন মিলে বসে আড্ডা দিচ্ছে। কোথাও আবার জুটি বসে নিজেদের মধ্যে গল্পে মগ্ন। যাদের ক্লাস আছে তারা ক্লাসে ব্যস্ত। আজ হেরাদের জন্য ছিল রিফ্রেশ পার্টি । গান বাজছে । পুরো ক্যাম্পাস টা মনে হচ্ছে আনন্দে ভরা। হেরার খুব ভালো লাগছে সব কিছু দেখে।
হেরার দুজন মেয়ের সঙ্গে পরিচয় হয়েছে। ওদের বাসা ঢাকার বাহিরে এখানে বাসা ভাড়া করে আরো মেয়েদের সঙ্গে থাকবে।
হেরার বেশি ভালো লাগছে এলিনের বান্ধবী দের ওরা খুব হাসিখুশি আর দাপুটে । ছেলেদের বকা দিচ্ছে, ধমক দিচ্ছে। হেরা মুগ্ধ হয়ে দেখেছে ওদের।
মোবাইলে রিং হতেই তাকিয়ে দেখে নওশাদের ফোন ।
হ্যালো।
কি করছো ?
এলিনের সঙ্গে ক্যাফেতে বসে আছি ।
কেমন লাগছে ভার্সিটি ?
ভালো।
ভয় কমেছে আমার কাঠবিড়ালীর ?
হুম ,হাসলো হেরা ।
খেয়েছো কিছু ?
কফি খেয়েছি ।
বাসায় গিয়ে আমাকে ফোন দিও।
ঠিক আছে।
রাখলাম সাবধানে থেকো।
হুঁ।
হেরা ফোন রেখে আবার এলিনের পাশে এসে বসলো। বৌমনি আমার আজ আর ক্লাস নেই চলো একটু শপিং করব ।
তুমি যাও আমি বাসায় ফিরব ।
আরে চলো তো ভালো লাগবে তোমার ।
তোমার ভাইয়াকে বলি নাই এভাবে যাওয়া ঠিক হবে না।
ইস তুমি এত ভেবো না তো খুব মজা হবে দেখো । বেশিক্ষণ লাগবে না একটা সাদা ওড়না কিনব পছন্দ করাই আছে যাব আর আসব ।
ঠিক আছে চলো। কিন্তু বেশি সময় লাগাতে পারবে না কিন্তু।
হেরা নওশাদ কে এসএমএস পাঠিয়ে এলিন,নাহিন আর ওদের ফ্রেন্ডদের সঙ্গে শপিং চলে গেল। আজকে হেরার অনুরোধে ওকে দুইবোন বৌমনিই ডাকলো সবার সামনে এবং হেরার আসল পরিচয়েই পরিচিত করলো।
এলিন গিয়ে তো ছিল একটা সাদা ওড়না কিনতে প্রায় দুই ঘণ্টা ও আর ওর ফ্রেন্ড রা ঘুরাঘুরি করলো এই দোকান সেই দোকান । তারপর হাবিজাবি এক গাদা জিনিস কিনলো । কেউ বয় ফ্রেন্ডের জন্য গিফট কিনলো। কেউ ছোটবোনের জন্মদিনের গিফট । তবে ওদের সঙ্গে ঘুরতে ঘুরতে হেরা এই প্রথম নওশাদের জন্য একটা শার্ট পছন্দ করে কিনে ফেলল। নাহিন ওকে খুব সাহায্য করল ,সেই নিয়ে গেল ভালো ব্র্যান্ডের শার্ট কিনতে। হেরা এই প্রথম নওশাদ কে কিছু একটা উপহার দিবে ও খুব এক্সাইটেড। অনেক চিন্তা ভাবনা করে একটা শার্ট সে কিনেছে। ওর বারবার মনে হচ্ছে উনার পছন্দের কাছে পৌঁছবে তো শার্ট টা?
বাসায় ফিরতে ওদের দুপুর পার হয়ে গেল।
এক দিনেই হেরা অনেক ক্লান্ত এসেই বিছানায় এলিয়ে পড়লো।
নওশাদ বাসায় ফিরে ওকে ঘুম থেকে ডেকে তুলল যখন, তখন রাত প্রায় আটটা!
কি ব্যাপার ড্রেস চেঞ্জ না করেই ঘুমাচ্ছো যে ?
খুব ক্লান্ত লাগছে।
প্রথম দিন ভার্সিটিতে গিয়েই ,নাকি শপিং করে ?
শপিং মলে হেঁটে হেঁটে। ওরা কেনাকাটার চেয়ে বেশি ঘুরে । আমি ওদের সঙ্গে ঘুরতে ঘুরতে ক্লান্ত হয়ে গেছি।
নওশাদ হেরার কপালে হাত রাখলো। মেয়েরা তো এই কাজই করে যতনা শপিং করে তারচেয়ে দ্বিগুণ ঘুরে। খেয়েছিলে কিছু নাকি শুধু ঘুরেছো ?
খেয়েছি । আজ একটা দারুন জিনিস খেয়েছি !
কি ফুচকা ? মেয়েদের তো দারুন জিনিস মানেই ফুচকা ।
না ভেলপুরি ! দারুন ঝাল টক খুব মজার।
এটা কি জিনিস ?
আপনি খাননি কখনো ?
না । কোথায় পাওয়া যায় ?
রাস্তার পাশে মামা রা বানায় ! আমি এই প্রথম খেলাম । আপনি সত্যি খাননি ?
আমি রাস্তার পাশে থেকে কিছু খাই না হেরা ! আই মীন খাওয়ার সুযোগ হয় না এখন। স্টুডেন্ট লাইফে খেয়েছি । কিন্তু তখন ভেলপুরি নামের কিছু খেয়েছি বলে মনে পড়ছে না !
একদিন চলেন আমি আর আপনি খাব । হেরা উৎসুক চোখে তাকিয়ে আছে নওশাদের দিকে ।
ঠিক আছে খাব যাও। এখন উঠো ড্রেস চেঞ্জ করো ডিনার করি ।
হেরা গোসল করে বের হয়ে দেখে নওশাদ ফোনে কথা বলছে।
কথা শুনেই বুঝেছে রেজোয়ান ভাইয়ের সঙ্গে কথা বলছে।
পাঁচ সাত মিনিট পর নওশাদ কথা শেষ করতেই হেরা শার্টের বক্সটা নিজের পিছনে লুকিয়ে নওশাদের সামনে গিয়ে দাড়ালো।
চোখ বন্ধ করুন তো ।
কেন?
আমি বলছি তাই ।
ঠিক আছে করলাম ।
না চিটিং করলে হবে না প্রোপার বন্ধ করে রাখতে হবে ।
ঠিক আছে। এই যে বন্ধ করলাম।
হেরা এক হাত দিয়ে নওশাদের চোখ ধরলো । তারপর বক্সটা নওশাদের হাতে তুলে দিলো।
এখন খুলুন।
কি এতে ?
আপনার জন্য এই প্রথম একটা গিফট কিনলাম। নওশাদ অবাক হয়ে দেখে হেরা লজ্জা লজ্জা মুখ নিয়ে ওকে দেখছে।
বক্স থেকে বের করলো একটা হালকা আইস ব্লু কালারের পার্ক এভিনিউ ফরমাল শার্ট । শার্টটা হাতে নিয়ে নওশাদ হাসছে । আজকে কিনেছো ?
হুঁ।
পছন্দ হয়নি তাই না ? আমি কি আর বুঝি আপনার পছন্দ কেমন নাহিন আমাকে একটা বড় দোকানে নিয়ে গেল সেখান থেকে পছন্দ করলাম। শুধু মাপটা আনারের মা কে ফোন করে জিজ্ঞেস করলাম ও আপনার শার্ট দেখে বলল।
নওশাদ হো হো করে হাসছে , এত হুলুস্থুল করতে হলো !
পছন্দ হয়নি তাই না ? হেরা মুখটা অন্ধকার করে ফেললো।
এই মেয়ে মুখ কালো করছো কেন আমি কি বলেছি পছন্দ হয়নি ? খুব সুন্দর হয়েছে । কালারটা খুব সোবার ।
হাসছেন তো আপনি !
নওশাদ হেরার ঘাড়ে হাত রাখলো ,হাসছি দোকান থেকে আনানের মা কে ফোন দিয়ে শার্টের মাপ জেনেছো সেই জন্য ।
হ্যা ওকে বললাম আলমারি থেকে শার্ট বের করে কলারের কাছে কি লিখা আছে বলো । ও বলতেই পারছে না তারপর আনারের মা শার্ট আব্বার কাছে নিয়ে গেল আব্বা দেখে বলল ।
এক শার্টের জন্য কত মানুষ কষ্ট করলো সেই শার্ট ভালো না হয়ে কোথায় যাবে ! আমার খুব পছন্দ হয়েছে হেরা থ্যাংকস। নওশাদ শার্ট টা খুলে সঙ্গে সঙ্গে পড়ে ফেলল।
দেখো অনেক ভালো লাগছে , আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নওশাদ বলল।
হেরা তাকিয়ে দেখছে নওশাদকে সত্যি অনেক সুন্দর লাগছে শার্ট টা পড়ে।
আপনি তো মাসাআল্লাহ সব সময়ই সুন্দর , হ্যান্ডসাম !
তাই বুঝি ?
এমন ভাবে বলছেন যেন কেউ আগে বলেনি আপনাকে !
তুমি তো এই প্রথম বললে সে জন্যই শুনতে ভালো লাগছে ।
আমি প্রথম দিন থেকেই আপনাকে যখন দেখি মুগ্ধ হয়েই দেখি ।
আমি মাঝ বয়সী একজন মানুষ কাউকে মুগ্ধ করার ক্ষমতা আমার নেই ।
আপনি সবকিছু দিয়ে মুগ্ধ করেন , আপনার ব্যক্তিত্ব দিয়ে, ভালোমানুষী দিয়ে, আপনার ক্ষমতা দিয়ে , আপনার রূপ দিয়ে । আপনার সবকিছুতেই মুগ্ধতা আমার ! আর আমি তো শুনেছি কত সেলিব্রিটি থেকে নামীদামী রমনীরা মি: আজমী আপনার সবকিছু তেই মুগ্ধ হয়ে থাকে হেরা মুচকি হেসে বলল।
তাই তোমাকে সুমনা বলল আর তুমিও বিশ্বাস করে বসে আছো ! চুল পাকা দাঁড়ি পাকা বুড়ো আমি আমার জন্য ওরা কেউ পাগল না বুঝলে ওরা পাগল স্ট্যাটাস, পজিশন , ব্যাঙ্ক স্টেটমেন্ট এসবের জন্য। তাই আজ আমি কালকে অন্য কারো জন্য হবে পাগল । নওশাদ গায়ের শার্টটা খুলতে খুলতে বলল , ম্যাডাম ভারী মানিব্যাগ দেখলে ওদের কাছে লাইট নিভিয়ে দিলে সব পুরুষ মানুষ ই এক।
ছিঃ কি বলছেন এসব আপনি !
হুম ঠিক কথাই বলেছি তুমি তো জানো না সুন্দর সুন্দর মুখের আড়ালে কত রূপ একেক জনের। বাদ দাও ওসব কথা , এখন বলো
তোমার ভার্সিটির প্রথম দিন কেমন গেল সেটা বলো ।
ভালো ।
ফ্রেন্ড হয়েছে ?
না প্রথম দিনেই কি ফ্রেন্ড হয়ে যায় নাকি ?
হুঁ হওয়ার তো কথা ।
আমার হয়নি । আসলে আমি খুব একটা তাড়াতাড়ি বন্ধু বানাতে পারি না ।
কারণ তুমি খুব দ্বিধা দ্বন্দ্বে থাকো তাই। বন্ধু বানাতে হয় মন খুলে ।
কমফোর্ট জোন যেখানে সেখানেই আমার বন্ধুত্ব। আর আমার সবচেয়ে ভালো বন্ধু মনে হয় কাকে জানেন ?
কাকে ?
হেরা পেছন থেকে নওশাদ কে জড়িয়ে ধরলো , আপনাকে । আপনার সঙ্গে সব বলতে, ঘুরতে , আপনার আশেপাশে থাকতে খুব ভালো লাগে।
সত্যি ! থ্যাংকস তোমার বন্ধু হতে পেরে ভালো লাগছে। এখন চলো ডিনার করি হেরা । তোমার ক্লাস কবে থেকে?
আগামীকাল থেকে।
ও নিশাল ফোন দিয়েছিল আগামী সপ্তাহে আসবে।
তাই !
ও আসলে আমরা ঘুরতে যাব । ওর এবার লম্বা ছুটি থাকবে । আমি পুরো সময়টা আমার ছেলের সঙ্গে কাটাব ! খুব এনজয় করবো আমরা কেমন।
জ্বি।
হেরার ক্লাস শুরু হয়ে গেছে । সে খুব মনোযোগ দিয়ে পড়াশোনা টা করছে। এত রিল্যাক্স ভাবে আগে কোন দিন পড়াশোনা সে করতে পারেনি। ছোট থেকেই স্কুলে, কলেজে যাওয়ার আগে বাড়ির সব কাজ গুছিয়ে দিয়ে তারপর যেতে হতো তাকে। পড়াশোনা করার আগে মামিদের সব কাজ করে দিতে হতো। আর এখন শুধু পড়াশোনা ছাড়া আর কিছু করার নেই তার। নওশাদ তাকে পড়তে খুব উৎসাহ দেয়। হেরার সিরিয়াস পড়াশোনা দেখে এলিন, নাহিন ওকে নিয়ে হাসাহাসি করছে এত পড়ার কি আছে বৌমনি ! পরীক্ষার মাস খানেক আগে একটু পড়লেই হয় !
আমি তোমাদের মত সামলাতে পারব না তাই আগে থেকেই নেড়েচেড়ে দেখছি কি হয় ! আর সামনের মাসে হয়তো কোথাও ঘুরতে যাচ্ছি তখন অনেক বড় গ্যাপ হয়ে যাবে তাই একটু পড়ছি।
নওশাদ সন্ধ্যায় বাসায় ফিরে আসার সঙ্গে সঙ্গে সে পড়া বন্ধ করে দেয়। নওশাদ বাসায় ফিরে এলে মানুষটার সঙ্গে সময় কাটাতে তার খুব ভালো লাগে। তখন পড়ায় মনোযোগ দিতে পারে না সে। নওশাদ ন্যাশনাল জিওগ্রাফী দেখলে সেও পাশে বসে দেখে। খেলা দেখলে সে তাই দেখে। নওশাদের সঙ্গে টিভি দেখতে তার খুব ভালো লাগে কারণ ঐ সময়টা নওশাদ ওর হাত ধরে বসে থাকে । কখনো কখনো ওর গালে ধরে টানাটানি করে কখনো ঘাড়ে সুরসুরি দিবে, চুল ধরে টানবে । এসব কিছু করবে কিন্তু চোখ থাকবে টিভিতে । টিভি দেখবে আর খুনসুটি তে ব্যস্ত থাকবে। হেরা নওশাদের সামনে বিরক্ত প্রকাশ করলেও আসলে তার খুব ভালো লাগে সেই মুহুর্ত টা।
সকালে নওশাদ বের হওয়ার আগেই তাকে ক্লাসের জন্য বের হয়ে যেতে হয় । নওশাদ আগের মত একা ব্রেকফাস্ট করে এটা খুব খারাপ লাগে তার। যদিও নওশাদই তাকে টেনেটুনে উঠায় ঘুম থেকে।
নিশালের পরীক্ষা শেষ হওয়ায় সে বাসায় আসছে আজ । ওর জন্য দারুন এক সারপ্রাইজ প্ল্যান করেছে হেরা । নিশালের পরীক্ষা যখন চলছিল তখন ওর জন্মদিন ছিল আজ ওর জন্মদিন সেলিব্রেট করার প্ল্যান করেছে হেরা । ওকে সাহায্য করেছে এলিন, নাহিন দুই বোন।
সব আত্মীয় স্বজনদের দাওয়াত দিয়েছে । নিশালের পছন্দের খাবার রান্না হয়েছে। পুরো ড্রয়িং রুম আর লিভিং রুম ফেয়ারি লাইট দিয়ে সাজানো হয়েছে । নিশালের পছন্দের কেক আনা হয়েছে।
যুথী, বীথি দুই বোনকে হেরা নিজে ফোন দিয়ে আসতে বলেছে। ওরাও ওদের বাচ্চাদের নিয়ে এসেছে।
হেরা নিজে সব কিছু ছুটাছুটি করে করছে। নওশাদ হেরাকে মুগ্ধ হয়ে দেখছে। ওর কাছে এসে একবার বলল, তুমি এত কিছু কিভাবে করলে হেরা ?
আমি কি এত কিছু জানি না বুঝি আমাকে হেল্প করেছে এলিন, নাহিন। ওরা কত কিছু জানে !
তবে প্ল্যান তো তোমার ছিল । গীতি যাওয়ার পর এভাবে নিশালের বার্থডে করা হয়নি। ও বার্থডে র সময় কলেজে থাকে তাই করার সুযোগ হয়নি।
আপনি ফোন দিয়ে দেখুন কত দূর এসেছে গাড়ি?
আর দশ মিনিট লাগবে কাছাকাছি চলে এসেছে শোয়েবের সঙ্গে কথা হয়েছে আমার ।
নিশাল বাসায় ঢুকে পুরো হতভম্ব হয়ে গেল। বাসা ভর্তি লোকজন ওর বার্থডে পার্টি করার জন্য এসেছে। ও লজ্জাই পেয়ে গেল ।
পাপা এসব কি তোমার আইডিয়া ?
না বাবা সব তোমার মামনির আইডিয়া । দুই দিন থেকে সব করছে মামনি আর তার সঙ্গীরা ।
মামনি তুমি তো আমাকে লজ্জায় ফেলে দিলে এত বড় ছেলের বার্থডে এভাবে কেউ করে ?
তোমার ভালো লাগছে না নিশাল ?
সেটা বলিনি মামনি এত বেলুন , কনফেত্তি উড়িয়ে বার্থডে করার বয়স আছে আমার ।
ওরে বাবা কত বড় হয়ে গেছে ছেলে কয়দিন পর বিয়ে করিয়ে দিতে হবে , কথাটা বলেই নাদিয়া হেসে দিল।
বড় ভাবি তোমার ছেলের জন্য মেয়ে দেখা শুরু করো , মিলা হাসতে হাসতে বলল।
ছোট চাচী পাপা সত্যি সত্যি আমাকে কলেজ থেকে আসলে পরেই বিয়ে করিয়ে দিবে বলেছে । সবাই নিশালের কথা শুনে হেসে দিল।
বীথি দূরে দাঁড়িয়ে ছিল নিশালের কাছে এগিয়ে এসে বলল, বিয়ের জন্য এই ফ্যামিলির ছেলে গুলো একদম এক পায়ে দাঁড়িয়ে থাকে বুঝলে মিলা ।
সবাই বীথির কথা শুনে হাসছে কিন্তু নিশাল দীর্ঘ শ্বাস ফেলল । ও বীথির সেই কথা গুলো ভুলতে পারে না যেসব কথা বন্ধ দরজার ভেতরে পাপাকে বলেছে খালামনি। ওর খারাপ লাগছে এই ভেবে এসব কথা মামনি শুনলে কি ভাবতো ?
নওশাদ হতাশ দৃষ্টিতে বীথির দিকে তাকিয়ে রইল।
নিশাল ওর সব কাজিনদের নিয়ে কেক কাটলো। সবাই ওর পুরো মুখে কেকের ক্রীম লাগিয়ে দিল।
হেরা নিশালের কাছে এগিয়ে এলো , নিশাল রুমে চলে যাও ফ্রেশ হয়ে এসো ।
হ্যাঁ যাচ্ছি।
মামনি !
জ্বি।
থ্যাংকস খুব ভালো লাগছে এসেই সবার সঙ্গে এনজয় করছি তুমি এত কষ্ট করলে ।
কষ্টের কিছু নেই তোমার ভালো লেগেছে এটাই বড় কথা । হেরা নিশালের মাথায় হাত রাখলো।
অনেক দিন এই বাসায় সবার সঙ্গে এত হৈচৈ করা হয় না মামনি।
এখন থেকে সুযোগ পেলে হৈচৈ করবো আমরা নিশাল। দেখো তোমার পাপা কত আনন্দে আছে।
হ্যাঁ। সব তোমার জন্য মামনি।
তুমি আনন্দে আছো তাই পাপাও আনন্দে আছে নিশাল।
তোমার জন্য পাপা অনেক টিশার্ট, গেন্জি এনেছে তোমার রুমে রেখেছি ।
ঠিক আছে।নিশাল নিজের রুমে চলে গেল ।
নাদিয়া, মিলা ,যুথী,বীথি এক সঙ্গে বসে গল্প করছে।হেরা ছোটাছুটি করে সবার খাওয়া দাওয়া বাচ্চাদের ডিমান্ড পূরন করছে ।
বড় ভাবি পুরো সংসারটা নিজের করে নিয়েছে দেখে ভালোই লাগছে তাই না , মিলা বাকিদের উদ্দেশ্যে বলল।
বিয়ের পর সংসার থেকে কি দূরে থাকা যায় মিলা ! ভাইয়াকে দেখেছো , আগের ভাইয়া আর এখনের ভাইয়ার মধ্যে কত তফাত । এখন দেখেই বোঝা যায় ভাইয়া কত হ্যাপি।
তাই নাকি নাদিয়া? আমার তো দেখে আগের মতই লাগছে, বীথি বলল।
কি বলো বীথি, ভাইয়া ভাবী কে নিয়ে সিলেট থেকে হানিমুন ও করে এসেছে। নয় দিন ছিল ।
কবে নাদিয়া জানি না তো ? অবাক হয়ে বীথি তাকালো ।
গত মাসে, ভাইয়ার একটা রিসোর্ট আছে না সিলেটে ওখানে গিয়েছিল। নাদিয়া গলা নামিয়ে ফিসফিস করে বলল, আরমান ভাইয়াকে ফোন দিয়েছে কি একটা দরকারে কিন্তু ভাইয়া ফোন ধরে না বারবার ফোন দিচ্ছে ভাইয়া রিসিভ করে না, ও তো টেনশনে পড়ে গেল তারপর রিসোর্টের কনস্ট্রাকশন ম্যানেজার কে কল করেছে ঐ লোক বলল, স্যার আর ম্যাডাম কটেজেই আছে কিন্তু ঐ এলাকায় কারো যাওয়া নিষেধ । একদম কোন রকম ডিস্টার্ব নেস ছাড়াই হানিমুন করে এসেছে দুজন। ঐ নয়দিন অফিসের কারো ভাইয়াকে কল করা সম্পূর্ণ নিষেধ ছিল।
ও আমরা এসব জানব কিভাবে আর দরকারও নেই জানার বুঝলে , বুড়ো বয়সে বিয়ে করেছে ফুর্তি করে বেড়াতে হবে না এখন ,যুথী বলল।
ভাইয়া তো ভাবি আর নিশাল কে নিয়ে আগামী মাসে আমেরিকা যাবে ভিসাও হয়ে গেছে শুনলাম। আব্বাকে ও নিবে আব্বার ভিসা হয়নি এখনও ।
মিলা দুলাভাই এর মনে এখন অনেক রং কি বলব আর।
যুথী আপা সব হলো টাকার খেলা । ভাইয়া হলেন বিলিয়নিয়ার মানুষ ওনার জন্য যখন তখন যেখানে খুশি সেখানে যাওয়া কোন ব্যাপার না। আমার খুব হিংসে হয় বড় ভাবিকে ভাইয়ার মত মানুষ কে পেয়েছে । যেমন আছে টাকা সেরকম খাঁটি একটা মানুষ! কয়টা মেয়ে এরকম মানুষকে স্বামী হিসেবে পায় বলো ?
এটা ভালো বলেছো মিলা , নাদিয়া বলল।
ভাইয়া অসাধারণ একজন মানুষ! কোন দিন দেখিনি আমাদের সঙ্গে তো দূরের কথা ভাইদের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করতে। তবে খারাপ কিছু কে কখনো পশ্রয় দেয় না আবার।
মেঝ ভাবি তুমি তো দেখোনি একটু আগে ফারাজ কে খাওয়াচ্ছি দূর থেকে দেখি ভাইয়া হঠাৎ ভাবির গাল টেনে দিলো । কি সুইট না !
সত্যি !
ভাইয়া এমন বিহেইভ করে যেন ভাবী একটা বাচ্চা মেয়ে বলেই হাসছে মিলা !
বাচ্চা মেয়ে ই তো বাইশ বছর বয়স আর ভাইয়ার ছিচল্লিশ । ভাইয়ার কাছে তো বাচ্চা বয়সীই।
হুম। তাকিয়ে দেখো ভাবি যেখানে ভাইয়া ভাবির কাছাকাছি থাকবে ।
কি বলো খেয়াল করিনি তো !
দেখো একটু খেয়াল করে।
হ্যাঁ তাই তো !
বীথি বলল, ঢং বুঝলে সব । বুড়ো বয়সে বিয়ে করলে পুরুষ মানুষ এমন আহ্লাদ ই করে বউ এর সঙ্গে।
আমার কিন্তু ভালোই লাগে বীথি দুজনকে দেখে , নাদিয়া বলল।
যুথী বলল, দুই নাম্বার বউ কে সব পুরুষ মানুষ এমন মাথায় করে রাখে ।
তাই নাকি যুথী আপা, ইস আমি যদি ফারহানের দুই নাম্বার বউ হতাম !
মিলার কথা শুনে নাদিয়া আর যুথী হাসছে ।
বীথি নওশাদ আর হেরার সিলেট ট্যুরের খবর জানতে পারেনি কারণ পারুল তখন ছুটিতে বাড়ি গিয়েছিল। মনে মনে খুব বিরক্ত হলো পারুলের উপর। অনেকক্ষণ থেকেই সে দূর থেকে নওশাদকে দেখছে। হেরার সঙ্গে কখনো কথা বলছে , ভাইদের সঙ্গে গল্প হাসাহাসি করছে । উঠে গিয়ে বাচ্চাদের চকলেট দিচ্ছে কখনো। একবার হেরার মুখে ও একটা চকলেট তুলে দিলো । নিশালও গিয়ে কিছু একটা বলল ওদের কাছে , তিনজন হাসছে এক সঙ্গে। আবার ফ্যামিলি ফটো তুলছে ঢং করে করে।
অসহ্য লাগছে দেখে বীথির ।
শোয়েবের ছোটবোন এসেছে তার কোলে আট নয় মাসের একটা ছেলে । সেই বাচ্চাকে কোলে নিয়ে বসে আছে নওশাদ । ছোট বাচ্চাদের তার এত ভালো লাগে আশপাশে ছোট বাচ্চা দেখলে সে ওদের নিয়ে খেলতে পছন্দ করে।
নিশাল পাপার কাছে দাঁড়ালো এই গুল্লু বেবিটা কে পাপা ?
শোয়েবের ছোট বোন রাখির ছেলে । সবার কাছে যায় আবার হাসে দেখো খুব সুইট !
অনেক কিউট তো কোলে নিব একটু ?
পারবে তুমি ?
পারব । নিশাল বেবিটাকে কোলে নিয়ে হাসানোর চেষ্টা করছে।
নাদিয়া হাত ইশারায় নিশালকে কাছে ডাকলো ।
জ্বি চাচী।
বাচ্চা টা কে , সুন্দর তো ?
চাচী শোয়েব ভাইয়ার বোনের ।
রাখির ?
জ্বি !
তোমার কোলে বেবিটাকে খুব মানিয়েছে নিশাল। কয়দিন পর তোমার ভাই বোন হবে তখন এভাবে খেলতে পারবে, মিলা বলল।
জ্বি চাচী আমার তো ভাবতেই ভালো লাগে বাসায় একটা ছোট বাবু দৌড়ে বেড়াচ্ছে। আমি ওর পিছনে পিছনে ছুটছি। অনেক মজা হবে।
নাদিয়া বলল, তোমার পাপা আর মামনি কে বলো তোমার ভালো লাগার কথা টা।
জ্বি বলতে হবে ।
নওশাদ পাশ থেকে ছেলের কথা শুনতে পেয়ে চমকে গেল! নিশাল তার ভাই বোন হবে এই কথা ভাবে ? আশ্চর্য!
হেরা ওদের কাছে আসতেই নাদিয়া বলল,ভাবি তোমার বাবু হলে আর চিন্তা নেই নিশালই রাখতে পারবে দেখো কত সুন্দর করে কোলে নিয়ে বসে আছে রাখির ছেলেকে !
হেরা নাদিয়ার কথায় কি বলবে বুঝতে পারছে না ।
ভাবি তাড়াতাড়ি বাবু নিয়ে নাও একটা, নিশাল আরো বড় হয়ে গেলে বেখাপ্পা লাগবে ।
ওসব নিয়ে পরে গল্প করব খাবার ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে তোমরা এসো খেতে।
সবাই খাবার টেবিলের দিকে এগিয়ে গেল । বীথি হঠাৎ হেরার পাশে দাঁড়িয়ে গলা নামিয়ে বলল, তোমার বাচ্চা হবে আর আমাদের নিশালের কপাল পুড়বে ।বোকা ছেলেটা, এটা বুঝে না ও যাদের ভাই বোন ভাববে ও গুলো যে কালসাপ হয়ে ওকেই কামড়াবে !
হেরা বীথির কথা শুনে ওর দিকে অবাক হয়ে তাকালো বীথি হেরার দৃষ্টি অগ্রাহ্য করে খাবার টেবিলের দিকে এগিয়ে গেল।
হেরা তাকিয়ে আছে বীথির দিকে কেন যেন কথাটা ওর বুকের ভেতরে গিয়ে লাগলো । ওর চোখ পানিতে ভরে যাচ্ছে। হেরা খুব চেষ্টা করছে চোখের পানি আটকাতে । অন্যদিকে তাকিয়ে চোখ মুছলো সে। নওশাদ খেয়াল করেনি কিন্তু নিশাল খেয়াল করলো হেরা চোখের পানি মোছার চেষ্টা করছে শাড়ির আঁচল দিয়ে তারপর ওখান থেকে বাথরুমে ঢুকে গেল তাড়াহুড়ো করে ।
চোখে মুখে পানি দিয়ে তাড়াতাড়ি বের হয়ে আসলো হেরা। সবাই খাচ্ছে ও ওখানে দাঁড়িয়ে আছে ।
নিশাল কাছে এসে দাঁড়ালো , কি হয়েছে তোমার মামনি ?
কোথায় , কিছু না তো ?
হঠাৎ মনে হলো আমার ।
না আমি ঠিক আছি। তুমি খেয়েছো ঠিক ভাবে ?
হুঁ।
হেরা বীথির দিকে তাকিয়ে আছে । কি সুন্দর অন্যদের সঙ্গে হেসে হেসে গল্প করে খাচ্ছে! একটু আগে যে কথাটা উনি বললেন হেরার ভেতরটা নাড়িয়ে দিয়েছে কথাটা । ওর বারবার মনে হচ্ছে উনি এরকম করেন কেন ওর সঙ্গে ? এত রাগ কেন উনার হেরার উপর?
সবার খাওয়া শেষ হতেই এলিন হেরাকে গান গাওয়ার জন্য জোর করা শুরু করলো।
প্লিজ এলিন সবার সামনে লজ্জায় ফেলো না ।
না বৌমনি তোমাকে গাইতেই হবে ।
নিশাল এলিনের কথা শুনে সেও রিকোয়েস্ট করা শুরু করলো। হেরার মনটা খুব খারাপ ওর এখানে থাকতেই কষ্ট হচ্ছে তার মধ্যে গান গলা দিয়ে আসবেই না।
ওদের কথা শুনে ঘর ভর্তি সবাই হেরার গান শোনার আগ্রহ প্রকাশ করলো । হেরা নওশাদের দিকে তাকিয়ে আছে । নওশাদও চোখ ইশারায় গাইতে বলল!
কারাওকি স্পিকার নিয়ে এলো নিশাল । হেরাকে দেখিয়ে দিল কিভাবে কি করবে । হেরা প্রচন্ড মন খারাপ নিজের মধ্যে লুকিয়ে রেখে গাইতে শুরু করলো কিশোর কুমারের বিখ্যাত গান ” এই তো হেথায়, কুঞ্জ ছায়ায় / স্বপ্ন মধুর মোহে / এই জীবনে যেকটি দিন পাবো/ তোমায় আমায় হেসে খেলে/ কাটিয়ে দিব দোহে / স্বপ্ন মধুর মোহে ….
হেরা গান গাইছে নওশাদ উঠে বাহিরে এসে দাঁড়ালো । এখান থেকেও স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে গান। এই গানটা গীতি যাওয়ার কিছুদিন আগে ও শুনিয়েছিল গীতিকে । গানটা ওকে ছয় বছর আগের একটা রাতের কথা মনে করিয়ে দিলো । বুকের কোথায় যেন চিনচিনে একটা কষ্ট হচ্ছে আবার। সৃত্মি গুলো তাকে তাড়া করে নিয়ে যায় । কেন সুখের স্মৃতি গুলো একটা সময় কষ্ট দেয় ! গীতির সঙ্গে কাটানো সুখের সময় গুলো আজ ছয় বছর ওর বুকের রক্ত ক্ষরণ বাড়িয়ে দেয়। আজও এই গানটা শুনে সেই রক্ত ক্ষরণ টের পাচ্ছে সে।
আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে শুনতে পাচ্ছে খুব দরদ দিয়ে হেরা গাইছে,
অভিসারের অভিলাষে/ রইবে তুমি আমার পাশে/জীবন মোদের যাবে ভরে/ রঙের সমারহে/স্বপ্ন মধুর মোহে….
( চলবে)
#তবু_সুর_ফিরে_আসে
৩৫ পর্ব
নওশাদ পার্টি ছেড়ে উপরে উঠে এলো । সব গেস্ট এখনো আনন্দ করছে । নিশাল গিটার বাজালো কিছুক্ষণ। গল্প গুজব চলছে এখনো। নওশাদ আসার সময় হেরার কাছে গিয়ে শুধু বলল, আমি রুমে যাচ্ছি । টায়ার্ড লাগছে।
জ্বি ।
হেরার গান শুনে সে ছয় বছর পিছনে এক রাতে ফিরে গেল। তার খুব মনে আছে গীতি সেদিন তার এক বান্ধবীর বাসায় গিয়েছিল উত্তরায়। নওশাদ গাজীপুর থেকে আসার পথে গীতিকে সঙ্গে নিয়ে এলো উত্তরা থেকে। গীতির সেই বন্ধুর বাসায় উঠবে না উঠবে না করেও অনুরোধ টা ফেলতে পারেনি, নওশাদ কে কফি খাওয়ার জন্য বাসায় যেতেই হলো। সেখানে গীতির আরো দুই বান্ধবী ছিল তারাই কথা বলছিল স্বামীদের ব্যস্ততা আর তাদের প্রতি উদাসীনতা এসব নিয়ে । সংসারের কোন খবর রাখে না কেউ।
নওশাদ তোমরা পুরুষ মানুষ এমন কেন বলো তো ? রুমা নামের গীতির এক বন্ধু বলল।
আমি কি বলব এটা তো তোমার বন্ধু গীতি উত্তর দিবে আমি উদাসীন নাকি মনোযোগী ?
তুমি পুরুষ দের ব্যাপার টা বলো ওরা এমন কেন ?
আমি কোন পক্ষ নিব না রুমা এই মুহূর্তে আমি এখানে একা, পুরুষ মানুষের পক্ষে কথা বলে ধোলাই খাওয়ার ইচ্ছা নেই। তারচেয়ে মেয়েদের অভিযোগ মাথা পেতে নিলেই মঙ্গল , নওশাদ হাসতে হাসতে বলল।
তুমি সাধে কি লাইফে এত তাড়াতাড়ি এত সফল বুদ্ধি মাথায় শুধু গিজগিজ করে তাই না ?
বুঝতে হবে রুমা ।
রুমার বাসা থেকে ফিরে আসার সময় নওশাদ ড্রাইভ করছে গীতি পাশে বসে ছিল। নওশাদ মজা করে বলল, কি কি অভিযোগ আলোচনা করলে আমার নামে বন্ধুদের সঙ্গে তুমি ?
তোমার কি মনে হয় আমি তোমার নামে কি কি অভিযোগ করি নওশাদ ?
একবারেই যে কোন অভিযোগ নেই, সেটা হতেই পারে না।
সেটা ভাবাও তো ভুল ।
সেটাই গীতি ডার্লিং জানতে চাইছি কি কি অভিযোগ তোমার ?
সাধারণ অভিযোগ তুমি সব আমার উপর ছেড়ে খুব নিশ্চিন্তে অফিস, বিজনেস করে পার করে দিচ্ছ জীবন, সংসারে তোমার টাকা দেয়া ছাড়াও কিছু দ্বায়িত্ব পালন করা উচিত এটাই আমার তোমার ব্যপারে একমাত্র অভিযোগ নওশাদ।
শুধু এই টুকুই গীতি ! ঠিক আছে যাও আজ থেকে তোমার সঙ্গে সংসারের সব ব্যাপারে নাক গলাবো কথা দিলাম !
ও আমার খুব জানা আছে তুমি কতটুকু কি করতে পারবে , গীতি গাল ফুলিয়ে বলল ।
তুমিই তো সব সামলে আমার অভ্যাস খারাপ করে দিয়েছো গীতি।
এটা ঠিক বলেছো তোমাকে খারাপ টা আমিই করেছি সব মুখের সামনে রেডি করে দিয়ে দিয়ে।
নওশাদ হাসতে হাসতে বলল সে জন্যই তোমার আঁচলের তলায় থাকতে ভালো লাগে ।আর এভাবেই এই আঁচলের তলায় হেসে খেলে বাকি জীবন কাটিয়ে দিব গীতি। নওশাদ গীতির হাত ধরে গান গেয়ে উঠেছিল সেদিন , এই তো হেথায় কুঞ্জ ছায়ায়, স্বপ্ন মধুর মোহে ….
আজ এত বছর পর গানটা শুনে সেই রাতের কথা মনে পড়ে গেল। এর ঠিক সাত আট দিন পরেই গীতি চলে যায় । সেই মায়ার আঁচল চলে যায় চিরতরে। যে সংসার একা ও সামলাতো , আত্মীয় স্বজন, সামাজিকতা । সব নওশাদের হাতে ছেড়ে ছুড়ে চলে গেল। অভিযোগ করার , অভিমান করার কেউ নেই তারপর থেকে।
নওশাদ বারান্দায় অন্ধকারে বসে আছে। নিচ থেকে হাসাহাসি , বাচ্চাদের হৈচৈ শোনা যাচ্ছে। নওশাদ গীতির কথা ভাবছে গীতির পড়িয়ে দেয়া আঙুলের আংটি টার দিকে তাকিয়ে আছে।
বীথি নিশালের কাছে গিয়ে বসলো । নিশু পরীক্ষার সময় একটা ফোন দাও নি কেন ?
পরীক্ষা শুরুর আগের দিন দিলাম না ফোন তোমাকে !
আমি বলছি এর পর একটা কলও দাওনি, আমি জানার জন্য অস্থির হয়ে ছিলাম কেমন হচ্ছে আমার নিশু বেবির পরীক্ষা গুলো?
পরীক্ষার মাঝখানে ফোন দেয়ার মত এত সময় কোথায় খালামনি ।
পাঁচ মিনিট কথা বলার সময় হয়নি তোমার ! পাপাকে ফোন দাওনি বলছো নিশু ?
পাপার সঙ্গে তো কথা বলতেই হতো তাই না !
আমি তো খবর পেয়েছি তুমি প্রতিটা পরীক্ষার পর, পাপা শুধু না হেরার সঙ্গেও অনেকক্ষণ করে কথা বলেছো নিশু !
পাপা আর মামনি অপেক্ষা করে থাকতো তাই ডিনারের আগে আগে চার পাঁচ মিনিট কথা হতো এই যা ।
তোমার পাপা আর দুই দিনের মামনির অপেক্ষা তোমার কাছে অনেক বড় কিছু আমার ফিলিংসের কোন দাম নেই ?
ওফফ খালামনি এত কিছু পরীক্ষার সময় ভাবার মানসিক অবস্থায় ছিলাম না। পরীক্ষার সময় জ্বর হলো সেটাই পাপা মামনি কাউকে বলি নাই টেনশন করবে দেখে ।
তোমার জ্বর ছিল আর তুমি কাউকে বলোনি ! তুমি অনেক চেঞ্জ হয়ে গেছো নিশু ! তুমি অসুস্থ থাকলে আমার সঙ্গে কথা না বললে তোমার অনেক খারাপ লাগতো সব সময় এটাই বলতে, আর আজ তুমি গোপন তো করেছোই এবং ভালোও ছিলে তাই না ? আমার এই পাওনা ছিল বাচ্চা !
প্লিজ খালামনি আমি অতশত ভাবি নাই পরীক্ষার সময় পড়াশোনা নিয়েই ব্যস্ত ছিলাম।
পারুল এসে নিশালের কাছে দাঁড়ালো ।
কিছু বলবে তুমি পারুল বুয়া , নিশাল বলল?
আম্মা আপনার জন্য কেক দিয়ে পাঠালো ।
না এখন খাব না মামনিকে গিয়ে বলো মামনি তো ডিনার করেনি আমি মামনির সঙ্গে পরে কেক খাব !
পারুল বীথির দিকে তাকিয়ে আছে , আপনে খাবেন খালাম্মা ?
বীথি যা ভাগ বলে ধমক দিয়ে উঠলো পারুল কে।
পারুল দৌড়ে চলে গেল।
খালামনি তুমি বসো আমি ওদিকে যাচ্ছি ।
না আমার কথা শেষ হয়নি নিশাল । তুমি আমার সঙ্গে চলো আমার বাসায় । পরীক্ষার পর আমার বাসায় থাকার কথা ছিল তোমার । আর বাবা মনে আছে আমরা প্ল্যান করেছিলাম তুমি আমি তোমার পরীক্ষা শেষ হলে নেপাল ঘুরতে যাব !
খালামনি পাপা আমাকে জীবনেও নেপাল যেতে দিবে না । মনে নেই নেপালে প্লেন ক্রাশ করলো !
প্লেন ক্রাশ করলো বলে ওখানে কি মানুষ যাওয়া বন্ধ হয়ে গেছে ফালতু কথা !
তুমি জোর করলে তোমার পাপা রাজি না হয়ে যাবে কোথায় ?
খালামনি আমি এখন আর পাপার মনের বিরুদ্ধে পাপাকে কোন কাজে বাধ্য করতে চাই না । ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল করার ইচ্ছে নেই আর অনেক হয়েছে । তুমি বসো আমি ঐদিকে যাচ্ছি বলে উঠে গেল নিশাল ।
বীথি তাকিয়ে আছে নিশালের দিকে !
হেরা বেড রুমে ঢুকে দেখে নওশাদ রুমে নেই ! প্রথমে ভাবলো ওয়াসরুমে । তারপর গিয়ে দেখে বারান্দায় বসে আছে । হেরা ঘাড়ে হাত রাখলো, কি ব্যাপার শরীর খারাপ ?
নওশাদ একটু চমকে গেল হঠাৎ হেরা ধরাতে !
না শরীর ঠিক আছে।
তাহলে মন খারাপ ?
ভীড়ের মধ্যে থাকতে ভালো লাগছিল না ! সবাই চলে গেছে ?
যুথী আপা বাচ্চাদের নিয়ে চলে গেছে বাকিরা আছে ! ভাইয়ারা আব্বার রুমে গল্প করছে । আর বাকিরা সব নিচে । আপনি একা বসে আছেন আমি ভাবলাম মন খারাপ ।
সেরকম কিছু না হেরা । নিশাল কোথায় ?
নিচে ।
ও খুব আনন্দ পেয়েছে ।
হুম।
গীতি যাওয়ার পর এভাবে এই বাসায় কোন উৎসব হয়নি । থ্যাংকস তুমি অনেক দিন পর বাসায় একটা আনন্দ করার উপলক্ষ তৈরি করলে । নওশাদ হেরার হাত ধরলো।
থ্যাংকস এর কি হলো, নিশালের ভালো লাগাছে এটাই বড় পাওয়া।
আপনি তো চলে এলেন ছেলে কত সুন্দর গিটার বাজিয়ে শোনালো আমাদের।
তোমার গানটা চমৎকার হয়েছে।
আরে ধুর সবার রিকুয়েস্ট রক্ষা করতে গাইলাম । আমি কখনো মানুষের সামনে গান গেয়েছি নাকি আগে ।
বীথি নওশাদের ঘরের দরজা খোলা দেখে ভেতরে ঢুকলো নক না করেই । বারান্দা থেকে কথা শোনা যাচ্ছে ,বারান্দার কাছে আসতেই দেখে নওশাদ চেয়ারে বসা ওর কোলে হেরা পা দুলিয়ে বসে আছে । হেরা হাত নেড়ে নেড়ে কথা বলছে । দু’জনে কেউই ওকে দেখতে পায়নি। হয়তো ভাবতেই পারেনি এই মুহূর্তে এখানে কেউ আসবে।
ওভাবে দুজনকে দেখে সঙ্গে সঙ্গে বীথির পায়ের রক্ত মাথায় উঠে যাওয়ার মত অবস্থা! সে নিজেকে সামলে নিলো । আদিখ্যেতা। মনে মনে বলল, কিভাবে পারে মানুষ ঘর ভর্তি লোকজন এর ভিতরে রুমের মধ্যে বউ কে কোলে নিয়ে বসে থাকতে !
বীথি জানে না নওশাদ কতটা আদরে, আহ্লাদে, ভালোবাসায় আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রেখেছে হেরাকে। যদি জানতো তাহলে ওর বুকে যে হিংসার আগুন সেটা দিয়ে হেরাকে জ্বালিয়েই দিতো।
বীথি পিছনে চলে গেল আবার রুমের দরজার কাছে গিয়ে দরজায় নক করতে শুরু করলো।
হেরা , হেরা ।
হেরা বীথির গলার আওয়াজ শুনে রুমের ভেতর এসে দাঁড়ালো ।
আসেন আপু ভেতরে আসেন ।
দুলাভাই কোথায় ?
উনি বারান্দায় বসে আছে ডাকছি আপনি বসুন না ।
নওশাদ বারান্দা থেকেই বীথির কথা শুনতে পাচ্ছে । উঠে যেতে ইচ্ছে করছে না। মনটা এত বিক্ষিপ্ত অবস্থায় আছে কথা বলতে ভালো লাগছে না বীথির সঙ্গে তো আরও না।
বীথি বারান্দায় এসে হাজির হলো ।
দুলাভাই আপনার সঙ্গে কথা ছিল ।
বলো ।
আপু বসেন চেয়ারে ।
বীথি নওশাদের সামনে রাখা চেয়ারে গিয়ে বসলো । আপনারা কথা বলেন আমি নিচে যাই ।
থাকতে পারো হেরা এমন কোন কথা নেই যা তোমার সামনে বলা যাবে না।
হেরা নওশাদের পাশে গিয়ে দাঁড়ালো ।
বারান্দার আলো নিভানো আবছা আলোয় নওশাদের চেহারা দেখা যাচ্ছে না। নওশাদ বীথির দিকে তাকিয়ে বলল, বলো কি বলবে ?
দুলাভাই অনেক দিন থেকেই আমি আর নিশাল প্ল্যান করেছিলাম ওর পরীক্ষা শেষ হলে ওকে নিয়ে নেপাল ঘুরতে যাব । আপনার কাছ থেকে অনুমতি নিতে এসেছি।
নওশাদ কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো।
নেপাল ।
হ্যাঁ ও তো কখনো নেপাল যায়নি তাই ওকে নিয়ে ঘুরতে যাওয়ার প্ল্যান করেছিলাম।
নিশাল কি পাহাড় পছন্দ করে নাকি ? আমি তো জানি ওর কিছুটা এক্রোফোবিয়া আছে ।
মানে ?
ওর উচ্চতা ভীতি আছে । তারচেয়েও বড় কথা ত্রিভুবন এয়ার পোর্ট টা খুব রিস্কি । যে কয়বার গিয়েছি টেকঅফ আর ল্যান্ডিংয়ের সময় আমার ই ভয় লাগে। মনে এই বুঝি প্লেন টা ধাক্কা খেলো পাহাড়ের সঙ্গে।
দুলাভাই পাইলট জানে কিভাবে কি করতে হয় এখন যেতে দিবেন কি দিবেন না সেটা বলেন।
নেপাল বাদ দাও মালদ্বীপ থেকে ঘুরে আসো তোমরা, আমি স্পন্সর করব ট্রীপ ।
ওদের কথার মাঝখানে দরজায় ফারহান এসে দাঁড়ালো । বড় ভাবি ?
হেরা রুমে গিয়ে ঢুকলো ।
জ্বি ভাইয়া !
আমরা যাচ্ছি অনেক রাত হয়ে গেছে ভাইয়া কোথায় ?
বারান্দায় বীথি আপুর সঙ্গে কথা বলে ।
ফারহান বারান্দায় এসে দাঁড়ালো । ভাইয়া আমরা যাচ্ছি ।
ঠিক আছে আমি আর নামলাম না।
তোমার আসতে হবে না তুমি কথা বলো।
আমি সবাইকে বিদায় দিয়ে আসি বলে হেরাও ফারহানের সঙ্গে বের হয়ে গেল।
নওশাদের একা বীথির সঙ্গে কথা বলতে অস্বস্তি হচ্ছে।
দুলাভাই আমিও উঠব সমস্যা টা কি নেপাল নাকি আমার সঙ্গে যাওয়া সেটা বলেন ? না আপনি হয়তো ভাবছেন আমার সঙ্গে গিয়ে আপনার বউ হারিয়ে গেছে এখন ছেলে কে নিয়ে ইনসিকিউর ফীল করছেন হয়তো।
এত প্যাচাও কেন বীথি তুমি সমস্যা হতে যাবে কেন ? তুমি নিশালকে কতটা ভালোবাসো আমি জানি।
আমার সমস্যা নেপাল যাওয়া টা। আমার একটা মাত্র সন্তান । তোমার বোনের আমানত ও । আমার জানটা ওর মধ্যে, ওকে নিয়ে সব সময় আমার ভেতরে আতঙ্ক কাজ করে ।
নেপাল কি মানুষ যাচ্ছে না দুলাভাই ?
যাচ্ছে কিন্তু ওরা আমার কেউ না, তোমার আপাও কিন্তু নেপাল পছন্দ করতো না । একবার নিয়ে গেছি পোখরা যাওয়ার পথেই কান্নাকাটি অবস্থা তার । পাহাড়ী রাস্তা খুব ভয় পেতো। নিশাল ও ভয় পায় । প্লেনে বসলে কখনো উইন্ডো সীট নেয় না ।
মালদ্বীপ হলে তখন বলবেন সাগরে গিয়ে প্ল্যান ঝাঁপ দিয়ে পড়বে ?
আপনি কি সব কাজ আপার পছন্দ অনুযায়ী করেন ,এই যে আপার সাজানো ঘরে আরেক জনকে কোলে বসিয়ে ….বীথি চুপ করে গেল ।
নওশাদের এত মেজাজ খারাপ হলো কথাটা শুনে । তারপরও সে ঠান্ডা গলায় বলল, কমপ্লিট করো কথাটা বীথি ?
শোনো আরো অনেক কিছুই হয় এই ঘরে এখন। কথা সেটা না , কথা হলো হেরার জায়গায় বীথি হলেই কি সব শুদ্ধ হয়ে যেতো তখন ? নওশাদ রাগে দুঃখে তাকিয়ে আছে বীথির দিকে । গীতি যাওয়ার পর সে নিজের সঙ্গে প্রমিজ করেছিল গীতির পরিবারের মানুষদের আমৃত্যু নিজের আপনজন ভাববে। কিন্তু বীথি ওর ধৈর্যের পরীক্ষা নেয়ার জন্য বসে থাকে ।
শোন নিশাল যদি যেতে চায় ওকে বলো আমার সঙ্গে কথা বলতে ।
ঠিক আছে। বীথি উঠে গেল।
আর দরজা খোলা থাকলেও কারো বেডরুমে ঢোকার সময় দয়াকরে একটু নক করবে, তা না হলে এমন কিছুর মুখোমুখি হয়তো হয়ে গেলে কষ্ট, রাগ সব অনেক বেশিই বেড়ে যেতে পারে বীথি।
মানে ? বীথি ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো।
মানে বেডরুম আমার বিয়ে করা বউ আমার বাকিটুকু আশাকরি তুমি বুঝতে পারছো।
বীথি উঠে চলে গেল ।
নওশাদের মন খারাপ ছিল বীথির সঙ্গে কথা বলে মন, মেজাজ সবই এখন খারাপ হয়ে গেছে।
মামনি তুমি কিন্তু খুব ভালো গান গেয়েছো আজকে।
চুপ এটাকে গান গাওয়া বলে নাকি !
সত্যি বলছি।
হেরা খাচ্ছে ওর পাশে নিশাল বসে আছে।
পাপা কোথায় মামনি ? কখন থেকে দেখছি না ।
রুমে বীথি আপুর সঙ্গে কথা বলে ।
খালামনির সঙ্গে কি কথা ? নিশাল বিরক্ত নিয়ে তাকালো।
তুমি আর বীথি আপু ঘুরতে নাকি নেপাল যাবে সেটা নিয়ে কথা বলছে ।
নিশাল আরো বিরক্ত হলো এটা শুনে। ঘাড় ফিরিয়ে সিঁড়ির দিকে তাকাতেই দেখে বীথি আসছে।
নিশালের কাছে এসে দাঁড়ালো বীথি । নিশু বেবী পাপা ডাকে উপরে যাও । আর প্লিজ পাপাকে গিয়ে বলো তুমি নেপাল যাবে, প্লিজ আমার জন্য। আমি বাসায় যাচ্ছি তুমি যাও পাপার কাছে।
নিশাল বীথির দিকে তাকিয়ে কিছু বলল না , পাপার রুমের দিকে রওনা হলো।
হেরা খাচ্ছে বীথির সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছে করছে না তার।
বীথি হেরার দিকে তাকিয়ে বলল , গেলাম হেরা তোমার এরেন্জমেন্ট ভালো ছিল আজকে। থ্যাংকস আমার নিশালের জন্য তুমি এতটা চিন্তা করেছো।
আপু নিশালের জন্যই সব কিছু আমাদের ।
তোমার চেষ্টার কোন কমতি নেই বুঝতে পারছি। কয়দিনেই দুলাভাইকে নিশালকে একেবারে হাতের মুঠোয় নিয়ে নিলে ! এই বিদ্যা কি ছোটবেলা থেকেই জানতে নাকি এই বাসায় এসে নওশাদ আজমীর বউ হয়ে শিখে নিয়েছো ? তোমাদের মতো কিছু মেয়ে আছে যাদের দেখলে মনে হয় ভাজা মাছটা উল্টে খেতে পারে না কিন্তু এরা নিজেরাই আসলে গভীর পানির মাছ । তুমি একটা কথা মনে রেখো, যত খুশি নওশাদ আজমীর কোলে বসে দোল খাও আমার নিশালের মাথা খাওয়ার চেষ্টা করবে না ছয় টা বছর ওকে আমি লালন পালন করেছি । এত সহজে আমার ছেলেকে তোমার ছেলে হয়ে যেতে দিব না ! মামনি ডাকে বলেই ওর মা ভাবা শুরু করে দিয়েছো তুমি নিজেকে ! ভুলেও নিশালের মা ভেবো না নিজেকে বলে দিলাম।
হেরা খাওয়া বন্ধ করে তাকিয়ে আছে বীথির দিকে । বীথি হেরার অসহায় দৃষ্টিকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে বাচ্চাদের নিয়ে বেড়িয়ে গেল ।
হেরার বুকের ভিতরে এত যন্ত্রণা হচ্ছে । কষ্টে চোখে পানি চলে এলো। সে উত্তর দিতে পারতো কিন্তু আসলেই কি উনাকে উত্তর দেয়ার অধিকার তার আছে আদো, সে এটাই ভাবছে।
নিশাল পাপার রুমে ঢুকে দেখে পাপা বিছানায় শুয়ে আছে। ঘুমিয়ে গেছো পাপা?
না বাবা শুয়ে আছি।
তোমার কি মন খারাপ ?
আমাকে দেখে তাই মনে হচ্ছে বুঝি ?
হ্যাঁ ! তুমি মাম্মার কথা ভাবছো ।
কিভাবে বুঝলে ? নওশাদ ছেলের দিকে তাকিয়ে আছে।
মাম্মাকে যখন তুমি মিস করো তুমি চুপচাপ হয়ে যাও। আর কেউ না বুঝলেও আমি বুঝে যাই পাপা।
নওশাদ ছেলের মাথায় হাত রাখলো ।
আমাকে তুমি ডেকেছো ?
তুমি কি নেপাল যেতে চাও বীথির সঙ্গে ?
তুমি বললে যাব !
আমি বলি কি নিশাল তুমি আর বীথি অস্ট্রেলিয়া থেকে ঘুরে আসো। নানুকেও দেখে আসলে ,নানু অসুস্থ । তোমার মাম্মা যাওয়ার পর তো তোমার যাওয়া হয়নি অস্ট্রেলিয়া কিছুদিন মামা আর নানুর সঙ্গে থেকে এলে। ওদেরও ভালো লাগবে তোমার ও ভালো লাগবে।
আইডিয়া খারাপ না পাপা। কিন্তু শোয়েব ভাইয়া তো বলল, আমি তুমি মামনি ইউএসএ তে ফুপির বাসায় যাচ্ছি ?
হ্যাঁ তুমি অস্ট্রেলিয়া থেকে ঘুরে আসো তারপর গেলাম কিংবা আমরা ঘুরে আসার পর তুমি গেলে অস্ট্রেলিয়া যেটা তোমার ইচ্ছে।
তাহলে আগে ফুপির ওখানে যাব তারপর নানুকে দেখতে যাব ।
বীথিকে জানিয়ে দাও তোমরা অস্ট্রেলিয়া যাচ্ছো।
তুমি কি নেপালের কথা শুনে রাগ করেছো পাপা ?
রাগ করিনি , ভয় পাই ।
বাবা আমার তোমাকে দূরে যেকোন জায়গায় পাঠাতে ভয় করে । কলেজে নিরাপত্তার ভিতরে থাকো তাই চিন্তা কম হয় তখন কিন্তু অন্য যেখানেই আমার চোখের আড়ালে যাও আমার টেনশন হয়। তুমি ব্যথা পেলে, কষ্ট পেলে মনে হয় তোমার মাম্মা কষ্ট পাচ্ছে। আমি তোমাকে আর তোমার মাম্মা কে কষ্টে আছো দেখতে পারি না।
তুমি টেনশন করো না আমি কোন রিস্ক নেই না পাপা।
ঠিক আছে।
ঘুমাও তুমি আমি গেলাম।গুড নাইট।
গুড নাইট বাচ্চা।
হেরা বীথির কথা গুলো শুনে আর কিছু খেতে পারেনি। ওর এত কান্না পাচ্ছে সে খাবার প্লেট সরিয়ে রেখে দিলো। হাত ধুয়ে উঠে এলো ।
সিঁড়ির কাছে এলিনের পাশ দিয়ে আসার সময় ও হাত ধরে আটকালো ।
কি হয়েছে তোমার ?
কোথায় কিছু হয়নি তো?
বৌমনি এই কয় মাসে তোমাকে অনেকটা চিনে গেছি এটা বিশ্বাস করবে তো ।
হেরা মাটির দিকে তাকিয়ে আছে !
বলবে না আমাকে ?
এলিন বীথি আপুর আমাকে নিয়ে এত সমস্যা কিসের বলো তো ? উনি সহ্য ই করতে পারেন না আমাকে কেন জানি ! হেরা কেঁদে ফেলল।
কি হয়েছে বৌমনি !
হেরা কাঁদতে কাঁদতে বীথির কথা গুলো বলে ফেলল এলিনকে ।
তুমি এগুলো অবশ্যই ভাইয়াকে গিয়ে বলবে এখন !
না কোন দিনও না !
কেন ! উনার জানা উচিত ঐ মহিলা জেনে বুঝে তোমার সঙ্গে কতটা নির্দয় আচরণ করছে । তোমাকে ইচ্ছে করে বিপদে ফেলে চলে এলো শপিং মলে কত বড় দূর্ঘটনা হতে পারতো সেদিন , আজ কত খারাপ খারাপ কথা বলল কিসের জন্য এমন করছে সেটা জানা দরকার সবার ।
না এলিন যত কিছুই বলো উনি নিশালের আপনজন । নিশাল উনাকে খুব ভালোবাসে । অনেক দিন পর নিশাল আর ওর পাপা কাছাকাছি এসেছে আমার জন্য আবার দূরে সরে যাক এটা আমি চাই না।
তাই বলে তোমার বাচ্চাকে কালসাপ বলতে তো উনি পারেন না !
আমার তো বাচ্চাই নেই, আর হবে সে সম্ভাবনাও নেই তাই কেউ কিছু বললেই বা কি আসে যায় বলো। হেরা কথাটা বলেই চোখ মুছে ফেলল।
বাচ্চা হবে না কেন বৌমনি ?
হবে না নিশাল আছে তো আর কারো দরকার নেই আমাদের ।
তুমি কাউকে বলো না এসব কথা নিশাল শুনলে কষ্ট পাবে বীথি আপু যা বলেছে ।
ঠিক আছে যাও , কেঁদো না ফালতু মানুষ দের কথায় কষ্ট পেয়ো না । ভাইয়া তো তোমাকে অনেক ভালোবাসে সেটাই বড় কথা ।
একটা কথা বলব বৌমনি , বাচ্চার ব্যাপার টা কি ভাইয়া বলেছে নাকি তুমিই চাওনা তোমাদের কোন সন্তান হোক?
হেরা মুখে কিছু বলল না শুধু কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে রইলো এলিনের চোখের দিকে।
হেরা শাড়ির আঁচলে চোখ মুছে রুমে ঢুকলো।
নিজের রুমে ঢুকে সে অবাক ! ঘর অন্ধকার নওশাদ ঘুমিয়ে গেছে! এমন কখনো হয়নি ওকে রেখে একা একাই ঘুমিয়ে গেছেন উনি। শরীর খারাপ করেছে ?
হেরা খুব সাবধানে এসে নওশাদের পাশে দাঁড়ালো।
ঘুমাচ্ছে দেখে আর কোন শব্দ করলো না।
নিজের শাড়ি পাল্টে নওশাদের পাশে গিয়ে শুয়ে পড়ল।
ভেবেছিল অন্যান্য রাতের মত নওশাদ ওকে বুকে জড়িয়ে ধরলেই , আজ বীথির দেয়া কষ্ট গুলো ভুলে যেতে পারবে সে। কিন্তু নওশাদ পাশ ফিরে ঘুমিয়ে আছে।
সিলেট থেকে আসার পর নওশাদ ওকে বুকের সঙ্গে আটকে রাখে প্রতি টা রাতে। রাতে হেরার পানির তৃষ্ণা পেলে নওশাদের হাতের বাঁধন খুলে বের হতে হয় তাকে। প্রথম প্রথম হেরার একটু অস্বস্তি হতো সারারাত নওশাদের শক্ত বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে ঘুমাতে। কিন্তু এখন এটা অভ্যাস হয়ে গেছে । ঘুমন্ত নওশাদের ভারী নিঃশ্বাস টা ওর ঘাড়ের ওপর যখন পরে ওর সমস্ত শরীরে আনন্দ খেলে যায়। নওশাদের বুকের পাঁজর উঠা নামা করে সে তার পুরো শরীরের ভেতর তা অনুভব করে। সারা রাতে কতবার যে সে শিহরিত হয় নওশাদের ছোঁয়ায়।
হেরা হাত বাড়িয়ে নওশাদকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরলো। হেরা জানে এই মানুষটার সামান্য একটু স্পর্শ তাকে সব কষ্ট থেকে মুক্তি দিবে। তার খুব বলতে ইচ্ছে করছে নওশাদকে আপনি প্লিজ আমাকে একবার একটু জড়িয়ে নিন আজ আমার ভেতরে অনেক কষ্ট !এই কষ্ট গুলো নিয়ে আমি ঘুমাতে পারছি না।
নওশাদ জেগেই আছে আজ গীতির কথা এত বেশি মনে পড়ছে, এর মাঝে বীথির উল্টোপাল্টা কথা সব মিলিয়ে নওশাদের ভেতরে সেই পুরোনো হাহাকার। হেরা তাকে জড়িয়ে আছে প্রচন্ড আবেগ নিয়ে সে বুঝতে পারছে।
মনে মনে নওশাদ বলল, হেরা আমাকে সামান্য একটু সময় দাও আমি এই হাহাকার থেকে বের হই ।
মাথার কাছের জানালার পর্দা টা একটু ফাঁক হয়ে যাওয়ায় কাচের ভেতর দিয়ে চাঁদের আলোটা ওদের গায়ে এসে পড়ছে। হেরা তাকিয়ে দেখছে তার মনের মতোই বিষন্ন একটা জোছনা তাদের দুজনের গায়ে মেখে আছে। কোন কোন রাতের জোছনা বুকের ভেতরের হাহাকার কে আরো বেশি বাড়িয়ে দেয়। যেমনটা আজ নওশাদের ভেতরে।
দুজন মানুষ আজ দুইরকম কষ্ট বুকে নিয়ে জেগে আছে ।
( চলবে )