তরঙ্গিনী পর্ব-০৪

0
313

#তরঙ্গিনী (পর্ব-৪)

#আরশিয়া_জান্নাত

রেবা, মা বলছিলেন আপনাদের ওখান থেকে ফোন‌ এসেছে, বিয়ের পর তো যাওয়া হয়নি। তাই কাল সকালে রওয়ানা দিবো।

আচ্ছা। আপনার জন্য কয়দিনের কাপড় নিবো? থাকবেন নাকি,,,

আপনার ইচ্ছা কি?

আপনি যা বলবেন,

সবসময় এমন বলেন কেন? আপনার মতামত আমি না জানলে কে জানবে? সবসময় আমার উপরেই ফেলে দিলে হবে?

আপনি যা বলবেন তাই মানবো বলে,

আমি এমন আনুগত্য চাই না রেবা! আমাকে আপনি বন্ধু ভাবছেন না কেন? স্বামী মানেই হুকুমকর্তা নয়। আমরা দুজন একে অপরের মতামত জানবো বলবো। বন্ধুসুলভ আচারণ করবো। তবেই তো সম্পর্ক দৃঢ় হবে তাই না? আপনাকে আমি জানতে চাই, বুঝতে চাই। সেই চেষ্টাই করি সবসময়। কিন্তু আপনি তো আমায় জানতে দিচ্ছেন না। এভাবে হলে আমি একা কতদূর যাবো??

আপনি আমায় ভুল বুঝছেন, ব্যাপারটা এমন নয়।

তবে কেমন? বুঝিয়ে বলুন?

দেখুন আপনি অফিস করেন, আপনার অনেক কাজ থাকে। ওখানে কতদিন থাকবো এটা তো আপনিই ভালো বুঝবেন, আপনার সুবিধা মতো দিন নির্ধারণ,,,

আপনি আমার অভিযোগ বোঝেন‌নি। আমি শুধু আজকের টপিকের পরিপ্রেক্ষিতে বলিনি। আমি চাই আপনি আমার সঙ্গে মনখুলে কথা বলুন, আপনার ইচ্ছা অনিচ্ছা, পছন্দ অপছন্দ, ইভেন আমি কোন রঙের শার্ট পড়বো তা পর্যন্ত আপনি সিলেক্ট করুন। আমি সবসময় ভেবে এসেছি আমার জীবনসঙ্গী যখন আসবে আমি আমার সব দায়িত্ব তাকে দিয়ে দিবো। তার কাজ হবে কেবল আমাতে ডুবে থাকা।

কিন্তু আমিতো শুনেছি আপনি নিজের কাজ নিজে করেন, অন্য কাউকে দিয়ে করাতে পছন্দ করেন না!

আমি নিজের সব কাজ নিজেই করি এটা সত্যি, আর অন্যকাউকে দিয়ে করাতে আমার ভালো লাগেনা। কিন্তু আপনি তো অন্য কেউ নন! আপনি আমার অংশ, আমার অর্ধাঙ্গিনী। আপনার বেলাও তেমন ভাববো?

আমি দুঃখিত। আমার আপনার প্রতি আরো যত্নশীল হওয়া উচিত ছিল। আমি এখন থেকে সব খেয়াল রাখবো।

আরাফ দীর্ঘশ্বাস ফেলে মনে মনে বলল, আপনাকে আমি বোঝাতে পারিনি রেবা! এখানে কাজের লোকের কি অভাব আছে যে আপনাকে কাজ করতে হবে? আমি তো বোঝাতে চেয়েছি আমায় ভালোবাসতে, মেয়েরা ভালোবাসার মানুষের জন্য যা যা করে আপনিও তাই করুন। অথচ আপনি বুঝলেন অন্যটা! কেন আপনি এমন নিযুক্ত কর্মচারীর মতো আচারণ করেন? আমার সামনে নত হয়ে থাকেন! আমি আপনার মনিব না। আমিতো এমন চাই নি রেবা। একটা অদৃশ্য দেয়াল আমাদের মাঝে, যা টপকে না আমি ভেতরে ঢুকতে পারছি; না আপনি আমার ব্যকুলতা দেখতে পারছেন!

রাতে মাকে ফোন করে জানালাম আমরা আগামীকাল সিলেট আসছি। মা শুনে অনেক খুশি হলো। আমি ব্যাগপত্র গুছিয়ে বেলকনীতে গিয়ে বসলাম। আরাফ তখন ল্যাপটপে কাজ করছে। হঠাৎ মনে পড়লো তার দায়িত্ব নিয়েছি আমি।
আপনার জন্য কফি বানিয়ে আনবো?

আরাফ পাশে থাকা কফি মগ দেখিয়ে বলল, ধন্যবাদ,লাগবেনা।

আমি তার সামনে বসে আঙুলে আঁচল পেচাচ্ছিলাম তখন সে বলল, কিছু বলবেন?

আপনি কি আমার উপর রেগে আছেন?

আপনার এমন মনে হলো কেন?

তখন আপনার গলার স্বর শুনে মনে হলো,

আরাফ ল্যাপটপ রেখে আমার দিকে তাকালো। ধীর গলায় বলল, রেবা আমি কথাগুলো রাগ করে বলিনি। আমি আমার মনের কথা গুছিয়ে বলতে পারিনা। হয়তো তখন উত্তেজিত হওয়ার দরুন আপনার তেমন লেগেছে। আপনাকে হার্ট করে থাকলে সরি। প্লিজ ডোন্ট মাইন্ড।

আমি অবাক হয়ে তার দিকে তাকালাম। কারণ আমায় আজ পর্যন্ত কেউ সরি বলেনি। দোষ হোক বা না হোক আমিই সবসময় সরি বলি। অথচ এই মানুষটা সামান্য একটু জোরে কথা বলায় সরি বলছে!

আরাফ আমায় চুপ থাকতে দেখে বলল,আপনি ইন্ট্রোভার্ট এটা আমি জেনেও ওভাবে রিয়েক্ট করা ঠিক হয় নি। আমার উচিত ছিল আপনার ন্যাচার বোঝা। কিন্তু বিশ্বাস করুন আমি আপনাকে পরিবর্তন হতে বলছি না। আপনি যেমন আছেন‌ তেমনই বেশ। আপনার যখন আমাকে কাছের বলে মনে হবে, কিংবা আমি আপনার কম্ফোর্ট জোন হবো। তখনই নাহয় মনখুলে কথা বলবেন! আর আমার বিশ্বাস আষেটা খুব শীঘ্রই হবে।

আমি তার চোখের দিকে তাকালাম। কি প্রশান্তিময় সেই চাহনি! সেই চোখে কোনো ক্রোধ নেই, হিংস্রতা নেই। আছে পরম বিশ্বস্ততার হাতছানি!


সকালে ব্রেকফাস্ট করেই আমরা বের হই, মা ড্রাইভার চাচাকে বারবার করে বলে দিলেন সাবধানে যেন নিয়ে যায়, ঠান্ডা মাথায় ধীরেসুস্থে ড্রাইভ করে।

গাড়িতে বসার পর আরাফ বলল, আসলে মায়ের জার্নি নিয়ে ফোবিয়া আছে। তাই আর কি,,

আমি বললাম, মা আসলে নরম মনের মানুষ। সবার জন্যই অনেক ভাবেন।

কিছুক্ষণ বাইরের দিকে চেয়ে ব্যস্ত নগরী দেখলাম। আমি আবার জার্নিতে জেগে থাকতে পারিনা। গাড়িতে উঠলেই আমার ঘুম আসে। আমি বেশ শান্তিতেই ঘুমের দেশে তলিয়ে গেলাম।

আরাফ ল্যাপটপ অফ করে পাশে তাকিয়ে দেখে রেবা ঘুমাচ্ছে। মুচকি হেসে বলল, ঘুমকাতুরে মেয়ে একটা! ঘুমানোর কম্পিটিশন হলে সে নিশ্চয়ই ফার্স্ট হতো।

ঝাকুনি হতেই রেবা সাইডে পড়ে যাচ্ছিল আরাফ তাকে ধরে ফেলে। সাবধানে একহাতে জড়িয়ে রেবাকে আগলে রাখে পুরোটা সময়। রেবাও তার বরের বুকে মাথা রেখে শান্তিতে ঘুমায়।

বাসার সামনে আসতেই আরাফ আমায় ডেকে তুলে, আমি এক ঘুমে সিলেট পৌঁছে গেছি ভেবেই লজ্জায় পড়ে গেলাম। মানুষটা আমায় কি ভাবলো কে জানে!

গাড়ি থেকে নামতে মা, বড় আপা, ভাইয়া আর ভাবী এলো আমাদের ভেতরে নিতে। অনেক দিন পর সবাইকে দেখে আমার মনটাই ভালো হয়ে গেল। সবাই আরাফকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লো আর আমি আমার ভাতিজী মিম কে কোলে নিয়ে আমার রুমে ঢুকলাম। নিজের রুম যেমনই হোক না কেন এটার মতো স্বস্তির স্থান আর কোথাও হয় না। আমি আমার বেলকনীতে গিয়ে দেখি মা আমার সব গাছকেই যত্নে রেখেছেন। আমি সবকটাকে ছুঁয়ে বললাম,ভালো আছিস তোরা? আমায় মিস করছিলি তোরা তাই না?

মিম বলল, ফুপ্পী জানো তুমি যখন ছিলেনা আমিও তোমার মতো ওদের সাথে গল্প করেছি। ওরা নাহয় বোর হবে তো! এজন্যই এরা এতো ভালো আছে।

আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ আম্মাজান।

(আমার বিয়ে হবার পর মা একা হয়ে যাবেন ভেবে ভাবীরা এখানেই থাকেন)

আমি শাওয়ার থেকে বের হতেই দেখি আরাফ বসে আছে। আমাকে দেখে বলল, বেশ পরিপাটি রুম আপনার। বোঝাই যায় খুব যত্নে সাজিয়েছেন।

ধন্যবাদ। আপনার কিছু লাগবে?

নাহ। যে খাতিরটা হলো আমার। এখন পানি পান করবারো জায়গা নেই।

ধুর বাড়িয়ে বলছেন। আপনার খাওয়ার হাল আমি ভালোই জানি।

আরাফ শার্টের কলার পেছনে ঠেলে বলল, আমি একটু ঘুমাবো। আপনার তো ঘুমাতে হবে না নিশ্চয়ই। পুরোটা জার্নিতে যে ঘুম দিয়েছেন মাশাআল্লাহ!!

আমি ঈষৎ গাল ফুলিয়ে বললাম, ঘুম নিয়ে খোঁচা দিবেন না। আমি একটু বেশি ঘুমাই আর কি! ঘুমাতে পারা একটা আর্ট। সবাই ঘুমাতে পারে না।

জ্বি জ্বি অবশ্যই। আমি তো বলছিনা এটা খারাপ। তবে এমন রোমান্টিক লং জার্নিতে কেউ ঘুমায়। আমিতো ভাবছি হানিমুনে গেলে কি হয়? দেখা গেল টাকা খরচ করে নেপালে গেলাম আর আপনি রেজোর্ট ছেড়ে বের হচ্ছেন না ঘুমের জন্য!! হাহাহা

আমি লজ্জায় মাথা নুইয়ে ফেললাম। তার ধারণা সত্যি এ আমার চেয়ে কেউ ভালো জানে না। কলেজ থেকে কক্সবাজার ট্যুরে গিয়ে আমি বেশিরভাগ সময় ঘুমিয়েই কাটিয়েছিলাম। তখন আমার ফ্রেন্ড মিথিলা বলেছিল, টাকা খরচ করে এতোদূর আসলি বুঝি ঘুমাতে? সূর্যোদয় তো দেখলি না অন্তত অস্তটা দেখতে চল!!

রান্নাঘরে গিয়ে দেখি মা আর ভাবি বিকেলের জন্য নাস্তা তৈরি করছেন। আমি ভাবিকে বললাম, ভাবি তুমি রেস্ট নাও, এই সময়ে এতো খাটতে হবেনা।

মা বলল, আমিও সেই কখন থেকে বলছি গিয়ে বিশ্রাম নিতে। আমার শরীরে এখনো জোর আছে। কিন্তু তোর ভাবী শুনলে তো!

ভাবী হেসে বলল, মা আমাকে একটুও কাজ করতে দেন না রেবা। আপা আসার পর থেকে উনি আর আপাই সব করছেন। সবসময় শুয়ে বসে থাকতে কার ভালো লাগে বলো?

প্রথম কয়েকমাস একটু সাবধানে থাকো না বাপু, এমন তো আমার ঘরে অনেক মানুষ, কাজের শেষ নেই? বুঝলি খুকি তোর ভাইটা আরেক বদ। পানির গ্লাসটা পর্যন্ত তুলে নেয় না। সব কাজ বৌকে করে দিতে হয়, ছেলেটার কবে যে আক্কেল হবে। দিনদিন অলসের ঢেঁকি হচ্ছে, আর এর সব ক্রেডিট তোর ভাবীর। এত বরসোহাগী মেয়ে!!

আমি জোর করে ভাবীকে রুমে পাঠিয়ে মায়ের সঙ্গে যোগ দিলাম। মা আমার দিকে চেয়ে হাসলেন। বললেন, হ্যাঁ রে খুকি ওখানে তোর কোনো কষ্ট হয় না তো? ওনারা সবাই তোর যত্ন করে?

হু অনেক যত্ন করে,

আর তুই?

আমি ও চেষ্টা করি,

শোন মা বিয়ের পর স্বামী সংসারই সব। তাদের মন‌ থেকে ভালোবাসতে হয়, যত্ন করতে হয়। ওখানে কারো সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করবি না, সবসময় হাসিমুখে থাকবি। প্রথম প্রথম একটু কষ্ট হলেও কয়েক বছর পর দেখবি এরাই তোর আপনজন। বিয়ের আগের সব স্মৃতি ভুলে বর্তমানে বাঁচ। একটা কথা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করবি- আমাদের জীবন থেকে কেউ চলে যায় না, আল্লাহই মেহেরবানী করে ভুল মানুষদের সরিয়ে দেন। যা হয়েছে ভালোর জন্যই হয়েছে ভেবে জামাইকে ভালোবাসতে শুরু কর।

আমি শান্তদৃষ্টিতে মায়ের দিকে তাকালাম। ধীর গলায় বললাম, ভালোবাসতে শুরু কর বললেই ভালোবাসা শুরু হয়ে যায়? ভালোবাসা এতো সহজ?

মা হাতের কাজটা না থামিয়ে বললেন, সবকিছুই সহজ। কঠিন ভাবলেই কঠিন। আমরা ভাবি মন বুঝি বড় জ্ঞানী, ওকে ফাঁকি দেওয়া সহজ না! অথচ সত্যিটা হলো মন হচ্ছে সবচেয়ে বোকা। ও যদি বুদ্ধিমান হতো ভুল মানুষের জন্য ভালোবাসা জমাতো না। খবর নিয়ে দেখ গিয়ে কয়টা মন সঠিক মানুষকে ভালোবেসে সুখে আছে? বেশিরভাগ দেখবি আবেগের তাড়নায় ভুল মানুষের জন্য জীবনটা নরক বানিয়ে রেখেছে। তুই অল্পবয়সে বাছবিচার না করে প্রেমে পড়েছিলি। পরিপক্ক বয়সে এসেও লোকে সঠিক মানুষ চিনতে পারে না তোকে আর কি দোষ দিবো। তবে একটা কথা মনে রাখিস মা যে মানুষ সম্মান করতে পারে না, কদর দিতে জানে না, অন্যজনকে অপমান অপদস্ত করার মাঝেই দাম্ভিকতা খুঁজে পায়। সে আর যাই হোক প্রকৃত ভালোবাসা পাওয়ার অধিকার রাখে না। যে প্রেমিকার অপরিপক্ক হাতের রান্না করা খাবারে ভালোবাসা না খুঁজে বিস্বাদ বলে রাস্তায় ছুঁড়ে ফেলে দেয়, তার থেকে ভবিষ্যতে ভালো আচারণ আশা করতে পেরেছিলি কিভাবে?

আমি চমকে মায়ের দিকে তাকালাম, মা সেই ঘটনা কিভাবে জেনেছে?

মা আমার দিকে চেয়ে কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল, তোরা ভাবিস তোরা খুব শেয়ানা, লুকিয়ে বাবা-মাকে ফাঁকি দিতে পারিস। আসলে কি জানিস তোরা আমাদেরই অংশ। আমাদের ফাঁকি দেওয়া এতো সহজ না। তুই যেদিন ভোরে রান্নাঘরে ঢুকে কিসব রান্না করে বক্সে ভরে কোচিং এর জন্য বেরিয়েছিলি, সেদিনই খটকা লাগে আমার। ফেরার পর তোর ফোলা চোখ আর বিবর্ণ মুখ দেখে বুঝলাম কিছু একটা হয়েছে। কিন্তু কি ঘটেছিল তা পরে জেনেছিলাম মিথিলার কাছ থেকে। বলেই দীর্ঘশ্বাস ফেললেন,

আমি মাথা নীচু করে বললাম, মা ওকে অভিশাপ দিও না। এখানে ওর কোনো দোষ‌ নেই। তোমার মেয়ের কোনো গুণই ছিল না, তাছাড়া কেউ তো আর মুখ বুঝে জঘন্য খাবার গিলবে না। প্রেমিকা হোক বা বৌ মুখের উপর রাগ দেখাবেই।

মা আমার দিকে বললেন, আচ্ছা! তবে পরীক্ষা করে দেখি কি বলিস?

আমি মায়ের দিকে তাকালাম, তিনি কি ভাবছেন বোঝার বৃথা চেষ্টা করলাম।

চলবে,,