তারে ভালোবাসি বলে পর্ব-২৪ এবং শেষ পর্ব

0
875

#তারে_ভালোবাসি_বলে
#পর্বঃঅন্তিম_পর্ব
#লেখকঃআয়ান_আহম্মেদ_শুভ
অয়ন দৌড়ে ঘাটে যেতেই দেখতে পেলো জাহাজটা ঘাট থেকে ছেড়ে যাচ্ছে। অয়ন চিৎকার করে বলছে জাহাজটা ঘাটে আসার জন্য। কিন্তু অয়নের চিৎকার কারো কান উবদি পৌঁছায় না। তবে কি‌ ঈশারা সাথে তার আর কখনও দেখা হবে না? অয়ন এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখতে পেলো জাহাজের লোহার চেন টা নিচে পরে আছে। কয়েকজন লোক জাহাজ থেকে সেই চেন টা টেনে তুলছে। অয়ন দৌড়ে সেই লোহার চেনটা ধরে একটা পিলারের সাথে জরিয়ে ধরে রাখলো। জাহাজের গতির কাছে অয়নের‌ শক্তি তুচ্ছ। অয়নের হাতে চেনটা বসে গেছে। রক্ত বেরিয়ে আসছে তার হাত‌ থেকে। অয়ন চিৎকার করে তার কষ্ট লাঘব করছে। এই‌ আঘাতের চেয়ে বেশি যন্ত্রণা দিচ্ছে প্রিয়জন হারানোর কষ্ট। অয়নের চেন ধরে রাখাতে জাহাজ এগোতে পারছে না। ক্যাপ্টেন বাধ্য হয়ে জাহাজটা ঘাটে নিয়ে আসে। জাহাজটা ঘাটে আসতেই অয়ন চেনটা ছেড়ে দিয়ে জাহাজের ভিতর ছুটে চলে যায়। অনুর চোখ দিয়ে প্রবল বর্ষণ হচ্ছে। ভালোবাসার জন্য মানুষ কত কিছু করতে পারে। অয়ন তার উদাহরন। জাহাজ রিটার্ন আসাতে অনু বেশ খুশি হয়েছে। অয়ন জাহাজের ভিতরে গিয়ে পাগলের মতো একটার পর একটা কন্টেনার খুঁজতে লাগলো তার প্রিয়জনকে। অয়ন অনেক খোঁজাখুঁজির পরেও পাচ্ছে না। শেষের একটা কন্টেনার খোজা বাকি। একটাতে যদি না পাওয়া যায় ঈশাকে। তবে অয়ন আর ঈশাকে কখনও পাবে না। অয়ন কন্টেনারের কাছে যেতেই শুনতে পেলো অস্পষ্ট গোঙানির আওয়াজ। অয়ন বিচলিত হয়ে পরলো।

— হ্যাঁ এটা ঈশার আওয়াজ।

অয়ন দ্রুত কন্টেনারটার‌ দিকে এগিয়ে গেলো। অয়ন কন্টেনারটা খুলতেই দেখতে পেলো ঈশা হাত পা বাঁধা অবস্থায় পরে আছে। ঈশাকে এমন অবস্থায় দেখে অয়নের বুকের ভিতর চিন চিন ব্যথা অনুভব করলো। অয়ন ঈশা বলে চিৎকার করে ঈশার দিকে ছুটে চলে আসে। অয়ন ঈশার কাছে হাঁটু গেড়ে বসে ঈশার বাঁধন খুলে দিলো। ঈশা অয়নকে‌ দেখতে পেয়ে চোখ জোড়া ছলছল করে ফেলে। বাঁধন থেকে মুক্ত হতেই ঈশা অয়নকে জরিয়ে ধরে শক্ত করে। ঈশা চিৎকার করে করে কাঁদছে। অয়নের চোখ থেকে পানি পরলেও অয়ন নিশ্চুপ। ঈশা অয়নের বুকের উপর থেকে মাথাটা তুলে অয়নকে উদ্দেশ্য করে বলতে লাগলো

— অয়ন অনু আমাকে এখানে এনে বন্ধ করে দিয়েছে। ও আমাদের ক্ষতি করতে চায়। ওর থেকে আমাদের দূরে থাকতে হবে।

অয়ন ঈশার দিকে হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ল। ঈশা অয়নের গালে হাত রেখে বলল

— এই তোমার এসব কি হয়েছে? ঐ অনু তোমার ও ক্ষতি করে দিয়েছে। আচ্ছা চলো আমরা এই শহর থেকে পালিয়ে যাই। অনেক দূরে চলে যাবো দুজন। আর কেউ আমাদের ক্ষতি করতে পারবে না। আমরা সবার থেকে দূরে চলে যাবো। এমন একটা শহরে চলে যাবো যেখানে আমাদের কেউ চিনবে না। চলো অয়ন চলো।

ঈশা চোখে মুখে ভয়ের ছাপ স্পষ্ট। ঈশা বসা থেকে উঠে দাড়াতেই অনুকে দেখতে পেলো। ঈশা অনুকে দেখে ভয়ে আতকে উঠে। আবারও চিৎকার করে বলে উঠে ঈশা।

— না, এই অনু প্লিজ আমাদের যেতে দাও। তোমার যা লাগবে নিয়ে যাও। আমারা সব তোমায় দিয়ে দিবো। প্লিজ আমার অয়নের কিছু করো‌ না প্লিজ। তুমি আমাকে সহ্য করতে পারো না তো! আচ্ছা আমাকে মেরে ফেলো। কিন্তু অয়নকে কিছু করো না প্লিজ। আমি তোমার পা এ পরি।

অয়ন ঈশাকে বুকের সাথে চেপে ধরলো। ঈশা মানুষিক ভাবে দূর্বল হয়ে পরেছে। অয়ন ঈশাকে উদ্দেশ্য করে বলল

— শান্ত হয়ে যাও ঈশা। অনু কিছু করবে না।

— তুমি জানো না এই মেয়ে সব করতে পারে। তোমার এক্সিডেন্ট টাও ও করিয়েছে। আমাকে মেরে ফেলতে গিয়ে ঐ দিন ভূল করে তোমার এক্সিডেন্টে হয়। অয়ন তুমি জানো না এই অনু কি করতে পারে। আমি চাই না ও তোমার আবার কোনো ক্ষতি করুক। আমি মরে গেলে সব ঠিক হয়ে যাবে। অনু তুমি অয়নকে নিয়ে যাও। আমি আসবো না তোমাদের মাঝে।

অনু কিছু বলছে না। চোখ বেয়ে অশ্রু জল পরছে। অনু ঈশার কাছে এসে হাত জোড় করে বলে

— ঈশা আমাকে ক্ষমা করে দাও। আমি অনেক পাপ করেছি। আমাকে তুমি মাফ করে দাও।

ঈশা অবাক চোখে অয়নের দিকে তাকালো। অয়ন ঈশার দিকে হ্যা সূচক মাথা নাড়ল। ঈশা একটু স্বাভাবিক হয়ে অনুকে বলল

— সত্যি তুমি আমাদের কোনো ক্ষতি করবে না?

— হুম

অয়ন ঈশা কে সবটা খুলে বলল। ঈশা সব কথা শোনার পরে অনুর উদ্দেশ্য বলল

— অনু ভালোবাসা ভালো‌ রাখতে শিখায়। ভালো থাকা কেরে নিতে নয়। উঠো তুমি নিজের ভূল স্বীকার করেছো তাতেই হবেন আমাদের কোনো অভিযোগ নেই তোমায় নিয়ে।

* অয়ন, ঈশা, অনু কন্টেনার থেকে নেমে আসে। ঈশা অয়নের হাত শক্ত করে ধরে আছে। অয়ন ঈশাকে নিজের বাহুর সঙ্গে জরিয়ে হাঁটছে। অনু অয়নের পিছনে। ঈশা আর অয়নকে এক সাথে দেখে অনুর কষ্ট হলেও নিজেকে বোঝাচ্ছে অনু্।

— অয়ন কখনও আমার ছিলো না।

* অয়ন গাড়িতে উঠতে যাবে এমন সময় অনু চিৎকার করে বলে উঠলো

— অয়ন!

অনুর চিৎকারের শব্দ শুনে অয়ন পিছন ফিরে তাকাতেই দেখতে পেলো দিব্ব অনুর চুলের মুঠি ধরে টানতে টানতে নিয়ে‌ যাচ্ছে। অয়ন ঈশার হাত ছেড়ে দিয়ে অনুর দিকে দৌড়ে ছুটে আসতে লাগলো। দিব্ব অয়নকে আসতে দেখে অনুকে ফিসফিস করে বলল

— তোর ভালো মানুষির জন্য আমার রানি ও গেছে আর রাজত্ব ও। তোকে বাঁচিয়ে রাখলে আমার লাভ নেই।

কথাটা শেষ করতেই দিব্ব পকেট থেকে ছুরি টা বের করে অনুর পেট বরাবর গেথে দেৎ। একের পর এক আঘাত করতে লাগলো দিব্ব‌। অয়ন দৌড়ে আসছে কিন্তু অয়ন দেরি করে ফেলেছে। দিব্ব কয়েক বার ছুরিকাঘাত করে অনুকে ফেলে দেয়। অনু মাটিতে লুটিয়ে পরে। দিব্ব দ্রুত স্থান পরিত্যাগ করলো। অয়ন অনুর পাশে গিয়ে বসে পরে। অনু বড় বড় শ্বাস ফেলছে। প্রচুর রক্তক্ষরণ হচ্ছে অনুর। অয়ন অনুকে পরে থাকতে দেখে বলল

— এই অনু কিছু হবে না তোমার। আমি আছি তো। কিছু হতে দিবো না তোমার।

* অনু অয়নের দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসলো। এই হাসির রহস্য বোধগম্য নয়। অয়ন অনুকে কোলে তুলে নিলো। গাড়ির দিকে এগিয়ে আসছে অয়ন। অনু অয়নকে হালকা শব্দ করে বলল

— অয়ন আমার কিছু হবে না। আমার মরন নেই। এতোটা চিহ্নিত হয়ে পরছো কেনো?

— হুমমম তোমায় বাঁচতে হবে।

অয়ন অনুকে গাড়িতে তুলে দ্রুত ড্রাইভ করতে লাগলো। একটা হসপিটালে জরুরী নিতে হবে তাকে। ঈশা অনুকে অনুরোধ করছে চোখ জোড়া খোলা রাখতে। অয়ন হসপিটালের সামনে আসতেই গাড়িটা ব্রেক করলো। অনুকে গাড়ি থেকে নামিয়ে অয়ন স্টেচারে শুয়িয়ে দিতেই অনু দ্রুত শ্বাস নেয়া শুরু করলো। অয়ন অনুর হাত ধরে আছে।

— অনু আর একটু এখনি সব ঠিক হয়ে যাবে। প্লিজ। একটু

অনু ছেড়ে ছেড়ে শ্বাস নিয়ে অনেকটা কষ্ট করে বলল

— অয়ন আমাকে একটু জরিয়ে ধরবে প্লিজ? আর কখনও বায়না করবো না আমি।

অয়ন অনুর মাথাটা নিজের বুকের সাথে চেপে ধরলো। অনু অয়নকে জরিয়ে ধরে বলল

— খুব শীত লাগছে জানো। আমার রক্ত ঠান্ডা হয়ে আসছে। আমাকে মন‌ থেকে ক্ষমা করে দিও অয়ন। অনেক ভালোবাসি তোমায়।

কথাটা শেষ করতেই অনুকে অপারেশন থিয়েটারের নিয়ে যাওয়া হলো। অয়ন ঈশা অপেক্ষা করছে একটা ভালো খবরের জন্য। অপারেশন শেষে ডক্টর হতাশ মুখে অনু্র মৃত্যুর সংবাদ দিলেন। অয়ন চোখটা মুছে ফেললো। কেবিনে চলে যায় অনুকে দেখতে। অনু আজ নিশ্চুপ। এক মূহুর্তের মধ্যে অয়নের মনে পরে গেলো অনুর সাথে তার প্রথম দেখা হবার কথা। মনে পরে গেলো এতো দিন বলা অনুর হাজারো কথা। যা অয়নের কাছে বিরক্তির কারন ছিলো। অয়ন অনুকে উদ্দেশ্য করে বলল

— চলে গেলে তো আমায় ছেড়ে! বন্ধু হয়ে তো সব সময় পাশে চেয়েছি। শুধু তুমি না আমিও তোমায় ভালোবাসি। যেখানেই থাকো, ভালো থেকো তুমি।

ঈশা কান্না করছে অনুকে ধরে। আজ আর অনু কোনো প্রকার আগ্রহ প্রকাশ করছে না অয়ন আর ঈশাকে আলাদা করার। “তাকে ভালোবাসি। ও কেনো আমার হবে না? আমি ওকে নিজের করে ছাড়বো। ওকে আমি না পেলে অন্য কাউকে পেতে দিবো না”। একথা গুলোর ভিক্তি নেই। কারন তাকে পেতে হবে এমন তো কোনো কথা নেই। ভালোবাসা জোর করে তৈরি করা যায় না। সব কিছু জো্য করে পাওয়া গেলেও ভালোবাসা! উহু জোর করে পাবেন না। হৃদয়ের অনুভূতি সবার জন্য আসে না। তাই বলে জোর করা, তার ক্ষতি করতে হবে? ভালোবাসা প্রতিশোধ নিতে নয় বা জোর করতে নয়। ভালোবাসা তাকে ভালো রাখতে শেখায়। সে যার সাথেই থাকুন না‌ কেনো। ভালো থাকুক সব সময়।

* অয়ন ঈশা অনু কে হসপিটালের থেকে নিয়ে আসে। দিব্বকে পুলিশের হাতে তুলে দেয়া হয়। দিব্বর ফাঁসি হয়ে যায়। অয়ন‌ আর ঈশা নিজেদের জীবন আবার সুন্দর করে সাজিয়ে নেয় ভালোবাসা দিয়ে।

— ছিঃ এই সব লিপস্টিক মুখে মেখে কি অবস্থা করে ফেলেছিস তুই?

ঈশার রাগি কন্ঠে ভয় পেয়ে যায় ঈশান। ঈশান দৌড়ে চলে আসে তার বাবার কাছে। অয়ন ঈশানকে এমন অবস্থা দেখে বলল

— বাহ বাহ ঈশান বাবাকে তো আজ অনেক সুন্দর লাগছে।

ঈশান দৌড়ে তার বাবার কোলে চলে আসে। অয়ন ঈশানের দুই গালে ভালোবাসার পরশ এঁকে দেয়। ঈশা অয়নের রুমে এসে রাগে গজগজ করতে করতে বলল

— এই তোমার এই কার্বন কপিকে আমার কাছে দাও। ওর আজ খবর আছে।

ঈশার কথা শুনে ঈশান অয়নের গলা জরিয়ে ধরলো। অয়ন গম্ভীর কন্ঠে বলল

— এসব কি ঈশা? দেখছো ছেলেটা ভয় পেয়ে গেছে।

— ও ভয় পাচ্ছে? ভয় তোমার ছেলেকে দেখে দৌড়ে পালায়। ফাজিল ছেলে আমার ফেভারিট লিপস্টিক টা নষ্ট করে দিয়েছে। আজ ওর একদিন কি আমার একদিন। আসিস তুই আমার কাছে আবার। তখন বুঝাব।

অয়ন হেসে বলল

— আহহহহ থাক হয়েছে আমি নতুন একটা এনে দিবো। ঈশানকে কিছু বলো না তুমি।

— হুম। ছেলে হয়েছে বাবার মতো নাটক বাজ একটা।

— এই যা আমি আবার কবে তোমার লিপস্টিক খেয়েছি?

অয়নের কথা শুনে ঈশা লজ্জা পেয়ে গেলো। ঈশা মৃদু হেসে বলল

— না না। তুমি কেনো খাবে? আমি খেয়ে ফেলি হুমমম। এসব ফালতু মার্কা কথা বলে লাভ হবে না গো। যাও ঈশানকে ফ্রেশ করিয়ে নিয়ে আসো। নাস্তা রেডি করছি আমি। তারপর খেয়ে ভালোয় ভালোয় কেটে পরো। তা না হলে আমার আবার মানুষের মাথা থেকে প্রেমময় ভূত নামানোর কৌশল জানা আছে। দুই বাপ ছেলে আমার জীবনটা ত্যানা ত্যানা করে দিলো। উফফফফ

অয়ন মুখটা মলিন করে ঈশানকে বলল

— চলো বাবা ফ্রেশ হয়ে আসি। তোমার দুষ্টমির জন্য আমাকে কথা শোনা লাগে আর কি।

* অয়ন ঈশানকে নিয়ে চলে যায়। ঈশা রান্না ঘরে। ঈশানকে রেডি করে রুমে রেখে অয়ন রান্না ঘরে উঁকি দেয়।

— ওয়াও মিস রান্না করছে!

অয়ন পা টিপে টিপে পিছন থেকে ঈশাকে জরিয়ে ধরলো। ঘারে মুখ গুজে দিতেই ঈশা ফস করে উঠলো

— এই কি করছো?

— লিপস্টিক টেস্ট করতে এসেছি।

— আহহহহ তাই গো। এই গরম খুন্তি দিয়ে টেষ্ট করাতে হবে নাকি ভালোয় ভালোয় এখান থেকে বিদেয় হবে?

— যাচ্ছি। ডেভিল মার্ক বউ একটা।

অয়ন চলে যেতেই ঈশা মুচকি হেসে ফেলল। এভাবেই চলতে থাকে অয়ন ঈশার ভালোবাসার সংসার। জীবনে বাধা থাকবে, কষ্ট থাকবে, লড়াই থাকবে, তবে কখনও ছেড়ে যাবে না। এমন একজন জীবন সঙ্গী পাওয়া দুষ্কর ব্যাপার। কারন এক সাথে হাত ধরে সব কিছু সামনা সামনি মোকাবেলা করার মতো শক্তি সবার মধ্যে থাকে না। অয়ন ঈশার বাকি জীবনটা যেনো এমনি সুন্দরতম হয়। প্রত্যাশা রইল।

———————– সমাপ্ত—————