তীব্র প্রেমের নেশা পর্ব-৩+৪

0
360

#তীব্র_প্রেমের_নেশা (৩)
#বোরহানা_আক্তার_রেশমী
_______________

ফারদিন ভাইকে দেখে রীতিমতো ভয়ে ঘামতে শুরু করলাম। তীব্র আমার দিকে তাকিয়ে সামনে তাকালেন৷ ফারদিন ভাই ততক্ষণে কাছে চলে এসেছে। তীব্র আমার হাত শক্ত করে ধরে সামনে আনলেন। আমি দৃষ্টি এদিক ওদিক করলাম। ফারদিন ভাইয়ের দৃষ্টি তখনো আমার দিকে। তীব্র অদ্ভুত ভাবে হেঁসে বলে,

‘আরেহ ফারদিন ভাই যে! আপনার মূল্যবান সময় নষ্ট করে আমাদের বিয়েতে এসেছেন! ওয়াও।’

আমি তীব্রর দিকে তাকালাম। তার মুখে অদ্ভুত এক হাসি। ফারদিন ভাই দাঁতে দাঁত চেপে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘তুই ওকে নিজের ইচ্ছেতে বিয়ে করেছিস?’

আমি ফাঁকা ঢোক গিললাম৷ আমার জবাব না পেয়ে তীব্র নিজেই পাশ থেকে উত্তর দিলো, ‘দেখতেই যখন পাচ্ছেন তখন জিজ্ঞেস কেনো করছেন শালা সাহেব? উফস মিস্টেক আপনি তো প্রানেশার বড় ভাই!’

ফারদিন ভাই তীব্রর দিকে কড়া দৃষ্টিতে তাকালো। যেনো চোখ দিয়েই তাকে মে’রে ফেলতেছে। তীব্রর ঠোঁটের কোণে তখনো বাঁকা হাসি। ফারদিন ভাই আমার দিকে তাকিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বললেন,

‘আজ পর্যন্ত কোনো ছেলেকে তোর পাশে ঘেষতে দেইনি এতো সহজে তীব্রর সাথেও থাকতে দিবো না।’

আমি চোখ পিটপিট করলাম। ফারদিন ভাই কি করতে পারে তা আমার হাড়ে হাড়ে জানা আছে। এই একটা মানুষ আমাকে জীবনে শান্তিতে থাকতে দেয়নি৷ জানি না আমি তার ভালোবাসা নাকি জিদ কিন্তু আমাকে পাওয়াটা যেনো তার কাছে জিদ-ই। একবার কলেজে একটা ছেলে সবার সামনে আমাকে প্রপোজ করেছিলো। ব্যাস! পরেরদিনই তার হাত পা ভেঙে হসপিটালে এডমিট করিয়ে এসেছে। সাথে সেদিন আমার গালে ৫ আঙুলের দাগ পড়ে গেছিলো। এরপর থেকে ভয়ে কোনো ছেলে আমার কাছে ঘেঁষতো না আর আমিও শত হাত দুরে থাকতাম। আমার ভাবনার মাঝেই পলি দৌড়ে এসে ফারদিন ভাইকে বললো,

‘ভাইয়া ওদিকে আব্বু তোমাকে ডাকছে। চলো!’

ফারদিন ভাই গম্ভীর গলায় বললেন,’যা তুই। আসছি!’

পলি চলে গেলো। ফারদিন ভাই কাছে এগিয়ে এসে তীব্রর শেরওয়ানি ঝেড়ে বাঁকা হেঁসে বললেন, ‘প্রানেশা আমার। তোকে এতো সহজে কখনোই জিততে দেবো না তীব্র। প্রানেশা আমার মানে শুধুই আমার।’

বিনিময়ে তীব্র হাসে। হুট করেই ফারদিন ভাইকে জড়িয়ে ধরে বলে, ‘বেষ্ট অফ লাক ফারদিন ভাই।’

ফারদিন ভাই তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে চলে যায়। আমি হাফ ছেড়ে বাঁচলাম। তীব্রর মুখের হাসি মিলিয়ে গিয়ে ফুটে ওঠে গম্ভীরতার ছাপ। থমথমে গলায় বলে,

‘আমার সাথে এতো বড় বড় কথা বলো আর ফারিদনকে দেখে এতো ভয় পাও?’

আমি আগে নিজের জায়গায় বসলাম। কয়েক বার বড় বড় করে শ্বাস নিলাম। তীব্রও পাশে এসে বসেছে। আমি ধীর স্বরে বললাম, ‘এই একটা মানুষের কাছে এতোটা অ’ত্যা’চা’রি’ত হয়েছি যতটা কখনো কারোর কাছে হইনি। উনার কথার অবাধ্য হলেও যেখানে আমার জন্য শাস্তি বরাদ্দ ছিলো সেখানে উনাকে না জানিয়ে বিয়ে করে ফেলেছি। না জানি কি করে!’

ঘামতে শুরু করলাম। তীব্রর কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে তার দিকে তাকালাম। চোখ দুটো লাল টকটকে হয়ে আছে, হাত মুষ্টিবদ্ধ করে বসে আছে। উনার চোখ দেখেই ভয় পেলাম। অস্বাভাবিক রকমের লাল। মুহুর্তেই ছুটে আসলেন আঙ্কেল আর ইমন ভাইয়া। আঙ্কেল টিস্যু দিয়ে নিজের কপালের ঘাম মুছে কোনো রকমে বললেন,

‘তীব্র একদম না। এখানে অনেক মানুষ আছে।’

তীব্র ভ’য়ং’কর দৃষ্টিতে তাকিয়ে চোখ বন্ধ করে নিলেন। আঙ্কেলকে কিছুই বললেন না। আমি উনাদের কান্ডে কিছুই বুঝলাম না। সম্ভবত তীব্র রেগে গেছে। কেনো? কি এমন হলো! হঠাৎ করে তীব্র রেগে কেনো গেলো?
____

সন্ধ্যার দিকে ফুপিরা সবাই চলে গেছে। ফারদিন ভাই আরো আগেই চলে গেছে। আমরা কাল ওই বাড়ি যাবো। শুধু আমি আর তীব্র। পলিকে থাকতে বললেও ফুপি থাকতে দিলেন না। এতোটা সময় পর ছাড়া পেয়ে বড় করে শ্বাস নিলাম। কোনো রকমে আগে চেঞ্জ করে শাড়ি পড়লাম। এতক্ষণে নিজেকে হালকা মনে হলো। চোখ মুখ ভালো করে ধুয়ে সব মেক আপ তুলে ফেললাম। একটু পরই তীব্র চলে আসে। চোখ মুখ তখনও গম্ভীর। ভ্রু কুঁচকে তার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে আয়নার সামনে বসলাম। তীব্র কাবাড থেকে প্রয়োজনীয় জিনিস নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকলেন। ততক্ষণে আমি সব ঠিকঠাক করে আগে বিছানায় শুয়ে পড়লাম। গত কয়েকদিন থেকে ধকলের শেষ নেই। ঘুমও হচ্ছে না ঠিকমতো। চুপচাপ ব্ল্যাঙ্কেট মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়লাম। ক্লান্তিতে যখন চোখ বন্ধ হয়ে গেছে তখনই একটা শব্দে চমকে উঠলাম। লাফিয়ে বসে নিজেকে সামলে আশে পাশে তাকালাম। তীব্র ল্যাপটপ হাতে বসে আছে সোফায়। আমি পিটপিট করে তাকাতেই বললো,

‘কি হলো? ভয়ে ঘুম আসছে না? কাল না বললে সজ্ঞানে কোনো রে’পি’ষ্টের সাথে ঘুমাবে না তা আজ কি অজ্ঞানে ঘুমাচ্ছো?’

উনার খোঁচা মা’রা কথায় কপালে ভাজ পড়লো। ক্লান্তিতে মাথা পুরাই ফাঁকা। উনাার সাথে তর্ক করতেও ইচ্ছে করলো না। চুপচাপ পাশ ফিরে শুয়ে পড়লাম। তীব্র বোধহয় অবাকই হলো। কাছে এগিয়ে এসে বললো,

‘তোমার কি শরীর খারাপ লাগছে?’

অদ্ভুত ভাবে উনার কন্ঠে কোনো রাগ, গম্ভীরতা কিছুই টের পেলাম না। অন্যরকম কিছু ছিলো। চোখ মেলে তার দিকে তাকিয়ে বললাম, ‘আপনার এই টেপ রেকর্ডার বন্ধ করবেন প্লিজ? ক’দিন থেকে একদম ঘুম হয়নি। একটু ঘুমাতে দেন!’

তীব্র ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে চুপচাপ চলে যায়। আমি নিজের মতো ঘুমিয়ে পড়লাম। মাঝরাতে মনে হলো কারো ঠান্ডা হাতের স্পর্শ পেলাম। আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরেছে কেউ। কিন্তু ঘুমের জন্য চোখ খুলতে পারলাম না। উষ্ণ জায়গা পেয়ে গুটিশুটি মে’রে ঘুমিয়ে পড়লাম।

পরেরদিন সকাল থেকে তীব্র বেঁকে বসেছে কিছুতেই ফুপিদের বাড়ি যাবে না। আঙ্কেল, আন্টি, তিহা বুঝানোর পরও উনাকে রাজি করাতে পারেনি। উল্টো রেগে বাড়ি থেকেই বের হয়ে গেছেন। মন খারাপ করে লিভিং রুমে সোফায় বসে কার্টুন দেখা শুরু করলাম। ফুপিদের বাড়ি যাবো না! এদিকে এই বাড়িতেও আমার ভালো লাগছে না। কার্টুন দেখতে দেখতে খেয়াল করলাম আন্টি আমার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। আমি তাকাতেই চোখ মুখ কুঁচকে আঙ্কেলকে উদ্দেশ্য করে বললেন,

‘আমার ছেলেটা রেগে না খেয়েই বেরিয়ে গেছে। ঘরে এনেছো এক অ’পয়া মেয়েকে। ছোট বেলায় তো নিজের বাবা মা’কে খে’য়ে এসেছে ৩ বছর থেকে আমার ছেলেকেও খা’ওয়ার জন্য বসে আছে। তার জন্য রেগে যে আমার ছেলে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেছে এতে তার হেলদোল আছে? উল্টো নেচে নেচে কার্টুন দেখছে।’

আরো কিছু কথা শোনালেন। আঙ্কেল ধমক দিলেন আন্টিকে। আমি কোনো রকমে নিজের কান্নাটা গিলে টিভি অফ করলাম। তিহা কাছে এগিয়ে আসতেই আমি হাসার চেষ্টা করে রুমে চলে আসলাম। অন্য কথাগুলো যেমন তেমন বাবা মায়ের কথা উঠলে আমার এমনিই খারাপ লাগে। সেখানে উনি কতগুলো কথা শোনালেন! চুপচাপ ব্যালকনির রেলিংয়ের সাথে হেলান দিয়ে বসে থাকলাম। চোখ বুজে দীর্ঘশ্বাস নিলাম। আমার বাবা মায়ের কোনো স্মৃতিই আমার সাথে নেই। এতোটা ছোট বয়সে তারা মা’রা গেছেন। ফুপির কাছে বাবা মায়ের ফটো দেখেছি। নয়তো তাদের মুখটাও হয়তো ঠিকমতো মনে নেই আমার। কতক্ষণ ওভাবেই বসে ছিলাম মনে নেই। চুপচাপ রেলিং এ হেলান দিয়ে গার্ডেনের দিকে তাকিয়ে ছিলাম। পাশে কারো উপস্থিতি টের পেয়ে পাশ ফিরে তাকাতেই তীব্রকে চোখে পড়লো। আমি তার দিকে একবার তাকিয়ে আবার অন্যদিকে তাকালাম। উনি ধীর কন্ঠে বললেন,

‘সরি!’

আমি চমকে তাকালাম। শান্ত কন্ঠে বললাম, ‘কেনো?’

‘আমার জন্য তোমাকে এতো কথা শুনতে হলো তার জন্য।’

তাচ্ছিল্যের সুরে বললাম, ‘ইটস ওকে। বড়লোকরা ওমন একটু আকটু অপমান করবে এটাই স্বাভাবিক।’

উনি ভ্রু কুঁচকে বললেন, ‘সবসময় ত্যাড়া ত্যাড়া কথা না বললে শান্তি পাও না? বাই দ্যা ওয়ে রেডি হও। যাও!’

‘কোথায় যাবো? ওই বাড়ি?’

‘নাহ গো। হানিমুনে যাবো। যাবে তো বউ?’

আমি থতমত খেলাম। রাগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে উঠে পড়লাম। মুখে তখনো উনার দুষ্টু হাসি। মাঝে মাঝে মন চায় উ’স্টা দিয়া এই ব্যালকনি থেকেই ফেলে দিই। কাপড় গুছিয়ে রেডি হয়ে নিলাম। তীব্রও রেডি হয়ে নিলো। বের হওয়ার সময় আন্টি আমাকে দেখেই মুখ ফিরিয়ে নিয়ে চলে গেলেন। আঙ্কেল আর তিহার থেকেই বিদায় নিলাম। পুরো রাস্তা তীব্র মুখ গম্ভীর করে থাকলো। আমিও কোনো কথা বললাম না। বাড়িতে আসতেই ফুপি আর পলি খুব খুশি হলো। ফুপি, ফুপা, কাকি, কাকা, সবাই ব্যস্ত হয়ে গেলেন তীব্রকে নিয়ে। আমার সাথে সবাই টুকটাক কথা বললেন শুধু। পলি হাসতে হাসতে বললো,

‘বিয়ে করে তুমি পর হয়ে গেছো আপু। এখন তোমার জামাই আপন।’

পলি হাসতে থাকে। আমি মনে মনে হাসলাম। আমি আর আপন ছিলামই বা কবে! আজাদ শেখের ছেলেকে তারা জামাই হিসেবে পেয়েছে তাকে তো আপন করতেই হবে। কিন্তু এ কথাগুলো না বলে হাসিমুখে পলির গাল টেনে দিয়ে বললাম,

‘তোমার বিয়ে হোক তখন তুমিও পর হয়ে তোমার বর আপন হয়ে যাবে।’

পলি মুখ ভেংচালো। ওকে থাকতে বলে আমি রুমে চলে আসলাম। আসার সময় ফারদিন ভাইকে চোখে পড়েনি। ভাগ্যিস সামনে পড়েনি নয়তো সিউর আমাকে থা’প্প’ড় দিয়েই ক্ষ্যান্ত হতো। রুমে এসে প্রথমে ফ্রেশ হয়ে নিলাম। তারপর একবার ব্যালকনিতে উঁকি দিতেই দরজা খোলার শব্দ পাওয়ায় রুমে ফিরে আসলাম। ভেবেছিলাম তীব্র এসেছে কিন্তু সামনে ফারদিন ভাইকে দেখে গলা শুকিয়ে গেলো। আমতা আমতা করে বললাম,

‘ফ-ফারদিন ভাই আপনি! আ-আমার রুমে?’

ফারদিন ভাই শ’য়তানি হাসি হাসলেন। এগিয়ে আসতে আসতে দাঁতে দাঁত চেপে বললেন, ‘আমার অগোচরে বিয়ে করে নিয়েছিস! তাও আবার আমারই শ’ত্রুকে! তোর কলিজা এতো বড় হয়ে গেছে রে? টেনে কলিজাটা বের করে ফেলি?’

ভয়ে আমার গলা শুকিয়ে গেলো। পুরো রুমে আমি আর উনি ছাড়া কেউ নেই। মনে মনে হাজার বার চাচ্ছিলাম কেউ আসুক। বার বার দরজার দিকে তাকিয়ে যখন ফারদিন ভাইকে পাশ কাটিয়ে চলে যেতে নিলাম উনি টেনে ধরলেন আমাকে। সামনে এনে গলা চেপে ধরলেন। রাগী কন্ঠে বললেন,

‘তোর আর তীব্রর খুব বড় মাশুল দিতে হবে। আমি হারবো না ওই তীব্রর কাছে। কখনোই না। তোকে আমি না পেলে তীব্রকেও পেতে দিবো না। তীব্রর চোখের সামনে তোকে তিলে তিলে মা’রবো। ওয়েট & ওয়াচ।’

চলবে..

#তীব্র_প্রেমের_নেশা (৪)
#বোরহানা_আক্তার_রেশমী
_________________

আজ থেকে ভার্সিটিতে যাবো। এই কয়দিন বিয়ের ঝামেলার জন্য ভার্সিটি যাওয়া হয়নি। সেদিন ফুপির বাড়ি থেকে আসার সময় তীব্র আমার সব বই নিয়ে এসেছে। যদিও আমরা শুধু ওখানে ১ দিনই ছিলাম। কিন্তু যতক্ষণ ছিলাম একটা আতঙ্কে ছিলাম। ফারদিন ভাই কেমন ক্রোধ নিয়ে তাকাতেন৷ তীব্রও কম না। ফারদিন ভাইকে দেখিয়ে দেখিয়ে আমার কাছ ঘেঁষে থাকে। এমনি সময় দুজনের মধ্যে যথেষ্ট দূরত্ব থাকলেও ফারদিন ভাইকে দেখলেই তীব্র কাছ ঘেঁষে থাকতো। মিষ্টি সুরে ফারদিন ভাইকে খোঁচা মা’রা তো আছেই। আমি ভেবে পাই না দুজনের মধ্যে আসলে শ’ত্রুতা ঠিক কোথায়! দুজনের মাঝে পড়ে আমি চ্যাপ্টা হয়ে গেছি। আমার ভাবনার মাঝেই তীব্র ঘড়ি পড়তে পড়তে বললো,

‘চলো!’

আমি ফিরে তাকালাম উনার দিকে। পলি আর তিহা এডমিশনের জন্য বসে আছে। আমি এবার অনার্স ২য় বর্ষ। আগে পলির সাথে যাওয়া আসা করতাম আর এখানে তিহা যদি ভর্তি হয়ে যায় তাহলে ওর সাথে যাওয়া আসা করবো। কিন্তু ততদিন পর্যন্ত আমার তীব্রর সাথেই যেতে হবে। হিজাবের পিনটা ঠিক করে ব্যাগ নিয়ে নিলাম। তীব্র ফরমাল গেটআপে আছে। মুখে গম্ভীরতা, কোনো কথা নেই৷ আমি কোনো কথা আশাও করি না। চুপচাপ উনার পিছু পিছু বের হয়ে আসলাম। আসার সময় আন্টি চোখ মুখ কুঁচকে রেখেছিলেন। আমার পড়ালেখার বিষয়টা উনার পছন্দ না। এই তো গতকালই এ নিয়ে তর্কের শেষ ছিলো না। আমি একটা কথাও বলিনি। আন্টি বলছে বিয়ের পর পড়ে কি হবে! কিন্তু তীব্রর কথা তার বউ আমি আমার সব স্বপ্নও তার দায়িত্ব। আমি মনে মনে শুধু হেসেছি। মানুষটাকে আমার যতবার ভালো মনে হয় ঠিক ততবারই মনে পড়ে যায় সেদিন রাত, বি’ভৎস চেহারা আর চিৎকার করে কান্না। ঘৃ’ণায় তখন গা গুলায়। চুপচাপ গাড়িতে বসলাম। তীব্র নিজেও চুপ করে ছিলেন। ভার্সিটির সামনে গাড়ি দাঁড় করিয়ে শুধু এটুকু বললেন,

‘সাবধানে থাকবে। আমি আসবো নিতে। একা যাওয়ার দরকার নেই। ফারদিনকে দেখলে দুরে থাকবে আর নয়তো আমাকে কল দেবে।’

আমি তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে চুপচাপ গাড়ি থেকে নেমে গেলাম। গেইটের ভেতর পা রাখতেই তীব্রর গাড়ি চোখের পলকে উধাও হয়ে গেলো। আমাদের আড্ডা দেওয়ার জায়গায় গিয়ে দেখলাম ফ্রেন্ড সার্কেলের সবাই বসে আছে। আমি কাছে গিয়ে দাঁড়াতেই তানজিলা বললো,

‘কিরে বড়লোকের বউ! বিয়ে তো করছোস দাওয়াত না দিয়া তারওপর এই কয়দিন কোনো যোগাযোগও রাখোস নাই৷ এখন কি দেখতে ভার্সিটি আসছিস?’

আমি ওর মাথায় গাট্টা মে’রে বসে পড়লাম। ৩২ টা দাঁত বের করে বললাম, ‘আসলে হয়ছে কি বল তো! তুই তো একটা পেটুক রানী তাই তোকে বিয়েতে দাওয়াত দেইনি। দেখা গেলো তুই সব খাবার একাই সাবার করে দিছিস। তখন কি করমু?’

সবাই হেঁসে ওঠে। তানজিলা গাল ফুলায়৷ পাশ থেকে সাবিহা বলে, ‘তানজিলা না হয় পেটুক তাই বলে আমাদেরও দাওয়াত দিবি না! এই তুই কেমন বান্ধবী আমাদের? বাই দ্যা ওয়ে শুনলাম তোর নাকি তাশজিদ শেখ তীব্রর সাথে বিয়ে হয়ছে! কিরে ভাই তুই তো রাতারাতি আমার ক্রাশরেই বিয়ে করে ফেললি। বলি তুই এইডা কেমনে পারলি?’

সাবিহা কান্নার ভান করে। ওর কথা শুনে দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। আমার কোনো জবাব না পেয়ে রাতুল বলে, ‘তোর মুখ ওইরকম বা’দরের মতো করে রাখছিস কেন? তীব্র ভাইয়ের মতো জামাই পাইয়াও তোর মুখ ওইরকম হইলে আমাগো বউরা তো পুরাই কষ্টে হার্ট অ্যাটাক করবে।’

আরেকদফা হাসাহাসি হয়। সবাই কিছুক্ষণ বসে থেকে ক্লাসের দিকে গেলো। আমি যেতে নিলে হাত আটকায় সামি। আমি ওর দিকে তাকালাম। ‘ও’ শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে,

‘তুই তীব্র ভাইকে বিয়ে করলি কেনো? তুই কি ভুলে গেছিস উনি কি করেছে?’

‘ভুলিনি। বাদ দে! ক্লাসে চল।’

সামি আর কিছু বললো না। আমাদের ফ্রেন্ড সার্কেলের কেউ ই জানে না তীব্রর বিষয়টা। মূলত আমি আর সামিই জানি তাও বিশেষ একটা কারণে। শুধু আমার ফ্রেন্ড সার্কেল না এই শহরেরও কেউ জানে কি না সন্দেহ। সেদিন রাতে যখন পুলিশ তীব্রকে এরেস্ট করেছিলো তখনই আজাদ আঙ্কেল সবটা সামলে নেয়। তাই তেমন ভাবে কেউই কিছু জানে না। আর আমরাও চুপ থাকার অনেকগুলো কারণ আছে। আমরা বললেই বা কি হতো! আজাদ আঙ্কেল তার পাওয়ার দিয়েই আমাদের মুখও বন্ধ করতো। অবশ্য পুলিশ নিজেও আমাদের কথা শুনতো না যে বললেই কিছু হবে!
______

ভার্সিটিতে শেষ ২ ক্লাস না করে চলে আসলাম আন্টিদের বাড়ি। বাড়িতে ঢুকতেই জুঁই ছুটে আসলো কাছে। ছোট ছোট হাতে আমাকে জড়িয়ে ধরে বললো,

‘মামুনি এতোতিন আতো নি কেনো?’

৩ বছরের মেয়ে। স্পষ্ট ভাবে এখনো কথা বলতে পারে না। আমি ব্যাগ রেখে হেঁসে ওকে কোলে তুলে নিলাম। ওর গালে চুমু খেয়ে বললাম, ‘সরি মামুনি। একটুও সময় পাইনি তাই আসতে পারিনি। কিন্তু আসার সময় তোমার জন্য চকলেট এনেছি৷’

জুঁই খুশিতে আমার গালে টপাটপ দুইটা চুমু দিলো। আমি ব্যাগ থেকে ওর জন্য চকলেট বের করে দিয়ে বললাম, ‘তোমার নানুমনি কোথায়? আর আম্মু কি করছে?’

জুঁই মন খারাপ করে বলে, ‘নানুমনি নান্না(রান্না) করতে আর আম্মা তো ঘুম। ওতে না তো।’

ওর কথায় দীর্ঘশ্বাস নিলাম৷ ওকে খেলতে বলে একবার রান্নাঘরে উঁকি দিয়ে চলে আসলাম জুথি আপুর রুমে। জুথি আপুর নিথর দেহ যেনো পড়ে আছে। গত ১ বছর থেকে উনি কোমায়। যদিও কোমার পেশেন্ট হসপিটালে থাকে কিন্তু উনার ওপর কয়েকবার অ্যাটাক হওয়ায় আমি আর সামি সবকিছুর ব্যবস্থা এই বাড়িতেই করে দিয়েছি। ওদের এই ঠিকানাটা তেমন কেউ জানে না। আল্লাহর রহমতে এখনো আর আপুর ওপর অ্যাটাক হয়নি৷ আমি আপুর পাশে বসে তার হাত আগলে নিলাম। এই আপুকে যতবার দেখি, এই বাড়িতে যত বার আসি ততবার নতুন করে ঘৃ’ণা নিয়ে যাই তীব্রর জন্য। অতোটুকু একটা বাচ্চাকে অনাথ করে দিয়েছে। সবটা ভাবতেই চোয়াল শক্ত হয়ে এলো৷ এরমধ্যেই পেছন থেকে আন্টি গম্ভীর কন্ঠে বললেন,

‘তুমি এইখানে কেন প্রানেশা? তোমার স্বামীকেও সাথে এনেছো!’

আমি অবাক হয়ে তাকালাম। বিয়ের পর আজই তো আসলাম তাহলে আন্টি কেমনে জানলো আমার বিয়ে হয়ে গেছে! আন্টি কি জানে আমার কার সাথে বিয়ে হয়েছে! শুকনো ঢোক গিললাম। আন্টি কি আমাকে ভুল বুঝবে! আমি কিছু বলার আগেই আন্টি বললেন,

‘কি ভাবছো! কিভাবে জানলাম? জেনেছি কোন একভাবে। তুমি আমাদের এতোটা সাহায্য করে এটা কিভাবে করলে প্রানেশা? যে ছেলে আমার ২ মেয়ের জীবন ন’ষ্ট করে দিলো, যার জন্য এক মেয়েকে হারিয়েছি, আরেক মেয়ে কোমায় শুয়ে আছে তুমি তার সাথেই বিয়ে করে নিলে! তোমার এতো লো’ভ!’

মাথায় যেনো আকাশ ভেঙে পড়লো। হতভম্বের মতো তাকিয়ে থাকলাম। আমার লো’ভ! আন্টি আমাকে কিছু বলার সুযোগই দিলেন না। হাত টেনে এনে দরজা থেকে বের করে দিয়ে বললেন,

‘আমাদের শেষ একটা উপকার করো! তোমার স্বামীকে আমাদের ঠিকাানাটা দয়া করে বলো না। আমার ছোট নাতনীকে নিয়ে, আমার মেয়েকে নিয়ে আমাকে বাঁচতে দাও। আর কখনো এবাড়িতে আসবে না।’

মুখের ওপর দরজা বন্ধ করে দিলেন। যাদের জন্য এতো কিছু করলাম তারা এতো সহজে ভুল বুঝলো! অবাকতায়, হতভম্বতায় আমি নির্বাক। কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম দরজার বাহিরে। চোখ থেকে দু ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়লো। নিজেকে সামলে ব্যস্ত ভঙ্গিতে দরজায় কড়া নাড়লাম। এতো সহজে তারা আমাকে কিভাবে ভুল বুঝতে পারে! আমার পুরো কথা তো শুনবে। আমি দরজায় কড়া নাড়লেও ভেতর থেকে আন্টি দরজা খুললো না। হতাশ হয়ে দরজার সামনেই বসে রইলাম। কতক্ষণ ওভাবে ছিলাম জানা নেই। হাতে থাকা ঘড়িতে তাকিয়ে দেখলাম আমার ভার্সিটির ছুটির সময় চলে গেছে। আমাকে তো তীব্র নিতে আসবে বলেছিলো! আমি দ্রুত উঠে দাঁড়ালাম। একবার আমাকে তীব্র না পেলে যদি পরে! তাড়াতাড়ি ছুট লাগালাম। এখান থেকে যেতেও সময় লাগবে প্রায় আধাঘন্টা। তীব্র যদি ভুল করেও এখানকার ঠিকানা পেয়ে যায় তাহলে তো আমি শেষ।

ভার্সিটির সামনে আসতেই কল আসে তানজিলার। দ্রুত রিসিভ করতেই চিন্তিত কন্ঠে বলে, ‘কিরে কই গেছিস তুই? তীব্র ভাই তোকে খুঁজতে খুঁজতে হয়রান হয়ে গেছে। জলদি বাড়ি যা।’

আমি ‘আচ্ছা’ বলে কল কেটে দিলাম। বাড়ির রাস্তায় ছুট লাগালাম। বাড়িতে ঢুকতেই তিহা কাছে ছুটে আসে। ব্যস্ত গলায় বলে, ‘ভাবি ঠিক আছো! জলদি রুমে যাও।’

আমি কিছু না বলে চলে আসলাম। রুমে আসতেই দেখলাম তীব্র এলোমেলো হয়ে বসে আছে। আমি ফাঁকা ঢোক গিলে ধীরে ধীরে রুমে ঢুকলাম। কোনো শব্দ না করে ব্যাগ টেবিলে রেখে পেছনে ঘুরতেই তীব্র ঠান্ডা গলায় বলে,

‘কোথায় গেছিলে?’

আমি চমকে গেলাম। উনার এতো ঠান্ডা গলা আমার ঠিক হজম হলো না। কোনো রকমে কন্ঠ শক্ত করে বললাম, ‘কোথাও যাইনি তো। আমি তো…’

আমাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, ‘ডোন্ট ট্রাই টু ইট! আমি তোমাকে সব জায়গায় খুঁজেছি। তাই মিথ্যা বলার চেষ্টাটাও করবে না।’

আমি ফাঁকা ঢোক গিললাম। নিজেই নিজেকে হাজারটা গা’লি দিলাম। আমার জবাব না পেয়ে তীব্র ঝড়ের গতিতে কাছে এলো। ভয়ে দু পা পিছিয়ে যেতেই দেয়ালের সাথে ধাক্কা খেলাম। উনি চেপে ধরলেন দেয়ালের সাথেই। চোখ দুটো অসম্ভব লাল হয়ে আছে। চুল গুলো উষ্কোখুষ্কো। দাঁতে দাঁত চেপে চেঁচিয়ে বললেন,

‘তোমার কাছে সব মজা মনে হয়? আমি নিষেধ করেছিলাম না একা কোথাও যেতে! আমি করেছিলাম নিষেধ? ‘

চমকে উঠে ভয়ে মাথা নাড়ালাম। উনি বাহুতে চেপে ধরে ফের বললেন, ‘তাহলে গেছো কেনো? ফোন অফ ছিলো কেনো তোমার? আমি কতটা ভয় পেয়েছিলাম তোমার ধারণা আছে?’

আমি উত্তর দিলাম না। আমি আন্টির বাড়িতে যাওয়ার সময় সবসময়ই ফোন অফ করে যেতাম আর ফিরে আসার সময় ফোন অন করে নিতাম। উনি ছেড়ে দিয়ে সরে গেলেন। পেছনে ঘুরে নিজের মাথা চেপে ধরে নিজের রাগ সামলানোর চেষ্টা করলেন। তারপর তাচ্ছিল্যের সুরে হেঁসে বললেন,

‘আমিও কাকে কি বলছি! যার কাছে আমি শুধুমাত্র একটা রে’পি’ষ্ট তার কাছে আবার আমার ফিলিংস! ইম্পসিবল।’

উনার কথায় ভ্রু কুঁচকে বললাম, ‘রে’পি’ষ্ট কে নিশ্চয় রে’পি’ষ্টই বলবো! আর আপনার ফিলিংস? সিরিয়াসলি? যে মানুষ একটা মেয়েকে রে..’

চুপ করে ঢোক গিলে ফের বললাম, ‘এরপর আবার তাকে মে’রেও ফেলে, তার পরিবারকে পর্যন্ত মা’রতে যায় শুধুমাত্র নিজের কার্যসিদ্ধির জন্য তার আবার ফিলিংস!’

উনি দ্বিগুণ রেগে গেলেন৷ আমার দিকে ভ’য়ং’কর দৃষ্টিতে তাকিয়ে ড্রেসিং টেবিলে মিরোরে আ’ঘা’ত করে। রুমের মধ্যে মুহুর্তেই ভাঙচুরের শব্দে কান ঝা ঝা করে ওঠে। তীব্রর হাতে ততক্ষণে রক্তের ফোয়ারা বয়ছে..

চলবে..
(আসসালামু আলাইকুম। ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন)