তুই আমার কাব্য পর্ব-১২

0
2043

#তুই_আমার_কাব্য 🍂

#Writer: Anha Ahmed
#Part: 12
.
🍁
.

মেঘলার বাবা নির্বাক দৃষ্টিতে দাড়িয়ে আছে মেয়েকে দেখে। মেহের মেয়েকে কোলে নিয়ে বাবার দিকে আসতে থাকে। মেঘলার বাবা অর্থাৎ শফিক রহমান মেয়েকে আসতে দেখে অন্যদিকে চলে যায়। যতই হোক অভিমান তো এতো সহজে ভাঙ্গে না। মেহের বাবাকে ওভাবে চলে দেখে চোখের পানি গাল বেয়ে গরিয়ে পড়ে। মেয়েকে কোলে নিয়ে মায়ের দিকে এগিয়ে যায়। মেঘলার মা আর মেয়ের ওপর রাগ করে থাকতে পারে না। নাতনিকে কোলে নিয়ে মেয়েকে হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে নিরবে চোখের পানি ফেলে। সব মানুষ তাদের দিকে তাকিয়ে আছে। নাতনি মেয়েকে পেয়ে মেঘলার মায়ের এতোদিনের যে শূন্যতা তা যেনো মুহুর্তেই পূর্ণ হলো। মোহনা মেঘলা একে একে এসে বোনকে জড়িয়ে ধরে মেয়েকে কোলে নিয়ে আহ্লাদ করতে থাকে। মেহের মেঘলার কাছে মেয়েকে রেখে বাবার দিকে যাবে তখনই পেছন থেকে মেহেরের স্বামী বাঁধা দিলো। চোখ দিয়ে ইশারা করে ওখানেই দাঁড়িয়ে থাকতে বললো। জহির আহমেদ অথাৎ মেহেরর শশুর আর মেহেরের স্বামী শফিক রহমানের কাছে গিয়ে সোফায় দুজন বসে নরমাল স্বরে বলে,

– কি ব্যপার মি. রহমান? এই আনন্দমোহলে আপনার মুখ বিষন্ন। কি আমার নাতনি পছন্দ হয় নি? হা হা

– না না তেমন ব্যপার না। আপনার নাতনি পছন্দ না হওয়ার কি কোনো অবকাশ আছে?

– তা ঠিক। নাতনি আমার হাজারে এক হবে। আচ্ছা মি. রহমান এই যে আমার বড় ছেলে আয়মান রহমান শুভ। আমার কম্পানির ভাবি মালিক।

মেহেরের স্বামী শুভ শফিক রহমানের সামনে গিয়ে পায়ে হাত দিয়ে সালাম করে নিলো। শুভ ওর বাবার পাশে গিয়ে বসে পড়ে। সালাম করে ওঠে জহির আহমেদ আবার বললেন,

– আর আপনার বড় মেয়ের জামাই

কথাটা শুনার সাথে সাথে শফিক রহমান একটা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বলেন,

– আপনাদের প্রি -প্ল্যান ছিলো তাই না?

– আমাদের বলতে শুধুমাত্র আমার আর আমার দুই ছেলের। আমার বৌমা আপনার মতো এসব থেকে অজ্ঞাত ছিলো। মি. রহমান আমি বুঝতে পারছি আপনার রাগ করার কারণটা। আপনার জায়েজও রাগ করা। ইভেন আমি নিজেও প্রথমে অসম্মতি জানিয়েছিলাম কিন্তু কি বলুন তো বাবা তো। আমিও তো বাবা তবে হ্যা আপনার মতো ওতো কঠোর না। মানুষ বলে মেয়ের বাবারা নাকি কঠিন হয় নাকি। আপনি সেটাই প্রমাণ করেছেন। মেয়ের বাবা হওয়া কঠিন না কিন্তু মেয়ের বাবা হওয়াও বড় সৌভাগ্যের ব্যাপার। আমার যে মেয়ে নেই। মেয়ের কমতিটা খুব অনুভব করি। তাই তো আপনার মেয়েটার সাথে থেকে আর রাগ করে থাকতে পারলাম না। আমাদের মান সম্মানের অনেক উপরে এই সন্তানদের ভালো থাকা। ওদের জন্যই বেঁচে থাকা। ওরা ভুল করেছ, অনেক বড়ই ভুল করেছে।

তখনই শুভ পাশে থেকে বলে,

– বাবা আমরা জানি ভুল করেছি। মেহের তো আপনার মেয়ে আর আপনি জানেন ও আপনাকে কতটা ভয় পেতো। এই ভয়ের কারণেই ও মুখ ফুটে বলতেও পারে নি আমার কথা। আর তখন আমিও কেবল পড়াশুনা শেষ করেছি। বাবার বিজনেস ছিলো বলে অন্য কোনো কিছুর প্রতি মন যায় নি। এটাই করবো বলে স্থির ছিলাম। ভেবেছিলাম বিজনেসে জয়েন করার পর একটু গুছিয়ে নিয়ে তারপর আপনাদের জানাবো কিন্তু তার মধ্যেই বিয়ে ঠিক করায় মেহের আরো সাহস করে ওঠলো না আপনাকে বলার। মেহের রাজি ছিলো না পালাতে। কারণ আপনাকে যেমন ভয় পায় তেমন ভালোও বাসে। আপনার সম্মানের কথাও ভাবে। কিন্তু সেদিন আমি ওকে নিয়ে না আসলে ও মারা যেতো। সেইটা কি করে মেনে নিতাম বাবা? আর আপনিও কি মেনে নিতে পারতেন? মারা যাওয়ার পর হয়তো বলতেন কেনো বললো না? কেনো মেয়ের কথা শুনলেন না, বুঝলেন না ইত্যাদি যা প্রায়ই আমরা করি। তাতে কি লাভ হতো? চলে যেতো তো। ফিরে পেতাম না কখনো। তাই বাধ্য হয়ে ওকে নিয়ে আসি। এর জন্য আপনার কাছে হাজার বার ক্ষমা চাইতেও দ্বিধা নেই আমার।

মেঘলার বাবা চুপ করে আছেন। শুভর কথা শেষ হতেই মি. আহমেদ বলেন,

– দেখুন মি. রহমান, এই ভুলটা না করে যদি এরা আমাদের পছন্দ মতো বিয়ে করে নিতো তাহলে কি এখন যেমন প্রাণচ্ছল রয়েছে, যতটা খুশি আছে ততটা থাকতো? মানিয়ে নিয়ে সুখি হওয়ার চেষ্টা করতো কিন্তু সত্যিই কি এতোটা সুখি হতো? আমাদের কাছে ওদের সুখের চেয়ে আর কি আছে বলুন? আর শুধু যে মনের মতো মানুষই দরকার ওদের তা কিন্তু না পরিবারও দরকার ওদের খুশি থাকার স্বার্থে। দেখুন না আপনার মেয়েটা অনেক হাসি খুশি, কিন্তু এরপরও এতদিন একটা শূন্যতা পেয়েছি ওর খুশিতে। আজকে সেই শূন্যতার বেশ খানিকটা ভরেছে আপনি ষোল আনা করে দিন। একজন বাবা একজন বাবার কাছে অনুরোধ করছে, মেয়েটাকে কাছে নিন সকল অভিমান ভুলে। মেয়েটা যে অপেক্ষায় আছে আপনার কাছে আসতে।

মেঘলার বাবা কিছু না বলে এখনো চুপচাপ রয়েছে। সোফা থেকে ওঠে সোজা চলে যায় অন্যদিকে। জহির আহমেদ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। শুভ মাথা নিচু করে পাশ ফিরে মেহেরের দিকে তাকায়। মেহের এখনো আগের জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে। কি হচ্ছে বোঝার চেষ্টা করছে। বাবাকে ওভাবে ওঠে যেতে দেখে বুঝতে বাকি রইলো না যে কোনো কাজ হয় নি। বাবার রাগ কমে নি। অঝোরে চোখ দিয়ে পানি বেয়ে পড়ছে। শুভ মেহেরর অবস্থা দেখে ওঠে গিয়ে মেহের কাছে যায়। পাশে দাড়িয়ে এক হাত দিয়ে মেহেরের বাহুতে চেপে বুকে আগলে রাখে। মেহের নিরবে চোখের পানি পেলে যাচ্ছে। আর এদিকে মেঘলা পড়ে আছে আরেক গোলক ধাঁধায়। মেহেরের মেয়েকে নিজের মায়ের কোলে দিয়ে দেয়। কারণ সে তার নাতনিকে যেনো চোখের আড়াল করতে পারছে না। রক্তের টান বলে একটা কথা আছে না? নাতনি মেয়েকে পেয়ে সে তো সর্বসুখের অধিকারী। তাই নাতনিকে কোল ছাড়া করতে চায়ছে না। মেঘলার মা জানে সে বেশিক্ষণ নিতে পারবে না। হয়তো দেখতেও পারবে না। তাই ইচ্ছে মতো আদর করে নিচ্ছে। মেঘলা মায়ের কোলে দিয়ে সফ্ট ড্রিংকের দিকে যাচ্ছে। তার প্রচুর পানি তৃষ্ণা পেয়েছে। তাই পানি খাবে। পানি খেতে গিয়ে দেখে কাব্য ফ্রেন্ডস নিয়ে ভিষণ ব্যস্ত। হাতে একটা ড্রিঙকসের গ্লাস, পকেটে হাত দিয়ে কুল মুডে আড্ডা দিচ্ছে। এতোকিছু হয়ে গেলো তাই কিছুক্ষণের জন্য মেঘলার খেয়ালও ছিলো না কাব্য এখানে উপস্থিত। কেনো জেনো মেঘলা কাব্যকে যতই দেখছে ততই ভালো লাগছে। আকর্ষণ করছে কাব্য ওকে। হাজার হোক ক্রাশ খেয়েছে বলে কথা। মেঘলা কাব্যর দিকে তাকিয়েই হাঁটছে তখনই সামনে থেকে এক ওয়েটারের কাছে থাকা পানির গ্লাস ড্রেসে গিয়ে পড়লো। ব্যাপারটা কাব্যের চোখ এড়ালো না। মেঘলাও তখন অজানা ভাবেই কাব্যর দিকে তাকায়। কাব্য ভ্রু কুচকে মেঘলার দিকে তাকালো। কাব্যর ওভাবে তাকানো দেখে মেঘলার খুব লজ্জাজনক পরিস্থিতিতে পড়লো। ইস্! কি একটা অবস্থা। এখন কি করবে? মানুষ কি ভাবছে? কাব্য কি ভাবছে? ভাবতেই মেঘলা নিজে নিজে বলে ওঠে,

– আশ্চর্য! আমি এটা কেনো ভাবছি যে কাব্য কি ভাবছে? ওনি কি ভাবলো আর না ভাবলো তাতে আমার আসেই কি যায়ই কি? খারুশ একটা বেটা। যা খুশি ভাবুক। আমার কি? আমার এখন এইটা নিয়ে ভাবতে হবে। কি যে করা যায়? কিভাবে সুকাবো?

ভাবতে ভাবতে পাশে থেকে একজন সুদর্শন মেয়ে এসে বলে,

– ম্যম আপনার কি হেল্প লাগবে? চিন্তিত লাগছে। কোনো প্রবলেম?

– জ্বি আসলে….

মেঘলা মনে মনে ভাবতে থাকে মেয়েটা কিভাবে জানলো তার হেল্প লাগবে। তারপর মনে করে হয়তো মেয়েটাও দেখেছে তাই এগিয়ে এসেছে। মেঘলা ভাবতে ভাবতে মেয়েটা আবারো বলে ওঠে,

– ম্যম আপনি নিঃসংকোচে বলতে পারেন। আমি এই পার্টির ম্যনেজার। সো আপনি বলতে পারেন।

মেঘলা এবার নিঃসংকোচে বলে,

– আমার জামাটায় পানি লেগে ভিজে গেছে। একটা ড্রায়ার হলে ভালো হতো।

– আসুন আমার সাথে।

মেয়েটার পেছন পেছন মেঘলা যায়। মেয়েটা মেঘলাকে একটা ড্রেসিং রুমে নিয়ে গিয়ে ড্রায়ার দেয়। মেঘলা নিজেই পারবে বলে মেয়েটা চলে যায়। মেঘলা জামাটা শুকিয়ে আয়না সামনে থাকায় নিজেকে একটু গুছিয়ে নেয়। হঠাৎই খেয়াল করে আয়নার একপাশে নীল রঙ্গের চিরকুট। এখানেও এমনভাবে চিরকুট দেখে স্বাভাবিকভাবেই অবাক হয়। চিরকুটটা নিয়ে খুলে পড়তে থাকে মেঘলা। তাতে লেখা,

– আকাশের মাঝে মেঘ বিস্তার করে বলে জানা ছিলো। তবে আজ দেখছে মেঘের মাঝে পুরো আকাশটাই বন্ধী হয়ে আছে। আবারো সবাধান করছি। খুনী হয়ে যেয়ো না। যাবৎ জীবন কারদন্ডে দন্ডিত হয়ে থাকতে হবে আমার কয়েদখানায়।

মেঘলা এবার সত্যিই চিন্তায় পড়ে গেলো কে করছে এসব এই ভেবে। কলেজ, বাসা ছেড়ে শেষ পর্যন্ত এখানেও। সব জায়গায় কি নজর রাখছে ছেলেটা? মেঘলা শেষ চিন্তায় পড়ে গেলো। মেঘলার কালকে কাব্যের আচানাক ওখানে ওভাবে চলে এসে বাঁচিয়ে নেওয়া, আজকে এ বাড়িতে প্রবেশের সময়ের ঘটনা এখনকার এইটা সব কিছুতে কেনো জানি কাব্যের দিকে সন্দেহ যাচ্ছে। এইটা সম্ভব নয় তবে অসম্ভবও তো নয়। মেঘলা নিজেকে বোঝাতে চাচ্ছে যে কাব্য হতেই পারে না কিন্তু আবার মন তাকে সন্দেহ করছে। মেঘলা আর এক মুহূর্ত দেরি না করে কাব্য কোথায় সেইটা দেখতে যায়। গিয়ে দেখে কাব্য এখনো বন্ধুদের সাথে আড্ডায় মজে আছে। কিছু একটা ভাবতে ভাবতে খেয়াল করে ফোনটা রেখে এসেছে। ওই রুমে ফিরে গিয়ে ওর ফোনের নিচে আবারো একটা চিরকুট পায়। এবার আর অবাকও হয় নি আর চিন্তায়ও পড়ে নি। ভিষণ বিরক্ত হয়ে চিরকুট খুলে পড়ে,

– চোখ দিয়ে খুুজো না প্রেয়সী আমি দৃশ্যমান নই
তোমার মনে বসবাস আমার তোমার খেয়ালে রই

মেঘলা আবারো দেখতে গেলো কাব্যকে। কাব্য কি এখন কোথায়? এগুলো যদি কাব্য করে থাকে তাহলে এতো দ্রুত আগের জায়গায় আসতে পারবে না। এইটা ভাবতেই আবার ভাবে কাব্য কি করে হয়। ও তো কাব্যকে দেখেই এখানে এলো। যদি কাব্যই হতো তাহলে ওখানে ও থাকতো না। মেঘলা কোনো ক্লু পাচ্ছে না। খুবই হতাশ হয়ে অসহায় মুখ নিয়ে ফিরে আসে পার্টিতে। আর মেঘলার এই অসহায় মুখোভঙ্গিও আরেকজনের মনে তোড়পাড় সৃষ্টি করছে। কি করে একজনের সকল কিছু এতোটা ভালো লাগতে পারে? কেনো সে এতোটা আসক্ত হচ্ছে মেঘলার দিকে। অপলক চেয়ে ভাবতে থাকে।

চলবে….❤