তুই আমার কাব্য পর্ব-১৪

0
1935

#তুই_আমার_কাব্য 🍂

#Writer: Anha Ahmed
#Part: 14
.
🍁
.

রাত সাড়ে দশটা। মেঘলার পরিবার বিদায় নিয়ে নিজের বাড়িতে ফিরে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হচ্ছে। সবাই নিজেদের মধ্যে বিদায় নিয়ে চলে যাবে তখন মেহের ওর মাকে বলে,

– মা আজকের রাতটা থেকে যাও না। কত বছর পর বলতো পেয়েছি তোমাদের। থেকে যাও না। তোমাদের কি ইচ্ছে করে না আমাকে কাছে রাখতে?

– ধুর পাগল মেয়ে কি বলিস এসব? কেনো ইচ্ছে করবে না। কিন্তু সব সময় কি ইচ্ছে করলেই হয় নাকি? তোর বাবা অসুস্থ। কাজের পেশারে বিপি হাই থাকে আর ইদানিং ডায়াবেটিসটাও বেড়েছে। এসব তো আমাকেই দেখে রাখতে হবে তাই না?

– একটা রাতেরই তো ব্যাপার।

– না মা। এখন তো দেখা কথা হবেই। কয়েকদিন পর এসে থেকে যাবো কেমন?

– তাহলে মেঘু কে রেখ যাও। ওর তো কাজ নেই।

মেঘলার মা মেঘলার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করলো,

– কি থাকবি?

মেঘলা প্রথমে খুশি হলো পরক্ষণেই কাব্যর কথা মনে হলো। কাব্যও তো এই বাড়িতে থাকে। ওই খারুশটার সাথে এক বাড়িতে থাকবে? এমনিতেই কদমে কদমে হেনস্তা হতে ওর কাছে আর একই বাড়িতে থাকলে তো আরো অবস্থা খারাপ। এ কথা ভাবতেই সাথে সাথে বলে,

– না না আমি থাকবো না। আমিও অন্য কোনোদিন এসে থাকবো।

পাশে থেকে শুভ বলে,

– শালিকা থেকে যাও। বারবিকিউ হবে রাতে।

– না জিজু। বেঁচে থাকলে পড়েও হবে বারবিকিউ পার্টি। বাঁচা টা জরুরি বেশি।

– বাঁচবে না কেনো? এখনি মরলে হবে? বাঁচতে হবে হাজার বছর।

– না মানে খুব টায়ার্ড তো। শরীরটাও ভালো লাগছে না। বাসায় গিয়ে রেষ্ট নিবো তবেই ভালো লাগবে। তাই আরকি বললাম বেঁচে থাকি আগে।

মেহের মেঘলাকে টান দিয়ে নিজের পাশে বসিয়ে বলে,

– সে তুই এই বাড়িতেও রেষ্ট নিতে পারবি। রুমেে অভাব পড়ে নাই শ্বশুড় বাড়ি। এখানে থাকবি তুই কয়েকটাদিন। বাবুকে নিয়ে একা পাড়ি না। আম্মাও বাড়ি নেই। যতদিন না আম্মা আসে তুই এই বাড়িতেই থাকবি ব্যস!

কয়েকদিন থাকার কথা শুনে মেঘলা বসা থেকে ওঠে গিয়ে উচ্চস্বরে বলে,

– কিহ! কয়েকদিন তাও আবার এই বাড়িতে? পাগল নাকি?

– এখানে পাগলের কি হলো? কেনো এ বাড়িতে বাঘ আছে না ভাল্লুক আছে যে থাকতে পারবি না?

– না মানে

– কোনো মানে না। থাকবি আর এটাই শেষ।

– আপু প্লিজ

– কি আপু? ওওও আচ্ছা বুজেছি। এখন তো আমাকে ছাড়া থাকার অভ্যাস হয়ে গেছে তাই আর আমাকে আগের মতো ভালোবাসিস না। আমাকে ছাড়া যেখানে একটা দিনও থাকতে পারতি না সেখানে এখন তো আর আমাকে মনেই পড়ে না। পর হয়ে গেছি তো। আর জোড় করবো না। যা তুই।

– আপি দ্যাখ ইমোশনালি ব্ল্যাক মেইল করবি না। ওইটা আমার টেকনিক। চুরি করবি না একদমই বলে দিলাম।

মেঘলার কথা শুনে সবাই হেসে ওঠলো। মেঘলার মা পাশে থেকে বলে,

– থেকে যা মেঘলা। মেহের তো ঠিকই বলছে। ওর তো একজন দরকার। আর ছোট বোন থাকতে বড় বোনের অন্য কারো সাহায্য নেওয়ার দরকার পড়ে নাকি?

মেঘলা কি করবে বুঝতে পারছে না। ওরও মন চাচ্ছে এতোদিন পর আপুর সাথে দেখা থেকে যেতে কিন্তু ওই খাটাস ছেমরা। শেষ চেষ্টা করতে করুণ সুরে বলে ওঠে,

– আমার ভার্সিটি আছে। কি হবে সেটার?

মেহের ওঠে মেঘলার সামনে গিয়ে বলে,

– আরে টেনশন নিচ্ছিন কেনো? এখান থেকেই যেতে পারবি। তোর ভার্সিটি কোথায় বল? কাব্যও তো ভার্সিটিতে পড়ে। যাওয়ার সময় তোকে নামিয়ে দিয়ে যাবে।

কাব্যর সাথে যাওয়ার কথা শুনে মেঘলার বুকের ভেতর ধুক করে ওঠলো। যার থেকে দুরে থাকতে চায় তারই ঘাড়ে গিয়ে পড়তে হয়। মেঘলা আর কিছু না বলে চুপচাপ বসে পড়লো। মেহের তো বড্ড খুশি। মোহনাও থাকতে চেয়েছিলো কিন্তু এক্সাম তাই থাকতে পারলো না। সবাই চলে গেলো। মেঘলা অসহায় মুখ নিয়ে বসে রইলো। মেঘলার এমন অসহায় মুখ দেখে ওপর থেকে একজন মুচকি হাসতে থাকে। হয়তো সে বুঝতে পারছে মেঘলার অসহায়ত্বয়ের কারণ।

রাত প্রায় সাড়ে বারো টা। আকাশে হালকা কিছু মেঘ ঘুরছে। অর্ধ চাঁদটাও চারদিক আলোকিতো করে রেখেছে। বেশ কিছুক্ষণ পর পর কিছু মেঘ চাঁদটাকে ঢেকে দিচ্ছে। হালকা ঠান্ডা বাতাস বইছে। ছাদে একটা গোল মিটিং বসে আছে। গোল মিটিং বললে ভুল হবে। ত্রিকোণ মিটিং। মেহের, শুভ ও মেঘলা বসে আছে এক সাইডে আর কাব্য তাদের থেকে খানিকটা দুরে ফোন নিয়ে বসে আছে। মেঘলা বেশ ফ্রি হয়ে গেছে শুভর সাথে। তিন জনে জমিয়ে আড্ডা দিচ্ছে। মাঝখানে বারবিকিউ বানানো হচ্ছে। বানাচ্ছে কাব্য। বাড়তি কোনো লাইট নেই। শুধু আগুনের আলোই তারা বসে আছে। মেঘলা মেহের হাসিতে মেতে আছে সাথে যোগ দিচ্ছে শুভ। ওপর থেকে চাঁদের আলো আর সামনে আগুনের আলো, দুটোর সৌন্দর্য একসাথে হয়ে একজনের সৌন্দর্যকে বাড়িয়ে দিচ্ছে হাজার গুণ। দৃষ্টি যেনো তার থেকে জোর করে সরিযে নিতে হচ্ছে। কি অদ্ভুত তাই না! চোখ নিজের অথচ নিজের কথাই শুনে না। কোনোভাবেই নিজের কাজে মনোযোগ দিতে পারছে না। তাই বাধ্য হয়ে উঠে চলে গেল কাব্য। কাব্য উঠে যেতেই পাশ থেকে শুভ ডাক দিয়ে উঠলো,

– কিরে কাব্য কোথায় যাচ্ছিস? বারবিকিউ বানানো শেষ?

– হ্যাঁ প্রায় শেষ। তোরা থাকছি আমার কিছু কাজ আছে। শেষের টুকু তুই করে নে।

– কেন? তুই কই যাবি? আসবিনা?

– না বললাম তো আমার কাজ আছে।

– আজকে কাজ না করলে হয়না? সবাই বসে আছে এখানে আর তুই? আর দেখতো কত সুন্দর পরিবেশ! মিস করবি ব্রো।

– ভাইয়া! জানিস না মানুষের বেশি সৌন্দর্য বেশিক্ষণ সহ্য হয় না। আমিও সহ্য করতে পারছি না।

কথাগুলো বলেই কাব্য হনহন করে চলে গেলো। মেঘলা মেহের গল্পে মগ্ন। খাওয়া দাওয়া শেষে মেহের কাব্যর জন্য খাবার নিয়ে গেলো নিচে । রাত অনেক হয়েছে তাই সবাই চলে এলো। মেঘলাও নিচে নেমে এলো। যে যার যার মতো রুমে চলে গেলো। মেহের মেঘলাকে ওর রুমে রেখে দরকারি জিনিস দিয়ে চলে গেলো। যেহেতু মেঘলা কোনো জামা কাপড় নিয়ে আসে নি তাই মেহেরের টি -শার্ট ই ওর জন্য প্রযোজ্য হলো কেননা মেহেরের জামা ওর লাগবে না। মেহের একটা ব্লাক কালার স্কার্ট আর বেবি পিংক কালার টি -শার্ট দিয়ে চলে গেলো। মেঘলা দরজা বন্ধ করে শুয়ে পড়বে তখনই ফোনের মেসেজের আওয়াজ শুনতে পেলো। শোয়া অবস্থায়ই ফোনটা চেক করতেই চোখ ছানা বড়া। আগে পেছনে কিছুই লেখা নেই শুধু লেখা,

– জানালাটা খুলো।

মেঘলা দ্রুত জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়াতেই দেখে জানালার ওপর পাশে একটা ঘুড়ি চিপকে আছে। মেঘলা আস্তে করে জানালাটা খুলে ঘুরিটা হাতে নিয়ে আশে পাশে ঝুকে দেখতে লাগলো। যদিও সে জানে তাকে দেখতে পাবে না তবুও আশা রাখতে তো দোষ নেই। যদিই দেখা পেলো অথবা কোনো ক্লু। কিন্তু বরাবরের মতো এবারো সে অদৃশ্য। জানালাটা খুলে রেখেই ঘুরিটা নিয়ে দেখতে দেখতে খাটের উপরে পা তুলে বসলো। একটা চিরকুট বের করে ভাঁজ খুলে দেখে এবারের টা খানিকটা বড়। কি লিখেছে এতো? মেঘলা খুব এক্সাইটেড হয়ে পড়া শুরু করলো,

– জানো আজকে না তোমাকে খুব অসহ্য লাগছিলো। তোমাকে নিতে পারছিলাম না। অসহ্য এক যন্ত্রণা। তোমাকে ছুতে পেলে হয়তো নিস্তার পেতাম। দম বন্ধ করা এক অনুভুতি। সবকিছু ধীরে ধীরে নিস্তেজ হয়ে পড়ছে। ভিষণ অসুস্থ হয়ে পরেছি জানো? জানি না কবে সুস্থ হবো। হয়তো বা মরণব্যাধী। সুস্থই হওয়া হবে না। সুস্থ হতেও চাই না। যুগের পর যুগ এ মরণব্যধী বয়ে নিয়ে বেড়াতে রাজি আমি। কিন্তু আপাতত সেবার প্রয়োজন খুব। যুগ যুগ এ রোগ নিয়ে থাকতে হলে তো বেঁচে থাকতে হবে। আর তার জন্য যত্নের প্রয়োজন, ঔষধ প্রয়োজন। কিন্তু কিভাবে যোগার করবো এসব? এসব জোগাড় করার ক্ষমতা যে আমার এখন একদমই নেই। আমার রোগ কিন্তু ছোঁয়াচে। আমার হয়েছে, তোমারো হতে দেরি নেই। এর থেকে নিস্তার তো তুমি পাবেই না, আমি দেবো না। বার বার তোমাকে সাবধান করেছিলাম মেরো না আমায়। আমায় মেরে ফেললে তুমিও কিন্তু ঔষধের অভাবে মারা যাবে। তোমার সহিত্যচর্চা শুরুর আগেই শেষ হয়ে যাবে। ভেবো না এসব নিয়ে বেশি। ঘুমিয়ে পড়ো।

চিরকুটটা পড়ে মেঘলা এক দৃষ্টিতে তাকিয়েই আছে। কিছুই বুঝলো কি বললো। কিসের রোগ? কেমন রোগ? আবার নাকি বলছে অসুস্থ। আচ্ছা সে কি ঠিক আছে? মেঘলার কি করা উচিৎ? সত্যিই কি মেঘলা দায়ি এর জন্য?
এসব ভাবতে ভাবতে মেঘলা ধীরে ধীরে ওঠে জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়ালো। নিস্তব্ধতায় ঘিরে আছে চার দিক। তখনই ঝিরঝির শব্দ কানে ভেসে আসলো। বৃষ্টি নামছে। এমন অসময়ে বৃষ্টি? বাহিরে হাত বাহিরে বুঝতে পারলো তেমন একটা না। খুবই অল্প। গুরিগুরি বৃষ্টি। ঠান্ডা ঠান্ডা লাগছে খানিকটা। মেঘলা দুই হাত দুই হাতের বাহুতে ঘসে জড়িয়ে রেখে নিশ্বাস নিয়ে ছেড়ে দিলো। আলমারি থেকে একটা চাদর বের করে ছাদের দিকে রওনা হলো। ঘুম আসছে না। তাই একটু ঘুরে আসার নিয়তে ছাদে গেলো। ছাদেে ফ্লোরটা হালকা ভিজে ওঠেছে। গা ছমছম করছে তবুও ভালো লাগছে। কিছু একটা মনে করে জুতোটা খুলে নিয়ে ঠান্ডা ফ্লোরে পা রাখে। পা রাখতেই সারা শরীর কেঁপে ওঠলো শীতে। দুই এক কদম এগোতেই পেছনে কারো অস্তিত্ব পেলো। বেশ ভয় ভয় লাগছে এবার মেঘলার। এতো রাতে কে আসলো? কেউ তো আসার কথা না। তবে কি ভুত? ভুতের কথা ভাবতেই ভয় ধুক ধুক করতে লাগলো বুক। মনে মনে আয়তুল কুরসি পড়া শুরু করলো। চোখ বন্ধ করে পেছন ঘুরে এক চোখ মিটমিট করে খুলতেই দেখে কাব্য দরজার সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে দুই হাত বেঁধে মেঘলার দিকে তাকিয়ে আছে। মেঘলা কাব্যকে দেখে যেনো প্রাণ ফিরে পেলো। একটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বলে,

– আপনি? অহ্! বাঁচা গেলো।

কাব্য ভ্রু জোড়া উঁচু করে মেঘলার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি দিয়ে বলে,

– কি চাই এতো রাতে এখানে? ছাদে কেনো?

– কি চাই মানে? আপনার কি চাই? আপনি কেনো ছাদে এতো রাতে?

মেঘলার কথা শুনে কাব্য দুই পকেটে হাত রেখে সোজা হয়ে দাড়িয়ে জিজ্ঞাসা করে,

– বাড়িটা কার

– আপনার বাবার

– ছাদটা কার?

– বাড়ি যখন আপনার বাবার তখন ছাদটা নিশ্চয় পাশের এলাকার করিম চাচার হবে না।

কাব্য ধীরে ধীরে মেঘলার দিকে এগিয়ে আসতে থাকে। মেঘলা কাব্যর এগিয়ে আসা দেখে ভরকে যায়। মেঘলাও আস্তে আস্তে পিছোতে থাকে। কাব্য আসতে আসতে বলতে থাকে,

– ছাদটা যেহেতু আমার বাবার সো এখানে আমি কখন আসবো না আসবো তার কৈফত চাওয়ার তুমি কে? বরং আমি চাইতে পারি তোমার কাছে। কি মতলবে এতো রাতে ছাদে?

– কি কিছু ন ননা। এমমনি। ঘুম আসছিলো না তা তাই।

– এই মেয়ে! তোতলাচ্ছো কেনো? ঠিক করে কথা বলো। না হলে এক ধাক্কা দিয়ে ছাদ থেকে ফেলে দেবো।

হঠাৎই কাব্যর জোড়ে কথায় মেঘলা চমকিয়ে ওঠে। এই নিস্তব্ধ পরিবেশে কাব্যর ওই সামান্য জোড়ে কথাই যেনো চিৎকারের সম পরিমাণ। পেছন দিকে তাকিয়ে দেখে ছাদটা মোটামুটি ভালই উঁচু। ফেলে দিলে মরবে না কিন্তু হাত পা ঠিকই ভাঙ্গবে। মেঘলা ঠোঁট ফুলিয়ে কাব্যর দিকে তাকিয়ে রয়। এতক্ষণ খেয়াল করে নি সেভাবে কাব্যকে। চাঁদের আলোর মুখোমুখি থাকায় আলোটা সরাসরি কাব্যর মুখে পড়েছে। এলোমেলো চুল কপাল জুড়ে পড়ে আছে। একটা কালো টি-শার্ট ও ছাই কালার টাউজার পড়ে আছে। চোখের চশমাটার কারণে চোখ জোড়া বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে। মুখটা যেনো চাঁদের কাছ থেকে ধার করে নিয়ে এসেছে। আচ্ছ্ ছেলে হয়েও এতো সুন্দর হয় কিরে? মানায় না নাকি মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছে বুঝতে পারছে না। আরো কিছু ভাবতে যাবে তখনই আবারো কাব্য ধমক দিয়ে ওঠে,

– এই মেয়ে? কেবলাকান্তের মতো তাকায়ে আছো কেনো? কোনোদিন ছেলে দেখো নি? আজই প্রথম দেখছো?

কাব্যর এমন ত্যাড়া কথায় মেঘলা রেগে গিয়ে দুই হাত গলা টিপে দিবে এমন করে কাব্যর দিকে নিয়ে মৃদু চিৎকার করে বলে,

– ইউউউউউউউউউউউ…. আআআআআআ

– মেঘলাআআআআ

চলবে……… ❤