তুই আমার কাব্য পর্ব-২৩+২৪

0
1702

#তুই_আমার_কাব্য 🍂

#Writer: Anha Ahmed
#Part: 23
.
🍁
.

শহরজুরে নিস্তব্ধতার ঘন ছায়া। মাঝে মাঝে কিছু জানালা ভেদ করে আসছে কৃত্রিম বাতির আলো। মাথার উপর খোলা আকাশ। তারা শূণ্য আকাশে একা রাজত্ব করছে এই অর্ধচন্দ্র চাঁদটা। ছাদের চওড়া সিমেন্টের রেলিংয়ের ওপর হাত রেখে কোক খেয়ে চলছে দুই নিশাচর। দুজনের চোখই নির্ঘুম। নির্ঘুমরাতটা বিরক্তহীনভাবে কাটাতেই এই মধ্য রাতে ছাদে এসে কোক গিলছে আবির, মেঘলা। দূরের একটা জানালায় আলো জ্বলছে। মেঘলা বেশ গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছে আলো জ্বেলে রাখার কারণ জানার আগ্রহে। অন্যের রুমের দিকে এইভাবে তাকিয়ে থাকা ভদ্রতার সীমা লঙ্ঘন হয় জানা সত্ত্বেও তাকিয়ে আছে। এই এতো রাতে এইভাবে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শুধু কোক খাওয়া খুব বেশি শান্ত মানুষের ছাড়া আর কারো পক্ষে সম্ভব নয়। কিছু তো একটা করতেই হবে। এই কিছু একটা করা এই উদ্দেশ্যেই মূলত এই অভদ্রতার পথ অবলম্বন করছে। জানালার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতেই মেঘলা আবিরকে জিজ্ঞাসা করে,

– ভাইয়া, এই আবির ভাইয়া কয়টা বাজে দেখেন তো।

আবির গালে হাত দিয়ে মেঘলার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। মেঘলার ডাকে চোখ সরিয়ে সামনের দিকে তাকিয়ে বলে,

– ভাইয়া ছাড়া আর কিছু বলা না?

– ভাইয়া ছাড়া আর কি বলবো? মামা, চাচা,খালু, আঙ্কেল..

– হয়ছে হয়ছে থাক থাক ভাইয়াই ভালো। বলো কি বলবে?

– বলছি যে কয়টা বাজে?

– দুটো তেরো

– অনেক রাত হয়ে গেছে। কিন্তু এতো রাতে মানুষ জেগে আছে কেনো?

– আমরা জেগে আছি কেনো?

– ঘুম নাই তাই।

– ওদেরও হয়তো তাই।

– না না। অন্য কোনো কারণ আছে।

আবির এক ভ্রু উঠিয়ে মেঘলার দিকে তাকিয়ে বলে,

– অন্য কারণ বলতে?

– মানে ওই যে সামনের জানালায় দেখো। দুইটা ছেলে কিছু করছে আর বোতল জাতীয় জিনিসে কিছু একটা খাচ্ছে। আই থিংক ড্রিংকস করছে। কিন্তু ওরা বসে বসে ডিংকস করছে কেনো?

– মেঘলা সিরিয়াসলি! তুমি এতোক্ষণ এইসব দেখছিলে?

– হ্যা মানে, তো কি করবো আর? তাই এমনি দেখছিলাম। হি হি

– এতো দুর থেকে কিছু বোঝা যাচ্ছে না কি করছে। দূর্বিন হলে দেখা যেতো।

– আছে আমার কাছে। নিয়ে আসি?

– আর ইউ ম্যাড? এতো রাতে কে কি করে তা দেখার জন্য দুর্বিন আনতে নিচে যাবে? এতো কৌতুহল?

– প্লিজ প্লিজ। আমি যাবো আর আসবো। আর বেশি নিচে না তো। দুই সিড়ি পড়েই। যাষ্ট দুই মিনিট ওয়েট করেন আমি পাঁচ মিনিটে আসছি।

– অ্যা??

– হি হি।

মেঘলা এক দৌড়ে নিচে চলে যায়। আবির কোমরে হাত দিয়ে মেঘলার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে হেসে ওঠে। কৌতুহল কি একটা ব্যপার তাই না? কৌতুহলের বসে মানুষ কখন যে কি করে তা সম্পর্কে হয়তো সে নিজেও অবগত থাকে না। অতিরিক্ত কৌতুহল বিপদের সম্ভাবনাও বহন করে। মেঘলা প্রায় পাঁচ মিনিটের আগেই চলে আসে। হাপাতে হাপাতে এসে দাঁড়ায় ছাদের দরজার কাছে। আবিরকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই নিজে নিজেই দেখা শুরু করে। কিন্ত বোঝতে না পেরে মুখ ফুলিয়ে আবিরের দিকে তাকিয়ে বলে,

– বুঝতেছি না কি করছে। আপনি একটু দেখবেন?

– কেনো কেনো? দেখো তুমি। ভালো করে দেখো। আমার দরকার আছে নাকি?

– প্লিজ

আবির মেঘলার কাছ থেকে অভিমানী দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে দুর্বিনটা নিয়ে নিজে দেখতে থাকতে। দেখার পর নিজেই কিছুটা কপাল কুচকে আবারো দেখে তারপর বলে,

– ওরা দুজন না। বেশ কয়েকজন। জুয়া খেলছে আর ড্রিংকস করছে। কিন্তু এছাড়া আরো কিছু আছে মনে হয়। ঠিক বোঝতে পারছি না। ফিশি ফিশি লাগছে। আবার যা ভাবছি তা নাও হতে পারে। বড়লোকের বিগড়ে যাওয়া সন্তান হয়তো, টাকা উড়াবে কিসে।

– হুমমমমমমমমমমমমমমমমমমমমম। জঘন্য পোলাপাইন।

মেঘলার কথাটা শেষ হতে না হতেই সেখানে এক তৃতীয় ব্যাক্তির গলার শব্দ পাওয়া গেলো।

– বাহ্! জ্যোৎস্না বিলাশ হচ্ছে দেখি।

মেঘলা পেছন ঘুরে তাকাতেই কেনো যেনো এক ভয়ের শীতল বায়ু শরীর ছুঁতে ঠান্ডা করে দিলো। আস্তে করে বলে,

– কাব্য ভাইয়া!

কাব্য দরজায় হেলান দিয়ে দুই হাত বুকের কাছে ক্রশ করে বেঁধে দাঁড়িয়ে অদ্ভুত এক শান্ত ক্ষোভের দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। আবির কাব্য গলার আওয়াজ পেয়ে পেছন ঘুরে তাকিয়েই বিরক্ত হলো। কাব্য আবিরকে উপেক্ষা করে মেঘলা জিজ্ঞাসা করে,

– এতো রাতে ছাদে একটা পরপুরুষে সাথে আসার কারণটা কি জানতে পারি?

– আসলে আমারো ঘুম আসছিলো আর আর আবির ভাইয়ারও ঘুম আসছিলো না। তাই দুজনেই কাকতালীয়ভাবে ছাদে আসি আর এখানেই দেখা হয় বলে গল্প করছিলাম।

– গল্প শেষ?

– না মানে… হ্যা

– রুমে যাও তাহলে

আবির এবার রাগি কন্ঠে বলে ওঠে,

– কে কি করবে সব খবরদারি কি তোকেই করার দায়িত্ব দেয়া হয়েছে?

– আমি তোর সাথে কথা বলছি না। সে আশা করছি তুইও বলবি না।

এই কথা বলে কাব্য এগিয়ে গিয়ে মেঘলার হাত ধরে টেনে আনতে যাবে তখনই টান অনুভা করে পেছন দিকে তাকাতেই কপালের রগ ফুলে ওঠে কাব্যর। কাব্য দাঁতে দাঁত কামড়ে ধরে বলে,

– লিভ হার হ্যন্ড

– ইউ শুড লিভ হার হ্যন্ড

– মেঘলা এখন ওর রুমে যাবে এন্ড যকবে মানে যাবে

– মেঘলা কি করবে না করবে তা ঠিক করতে তুই পারিস না।

– আমি কি পারি আর কি পারি না তা তোর কাছ থেকে জানতে হবে এতোটা দুর্সময় তো আমার আসে নি।

– ঝামেলা করিস না কাব্য

– ঝামেলা আমি করছি না তুই করছিস। ওর হাতটা ছাড়

– সবসময় আমি ছাড়বো তার কি আইন হয়েছে নাকি? আমার সবকিছু এইভাবে ছিনিয়ে নেওয়া তোর অভ্যাসে পরিণত হয়ে যাচ্ছে।

– যা আমার তা তাতে যদে অন্য কেউ ভাগ বসাতে আসে তখন ছিনিয়ে তো নিতেই হয়।

– কোনোকিছুই তোর ছিলো না যা তুই নিয়েছিস। সব কিছু আমার সাইডে ছিলো। তুই জোড় করে নিয়েছিস। এবার আর তা হতে আমি দেবো না। অনেক কিছু নিয়ে নিয়েছিস। আর এক বালু কণাও নিতে দেবো না। মেঘলাকে ছাড়। মেঘলা আমার সাথে থাকবে৷ আমি ওকে সময়মতো পৌঁছে দেবো।

– মেঘলা আমাদের সাথে এসেছে। সো ওর রেসপনসেবলিটি আমাদের।

– মেঘলা তোর ক্ষণিকের রেসন্সিবিলিটি হতে পারে কিন্তু পারমানেন্ট আমার। সি ইজ মাইন।

মেঘলা নিবার্ক দৃষ্টিতে নিরব দর্শকের মতো ওদের কথা শুনে যাচ্ছে। দুইজনেই রেগে পারমানবিক বোমা। এদের মধ্যে মেঘলা কিছু বলবে এতো সাহস বোধহয় এখনো হয় নি মেঘলার। দুই হাত ওর জ্বলছে। কিছু বলতেও পারছে না আবার সহ্য করাও কষ্টকর হয়ে যাচ্ছে। অসহায় এক মুখ করে দুজনের মাঝখানে ফেসে আছে। কে কি, কার কি ছিনিয়ে নিয়েছে সব কিছু ওর মাথার সাড়ে তিন ইঞ্চি উপর দিয়ে চলে যাচ্ছে। বোঝার উদ্দেশ্যই মূলত নিরবতা বজায় রেখেছে। হঠাৎই কাব্য ওর আরেক হাত দিয়ে আবিরের এক কলারে চেপে ধরে কাছে গিয়ে ফিসফিসিয়ে বলে,

– যা বলার বলেছিস একবার। পরবর্তীতে ভুল করেও বলার চেষ্টা করবি না।

আবিরও কাব্যের এক কলার ধরে ফেলে। কেউ যেনো কারো থেকে কম নয়। এক চুল ছাড় দিতেও রাজি না। আবির কাব্যর দিকে অগ্নি দৃষ্টিতে বলে,

– বলার নয় করে দেখাবো। কে কার তা সময়ই বলে দেবে।

বলেই কাব্যকে ধাক্কা দিয়ে কিছুটা দুরে সড়িয়ে দেয়৷ কিন্তু দুজনে ঠিকই মেঘলার হাত ধরে আছে। আবিরের মুখে সি ইজ মাইন কথাটা শুনে মেঘলার কান যেনো ঠান্ডায় জমে গেলো। কি বলবে, কি করবে তার হুশই হারিয়ে ফেলে মেঘলা। কাব্য জোড়ে এক ঝটকা টেনে মেঘলাকে নিজের কাছে এনে নেয়। আচমকা এমন হওয়া মেঘলা হকচকিয়ে ওঠে। কিছু বলতে যাবে তখন আবির কাব্যর কলার দুই হাত দিয়ে ধরে বলে,

– আজকের দিনটা কি ভুলে গেছিস? আজকের দিনে আমার কাছ থেকে অনেক বড় একটা জিনিস কেড়ে নিয়েছিলি মনে আছে? আবার সেই আজকেই আবারো আরেকটা জিনিস কেঁড়ে নিতে এসেছিস?

আবিরের কথা শুনে কাব্য আজকের তারিখটা মনে করে। তারিখটা মনে আসতেই বুকের ভেতরে ধুক করে ওঠে ওর। কিছুটা রাগ কমিয়ে আবিরের রক্তচক্ষুর দিকে তাকিয়ে বলে,

– আমি কাউকে কেড়ে নেই নি। অহনা যা করেছে সেচ্ছায় করেছে। ওর এমন কাজে, চলে যাওয়ার পেছনে তোরা নিজেরা দায়ী। নিজের দোষ অন্যের ঘাড়ে জোড় করে চাপিয়ে দিলেই নিজেদের দোষ ঢাকা পড়ে না।

মেঘলা এতক্ষণ চুপ করে থাকলেও এখন আর চুপ করে থাকতে পারলো না। তাই জোড়ে চিৎকার করে ওঠে বলে,

– স্টপ! কি হচ্ছে কি? একজন আরেকজনকে দোষ দেওয়া ছাড়া আর কি কিছুই নাই? এ বলে তুই করছি তো আরেকজন বলে তুই করছিস। করছেন তো দুজনেই কিন্তু করছেনটা কি? আর এই অহনাটা কে?

আবির কাব্য মেঘলার চিৎকার শুনে একে ওপরকে ছেড়ে দিয়ে দুরে দাঁড়ায়। কাব্য আবার মেঘলার হাত ধরে টেনে বলে,

– এসবের মধ্যে তোমার ডুকে কাজ নেই। জানারও প্রয়োজন নেই। রুমে চলো। অনেক রাত হয়েছে।

মেঘলা হাত ঝাপটা মেরে সড়িয়ে বলে,

– না যাবো না। আমাকে যতক্ষণ না জানাচ্ছেন এই অহনাটা কে আর এর কি হয়েছে? কোথায় চলে গেছে , কেনো গেছে না জানানো পর্যন্ত আমি যাবো না। আবির ভাইয়া তুমি বলো না।

মেঘলা আবিরের দিকে জিজ্ঞাসু পিপাসা চোখে তাকিয়ে আছে। আবির সামন ছাদের রেলিংর উপর দুই হাত ভর করে সামনের দিকে তাকিয়ে আছে। এক গাল বেয়ে নোনা পানি বেয়ে পড়ছে যা মেঘলাকে খুবই অবাক করে আর ওর জানার ইচ্ছা আরো কয়েকগুণ বাড়িয়ে দেয়৷ কি এমন কারণ, কে এই অহনা যে এদের মাঝে একে নিয়ে এতো ঝগড়া, একজনের চোখে উপচে পড়ছে কষ্ট আর আরেকজনের চোখে বাঁধাহীনভাবে গরিয়ে পড়ছে নোনা পানি।

চলবে…. ❤

#তুই_আমার_কাব্য 🍂

#Writer: Anha Ahmed
#Part: 24
.
🍁
.

কাব্য হাতের মুঠো শক্ত করে নিজের রাগ যথাসম্ভব কন্ট্রোল করার চেষ্টা করে। সে জানে এখানে থাকলে রাগ কন্ট্রোল করতে পারবে না। তাই সেখান থেকে এসে পড়ে। রুমে ডুকে সোজা সাওয়ার নিতে চলে যায় ওই অবস্থাতেই।

মেঘলা আবিরের চোখে পানি দেখে একটু শান্ত হয়ে আবিরের কাছে গিয়ে দুই হাত দিয়ে আবিরের একহাত ধরে হালকা ঝাকিয়ে জিজ্ঞাসা করে,

– ভাইয়া বলো না প্লিজ। অহনাটা কে? কি হয়েছে? কেনো তাকে নিয়ে তোমাদের মাঝে এতো ঝামেলা? তু তু তুমি কি ওকে ভালোবাসতে?

আবির একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সামনের দিকে তাকিয়েই বলে,

– হ্যা! বাসতাম। খুবই ভালোবাসতাম। আমার কলিজার টুকরা ছিলো।

তারপর ঘাড় ঘুরিয়ে মেঘলার দিকে তাকিয়ে বলে,

– অহনা আমার একমাত্র ছোট বোন ছিলো আর যার মৃত্যু বার্ষিকী আজ।

মেঘলা আবিরের প্রথম কথাটা শুনে যতটা না অবাক হয়েছে তার থেকে দ্বিগুন আহত হয়েছে শেষের কথাটায়। মুহূর্তেই চোখ দুটো ছলছলিয়ে ওঠে গাল বেয়ে নোনা জল গড়িয়ে পড়ে। কি বলবে এখন? কি বলা উচিৎ তার? আদোও কি কিছু বলা যায়? অপলক আবিরের দিকে তাকিয়ে আছে। কেনো মারা গিয়েছে? কতটুকুই বা বয়স ছিলো মেয়েটার। কেনো এই কম বয়সে দুনিয়ার মায়া ত্যাগ করতে হলো তাকে। এসব প্রশ্ন মেঘলার মাথায় অনবরত ঘুরপাক খেলেও আবিরকে জিজ্ঞাসা করার সাহস হচ্ছে না। মেঘলা আবার আবিরের কাছে গিয়ে ওর হাত ছোঁয়ার আগেই আবির ঘুরে মেঘলার সামনে হাটু গেড়ে বসে ওর দুইহাত মেঘলার একহাতে নিয়ে মাথা ঠেকিয়ে নিরবে চোখের জল ফেলে। মেঘলার এই পরিস্থিতিতে কি করা উচিৎ সে জানে না। তাই কিছু না বলে নিজেও আবিরের সামনে বসে মাথায় হাত রাখতে যাবে ঠিক তখনই গম্ভীর একটা গলার আওয়াজ পেয়ে মেঘলা চকমিকে ওঠে আবিরের থেকে হাত ছুটিয়ে সোজা হয়ে দাড়িয়ে পড়ে। মেঘলার এমন ব্যবহারে আবিরও চমকিয়ে ওঠে সামনে তাকাতেই বুঝতে পারে মেঘলার ওরকম করার কারণ। আবিরও চোখের পানি মুছে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে। মেঘলার মুখ কাচুমাচু হয়ে আছে কারণ তার সামনে প্রায় পুরো পরিবারই। মেঘলার মা- বাবা, আবিরের মা ও বড় ভাই , শুভ, মেহের, অহনা। এরকম সময় এইরকম একটা মুহূর্তে এদের একসাথে এখানে হয়তো মেঘলা দুঃস্বপ্নেও কল্পনা করতে পারে নি। মেঘলার বাবার চোখে তীক্ষ্ণ রাগ। বাবার চোখ মুখ দেখে মেঘলার অর্ন্তরআত্না কেপে ওঠে। নিশ্চয় তারা ভুল বোঝছে ওদের। মেঘলা আশেপাশে তাকিয়ে কাব্যকে খুঁজছে। কাব্য ব্যপারটা জানে। ও হয়তো বাঁচাতে পারবে। কিন্তু খুঁজেও না পেয়ে মনের ভেতর অনেক বড় একটা তুফানের পূর্ব সংকেত পেলো। মেঘলার বাবা রাগ মিশ্রিত গলায় মেঘলার উদ্দেশ্য বলে,

– মেঘলা এখন কয়টা বাজে?

মেঘলা ভয়ার্থ কন্ঠে উত্তর দেয়,

– তি তিনটা প্রায়

– তোমার কাছে কি দুপুর তিনটা মনে হচ্ছে কোনোভাবে?

– ন ন না আব্বু

– তাহলে যখন সবাই ঘুমিয়ে পড়েছি তখন তোমরা একা একা ছাদে কি করো? কি এমন কথা তোমাদের যে রাতে, একটা হোটেলে থাকা স্বত্বেও সেই ছাদে ওঠে সময় কাটাচ্ছো। তোমাদের মধ্যে এমন কি সম্পর্ক?

– আব্বু আ আপনি ভভভুল বুঝচ্ছেন।

– যাষ্ট শাট আপ। আর একটা কথাও তোমার মুখ থেকে আমি শুনতে চাই না। তোমার চেহারাও আমি দেখতে চাই না। যাষ্ট গেট আউট ফ্রম মাই আইস

মেঘলার বাবা উদ্বিগ্ন হয়ে কথাগুলো বলে। মেঘলা ওর বাবার ধমকে বেশ ভয়ে কুচকে যায়। চোখ দিয়ে অনবরত পানির ধারা বয়েই যাচ্ছে। আবির পেছন থেকে নিচু স্বরে মেঘলার বাবার উদ্দেশ্য বলে,

– আংঙ্কেল! আপনি হয়তো ভুল বোঝছেন আমাদের। যা ভাবছেন তা একদমই না। আসলে আমাদের ঘু….

– কোনো এক্সকিউজ না আবির। তোমাদের থেকে এরকম কাজ আমি কখনোই এক্সপেক্ট করি নি। আমার এক মেয়ে একম একটা কাজ করেছে আর এখন দ্বিতীয় মেয়েটাও সেই রাস্তাতেই হাটছে। আমি কি আমার মেয়েদের ভালো শিক্ষা দিতে পারি নি?

মেঘলার বাবা কথাগুলো বলেই চেয়ারে বসে পড়ে। মেঘলার মা দৌড়ে গিয়ে ওর বাবার কাছে গিয়ে তার কাঁধে হাত রেখে করুণ দৃষ্টি নিয়ে তাকায়। পিনপতন একটা পরিস্থিতি। যেখানে শুধু মেঘলায় ফুঁপানোর আওয়াজ শুনা যাচ্ছে। মেঘলার পাশে এসে মেহের ও মোহনা দাড়িয়ে আছে। আবিরের মা আবিরের কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে রাগি দৃষ্টি নিক্ষেপ করে। অনেক কিছু বলতে চাচ্ছে কিন্তু গরমে গরম হাওয়া সে দিতে চায় না তাই চুপ করে আছে। মেঘলার বাবা কিছুক্ষণ চুপ থেকে ওঠে দাঁড়িয়ে আবিরের মায়ের দিকে তাকিয়ে বলে,

– সাহানা! আমার মেয়েকে কি সত্যি তুমি তোমার ছেলের বউ করতে চাও? আমি আমার মেয়েকে দিয়ে দিলাম। আমার দ্বিতীয় বারের মতো আর সম্মান ক্ষয় করতে পারবো না। এর থেকে ভালো মেয়ে যাকে পছন্দ করে তাকে আগেই বিয়ে করে নিক। পরে পালিয়ে গিয়ে বদনামের মুখোমুখি আর হতে পারবো না আমি।

মেঘলার মাথা নিচু করে চোখের পানি ফেলে ফুপাচ্ছিলো। বাবার মুখে বিয়ের কথা শুনে হুট করে মাথা উচু করে পাথর হয়ে দাড়িয়ে তাকিয়ে রইলো। কি বলছে এসব? মেঘলার সাথে আবিরের বিয়ে? মেঘলা কথাটা ভাবতেই অনুভুতি শূন্য হয়ে যাচ্ছে। সাথে সাথে বুকের বাম পাশে সূক্ষ এক ব্যথা অনুভব করছে। কথা বলার ক্ষমতাই হারিয়ে ফেলেছে। পাশে থেকে আবির বলে ওঠে,

– আঙ্কেল আপনি ভুল বুঝছেন। এরকমভাবে একটা সিদ্ধান্তে যাবেন না। পুরো ব্যপারটা বোঝার চেষ্টা করুন।

– কি বোঝতে বলছো? আচ্ছা! তুমি সত্যি করে বলো তাহলে, তুমি মেঘলাকে পছন্দ করো না? কোনো একটা বারতি কথা বলবে না। শুধু হ্যা কি না।

আবির কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে মেঘলার দিকে তাকালো। মেঘলার অসহায় নির্বাক মুখের পেছনের ভাষা পড়তে অক্ষম হয়ে আবির মাথা নিচু করে বলে ওঠে,

– হ্যা

আবিরের মুখে হ্যা সূচক উত্তর মেঘলার মন দুমড়ে মুচড়ে দিলো। একদম ভেঙ্গে পড়েছে। মেঘলা সত্যি যেনো বোবা হয়ে গেছে। বলতেও পারছে না আমি আবির ভাইয়াকে ভালোবাসি না, ভালোবাসি না আমি তাকে। মেঘলা অজান্তেই শুভর দিকে তাকায়। হয়তো শুভ কিছু একটা বোঝতে পেরে বলে,

– বাবা! আমি বলি কি রাগের মাথায় এসব সিদ্ধান্ত নেবেন না। ঠান্ডা মাথায় বসে নেওয়া যাক। আর হতেই তো পারে আমরা যা ভাবছি তা ভুল, এর পেছনে অন্য কোনো কারণ আছে। আর মেঘলা তো আবিরকে সেই ভাবে পছন্দ নাও করতে পারে। হয়তো কেবল বন্ধু ভাবে।

– তুমি কি দেখো কি ওরা কিভাবে ছিলো? নিজের চোখে এসব দেখার পরও আরো কনফার্মেশন চাই তোমার? কোনো সন্দেহের অবকাশ থাকে যে ওরা বন্ধ কেবলমাত্র?

– ব্যাস! আর কারো কাছ থেকে কোনো কথা না। মেহেরের মা, তোমার আপত্তি আছে কোনো?

– নেই, একদনই নেই। কিন্তু এখন এইভাবে সিদ্ধান্ত না নিয়ে বাড়ি গিয়ে আলোচনা করে গোটা বিষয় জেনে তারপর না হয়…

– আর কোনো কথা না। সাহানা তোমার মত?

– দুলাভাই আমি সেই আতে দেখেই সব ঠিক রেখেছি। কিন্তু বিশ্বাস করেন আমিও কখনো আশা করি ওরা এমন কাজ করবে।

– ব্যাস! তাহলে তো হলোই। তাহলে আমি কোনো রিস্ক নিতে চাই না। বাড়ি গিয়ে ওদের এন্গেজমেন্ট আর কাবিন নামা সেড়ে রাখবো। পড়ে আবিরের পড়া শেষ হতে মাত্র দু বছর। তখন ভালো করে বিয়ে দিয়ে তোমাকে মেয়ে দিবো।

মেঘলা বুলিহীন জড় পদার্থের মতো দাড়িয়ে দাড়িয়ে কথাগুলো শুনে গেলো। যেনো ওকে নিয়ে কোনো সওদা কনর্ফাম করা হলো যার সময়কাল মাত্র দুই বছর। এরপর সে অন্যের সম্পদ হয়ে যাবে। চোখ লাল বর্ণ ধারণ করেছে কান্নার ফলে। কেউ সত্যিটা জানার প্রয়োজন মনে না করেই, মেঘলার সম্মতি গ্রহণ করে শুধুমাত্র অর্ধেক দেখেই তিলকে তাল ভেবে কয়েকটা জীবন নষ্ট করার সওদা পাক্কা করে ফেললো। সবসময় চোখে যা দেখা যায় তা সত্যি নাও হতে পারে। অবশ্যই দুই পক্ষ হতে কথা শুনা সত্য উদ্বঘাটনের অন্যতম শর্ত। সবাই নেচে নেমে গেলো। আবিরের মা আবিরকে নিয়ে নিয়ে গেলো। আবির অপরাধের দৃষ্টিতে মেঘলার দিকে তাকিয়ে রইলো। মেঘলার দৃষ্টি মাটিতে। এক ধ্যানে তাকিয়ে আছে মাটির দিকে। বিধ্বস্ত তার চেহারার ভাব। ভেঙ্গে খানখান হয়ে আছে। বুকের ভেতর কিছু একটা না পাওয়ার অজানা ব্যাথায় ক্রমশ আহত হয়ে চলছে। ভালোবাসা নামক আজব, অসহ্যকরম সুন্দর জিনিসে কি সে আক্রান্ত কোনোভাবে? না হলে কেনো শূন্য অনুভব হচ্ছে? কেনো এতো বেশি কষ্ট হচ্ছে? শুধু কি ভুল বুঝেছে এই আক্ষেপে, এই কষ্টে? নাকি আরো কিছু মিশ্রিত? বাঁচা কি সম্ভব হবে? বোঝতে কি সক্ষম হবে মেঘলা এই অতিরিক্ত ব্যাথা হওয়ার কারণটা?

চলবে …. ❤

হ্যাপি রিডিং। ধন্যবাদ সবাইকে।