#তুমিময়_আসক্তি
#কলমে_আলো_ইসলাম
“৩৯”
— জেসমিন চৌধুরী আর দোলা দুজনে রিভোলবার নিয়ে কাড়াকাড়ি করার সময় একটা গুলি বেরিয়ে যায় চাপ লেগে। গুলির শব্দে সবাই চমকে উঠে হতভম্ব হয়ে তাকায়। “তানিয়া চিৎকার করে মা বলে উঠে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। সবাই তানিয়ার দিকে বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে থাকে অবাক হয়ে। জেসমিন চৌধুরী তানিয়ার দিকে তাকিয়ে আঁতকে ওঠে রিভোলবার ফেলে দিয়ে মাটিতে বসে পড়ে।
— দোলা বড় বড় চোখ করে তাকায় তানিয়ার দিকে। সবার চোখ মুখে ভয়ের ছাপ। তানভীর আহমেদ ছুটে যায় তানিয়ার কাছে। তানিয়ার মাথাটা কোলে নিয়ে তানিয়াকে ডাকতে থাকে। বাকিরা এখনো যেনো বিষ্ময় কাটিয়ে উঠতে পারিনি৷ এর পর একে একে সবাই ছুটে যায় তানিয়ার কাছে। দোলা এখনো একই ভাবে তাকিয়ে আছে৷ কি হয়ে গেলো বুঝতে বেশ কিছুটা সময় লাগে তার৷ আর জেসমিন চৌধুরী বাকরুদ্ধ হয়ে স্থীর চোখে তাকিয়ে আছে সামনে।
— সবাই মিলে তানিয়াকে ঘিরে ধরেছে। তানিয়ার চোখ দিয়ে অঝোরে পানি পড়ছে৷ চোখ দুটো খুব কষ্টে খুলে রেখেছে যেনো সে৷
— শেষ পর্যন্ত নিজের মেয়েকেও ছাড়লে না জেসু৷ গুলি করলে নিজ হাতে। তুমি নাকি মা৷ ছিহ! আজ সত্যি আমার মেয়েটার জন্য করুণা হচ্ছে৷ যে কিনা এমন একটা মা পেয়েছে৷ যে মা নিজের সন্তানকেও হত্যা করতে পিছপা হয়না। তোমার মা হওয়ার কোনো যোগ্যতাই নেই। তোমার কঠিন শাস্তি হওয়া উচিত৷ আমার মেয়ের যদি কিছু হয় তাহলে তোমাকে আমি কখনো ক্ষমা করবো না এই বলে রাখছি, চোখ লাল করে বলে তানভীর আহমেদ। এরপর তানিয়ার দিকে মনোযোগ দেয় সে।
– জেসমিন চৌধুরী মাটির দিকে তাকিয়ে আছে৷ অনেক বড় শক পেয়েছেন যেনো তিনি। তানিয়ার গুলিটা লেগে যাবে কল্পনাও করেনি সে। আর না বাকিরা ভেবেছিলো।
–তানিয়ার সেন্সলেস হয়ে গেছে অনেকখন আগে৷ তানভীর আহমেদ কান্নারত স্বরে তানিয়াকে বারবার ডাকে। রত্না চৌধুরী চেয়ারে বসে কান্না করছে৷ তার খারাপ লাগছে। আজ যদি সে এখানে না আসতো। জেসমিন চৌধুরী না ডাকতো তাহলে এমনটা হতো না। সব কিছুর জন্য নিজেকে দোষী লাগছে তার৷ সজলের অনুভূতিগুলো থমকে গেছে যেনো। অবিশ্বাস্য চোখে তাকিয়ে আছে একপাশে দাঁড়িয়ে। দোলা আস্তে আস্তে এগিয়ে আসে তানিয়ার দিকে। তানিয়ার পাশে বসে আলতো স্বরে তানিয়াকে ডেকে উঠে। একটা ঘোরের মধ্যে আছে যেনো এখনো দোলা।
— আঙ্কেল এইভাবে বসে থাকা ঠিক হবে না। তানুকে হসপিটাল নিতে হবে ইমিডিয়েটলি। রুদ্রর কথা শুনে তানভীর আহমেদ বলে হ্যাঁ বাবা, আমার মেয়েটাকে হসপিটাল নিতে হবে। ওর কিছু হয়ে গেলে আমি বাঁচব না৷ ওর জন্য আমি ভালো আছি। আমার বেঁচে থাকার অনুপ্রেরণা আমার মেয়ে কথাটা বলে তানভীর আহমেদ জোরে কেঁদে দেন। জাহির চৌধুরী তানভীর আহমেদের কাধে হাত রাখে শক্ত করে।
– পুলিশ জেসমিন চৌধুরী সাথে শফিককে নিয়ে যায়। জেসমিন চৌধুরী একদম নীরব মেরে গেছেন। পুলিশ নিয়ে যাওয়ার সময় একটা টু শব্দও করেনি৷ ভেতরে ভেতরে অনুশোচনায় পুড়ছে সে এখন। এইদিকে এম্বুলেন্স ডাকা হয়েছে৷ রুদ্র ফোন করে দিয়েছে সাথে সাথে৷ কিছুখনের মধ্যে চলে আসবে। দোলা পুলিশের হাতে সব প্রমাণ তুলে দেয়। রত্না চৌধুরীর বলা কথা গুলো রেকর্ড করেছিলো দোলা। সেটার মেমোরিও দিয়ে দেয়।
———————————————–
— হসপিটালে সবাই মিলে চিন্তিত হয়ে বসে আছে৷ সজল হসপিটালের দেয়ালের সাথে হেলান দিয়ে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে৷ সজলের ভীষণ ভাবে কান্না করতে ইচ্ছে করছে। তানিয়ার কান্নামাখা মুখটা দেখার পর থেকে সজলের মধ্যে তোলপাড় করা অবস্থা। তানভীর আহমেদ, দোলা, রত্না চৌধুরী কান্না করছে। রুদ্র খুব করে নিজেকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করছে যাচ্ছে । সবার সাথে তারও ভেঙে পড়লে চলবে না। জাহির চৌধুরী ফ্লোরের দিকে দৃষ্টি নত রেখেছেন।
– তানিয়াকে অপারেশন থিয়েটারে নেওয়া হয়েছে সাথে সাথে৷ গুলিটা তানিয়ার বুকে গিয়ে লেগেছে। ভেতর থেকে কি খবর আসে এটা ভেবে সবাই অস্থির।
— রুদ্র দোলার দিকে তাকায় একবার। দোলাকে দেখে রুদ্রর অনেক খারাপ লাগছে৷ বুকের মধ্যে মোচড় দিয়ে উঠে দোলার কান্নারত মুখটা দেখে৷ এরপর রুদ্র তার মায়ের দিকে তাকায়। রত্না চৌধুরী একপাশে বসে আছে তার চেয়ারে৷। চোখ দিয়ে অনবরত পানি ঝরে যাচ্ছে৷ রুদ্র কখনো ভাবিনি তার মায়ের সাথে এমন একটা পরিস্থিতিতে দেখা হবে। এরপর রুদ্রর চোখ যায় সজলের দিকে। সজলকে দেখেই মায়া হচ্ছে রুদ্রর। সেই প্রথম থেকে চুপচাপ হয়ে আছে সজল। তার মধ্যে কোনো অনুভূতিরাই সজাগ নেই যেনো। রুদ্র ধীরপায়ে সজলের কাছে যায়৷ সজলের কাধে হাত রাখলে সজল ছলছল চোখে রুদ্রর দিকে তাকিয়ে চোখ নামিয়ে নেয়।
— চিন্তা করো না৷ সব ঠিক হয়ে যাবে৷ কিছু হবে না আমার বোনের। রুদ্রর কথায় সজল আর নিজেকে ধরে রাখতে পারে না। শক্ত করে জড়িয়ে ধরে চোখের পানি ছেড়ে দেয়।
– তানিয়া ঠিক হবে তো রুদ্র। ওর কিছু হলে আমি বাঁচব না। ভীষণ ভালোবাসি আমি তানিয়াকে৷ ওর সাথে কেনো এমনটা হলো। ওর তো কোনো দোষ ছিলো না৷ তাহলে ওর মায়ের পাপের ফল ও কেনো ভোগ করবে৷ কেনো এমনটা ওর সাথেই হতে হলো কান্নারত কন্ঠে বলে সজল। রুদ্র কি বলবে! কিভাবে বোঝাবে ভাষা খুঁজে পাচ্ছে না। খারাপ তো তারও লাগছে৷ ভেতরটা ভেঙেচুড়ে যাচ্ছে৷ সবার মতো নিজের অনুভূতিটা প্রকাশ করতে পারছে না রুদ্র।। তানিয়া তো তার বোন৷ সব সময় নিজের বোনের মতো করে আগলে রেখেছে। তার আজ এমন অবস্থা দেখে রুদ্রর ভেতরটাও ফেটে যাচ্ছে কষ্টে।
— কিছুখন বাদে ডক্টর বেরিয়ে আসে৷ ডক্টরকে দেখে সবাই উঠে দাঁড়ায়। উৎসুক চোখে তাকিয়ে আছে তানিয়ার খবর জানার জন্য। সজল ভয়ার্ত চোখে তাকিয়ে আছে আর মনে মনে প্রে করছে খারাপ কিছু যেনো না শুনে।
– ডক্টর তানিয়া কেমন আছে? রুদ্রর কথায় ডক্টর মুচকি হেসে বলে একদম চিন্তা করবেন না৷ উনি একদম ঠিক আছে৷ ঘুমের ইঞ্জেকশন দেওয়া হয়েছে তাই এখন ঘুমাচ্ছে সে। আল্লাহর কাছে শুকরিয়া করুন। অনেক বড় বিপদ থেকে বেঁচে গেছেন তিনি৷ গুলিটা উনার বক্ষ ছুয়ে বেরিয়ে গেছে৷ তবে আর একটু যদি এদিক সেদিক হতো তাহলে গুলিটা গিয়ে হার্টে টাচ করতো৷ তখন কিন্তু উনাকে বাঁচানো মুশকিল হয়ে যেতো।
– ডক্টরের কথায় সবার মুখে হাসি ফুটে উঠে। আশার আলো চোখ মুখে ফুটে উঠে সবার। হতাশার দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করে নতুন করে শ্বাস নেয় সবাই। তানভীর আহমেদ যেনো দেহে প্রাণ ফিরে পায়। সজল দুই হাত তুলে মোনাজাত করে আল্লাহর কাছে শুকরিয়া জানায়। তার বুক থেকে বড় একটা পাথর নেমে গেলো যেনো।
— গুলিটা হঠাৎ এসে লাগায় তিনি ভয় পেয়ে যান৷ যার ফলে সেন্সলেস হয়ে গেছে। একটু রেস্ট নিলে ঠিক হয়ে যাবে৷ জ্ঞ্যান ফিরলে দেখা করতে পারবেন আপনারা সমস্যা নেই৷ আমি আসি বলে ডক্টর চলে যায়।
— জাহির চৌধুরীর মুখে হাসি ফুটে এতখনে। দোলা রত্না চৌধুরীকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে উঠেন। এটা দুঃখের কান্না না৷ আনন্দের কান্না৷ নতুন করে সব কিছু শুরু করার আনন্দ। রত্না চৌধুরী দোলার মাথায় হাত রেখে আর চিন্তা করিস না মা৷ তানিয়া ঠিক আছে শুনলি তো৷ এত চিন্তা করলে তোর শরীর খারাপ করবে৷ যেটা একদম উচিত নয় এই সময়। রত্না চৌধুরীর কথায় দোলা মুখে হাসি নিয়ে আসার চেষ্টা করে মাথা ঝাকিয়ে হু বলে। জাহির চৌধুরী এবার রত্না চৌধুরীর দিকে তাকায় মায়া ভরা চোখে। খুব ইচ্ছে করছে ছুটে গিয়ে রত্নাকে একবার জড়িয়ে ধরতে৷ তার মধ্যকার যত কষ্ট, আবেগ সব কিছু প্রকাশ করতে। কিন্তু কোথাও একটা অনুশোচনা কাজ করছে৷ রত্না চৌধুরীকে এতদিন ভুল বুঝে এসেছে অহেতুক। কারণ ছাড়াই দোষারোপ করে গেছে৷ তাই রত্না চৌধুরীর সামনে গিয়ে দাঁড়ানোর সাহস হয়না জাহির চৌধুরীর।
–সজল আমাকে বাড়িতে রেখে আসবি বাবা। শরীর টা খারাপ করছে অনেক। ধীর কন্ঠে বলে রত্না চৌধুরী। তার কথায় সজল একবার দোলার দিকে তাকায়৷ এরপর একে একে সবার দিকে তাকায়। রত্না চৌধুরীর কথা শুনে রুদ্র ব্যথিত নয়নে তাকায়৷ তার মা কি তাদের উপর অভিমান করে আছে? আর করাটাই তো স্বাভাবিক। যে অন্যায় টা তার সাথে হয়েছে এতে তার যে অভিমান হবে রাগ হবে এটাই তো স্বাভাবিক কিনা।
— হুম চলো মনিমা বলে সজল রত্না চৌধুরীর দিকে এগুতে গেলে দোলা বড় বড় চোখে রুদ্র আর জাহির চৌধুরীর দিকে তাকায়৷ জাহির চৌধুরী অন্যদিকে ফিরে আছে৷ আর রুদ্র রত্না চৌধুরীর দিকে করুণ চাহনি নিয়ে তাকিয়ে আছে।
– সজল রত্না চৌধুরীর হুইলচেয়ার ধরে নিয়ে যেতে যাবে এমন সময় রুদ্র শান্ত স্বরে মা বলে উঠে। যেটা রত্না চৌধুরীর কর্ণপাত হওয়ার সাথে সাথে থমকে যায়। চোখ বন্ধ করে ফেলে সাথে সাথে৷ চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়ে অশ্রুকণা। মনের মধ্যে শীতল করা পরিবেশের সৃষ্টি হয়। দীর্ঘদিন পর রুদ্র মুখে মা ডাক শুনে রত্না চৌধুরী নিজেকে স্থীর রাখতে পারে না। তার পুরো শরীর যেনো মৃদু কেঁপে ওঠে। দোলার মুখে মৃদু হাসি। সজল আর তানভীর আহমেদ উৎসুক চোখে তাকিয়ে আছে৷
— রত্না চৌধুরী উল্টো দিকে ফিরে এখনো কান্না করে যাচ্ছে৷ রুদ্র আস্তে আস্তে তার মায়ের সামনে গিয়ে হাঁটু ভাঁজ দিয়ে বসে৷ রত্না চৌধুরী রুদ্রর দিকে তাকিয়ে আছে অশ্রুসিক্ত চোখে। রুদ্রর চোখের মধ্যেও পানি টলমল করছে৷ রুদ্র কাঁপা কাঁপা হাত দুটো তার মায়ের হাতে রাতে এতে রত্না চৌধুরী চমকানো চোখে তাকায় অবাক হয়ে রুদ্রর দিকে। এতদিন পর সন্তানের স্পর্শ পেয়ে রত্না চৌধুরীর পুরো শরীর যেন অবশ হয়ে আসে।
– কোথায় যাচ্ছো? আমাদের কি ক্ষমা করা যায় না? সব কিছু ভুলে নতুন করে শুরু করা যায় না? জানো মা! দিনের পর দিন অপেক্ষা করেছি তুমি ফিরবে বলে। বন্দী ঘরে কান্না করেছি তোমার ছবিকে বুকে জড়িয়ে। তুমি তো জানতে তোমার ছেলে তুমি ছাড়া কিছু বুঝে না৷ তারপরও চলে গিয়েছিলে আমাকে ছেড়ে। পিপি আমাকে বলেছিলো তুমি নাকি নিজের সুখ বেছে নিয়ে চলে গেছো। আর কখনো ফিরবে না আমার কাছে৷ প্রথম প্রথম বিশ্বাস করতাম না। অপেক্ষা করতাম এই বুঝি তুমি এসে রুদ্রসোনা বলে ডেকে উঠবে৷ আর আমি ছুটে গিয়ে তোমাকে জড়িয়ে ধরব। কিন্তু নাহ! তুমি আসোনি৷ পিপি যা যা বলতো তাই ঠিক হয়েছে৷ এরপর তোমার প্রতি আমার অভিমান জমতে থাকে। অভিমান গুলো বড় আকার ধারণ করে রাগ,ক্ষোভ এক সময় ঘৃণায় পরিনত হয়৷ তুমি সত্যি আমাকে ছেড়ে চলে গিয়েছো নিজে ভালো থাকার জন্য এইটাই মনে হতো সব সময়। সবার সামনে নিজেকে শক্ত করে রাখলেও রাতের আঁধারে তোমার অনুপস্থিতি আমাকে প্রায় কাঁদাতো। ভীষণ কষ্ট হতো মা তোমাকে ছাড়া।। আচ্ছা তুমি বলো এইটুকু একটা ছেলে যে মা ছাড়া কখনো থাকিইনি৷ সে দিনের পর দিন তার মায়ের থেকে দূরে আছে৷ আরেকটা মানুষ তার মায়ের নামে কুমন্ত্রণা দিয়ে ভেতরটা আঘাতে আঘাতে জরাজীর্ণ করে তুলেছে৷। সে সন্তানের মায়ের প্রতি অভিমান, রাগ হওয়াটা কি অস্বাভাবিক কিছু? রুদ্রর কথায় রত্না চৌধুরী শাড়ির আঁচল টেনে শব্দ করে কেঁদে উঠে। দোলা ফুঁপিয়ে কান্না করছে। সজলের চোখে পানি। তানভীর আহমেদ জাহির চৌধুরী নিরবে কান্না করে যাচ্ছে।
— রুদ্র একটু থেমে আবার বলে, যে সময় একটা সন্তানের মায়ের আদর ভালোবাসার দরকার ঠিক সেসময় আমার মা আমার কাছে নেই৷ এবার তুমি বলো মা যে সন্তানের অভিমান করাটা উচিত নয় কি? হ্যাঁ মানছি তুমি আমি সবাই পরিস্থিতির স্বীকার কিন্তু আমি তো মা হারিয়েছি। মায়ের ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত হয়েছি। এখন যখন আবার মাকে ফিরে পেয়েছি এতদিন পর! তখনও কি আমার মা তার সন্তানের থেকে দূরে থাকবে। অভিমান জমিয়ে রাখবে তার স্বামী সন্তানের প্রতি। আমি বাবাকে কখনো হাসতে দেখিনি মা বিশ্বাস করো। তুমি যাওয়ার পর ওই মানুষটাও পাথর হয়ে গেছে৷ দিনের পর দিন কষ্ট পেয়ে পেয়ে ভেতরে শেষ হয়েছে কিন্তু কাউকে বুঝতে দেয়নি। আমি দেখেছি বাবার সে কষ্ট। আমি তো একটা ছেলে! এই জন্য হয়তো বাবার কষ্ট আমি উপলব্ধি করতে পেরেছি। কথা গুলো বলতেই রুদ্রর গাল বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়ে। নিজেকে আর সামলাতে পারে না সে৷ উপস্থিত সবার চোখে পানি। রুদ্রর কথা গুলো ভুল কিছু তো নয়। সত্যি তো সবাই পরিস্থিতির স্বীকার কিন্তু কষ্ট তো সবাই পেয়েছে।
— রত্না চৌধুরী নিজেকে আর ধরে রাখতে পারে না। রুদ্রকে আঁকড়ে ধরে বক্ষমাঝে৷ রুদ্র আর রত্না চৌধুরী দুজনেই কান্না করে দুজনকে ধরে। এতদিন পর মা ছেলের মিলনে এতটুকু কান্নার মেলা ঘটবে স্বাভাবিক। এত কিছুর পরেও যে সব ঠিক আছে এটাই তো যথেষ্ট। দোলা চোখের পানি মুখে মুখে হাসি আনে৷ সজল, তানভীর আহমেদ মুচকি হেসে উঠে। শুধু হাসি নেই জাহির চৌধুরীর মুখে৷ তার ভেতরে দহণে প্রতিনিয়ত ক্ষয় হচ্ছে৷ অনুতাপ, অনুশোচনা কুঁড়েকুঁড়ে খাচ্ছে তাকে। জাহির চৌধুরী আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না সেখানে৷ দ্রুত পায়ে বেরিয়ে যেতে চাই সেখান থেকে।
— বাবা কোথায় যাচ্ছেন আপনি? জাহির চৌধুরীকে চলে যেতে দেখে কৌতুহলী হয়ে প্রশ্ন করে দোলা। দোলার কথায় জাহির চৌধুরী চমকে উঠে দাঁড়ায়। এরপর দোলার দিকে না ফিরে বলে বাড়ি যাচ্ছি বউমা। তানিয়া কেমন আছে আমাকে জানিও আসছি আমি বলে দ্রুত পায়ে বেরিয়ে আসে। দোলা, তানভীর আহমেদ পিছু ডেকেও লাভ হয়না। হতাশ হয় তারা সবাই।
— রত্না চৌধুরী করুণ চোখে জাহির চৌধুরীর চলে যাওয়া দেখে দুই ফোঁটা পানি ছেড়ে দেয়৷ এরপর দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে একটা নিঃশব্দে।
— মা তুমি আমাদের সাথে যাবে তো? আশাপুর্ণ দৃষ্টি রেখে! কাতর স্বরে বলে রুদ্র। রুদ্রর কথায় রত্না চৌধুরী সজলের দিকে তাকায়। সজল ব্যথিত চোখে তাকিয়ে থাকে রত্না চৌধুরীর দিকে। রত্না চৌধুরী এতদিন সজলের কাছে ছিলো৷ সজলের অধিকার আছে রত্না চৌধুরীর ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়ার।
— দোলা বুঝতে পারে রত্না চৌধুরীর চোখের ভাষা। তাই এগিয়ে এসে সজলকে উদ্দেশ্য করে বলে, আপনি এতদিন মায়ের সাথে ছিলেন। বলতে গেলে মা আপনারও মা। আপনিও একটা ছেলে মায়ের। আপনার সম্পুর্ণ অধিকার আছে মায়ের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়ার। আপনি যেটা বলবেন সেটাই হবে। তবে শুধু এইটুকু বলব যেটা করবেন ভেবে চিন্তে দয়া করে। দোলার কথায় সজল মুচকি হাসে৷ যে হাসির মানে দোলা বা রুদ্র কেউ বুঝে না।
— মনিমার উপর আমার না যতটা অধিকার আছে। তার থেকে বেশি অধিকার রুদ্রর। হ্যাঁ এত দিন আমি মনিমার পাশে ছিলাম, মনিমার আদর ভালোবাসা সব একা পেয়ে এসেছি। এখন সে আদরের কেউ ভাগ বসাবে এর জন্য সত্যি হিংসা হচ্ছে আমার। সজলের এমন কথায় দোলা আর রুদ্র চমকে তাকায়। ওদের মুখোভঙ্গি দেখে সজল শব্দ করে হেসে উঠে। দোলা রুদ্র হতভম্ব হয়ে তাকায়।
— আইম জোকিং ইয়ার। মনিমার উপর যতটা আমার অধিকার আছে এর থেকে বেশি অধিকার তোমার রুদ্র। মনিমা তোমার নিজের মা। তাই তুমি তোমার মাকে নিয়ে যেতে পারো এতে আমার কোনো কিছু বলার নেই। সজলের কথায় সবাই স্বস্তি পায়। রত্না চৌধুরী এখনো কৌতুহলে ভরা চাহনি নিয়ে তাকিয়ে আছে সজলের দিকে।
– সজল রত্না চৌধুরীর একহাতে হাত রেখে বলে! তুমি তোমার পরিবারের কাছে ফিরে যাও মনিমা। বিশ্বাস করো আমার থেকে বেশি খুশি কেউ হবে না তাহলে। আমি খুব করে চাইতাম তুমি যেনো তোমার প্রিয় মানুষের কাছে যেতে পারো। আমি তো জানি তুমি কতটা অপেক্ষা করে ছিলে এইদিনটার জন্যে। তাছাড়া রুদ্র তো তোমার আদর ভালোবাসা পায়নি সেভাবে।।তাই তুমি এখন থেকে তোমার ছেলের কাছে থেকে আদর ভালোবাসা দিয়ে সব পুষিয়ে দেবে বুঝেছো। সজলের কথায়ব রত্না চৌধুরী মুচকি হাসে৷ সজলও হেসে জড়িয়ে ধরে। রুদ্র দোলার মুখে হাসি। সব অভিমান পর্ব শেষ। জীবনের কালো অধ্যায় শেষ নতুন করে গল্পের সূচনা আবার। সব কি নতুন ভাবে নতুন করে শুরু হবে? নাকি আবার নেমে আসবে কালো ছায়া কারো জীবনে?
“” চলবে…