তুমিময় আসক্তি পর্ব-৪+৫

0
1353

#তুমিময়_আসক্তি
#কলমে_আলো_ইসলাম

“৪ + ৫”

— জাহির চৌধুরী তার রুমে বসে আছে মন খারাপ করে। দৃষ্টি তার মাটির দিকে আবদ্ধ। রুদ্র জাহির চৌধুরীর রুমের সামনে এসে তার বাবাকে উদ্দেশ্য করে বলে, আসবো ড্যাড?
– রুদ্রর কথায় জাহির চৌধুরী চোখ তুলে রুদ্রর দিকে তাকিয়ে ভেতরে আসতে বলে আবার দৃষ্টি সরিয়ে নেয়।

– রুদ্র এসে তার বাবার পাশে বসে বিসানায়।

– এখন তোমার শরীর কেমন আছে ড্যাড? জাহির চৌধুরী অন্য দিকে তাকিয়েই উত্তর দেয় ভালো। মুখটা গম্ভীর করে ভারী কন্ঠে বলে। রুদ্র বুঝতে পারে তার বাবা তার উপর রেগে আছে। বেশ কিছুখন চলে কুটকুটে নিরবতা। রুদ্র তার বাবার দিকে তাকিয়ে আছে আর জাহির চৌধুরী অন্য দিকে ফিরে৷

– তুমি চাও আমি বিয়ে করি তাই তো? হঠাৎ রুদ্রর মুখে বিয়ের কথা শুনে জাহির চৌধুরী চমকে তাকায় রুদ্রর দিকে৷ চোখ মুখে তার ভীষণ কৌতুহল একঝাঁক উচ্ছ্বাস।
– দেখো ড্যাডি আমি জানি তুমি আমার উপর রেগে আছো৷ যদিও প্রকাশ করতে চাচ্ছো না তবে আমি তো সবই বুঝি। তুমি কেনো এমন জেদ করছো সেটাও বুঝতে পারছি না। সব কিছু জানার পরও যদি এমন করো সত্যি আমার আর কিছু বলার নেই।

– জাহির চৌধুরী গভীর দৃষ্টি নিক্ষেপ করে আছে রুদ্রর দিকে। আসলে রুদ্রর কথার ভাবগতি বোঝার চেষ্টা মুলত তার।
– রুদ্র একটু থেমে আবার বলে, তুমি যখন চাচ্ছো আমি বিয়ে করি তো ঠিক আছে আমি বিয়ে করবো তবে আমার কিছু শর্ত আছে।

– রুদ্রর বিয়েতে রাজী হওয়ার কথা শুনে জাহির চৌধুরীর মুখের আকৃতি বদলে যায়। চোখ মুখে হাসির রেশ, খুশির উচ্ছ্বাস। তিনি মুখে মিষ্টি হাসি ঝুলিয়ে বলে সত্যি তুই বিয়েতে রাজী রুদ্র। আমার বিশ্বাসই হচ্ছে না৷ আমি যে কি পরিমাণ খুশি হয়েছি তোকে বলে বোঝাতে পারব না৷

– জাহির চৌধুরীর এত আনন্দ উচ্ছ্বাস দেখে রুদ্রর মনে মনে ভালো লাগে। আজ দুদিন তার বাবা মন খারাপ আছে। এটা দেখে রুদ্রর একটুও ভালো লাগতে ছিলো না।
– আমি বিয়ে করবো বলেছি তবে শর্তসাপেক্ষ এটাও বলেছি ড্যাড।

– শর্তর কথা শুনে জাহির চৌধুরীর মুখের হাসি বিলীন হয়ে যায়। কৌতুহল ভরা দৃষ্টি নিয়ে আবার তাকায় রুদ্রর দিকে।

— কি শর্ত? বিয়েতে রাজী যখন তাহলে এখানে শর্তের কি প্রয়োজন?

– আমি মোটেও বিয়েতে রাজী নই৷ তুমি বাধ্য করছো রাজী হতে। তাই বিয়ে করতে হলে আমার কিছু শর্ত মানতেই হবে নাহলে আইম সরি৷ আমি বিয়ে করবো না।

; এই না না রুদ্র বল না কি শর্ত৷ আমি তোর সব শর্তে রাজী। তাও বিয়েটা আর না করিস না। আমার অনেক স্বপ্ন আমার বউমা আসবে। আমার সামনে ঘুরে বেরাবে। আমার নাতি-নাতনি… বলে থেমে যায় জাহির চৌধুরী কারণ রুদ্র মারাত্মক রকম দৃষ্টি নিক্ষেপ করে তাকিয়ে আছে জাহির চৌধুরীর দিকে। তাই রুদ্রর তাকানো দেখে জাহির চৌধুরী আর বাকিটা বলার সাহস পাইনা।

– জাহির চৌধুরী মুখে মেকি হাসি নিয়ে এসে বলে, বল কি শর্ত তোর?

– আমি এখন যেমন আছি যেমন লাইফলিড করছি বিয়ের পরও তেমনই থাকবো। আমি কারো দায়িত্ব নিতে পারবো না আর না কাউকে স্ত্রীর মর্যাদা দিতে পারবো। তার প্রয়োজনীয় যা কিছু লাগে সময় মতো পেয়ে যাবে কিন্তু আমার থেকে এক্সট্রা কিছু কখনোই আশা করতে পারবে না। আমার সামনে যেনো না আসে। বাইরের সবার কাছে থাকবে আমার ওয়াইফ এর পরিচয়ে কিন্তু আমাদের মধ্যে কোনো স্বামী স্ত্রী সম্পর্ক থাকবে না। আর বিয়েটা অবশ্যই ঘরোয়া ভাবে হবে৷ নো পার্টি নো রিসিপশন। যদি এর সব কিছু মানতে পারে কেউ তবে বিয়ে করবো আমি৷ এখন ডিসিশন তোমার।

– জাহির চৌধুরী অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে রুদ্রর দিকে। রুদ্র যে মেয়েটাকে মেনে নিবে না এটা জানতো তাই বলে যে এত কিছু থাকবে ভাবিনি।

– রুদ্র এই বাড়িতে যে আসবে সে তোমার স্ত্রী হয়ে আসবে। তো সে তোমার সাথে থাকবে পাশে থাকবে এটাই স্বাভাবিক। তোমার সামনে যাবে না এটা কেমন কথা। বিয়েটা ঘরোয়া ভাবে হবে এটা ঠিক আছে মেনে নিলাম কিন্তু বাকিগুলো ইম্পসিবল।

– তুমি হয়তো ভুলে যাচ্ছো বিয়েটা তোমার ইচ্ছেতে হচ্ছে ড্যাড। আমি কিন্তু করছি না৷ তুমি জোর করছো আমাকে বিয়ে করতে৷ যেহেতু আমি তোমার জন্য বিয়েতে রাজী হয়েছি সেহেতু আমার জন্য তোমাকে এইটুকু করতেই হবে। তুমি যে মেয়ে ঠিক করবে আমার সমস্যা নেই আর আমি দেখতেও যাবো না। বাট আমার শর্ত গুলো তাকে জানিয়ে তবে বিয়ে ঠিক করবে। আশা করি বুঝতে পারছো বলে রুদ্র উঠে দাঁড়ায়।
– জাহির চৌধুরী এখনো অবাকিত চোখে রুদ্রর দিকে তাকিয়ে আছে৷ রুদ্র যা কিছু বলেছে সব কিছু তার মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে৷ আগের তুলনায় চিন্তা আরও দ্বিগুণ বেড়ে যায়।

– ভেবে চিন্তে তারপর আমাকে জানিও কেমন। এখন রেস্ট করো বলে রুদ্র মুখটা গম্ভীর করে বেরিয়ে যায়।

– জাহির চৌধুরী বিশাল ভাবনায় পরে যায়। কি করবে সেটা বুঝতে পারছে না। দোলার জন্য খারাপ লাগছে তার আবার বিয়েটা না দিলেও হবে না। জাহির চৌধুরীর দীর্ঘ বিশ্বাস একমাত্র দোলা পারবে সব কিছু ঠিক করতে। কিন্তু দোলার জীবন টা আবার নষ্ট হয়ে যাবে না তো৷ জাহির চৌধুরী যা ভেবে বিয়েটা ঠিক করছে, যদি তার উল্টো হয় তাহলে তো দোলার জীবনটা নষ্ট হয়ে যাবে।

– জাহির চৌধুরী কি করবে দোটানায় পড়ে যায়। আর যাই হোক তার ছেলের জন্য একটা মেয়ের জীবন নষ্ট করতে পারে না।

— তানভির আহমেদ অফিস থেকে ফিরে রিলাক্স হয়ে বসে ক্লান্ত শরীর নিয়ে। তখনই তানিয়া এসে পেছনে গলা জড়িয়ে ধরে তানভির আহমেদের।

— কি ব্যাপার! আমার মা’টার আজ এতো আলাপ করার কারণ তো ঠিক বুঝছি না?

– এটা কেমন কথা বাবা৷ আমি কি এমনি তোমার কাছে আসি না বলতে বলতে তানভির আহমেদের সামনে এসে দাঁড়ায়।
– সেটা আবার কখন বললাম তবে আজ আসতে না আসতেই এত আদর এই জন্য একটু খটকা লাগছে বলে হেসে দেয় তানভির আহমেদ সাথে তানিয়াও।

– তানিয়া তার বাবার পাশে বসে উল্লাসিত কন্ঠে বলে বাবা জানো ব্রোর বিয়ে।
– তানিয়ার কথা শুনে তানভির আহমেদ ভ্রু কুচকে বলে মানে। রুদ্র বিয়ে করছে। চোখ মুখে বিষ্ময়ের ছাপ৷

– মা ফোন দিয়েছিলো। মামা নাকি ব্রো’র বিয়ের জন্য চাপ দিচ্ছে৷ অবশ্য ব্রো এখনো কিছু বলেনি৷ তবে বিয়েটা মনে হয় এবার হয়ে যাবে।

– ছেলেটা জীবনে এত ধাক্কা খেয়েছে যে জীবনের আসল মানে গুলো হারিয়ে ফেলেছে। বড্ড মায়া হয় রুদ্রটার জন্য জানিস মা৷ ছোট বেলা মাকে হারালো বড় হয়ে এমন একটা শক পেলো। সব কিছু মিলিয়ে ছেলেটাকে নিঃস্ব করে দিয়েছে গেছে। আফসোস নিয়ে বলে কথা গুলো তানভির আহমেদ।

– জানো বাবা আমি খুব করে চাই কেউ একজন আসুক ব্রো’র জীবনে। যে ব্রো’র জীবনটা আবার সাজিয়ে দেবে৷ সুন্দর করে গুছিয়ে দেবে। ব্রো’র এই খিটখিটে মেজাজটা এক নিমিষে শেষ করে নতুন রুদ্রর জন্ম দিবে আবেগবাদী হয়ে বলে কথা গুলো তাকিয়া।

— এমন কি কেউ আছে যে ধৈর্য নিয়ে সব সামলাবে। তাছাড়া রুদ্র তো কোনো মেয়েকে এলাউ-ই করে না তার লাইফে। তাহলে বিয়ে কি করে সম্ভব?

– হবে হবে বাবা৷ দেখো ঠিক কেউ না কেউ এমন আসবে যে ব্রো’র উত্তপ্ত আগ্নেয়গিরির ভয়ানক লাভা নিভিয়ে সুন্দর প্রকৃতির রূপ দিবে। সে যাই হোক আমরা কবে দেশে ফিরছি তাই বলো?
– তানিয়ার কথায় তানভির আহমেদ ভ্রু কুচকে বলে আমরা মানে?

– তানিয়া মুখে হাসি নিয়ে এসে বলে হ্যাঁ আমরা মানে আমি আর তুমি।
– নো নো তানিয়া মা৷ আমি একদম যেতে পারবো না৷ আমার এখানে অনেক কাজ আছে৷ যদি যেতে চাও তো তুমি যেতে পারো। কিছুদিন থেকে আবার ব্যাক করবে কিন্তু আমি যেতে পারবো না৷ সরি মা।

; আমি কিছু শুনতে চাই না বাবা। তুই যাবে আমার সাথে। দেখো মায়ের জন্য না হোক তুমি মামার জন্য তো যেতে পারো। মামা তোমাকে কত ভালোবাসে বলো। প্লিজ বাবা তুমি আর না করো না।

– আচ্ছা আচ্ছা সে দেখা যাবে। এখন যাও ফ্রেস হয়ে এসো। খুব খুদা লেগেছে। তানিয়া আর কিছু না বলে মুচকি হেসে চলে যায়।

— কেটে যায় দুদিন।

— আজ দোলা আর রুদ্রর বিয়ে। দোলার বাড়িতে মানুষজনে পূর্ণ । বাইরের কেউ নেই কিছু আত্বিয় স্বজন আর প্রতিবেশি। রুদ্রর কথা মতো ঘরোয়া ভাবে তাদের বিয়েটা হচ্ছে। দোলাকে সাজানো হচ্ছে। আশা মন খারাপ করে দোলার পাশে বসে আছে। রোকনেরও খুব মন খারাপ।

– সেদিন রুদ্রর বলা কথা গুলো জাহির চৌধুরী খুব করে ভাবে। সব কিছু ভেবে জাহির চৌধুরী সিদ্ধান্ত নেয় রুদ্রর সাথে দোলার বিয়ে দেবে। দোলা পারবে সব কিছু একদিন ঠিক করতে এই আত্মবিশ্বাসে জাহির চৌধুরী এগিয়ে যায়। রাশেদ মিয়াকে এরপর সব জানায় জাহির চৌধুরী। রুদ্রকেও বলে তার শর্তে রাজী। রুদ্র অবাকই হয়েছিলো তার বাবার কথায়। কিন্তু যেহেতু কথা দিয়েছে সব শর্ত মানলে বিয়ে করবে তাই রুদ্র আর কিছু বলতে পারিনি।

– তবে রুদ্র বেশী অবাক হয়েছিলো দোলার সাথে বিয়ের কথা শুনে। রুদ্র দোলাকে দুই তিনবার দেখেচে মাত্র। তাও সেভাবে লক্ষ্য করেনি কখনো। দোলা এই বাড়িতে তেমন যাওয়া আসা করেনি দরকার ছাড়া।

— রুদ্র সাদা শার্ট কালো প্যান্ট চুল গুলো গুছিয়ে আচড়ানো। মুখে আগের তুলনায় আরো গম্ভীরতা। সব কিছুতে যেনো বিরক্ত আজ রুদ্র। জেসমিন চৌধুরীও ফুসে আছে। সে অনেক ভাবে বুঝিয়েছে রুদ্রকে।। এই বিয়েটা থেকে রুদ্রকে সরাতে চেয়েছে কৌশলে এর জন্য অনেক কান ভাঙ্গিয়েছে দোলার নামে তাও কাজ হয়নি। কারণ রুদ্র তার বাবাকে কথা দিয়েছে। তাছাড়া রুদ্রর বিয়ে নিয়ে ইন্টারেস্ট নেই। তাই মেয়ে কেমন স্বভাবের কেমন তার চরিত্র তার দেখার বিষয় নয়।
– রুদ্রর রেডি হওয়া শেষ হতেই জাহির চৌধুরী রুদ্রর ঘরে প্রবেশ করে। রুদ্রকে দেখে তিনি অবাক হয়ে বলে একি রুদ্র তুমি শার্ট প্যান্ট পড়েছো কেনো? আজ না তোমার বিয়ে। আজ তুমি পাঞ্জাবি পড়বে।

– দেখো বাবা বিয়ে করতে যাচ্ছি এটাই কি তোমার জন্য যথেষ্ট নয়। প্লিজ আমাকে আর কিছুতে জোর করবে না। আমি এইভাবেই যাবো বিয়েতে বলে রুদ্র বেরিয়ে যায় ঘর থেকে। জাহির চৌধুরী একটা তপ্ত দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। জানি না সামনে কি অপেক্ষা করছে তাদের জন্য। সত্যি ভুল করছে নাকি কোথাও একটু সঠিক,টাও উকি দিচ্ছে সেটাও বুঝতে পারছে না সে।

— জেসমিন চৌধুরী বিয়েতে যাবেন না বলে জেদ ধরে বসে থাকে। কিন্তু জাহির চৌধুরীর জন্য সেটা বেশিখন স্থায়ী হয়না। রুদ্রর জন্য জাহির চৌধুরী কাউকে বিয়েতে ইনভাইট করতে পারেনি। কারণ সে জানে রুদ্রর কথার বাইরে কিছু হলে রুদ্র আর বিয়েটা করবে না। তাই সে রিস্ক নিতে চাইনা জাহির চৌধুরী। কিন্তু বাড়ির মানুষ গুলো না গেলে কেমন হয়। তাই তিনি জেসমিন চৌধুরীকে জোর করে এক প্রকার যাওয়ার জন্য।

– জেসমিন চৌধুরী ঠোঁটে লিপস্টিক টা দিয়ে সেটা জোরের সাথে রাখে টেবিলে। সব কিছুতে প্রচন্ড বিরক্ত সে। এত চেষ্টা করলো বিয়েটা আটকানোর কিন্তু কিছুতেই কিছু হলো না। জেসমিন চৌধুরীর বেশি রাগ হচ্ছে তার মেয়ে তানিয়ার উপর। তাকে একদিন আগে আসতে বলেছিলো জেসমিন চৌধুরী কিন্তু তারও কোনো পাত্তা নেই।

— দোলাকে সাজানো হলে সবাই একে একে রুম থেকে বেরিয়ে যায়। রাশেদ মিয়া সবাইকে খাওয়ার জন্য ডেকে নিয়ে যায়। কিন্তু দোলার দিকে একবারও তাকায় না। আসলে রাশেদ মিয়ার সাহস নেই দোলার চোখে চোখ রেখে তাকানোর। ঘরে আশা, রোকন আর দোলা আছে একমাত্র।

– বিয়েটা কি করতেই হবে তোকে দোলা। এখনো সময় আছে প্লিজ জেদ করিস না। জীবন টা এইভাবে শেষ করে দিস না দোলা। দোলা আশার দিকে আহত চোখে তাকিয়ে বলে মেনে নিয়েছি সবটা চিন্তা করিস না। আমি দেখতে ভাগ্য আমাকে আর কি কি ফেস করাতে চাই।
– আপু তুই এই বিয়েটা করিস না। আমি একা হয়ে যাবো আপু। আমাকে কে আদর করে খাওয়ায় দিবে। আমার স্কুলের টিফিন কে রেডি করে দিবে৷ আমি কার কাছে থাকবো আপু?

— রোকনের কথায় দোলা ফুঁপিয়ে কান্না করে উঠে। দোলা খুব কষ্টে নিজেকে শক্ত করে রেখেছে। তার অনুভূতি, কষ্ট কান্না কাউকে দেখাতে চাই না। রুদ্রর সাথে তার বিয়েটা ফিক্সড হওয়ার পর থেকে দোলার মুখে হাসি উবে গেছে।।কিন্তু দোলা সবার সামনে এমন ভান করে থেকেছে সে খুব খুশি। কিন্তু একমাত্র রাশেদ মিয়া জানে তার মেয়ের মধ্যে কি ঝড় বয়ছে।

– দোলা কান্নারত কন্ঠে রোকন কে কাছে ডাকে। রোকন বোনের ডাক পাওয়ার সাথে সাথে বুকে ঝাপিয়ে পড়ে কান্না করে উঠে। রোকনের ভীষণ কষ্ট হচ্ছে দোলার জন্য। রোকন মাকে পায়নি ছোট থেকে। দোলায় মায়ের আদর দিয়ে তাকে বড় করে তুলেছে। আজ সেও চলে যাচ্ছে পরের ঘরে।

– একদম কষ্ট পাবি না ভাই। আমি তো আছি সব সময় তোদের সাথে। তোদের ছেড়ে কোথায় যাবো আমি বল। আমি তো বেশি দূরে যাচ্ছি না৷ কাছেই থাকবো যখন ইচ্ছে হবে চলে যাবি আমাকে দেখতে আমার যখন ইচ্ছে হলে আমি আসবো। কান্না করে না ভাই।।তোর কান্না যে আমার সহ্য হয়না। তাছাড়া বড় সাহেব তো একটা কাজের মানুষ দিয়েছে। সেই তোদের সব কাজ করে দিবে।।তোর টিফিন রেডি করে দিবে।

— জাহির চৌধুরী দোলার বাড়ির জন্য একটা কাজের মেয়ে পাঠায়। কারণ সে জানে দোলা ছাড়া ওই বাড়িতে আর কেউ নেই সংসার সামলানোর মতো। দোলা চলে আসলে রোকন আর রাশেদ বিয়ার অনেক সমস্যা হয়ে যাবে খাওয়া পড়া নিয়ে। তাই সে আগেই কাজের মানুষ পাঠায়। যদিও রাশেদ মিয়া রাজী ছিলো না। কিন্তু দোলা সব ভেবে চিন্তে তার বাবাকে বোঝায়। তাই রাশেদ মিয়া আর দ্বিমত করে না।

– আপু তুই কেনো ওই লোকটাকে বিয়ে করছিস।। ওই লোকটা তোকে অনেক কষ্ট দিবে আপু। তুই সব জেনেও কেনো এমন করছিস। বাবা কেনো তোর বিয়ে ওই লোকটার সাথে দিচ্ছে আমি বুঝতে পারছি না কান্না থামিয়ে বলে রোকন।

– তুই তো ছোট তাই এখন কিছু বুঝবি না। বড় হলে তখন বুঝবি বাবা কেনো সব জেনেও তার আদরের রাজকন্যাকে সেখানে তুলে দিচ্ছে। তবে ওরা সবাই অনেক ভালো ভাই। বড় সাহেব তোকে কত আদর করে বল?

— শুধু বড় সাহেবই ভালো ওই বাড়ির৷ তাছাড়া বাকিরা? ওরা কেউ ভালো না আপু।

– এমন কথা বলে না ভাই। সবাই ভালো সবার দিক থেকে। কেউ একটু ভালো আর কেউ বেশি এটাই তফাৎ। এর মধ্যে বাইরে থেকে শোরগোল আসে বর এসেছে বর এসেছে। কথাটা শোনা মাত্র দোলার বুকের মধ্যে ধক করে উঠে। তোলপাড় করা উত্তেজনা ভেতরে বহমান তার।

চলবে…..

( ❌❌কপি করা নিষেধ ❌❌ ভুলক্রুটি ক্ষমার সাপেক্ষে বিবেচনা করবেন।)

#তুমিময়_আসক্তি
#কলমে_আলো_ইসলাম

“৫”

–” রুদ্র আর দোলাকে বসানো হয়েছে পাশাপাশি। সবাই অনেক খুশি রুদ্র আর দোলার জুড়ি দেখে। অনেকে ফিসফিস করে বলা শুরু করছে,

– দোলার ভাগ্যটা আসলেই অনেক ভালো। নাহলে এমন বাড়ির বউ হওয়ার সুযোগ পাই। কত সুন্দর ছেলে কত বড় বাড়ি। রাজ করে খাবে সেখানে। পাড়া প্রতিবেশী, আত্বিয়স্বজনের মধ্যে এই সব কথায় বলা কওয়া চলছে।। দোলা আবছা সবই বুঝতে পারছে আর নিজেকে নিজে তাচ্ছিল্য করছে তার ভাগ্যকে নিয়ে।
— রুদ্র মুখটা থমথমে করে বসে আছে। দোলার দিকে একবারও তাকায়নি সে। দোলাকে যখন নিয়ে আসা হয় তখন দোলা চোখ তুলে একবার রুদ্রর দিকে তাকিয়েছিলো। রুদ্রর গম্ভীর মুখটা দেখে তার ভেতর থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়া আর কিছু আসেনি।

– আর কতখন এই ভাবে বসে থাকতে হবে ড্যাড। যা করার আছে তাড়াতাড়ি করো আমার কাজ আছে ভারী কন্ঠে বলে রুদ্র তার বাবাকে।
– জাহির চৌধুরী ছেলের কথায় আহত চোখে তাকায়। রাশেদ মিয়া জাহির চৌধুরীর দিকে তাকালে ইশারায় বলে বিয়ে পড়ানো শুরু করার জন্য।

– রাশেদ মিয়া কাজী সাহেবকে উদ্দেশ্য করে বলে বিয়ে পড়ানোর জন্য। দোলার বুকের মধ্যে ঢিপঢিপ শব্দ করছে। যত সময় যাচ্ছে তত যেনো একটা অজানা ভয় জেঁকে বসছে। দোলা চাইলেও যেনো নিজেকে আর নরমাল রাখতে পারছে না। আশা দোলার হাত শক্ত করে ধরে আছে শাড়ির নিচ দিয়ে। আশা খুব আপসেট দোলার এই বিয়ে নিয়ে। রোকন দূরে দাঁড়িয়ে চোখের পানি ফেলছে।

– কাজী সাহেব বিয়ে পড়ানো শুরু করে রাশেদ মিয়ার কথা মতো। বিয়ে পড়ানো শুরু করলে রাশেদ মিয়া সেখান থেকে সরে যায়। দোলা আগের থেকে আরো শক্ত করে আশার হাত চেপে ধরে।

– বেশ সুস্থ ভাবে দোলা আর রুদ্রর বিয়েটা হয়ে যায়। জাহির চৌধুরী মনে মনে আল্লাহকে ধন্যবাদ দেয়। শেষ পর্যন্ত বিয়েটা যে হয়েছে এটাই অনেক খুশি তিনি।

– বিয়ে পড়ানো শেষ হতেই রুদ্র উঠে দাঁড়ায়। রুদ্রকে দাঁড়াতে দেখে জাহির চৌধুরী ভ্রু কুচকে বলে, একি রুদ্র দাঁড়িয়ে পড়লে যে?

– আমার কাজ তো এখানে শেষ ড্যাড। এবার তোমাদের কাজ তোমরা করো। আমার একটা ইমপোর্টেন্স কাজ আছে বলে রুদ্র বড় বড় ধাপ ফেলে চলে যায়। জাহির চৌধুরী রুদ্রকে পিছু ডেকেও লাভ হয়না। আর না কিছু বলার সুযোগ দেয়। আত্বিয় স্বজন, পাড়াপ্রতিবেশি কানা ঘোষা শুরু করে দেয়। দোলার চোখ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছে অঝোরে। আশার ভীষণ কান্না পাচ্ছে। সে জানতো দোলা মোটেও সুখী হবে না ওই মানুষটার সাথে। রাশেদ মিয়া দূর থেকে কান্না করছে।। তার মেয়ের জীবন সে নিজ হাতে নষ্ট করে দিলো। বিয়ের দিন বর বউ রেখে চলে যায় এটা কারো কাছেই শোভা দেখায় না।

– অনেকে অনেক রকম কথা বলছে। জেসমিন চৌধুরী সে তো বেজায় খুশি। মিটিমিটি হাসছে সবার আড়ালে মুখ লুকিয়ে। রুদ্র চলে যাওয়ায় সে অনেক আনন্দ পেয়েছে।

– জাহির চৌধুরী ব্যাপারটা সামাল দেওয়ার জন্য সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলে রুদ্রর অফিসে জরুরি কাজ পড়ে যাওয়ায় চলে যেতে বাধ্য হয়। কিন্তু মানুষের যা বোঝার তা বোঝা হয়ে গেছে।

– আসলে পাড়াপ্রতিবেশিরা তো ওতপেতে থাকে কারো একটা কথা পাওয়ার জন্য। তারা যদি একটা কারণ পায় কাউকে কথা শোনানোর তাহলে সেটা কোনো ভাবে হাতছাড়া করতে চাইনা। সে মানুষটার মনের অবস্থা জানার প্রয়োজন তাদের পড়ে না। নিজেদের বাজে মন্তব্য করে আরো বিষিয়ে তোলে সে মানুষের মন।

— জাহির চৌধুরী বুঝতে পারেন এখানে বেশিখন আর থাকা যাবে না। যতখন থাকবে মানুষের বাজে কথা কটুক্তি শুনতে হবে। এতে দোলা আর তার পরিবার আরো বেশি কষ্ট পাবে৷ তাই জাহির চৌধুরী রাশেদ মিয়াকে ডেকে বলে সে দোলাকে নিয়ে বেরিয়ে যেতে চাই। দোলাকে নিয়ে যাবে শুনে রাশেদ মিয়া থমকে যায়। চোখ দিয়ে এবার অঝোরে পানি পড়তে থাকে জনসম্মুখে।

– জাহির চৌধুরী রাশেদ মিয়ার কাধে হাত রেখে বলে, কষ্ট পেয়েও না রাশেদ। মেয়েদের তো একদিন না একদিন পরের ঘরে যেতেই হয়। তাছাড়া তোমার মেয়ে তো তোমার খুব কাছেই থাকছে। তুমি তো প্রতিদিনই দেখতে পাবে দোলা মাকে।

– রাশেদ মিয়া এবার জাহির চৌধুরীর হাত চেপে ধরে খপ করে।
– বড় সাহেব, আমার মেয়েটাকে আপনার ভরসায় দিচ্ছি। ওকে দেখবেন দয়া করে। আমার খুব আদরের কন্যা আমার দোলা মা। আমি অনেক ভালোবাসি আমার মেয়েকে। ছোট সাহেব জানি না কি করবেন এরপর, তবে আপনি আমার একমাত্র ভরসা বড় সাহেব।

– তুমি চিন্তা করো না রাশেদ আমি তো আছি। তাছাড়া রুদ্র মেয়েদের যতই খারাপ চোখে দেখুন তাদের গায়ে হাত তুলবে না এই বিশ্বাস আমার আছে। হয়তো বকাবকি করবে রাগারাগি করবে তাছাড়া এর বাইরে সে কিছু করবে না। কিন্তু এর সব কিছু ঠিক করতে হবে দোলা মাকে। কি পারবি না মা তুই আমার ছেলেটাকে ঠিক করতে। ওর বদমেজাজী স্বভাব টা দূর করে নতুন করে ভালোবাসা তৈরি করতে।

– দোলা অসহায় চোখে তাকায় জাহির চৌধুরীর দিকে। দোলা চোখে ঝাপসা দেখছে চোখের মধ্যে পানি থাকায়। দোলার যেনো দম বন্ধ হয়ে আসছে।

— রাশেদ মিয়া এবার দোলাকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে উঠে বলে, আমাকে মাফ করে দিস মা৷ আমি তোর মতের বিরুদ্ধে গিয়েও বিয়েটা দিতে বাধ্য হলাম। তোর জীবন টা নিজ হাতে নষ্ট করে দিলাম। পারলে এই অধম বাবাটাকে ক্ষমা করে দিস মা তুই।

– দোলার কান্নার বেগ আরো বেড়ে যায়। আশা, রোকন সবাই অনেক কান্না করছে। উপস্থিত সবার মন খারাপ হয়ে যায় বাবা মেয়ের মিলনে।

– দোলা নিজেকে অনেক কষ্টে সামলে কান্না থামিয়ে বলে তুমি চিন্তা করো না বাবা। তোমার মেয়ে হারবে না। তুমি যে ভরসা বিশ্বাস নিয়ে আমার জীবনের এত বড় সিদ্ধান্ত নিয়েছো সেটাই আমি জয়ী হবো দেখো। তোমার মেয়ে তোমার বিশ্বাস ভরসা রাখবে। তোমার মাথা আমি কখনো নিচু হতে দেবো না বাবা। তুমি প্লিজ নিজেকে দোষী ভেবো না। এটা তো আমার ভাগ্যে ছিলো। কারো ভাগ্য কেউ কি করে খন্ডাতে পারে বলো।

– রোকন আসতে আসতে বোনের কাছে এগিয়ে আসে।
– দোলা তার বাবাকে ছেড়ে রোকনকে জড়িয়ে ধরে শক্ত করে। রোকন বোনের আদর পেয়ে আরো বেশি কান্না করে।
– তুই যাস না আপু। আমি একা হয়ে যাবো। আমি কার কাছে থাকবো আপু। রোকনের কথায় নিশ্বাস ভারী হয়ে আসে দোলার। দোলা যেনো মুখ দিয়ে কথা বের করার শক্তিটাও পাচ্ছে না। চোখ দিয়ে শুধু পানিই পড়ে যাচ্ছে।

– এখন বিদায়ের পালা। জেসমিন চৌধুরী আগে গাড়িতে উঠে বসে থাকে। জাহির চৌধুরী দোলাকে নিয়ে এগোয় গাড়ির দিকে। দোলা অনেক উইক হয়ে পড়েছে কান্না করার ফলে। ঠিক ভাবে হাঁটার শক্তিটাও পাচ্ছে না। রাশেদ মিয়া দোলাকে গাড়িতে তোলে দেয়। রোকন দোলার শাড়ির আঁচল চেপে ধরে। এতে যেনো দোলার বুক ফেটে কান্না আসছে।

– রাশেদ মিয়া রোকনকে বুকের সাথে চেপে ধরে। রোকন তার বাবাকে বলে, আপুকে যেতে দিও না বাবা। আমি আপুকে ছাড়া থাকতে পারবো না। রাশেদ মিয়ারও অনেক খারাপ লাগছে রোকনের জন্য।

– জাহির চৌধুরী গাড়িতে উঠলে গাড়ি চলতে শুরু করে। রাশেদ মিয়া আহত চোখে মেয়ের চলে যাওয়া দেখে। রোকন দৌড়ে বাড়ির মধ্যে চলে যায়।

– শুরু হয় নতুন যাত্রা দোলার জীবনে। তার জন্য কি অপেক্ষা নতুন জীবনে তার জানা নেই। তবে ভালো কিছু যে নেই এটা সে খুব ভালো করে জানে।

– রুদ্র বিয়ের আসর থেকে এসে একটা বারে বসে আছে। সাথে আছে তার বেস্ট ফ্রেন্ড রাজ। রুদ্র আর রাজ খুব ভালো বন্ধু। রুদ্র একমাত্র রাজকে তার মনের সব কথা বলে। সব শেয়ার করে। রাজও রুদ্রকে অনেক ভালোবাসে। তাদের ফ্রেন্ডশিপ দীর্ঘদিনের। তাই দুজন দু’জনকে খুব ভালো বুঝে।

– সে কখন থেকে এখানে এসে বসে আছিস। এটা কি হচ্ছে রুদ্র? আজ তোর বিয়ে কোথায় বাসায় থাকবি তা না। বিয়ে বাড়ি থেকে উঠে চলে আসছিস। আচ্ছা একবার মেয়েটার কথা ভাবলি না। এলাকার মানুষ পাড়াপ্রতিবেশি তাদের কত কটুক্তি করতে পারে বলতো। একটা দিন একটু নিজেকে সামলাতে পারলি না। নতুন বউ তার পাশে থাকবি আজ… আর বাকি কথা শেষ করতে পারে না রাজ। রুদ্রর রাগান্বিত দৃষ্টি দেখে আটকে যায় বাকি কথা।

– রাজ একটা শুকনো ঢোক গিলে বলে না মানে আমার কথাটা একটু.. স্টপ রাজ ধমক দিয়ে বলে রুদ্র।

– তুই ওই মেয়ের হয়ে একটাও কথা বলবি না। ওর কি হলো না হলো আই ডোন্ট কেয়ার ওকে। আমি কি বলেছিলাম আমাকে বিয়ে করার জন্য। ও কেনো সব জেনেও রাজী হলো।।আসলে কি বলতো লোভ, লোভে বিয়ে করেছে আমাকে৷ আমার এত টাকা পয়সা বাড়ি গাড়ি তাই লোভে পড়ে বিয়ে করেছে আমাকে।

– রাজের খারাপ লাগে রুদ্রর কথা গুলো। একটা মানুষ সম্পর্কে না জেনে এমন মন্তব্য করা কখনোই ঠিক না। তাছাড়া রাজ জাহির চৌধুরীর থেকে সব শুনেছে দোলা সম্পর্কে। আর এতে দোলাকে বেশ ভালো মনে হয়েছে রাজের৷

– দেখ রুদ্র একটা মানুষ দিয়ে কখনোই সবাইকে বিচার করা যায় না। তুই কেনো এটা বুঝতে চাস না আমি আজও বুঝলাম না। একটা মানুষের জন্য তুই গোটা নারী সমাজকে দায়ী করে রেখেছিস এটা কি ঠিক তুই বল?

– প্লিজ রাজ। আমাকে এই সব নিয়ে কিছু বলতে আসবি না৷ আমি নারী জাতিকে বিশ্বাস করি না। ওরা কালসাপের থেকেও বিষাক্ত হয়। সুন্দর সাজানো জীবনকে কালো বিষ দিয়ে ভরিয়ে বিষাক্ত করে দেয়। কথাটা বলতে রুদ্রর কন্ঠস্বরটা নরম হয়ে আসে। রুদ্র নিজেকে সামলে নিয়ে একটা ওয়েটারকে ডেকে বলে ড্রিংক সার্ভ করতে। কিন্তু এতে রাজ বাধা দেয়।

-দোলা চৌধুরী বাড়ি এসেছে অনেক আগে। এখন বাজে রাত প্রায় ১১ টার কাছাকাছি। এই বাড়িতে তেমন কেউ নেই যার সাথে একটু কথা বলবে দোলা। জেসমিন চৌধুরী এসে তার রুমে ঢুকে বসে আছে। জাহির চৌধুরী তার রুমে আছে। যত হোক সে তো দোলার সাথে থাকতে পারে না। আর কেউ নেই যে দোলার পাশে থাকবে। রুদ্রর জন্য কাউকে জানাতেও পারিনি জাহির চৌধুরী।

– দোলাকে রুদ্রর ঘরে বসিয়ে রাখা হয়েছে। ঘরটা সুন্দর করে গোছানো। কিন্তু বিয়ের জন্য কোনো রকম সাজানো হয়নি৷ আর টা যে রুদ্রর জন্য হয়নি এটাও বুঝতে পারছে দোলা। তাছাড়া দোলা এই সব আশাও করে না। তার জীবন এখন একটা উপহাস মাত্র।

– দোলা রুদ্রর ঘরটা বারবার দেখছে ঘুরেফিরে। ঘরটা বেশ পছন্দ হয়েছে দোলার। সব জিনিস জায়গা মতো সাজানো। তবে ঘরে বেশির ভাগ জিনিস সাদা রঙের যার জন্য ঘরটা আরো আকর্ষণীয় দেখাচ্ছে।

– এর মধ্যে একজন সার্ভেন্ট এসে দোলাকে জানায় জাহির চৌধুরী তার ঘরে তাকে ডাকছে। দোলা সার্ভেন্টের কথা মতো চলে যায় জাহির চৌধুরীর ঘরে।

– জাহির চৌধুরী আলমারির সামনে দাঁড়িয়ে আছে দোলা জাহির চৌধুরীর ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে বলে আসবো বড় সাহেব?
– দোলার কথায় জাহির চৌধুরী থমথমে গলায় বলে একদম না। জাহির চৌধুরীর কথায় আঁতকে উঠে দোলা। ভ্রু কুচকে আসে সাথে ভয় ঢুকে যায় মনে।

– জাহির চৌধুরী দোলার দিকে তাকিয়ে মুখটা গম্ভীর করে বলে বড় সাহেব কি কথা হ্যাঁ? বাবা বল বাবা। আমি আজ থেকে তোর বাবা বুঝেছিস। নো বড় সাহেব অনলি বাবা বুঝেছিস তুই কড়া শাসনে বলে জাহির চৌধুরী।
— জাহির চৌধুরীর কথায় একটা স্বস্তির নিশ্বাস ত্যাগ করে দোলা।।সে তো বেশ ভয় পেয়ে গিয়েছিলো প্রথমে জাহির চৌধুরীর কথায়।

– দোলা মুচকি হেসে মাথা ঝাকিয়ে হ্যাঁ বলে ভেতরে যায়। দোলাকে বসতে বলে জাহির চৌধুরী আলমারি থেকে কিছু বাক্স বের করে নিয়ে আসে। জাহির চৌধুরীর হাতে বাক্স দেখে দোলা ভ্রু কুচকে জিজ্ঞেস করে এর মধ্যে কি আছে বাবা?

– জাহির চৌধুরী দোলার হাতে বাক্স গুলো ধরিয়ে দিয়ে বলে নিজে দেখে নে।
– দোলা কৌতুহল ভরা চাহনি নিয়ে বাক্স গুলো দেখে এরপর বাক্স খুলে দেখে একটা ভারী স্বর্ণের হার। দোলা অবাক হয়ে তাকায় জাহির চৌধুরীর দিকে। দোলাকে তাকাতে দেখে জাহির চৌধুরী মুচকি বলে আরেকটা বাক্স খোলার জন্য। দোলা আরেকটা বাক্স খুলে দেখে ওইটাই স্বর্ণের চুড়ি। সব জিনিস অনেক পুরানো দেখে মনে হচ্ছে।

– বাবা এই সব কি?

– আমার মায়ের গহনা৷ অনেক পুরানো কিন্তু খাঁটি সব। আমার মায়ের ইচ্ছে ছিলো তার নাতবউকে নিজ হাতে এই গুলা দেওয়ার কিন্তু সে ভাগ্য আমার মায়ের হয়ে উঠেনি৷ তাই আমার হাতে দিয়ে গেছে এইগুলা রুদ্রর বউয়ের জন্য।

– দোলা চমকে উঠে বলে এই গুলা সব আমার?
– জাহির চৌধুরী স্বাভাবিক ভাবে উত্তর দিয়ে বলে হ্যাঁ। দোলা এবার অবাক হওয়া কন্ঠে বলে না না বাবা আমি এই গুলো নিতে পারবো না৷ এইগুলো বরং আপনার কাছে থাক বাবা।
– জাহির চৌধুরী দোলার কথায় মনোক্ষুণ্ণ হয় একটু।
– এইগুলো তোমার জন্যই রাখা বউমা। তাই এইগুলো তোমাকে নিতে হবে। আমি এই সব কিছু তোমার হাতে তুলে দিয়ে দায় মুক্ত হতে চাই। প্লিজ মা না করিস না।

– জাহির চৌধুরীর কথায় দোলা দোটানায় পড়ে যায়। কি করবে বুঝতে পারে না।
– কি রে মা নিবি না?

– দোলা আর কিছু না ভেবে মুখে হাসি নিয়ে এসে বলে ঠিক আছে বাবা এইগুলো আমি নিয়ে যাচ্ছি। তবে আমি এই গুলো আমার দায়িত্বে রাখবো শুধু আমি কখনো ব্যবহার করবো না।

– দোলার কথায় জাহির চৌধুরী অবাক হয়ে বলে কেনো?
– দোলা মুখটা মলিন করে বলে এই সব কিছুর প্রতি আমার এখনো কোনো অধিকার হয়নি বাবা। যেদিন আমি ছোট সাহেবের মন জয় করে এই বাড়ির যোগ্য বউ হয়ে উঠতে পারবো আমি সেদিনই এই সব গহনা দিয়ে সুন্দর করে সাঁজবো।
– দোলার কথা গুলো বেশ ভালো লাগে জাহির চৌধুরী।

– দোলার মাথায় হাত রেখে বলে দোয়া করি রে না৷ তুই তোর উদ্দেশ্যে সফল হো। আমার ছেলেটাকে হাসিখুশি বানিয়ে দে। ওর ভেতরের চাপা কষ্টগুলোকে দূর করে দে।

– শুন দোলা মা আমি তোকে কিছু কথা বলি আজ। মন দিয়ে শুনবি আমার কথা গুলো।

– দোলা আগ্রহের সাথে তাকায় জাহির চৌধুরীর দিকে।

– জাহির চৌধুরী দোলার পাশে বসে বলে, আমি জানি তুই সব জানিস। রুদ্র যে মেয়েদের পছন্দ করে না তাদের সম্মান করে না এর সবই তো অজানা নয়।রুদ্রর রাগ জেদ সব কিছু বেশি এটাও জানিস। আর এই সব কিছু মানিয়ে তোকে চলতে হবে এখন থেকে । তুই কিন্তু একদম ভয় পাবি না রুদ্রর এই সবগুলো।

– আমি আমার ছেলেকে জানি রুদ্র যত রুড হোক না কেনো একটা মেয়েকে নির্যাতন কখনোই করবে না। তাই তুই যেনো ওর রাগ ওর বকাবকি এইসব শুনে দূরে সরে যাস না। আমি কি বলতে চাইছি তুই নিশ্চয় বুঝতে পারছিস?

– দোলা মাথা নাড়িয়ে বলে আমি সব বুঝেছি বাবা। আমার জীবনটা একটা যুদ্ধক্ষেত্র হয়ে গেছে। এখানে প্রতি মুহূর্তে আমাকে লড়াই করে বাঁচতে হবে তাও আবার আমার স্বামীর সাথে।

– আরেকটা কথা শুন মা। তোকে যদি এই বাড়ির আর কেউ কিছু বলে, কটুক্তি করে একদম কানে তুলবি না কথা গুলো। আমি তোকে ভালোবাসি এটা ভেবে তুই চুপ করে থাকবি। আস্তে আস্তে সবার মুখ বন্ধ করে দিবি তুই তোর কাজ দিয়ে।
– জাহির চৌধুরী আসলে এটা জেসমিন চৌধুরীর কথায় বুঝায়ছে দোলাকে। দোলাও যানে যে, জেসমিন চৌধুরী তাকে পছন্দ করে না। দোলা এর আগে এই বাড়িতে দরকারে আসলে জেসমিন চৌধুরী ত্যাড়া ভাবে সব কথার উত্তর দিতেন। দোলা সেদিন থেকে বুঝে যায় এই মহিলা সুবিধার নয়।

– যা মা এবার তোর ঘরে যা। রুদ্রর আসার সময় হয়ে আসছে। রুদ্রর ঘরে যাওয়ার কথা শুনে দোলার মুখটা ফ্যাকাসে হয়ে যায়।।অসহায় চোখে জাহির চৌধুরীর দিকে তাকায়।

– তুই তো অনেক সাহসী আর বুদ্ধিমতী আমি জানি। রুদ্রকে একমাত্র তুই জব্দ করতে পারবি আমি এটাও জানি।

– দোলা জাহির চৌধুরীকে সালাম করে বলে দোয়া করেন আমাকে বাবা। আমি যেনো আপনাদের সবার বিশ্বাস ভরসা রাখতে পারি। আজ থেকে আমার শুরু হবে জীবনের নতুন অধ্যায়। আর এই অধ্যায়ের যত কালো অতীত আছে সব ধুয়ে মুছে আমি নতুন অধ্যায়ের সূচনা করবো দেখবেন।

– দোলার কথা জাহির চৌধুরী অনেক খুশি হয় সাথে শান্তি অনুভব হয় হৃদয়ে। জাহির চৌধুরী তো এটাই চেয়েছে। দোলা রুদ্রকে সঠিকটা বুঝতে সাহায্য করুক, রুদ্রর মনের ভুল ধারণা গুলো ভেঙে দিক।

— চলবে…

❌❌কপি করা নিষেধ ❌❌ ভুলক্রুটি ক্ষমার সাপেক্ষে বিবেচনা করবেন।