তুমিময় নেশায় আসক্ত পর্ব-২২+২৩

0
696

#তুমিময় নেশায় আসক্ত 🖤
#পর্ব- ২২
#Jannatul_ferdosi_rimi (লেখিকা)
রিমির মামুর জোড় করে রিমির হাতে কলম ধরিয়ে ডিভোর্স পেপারে সাইন করিয়ে দিতে বললেন। রিমি অসহায় দৃষ্টিতে তার মামুর দিকে তাঁকালো কিন্তু রিমির মামার তাতে ভ্রুক্ষেপ নেই। তিনি মুখে গাম্ভীর্য এটেঁ রয়েছেন যেন ডিভোর্সটা হয়ে গেলে তারই ভালো। অনেক পরিশ্রম করে তিনি চেয়ারম্যানের পদটা পেয়েছেন। আজ তা রুহানা চৌধুরী কেড়ে নিলে পথে বসে যাবেন তিনি। রুহানা চৌধুরীর ক্ষমতা বেশ অবগত তিনি। আমান ও রিমির পাশে দাঁড়ায়। রিমিকে তাড়া দিতে থাকে রিমির মামু সাইন করানের জন্যে। রিমি তার মায়ের দিকে ব্যাথাতুর দৃষ্টিতে তাকালে তার মা কড়া চোখে রিমির দিকে তাকিয়ে বললেন,

‘ তাড়াতাড়ি সাইন করে দে রিমি। ‘

রিমির কষ্ট বেড়ে গেলো। সাইন করতে ইচ্ছে করছে না। ভিতরে এক অদ্ভুদ দ্বিধায় পিরিত হচ্ছে সে প্রতিনিয়ত। কালকের রাতে কি সুন্দর মুহুর্ত কাটালো রিমি কিন্তু আজ? সবকিছুই কেমন উলোট পালোট হয়ে গেলো মুহুর্তেই! রিমির শ্বাস রোধ হওয়ার অবস্হা হলো। অয়ন ডিভোর্স পেপারে সাইন করে দিয়েছে তা মেনে নিতেই বড্ড কষ্ট অনুভব করছে রিমি। কলমটুকু আঙ্গুল দিয়ে ধরা রাখার শক্তিটুকুও পাচ্ছে না। কি অসহ্য বিচ্ছিরি পরিস্হিতি। দ্বিতীয়বারের মতো এমন বিচ্ছিরি পরিস্হিতির স্বাকীর হচ্ছে রিমি কিন্তু প্রথমবার তো তার পাশে অয়ন ছিলো আজ কোথায় গেলো সে? রিমির বুক ভারি হয়ে আসলো।
অয়নের মুখশ্রীটা মনে পড়তেই,চটজলদি হাতের কলমটা ফেলে দিলো রিমি। রিমির মামুসহ উপস্হিতসহ সবাই হতভম্ব হলো রিমির কান্ডে। রিমি মিনমিনিয়ে বললো,

‘ আমি পারবো না সাইন করতে। আমি কিছুতেই সাইন করতে পারবো না। ‘

রিমির মামু রোষপূর্ন দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো রিমির দিকে। যেন কাঁচা চিবিয়ে খেয়ে ফেলবে রিমিকে। রিমি সেই দৃষ্টি উপেক্ষা করে নিজের ঘরের দিকে পা বাড়ালে নিলে, আমানে কথায় থেমে যায়। আমান খুবই শান্ত সুরে বলে,

‘ রিমিপাখি! তুমি ডিভোর্স দিবে কিনা দিবেনা তা সম্পূর্ন তোমার ব্যাপার কিন্তু তার আগে আমার কিছু কথা তোমাকে শুনতে হবে। আশা করি আজকে তুমি আমাকে কিছু কথা বলার সুযোগ দিবে। দয়া করে একটু সুযোগ দাও আমাকে রিমিপাখি। ‘

আমানের অসহায়মাখা গভীর অনুরোধকে চাইলেও
নাখোচ করতে পারেনা রিমি। মাথা নাড়িয়ে নিজের ঘরের দিকে রওনা হয় রিমি।

_______________

পায়েল ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়ে ফটোশ্যাুট করছে এবং রুহানা চৌধুরী এবং তার ছোট ছেলে সবকিছুর তদারকি করছে কিছুক্ষনের মধ্যেই ক্যানাডার বড় বড় ফ্যাশান কম্পানি আসবে রুহানা চৌধুরীর সাথে মিটিং করতে। আজকে যথেষ্ট ব্যস্ত রুহানা চৌধুরী। এতো ব্যস্ততার মাঝেও তিনি এখনো অব্দি রিমির মামুকে ফোন করার সুযোগটুকুও পাননি। রিমি কী আদোও সাইন করেছে? জানেন না রুহানা চৌধুরী তবুও এইটুকু বিশ্বাস আছে রুহানা চৌধুরীর, নিজের পদ হারানোর ভয়ে যেকোন মূল্যে, নিজের ভাগ্নীর ডিভোর্স করিয়ে দিবেন রিমির মামু। রুহানা চৌধুরী ভাবনার মাঝেই বাইরে জিনিসপত্র ভাঙ্গার শব্দ পেতে শুরু করেন তিনি। শব্দের উৎস তীব্র থেকে তীব্রতম হতেই তিনি দ্রুততার সাথে বাইরে বেড়িয়ে দেখে অয়ন তার গার্ডসদের দিয়ে ফটোশ্যুটের সবকিছু ভেঙ্গে ফেলছে কেউ চাইলেও অয়নকে আটকাতে পারছে না। পায়েলসহ অফিসের সকলে হতবাক হয়ে অয়নের কান্ড দেখছে। অয়নের কাকা অয়নের কাছে ছুটে আসে,অয়নের কাধে হাত রেখে বলে,

‘, কি করছো তুমি? এইভাবে সব ভাঙ্গচুড় করছো কেন? আজকে অনেক বড় কম্পানি থেকে আমাদের সাথে মিটিং করতে আসছে। ‘

অয়ন সাথে সাথে হাত সরিয়ে ক্রোধ নিয়ে তীব্র হুংকার ছেড়ে বলে,

‘ আই ডোন্ট কেয়ার! কে আসছে না আসছে। আগে
রুহানা চৌধুরীকে ডেকে আনুন। আমি রুহানা চৌধুরীর সাথেই কথা বলবো। ‘

এই প্রথম অয়নের মুখে নিজের নাম শুনে রুহানা চৌধুরীর ভয়ে গলা শুকিয়ে একপ্রকার কাঠ হয়ে গেলো। তিনি বুঝে গিয়েছেন অয়ন তার হাতছাড়া হয়েছে। রিমির ভালোবাসায় বদ্ধ উম্মাদে পরিনত হয়েছে সে। রুহানা চৌধুরীকে আরেকবার হুংকার দিয়ে ডেকে উঠে অয়ন। রুহানা চৌধুরী বসে থাকেনা
দ্রুততার সাথে অয়নের নিকট পৌঁছে দাম্ভিকতার সাথে বলে,

‘ কি করছো অয়ন? এইভাবে ভাঙ্গচুর করছো কেন? ‘

অয়ন পকেটে হাত ঢুকিয়ে রুহানা চৌধুরীর দিকে ঝুঁকে বলে,

‘ তা তো তোমার সবথেকে বেশি ভালো জানার কথা গ্রেন্ডমা। অয়ন চৌধুরীকে রাগানোর ফল তোমাকে ভোগ করতেই হবে গ্রেন্ডমা! ‘

‘ মানে? ‘

রুহানা চৌধুরীর প্রশ্নে অয়ন অধরের কোণে ভয়ংকর
বিক্ষিপ্ত বাঁকা হাসি ফুটিয়ে বলে,

‘ তুমি আমার থেকে আমার রিমিপরীকে কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা করবে আর আমি অয়ন চৌধুরী বসে থাকবো? তোমার সব প্ল্যান আমি জেনে গিয়েছে। তোমার পারসোনাল সেক্রিটারিকে ডাবল পেমেন্ট করে। তুমি কীভাবে রিমিরপরীর মামুকে ভয় দেখিয়ে আমার থেকে রিমিপরীকে আলাদা করার চেষ্টা করেছো সব জেনে গিয়েছি আমি। ‘

রুহানা চৌধুরীর ভয়ে তরতর করে ঘামতে থাকে। গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে আসে। অয়ন কিছু মহিলা গার্ডদের ইশারা করে, অয়নের ইশারা শুনে মহিলা গার্ডগুলো পায়েলের হাত ধরে ফেলে। পায়েলকে এইভাবে হুট করে আক্রমন করায় ভরকে যায় পায়েল। অয়নের দিকে তাকিয়ে ভয়ার্থ গলায় বলে উঠে,

‘ অয়ন আমাকে ধরছে কেন? ‘

অয়ন কিছু বলেনা শুধু চোখের ইশারায় মহিলাগুলোকে পায়েলকে নিয়ে যেতে থাকে। পায়েল
ভয়ে চিৎকার করে কান্না করতে থাকে প্রতিনিয়ত। অয়নের মতো উম্মাদ ছেলেকে বিয়ে করার ইচ্ছেটা তার জীবনের সবথেকে বড় ভুল মনে হচ্ছে তার। রুহানা চৌধুরী চাইলেও আটকাতে পারেনা অয়নকে।
পায়েলকে নিয়ে যাওয়ার পরে, অয়ন ব্জ্র কন্ঠে বলে,

‘ রুহানা চৌধুরী যার জন্যে আমাকে এবং আমার রিমিপরীকে আলাদা করতে চেয়েছিলেন আজ যদি আমি তাকেই সরিয়ে ফেলি তখন কি করবেন আপন? ‘

রুহানা চৌধুরী হাপাতে হাপাতে প্রশ্ন করে উঠেন,

‘ অয়ন কি বলছো তুমি? তোমার মাথা কী আদোও ঠিক আছে? ‘

অয়ন রুহানা চৌধুরীর প্রশ্নের বিপরীতে কিছু বলেনা শুধু গটগট করে রাগে ফুশতে ফুশতে বেড়িয়ে যাওয়ার আগে রাগে একটা কাচের জিনিস পিছনের দিকে ছুড়ে মারে যা গিয়ে রুহানা চৌধুরীর কপালে গিয়ে লাগে। রুহানা চৌধুরী কপালে হাত দিয়ে দেখে তার কপাল থেকে রক্ত বেড়োচ্ছে ইতিমধ্যে। রুহানা চৌধুরী ধপ করে বসে পড়ে। অফিসের সবাই গিয়ে তাকে ধরে।

[লেখিকাঃ জান্নাতুল ফেরদৌসি রিমি]

_________

অয়ন রাগে বেড়োতেই খেয়াল করে দেখে ইতিমধ্যে
প্রেস-মিডিয়া সব জড়ো হতে শুরু করেছে বাইরের দিকে। হয়তো অয়নের ভাঙ্গচুরের খবর পেয়েই তারা ছুটে আসে। এইসব খবর বাতাসের মতো ছড়ায়।
প্রেস-মিডিয়াকে দেখে অয়ন তার গার্ডদের উদ্দেশ্য করে পায়েলকে অন্য রাস্তা দিয়ে নিয়ে যেতে বলে।
প্রেস-মিডিয়াকে অয়নকে দেখে ছুটে আসলে অয়ন তার গার্ডদের দিয়ে, প্রেস-মিডিয়াকে সরিয়ে গাড়িতে গিয়ে বসে পড়ে। অয়নের থেকে কোনরুপ প্রতিক্রিয়া না পেয়ে, সাংবাদিকগন ক্যামেরার সামনে বলতে থাকে,

‘এইমাত্র পাওয়া খবর! চৌধুরী ফ্যাশন ডিজাইনার ওনার রুহানা চৌধুরীর ছোট নাতী অয়ন চৌধুরী
নিজ অফিস চৌধুরী ফ্যাশনে ভাঙ্গচুর করে গিয়েছেন, কিন্তু কেন? ‘

হাওয়ার মতো খবরগুলো প্রেসমিডিয়া মুহুর্তেই সকলের কাছে পৌঁছে দিলো।

অয়ন গাড়ি থেকে বেড়িয়ে এয়ারপোর্টের উদ্দেশ্য গেলো। সেখানে কিছু লোক দাঁড়িয়ে ছিলো। অয়নকে দেখেই তারা অয়নকে তার প্রাইভেট প্লেনটা দেখিয়ে দিলো। অয়ন তড়িঘড়ি করে তার প্রাইভেট প্লেনে উঠে গেলো। তাকে এখন খুব তাড়াতাড়িই সিলেটে পৌঁছাতে হবে,অনেক হিসাব বাকি আছে তার।

_____________

রিমি এবং আমান আপাতত রিমির ঘরের বসে আছে। আমান কিছুক্ষন ধরে বেশ অস্হির হয়ে রিমির দিকে আড়চোখে তাঁকাচ্ছে কিন্তু রিমি বেশ স্বাভাবিক হয়েই বসে আছে। নিরবতা ভেঙ্গে সর্বপ্রথম রিমি নিজ থেকেই বলে উঠে,

‘ চুপ করে বসে আছেন কেন আমান? যা বলার বলুন। আজ আমি সব শুনবো। ‘

রিমির কথায় আমান কিছুটা ভরসা পেলো। মুখের জড়তার রেশ নিমিষেই কেটে গেলো। আমান উঠে দাঁড়িয়ে বলতে থাকে,

‘ রিমিপাখি সেদিন বিয়ের আসর থেকে আমি ওভাবে যেতে চাইনি। একপ্রকার যেতে বাধ্য হয়েছি। তুমি তো জানো আমি মধ্যবিত্ত ফ্যামেলি থেকে বিলং করি। বাবা মা এবং ছোট দুই ভাইবোনের পড়াশোনার খরচ আমাকেই বহন করতে হয়। আমি খুব কষ্টে ডাক্তারি পড়ে একটা সরকারী অফিসে চাকরী করি। তবুও নতুন নতুন চাকরী। বেশ হিমশিম খাচ্ছিলাম আমি।
তারমধ্যে অস্ট্রেলিয়ার একটা বড় হসপিটালে আমি জবের এপ্লাই করি এবং সেই জবটা কনফার্ম হয় আমাদের বিয়ের দিন। আমি যদি সেদিন অস্ট্রেলিয়া না যেতাম তাহলে জবটা পেতাম না আমি। হাতছাড়া হয়ে যেতো আমার। ‘

রিমির আমানের দিকে তাকাতেই আমান মাথানিচু করে বলে,

‘ মধ্যবিত্ত ঘরের ছেলে আমি। চাকরী আমাদের কাছে অনেক কিছু। অনেকসময় চাকরীর কাছে আমাদের ভালোবাসা হেরে যায়। এইটাই হচ্ছে কঠিন বাস্তবতা।’

‘ তাহলে ফিরে এলেন কেন? আপনার কাছে তো চাকরীই সব। ‘

রিমির প্রশ্নে আমান সামান্য হেসে বলে,

‘ আমার কাছে যেমন চাকরীটা জরুরী ছিলো তেমনি তুমি আমার জীবনেও অনেক গুরুত্বপূর্ণ রিমিপাখি। যখন শুনলাম তোমার বিয়ে হয়ে গিয়েছে আমার ভিতরটা ছাড়খাড় হয়ে যাচ্ছিলো। তোমাকে হারানো শূন্যতায় আমি প্রায় শেষ হয়ে যাচ্ছিলাম তাই তোমাকে পাওয়ার আশায় কয়েকদিনের ছুটি নিয়ে বাংলাদেশে এসেছি। আমাকে আশাহত করোনা রিমিপাখি। আমি সত্যি তোমায় ভালোবাসি। ‘

আমানের মুখে ভালোবাসি শব্দটা কেন যেন আজ রিমিকে গলাতে পারলো না। রিমির তেমন একটা আলাদা অনুভুতি এলো না মনে। রিমি কিছু বলবে তার আগেই……..

চলবে….কী?

#তুমিময়_নেশায়_আসক্ত 🖤
#পর্ব- ২৩
#Jannatul_ferdosi_rimi (লেখিকা)
রিমি কথাটুকু বলার সুযোগ পেলো না তার আগেই ভয়ংকর এক শব্দে কেঁপে উঠলো তার হৃদয়টা। কানে হাত দিয়ে নীচে বসে পড়লো রিমি। আমানও কান চেপে ধরলো শব্দটি পেয়ে। এতোটাই ভয়ংকর
হিম করা শব্দটি। আমান একটু ভালো করে অনুভব করে বুঝলো কেউ বেহালা বাজাচ্ছে। এতোটা ভয়ংকর সুর কেউ তুলতে পারে তা ভাবতেই গায়ে কাটা দিয়ে উঠছে আমানের। শব্দের যতটা প্রখর হচ্ছে ততই রিমির তত কষ্ট হচ্ছে। আমান রিমির কছে ঝুঁকে রিমির হাত ধরে কম্পিত কন্ঠে বলে উঠে,

‘ রিমিপাখি তুমি ঠিক আছো তো? ‘

রিমির গলা দিয়ে শব্দ বের হচ্ছে না কেন যেন। রিমির শরীরটা আসার হয়ে যাচ্ছে। শরীরের গতি সে নিয়ন্ত্রন করতে পারছে না। আমান উঠে দাঁড়িয়ে পানি নিয়ে এসে রিমির মাথাটা নিজের কাধে রাখে।অতঃপর রিমির চোখমুখে পানি ছিটাতে শুর‍ু করে। রিমি বহু কষ্টে বলে উঠে,

‘ আমি শব্দটা সহ্য করতে পারছি না আমান। প্লিয বন্ধ করান শব্দটা। ‘

আমান মাথা নাড়িয়ে রিমিকে চেয়ারে বসিয়ে জানালা দিয়ে শব্দের উৎস দেখতে গেলো। শব্দের উৎস পেতেই একপ্রকার ভরকে গেলো আমান। রিমিদের বাড়ির চারিপাশে কালো পোষাক পরিহিত গার্ডসরা দাঁড়িয়ে আছে বন্দুক হাতে। অয়ন গাড়িতে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে, কালো হুডি পড়ে হাতে কালো রংয়ের একটা বেহালা নিয়ে অদ্ভুদ এক ভয়ংকর সুর তুলছে। অয়নের ভয়ংকরতম শব্দ পেয়ে রিমির মামুসহ রিমির বোনেরা এবং রিমির মা বেড়িয়ে যায়। রিমির মামু এতো গার্ডস এবং অয়নকে এই মুহুর্তে আশা করেনি। রিমির মামাতো বোনেরা কানে হাত দিয়ে একপ্রকার মরন বেদনায় ভুগছে। রিমির মামু হতবাক হয়ে অয়নের দিকে তাকিয়ে অনুনয়ের সুরে বলে,

‘ বন্ধ করো এইসব শব্দ! দয়া করে বন্ধ কর। ‘

অয়ন থেমে যায়। শান্ত দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে থাকে রিমির মামুর দিকে। রিমির মামু সেই শান্ত দৃষ্টি দেখে
ঘাবড়ে যায়। শব্দের তীব্রতা কমতেই রিমি নিজের মধ্যে কিছুটা শক্তি পায়। উঠে দাঁড়িয়ে পড়ে দ্রুতভাবে। ছোটবেলা থেকে ভয়ংকর শব্দ শুনতে পায়না রিমি। ভয় পায় সে। একধরনের ফোবিয়া আছে তার ভয়ংকর শব্দে। রিমি উঠে দাঁড়িয়ে আমানের পাশে দাঁড়িয়ে দেখে, অয়ন এবং তার গার্ডস তাদের বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আছে। অয়নকে দেখে আনমনে হেঁসে উঠে রিমি। যাকে বলে প্রাপ্তির হাঁসি। তার বিশ্বাস তবে ঠিক হলো। অয়ন ডিভোর্স পেপারে সাইন করেনি বলেই তাকে নিতে ছুটে এসেছে এতো দূর। রিমি ‘ডক্টর এয়ারসি ‘ বলে চিৎকার করতে নিলে, তাতে বাঁধা দেয় আমান। হাতের ইশারায় রিমিকে সামনের দিকে তাকাতে বলে। সামনের দিকে তাকাতেই রিমি আৎকে উঠে। কেননা অয়ন রিমির মামুর কপাল বরাবর বন্দুক তাক করে আছে।

_____________

রুহানা চৌধুরীর মাথায় ডক্টর এসে ব্যান্ডিজ করে দিয়েছে। রুহানা চৌধুরী এবং তার ছেলে অফিসে টিভির সামনে বসে আছে। নিউজে ব্রেকিং নিউজ হিসেবে বেড়িয়েছে তাদের অফিসে ঘটনাটি। পুরো শহরে রটিয়ে পড়েছে অয়ন নিজের অফিসে ভাঙ্গচুর করেছে। লজ্জায় মাথা কাটা যাচ্ছে রুহানা চৌধুরীর। এতো বছরের অর্জিত সম্মান নিমিষেই ধুলে মিশে যাচ্ছে তার। সমস্ত মিটিং ক্যানসেল করে ফেলেছে অন্যান্য কম্পানিরা চৌধুরী ফ্যাশন কম্পানির সাথে।
রুহানা চৌধুরীর ছোট ছেলে আশরাফ চৌধুরী রুহানা চৌধুরীর পাশে বসলেন। রুহানা চৌধুরী তার ছেলের দিকে একপলক তাকিয়ে হতাশার সুরে বললেন,

‘ সব শেষ হয়ে গেলো রে আশরাফ। এতো বছরের মান-সম্মান সব শেষ। ‘

আশরাফ নরেচড়ে উঠলেন। তাকেও বেশ চিন্তিত দেখাচ্ছে। অতঃপর চিন্তিত গলায় বলে উঠলেন,

‘ একটা খবর দেওয়া আছে তোমাকে মা। ‘

‘ কি খবর? ‘

‘ পায়েলকে পাওয়া যাচ্ছে না। পায়েল যেহুতু মিডিয়ার লোক তাই তার নিখোঁজ হওয়ার খবরটা শহরে দ্রুত গতিতে ছড়িয়ে পড়েছে। পুলিশ ও ইনভেস্টিগেট করা শুরু করে দিয়েছে। ‘

রুহানা চৌধুরী ছেলের কথা শুনে হন্তদন্ত হয়ে বললেন,

‘ না না পুলিশকে কিছুতেই এই ব্যাপারটা ইনভেস্টিগেট করতে দেওয়া যাবেনা। অয়ন আমাদের বাড়ির ছেলে। যদি পুলিশ ব্যাপারটা তদন্ত করে তাহলে শুধু অয়নকে নয় পুরো চৌধুরী কম্পানিকে এর জন্যে সাফার করতে হবে। এমনিতেই আমাদের অনেক ক্ষতি হয়েছে আমাদের কম্পানির। তুমি এখনি কিছু একটা ব্যাবস্হা করো আশরাফ। যে করেই হোক পায়েলের ক্যাসটা ধামাচাপা দাও। ‘

আশরাফ তার মায়ের আদেশ পাওয়া মাত্র দ্রুত মাথা দুলিয়ে স্হান ত্যাগ করলেন। রুহানা চৌধুরী হাত শক্ত করে মুঠো করে নিলেন। রোষাক্তপূর্ন দৃষ্টিতে চেয়ে রইলেন টিভির পর্দায়। আজ সবকিছুর জন্যে দায়ী অয়ন। রুহানা চৌধুরী রোষপূর্ন কন্ঠে বলে উঠলেন,

‘ ছাড়বো না আমি। কিছুতেই ছাড়বো না আমি অয়নকে। ‘

___________

সানা এই নিয়ে চতুর্থবারের মতো বিয়ে ভেঙ্গে দিলো। আজ ও তাকে পাত্রপক্ষ দেখতে এসেছিলো, কিন্তু সে কৌশলে পাত্রের দোষ ত্রুটি খুঁজে পাত্রকে নাখোচ করে দিয়েছে। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে সানা গুনগুন করে গান গাইছে এবং তার হাতে থাকা চুড়িগুলো সযত্নে খুলে রেখে দিচ্ছে। সানার মা রেগে
সানার ঘরে আসেন। সানা তার মায়ের রাগান্বিত মুখশ্রী দেখে একপলক হেসে আবারোও কাজে মনে দেয়। তাতে যেন দ্বিগুন রেগে যায় সানার মা। সানার মা সানার সামনে এসে বলে,

‘ এই নিয়ে চতুর্থবার! আর কত বিয়ে ভাঙ্গবি তুই?
তোর কি বিয়ে করার ইচ্ছে নেই? ‘

সানা তার মায়ের গলা জড়িয়ে আদুরে কন্ঠে বলে,

‘ আচ্ছা মা। তুমি আমাকে তাড়ানোর জন্যে উঠে পড়ে লেগেছো কেন? আমি যদি তোমাকে ছেড়ে চলে যাই তাহলে তুমি কীভাবে থাকবে বলো তো? ‘

সানার কথা শুনে সানার মায়ের নেত্রকোণায় জল চলে আসে। সানা আবারোও বলে উঠে,

‘আর বিয়ের ব্যাপার টা তো? তা সঠিক সময়ে আমি করে ফেলবো। তুমি চিন্তা করো না তো। আসছি আমি। অফিসে একটা জরুরী মিটিং চলে এসেছে। আমি আসছি। ‘

সানা কথাটি বলেই বেড়িয়ে যায়। সানার মা হতাশ পানে তাকিয়ে থাকে সানার দিকে। বাপ ছাড়া মেয়েটাকে একাই মানুষ করে এসেছেন তিনি। সত্যিই তিনি বেশি তাড়াহুড়ো করে ফেলছেন। সানা নিশ্চয় সঠিক সময় এলে নিজ থেকেই বিয়ে করতে চাইবে।

__________

সানা অফিসে গিয়ে দেখে ফারহান টিভিতে গভীর দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে আছে। সামনে বড় বড় করে অয়নের খবরটা দেখানো হচ্ছে। ফারহান রিমোর্টটা হাতে নিয়ে খবরের চ্যানেলটা চেঞ্জ করে টিভিটা বন্ধ করে দিয়ে, কাজে মন দিলো। সানা ভরকে গেলো। নিজেদের কম্পানি নিয়ে কোন মাথা ব্যাথা নেই ফারহানের। সারা শহরে যেখানে তোলপাড় হয়ে যাচ্ছে সেখানে ফারহান এতোটা শান্ত কীভাবে থাকে?ভেবে পায় না সানা। ফারহান হয়তো সানার মুখ দেখে কিছুটা আন্দাজ করতে পেরেছে। তাই খুবই শান্ত সুরে বলে,

‘ এতেটা অবাক হওয়ার কিছুই নেই মিস সানা। চৌধুরী পরিবারের সাথে আমার কোন সম্পর্ক নেই। যা আছে সব ফর্মালিটির।’

‘ কিন্তু কেন স্যার? ‘

‘ ভয়ংকর এক অতীতের জন্যে। ‘

ফারহানের দায়সারা উত্তর।

__________________

অয়ন এইভাবে বন্দুক তাক করে রাখায় বেশ ভয় পেয়ে যায় রিমি। অয়নের ভয়ংকর রুপের সাথে সে আগেও পরিচিত। অয়ন রিমির মামাকেও গুলি করে দিতে বিন্দুমাত্র হাত কাঁপবে না। কথাটা ভেবেই ভয়ে ঢুগ গিলে রিমি । অয়ন রিমির মামুর কপালে বন্দুক তাক করে ঘাড় কাত করে বাঁকা হেসে বলে,

‘ মানুষ কতটা স্বার্থপর হলে, নিজের পদ হারানোর ভয়ে নিজের ভাগ্নীর সংসার শেষ করতে দুইবার ভাবেনা। ‘

রিমির মামু ভয়ে কাঁপছে। মনে হচ্ছে এই বুঝি অয়ন তাকে গুলি করে দিবে। রিমির বোনগুলোও নিজের বাবার এমন অবস্হা দেখে কেঁদে ফেলে। রিমির মা অসহায় হয়ে তাকিয়ে দেখছে শুধু। অয়ন হঠাৎ করে নিজের বন্দুকটা নীচে ফেলে দেয় এবং খপ করে রিমির মামার হাত ধরে ফেলে। অয়নের কাজে সবাই বেশ অবাক হলেও রিমি হয়না। রিমির ভয়টা সময়ের সাথে সাথে প্রখর হতে থাকে। কেননা অয়নের অধরের কোণে বেশ ভয়ংকর হাঁসি বিদ্যমান। যেই হাঁসির সাথে বেশ পরিচিত রিমি। অয়ন রিমির মামার হাতটা শক্ত করে চেপে শীতল গলায় বলে,

‘ এই হাত দিয়ে আপনি আমার রিমিপরীর হাতে কলম তুলে দিয়েছিলেন না সাইন করানোর জন্যে তাইনা? আমার থেকে আমার রিমিপরীকে আলাদা করার জন্যে? ‘

রিমির মামা ভয়ে মাথা নাড়ায়। অর্থাৎ সে করে নি।
অয়ন রিমির মামার হাত ধরে সামনে থাকা টেবিলে হাতটা রেখে পকেট থেকে হাতুড়ি বের করে, রিমির মামার হাতে জোড়ে বারি দেয়। রিমির মামা জোড়ে চিৎকার করে উঠে। হাত থেকে অনবরত রক্ত বেড়াচ্ছে। এতোটাই জোড়ে বারি দিয়েছে যার জন্যে হাতের অবস্হা করুণ হয়ে গিয়েছে। রিমির মা এবং
রিমির বোনেরা কাঁদতে থাকে। আমান বিষ্ময় নিয়ে থাকিয়ে থাকে। অয়নের পাগলামো সম্পর্কে সে শুনেছিলো কিন্তু এতোটা ভয়ংকর অয়ন তা জানতো না সে। রিমি নিজেকে আটকিয়ে রাখতে পারেনা। দৌড়ে নীচে চলে যায়। আমান চাইলেও আটকাতে পারেনা রিমিকে।

‘ ডক্টর এয়ারসি থামুন প্লিয! দয়া করে মামুকে মারবেন না। ‘

অয়ন দ্বিতীয়বারের মতো আঘাত করলে চাইলে,কাঙ্খিত মানুষটির কন্ঠ পেয়ে থেমে যায়। হ্যা তার রিমিপরী যার জন্যে সে এতো কান্ড করলো। যাকে পাওয়ার জন্যে এতোদূর ছুটে এলো সে। অয়ন হাতুড়িটা রেখে সামনের দিকে তাকায়। রিমি শশরীরে দাঁড়িয়ে আছে সামনে। নেত্রকোণে অজস্র জল এসে
হানা দিচ্ছে রিমির। অয়ন দ্রুত পায়ে এগিয়ে আসে রিমির দিকে। অয়নকে এইভাবে এগিয়ে আসতে দেখে রিমি দ্রুত তার আখিজোড়া বন্ধ করে ফেলে দ্রুত। এই বুঝি অয়ন তাকেও শাস্তি দিবে, কিন্তু রিমিকে সম্পূর্ন রুপে অবাক করে দিয়ে অয়ন রিমিকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। অতঃপর রিমির কানের কাছে গিয়ে ধীর কন্ঠে বলে,

‘ তোমার প্রতি অজস্র অভিমান বুকে পুষে রেখেছি রিমিপরী। এই অভিমান গুলো বেশ তীব্র। বেশ বেদনাদায়ক ।’

চলবে….কী?