তুমি আমারই রবে পর্ব-০১

0
1221

#তুমি_আমারই_রবে
#সূচনা_পর্ব
#Nishat_Jahan_Raat (ছদ্মনাম)

১.

অফিস থেকে ফিরে এসেই আচমকা “হিমু” আমার হাত দুটো করিডরের দেয়ালের সাথে চেঁপে ধরে আমার গলায় মুখ ডুবিয়ে ঢুলুঢুলু কন্ঠে বলে উঠল,,,

–“রূরূরূপা…. তোতোতোমার সাথে আমার কিছু কথা ছিলো। খুখুখুব গুরুত্বপূর্ণ। আশাশা করি তুমি বুঝতে পেরেছ আআআমি কি বলতে চাইছি।”

উনি কথাগুলো বলছে আর ঢুলে ঢুলে পড়ছে। মুখ থেকে কেমন এক্টা বিশ্রি গন্ধ আসছে। আমি বুঝতে পারছি উনি ড্রিংক করেছে। অতি মাএায় ড্রিংক করেছে। যার কারণে উনি অতি অপছন্দের মানুষটাকে আনমনেই জড়িয়ে ধরেছে। গলায় মুখ ডুবিয়ে তাকে ভালোবাসায় সিক্ত করে তুলছে। উনার প্রতিটা গরম শ্বাস প্রশ্বাস আমাকে উত্তেজিত করে তুলছে। উনার এই নির্মম অত্যাচারে আমি না পারছি ঠিকভাবে শ্বাস নিতে না পারছি মুখ খুলে উনাকে কিছু বলতে। আমার মৌণতা দেখে উনি এক ঝটকায় আমার গলা থেকে মুখ উঠিয়ে আমার চোখের দিকে তাকালো। এক প্রকার মাতাল চোখে উনি আমার দিকে তাকিয়ে আছে। দুচোখে উনার এক প্রকার মাদকতা টের পাচ্ছি। আমি হয়তো বুঝতে পারছি উনি কি চাইছে।

উষ্ণতায় আমার পুরো শরীর শিউরে উঠছে৷ লজ্জায় এক প্রকার মাথা কাঁটা যাচ্ছে। কাঁপা কাঁপা চোখে আমি উনার দিকে তাকাচ্ছি। গলা জড়ানো কন্ঠে আমি কিছু বলার আগেই উনি এক নিশ্বাসে বলে উঠল,,,

–“রূপা৷ কথাটা শোনার পর তুমি আমাকে ভুল বুঝবে না তো? আমার না, অনেক কথা বলার আছে তোমাকে। কিন্তু কখনো সেভাবে বলা হয়ে উঠে নি। আসলে কোনো স্কোপ ই পাই নি।”

আমি মৌণতা কাটিয়ে উনার থেকে চোখ সরিয়ে নিচের দিকে তাকিয়ে লজ্জা মাখা স্বরে বললাম,,,

–“কি বলবেন হিমু? আপনি যাই বলুন না কেনো আমি আপনাকে ভুল বুঝতে পারব না। আপনি আমার স্বামী হিমু। আপনাকে ভুল বুঝা সম্ভব না৷ আর আমি এ ও জানি আপনি কি বলতে চাইছেন। আপনার চোখেই সব স্পষ্ট আছে। আমাকে বলে কয়ে কিছু বুঝাতে হবে না।”

কথার মাঝেই আচমকা উনি আমার থুতনী চেঁপে ধরে আমার ঠোঁট জোড়া দখল করে নিলো। আমি চোখ দুটো বড় বড় করে উনাকে দেখছি। এক প্রকার অবিশ্বাস্য চোখে উনাকে দেখছি। বিয়ের ৫ মাসের মাথায় এসে উনি এই প্রথমবার আমার এতোটা কাছাকাছি এলো। শুধু তাই নয়, ফিল্মি স্টাইলে আমার ঠোঁটে ঠোঁট ও ডুবিয়ে দিলো। উনাকে ও এতোটা কাছ থেকে দেখার সুযোগ করে দিলো। ইদানিং এই লোকটার প্রতি আমি এক্টু বেশিই আকৃষ্ট হয়ে উঠছি। “যা হয়তো আমার জন্য খুব বেশি বাড়াবাড়ি।” তবে এই মুহূর্তে উনার আচরনটা আমার মোটে ও বাড়াবাড়ি মনে হচ্ছে না। উনার স্ত্রী আমি৷ শতভাগ অধিকার আছে উনার আমার কাছাকাছি আসার৷ আমাকে আপন করে নেওয়ার। আমার ও উচিত এই মুহূর্তে উনাকে নিজের করে নেওয়ার। মৃদ্যু হেসে আমি উনার শার্টের কলার চেঁপে ধরলাম। আনমনে আমি ও উনার সাথে তাল মিলাতে লাগলাম। ভালোবাসায় গাঁ ভাসাতে লাগলাম। জানি না কেনো আমার মন বলছে এটা কোনো ভয়ংকর দুঃস্বপ্ন। “ইদানিং হয়তো আমি আমার অতীতটাকে ভুলতে বসেছি! আচ্ছা… অতীত ভুলা কি এতোটাই সহজ?

কিছুক্ষনের মধ্যে আচমকাই উনি এক ঝটকায় আমাকে দূরে সরিয়ে দিলো। প্রায় এক গজ দূরে গিয়ে ছিটকে পড়লাম আমি। মায়ায় ভরা চোখ দুটো ক্ষনিকের মধ্যেই হিংস্র হয়ে উঠল। লাল টগবগে হিংস্র চোখ নিয়ে উনি আমার দিকে তেড়ে এসে জোরে চেঁচিয়ে বলে উঠল,,,

—“আমি ডিভোর্স চাই রূপা।”

ব্যাস এটুকুই। তাল মাতাল হয়ে উনি বেডের উপর লুটিয়ে পড়ল। হাত,পা চারদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে উনি চোখ জোড়া বুজে মুহূর্তের মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়ল। এই মুহূর্তে আমি আমার দুকানকে বিশ্বাস করতে পারছি না। মনে হচ্ছে কোনো এক স্বপ্নপুরীতে আছি আমি। যেখানে প্রতিনিয়ত কয়েক মুঠো রঙ্গিন স্বপ্ন নিয়ে বেঁচে থাকার মিথ্যে লড়াই চালিয়ে যেতে হচ্ছে। দু চোখে শত সহস্র অশ্রু নিয়ে আমি ধপাস করে ফ্লোরে বসে পড়লাম। এই পাঁচ মাসের সম্পর্কে উনি কখনো আমাকে ছোঁয়ে দেখে নি, না কখনো আমার সাথে বিন্দু পরিমান কথা বলার চেষ্টা করেছে। আজ যা ও উনি আমার এতোটা কাঁছাকাছি এলো তা ও আবার কিছুক্ষনের মধ্যে ডিভোর্স ও চেয়ে নিলো! মন বলছে সকাল হতে হতে সব ঠিক হয়ে যাবে৷ “অন্তত এইবার আমাদের মাঝে কোনো বিচ্ছেদ আসবে না!” বিচ্ছেদের জ্বালা এবার অন্তত আমাকে সইতে হবে না! বাবা- মায়ের ঠিক করা বিয়েতে এবার অন্তত আমাকে অযথা কষ্ট পেতে হবে না। পরিবারের কথাতেই তো আমি আবার সংসার জীবনে ফিরে এলাম। অতীত ভুলে নতুন এক্টা জীবনে পা বাড়ালাম।

ঢুকড়ে কাঁদছি আমি। হাঁটু গুজে উন্মাদের মতো চিৎকার করে কাঁদছি আমি। আমার ভুলটা কোথায় তাই আমার বোধগম্য হচ্ছে না। উনি হঠাৎ কেনো আমার থেকে ডিভোর্স চাইল? কেনোই বা আজ হঠাৎ আমার এতোটা কাছাকাছি এলো? তবে কি সবটাই নেশার ঘোরে? নাকি উনি যা চাইছে তাই ভুলবশত মুখ থেকে বের হয়ে গেছে? কিছুই বুঝতে পারছি না আমি কিছু না!

কিছুক্ষন হাউমাউ করে কেঁদে আমি বসা থেকে উঠে উনার পায়ের কাছে এসে দাঁড়ালাম। নিজেকে কোনো রকমে শান্তনা দিয়ে আমি স্থির হয়ে উনার দিকে এক ধ্যানে তাকিয়ে আছি। নাক টেনে ঘুমুচ্ছে উনি। তীব্র সৌন্দর্য্য উনার চোখে, মুখে ফুঁটে উঠেছে। গোলাপী ঠোঁট জোড়া কিছুক্ষন পর পর কেঁপে কেঁপে উঠছে। চোখের পাপঁড়ী গুলো জানালা দিয়ে আসা মৃদ্যু মন্দ বাতাসে নড়ে চড়ে উঠছে। সাথে পাল্লা দিয়ে উড়ছে জেল দিয়ে সেট করে রাখা সিল্কি চুল গুলো। শুভ্র মুখটা উনার নেশার ঘোরে লাল হয়ে আছে। নীল রঙ্গের ইন করা শার্টটা ঘামে ভিজে একাকার হয়ে আছে। অফিসের জুতো জুড়ো এখনো পায়েই রয়ে গেছে। চোখের জল গুলো মুছে আমি এক্টু ঝুঁকে উনার পা থেকে জুতো জুড়ো খুলে দিলাম। গায়ের শার্টটা চেইন্জ্ঞ করিয়ে ব্রাউন কালার টি শার্ট পড়িয়ে দিলাম। আরাম পেয়ে উনি নড়েচড়ে আরেক দফা শান্তির ঘুম দিলো।

প্রায় অনেকক্ষন উনার মুখটার দিকে তাকিয়ে থেকে আমি চোখে জল নিয়ে এক দৌঁড়ে ব্যালকনীতে চলে এলাম। ব্যালকনীর গ্রীল ধরে রাতের নিস্তব্ধ আকাশে এক ধ্যানে তাকিয়ে আছি। চোখ থেকে অজান্তেই শ্রাবনের বর্ষণ হচ্ছে। বর্ষণ শুধু আজ আমার চোখে না আকাশে ও হচ্ছে। ঝিরিঝিরি বৃষ্টি হচ্ছে আকাশের ঐ নীল সীমান্তে। চাঁদ, তাঁরা সবাই আজ মুখ লুকিয়ে আছে। আকাশের দিকে তাকিয়ে অন্য এক “আকাশকে” মন থেকে খুব মিস করছি। যাকে আমি অনেক গুলো বছর আগেই হারিয়ে ফেলেছি। আমি যাকেই আঁকড়ে ধরতে চাই সেই আমাকে কয়েক কদম পিছনে ফেলে কোথাও এক্টা হারিয়ে যায়।

এর মাঝেই রাস্তার ওপাশ থেকে কেউ আকাশ বলে চিৎকার করে উঠল। আওয়াজটা আমার কানে এসে বার বার প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। বুকটা ধড়ফড় করে কেঁপে উঠছে আমার। সে নেই জেনে ও আমার খুব কৌতুহল হচ্ছে। একবার ঐ আকাশ নামের লোকটাকে দেখতে খুব ইচ্ছে করছে। গত দুই বছর ধরে আমি এটাই করে আসছি। কারো মুখে আকাশ নামটা শুনলেই সেই আকাশকে দেখার জন্য আমি মরিয়া হয়ে উঠি। এখনো আমি সেই হারিয়ে যাওয়া আকাশকে খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা করি।!

ঘড়িতে রাত প্রায় ১২ টা বাজছে৷ রাস্তায় লোকজনের আনাগোনা নেই বললেই চলে৷ সকল প্রতিবন্ধকতা উপেক্ষা করে আমি উন্মাদের মতো দৌঁড়ে ব্যালকনী থেকে বের হয়ে সদর দরজা পাড় হয়ে রাস্তায় চলে এলাম। ঝিরিঝিরি বৃষ্টি এখন ঝুম বৃষ্টিতে পরিণত হয়েছে। ভেজা শাড়ি নিয়ে দৌঁড়ে চলছি আমি রাস্তার পাশ ধরে। ছেলেটা এখনো আকাশ আকাশ বলে চেঁচাচ্ছে৷ ছেলেটা ও বৃষ্টিতে ভিজে গেছে। পিছন থেকে চিৎকার করা ছেলেটাকে আমি দেখতে পারছি৷ রাস্তা ঘাট নির্জন হয়ে আছে। সমস্ত দোকান পাট ও বন্ধ। মনের মাঝে বিন্দু পরিমান ভয় ও বাঁসা বাঁধছে না। আমি দৌঁড়ে গিয়ে যেই না ঐ ছেলেটার মুখোমুখি দাঁড়াবো অমনি আরেকটা ছেলে এসে ঐ ছেলেটার কাঁধে হাত রেখে বলল,,,,

—“কিরে এভাবে ডাকছিস কেনো? কি হয়েছে?”

মুহূর্তের মধ্যেই আমার সব ধারণা পাল্টে গেলো। বুঝতে আর দেরি হলো না এই ছেলেটাই আকাশ। আর এই আকাশের সাথে আমার হারিয়ে যাওয়া আকাশের কোনো মিল নেই। প্রতিবারের মতো এবার ও আমি ব্যর্থ হলাম। আবারো খুব বড় এক্টা ধাক্কা খেলাম। তাদের দুজনের মাঝখান থেকে সরে এলাম আমি। চোখের জল মুছে আমি ধীর পায়ে হেঁটে সোজা বাড়ি চলে এলাম। ভেজা শাড়ি নিয়ে ব্যালকনীতে এসে দাঁড়ালাম। ব্যালকনীর গ্রীল ধরে আমি বেড রুমের দিকে মুখ করে দাঁড়ালাম। হিমুর ঘুমন্ত মুখটা চোখে পড়ার সাথে সাথেই আমার হঠাৎ খিঁচুনী শুরু হলো। নাক, মুখ দিয়ে সাদা ফেনা বের হতে শুরু হলো। বুকটায় খুব কষ্ট হচ্ছিলো। চোখ জোড়া লাল হয়ে প্রচন্ড জ্বলছে। মনে হচ্ছে এক্ষনি জান টা বের হয়ে যাবে। শাড়ির আঁচলটা আঁকড়ে ধরে আমি মুহূর্তের মধ্যেই ফ্লোরে লুটিয়ে পড়লাম। চোখ বুজার আগ পর্যন্ত আমি কেবল হিমুর মায়াবী মুখটার তাকিয়েই সব কষ্ট সহ্য করে নিচ্ছিলাম। তবে শেষ রক্ষে আর হলো না। চোখের সামনে আকাশ চলে এলো। এবার চোখ জোড়া বুজেই নিলাম। আকাশকে দু চোখ ভরে দেখার সামর্থ্য আমার নাই।

এই মুহূর্তে আমি মরে গেলে ও হয়তো হিমু টের পাবে না! কারণ, “সে শুধুই আমার প্রয়োজন, প্রিয়জন না!”

#চলবে????