তুমি আমার পর্ব-০১

0
853

#তুমি_আমার🍁
#সূচনা_পর্ব
#লেখনীতে_নাজিফা_সিরাত

ভরা ক্লাস রুমে মাথানিচু করে কান ধরে দাঁড়িয়ে আছে সিরাত । আর ক্লাসের সকলে ইতিমধ্যে মুখ চেপে হাসির সাগরে ভাসছে।অন্যদিকে ছলছল চোখে ক্লাসের নতুন টিচারের দিকে তাকালো সে,যদি এই নিরীহ প্রাণীটির মুখ দেখে মন গলে তাঁর। কিন্তু টিচার সেদিকে পাওা না দিয়ে মনযোগ সহকারে ক্লাস নিচ্ছেন।প্রায় পাঁচ মিনিট পর মুখ কাচুমাচু করে অসহায় কন্ঠে সিরাত বললো…..

-‘আর কতক্ষণ এভাবে দাঁড়িয়ে থাকবো স্যার’?

প্রতিওোরে ভাবলেশহীনভাবে উওর দিল আবেশ….

-‘যতক্ষণ না পর্যন্ত ক্লাস শেষ হচ্ছে ঠিক ততক্ষণ’।

-‘সরি স্যার আজকের মতো মাফ করে দিন আর কখনও ক্লাসে লেইট করবো না।একদম ক্লাস শুরুর আধ ঘণ্টা আগে চলে আসবো’।

-‘সেটা কাল থেকে এমনিই করতে হবে।কারণ নইলে ক্লাসে লেইট করে আসার অপরাধে আজকের থেকেও ভয়ানক শাস্তি পাবে’।

আবেশের কথা শুনে মুখ অটোমেটিক্যালি হা হয়ে গেলো ওর।ডানে বামে তাকিয়ে চোখ গরম করে তাকালো বন্ধু মহলের প্রতি।কারণ ওদের জন্যই আজ ওর এই দূর অবস্থা।সকলের মুখেই অসহায়ত্ব ফুটে উঠেছে।এ যাএায় আবেশের হাত কেউ বাঁচাতে পারবে না এটা ওদের মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে।হতাশ হয়ে মাটির মধ্যে চোখ নিবদ্ধ করে তাকিয়ে রইলো সিরাত।অনেকটা সাহস নিয়ে হাত কচলাতে কচলাতে আবেশের বোন আরোহী অনুনয়ের সুরে বলেই ফেলল…

-‘স্যার আপনার তো দয়ার শরীর আজ কলেজে আপনার প্রথম দিনও।সেই সুবাধে আজকের মত ওকে ছেড়ে দিন’।

কথাটা শেষ হতেই আবেশের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি পরলো আরোহীর উপর।সাথে সাথে চোখ নামিয়ে মিইয়ে গেলো সে।রুক্ষ কন্ঠে আরোহীর কানের সামনে দাঁত চেপে বললো….

-‘তোমাকে কারো চামচামি করার জন্য কলেজে পাঠানো হয়নি।নিজের কাজ কর।আরেকবার ওর হয়ে কেউ সাফাই গাইলে তোমাদেরকেও ওখানে ওর পাশে থাকতে হবে’।

ভাইয়ের কথায় খুব রাগ হল আরোহীর।এরকম করছে কেন?সবকিছুতেই ভাইয়ের বাড়াবাড়ি।ঠোঁট নাড়িয়ে আরও কিছু বলার আগেই তাঁরও অবস্থান হলো সিরাতের পাশে।আবেশের এহেন আচরণে হচকালো থমকালো সিরাত।ওর জন্য নিজের বোনকেও ছাড়লো না।এটা ওর ভাই নাকি কোনো দৈত্য দানব।ওদের দুজনের এই অবস্থা দেখে আয়ান,মিনার,আয়েশা আর রিয়া একসাথে বলল….

-‘স্যার এবার ওদের ছেড়ে দিন’।

কথাটা বলতে দেরি হল কিন্তু সিরাতের পাশে স্থান পেতে সময় নিল না।এবারে সকলের মুখে বিশ্বজয়ের হাসি।তাঁরা যেটা চেয়েছে সেটা করতে পেরেছে।তাঁদের দোষে বান্ধবী একা শাস্তি পাবে এটা হয় না।তাই সবাই মিলে ওর শাস্তি ভাগাভাগি করে নিল।একে অন্যকে আড়চোখে দেখছে আর মুচকি হাসছে।বিষটা নজর এড়ায়নি আবেশের।ওরা ওকে হেনস্তা করার জন্য এরকম করেছে সেটা বুঝতে বেগ পেতে হয়নি তাঁর।সবাইকে কান ধরা অবস্থায় দেখে এবার কিছুটা অস্বস্তি কমেছে সিরাতের।সবার একসাথে শাস্তি পাওয়ার মজাই আলাদা।এজন্যই বন্ধুমহলকে এত ভালোবাসে সে।

প্রায় আধ ঘন্টা আগে ক্লাস শেষ হয়ে গেছে সিরাতের।ইতিমধ্যে বাড়ীর উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিবে সবাই।সিরাত হেঁটে যেতে পারবে না।পা ব্যাথা করছে তাই সবাই রিকশার জন্য অপেক্ষা করছে।সিরাত গাল ফুলিয়ে মুখ কালো করে আছে।কারো সাথে কথা বলছে না।ওদের জন্যই এতটা অপমানিত হতে হলো।আজ আরুর বার্থডে তাই ওট কাছ থেকে সবকয়টা ট্রিট স্বরূপ ঝাল মুড়ি আনতে বাইরে গিয়ে ওকে অপেক্ষা করতে বলে ক্লাসে চলে গেছে।আর সে ওদের অপেক্ষায় পথ চেয়ে বসে ছিলো।ক্লাসে লেইট হচ্ছে বুঝতে পেরে ক্লাসে আসতেই সকলকে দেখে চমকালো সে।আরোহী আর আয়ান বললো….

-‘সরি দোস্ত রাগ করিস না।আমরা ইচ্ছে করে করিনি।জাস্ট হয়ে গেছে।আমাদের এদিকে আসতে দেখে ভাইয়া জোর করে ক্লাসে ঢুকিয়ে দিল’।

-‘থাক আর কারো কিছু বলতে হবে না।আগে বল তোর ভাই কবে বাসায় ফিরল আর আমাদের কলেজে জব নিয়েছেন সেটা আমার কাছ থেকে লুকালি কেন?’

-‘আরে গাধী আমি কিছু জানলে না তোদের বলব।গতকাল হঠাৎ ভাইয়া এসে হাজির।শুধু এটুকুই বলেছে একটা জবের এপ্লাই করেছিল আর সিলেক্টও হয়ে গেছে।পরশু জানিয়েছে তাই তাড়াহুড়া করে এসেছে ব্যস এইটুকুই।আর সকালে শুধু বলেছিলো আজকে আমার জন্য সারপ্রাইজ আছে।কিন্তু এই সারপ্রাইজ টা যে এটা আমি ভাবতেই পারিনি’।

-ভ্রু নাচিয়ে ‘সত্যি বলছিস’?

-‘আরে হ্যা রে বাবা সত্যি বলছি’।

-‘যাই বলিস না কেন তোর ভাই সাংঘাতিক একটা চিজ। এইটুকুর জন্য আমার সাথে এমনটা করতে পারল।দেখে মনেই হয়নি আমি তোর বেষ্টফ্রেন্ড বা তাঁর বেষ্টফ্রেন্ডের বোন।এইজন্যই বলে ঘরের শত্রু বিভীষণ।শালা উজবুক কি ভাবটাই না করল যেন আমাকে চিনেই না’।

তাঁদের কথার মাঝেই একটা ভরাট পুরুষালী কণ্ঠস্বর শুনে থেমে গেল সবাই।মুখ থমথমে হয়ে গেল।সিরাত চোরের মতো মুখ করে এদিক ওদিক তাকাচ্ছে।যেন সে কিছুই করে নি।সামনে দাঁড়িয়ে আছে আবেশ।ছেলেটাকে বরাবরই ভালো লাগে সিরাতের।এতক্ষণ খেয়াল করেনি এখন ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করছে গায়ের রঙ ফর্সা আর সুঠাম দেহের অধিকারী।আগের থেকে এখন আটেকটু ফর্সা হয়েছে। সাদা শার্ট আর কালো প্যান্ট পরেছে।।শার্টের হাতা ফোল্ড করা।হাতে কালো বেল্টের ঘড়ি।সিল্কি চুলগুলো বাতাসের তালে তালে হেলে দুলে পরছে।দেখতে হিরোদের থেকে কম নয়।বেশ লাগছে।ওর ভাবনায় ছেদ পরলো আবেশের কথা শোনে….

-‘লিসেন মিস সিদরাতুল সিরাত এখানে না আমি আপনাকে চিনি আর না ত আপনি আমাকে চিনেন।এখানে সবার একটাই পরিচয় সবাই আমার স্টুডেন্ট এর বাইরে বোন,বোনের বেস্টু,সিয়ামের বোন এগুলো ম্যাটার করে না।তাই সিয়ামের বন্ধু বা আরুর ভাই হিসাবে আমার কাছ থেকে বাড়তি এডভান্টেজ পাওয়ার আশা ছেড়ে দিন।আপনারা ভালো ত আমিও ভালো আপনারা ত্যাড়া ত আমিও ত্যাড়া।আশা করি সবাই বুঝতে পেরেছ’।

মাথা ঝাঁকিয়ে সবাই সায় জানালো।আমি উনার অগোচরে একটা ভেংচি কেটে দিলাম অনেক কিছু বলে ঝারতে ইচ্ছে করছে কিন্তু কিছু বলার মুখ নেই বললে ভাইয়ার কান অবধি কথাটা পৌঁছাতে দু-সেকেন্ড সময় লাগবে না।তারচেয়ে থাক বাবা প্রয়োজন নেই।ইতিমধ্যে যে যার বাড়ীর পথে হাঁটা দিয়েছে।শুধু আরু আর সিরাতই দাঁড়িয়ে আছে।আবেশ আরোহীকে উদ্দেশ্য করে বলল….

-‘আরু এখানে সঙের মত দাড়িয়ে কি করছিস? চল বাড়ী যাওয়া যাক।এখানে বসে অযথা হইচই ফালাফালি লাফালাফি করে লাভ নাই’।

-‘এই ত ভাইয়া যাচ্ছি।আসলে সিরাতের পা ব্যাথা করছে। রিকশাও পাচ্ছে না।ওকে যদি আমাদের সাথে নিয়ে যাই’।

-‘এই শুরু হলো আরেক প্যানপ্যানানি।মেয়ে মানেই উটকু ঝামেলা।তোকে বলাটাই আমার দোষ হয়েছে।এখন আরেকটা দলে টানছিস।ও যেভাবে পারবে সেভাবে যাবে।ওর চিন্তা তোকে করতে হবে না’।

আবেশের কথা শুনে চোখ দুটো আপনাআপনি ভিজে গেলো ওর।আগে কত আগলে রাখতেন।খেয়াল রাখতেন হয়তো উনার বেস্ট ফ্রেন্ড সিয়াম ভাইয়ার বোন সেই সুবাধে।কিন্তু আমি তো সেটা ভাবিনি।আমি ত সেই কিশোরী বয়স থেকে এখনও ভালোবাসি উনাকে।হ্যাঁ উনার অবর্তমানে অন্য একজন এসেছে কিন্তু তবুও উনাকে ভুলতে পারিনি।উনার সবকিছুতে মুগ্ধ আমি।তবে এবার কেন বদলে গেলেন উনি।আগের সেই চিরচেনা আবেশ ভাইয়াকে কেন চিনতে পারছি না।কেন প্রথম দেখাতেই এত রুক্ষ আচরণ।ঠোঁট চেপে কান্না আটকাতে ব্যস্ত আমি আরু গুতো দিয়ে বলল….।

-‘কিরে চল ভাইয়া আমাদের লিফট দেবে।তোকে নামিয়ে আমরা বাড়ী যাব’।

আবেশ ভাইয়ার উপর বর্তমানে এক বস্তা সমপরিমাণ অভিমান জমেছে আমার।যদিও জানি তাঁর কাছে এই অভিমানের কোনো মূল্য নেই তবুও মনকে বোঝাতে পারলাম না।কর্কশ কন্ঠে বললাম….

-‘তুই চলে যা।আমি কারোর থেকে লিফট চাচ্ছি না।আমি ঠিক রিকশা পেয়ে যাবো।নইলে পায়ে হেঁটে বাসায় যাব’।

-‘সিরাত কেন এমন করছিস চল না।এই ভ্যাপসা গরমে অতীষ্ঠ হয়ে গেছি আর কিছুক্ষণ থাকলে মাথা ঘুরা শুরু করবে।সন্ধ্যায় পার্টিতে যাবি দেরি হচ্ছে জেদ করিস না চল’।

-‘কি বলেছি কানে যাচ্ছে না।আমি যাব না।তোর দাঁড়িয়ে থাকতে ইচ্ছে হলে থাক নইলে ফুট’।

আড়চোখে আবেশ ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে দেখলাম সে বিরক্তিকর চাহনী দিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে।আমি সেদিকে আর তাকালাম না।আরু এখনও দাঁড়িয়ে আছে সরছে না।ইচ্ছে করছে মেয়েটাকে ল্যাং মেরে ফেলে দিতে।শাঁকচুন্নি তোর জন্য লোকটার কাছে কথা শুনতে হল আমায়।লোকটা দাঁত চিবিয়ে বলল….

-‘আরু আজ তোর বার্থডে এটা মাথায় রাখিস।আমাকে এমন কিছু করতে বাধ্য করিস না যাতে তোর আজকের দিনটার সব আনন্দ মাটি হয়ে যায়।এই ঘ্যাড়ত্যাড়া হাফ মেন্টাল মেয়েটার জন্য আমাদের লেইট হচ্ছে।বাসায় অনেক কাজ পরে আছে।সো হারি আপ’!

ব্যস হয়ে গেলো! আকাশসম রাগ হলো লোকটার উপর।কি বলল আমি পাগল।

-‘এক্সুউজমি!আপনি কাকে মেন্টাল বললেন’?

-‘এই প্রশ্নই প্রমান করে তুমি কি’ বলেই হুড়মুড় করে গাড়িতে বসল সে।আরু আমার দিকে অসহায় ফেস করে তাকিয়ে ধীর পায়ে গাড়িতে উঠে বসলো। সাথে সাথে হুস করে কয়েক সেকেন্ডে গাড়িটি চলে গেলো বহুদূর।আমি থমকে গেলাম একই জায়গাতে।সত্যি আমাকে ফেলে চলে গেলেন নাকি এটা আমার ভ্রম।কিছুক্ষণ পর ভাইয়া এসে বাসায় নিলে গেল আমায়।

আরুর বার্থডে পার্টিতে এসেছি ঘন্টা খানেক আগে।যদিও এখানে আসার বিন্দু পরিমান ইচ্ছা ছিল না।কিন্তু আরু আর বাকী সবাই মিলে বার বার কল করে আমাকে পাগল বানিয়ে দিচ্ছিল।উপায় না পেয়ে ফোন সুইচ অফ করেও রেহাই মিলে নি।ভাইয়াকে কল করে ম্যানেজ করেছে আরু।আবেশ ভাইয়াও বার কয়েক ফোন করে ভাইয়াকে যেতে বলেছেন।অগত্য আসতে হল আমায়।কিন্তু এখন আনেশ ভাইয়াকে দেখিনি।না দেখা হলেই ভালো।এখন হাসি আনন্দ আড্ডায় মেতে উঠেছে পুরো খান বাড়ী।কেক কাটার আগ মূহুর্ত পর্যন্ত সবকিছু ঠিকঠাক চলছিলো।কিন্তু হঠাৎ আয়ান একগাদা কেক এনে আমার পুরো মুখে লেপ্টে দেয়।তখন ওর পিছু নিয়ে পাল্টা দাওয়া করি কিন্তু মাঝ পথে বাঁধে বিপওি।কোনোকিছুর সাথে পা বেঁধে হুমড়ি খেয়ে পড়ে যেতে গিয়েও কারো সাথে লেগে আটকে যাই।নিজেকে সামলে উঠার আগেই এমন কিছু ঘটে যার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না আমি।চোখ থেকে নিমিষেই গড়িয়ে পরতে লাগল কয়েক ফোঁটা নোনাজল।রাগে লজ্জা মিশ্রিত অনুভূতির সমীকরণে এখন মরে যেতে ইচ্ছে করছে আমার।আচ্ছা এর থেকে মৃত্যুই ভালো সলিউশন নয় তো।
.
.
.
চলবে।