#তুমি_আমার
#পর্ব_১৭
#লেখনীতে_নাজিফা_সিরাত
আবেশের রুমে দাঁড়িয়ে আছে সিরাত।আবেশ পাশ ফিরে শুয়ে আছে।কফির কাপ পাশের সেন্টার টেবিলে রেখে ওর দিকে উঁকিঝুঁকি মারলো সিরাত।না কোনো সাড়াশব্দ নেই হয়তো ঘুমিয়ে গেছে এখন ডাকা উচিৎ হবে না।শব্দহীন পায়ে হেঁটে চলেছে সে।জেগে নেই বলে মনে মনে বেজায় খুশী।কারণ এখন তার সামনে আসতেও লজ্জা লাগে ওর।রুম থেকে চলে যেতে উদ্যত হতেই সামনে এসে দাঁড়ায় আবেশ।ফলাফল ওর সাথে ধাক্কা লেগে যায়।সিরাত চমকে উঠে সামনে আবেশকে দেখে।বিছানায় চোখ বুলিয়ে অবাকের চরম পর্যায়ে পৌঁছায় সে।না এটা সত্যি আবেশ।মুখে লেগে আছে দুষ্টু হাসি।আবেশ বলে,
“এভাবে চোরের মতো হাঁটছো কেন?কফি যখন এনেছোই তাহলে না বলে চলে যাচ্ছ কেন”?
“আপনি তো ঘুমাচ্ছিলেন তাই ডিস্টার্ব করিনি”।আমতা আমতা করে প্রতুক্তি করলো সিরাত।আবেশ বিছানা হাতরে ফোন হাতে নিয়ে ঝটপট কাউকে কল করলো বাট রিসিভ হলো না।সিরাত দাঁড়িয়ো দাঁড়িয়ে কান্ড কারখানা দেখে চলেছে তাঁর।ফোনটা বিছানায় ফেলে বললো,
“বসো কিছু কথা আছে”।ব্যস জমে গেলো সিরাত।এজন্যই এখন লোকটার সামনাসামনি আসতে ভয় লাগে তাঁর।কখন কি করে ঠিক নেই।সিরাতের বক্ষস্থলে ঢিপঢিপ শব্দ বেড়েই চলেছে।এখানে দাঁড়িয়ে থাকতে একটাই ভয় যদি ওর প্রতি ফিলিংস গুলো কোনোভাবে বেরিয়ে আসে তখন।কফির কাপে চুমুক দিতে দিতে বললো,
“বাই দ্যা ওয়ে এক্সাম কেমন হলো”?সিরাত সহসা জবাব দিল,”ভালো”
“শুধু ভালো?হায়েস্ট মার্কস থাকবে নাকি সেকেন্ড কোনটা “কপাল কুঁচকে প্রশ্ন করলো।”এটা বলা টাফ।হয়তো থাকবে নয়তো না”
“তোমার নিজের উপর বিশ্বাস নেই”?মনে মনে আওরালো সিরাত বিশ্বাস তো আছেই কিন্তু বলতে চাইছি না।যদি পরে না এত মার্কস না পাই তখন।”আচ্ছা আমি আসি”।সিরাত চলে যেতে চাইলেই এক হাত টান দিয়ে নিজের উপর ফেললো।আচমকা তাল সামলাতাম না পেরে আবেশের বুকে এসে বারি খেলো সে।নিজেকে সামলে আস্তে করে মুখ তুলে বললো,”এটা কি হলো যেতে দিন আমায়”।
“উহু! যেতে দেবো না।আমি এখন ঘুমাবো আর তুমি মাথায় হাত বুলিয়ে দেবে।”চোখ বড় বড় তাকাল সিরাত।এই ছেলে বলে কি।বাইরে এত লোকজন রেখে আমি এখন উনার মাথা টিপবো ইম্পসিবল।আবেশ গিয়ে দরজা লক করে এলো।সিরাত উওেজিত হয়ে বললো,
” দরজা লক করছেন কেন?প্লিজ আমাকে যেতে দিন”
” নো ডিয়ার!বিয়ের এক মাস পেরিয়ে গেলো এখন বউয়ের পাশে ঘুমাতে পারলাম না।একসাথে না পারলাম খেতে আর না পেলাম তার কোনো সেবা শুশ্রূষা।এখন আমার তোমার সেবা পেতে ইচ্ছে করছে।”
” বাইরের লোকজন কি ভাববে।আঙ্কেল আন্টিও আছেন ড্রয়িংরুমে”।
” তাতে কি!তুমি আমার স্ত্রী।কেউ খারাপ ভাববে না”।হাত ধরে টেনে বিছানায় বসিয়ে ওর কোলে শুয়ে পরলো আবেশ।বরফের ন্যায় জমে গেলো সিরাত।পর স্পর্শে পুরো শরীর কেঁপে উঠলো।তখনই ফোন বেজে উঠলো ফোন হাতে নিয়ে লাউডে দিলো আবেশ বললো,
“থ্যাংকস ভাবী এই অবেলায় বউকে পাঠানোর জন্য।শুনো পাঠিয়েই যখন দিয়েছো তখন আর ওর আশা করো না।আমি এক ঘন্টা ঘুমাবো কেউ ডিস্টার্ব করো না।মানে ওকে কেউ খুঁজো না”।
“এক ঘণ্টা না দশ ঘন্টা ঘুমাও কেউ ডিস্টার্ব করতে যাচ্ছে না।তোমার বউ নিয়ে তুমি ঘুমাবে এতে কে কি বলবে।ইনজয় দিস মোমেন্ট টাটা”!হাসতে হাসতে কেটে দিলেন তিনি।এবার লজ্জায় মাটির নিচে ঢুকে যেতে ইচ্ছে করছে ওর।এই রুম থেকে বেরিয়ে সবাইকে মুখ দেখাবে কি করে ভেবে কুল কিনারা পাচ্ছে না।আবেশ ওর হাত টেনে ধরে বললো,
“প্লিজ খুব মাথা ধরেছে একটু ম্যাসেজ করে দাও”।এই নরম বিনয়ী সুর শুনে কিছু বললো না সে।মাথায় বুলাতে লাগলো।আবেশ চোখ বন্ধ করে নিলো।চোখ বন্ধ অবস্থায় বললো,
“আমি না উঠা পর্যন্ত এখানেই থাকবে।চোখ খুলে যেন তোমাকে দেখতে পাই”।
ড্রয়িংরুমে বসে আছে সিরাত।ইতিমধ্যে তিথি আর রাদিফও চলে এসেছে।এখানেই আড্ডা দিচ্ছে সে।আবেশ ঘুমিয়ে পরার কিছুক্ষণ পর সেখান চলে এসেছে সে।রুম থেকে বেরুতেই আরু আর ভাবী মিলে লেকফুলে মেতেছিলো।সিরাত লজ্জায় শুধু মাথা নিচু করেই ছিলো।আজকের দিনটা অসম্ভব ভালো সিরাতের।ভালোবাসার মানুষটার এতটা কাছাকাছি আসার সোভাগ্য আগে কোনোদিন হয়নি তার।আচ্ছা আবেশ কি তাকে ভালোবাসে।নাকি শুধু ওয়াইফ বলে ঘাড় থেকে নামাতে পারছে না বলে ইজি হতে চাইছে।
রাদিফ এখানে সিরাতকে দেখে বেশ চমকে গেছে।সকলে একসাথে বসে আড্ডায় মশগুল।তিথি বললো,
“আবেশ কোথায়”?আরু বললো,”ভাইয়া ঘুমাচ্ছে”।ছোট করে ‘অহ’ বললো সে।আরুর রাদিফকে দেখে একটি কথা মনে পরে গেলো।ভালোভাবে তাঁকে পর্যবেক্ষণ করে নিলো সে।এবার হিসেব মিলাতে হবে তাকে।
রাদিফ আর সিরাত দাঁড়িয়ে আছে ছাদের কিনারে।মূলত রাদিফ এখানে নিয়ে এসেছে তাকে।অনেক কিছু বলার আছে তার সিরাতকে।আজ এগুলো বলতেই হবে নইলে শান্তি পাবে না সে।কিছুতেই পাবে না।দুজনে দাঁড়িয়ে গল্প করছে আর হাসাহাসি করছে আর একজন রাগে ফুস ফুস করছে।দুজনে গল্প করে অনেক্ষণ পর নেমে এলো নিচে কিন্তু কিছুই বলতে পারলো না রাদিফ।আবারও ব্যর্থ সে।ফুস করে একটি শ্বাস ছাড়লো।ড্রয়িংরুমে এসে আবেশকে দেখে মনে মনে খুশি হলো সিরাত।কিন্তু আবেশ তাতে কোনো প্রতিক্রিয়া দেখালো না।গম্ভীর মুখে বসে রইলো।সিরাত বারবার ওর দিকে তাকালেও সে একবারও ফিরেও তাকালো না।
রাত এগারোটা ছুঁইছুঁই।গাড়িতে বসে আছে আবেশ।চারিদিকে অন্ধকার।আকাশে তালার মতো একটি চাঁদ উঠেছে।আর চারিপাশে জ্বলছে কয়েকটি তারা।কোনো প্রেমিক যুগলের কাছে সময়টা নিঃসন্দেহে সুন্দর,মোহনীয় আর স্মরণীয়।রাদিফ আর তিথি চলে গেছে খানিকক্ষণ আগে।সিরাতকে যাওয়ার জন্য জোর করেছে কিন্তু মিঃ খান ছাড়েন নি তাঁকে।তার এক কথা আবেশ পৌছে দেবে তাকে।কারণ এই বাহানায় দুজনে একটু স্পেস পাবে।যদি সবকিছু ঠিকঠাক হয় সেই আশায় আছেন তিনি।সকলের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে সিরাত এসে বসলো গাড়িতে।কোনোকথা না বলে গাড়ি স্টার্ট দিল আবেশ।আবেশের গম্ভীরভাব দেখে ভিতরে মোচড় দিয়ে উঠলো সিরাতের।নীরবতায় কাটছে তাঁদের।সিরাত এবার মুখ খুলে বললো,
“তখনকার জন্য কি আপনি রেগে আছেন?”আবেশ তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বললো,
” রাগ করবো কেন?আমি জানি আমি ছাড়া তোমার আরো অনেক কে সময় দিতে হয়।তাদের থেকে এখনও আমি ইম্পরট্যান্ট হতে পারিনি।মেনে নিয়েছি।তুমি তোমার খুশি ইচ্ছে মতো থাকো আমি ইন্টারফেয়ার করবো না”।সিরাতকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে বললো,
“নামো চলে এসেছো নিজ গন্তব্যে”।সিরাত আবারও কিছু বলতে উদ্যত হতেই চিৎকার করে দাঁত চিবিয়ে বললো,”নামতে বলেছি নামো।কোনোকথা শুনতে চাইছি না”।সিরাত সাথে সাথে নেমে পরলো।মুহূর্তেই চোখে অশ্রুকণা ভীড় করলো তাঁর।ছলছল চোখে তাকালো আবেশের দিকে।আবেশ গাড়ি স্টার্ট দিয়ে চলে গেলো।যাওয়ার আগে বলে গেলো।
“আগলে রাখতে চেয়েছিলাম কিন্তু উড়তে চাইছো,উড়ো”। চোখের আড়াল হতেই চোখ থেকে অঝর ধারায় পানি গড়িয়ে পরতে লাগলো।সামান্য একটি কথা শোনেনি বলে এত রাগ।এভাবে ধমকালেন অপমান করে নামিয়ে দিলেন।আর শেষের কথাটার মানে কি!
সিয়ামের সামনে বসে আছে আবেশ।সিয়াম যতই সকলের সামনে নিজেকে স্ট্রং প্রমাণ করার চেষ্টা করুক না কেন।আবেশ তো জানে ভিতরে ভিতরে দুমড়ে মুচড়ে শেষ হয়ে যাচ্ছে সে।সিয়াম হাস্যজ্জ্বল মুখে বললো,
“কিরে তোর খবর কি?আমার বোনটাকে কাঁদাচ্ছিস কেন?”আবেশ সে কথার জবাব না দিয়ে বললো,”তিহানা খুব ভালোবাসিস?”।বিপরীতে হাসলো সিয়াম।হেসে হেসে বললো,
“যা আমার নয় তার প্রতি ভালোবাসা প্রকাশ করে কি হবে।নিজেকে সামলে নিয়েছি তুই চিন্তা করিস না”।
-“সত্যি সামলে নিয়েছিস?কোথাও খারাপ লাগা নেই?”।
“নেই সেটা বলবো না।কারণ ও আমার ফার্স্ট লাভ ছিল।তবে সময়ের সাথে ঠিক ভুলে যাবো চিন্তা করিস না”।
“নতুন কাউকে বেচে নে।আগলে রাখার হাত খুঁজে নে।বিয়ে।সাদী করে সংসারী হ”।
“তুই নিজে বিবাহিত বলে আমাকেও ওই দলে টেনে দল ভারী করার চিন্তায় আছিস নাকি?ওসব চিন্তা করে লাভ নেই।আমি অত তাড়াতাড়ি এসবে নাম দিচ্ছি না।এবার বল সিরাতের সাথে কি হয়েছে।কেন আমার বোন সকলের অগোচরে কাঁদে।তোদের বাসা থেকে এসেছে থেকে দেখছি এই অবস্থা।কি হয়েছে তোদের?”।ফুস করে শ্বাস ছাড়লো আবেশ।
“সবার আগে তুই আমার বন্ধু।আমি জানি ভবিষ্যতে তাই থাকবি।সিরাত হয়তো এখনও আমাকে মন থেকে মেনে নিতে পারেনি।তাই ওর কাছে আমার চাওয়া পাওয়ার কোনো মূল্য নেই।তাছাড়া আরও অনেক কিছু যাগগে।তবে সেদিন পর সাথে রাগ করে কথা বলেছি ওর উপর চেঁচিয়েছি এসব করা ঠিক হয়নি।কিন্তু কি করবো বল আমিও তো মানুষ”।
আজ এক্সামের রেজাল্ট দেবে।আবেশ আজ পর্যন্ত কথা বলে নি সিরাতের সাথে।বারবার ইগনোর করে গেছে তাকে।ও কথা বলতে গেলেও এড়িয়ে গেছে।সবার সাথে খুব ভালো হাসিখুশী হয়ে কথা বলে শুধু সিরাতের বেলায় ইগনোর।এরইমধ্যে দুইবার রাদিফ কলেজ এসেছে সিরাতের সাথে দেখা করতে।কিছু বলতে গিয়ে পারে না।কারণ সবসময় ওর সাথে আরু থাকে তাই স্পেস পায় না।রেজাল্টের অপেক্ষায় বসে আছে সিরাত।যদি রেজাল্ট ভালো হয় তাহলে হয়তো কথা বলবে কিন্তু না তাও হলো না।হায়েস্ট মার্কস পাওয়া স্বও্বেও কোনোকথা বললো না সে।এবার আর সহ্য হচ্ছে না সিরাতের।আজ আবেশের সাথে কথা বলেই ছাড়বে।আবেশের রুমে গিয়ে দরজা খুলতেই পায়ের নিচের মাটি সরে গেলো সিরাতের।চোখ থেকে গড়িয়ে পরতে লাগলো নোনাজল।বিশ্বাস ভেঙ্গে যেন আজ টুকরো টুকরো হয়ে গেলো।সত্যি মানুষটা তার নয়।হাত পা অচল হয়ে এলো প্রায়।নড়ার শক্তি পেলো না স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো একই জায়গায়।
#চলবে