#তুমি_আমার_প্রেয়সী
#অন্তিম_পর্ব
#তাসনিম_জাহান_রিয়া
তোমাকে একদিন বলেছিলাম, তোমাকে ছাড়া আমি এক মুহূর্তও থাকতে পারি না। দম বন্ধ হয়ে আসে। তখন তুমি বলেছিলে, আমি মারা গেলে কী করবে? তখন আমি বলেছিলাম, যেদিন তুমি এই পৃথিবীতে থাকবে না সেদিন আমিও থাকব না। আমি তোমাকে ছাড়া এক মুহূর্তও বাঁচতে পারব না। সেদিন তুমি আলতো হেসে বলেছিলে, কেউ কারো জন্য মারা যায় না। এটা জাস্ট তার মনের কল্পনা। একদিন তুমিও আমাকে ছাড়া বাঁচতে শিখে যাবে। দেখো আমি তোমাকে ছাড়া বাঁচতে শিখে গেছি। কিন্তু আমি ভালো নেই। আমার দেহটাই আছে আমার আত্না তো তোমার সাথেই চলে গেছে। জ্যান্ত লাশ হয়ে বেঁচে আছি।
আভিয়ান তার কথাগুলো শেষ করার আগেই নোমান নিজের পায়ের জুতাটা খুলে আভিয়ানের দিকে ছুড়ে মারে। আভিয়ান সরে গিয়েছিল নাহলে নোমানের জুতাটা আভিয়ানের মুখে লাগত। আভিয়ান সরে যাওয়ায় জুতাটা গিয়ে বেলি ফুল গাছে লাগে।
শালা এতো ভালো এক্টিং কী করে করতে পারস? আমার তো মনে হচ্ছিল সত্যি সত্যি ঐশি ভাবি মারা গেছে। আর তুই দেবদাশ হয়ে গেছিস। আমি তো একটুর জন্য কেঁদে দেয়নি। তোর এই ফালতু এক্টিংয়ের জন্য আমার চোখের মূল্যবান অশ্রুগুলো নষ্ট হয়ে যেতে।
আভিয়ান আলতো হেসে নোমানের পিঠে একটা থাপ্পড় মারে। আদিয়াত কণার দিকে একবার আড়চোখে তাকিয়ে বলে,
বিয়ের আগে ছেলেরা বাঘের মতো থাকলেও। বিয়ের পরে কিছু ছেলেরা বউয়ের ভয়ে বিড়াল হয়ে যায়। বউয়ের সুরে গান গায়। সেটা নোমানের দ্বারা প্রমাণিত। নোমান বন্যার সুরে গান গায়।
সাফাত ও আদিয়াতের সাথে তাল মিলিয়ে বলে, একদম ঠিক বলছেন আদিয়াত ভাইয়া। নোমান আর আমি ১৪ বছর ধরে একসাথে আছি। কিন্তু নোমানকে আগে কখনো শালা, বাল বলতে শুনিনি। যদি কেউ স্ল্যাং ইউজ করতো তার সাথে ঝগড়া বাধিয়ে দিত। আর এখন কথায় কথায় স্ল্যাং ইউজ করে বন্যার মতো। আর ঐদিন জানেন কি হয়ছিল? আমি নোমানকে ফোন দিয়ে বললাম, আমি, আভিয়ান, তুই একসাথে অনেকদিন ধরে লং ড্রাইভে যায় না। চল আজকে তিনজন মিলে লং ড্রাইভে যায়। আমার আর আভিয়ানের কোনো অসুবিধা নেই। তুই রাজি হলেই হবে। তুই কী যাবি আমাদের সাথে। তখন নোমান বললো কেনো যাবো না অবশ্যই যাব। আমি আবার বললাম, বন্যা কিছু বলবে না তো। তখন নোমান ভাব নিয়ে বলে, কে বন্যা? আমি বন্যার কথা কেনো শুনব? আমি একজন এডাল্ট নিজের ডিসিশন নিজে নিতে পারি। ঐ পাগলির কথা আমার শুনতে বয়েই গেছে। বন্যা আমার কথায় ওঠে বসে। তখন বন্যা চিৎকার করে বলে, আজকে বাসা থেকে বের হও শুধু পা ভেঙে ঘাড়ে ঝুলিয়ে দিব। তারপরেই নোমান ভয়ে চুপসে যায়। মিনমিনিয়ে বলে, দোস্ত আমি লং ড্রাইভে যেতে পারব না। আমি ভুলে গিয়েছিলাম আমার পেট ব্যথা করছে। তোরা যা আজকে আমি অন্যদিন যাব।
কথাগুলো বলেই সাফাত হু হা করে হেসে দেয়। সাফাতের সাথে তাল মিলিয়ে বাকি সবাই হেসে দেয়। নোমান কাচুমাচু মুখ করে বসে আছে। আদিয়াত হাসি থামিয়ে বলে,
হেই বয়েস তোমরা ভুলে গেছো আমাদের কী প্লেন ছিল?
সব ছেলেরা একসাথে বলে, একদমই না।
কণা ভ্রু কুচকে বলে, তোমরা কোন প্লেনের কথা বলছো।
আদিয়াত এদিক ওদিক তাকিয়ে বলে, আজকে আমরা পাঁচ প্রেমিক পুরুষ তাদের প্রেয়সীকে নিয়ে লং ড্রাইভে যাব।
নওমি চিন্তিত হয়ে বলে, আমাদের বাচ্চারা কোথায় থাকবে?
সবাই সবার দাদা, দাদুর সাথে থাকবে।
আদিয়াত ঘড়ির দিকে তাকিয়ে সবাইকে তাড়া দিয়ে বলে, গাইস অলরেডি ১০ টা বেঁজে গেছে। এখানে বসে থেকে টাইম ওয়েস্ট করলে চলবে না। সবাই চলো তাড়াতাড়ি।
নোমান কাচুমাচু মুখ করে বলে, আমি আর বন্যা যাব না।
আদিয়াত ভ্রু কুচকে বলে, কেনো?
বন্যার এই অবস্থায় রাতের বেলা বাইরে যাওয়া একদম ঠিক না। আম্মু জানলে আমার অবস্থা খারাপ করে দিবে। আর আমিও কোনো রিস্ক নিতে চাই নাহ।
কিন্তু……..
আমি ব্যবস্থা করে ফেলছি তোরা যা।
নোমান আর বন্যাকে রেখেই বাকিরা বেরিয়ে যায়। আজকে সবার ৫ম বিবাহ বার্ষিকী। কণা আর আদিয়াতের দুইদিন বিবাহ বার্ষিকী উদযাপন করে। আর দুই ঘন্টা পর তাদের বিয়ে নামক পবিত্র সম্পর্কের পাঁচ বছর পুর্ণ হবে। তাই প্রেমিক পুরুষরা তাদের প্রেয়সীদের সারপ্রাইজ দিতে নিয়ে যাচ্ছে।
পাঁচ বছরে বদলে গেছে অনেক কিছু। সবার জীবনই পাল্টে গেছে। এখন তারা বাবা -মা হয়ে গেছে। তাদের দায়িত্ব অনেক বেড়ে গেছে। দুই বছর আগে নোমান আর বন্যার ধুমধাম করে বিয়ে হয়েছে। নোমান এখন একটা বড় কোম্পানিতে জব করে। বন্যা ৮ মাসের অন্তঃসত্ত্বা। জিয়ান আর নওমির সাড়ে তিন বছরের একটা ছেলে আছে। ছেলের নাম রেখেছে সাজিদ। অনেক চুপচাপ একটা ছেলে প্রয়োজন ছাড়া কারো সাথে বেশি একটা কথা বলে না। যা কথা বলে সব আরশির সাথে। আরশি হচ্ছে আভিয়ান আর ঐশির মেয়ে। বয়স তিন বছর। সাফাত আর অহির একটা মেয়ে হয়েছে। মেয়ের বয়স তিন বছর নাম সাবা। আরিয়ানের জ্বালায় অতিষ্ঠ সাবা। এটা
করবি না ওটা করবি না সাবা। ঐ ছেলের সাথে মিশবি না সাবা। তুই শুধু আমাকে আরিয়ান ভাইয়া বলে ডাকবি। অন্য কাউকে না। আরিয়ান হচ্ছে কণা আর আদিয়াতের ছেলে। বয়স ৪ বছর পুরো নাম আরিয়ান আয়মান। বয়স ৪ বছর হলে কী হবে এডিটিউট দেখে মনে হবে ১৮ বছরের যুবক। সুন্দরের দিক দিয়ে আদিয়াতকেও হার মানায়। আদিয়াতের চলা ফেরার স্টাইল, কথা বলার স্টাইল সব কপি করে আরিয়ান।
ঐ ঘটনার পর থেকে কণা ডিপরেশড হয়ে যায়। তাই আদিয়াত কণাকে নিয়ে লন্ডন চলে যায়। কিন্তু কণার কোনো পরিবর্তন হয় না। আদিয়াতের সাথে কথা বলে না। চুপচাপ থাকে। সারাদিন ঘরের এক কোণে পড়ে থাকে। আদিয়াত কী করবে কিছুই ভেবে পায় নাহ। এর মাঝে কণা জেদ ধরে তার বেবি চায়। কিন্তু আদিয়াত সাফ মানা করে দেয়। কণা রাগ করে খাওয়া দাওয়া ছেড়ে দেয়। আগে যাও একটু রুম থেকে বের হতে পরে তাও বের হয় না। আদিয়াত কণার জেদের কাছে হার মেনে নেয়। কণা যেদিন জানতে পারে সে প্র্যাগনেন্ট সেদিন তার সে কী আনন্দ। খুশিতে আদিয়াত আর কণা দুজনেই কেঁদে দিয়েছিল। কণা প্র্যাগনেন্ট হওয়ার পর থেকে আবার আগের মতো হয়ে যায়। কণা এরূপ পরিবর্তনে আদিয়াত ভীষণ খুশি হয়।কিন্তু তার মনের মাঝে একটা ভয় থেকেই যায় যদি বেবির জন্য কণার লাইফ রিস্ক হয়ে যায়। তার তো দুজনকেই চায়।
মাস খানেক পর মহুয়া জাহান আসে কণার সাথে দেখা করতে প্রথম কয়েকদিন উনার অনেক ভালোই কেটেছিল। কিন্তু যতদিন যেতে থাকে তত তিনি একাকীত্ব অনুভব করতে থাকেন। উনি বুঝতে পেরেছিলেন টাকা পয়সা জীবনে সবকিছু না। জীবনে বেঁচে থাকতে হলে আপনজনদের প্রয়োজন হয়। তাই তিনি কণার কাছে সত্যি সত্যি ক্ষমা চেয়ে সবকিছু ঠিক করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ততদিনে অনেক দেরি হয়ে যায়। কণা আর আদিয়াত লন্ডনে চলে যায়। বছর তিনেক পর ছোঁয়া সত্যি সত্যি ব্রেইন ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়। এবং দেড় মাসের মাঝেই মারা যায়। যে রোগ নিয়ে মিথ্যা বলেছিল সেই রোগে আক্রান্ত হয়েই মারা গেলো ছোঁয়া। হেলাল রহমানের ১৯ বছরের জেল হয়। হয়তো এ জীবনে আর জেলের ভিতর থেকে বের হয়ে বাইরের আলো বাতাস দেখতে পারবেন নাহ। পাঁচ বছর পর কণা, আদিয়াত আর আরিয়ান দেশে ফিরে আসে। সেই খবর শুনে মহুয়া জাহান কণার সাথে দেখা করতে আসে। কিন্তু আদিয়াত দেখা করতে দেয় না। আদিয়াত মহুয়া জাহানকে কিছু টাকা দিয়ে বিদায় করে দেয়। মহুয়া জাহানের কথাটা শোনার প্রয়োজনই মনে করে না। আদিয়াত ভাবে মহুয়া জাহান টাকার জন্য আবার কণার কাছে ক্ষমার চাওয়ার অভিনয় করতে এসেছে। আদিয়াত চায় না কোনো ভাবেই কণা এই মহিলার মুখোমুখি হোক। মহুয়া জাহান সত্যি সত্যি ক্ষমা চাইতে আসলেও সেই সুযোগ পেল না। সবাই সবার অন্যায়ের শাস্তি পেয়েছে।
আদিয়াত আর কণা ফিরে আসায় সবাই কণাদের বাসায় আসে। সবাই মিলে বাসার ছাদে আড্ডা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। ছাদে সবাই মাদুর পেতে ট্রুথ অর ডেয়ার খেলা শুরু করে। আভিয়ান ডেয়ার নেয়। অহি আভিয়ানকে ডেয়ার দেয় ইমোশনাল এক্টিং করতে। আভিয়ান সেটাই করে।
১০৬
নোমান বন্যার চোখে ধরে একটা রুমে আসে। রুমের মাঝখানে এনে বন্যার চোখ থেকে নিজের হাত সরিয়ে দেয়। রুমের চারদিকে তাকিয়ে বন্যা অবাক হয়ে যায়। রুমটা সুন্দর করে ডেকোরেশন করা। নোমান বন্যার কানের কাছে মুখ এনে বলে,
আমার সারপ্রাইজটা কেমন লাগল বাবুর আম্মু।
অনেক সুন্দর।
তুমি আমাদের বাসর রাত নষ্ট করে দিয়েছিলে ঘুমিয়ে। আজকে সেটার সুদ তুলবো প্রেয়সী।
জিয়ান নওমিকে তাদের গ্রামে নিয়ে গিয়ে সারপ্রাইজড দেয়। যেখানে তাদের প্রথম দেখা হয়েছিল। আভিয়ান ঐশিকে নিয়ে একটা রেস্টুরেন্ট যায়। যেটা আভিয়ান পুরোটা বুক করে রেখেছে। সাফাত অহিকে নিয়ে তাদের ফার্ম হাইজে যায়। যেখানে সে অহিকে তার মনের কথা বলেছিল।
১০৭
আদিয়াত কণাকে নিয়ে একটা নদীর পাড়ে আসে। আদিয়াত গাড়ি থেকে নেমে কণাকে গাড়ি থেকে নামিয়ে কালো কাপড় দিয়ে চোখ বেধে দেয়। কিছুটা পথ অতিক্রম করার পর আদিয়াত কণার চোখের ওপর থেকে কালো কাপড়টা সরিয়ে দেয়। কণা সামনে তাকিয়ে অবাক হয়ে যায়। কণার সামনে রাশি রাশি জোনাকি পোকা। যাদের আলোয় অন্ধকার জায়গাটাও আলোকিত হয়ে গেছে। কণা খুশিতে লাফিয়ে ওঠে। আদিয়াক কণার হাত ধরে নদীর সামনে দাঁড় করায়।
১
২
৩
আদিয়াক ৩ বলার সাথে সাথেই অন্ধকারা আকাশ আলোকিত হয় যায়। আকাশ জুড়ে বড় বড় করে লেখা হেপি এনিভার্সিটি মাই লাভ।
আদিয়াত কণার কানের লতিতে একটা কিস করে বলে, আমাদের দ্বিতীয় বিয়ে পাঁচ বছর পূর্ণ হলো। দুজন একসাথে পাঁচটা বছর কাটিয়ে দিলাম। কিন্তু আমাদের মাঝে ভালোবাসা একটুও কমেনি বরং বেড়েছে।
“ভালোবাস শব্দটা সবসময় নতুন, কখনোই তা মলিন হয় না, এর রং ধূসর নয় কিংবা বর্নহীনও নয়, যা আছে তা রংধনুর রঙে রাঙ্গানো। হোক না সেটা অনেক বিভেদ, তারপরেও ভালোবাসা শুধুই ভালোবাসা।
ভালোবাসি তোমায় প্রেয়সী।
এই প্রথম আদিয়াতের মুখে ভালোবাসি শব্দটা শুনে কণার সাড়া শরীরে শিহরণ ভয়ে গেলো। কানের কাছে একটা কথাই বার বার বাঁজছে ভালোবাসি তোমায় প্রেয়সী।
সমাপ্ত।💝