তুমি আমি দুজনে পর্ব-২২+২৩

0
437

#তুমি_আমি_দুজনে
#লেখিকা_হুমাইরা_হাসান
পর্ব- ২২

-তুমি এখানেও চলে এসেছ আমার পিছু পিছু!

আহানের কথার আগা মাথা না বুঝে টুনি এক হাত মুখের কাছে দিয়ে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে রইল।
আহান প্রচন্ডরকম বিরক্তি নিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলল

-কত বড় সাহসে তুমি এসেছ আমার পিছু। ঘরে থাকলে বালিশে এসে শুয়ে পরো আবার জগিং করতে এসেও পিছু নিয়েছ?

খানিক থেমে আবারও বলল

-তুমি আসলেই একটা আপদ,আমার মাথার উপর আপদ। আমার গলায় কি মাছ ঝুলানো আছে যে চুইংগামের মতো পিছু করা ধরেছ? যাও, তোমার মালিকের কাছে ফিরে যাও

কিন্ত কে বুঝে কার কথা,টুনি আগামাথা কিছু না বুঝেই ভীষণ নাদুস নুদুস চেহারা করে বলল ‘ম্যাও’
আহান আবারও কিছু বলতে গেলেও থেমে গেলো। এবার নিজেকেই পাগল মনে হচ্ছে, একটা আজাইরা বিড়ালের সাথে সে এতক্ষণ পকপক করছিল। বিড়াল কি আর মানুষের কথা বুঝে। সব দোষ ওই মেয়ের ওই মেয়েটা বিড়ালের সাথে পকপক করে এখন আহান ও তাই করেছে।
বিরক্তিতে চ জাতীয় শব্দ করে আবারও হাঁটা ধরল। টুনিও আহানের পিছু পিছু হাঁটছে। বেশ কিছুক্ষণ হাঁটার পর কি মনে হতে আহান পিছু ফিরে তাকাল। কিন্তু টুনিকে কোথাও পেলো নাহ। কোথায় গেল বিড়ালটা?এখনই তো পিছনেই ছিল। এদিক ওদিক চোখ ঘুরিয়ে তাকাল। কিন্তু কোথাও টুনিকে দেখতে পেল না। ভালো হয়েছে, আপদ টা পিছু ছেড়েছে। ভেবেই আবারও হাঁটা শুরু করতেই পেছন থেকে ম্যাও করে ডেকে উঠল। আহান ঘুরে তাকিয়েও টুনিকে কোথাও দেখতে পেল না কিন্তু সে তো স্পষ্ট শুনেছিল টুনির ডাক। আবারও ম্যাও করে ডেকে উঠতেই আহান বাম দিকের বেঞ্চির পেছন দিকটাই তাকাল। ছোট খাটো একটা গর্তের মতো, তার মধ্যে গলা সমান ডুবে শুধু মাথা টা উঁচু করে ম্যাও ম্যাও করছে টুনি। আহান এগিয়ে যেতে ওকে দেখেই আরও জোরে জোরে ডাকাডাকি শুরু করল টুনি।

-যেমন হেড তার তেমন অ্যাসিস্ট্যান্ট,, নিজের তো ধুপধাপ পরার অভ্যাস আছেই সাথে বিড়াল টাকেও তাই বানিয়েছে। একেবারে ট্রেনিং প্রাপ্ত করে ফেলেছে তোমাকে এই কয়দিনে। তোমার মালিক নিজে আসতে পারেনি তো কি হয়েছে তোমাকে পার্সেল করে দিছে আমার পেছনে আমার মাথা নষ্ট করার জন্য

বলেই এগিয়ে গেল। ঘাড় ঘুরিয়ে পাশেই একটা কাঁঠাল গাছ দেখতে পেলো। সেখান থেকে বড় বড় দুইটা পাতা ছিড়ে হাতে নিয়ে টুনিকে ধরে টেনে তুলল। গর্ত থেকে বের করার সাথে সাথে টুনি আহানের পায়ের কাছে এসে কাচুমাচু মুখ করে বসে ম্যাও ম্যাও করতে লাগল।

-সাট আপ, একটা সাউন্ড করবে না। সোজাসুজি কি হাঁটতেও পারো না? হাঁটছিলে তো রাস্তা দিয়ে পরলে কি করে তুমি? ডিসগাস্টিং

বলেই আহান আবারও হাঁটা শুরু করল। তবে এবার টুনিকে নজরে নজরে রেখে হাঁটছে,যাতে আবারও কোথাও গিয়ে মুখ থুবড়ে না পরে।

সকালের নাস্তা সব চুমকির সাথে সাথে এনে টেবিলে রাখল তুরা। আমেনা আর মিনু তাদের খোশ গল্প নিয়ে বসেছে। রান্নাঘরে রুবি খাতুন নাস্তা বানাচ্ছেন আর তুরা আর চুমকি তাতে সহায়তা করছে। খাবার গুলো সব টেবিলে এনে রাখতেই দরজার সামনে এসে দাঁড়াল দারোয়ান আলম।

-ম্যাডাম, বড় সাহেব বাজার পাঠিয়েছে

আলমের কথায় তুরা সেদিক তাকিয়ে বাজারের ব্যাগ গুলো নেওয়ার জন্য এগোতে নিলেই পাশ থেকে চুমকি ছুটে এসে বলল

-আপনে বসেন ভাবিজান আমি আনছি

বলেই বেণি দুটো সামনে এনে, লাজুক লাজুক হাসি দিয়ে এগিয়ে গেল। আলম কে দেখেই চুমকির ভাবসাব কেমন পালটে গেছে দেখেই তুরা ভ্রু কুচকে চেয়ে রইল। চুমকি গালে এক ফালি হাসি নিয়ে এগিয়ে বাজারের ব্যাগ টা নিতেই আলম ও তার মতই একটা হাসি দিল। আলম বাজারের ব্যাগ টা চুমকির হাতে দিলেও চুমকি এক হাতে ব্যাগ ধরে চেয়ে আছে আলমের দিকে, আর আলম চুমকির দিকে। যেন জনম জনম পর নায়ক নায়িকার দেখা। আর এদের এমন ফিল্মি স্টাইলের দেখাদেখি হা করে দেখছে তুরা। দুটির ভাবসাব সুবিধার নাহ। ব্যাপার টা তো দেখতে হচ্ছে?

-কি ব্যাপার ব্যাগ আনতে গিয়ে কি তোমার ভীমরতিতে ধরল নাকি,ওমন সংয়ের মতো দাঁড়িয়ে আছো কেনো?

মিনু ফুফুর ভারি গলার ধমক শুনে হড়বড়িয়ে ব্যাগ টা ধরিয়ে দিয়েই উল্টো পথে হাঁটা দিলো আলম। আর চুমকি মেকি একটা হাসি দিয়ে মিনুর দিকে ঘুরে বলল

-ওই আসলে দেখছিলাম সব ঠিকঠাক আছে কি না

-সেসব তোমাকে দেখতে হবে না,রুবি যে রান্নাঘর থেকে কয়বার ডাক দিলো কানের মধ্যে পৌঁছায়নি?

ফুফুর কথায় তুরারও হুস এলো। না তো চুমকি আর আলমের দৃষ্টি বিনিময় দেখতে গিয়ে সেও হা করেই চেয়ে ছিল। ভাগ্যিস ফুফু খেয়াল করেনি। সেখান থেকে সরে এসে টেবিলের পাশ থেকে ছোট বাটিটা নিয়ে ওতে ক্যাট ফুড ঢেলে রেখে এদিক ওদিক খুঁজতে লাগল,,টুনি টুনি বলে বেশ কয়েকবার ডাক ও দিলো কিন্ত টুনির কোনো সাড়া নেই। এই তো রান্নাঘরে যাওয়ার আগেই তো দেখল গেলো কই?

-কি খুঁজছো নাতবউ?

আমেনা বেগম তুরাকে এদিক ওদিক ঘুরেফিরে কিছুর তালাশ করতে দেখে জিজ্ঞাসা করল।

-টুনিকে খুঁজছি দিদুন। ওকে পাচ্ছিনা তো

-তোমার বিড়ালটাকে তো এখানেই দেখেছিলাম কোথায় আর যাবে, তোমার ঘরে দেখেছ?

মিনু ফুফুর কথায় তুরা সিড়ি বেয়ে উপরে উঠে রাইমার ঘরে ঢুকে সব জাগায় খুঁজেও টুনিকে না পেয়ে আহানের ঘরেও খুঁজলো । অবশেষে কোথাও না পেয়ে কাঁদো কাঁদো মুখ করে নিচে নেমে আসলে ওর এমন শুকনো মুখ দেখে আমেনা বলল

-কি হলো নাতবউ, পেলে না তোমার বিড়ালছানা টাকে?

-না দিদুন,উপরে সব ঘরে দেখেছি। কোথাও নেই ও

-ওমা সে কি কথা সকাল বেলা করে কোথায় যাবে? বাগানের দিকে গেছে নাকি?

ফুফুর কথা শুনে তুরা বাগানের দিকে ছুটতে যাবে তখন রাইমা হাতে দুটো গোলাপের ফুল নিয়ে ঢুকল ঘরে। তুরাকে হন্তদন্ত হয়ে ছুটতে দেখে বলল

-কি হয়েছে, এভাবে কোথায় যাচ্ছিস তুরা?

-টুনিকে ঘরে কোথাও পাচ্ছিনা আপু, তাই বাগানের দিকটাতে দেখতে যাচ্ছি।

-কিন্ত আমিতো এতক্ষণ বাগানেই ছিলাম। ও ওখানে কোথাও নেই তো

এবার তুরার কাঁদো কাঁদো মুখটা আরও করুন হয়ে আসল। চোখের কোণায় টসটস করছে পানি,যেন যখন তখন গড়িয়ে পরবে। এত আদরের বিড়াল বাচ্চাটা গেল কোথায়,হারিয়ে গেল না তো। সাত পাঁচ ভাবনার মাঝেই দরজা দিয়ে গটগট করে ঘরে ঢুকল আহান। আহানের দিকে তাকাতেই দেখল ওর পেছন পেছন টুনিও ঢুকছে। টুনিকে দেখেই তুরার অধর কোণে হাসি ফুটল। ছুটে গিয়ে কোলে তুলে নিলো টুনিকে।

-বাবু, এই বিড়াল টাকে তুই সাথে করে নিয়ে গেছিলি?

মিনু ফুফুর কথায় রাশভারি স্বভাবের আহান মুখ খানার বেজায় গাম্ভীর্য ছড়িয়ে বলল

-ওকে সাথে করে নেওয়া লাগে? চুইংগামের মতো চিপকে আছে আমার পেছনে।

আহান পুরোটা শেষ করার আগেই তুরা বলল

-ও কোথায় গেছিল, কোথায় ছিলো এতক্ষণ?

আহান তুরার দিকে ক্রুর দৃষ্টিতে তাকিয়ে দাঁতে দাঁত খিঁচিয়ে বলল

-তোমার এই আপদ বিড়াল টাকে বলে দাও নেক্সট টাইম যদি আমাকে ফলো করে তাহলে ওকে ড্রেনে ফেলে দেবো আমি। একটারে নিয়েই বাচি না আবার সহোদর জুটেছে

বলেই গটগট করে সিড়ি বেয়ে উপরে উঠে গেল। আহানের যাওয়ার পানে তুরা হা করে চেয়ে রইল হতভম্ভের মতো। কি বলে গেলো লোকটা? টুনি উনাকে ফলো করছিল? তুরা কোলে থাকা টুনির দিকে তাকিয়ে দেখল ওর গায়ে মাটি ময়লা লেগে আছে

-ইশ কি করেছিস গায়ে ময়লা বাঁধিয়ে, কে বলেছিল তোকে ওই জল্লাদ লোকটার পেছনে যেতে

বলেই সামনে এগোতে নিলে দেখল মিনু আড়চোখে জহুরি দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ওর দিকই। গাল টেনে মেকি একটা হাসি দিয়ে বলল

-ওই আসলে ও ছোট তো বুঝতে পারেনি,আর যাবে নাহ

বলেই গা বাঁচিয়ে দৌড়ে উপরে উঠে এলো। উফ জল্লাদ লোকটাকে কিছু বলাও যাবে নাহ। জল্লাদ ই তো। একটু নাহয় গেছিল উনার পিছু পিছু, কোলে তো উঠতে চাইনি। এমন হম্বিতম্বি করার কি আছে তুরা ভেবে পাই না।

••••

মধ্যাহ্নের শেষ সময়, সূর্যের প্রখর রোদ এখন অবলীলায় মৃদু লালীমায় পরিনত। বেলা গড়িয়ে ব্যস্ত পাখিরাও ক্লান্তিতে ফেরারা তাড়া শান্তির নীড়ে। দুপুরের খাওয়া দাওয়া শেষে বসেছে সকলে ড্রয়িং রুমে। সফেদ টাইলস এর ফ্লোরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রঙ বেরঙের সুন্দর জিনিস গুলোতে। মাঝে শুধু একটা রাত,কালই রাইমার গায়ে হলুদ গাড়ি গাড়ি ভরে উপহার তত্ব এনেছে ইনসাফ। সেগুলোই গুছাতে বসেছে রুবি, রাইমা,চুমকি আর তুরা। আমেনা আর মিনু সোফার উপর বসে সবটা পর্যবেক্ষণ করছে,আর খোশ গল্প জুড়েছে। এর মাঝেই কলিং বেলের শব্দ বেজে উঠল। এই অসময়ে কে আসতে পারে ভেবেই কিঞ্চিৎ বিব্রত হলো রুবি। কিন্তু উপরে তা স্বাভাবিক রেখেই উঠতে নিলে তুরা থামিয়ে দিয়ে বলল

-আমি দেখছি মা,আপনি বসুন

বলে উঠে দরজা খুলতেই চার পাঁচজনের একটা দল এক সাথে চেঁচিয়ে বলে উঠল ‘সারপ্রাইইজজজ’
কিংকর্তব্যবিমূঢ় তুরা হা করে চেয়ে আছে,সামনে থাকা জন কয়েক মানুষের চেহারা বুঝে উঠার আগেই একজন হুমড়ি খেয়ে তুরার উপর পরে জড়িয়ে ধরল। তুরা এখনো ভাবশূণ্য ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে, ঘটনার আকস্মিকতায় বাকরুদ্ধ হয়ে গেছে, এটা কি হলো? কোত্থেকে এসে একদল ঝাপিয়ে পরল?

-আরেহ.. জায়মা, আরমান, তনু, রুহি!!
তোরা? তোরা সবগুলো??

পেছন হতে রাইমার কথা শুনে তুরাকে জড়িয়ে ধরা মেয়েটা এক ঝটকায় সরে গিয়ে দাঁড়াল,,হতভম্ব দৃষ্টিতে একবার রাইমা একবার তুরার দিকে তাকাচ্ছে। এক হাতে মাথা চুলকে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে বলল

-এ্যাহহ,,রাই আপু তুমি এখানে,,তাহলে আমি কাকে জড়িয়ে ধরলাম

মেয়েটা বলার সাথে সাথেই পেছন থেকে আরও একটা মেয়ে খুব প্রশ্নবিদ্ধ চাহনি দিয়ে বলল

-এই পুতুলের মতন দেখতে মেয়েটা কে রাই আপু?

-আল্লাহ রুহি তুই কার উপর হামলা করলি বলদি?

আরও একটা মেয়ে একথা বলতেই রাইমা সকলকে থামিয়ে বলল

-আরে থাম থাম,,আগে ভেতরে আই বলছি সব। দিনে দুপুরে তো তোরা ভয় পাইয়ে দিয়েছিস।

বলেই দরজা থেকে সরে দাঁড়ালো, তিনটা মেয়ে সহ আরও একজন ছেলে ঘরে প্রবেশ করতেই রুবি আর আমেনা খাতুন অবাক দৃষ্টিতে চেয়েও জ্বলজ্বল চোখে মুখে হেসে উঠে দাড়াল।

-কিরে,তোরা। বলা নেই কওয়া নেই এভাবে হুট করে চলে আসলি?

-ওমাহ এসে কি ভুল করলাম মামী,,রাই আপুর বিয়ে আর আমরা কি না বাড়ি বসে হলুদের দিনেই আসব। বলি আমরা না আসলে তোমার বাড়িতে হইহট্টগোল কারা করবে। বলেই থপ করে সোফার উপর বসল রুহি নামের মেয়েটা।

-একদম। বেশ করেছিস বনু। এই না হলে আমার নাতনিরা,তোর বাপ মা কাল আসুক আর না আসুক তোরা এসেছিস এতেই আমি খুশি

দিদুনের কথার সাথে সাথে লম্বা চিকন গড়নের মেয়েটা এগিয়ে দিদুনকে জড়িয়ে ধরে বলল

-আমরা না এসে কি পারি, রাই আপুর বিয়ে নিয়ে সেই কবে থেকে প্ল্যানিং করছি আর বাবা মা বলছে হলুদের দিনেই আসবে,তা কি হয়? তাই চলে এলাম তোমাদের সারপ্রাইজ দিতে

-আমাদের সারপ্রাইজ দিতে এসে সবচেয়ে বড় সারপ্রাইজ টা তোরা তুরা কে দিয়ে ফেলেছিস,বেচারি এখনও হতভম্ব হয়ে আছে

বলেই ফিক করে হেসে দিলো রাইমা। রাইমার কথা অনুসরণ করে সোফা থেকে রুহি নামের মেয়েটা উঠে দাঁড়িয়ে বলল

-আসলেই তো,,এই মেয়েকে তো ঠিক চিনতে পারলাম না। না চিনেই জড়িয়ে ধরে ফেলেছি

বলেই বোকা একটা চাহনি দিয়ে মাথা চুলকালো।

-মেয়ে নয়,ভাবি বল রুহি। ও তুরা,আহানের বউ। তোদের সবার বড় ভাবি

রাইমার কথা শেষ হওয়া মাত্র দিদুনকে জড়িয়ে ধরে রাখা মেয়েটা ধপ করে উঠে দাড়াল। রুহি নামের মেয়েটা বড়বড় চোখ করে তুরার দিকে চাইল যেনো অষ্টম আশ্চর্য দেখে ফেলেছে। রাইমার পেছনে দাঁড়ানো মেয়েটা এগিয়ে এসে বলল

-আরিইই,ভাবিই!! আরে ভাবিকে দেখার জন্যেই তো তোড়জোড় করে আসলাম আমরা দেখি দেখি সর তো

বলেই এগিয়ে এসে তুরার সামনে দাঁড়িয়ে বলল

-হ্যালো ভাবি, মাইসেল্ফ তনু আপনার অনেক গুলো ননদের মাঝের একমাত্র ননদ,,আহান ভাইয়ের ফুফাতো বোন

তনু নামের মেয়েটার কথায় তুরা বিস্ময় কাটিয়ে সামান্য হেসে কিছু বলতে যাবে তার আগেই পাশ থেকে রুহি বলল

-এই তাহলে তো আমি একদম ঠিক জাগায় ল্যান্ড করেছি গাইস। আরেকটা হাগ হয়ে যাক

বলেই আবারও হুড়মুড়িয়ে এসে তুরাকে জড়িয়ে ধরে বলল

-ভাবিই আমি রুহি আমিও আহান ভাইয়ের ফুফাতো বোন ওই যে ওই গাধাটার ছোট বোন।

জায়মাকে দেখিয়ে বলল,,তুরা জায়মার দিকে তাকালে জায়মাও মিষ্টি হেসে এগিয়ে এসে তুরার সাথে কুশল বিনিময় করে নিজের পরিচয় দিয়ে বলে

-আমি জায়মা। আহান ভাইয়ের চাচাতো বোন। ভাবি, বিশ্বাস করেন যবে থেকে শুনেছি আহান ভাই বিয়ে করেছে আমরাতো পারিনি রকেটে করে উড়ে আসতে। দ্যা ওয়ান এ্যন্ড অনলি বিয়ে বিদ্রোহী আহান ভাই বিয়ে করেছে ভাবতেও পারিনি তাই তো…

পুরোটা শেষ করার আগে, বাধা দিলো বেশ হাসি খুশি চেহারার সুদর্শন একটা ছেলে,যে এতক্ষণ অপেক্ষারত সবার কথা শুনে পরিস্থিতি বোঝার চেষ্টা করছিলো, এবার জায়মাকে কথা সম্পূর্ণ করতে না দিয়েই হড়বড় করে এসে এক ধাক্কায় জায়মা কে সরিয়ে তুরার সামনে ঝুকে পা ছুঁয়ে বলল

-আশির্বাদ করুন ভাবি,আমি আপনার একমাত্র দেবর আরমান

একের পর এক অপ্রস্তুত ঘটনায় তুরা বাকরুদ্ধ হয়ে কথায় খেই হারিয়ে ফেলেছে,কি বলবে কেমন প্রতিক্রিয়া করবে যেনো ভুলতে বসেছে। এত বড় দামড়া ছেলেটা তুরার পা ছুঁয়ে সালাম করাই তুরা সরে এসে কিছু বলতে নিবে তার আগেই আরেকটা পুরুষালি কণ্ঠে তাকায় দরজার দিকে

-হেই স্টপ। একমাত্র না দুইমাত্র দেবর বল

আরও একটা অনাকাঙ্ক্ষিত বাক্যবাণে তুরা তাকিয়ে দেখল। বেশ লম্বা চওড়া সুগঠিত শরীরের একটা ছেলে দাঁড়িয়ে, কাধে ব্যাগ পায়ে জুতা আর চোখে চশমা। তুলনামূলক বেশি সুদর্শন ছেলেটা,,দেখতে অনেকটা আহানের মতই। তুরাকে এক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকতে দেখে অপেক্ষাকৃত সুদর্শন ছেলেটা এগিয়ে এসে বলল

-আমাকে রেখেই তোরা চলে এলি। সো আনফেয়ার,, যাই হোক

বলেই তুরার সামনে এক হাত বাড়িয়ে চোখের চশমা টা খুলে গাল ভরা হাসি দিয়ে বলল

-আমি বিহান, আহানের কাজিন। যদিও বয়সে প্রায় ওর সমানই তবুও আপনার দেবর। নাইস টু মিট ইউ ভাবি

পরপর এতগুলো ঝটকায় তুরা হতভম্ব হয়ে গেছে, একসাথে এতগুলো মানুষ,কাকে ছেড়ে কাকে মনে রাখবে। মুখের খেই হারিয়ে হতবিহ্বল হয়ে তাকাল রাইমার দিকে। রাইমা সবটা বুঝতে পেরে এগিয়ে এসে তুরার পাশে দাঁড়িয়ে বলল

-আরে চিল গাইস। আস্তেধীরে গ্রেটিংস কর। বেচারি ভয় পেয়ে যাবে তো তোদের এমন লাফালাফি দেখে। এসেছিস এখনই চলে তো যাবি না, পরিচিত হওয়া যাবে। তা না তোরা আগেই হড়বড় করে বেচারিকে কনফিউজড করছিস

রাইমার কথা শুনে সকলে বেশ যেনো লজ্জিত বোধ করল। আসলেই তুরাকে দেখে এক্সাইটমেন্ট আটকাতে পারেনি, ওদের সবাইকে থামিয়ে মিনু ফুফু বলল

-ওরে তোরা এদিক আই আমার বাবুর বউটারে এসে থেকেই একেবারে ঘেটে ফেলেছিস,,বেচারি এমনিতেই নরম সরম।

ফুফুর কথার বিহান এগিয়ে এসে বসল মিনু পাশে, রুহি, জায়মা, তনু আগের মতোই তুরাকে ঘিরেই দাঁড়িয়ে আছে,ওদের এতসব জাঁকজমকপূর্ণ পরিবেশের মাঝে থমথমে গলার রাশভারি কণ্ঠে বলল

-তোরা? তোরা সবগুলো কখন এলি
.
.
.
চলবে ইনশাআল্লাহ

#তুমি_আমি_দুজনে
#লেখিকা_হুমাইরা_হাসান
পর্ব- ২৩

-হেই ব্রো,হাউ আর ইউ?

এগিয়ে গিয়ে হাত বাড়িয়ে দিলো আহানের সামনে

-নট ব্যাড

চোখে মুখে গাম্ভীর্যের ছাপ বহমান রেখে আরমানের সাথে হাত মিলিয়ে বলল আহান,প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে ওদের দিকে তাকিয়ে বলল

-তোরা এভাবে উইদাউট ইনফর্ম চলে এলি যে?

-কি করব ভাই,তুমি বিয়ে করলে আমরা তো ডান্স ও করতে পারলাম নাহ,কিন্তু ভাবিকে দেখার এক্সাইটমেন্ট আর ধরে রাখতে পারিনি,তাই আগে ভাগেই চলে এলাম

ভাবি দেখার কথা শুনে প্রথমে ভ্রুকুটি করলেও পরমুহূর্তে সেটাকে অগোচর করে পকেটে হাত ঢুকিয়ে আহান বলল

-বাহ, ভালো করেছিস। এবার সব গুলো কাজে লেগে পর। এমনেও সব কাজ আমারই করা লাগত তোরা যখন এসছিস, দল ভারি না করে চুপচাপ কাজে লেগে পর

আহানের এরূপ কথায় জায়মা মুখ খানা ছোট করে বলল

-সে কি ভাই। বিয়ে করেছ সেই উপলক্ষে কই ট্রিট দিবা তা না তুমি এসেই কাজের কথা বলছ

-তোদের মতো ওকাজের কথা আসেনা আমার,,আর যদি কথা হয় ট্রিট দেওয়ার তাইলে এই ষ্টুপিডের ডিব্বাটারে পেয়ে সকাল বিকাল যেই ট্রিট পাচ্ছি সেই হজম হচ্ছে না আবার আমি দেব ট্রিট

প্রথম লাইন টা জোরে সোরে বললেও শেষের লাইন টা বিড়বিড়িয়ে বলে সোফাতে গিয়ে বসল আহান। আহান পাশে বসতেই বিহান পাশ থেকে বলল

-ভাই যেই এটম টা মুখ দিয়ে ছুড়লি আমি ল্যান্ড করাই দি,কি বলো?

বিহান ফিসফিসিয়ে বলল আহানের কানের কাছে মুখ এনে,আহান এক পলক বিহানের দিকে তাকিয়ে বলল

-ভাই এই বাড়ির ওয়ার্ল্ড ফেমাস বউমার চক্করে সকাল বিকাল আমার নাকানি চুবানি খাওয়ার অবস্থা তুই আর ঘাটিস না প্লিজ

মুচকি হেসে চোখ টিপল বিহান সে আহানের পুরো কথাটাই বেশ ভালো মতোই শুনেছে, আহান আর বিহানের বয়সের পার্থক্য এক বছর মাত্র। বিহান আর তনু হলো আহানের চাচাতো ভাই অর্থাৎ ইনসাফের একমাত্র ভাই ইউসুফ এর ছেলে। বিহানের বাবা তার চাকরিসূত্রে সিলেটের অধিবাসী বর্তমানে, বিহান আর বাকিরা আপাতত রাইমার বিয়ের জন্যেই একত্রিত হয়ে এসেছে।
ওদের সাথে সামান্য আলাপচারিতা সেরে আহান বাইরে বেরোনোর উদ্দেশ্যে উঠে দাঁড়ালে রুবি খাতুন বলল

-তুমি কি কোনো কাজে বেরোচ্ছ আহান?

-হ্যাঁ মা,একটু কাজ আছে, বেশি সময় লাগবে না সন্ধ্যার মধ্যেই ফিরব,তোমার কিছু লাগলে বলিও

বলেই পা বাড়াতে নিলে রাইমা পেছন থেকে ডেকে বলে

-ভাই দারা৷ আমিও বেরবো, আমাদেরকেও সাথে নিয়ে চল। বাড়ির গাড়িটা তো বাবা নিয়ে বেরিয়েছে

-কোথায় যাবি? আর আমরা কারা?

-আমরা মানে আমি আর তুরা। আমার একটু পার্লার যাওয়া দরকার,ফেসিয়াল করাবো। নিয়ে চল না প্লিজ ভাই

-উফ আপি! কিন্তু

-কোনো কিন্তু নাহ,নিয়ে যেতেই হবে। তুই দুই মিনিট দারা আমরা এক্ষুনি রেডি হয়ে আসছি
বলে তুরার হাত ধরে উপরে উঠতে নিলে তুরা বলল

-কিন্ত আপু আমি কেনো,আমিতো ওসব করাবো না

-একদম চুপ করে থাকো তুমি চুপচাপ চলবে আমার সাথে
বলে ওখানে উপস্থিত জায়মা তনু আর রুহির দিকে তাকিয়ে বলল

-তোরা ফ্রেশ হয়ে রেস্ট কর আমরা একটু পরেই চলে আসব। তারপর জম্পেশ আড্ডা হবে

ওরাও সহমত দিয়ে রুবির সাথে গেস্টরুমে যায় ফ্রেশ হতে। রাইমা আর তুরা রেডি হয়ে কিছুক্ষণ পরই নেমে আসলে আহানের সাথে বেরিয়ে পরে।
দশ মিনিট গাড়ি চলার পর এসে থামল রাস্তার পার্কিং সাইডে। পার্লারটা পাশের চিকন গলির ভেতর। তাই গাড়িটা পার্ক করে নেমে হাটতে শুরু করল আহান আর রাইমা। তুরা পেছনের সিটে বসায় ও পরে বেরিয়ে আসে। আহান আর রাইমা আগে আগে হাঁটছে আর তুরা পেছনে। তুরা রাস্তার দুপাশের দোকান গুলো দেখতে দেখতে হাঁটতে গিয়ে বেশ পিছিয়ে পরেছে ওদের থেকে। উপরের দিকে তাকিয়ে হাঁটতে গিয়ে হঠাৎই কিছু একটার সাথে হোঁচট খেয়ে পরতে নিলে কেও এক হাত টেনে ধরে উঠিয়ে নিলো। অপ্রস্তুত ঘটনায় তুরা ঘাবড়ে গিয়ে বুকে হাত দিয়ে জোরে জোরে নিঃশ্বাস ছেড়ে স্বাভাবিক হলো। আর একটু হলেই মুখ থুবড়ে পরতো রাস্তার মাঝে। ভাগ্যিস বেঁচে গেছে।

-ঠিক আছো? কোথাও লেগেছে?

চেনা জানা কণ্ঠের কথায় তুরা ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল তার পাশেই দাঁড়িয়ে মাহিদ স্যার। তুরার এক হাত এখনো ধরে কৌতুহলী দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে উত্তরের অপেক্ষায়। তুরা মাহিদ স্যারের সাথে অনাকাঙ্ক্ষিত সাক্ষাতে হতবিহ্বল হয়ে তাকিয়ে থাকা অবস্থায় মাহিদ আবারও বলল

-তোমার কি কোথাও লেগেছে? আর ইউ অলরাইট?

সামান্য জোর গলায় বলায় তুরা ভাবনাচ্যুত হয়ে নিজেকে ধাতস্ত করে সরে দাঁড়ালো। একরাশ ব্যগ্রতা ঘিরে ধরল ওকে,,আবারও, আবারও এই স্যারটার সামনেই তার পরতে হলো? লজ্জায় মাটি ফাঁক করে ঢুকে যেতে ভীষণ ইচ্ছে হলো তুরার। তবুও অযাচিত ভাবাবেগ বাদ দিয়ে সৌজন্যসূচক হেসে বলল

-না স্যার আমি একদম ঠিক আছি, থ্যাংকিউ।

-সিউর তো?

-জ্বি স্যার।

মাহিদ সদা সর্বদার মতো অমায়িক হেসে বলল।

-গুড, বাট একটু দেখে শুনে চলাফেরা করো কেমন? এভাবে হোঁচট খেতে থাকলে তো কোনদিন হাত পা ভাঙবে

বলেই রসিকতার ছলে হেসে উঠল। তুরা মাহিদ স্যারের তাকে নিয়ে রহস্য করা কথায় প্রথমে বেশ বিব্রতবোধ করলেও মাহিদের হাসি দেখে হঠাৎই চমকে উঠে। এই হাসিটা,এই হাসিটা ভীষণ চেনা জানা লাগছে তুরার! কোথায় একটা দেখেছে মনে হয়। ভীষণ কৌতুহল নিয়ে খুতিয়ে চেয়ে রইল তুরা। ভেতরে ভেতরে কেমন খচখচ করছে। বার বার চেষ্টা করেও কিছুতেই মনে করতে পারছে না। তুরা অপলক চেয়ে থাকা অবস্থায় ই মাহিদ হাসি থামিয়ে বলল

-তুমি এসময় এখানে কি করছ? একাই এসেছ?

মাহিদের প্রশ্নে তুরা তটস্থ হয়ে তাকাল। আসলেই তো। রাইমা কই? হড়বড় হড়বড় করে বলল

-হ্যাঁ তাই তো,আমি আপুর সাথে এসেছিলাম। নিশ্চয় দূরে চলে গেছে, আমি আসি স্যার, থ্যাঙ্কিউ

বলেই দৌড় দিল। তুরার যাওয়ার পানে চেয়ে মাহিস স্মিত হেসে, হাঁটা ধরল। খানিকটা দৌড়ে সামনে এসেই থেমে যায় তুরা। চুপচাপ ঘাড় নামিয়ে নিয়ে দাঁড়ায়। অভিব্যক্তি ধরা পরা চোরের মতো। হাতের আঙুলে ওড়না পেচাতে থাকে। তুরার ঠিক সামনেই বুকে হাত গুজে দাঁড়ানো ছাই রঙা শার্ট পরিহিত সুপুরুষ। আপাতত তার রেশপূর্ণ দৃষ্টি দেখে মনে হচ্ছে চোখ দিয়েই ভস্ম করে দেবে। তুরা আমতাআমতা করে কিছু বলতে নিবে তার আগেই আহান মন্থর গলায় বলল

-কোথায় ছিলে?

উত্তরে তুরা এক পলক আহানের সুরত পানে চেয়ে আবারও ঘাড় নামিয়ে হাতের আঙুলে ওড়না পেচাতে লাগলো।

-উত্তর দিচ্ছ না কেনো, এ্যান্সার ড্যাম ইট!

ভারি গলার ধমকের দাপটে কেঁপে উঠল তুরা, ভয়ার্ত দৃষ্টিতে অবলোকন করল আহানের মুখ, আবারও নাকের পাটা লাল হয়ে গেছে লোকটার।কিন্তু এবার তো তুরা কোনো অকাজ করেনি তাও রেগে কেনো গেলো। তুরার মৌনতা দেখে আহানের মেজাজ সপ্তমের চূড়ায় পৌঁছালে রাগে ক্রুর হয়ে তুরার দিকে এগিয়ে আসতে নিলেই দেখল আশেপাশের লোকজন বেশ আড়চোখে দেখছে তাদের, তাই ভরা রাস্তায় আর সিন ক্রিয়েট না করে তুরার একহাত চেপে ধরে টানতে টানতে হাঁটা ধরল। প্রচন্ড জোরে হাত চেপে রাখায় ভীষণ লাগছে তুরার, আর হাটার তালে হুমড়ি খেয়ে পরার মতো অবস্থা। সে কিছুতেই বুঝত পারছে না লোকটা হুট করেই এত রেগে কেনো গেলো। সে তো কিছুই করেনি।
/-/
বেশ ঘন্টা খানেক সময় ব্যয় করে বেরোলো একতালা বিশিষ্ট ছিমছাম বিল্ডিংয়ের কর্ণার সাইড থেকে। রাইমার ফেসিয়াল করানো সহ হাত পায়ের কাজ করাতে প্রায় অনেকটা সময় লেগেছে। রাইমা তুরাকেও বেশ কয়েকবার বলেছে ফেসিয়াল করানোর কথা, কিন্তু সেই করেনি। এসব তার একেবারেই ভালো লাগে নাহ। সে তো সারাটা সময় মুখ খানা চুপসে রেখেছিল। ব’জ্জাত লোকটা চেপে ধরায় হাত লাল হয়ে গেছে, তখন ওভাবে টেনে এনে রাইমা আপুর কাছে দিয়ে বেরিয়ে গেছে ওমন মুখ করেই। লোকটার মেজাজ কি সবসময়ই তুঙ্গে উঠার টিকিট কেটে রাখে তুরা ভেবে পাইনা। আর যত হম্বিতম্বি তার উপর। মনে মনে দু চারটা ভেংচি দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে চুপচাপ রাস্তার পাশে। রাইমা বলল তার গণ্যমান্য ব’জ্জাত ভাই নাকি এখনই চলে আসবে,তাদের পার্লারে রেখে তার কার্য সাধনে গেছেন। লোকটা না আসুক আসলেই আবার রাক্ষসপনা শুরু করবে ভেবেই তুরা মুখ বিকৃত করল। কিন্তু তুরার ভাবনার ছেদ ঘটিয়ে আগমন ঘটল গণ্যমান্য.. থুরি আহানের।
ব্রেক কষে গাড়ি থামালেই রাইমা বলল

-তুরা তুই সামনে বস। আমি পেছনে বসব

বলেই পেছনের সীটে বসে পরল। তুরা এক নজর আহানের গম্ভীর মুখ পানে চেয়ে আস্তেধীরে উঠে বসলো গাড়িতে। তুরা বসা মাত্র আবারও গাড়িটা চলতে আরম্ভ করলো। খানিকটা পথ এগোতেই রাস্তার পাশে আইসক্রিম পার্লার দেখে রাইমা পেছন থেকে বলে উঠল

-আইসক্রীম খাবি তুরা

রাইমার বলার সাথে সাথে তুরা চোখ মুখ জ্বলজ্বল করে উত্তেজিত হয়ে বলল

-হ্যাঁ খাবো। ওই যে লাল আইসক্রিম খাবো। যেটা খেলে গাল মুখ লাল হয়ে যায় ওটা খাবো

-সাট আপ! সুযোগ পেলেই বাঁদরের বাঁদরামি শুরু হয়ে যায়। কোনো আইসক্রীম খাওয়া যাবে না। যত্তসব আনহাইজেনিক

তুরার কথা শেষ হওয়ার আগেই আহান গমগমে ধমকে থামিয়ে দিলো। আহানের ধমকে তুরার মুখ খানা চুপসে এইটুখানি হয়ে গেলো। এভাবে বলল লোকটা? সবসময়ই কি এমন করতে হবে তার সাথে! নিমিষেই তুরার মনটা খারাপ হয়ে গেলো। সে তো শুধু ঠোঁট লাল করা আইসক্রিম ই খেতে চেয়েছিল। বাকিটা পথ তুরা আর কোনো শব্দও করেনি। কেনো বলবে সে কিছু বললেই তো যা তা শুনিয়ে দেবে লোকটা।

•••••

-দেখ ভাই ওতসব আমি বুঝিনা আমিতো কালা চাশমা গানে ডান্স দিবো ব্যস

-আবে থাম, তুই কালা চাশমা দে আর হলুদ চশমা সেই তো ডান্স স্টেপ ভুলে গোলমাল করে দিবি

জায়মার কথায় প্রচন্ড ক্ষুব্ধ হয়ে রুহি তাকালো। আঙুল দিয়ে নাক ঘঁষে বলল

-ডোন্ট আন্ডারেস্টিমেট রুহি। এবার আমি সব ডান্স ভালো করে মনে রাখব। প্রয়োজনে মুখস্থ করে গিলে খাবো তাও কোনো ভুল হবে নাহ

-তুই প্রত্যেকবার এ কথা বলে নাচার সময় স্টেপ ভুলে ঘাপলা করে ফেলিস রুহি।

তনুর কথায় আরমান ওকে থামিয়ে বলল

-তোরা কালা চাশমা দে আর স্টেপ ঘুটে খেয়ে ফেল। আমিতো ভাবির সাথে একটা রোমান্টিক গানে ডান্স দেবোই দেবো। কি বলেন ভাবি?

বলেই তুরার দিকে তাকালে তুরা ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেলো। বিমূঢ় দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল

-হ্যাঁ? ডান্স? আমি?

-ইয়েস ভাবি। আপনি আমাদের একমাত্র ওয়ান এ্যন্ড অনলি ভাবি, বড় ভাবি। আপনি না নাচলে এই বেচারা সিঙ্গেল দেবরের কি হবে বলুন

আরমানের ভনিতা করা দেখে জায়মা বলল

-তোর ওভার অ্যাক্টিং বন্ধ কর,,আমি কি বলি ভাবি আর আহান ভাইয়ের একটা পারফরম্যান্স হয়ে যাক, রোমান্টিক গানে দুজনের নাচ হবে, দুর্দান্ত সিন,ওয়াহহ

-এই না না,,আমি রাজি আমি তোমাদের সাথেই নাচতে রাজি

একদমে হড়বড়িয়ে বলে ফেলল তুরা, সে কি না নাচবে ওই জল্লাদের সাথে? অসম্ভব! ওই লোক নাচতে গেলে মিউসিক ও পালাবে, সে তো শুধু পারবে গোমড়ামুখো চেহারা করে রাখতে আর তুরাকে বকতে, ওর সাথে নাচা মানে জেনে শুনে নিজেকে ফ্রী তে অপমান করার টিকিট পাওয়া। না না তার চেয়ে এদের সাথে কিছু একটা নেচে দেবে।

-বাহহ,,আর কোনো কথা শুনবো না,ভাবি রাজি,ব্যস আর কি লাগে। কাল আমি ভাবির সাথে ঝাক্কাস একটা পারফরম্যান্স দেবো

তুরার ভাবনার ছেদ ঘটিয়ে বলল আরমান। তুরা এবার পরল আরেক বিপাকে। এবার সে কি করবে নাচের ন টাও তো জানে না। ওই বজ্জাত লোকটার কাছ থেকে বাঁচতে হ্যাঁ তো বলে দিলো। কিন্তু এখন! চুপচাপ হ্যাবলাকান্তের মতো ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে ওদের সবার হৈ-হুল্লোড় দেখছে।তাছাড়া আর কি করার। কাল যে সে আবার কোনো ঘাপলা করে ফেলবে না এ ব্যাপারে এখন নিজের ও সন্দেহ হচ্ছে।

~

ঘড়ির ছোট কাটা একের ঘর ছুতেই ঢং শব্দ করে এ্যালার্ম বেজে উঠল। সাথে আহান ও চোখ ঘুরিয়ে সময় দেখে নিলো। এ দিয়ে চতুর্থ বার ঘড়ির দিকে তাকালো সে। রাত একটা বেজে গেল অথচ এখনো মেয়েটা ঘরে আসলো না। তখন বাড়ি ফেরার পর ওই যে দৌড়ে ঘরে ঢুকেছে আর ভুলেও আহানের সামনে আসেনি এতক্ষণে। আহানের একবার বেশ অনুতপ্ত লাগলো তখন তুরার সাথে ওভাবে কথা বলার জন্য। তারপর ভাবলো ঠিক ই করেছে, ওর সাহস কি করে হলো আবারও মাহিদের সাথে ঘেসাঘেসি করার। তখন পার্লার যাওয়ার সময় গাড়ি থেকে নেমে হাঁটার সময় পাশে তুরাকে না দেখে এগিয়ে আসলেই মাহিদকে তুরার হাত ধরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে মাথায় রক্ত চড়ে গেছে আহানের। সাহস কি করে হলো ওর, কি করে ধরল তুরার হাত সে! রাগে নিজের মাথা ফেটে যাচ্ছিলো আহানের। মাহিদকে তুরার পাশে একেবারেই সহ্য হচ্ছিল না তার। তাই মেজাজ খারাপ করে বকে দিয়েছে।
কিন্তু এখন তুরার ঘরে না আসায় বেশ চিন্তাও হচ্ছে৷ কয়েকবার বিছানায় গা এলিয়ে এপাশ ওপাশ করেও ঘুম আসেনি। ভাবনার মাঝেই
খট শব্দ করে দরজার নব মোচড়ানোর শব্দে তড়িৎ ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাতেই দেখল তুরা ঘরে ঢুকল। তুরাকে দেখে আহান কিছু একটা বলতে নিবে তার আগেই কোনো দিক না চেয়েই ওয়াসরুমে ঢুকে গেলো তুরা। ওর যাওয়ার পানে হা করে চেয়ে রইল আহান। মিনিট পাঁচেক পর ওয়াসরুমের দরজা খোলার শব্দে চোখ ফিরিয়ে নিয়ে হাতে রাখা বইয়ের দিকে মনোযোগ দিলো। তুরা ড্রেস চেঞ্জ করে ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে এসে নিজের কাজে ব্যস্ত হয়ে পরল কোনো দিক না তাকিয়েই, আহান আড়চোখে লক্ষ্য করছে তুরাকে, আর ভেতরে ভেতরে ফুঁসছে। মেয়েটার সাহস কত ভাবা যায় এমন একটা ভাব করছে যেনো এই ঘরে কেও নেই। কই অন্যান্য দিন তো এসেই পকপক করে মাথা খেয়ে ফেলত ‘স্বামী আপনার কিছু লাগবে? এটা লাগবে, এটা দেবো’ এসব বলে বলে,,আর আজ কি না ঘুরেও তাকাচ্ছে না। বেশ কিছুক্ষণ পার হওয়ার পরেও তুরার কোনো হেলদোল নেই,সে আপনমনে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুলে বেণি করছে। ধপ করে হাতের বইটা বন্ধ করে দিলো আহান। হুট করেই মেজাজ টা তার বিগড়ে গেলো। খাট থেকে নেমে এসে তুরার পেছনে দাঁড়িয়ে বলল

-মাহিদের সাথে তোমার কি সম্পর্ক

আচানক আহানের মুখ থেকে এমন উদ্ভট অনাকাঙ্ক্ষিত কথা শুনে তুরা প্রশ্নসূচক তাকিয়ে বলল

-মানে?

-মানে মাহিদের সাথে তোমার কি এত। যখন না তখন দেখি ওর সাথেই হাহাহিহি করো। এত কিসের খোশগল্প তোমার ওর সাথে

তুরা আহানের এমন বিভ্রান্তিকর কথা শুনে কিছু বলবে তার আগেই আহান আবারও বলে

-শোনো তোমাকে লাস্ট বারের মতো বলে দিচ্ছি মাহিদের আশেপাশেও ঘুরবে নাহ,নাহলে আমার চেয়ে খারাপ কেও হবে নাহ

আহানের এমন অভিব্যক্তি আর উল্টাপাল্টা কথার আগামাথা না বুঝে তুরা বোকার মতো করে বলল

-কিন্তু কেনো?

-কারণ আমি বলেছি। নেক্সট টাইম যেন আমি তোমাকে ওর ধারেকাছেও না দেখি

কিন্তু আহানের এবারের কথাকে পুরোপুরি অগ্রাহ্য করে তুরা ঘুরে বিছানার দিকে যেতে নিলেই আহান পেছন থেকে খপ করে ওর হাত ধরে ফেলল। তুরাকে নিজের দিকে ফিরিয়ে এক ধাক্কায় বিছানার উপর ফেলে দিয়ে হাঁটুতে ভর দিয়ে তুরার উপর ঝুকে তুরার দু হাত বিছানার সাথে চেপে ধরে। আকস্মিক আক্রমণে তুরা বাক্য শব্দ হারিয়ে হতবিহ্বলতার চূড়ান্তে পৌঁছে গেছে, কিছু বুঝে উঠার আগেই আহানকে নিজের ভীষণ কাছে আবিষ্কার করল। তীক্ষ্ণ চোখ, খাড়া নাক পুরু ঠোঁট আর গালভর্তি খোঁচা খোঁচা দাড়ির সুদর্শন পুরুষকে সজ্ঞানে আরও একবার নিজের এত কাছে দেখে অযাচিত চিন্তাভাবনায় মস্তিষ্ক নিরেট হয়ে গেলো। নিজেকে সংযতচিত্তে কিছু বলতে নিবে তার আগেই আহান হিসহিসিয়ে বলল

-তোমার সাহস কি করে হলো আমার কথার অগ্রাহ্য করার,হু? এসে থেকেই দেখছি আমাকে ইগনোর করতেছ, বেশি সাহস বেড়েছে তোমার মেয়ে! ডানা গজিয়েছে? ডানা কি করে ছেটে দিতে হয় তা ইরফান মাহমুদ আহান বেশ ভালো করেই জানে

দাঁতে দাঁত খিঁচিয়ে বলল আহান কথাগুলো। কথার সাথে আরেকটু ঝুকে আসায় দুজনের মধ্যবর্তী দূরত্ব হলো কিঞ্চিৎ ইঞ্চি সমান। নিজের শরীরের উপর পুরুষালি ভরে তুরার সারা শরীরে মিইয়ে নিস্তেজ হয়ে গেছে, কথার সাথে আছড়ে পরা আহানের উষ্ণ শ্বাস আর এতটা নৈকট্য তুরার বক্ষ স্পন্দনবেগের গতানুগতিক ধারার উচ্চমাত্রায় ব্যাঘাত ঘটিয়েছে, কণ্ঠনালীতে শব্দগুচ্ছ আটকা পরেছে। সকল অস্থিরতা মনস্তাপ জুড়িয়ে জিহ্বা দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে কিছু বলতে নিবে তার আগেই আহান এক হাতের তর্জনী উঠিয়ে তুরার অধরের মাঝ বরাবর চেপে ধরে বলল

-হুসস,নট অ্যা ওয়ার্ড।তোমার কোনো কথা শুনতে চাইনা আমি

তুরা আরও কয়েক ধাপ থমকালো,পিটপিট করে তাকালো,অজান্তেই আহানের গভীর দৃষ্টির ফাঁদে জড়িয়ে গেলো। মধ্যকার দূরত্ব একেবারেই ক্ষীণ। আহানের স্থূলদৃষ্টি হুট করেই ক্রোধ আর ক্রুরতা ছাড়িয়ে কেমন অবাধ্য মলাটে ছেয়ে গেলো। তুরার অধরের উপর রাখা তর্জনীর অবাধ্য বিচরণ শুরু করলো তুরার অধরের চতুর্দিকে অবিরাম।
নিগূঢ় কৃষ্ণাভ নয়নের ঘোর লাগা দৃষ্টিতে তাকাল তুরার চোখে
.
.
.
চলবে ইনশাআল্লাহ

Humu_♥