তুমি আমি দুজনে পর্ব-২৪+২৫

0
693

#তুমি_আমি_দুজনে
#লেখিকা_হুমাইরা_হাসান
পর্ব- ২৪

কাল ক্রমে তুরা অবাক হওয়াও ভুলে গেছে। বিবশ, ব্যগ্র, বিমূঢ়তা আর টানটান অনুভুতিতে মিশ্রিত হয়ে শরীরে নিবিড় কম্পন ধরলো। ক্ষণেই নেত্রপল্লব বন্ধ হয়ে এলো,,অনুভূতির তীব্র বর্ষণে ভার হয়ে যাওয়া আধবোজা চোখ টেনে তাকালো। আহানের নিষ্পলক চোখ তুরার নেত্রেই নিবন্ধিত থাকায় চোখাচোখি হলো দুজনের। বিহ্বল, বিচলিত আর উৎকণ্ঠিত অনুভবে কাঠ কাঠ হওয়া বদনে যেনো এক পষলা বৃষ্টি হয়ে নামলো দুজনের দৃষ্টি বিনিময়। কিয়ৎকাল অপলক দৃষ্টি বিনিমিয়েই যেন তৃষ্ণা মিটলো অশান্ত মনের। আহান চটজলদি চোখ সরিয়ে নিলো। নিজের অবস্থান বুঝে সরে গেলো তুরার উপর থেকে। বালিশটা ঠিক করে থপ করে উপুড় হয়ে শুয়ে পরলো।
কিন্তু তুরা তখনও বক্ষের দূর্লভ জোয়ারের আদ্রতায় সিক্ত , অনুভূতির পুঞ্জিভূত মেঘে প্রগাঢ় ভাবে থমকে আছে। আহান উপুড় হয়ে শুয়ে আছে কোনো প্রকার নড়চড় বিহীন। কিন্ত তুরার দৃষ্টি তখনও স্থির। নিবন্ধিত সিক্ত পুরুষের প্রণয়ী অনুভূতি জাগ্রত করা কর্মকাণ্ডে।
ফোঁস করে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো তুরা,যার ভার আকাশতম বিস্তৃত, যার কোনো ব্যাখ্যা বা বিশ্লেষণ নেই। কেনো বারবার তার কাছে এসে তার শান্ত মনে ঝংকার তুরা প্রলয়ে উচ্ছ্বসিত করে। কেনো তার সিক্ত অনুভূতি গুলোকে বারবার নামহীন বারিধারায় ভিজিয়ে দেয়। তার এমন হুটহাট কাছে আসা আর আকস্মিক স্পর্শ যে তুরার আকাশচুম্বী অনুরাগ চুরচুর করে দেয় তা কি বুঝে না?
নেত্রকোনার গ্লাণি ঝেরে ফেলল অদ্ভুত প্রশ্বাসে। চোখ বুঝে নিভিয়ে দিলো জাগ্রতার সাথে পীড়াদায়ক অনুভূতি গুলোকেও

••••

পুরো বাড়ি জুড়ে অনুষ্ঠানের আমেজ,,ইনসাফের ভাই ইউসুফ মাহমুদ আজ সকালেই এসেছেন তার সহধর্মিণী নাজ কে নিয়ে,,ইনসাফের ছোট বোন ইলা এসেছে সবেমাত্র। সুদূর পথ পারি দিয়ে এসে সকলে বেশ ক্লান্ত হলেও বিয়ে বাড়িতে হাত গুটিয়ে বসে থাকার মত আক্কেলহীন কাজটা করেনি। ইলা, নাজ, মিনু, রুবি সকলে মিলে হাতে হাতে সব রান্না বান্নার কাজ সামলাচ্ছে। বাড়িভর্তি মেহমানে ইনসাফ সকাল থেকে দু দফায় ব্যাগ ব্যাগ ভরে বাজার এনেছে।
আজ রাইমার হলুদ সন্ধ্যা, পুরো বাড়িতে ফুলের মালা,ঝিকিমিকি বাতি,ঝালরে আভিজাত্যসহিত সজ্জিত। দোতালা ডুপ্লেক্স বাড়িটার নিখুত সৌন্দর্য আর ত্বরান্বিত বিয়ের সাজে।

-তনু দেখ না শাড়িটা আমাকে মানাবে তো?

-উফ রুহি,এ দিয়ে পাঁচবার একই কথা বলছিস, সবার জন্য তো মামু একই রকম শাড়ি এনেছে তাহলে আমাদের টা ভালো লাগলে তোর টা কেনো লাগবে না।

-জানিস না এক কথা চৌদ্দ বার না ঘাটলে ওর হয়না। ওর কাহিনি বাদ দে,একটু পরই রাইমা আপুকে হলুদ ছোঁয়াবে ডালা গুলো সব সাজানো হয়েছে তো?

জায়মার কথায় তনু পাশ থেকে ডালাটা তুলে এনে সামনে ধরে বলল

-হ্যাঁ সাজিয়েছি তো সব। তাও একবার দেখে নে না সব ঠিকঠাক আছে কি না।

জায়মা ডালা দুটো ভালো মতো পর্যবেক্ষণ করে বলল

-ওমাহ হলুদ ছোঁয়াবে অথচ এখানে হলুদ বাটাই তো নেই

-আরে হলুদ তো এখনও বাটাই হয়নি। চুমকি গেছে এক্ষুনি নিয়ে আসবে।

-আপু তোমাদের সব হয়েছে? ফুফু আম্মা তাড়া দিচ্ছেন আপুকে নিচে নিয়ে যেতে

চিকন নারী কণ্ঠে জায়মা পিছু ফিরে তাকায়, পাশ থেকে তনু বলে

-উফ ভাবি, তোমকে কতবার বলছি আমাদের নাম ধরেই ডাকো, তুমি বড় ভাবি হয়ে আমাদের আপু ডাকলে কেমন শোনায় বলোতো

তনুর কথায় তুরা মুখটা বিভ্রান্তিকর করে বলল

-কিন্ত তোমরা সবাই ই বয়সে আমার চেয়ে বড়

-কিন্ত সম্পর্কে তুমি আমাদের চেয়ে অনেক বড়। আহান ভাই আমাদের বাড়ির সবার বড় সন্তান। সম্মানে সবার বড়। আর তুমি তার বউ তুমিও ঠিক তততাই বড় সম্মানে

বলেই এগিয়ে আসল। উত্তরে তুরা চুপ করে থাকলে রুহি পেছন থেকে এসে বলল

-ভাবি তুমি শাড়ি পরবা না?

রুহির কথায় তুরা একবার তাকাল নিজের দিকে, আজ সে হলুদ আর সাদার মিশ্রনে একটা চুড়িদার জামা পরেছে। কারণ শাড়ি তো সে পরতে পারবে না,আর কেও পরিয়ে দিলেও সামলাতে একেবারেই পারবে না। শেষে এমন জনসমাগমে যদি মুখ থুবড়ে পরে তাহলে মান সম্মান কিছুই থাকবে নাহ। বাড়ির বউ হয়ে কি না শাড়ি সামলাতে পারেনি এটা বড়ই লজ্জাজনক হবে।

-না শাড়ি একেবারেই সামলাতে পারিনা আমি,অভ্যাস নেই তো

মুখটা ছোট করে উত্তর দিল তুরা,রুহি তুরার পাশে এসে মুখে শয়তানি হাসি নিয়ে মৃদু ধাক্কা দিয়ে বলল

-কেনো,তোমার বর আছে না! সে সামলে নিবে। তোমার শাড়িকেও আর তোমাকেও

বলেই খিলখিল করে হেসে উঠল। রুহির এমন নাক কাটা কথায় তুরা সকলের সামনে লজ্জায় অপ্রস্তুত হয়ে পরল। পরিস্থিতি সামাল দিতে কিছু বলতে নিবে তার আগেই পেছন থেকে বিহানের কথা আসলো

-জায়মা রাই কোথায়, নিচে ডাকছে সবাই। ও বাড়ি থেকে এখনই ইমানের ছোঁয়ানো হলুদ নিয়ে আসবে। ওকে নিয়ে শিগগির নিচে চল

বিহানের কথায় তুরা ফিরে তাকালে, বিহান তুরাকে দেখে বুকে হাত দিয়ে স্বর টেনে টেনে বলল

-আহ্,ভাবিই। এমন লুক নিয়ে সামনে ঘুরলে তো যখন তখন পরে যাবো। আপনার বর এত রূপ সামলাতে পারলেও আমি পারব না তো

বিহানের কথায় তুরা ফিক করে হেসে দিলো। এই মানুষটা বেশ মজার, ওদের সবার থেকে বয়সে আর বুদ্ধিতে বেশ পরিপক্ব হলেও বেশ মজার চরিত্রের,তুরার ভীষণ ভালো লেগেছে সবাইক, আহান যতটা গম্ভীর তার ভাইবোন গুলো ততটাই মজার।

-পরে গেলে যান। তুলার দ্বায়িত্ব কিন্তু আমি নিতে পারব না ভাইয়া

এগিয়ে গিয়ে সামনে দাঁড়িয়ে বলল তুরা

-আহা ভাবি,এত সুন্দর হাসি দিয়ে ঘায়েল করে আবার ভাই বলে কষ্ট দিয়েন নাহ। ইউ ক্যান কল মি হানি

কথা শেষ করার সাথে সাথেই পেছন থেকে রাইমা এসে বিহানের এক কান টেনে ধরে বলল

-খুব শখ নাহ? আমার ভাইয়ের বউয়ের দিকে নজর দেওয়ার খুব শখ হয়েছে তোর দেখি

-আহহ রাই,কি করছিস ছাড়,লাগছে তো!!

-কেনো এতক্ষণ না ঘায়েল হচ্ছিলি, এখন লেগে গেলো

-ভাবি তোমার ননদিনী কে আটকাও কান টা ছিড়ে গেলো আমার।

বলে রাইমার হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বলল

-এই তুই না বউ,বউ হয়ে গুন্ডামি করতে লজ্জা লাগে নাহ। চোখে মুখে তো কোনো লাজ লজ্জার ছাপ ই নেই। তোর মতো গুন্ডারে নিয়ে ইমান যে কি করবে ওই জানে। বেচারা নির্ঘাত অকালে পাগল হবে

বিহানের কথায় রাইমা ঠাস করে একটা চাপড় বসিয়ে দিলো পিঠের উপর। বিহান সবাইকে আবারও নিচে যাওয়ার জন্য তাড়া দিয়ে নিচে গেলো। রাইমাকে একটা কাচা হলুদ রঙের শাড়ি পরিয়ে ফুলের গয়না পরিয়ে হালকা সাজিয়ে নিচে নিয়ে যাওয়ার জন্য উদ্যত হলো সবাই। সবার পরনে হলুদ লাল মিশেলে শাড়ি, ইনসাফ মেয়েদের জন্য একই রকম শাড়ি আনিয়েছে। তুরা না চাইতেও জায়মা আর তনু ওকে জোর করে পরিয়ে দিয়েছে শাড়ি। পরে তো নিলো কিন্তু এটা পরে হাঁটা চলা করবে কি করে।
সাজগোছ শেষ করে সবাইকে নিচে পাঠিয়ে দুই হাতে দুটো ডালা নিয়ে ঘর থেকে বেরোলো তুরা। উপর থেকে একবার নিচে তাকিয়ে দেখল বসার ঘরটা প্রায় ফাঁকা। সবাই গেছে বাড়িত পেছনের ফাঁকা জায়গায়। ওখানেই রাইমার হলুদ ছোঁয়ানোর জন্য স্টেজ সাজানো হয়েছে। নিচের দিকে এক পলক চেয়ে দুটো ডালা হাতে নিয়ে সিড়ি বেয়ে নামতে লাগল।
হাতের ডালা দুটো বেশ ভারি একটা করে আনলেই ভালো হতো বলে মনে হচ্ছে তুরার এখন। হাত লেগে আসছে,পরে গেলে তো সর্বনাশ। খুব সাবধানতার সহিত পা ফেলে সিড়ি বেয়ে নামলেও কাধ থেকে আঁচল টা বেয়ে পরে নিচে গড়াচ্ছে। আস্তেধীরে পা ফেলে সিড়ি বেয়ে নেমে আসতে আসতে গায়ের আঁচল টা একেবারে গড়িয়ে পরেছে,জায়মা তো ভালো মতনই পিন লাগিয়ে দিলো তবুও খুলে গেলো কি করে,এই এসব ঝামেলার জন্যেই তুরার শাড়ি একদম পছন্দ নাহ। এমতাবস্থায় বাইরে যাওয়া ও তো সম্ভব না আর দু হাতেও ডালা। বেশ বিভ্রান্তিকর পরিস্থিতিতে পরল তুরা,এখন কি করবে আশেপাশে তো কেও নেই ও। তুরার এমন অপ্রিতিকর পরিস্থিতিকে আরেকটু বাড়িয়ে দরজা বেয়ে ঘরে ঢুকল আহান। হাতে কতগুলো গিফটের বক্স নিয়ে, ব্যস্ত পায়ে দ্রুতগতি হঠাৎ ই মন্থর হলো। আহানের নেত্রকোনার একদম সম্মুখ বরাবর দাঁড়ানোতুরা, তার বউ। গাঢ় লাল টুকটুকে পাড়ের হলুদ শাড়ি তুরার চিকন গড়নের শরীরের বাঁকে একদম লেপ্টে আছে, ঢিলে খোঁপা করা চুলগুলোতে সরু ফুলের জড়ানো মালা কাধ ছুঁইছুঁই। কাঠ কাঠ হওয়া গলা শুকনো ঢকে ভেজানোর ব্যার্থ প্রয়াস করে বক্স গুলো হাতে নিয়েই এগিয়ে এলো। আহানের এগিয়ে আসাতে তুরার তটস্থতা বেড়ে বুকে দুরুদুরু কম্পন ধরালো৷ গায়ের আঁচল টা একেবারেই বেসামাল হয়ে আছে, এমতাবস্থায় আহানের অপলক দৃষ্টিতে সে একেবারে মিইয়ে যাওয়ার দায়।
আহান আগাগোড়া তুরাকে পরখ করল। ঘন পাপড়ির নেত্রযুগলের বারবার ঝাপটানোর পরেই চোখ গেলো প্রচন্ড অস্বাচ্ছন্দ্যর আঁকিবুঁকিতে ভরা তুরার চেহারায়। ওকে এমন বিব্রতবোধ নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ভ্রু কুচকে তাকাল। আহানের এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে তুরার অস্বস্থি আরও বেড়ে গেলো, এই লোকটা কি আসার সময় পেলো না। এখন কি করবে! এক তো দুই হাত ই জোড়া তার উপর গায়ের আঁচল টাও।।
তুরার ভাবনার মাঝেই আহান তার হাতের গিফট বক্স গুলো নামিয়ে একপাশে রেখে মন্থর গতিতে এগিয়ে আসল তুরার দিকে। আহানের এভাবে এগিয়ে আসা দেখে তুরা দু কদম পিছিয়ে গেলো, এই লোকটা এগিয়ে কেনো আসছে? তুরা আবারও পেছাতে নিলে আহান এগিয়ে একদম সামনে এসে দাঁড়াল তুরার। হাত বেয়ে পরে যাওয়া আঁচল টা নিজ হাতে তুলে পেছন দিয়ে পেচিয়ে মাথার উপর টেনে দিলো। তুরা বিহ্বলিত দৃষ্টিতে হা করে চেয়ে রইল তার সামনে দাঁড়ানো সফেদ পাঞ্জাবী পরিহিত শুভ্র পুরুষের দিকে। আহান তুরার শাড়ির গায়ে বিঁধে থাকা পিনটা ভালো করে লাগিয়ে দিয়ে,এক পলক পর্যবেক্ষণ করল সবটা। তুরা আহানের গভীর মনোযোগী হয়ে তার দিকেই পরখ করা দেখে নিষ্পলক চেয়ে রইল। ভাবনা ভঙ্গুর হলো আহানের কথায়

-যেটা সামলাতে পারো না ওটা পরতে যাও কেনো ষ্টুপিড!

বলেই গিফট বক্স গুলো আবারও হাতে তুলে গটগট করে সিড়ি বেয়ে উপরে উঠে গেলো। আহানের যাওয়ার পানে তুরা হা করে তাকিয়ে বলল

-পাগল নাকি লোকটা আজব, ষ্টুপিড!

আহানের মতো করে বলে মুখ ভেংচি দিয়ে আবারও হাটা ধরল। বাইরে বড় করে স্টেজ সাজানো হয়েছে, ফুল ঝারবাতি, ঝালর দিয়ে সাজানো স্টেজ চোখ ধাধানোর মতো সুন্দর,,আজ আশপাশে মেহমানের সমাগম। রুবি মিনু রান্নাবান্নার দিকটা দেখে বাড়িতে আসা মেহমানদের সাথে সৌজন্য সূলভ কথাবার্তায় ব্যস্ত। তুরা ডালা হাতেই এগিয়ে যাওয়ার সময় পাশ থেকে রুবির ডাকে এগিয়ে গেলো। দুজন ভদ্রমহিলা দাঁড়ানো, তুরা যেতেই রুবি বলল

-ও হলো তুরা,আমার আহানের বউ

তুরা ভদ্রমহিলার দিকে তাকাল। এজীবনে দেখেছে বলে মনে হয়না তবুও ভদ্রতার খাতিরে সালাম দিলো, মহিলা সালামের উত্তর দিয়ে বলল

-ওমা কি সুন্দর বউ এনেছ রুবি। তবে আহানের বয়সের তুলনাই একটু বেশিই ছোট,তা তুমি কোন ক্লাসে পড়তা তুরা?

পাড়ার মহিলাদের মতো খোঁচা যে একটা দিলো সেটা তুরা বেশ বুঝতে পারছে, তবুও হাসি বহমান রেখে উত্তর দিবে তার আগেই পাশ থেকে মিনু ফুফু বলল

-ও আহানের তুলনাই বেশিই ছোট তা আপনাকে কে বলল আপা। আপনি কি আদও ওর বয়স জানেন না আমার বাবুর, আর ও অনার্স ফার্স্ট ইয়ারে পরে একেবারেই বাচ্চা নয়।

-ওহ আচ্ছা, না ঠিকই আছে।

কাচুমাচু মুখে বলল উপস্থিত মহিলা। মিনু ফুফুর ঝাঝালো গলায় মহিলার দমে যাওয়া দেখে তুরা ঠোঁট টিপে হাসলো তখনই পেছন থেকে তনুর ডাক শুনে রুবিকে উদ্দেশ্য করে বলল

-ওখানে ডাকছে মা, আমি আসি

বলেই হাঁটা ধরল। স্টেজ এ আগে থেকেই হরেক রকমের সাজানো ডালা, আর থাল রাখা। তার পাশে হাতের দুটো রেখে দাঁড়াল তুরা।

-আহ ভাবি,যতবার দেখছি ততবারই প্রেমে পরে যাচ্ছি যে,,এভাবে বেশিক্ষণ চললে আহান ভাইরে বড়সড় একটা তকমা দিয়ে আপনারে নিয়েই চলে যাব কিন্তু

বিহান আবারও স্বভাব সুলভ টুসকি মারা শুরু করল তুরাকে,এবার বিহানের কথার পৃষ্ঠে আরমান বলল

-না না,ভাবি বলছে আমার সাথে একটা রোমান্টিক গানে ডান্স দিবে,তার আগে কোত্থাও যাওয়া নাই।

-তোরা দুটোই মুখ বন্ধ রাখ তো। আমায় ছবি তুলতে দে

জায়মা ক্যামেরা হাতে ধরে বলল। জায়মাকে ছবি তুলতে দেখে বিহান এগিয়ে এসে তুরার পাশে দাঁড়িয়ে বলল

-আগে আমার আর আমার অল্প বউয়ের ছবি তোল তোহ। দেখ শাড়ির সাথে আমার পাঞ্জাবী টাও ম্যাচেড হয়ে গেছে

বলেই তুরার পাশে দাঁড়াল। জায়মা বিহানের ছেছড়ামু দেখে কপাল চপড়ে ওদের সামনে ক্যামেরা ধরলেও তৎক্ষনাৎ লেন্স থেকে চোখ তুলে গোলগোল চোখ করে তাকাল বিহান আর তুরার দিকে। বিহান জায়মার এমন অভিব্যক্তি দেখে কপাল জড়ো করে বলল

-কি হলো, ছবি না তুলে হ্যাবলাকান্ত টাইপ লুক দিয়েছিস ক্যান!

জায়মা এক ভ্রু উচিয়ে তুরা আর বিহানের পেছনের দিকে ইশারা করলে ওর দৃষ্টি অনুসরণ করে পেছনে তাকাতেই দেখল আহান ভীষণ ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে চেয়ে আছে ওদের দিকে। মিষ্টির প্যাকেট গুলো নিয়ে এদিকেই আসছিল আহান। বিহানের এমন উস্কানিমূলক কথায় দাঁড়িয়েছিল। তুরা আহানের এমন ক্রুর দৃষ্টি দেখে খানিকটা ভড়কে গিয়ে সরে দাঁড়াল। বিহান আহানের চড়া মেজাজ বুঝেও ওকে আরেকটু ঘেটে দেওয়ার জন্য বলল

-আরে আহান, আই আই। তুই তো দুর্দান্ত ফটোগ্রাফি করিস,আমার আর আমার অল্প বউয়ের পিক তুলে দে তো

বলেই জায়মার হাত থেকে ক্যামেরা টা নিয়ে আহানের হাতে ধরিয়ে দিয়ে আবারও তুরার পাশে দাঁড়াল। পাশ থেকে রুহি ভ্রু কুচকে জিজ্ঞাসা করল

-কিন্ত অল্প বউ আবার কি?

-আরে দেবর হওয়ার খাতিরে আমারও হক আছে ভাবিকে বউ বলার,কিন্তু এই জলজ্যান্ত আপদ টা তো আছেই অলরেডি ওর বর হয়ে তাই পুরোপুরি বউ বানাতে পারছি নাহ,দ্যাটস হোয়াই অল্প বউ।
এখন তোদের পেচাল বাদ রাখ আমারে সুন্দর করে কাপল পিক তুলতে দে।

বলেই তুরার দিকে তাকিয়ে বলল

-ভাবি আপনি চাইলে কিন্তু আমার হাত ধরেই দাঁড়াতে পারেন,,আফটার অল আপনারই তো সব

বলেই চোখ টিপে দিলো। তুরা বিহানের কথায় মেকি হাসলেই আহানের দিকে তাকিয়ে থমকে গেলো। প্রচন্ড ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে চেয়ে আছে ওর দিকেই। এই লোকটা যে আবারও তার সাথেই হম্বিতম্বি করবে এ ব্যাপারে তুরা একদম নিশ্চিত। আহান কিছু বলতে নিবে তার আগেই তুরা সরে এসে বলল

-আ আসলে আমাকে ফুফু আম্মা ডেকেছিল। আমি আসি

বলেই তাড়াহুড়ো করে স্টেজ থেকে নেমে আসলো। ওখানে আর এক মুহূর্ত থাকলে জল্লাদ লোকটা সবার সামনেই আবারও যা তা বলত। ভীষণ ব’জ্জাত লোকটা, উনার সামনে না থাকাই ভালো। বিড়বিড় করতে করতে তুরা দ্রুত পায়ে হাঁটছিল এর মাঝেই কিছু একটার সাথে ধাক্কা লাগতেই ছিটকে গেলো। কপালে হাত দিয়ে সামনে তাকাতেই কপালে অজস্র ভাজ পরল সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটাকে দেখে।
.
.
.
চলবে ইনশাআল্লাহ

Humu_♥

#তুমি_আমি_দুজনে
#লেখিকা_হুমাইরা_হাসান
পর্ব-২৫

-হেই সুইটি,তুমি এখানে!!

সামনে দাঁড়ানো ছেলেটা হাস্যজ্বল চেহারা নিয়ে বেশ উচ্ছ্বসিত হয়ে বললেও তুরা এখনও বিমূর্ত চোখে তাকিয়ে হতভম্বিত হয়ে বলল

-আপনি? এখানে?

-হ্যাঁ আমিতো আসবই, কিন্তু তুমি এখানে যে

কৌতুহলী স্বরে জিজ্ঞাসা করলেও,উত্তরের সুযোগ না দিয়েই পরমুহূর্তেই আবারও বলল

-এক মিনিট, এটা তোমার বাড়ি? তাইলে তুমি কি ভাবির বোন?

সিফাতের ভ্রু যুগল জড়ো করে জিজ্ঞাসা করা প্রশ্নে তুরা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গেলো, এখন সে কি উত্তর দিবে? এই ছেলে তো তারই ভার্সিটির সিনিয়র তাইলে আহানেরও স্টুডেন্ট। তুরা পরল মহা ফ্যাসাদে, এই ছেলেটাকে এখন এখানে আসতে কে বলল! যত্তসব ঝামেলা কি তার উপরেই আসতে হয়। তুরা সিফাতকে উদ্দেশ্য করে কিছু বলবে তার আগেই পেছন থেকে রুহি তুরার হাত ধরে বলল

-তুমি এখানে কি করছ বলোতো? ওদিকে রাই আপুর হলুদ ছোঁয়ানো শুরু হয়ে গেলো,শিগগির চলো!

বলে তুরার হাত ধরে টেনে নিয়ে গেলো স্টেজ এর দিকে। রুহি সিফাতকেও খেয়াল করেনি,আবার তুরাও কিছু বলার সুযোগ পেলোনা। তুরাকে টেনে নিয়ে যাওয়ার পানে কিছুক্ষণ হা করে চেয়ে রইল সিফাত। কাধের উপর কারো হাতের স্পর্শ পেয়ে ঘুরে তাকাতেই অতি পরিচিত চেহারা দেখে এক ফালি হাসল

-তোকে কখন থেকে খুঁজছি আর তুই এখানে দাঁড়িয়ে কি করছিস বল তো

ফারিনের কথায় সিফাত ভাবাবেগ তাড়িত করে বলল

-ও কিছুনা, আচ্ছা ভাবির কি কোনো বোন আছে?

সিফাতের কথায় ফারিন বেশ ভাবুক মুখ করে বলল

-আমিতো জানি রাইমার একটাই ভাই আছে,আহান। কিন্তু তুই হঠাৎ এই প্রশ্ন করছিস যে!

-ও না কিছুনা,চলো ফারু কই?

-ওর বাবার সাথে আসছে চল

বলেই সিফাতের সাথে স্টেজের দিকে গেলো।
সন্ধ্যা গড়িয়েছে বেশ অনেক্ষণ আগেই, নিকষ কালো আধারে ডুবন্ত ধরণীর এ নিত্যকর্মসূচিতে ইনসাফ মাহবুব এর বাড়ির পেছন টা একেবারে জ্বলজ্বল করছে হরেক রঙের আলোতে। ফুল,মালা,ঝালর, মরিচবাতি সহ নানা রকম আলোতে একদম ঝিকিমিকি হয়ে আছে পরিবেশ। রাইমার হলুদ ছোঁয়ানোর পর্ব শুরু হতেই সকলে স্টেজের সামনে জড় হলো। হলুদ ছোঁয়ানো শুরু করল রাইমার বাবা মা ইনসাফ আর রুবি, মেয়েকে হলুদ দিয়ে,মিষ্টি মুখে দিয়ে প্রাণ ভরে দোয়া করল দুজনে। বাবা মায়ের হলুদ ছোঁয়ানো হলে একে একে আমেনা খাতুন, মিনু, রাইমার চাচা চাচী ইউসুফ আর নাজ সাথে ফুফু ইলা সবাই কালক্রমে পরপর ছুঁয়ে দিলে এবার বাকিদের পালা আসলেই আমেনা খাতুন বলল

-আহান,এবার তুমি রাইমাকে হলুদ ছুঁয়ে দাও দাদুভাই

-আবার আমি কেনো দিদুন,থাক না তোমরাই দাও

বেশ অনিহা ধরা গলায় বললেও আহানের কথাকে অগ্রাহ্য করে মিনু বলল

-তা বললে তো হবে না,তুই ওর ভাই ও তুই না দিলে কি করে হবে, কোনো কথা না বস তুই

মিনুর করা আদেশে আহান আর দ্বিরুক্তি না করে রাইমার পাশে বসলেই মিনু আহানকে থামিয়ে বলল

-দাঁড়া বাবু, এই যে তুমি বসো আহানের পাশে

-আমি!!

বেশ অবাক হয়ে বলল এক কোণায় দাঁড়িয়ে থাকা তুরা,মিনু ওকে উদ্দেশ্য করে আবারও বলল

-হ্যাঁ অবশ্যই তুমি, বাবু যেমন রাইমার ভাই তুমিও তো ভাবি৷ এভাবে এক কোণায় থাকলে কি করে চলবে,বাবুর ওই পাশটাই বসো গিয়ে দুজন একসাথেই হলুদ ছোঁয়াবে

মিনুর কথায় তুরাও দ্বিরুক্তি করার সাহস করল না,,হাজারো অনিচ্ছা সত্ত্বেও চুপচাপ রাইমার অপর পাশে বসে, মিনুর কথামতো এক সাথেই হলুদ ছোঁয়াল দুজনে। রাইমা বাটি থেকে হলুদ নিয়ে তুরা আর আহানের গালে লাগাতেই আহান উঠে দাঁড়িয়ে বলল

-উফ আপি,,কি করছিস, আই ডোন্ট লাইক টারমেরিক

-বিয়ের হলুদ ছোঁয়ান ভালো, না তো তোর মাঝে তো বিবাহিত টাইপ কোনো ভাইব ই নেই

-বিবাহিত ভাইব লাগবে নাহ আমার,ডিসগাস্টিং

বলেই উঠে হনহন করে স্টেজ থেকে নেমে গেলো আহান। আহান যেতেই তুরা ফিক করে হেসে দিলো,এতক্ষণ বড় কষ্টে আটকে রেখেছিল। বেশ হয়েছে, গোমড়ামুখো টারে আরও হলুদ মাখানো উচিত ছিল। রুহি আর তনু মিলে বসে রাইমার সাথে সেলফি তুলছিল এমন সময় ইউসুফ মাহমুদ এসে বললেন

-তোমাদের হলো গো? বরের বাড়ির লোকেরাও তো অপেক্ষা করছে

ইউসুফ মাহমুদ এর কথা শুনে নিজেদের হট্টগোল থামিয়ে তাকাতেই দেখল তার পাশেই মারুফ চৌধুরী, একটা অল্প বয়সী মেয়ে,তার পাশেই দাঁড়িয়ে আরেকটা লোক যার কোলে বছর দুয়েকের একটা বাচ্চা,আর সিফাত নামের ছেলেটা। কৌতুহলে তুরার কপালের ভাজ আরও গাঢ় হওয়ার আগেই ইউসুফ পরিচয় করিয়ে দিয়ে বলল

-মারুফ চৌধুরী কে তো নিশ্চয় চেনো ইমানের চাচা, আর এ হলো ফারিন ইমানের বউ আর পাশে দাঁড়ান..

-থাক না আংকেল আমরা নিজেরাই গ্রেটিং করে নিব।আর এদের সাথেই তো হবে আসল পরিচয় আফটার অল ইমানের শালা-শালী বলে কথা

বাচ্চা কোলে থাকা ভদ্রলোক টা ইউসুফ কে থামিয়ে বলল। মেয়েটি এগিয়ে এসে রাইমার পাশে বসে বলল

-আমায় চিনতে পেরেছ? আমি ইমানের বড় বোন ফারিন

-জ্বি আপু,আমি চিনতে পেরেছি।

রাইমার কথার সাথে সাথে ফারিনের স্বামী এসে পাশে বসে বলল

-তাহলে তো আমাকে আরও আগে চেনা উচিত, আমি তোমাদের একমাত্র দুলাভাই,আর এটা আমাদের মেয়ে ফারু

ফারিন আর তার স্বামী ইমতিয়াজ কিছুক্ষণ রাইমা সহ বাকিদের সাথেও কথা বলে পরিচিত হয়ে নিল। রাইমার গায়ে হলুদ ছুঁয়ে দিয়ে ওর জন্য আনা গিফট গুলো একে একে সব হাতে দিল। ওরা উঠতেই মারুফ চৌধুরী এসে রাইমার জন্যে আনা গিফট গুলো রাখতেই পেছন থেকে আরও একটা কন্ঠের কথা শোনা গেলো

-ভাবি স্মাইল প্লিজ

রাইমা তাকাতেই ফট করে একটা ছবি তুলে নিলো সিফাত, মুখের হাসি আরও প্রসারিত করে এগিয়ে এসে বলল

-ভাবি, আই এম ইউর ওয়ান এ্যন্ড অনলি দেবর,সিফাত। আপনার সাথে আমার আজই প্রথম পরিচয়

-পরিচয় প্রথম হলেও আমি কিন্তু তোমাকে চিনি সিফাত

-তাই না?

বলেই একটা শয়তানি হাসি দিলো সিফাত,রাইমাও উত্তর সুলভ হাসি দিলে ফারিন এসে বেশ অনেক্ষণ গল্প করল সবার সাথে। ওরা যাওয়ার জন্য উদ্যত হলে জায়মা তনু রুহি ওরা আবারও হলুদ মাখামাখি শুরু করল, তুরার মুখে অনেক বেশি মেখে যাওয়ার ও সরে আসল ভীড় ঠেলে। চোখের মধ্যেও কিছু একটা পরেছে হয়তো, তাকাতে পারছে না। চোখ বন্ধ রেখেই কয়েকবার ডাকল রুহি আর তনুকে,,ওদের উত্তর না পেয়ে জায়মাকে ডাকলে তার থেকেও উত্তর আসলো না। সবাই হলুদ নিয়ে খেলতে ব্যস্ত হয়ে গেছে। তুরা এক চোখ কোনো মতে খুলে ঝাপসা ঝাপসা দৃষ্টিতে এগিয়ে যেতে লাগলে তখনই সিফাত এসে বলল

-তুরা, এ্যানি প্রবলেম?

তুরা চোখ খুলে তাকানোর চেষ্টা করলেও জ্বলনের জন্য খুলতে পারল না,আরেক চোখে হালকা ঝাপসা দৃশ্যমান হলো সিফাতের চেহারা টা

-আপনি কি একটু ওদের কাওকে ডেকে দিতে পারবেন প্লিজ,আমার চোখে হলুদ ঢুকেছে মনে হয় খুব জ্বলছে

-আচ্ছা আমি এক্ষুনি ডেকে দিচ্ছি

বলে এগোতে নিলেও তুরা অন্ধকারে কিছু একটার সাথে গুতা লেগে ছোট্ট আর্তনাদ করে উঠল। সিফাত এগিয়ে এসে বলল

-তুরা ঠিক আছো? কোথায় লেগেছে?

-আমি ঠিক আছি,আপনি ওদেরকে তাড়াতাড়ি ডেকে দিন প্লিজ আমার চোখ খুব জ্বলছে

তুরার কথায় সিফাত এদিক ওদিক তাকালে পাশেই টেবিলের উপরে একটা পানির বোতল দেখে ছুটে গিয়ে সেটা এনে তুরাকে বলল

-আমি পানি এনেছি তুমি চোখে মুখে দাও

তুরা হাত পাতলে সিফাত বোতল খুলে পানি দিলে কয়েকবার চোখে মুখে ঝাপটা দেওয়ায় জ্বলন টা কমে আসে তুরার, টিপটিপ করে চোখ খুলে তাকালে সিফাতের বিচলিত চেহারা টা স্পষ্ট হলো।

-এখন বেটার ফিল করছ?

সিফাতের কথায় তুরা মৃদু ঘাড় নাড়িয়ে সম্মতি দিলো৷ সিফাত তুরার গালের দিকে ইশারা করে কিছু একটা দেখাল,তুরা কিছু বুঝতে না পারলে সিফাত হাত দিয়ে থামিয়ে পানির বোতল টা রেখে পকেটে থেকে টিস্যু বের করে তুরার মুখে লেগে থাকা হলুদ টা মুছে দিয়ে বলল

-নাও পারফেক্ট

~~

-আরে বিহান আমাকে নিয়ে যাচ্ছিস কোথায়?

-চুপ করে থাক। গেলেই দেখতে পাবি

হলুদ ছোঁয়ান পর্ব শেষ হতেই ফারিন মারুফ চৌধুরী সহ বাকিরা বিদায় নিতেই,বিহান রাইমা কে নিয়ে এসেছে বাগানের দিকটাই।এই অন্ধকারে বাগানে কেনো নিয়ে আসল বিহান রাইমা এটাই বুঝতে পারছে নাহ। বাগানের এক কোণায় রাইমাকে দাড় করিয়ে বিহান বলল

-তুই এখানে দাঁড়া আমি আসছি

বলেই রাইমাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই হনহন করে বেড়িয়ে গেলো সেখান থেকে। এখন এই অন্ধকারে রাইমা একা কি করবে? এই বিহান টা কি পাগল হয়ে গেছে, মিনিট খানেক দাঁড়িয়ে থেকে রাইমা বিরক্ত হয়ে চলে যেতে নিলেই পেছন থেকে হাতে টান পরল৷ পেছন ফিরে তাকানোর আগেই কেও এক টানে বুকের মাঝে ফেলল রাইমাকে। আকস্মিক আক্র’মণে হতবাক হয়ে রাইমা কিছু বুঝার আগেই চেপে ধরল আগন্তুক। ভয়ে রাইমার হাত পায়ে কম্পন ধরেছে, বাকরুদ্ধ হয়ে সরে আসতে নিলেই আরও চেপে ধরে ফিসফিসিয়ে বলল

-উহু,সরে কেনো যাচ্ছ রাই, দুটো বছরের তৃষ্ণার্ত, দু মিনিট তো বুকে থাকো

অন্ধকার বাগানে টিমটিমে আলো আসছে বাইরে থেকে,, তার মাঝে আকস্মিক কারো ঝাপটে ধরায় তুরা ভয় পেলেও হৃদয় শীতলকারী ভরাট কণ্ঠস্বরে এক মুহূর্তের জন্য থমকে গেলো রাইমা। জমে বরফ হয়ে গেছে সারা শরীর। তার ভালোবাসা, তার এতদিনের অপেক্ষা, যার সাথে আজ রাত বাদে কাল বিয়ে তাকে কি না রাইমা এখনো সচক্ষে দেখতে পারেনি। দুটো বছর কি কম? এতদিনে আসার সময় হলো?
নিগূঢ় অভিমানে কপোল ভিজে গেলো রাইমার। এতক্ষণে আসার সময় হলো? বলবে না সে কথা। ফট করে এক ধাক্কা দিয়ে ইমানকে সরিয়ে চলে আসতে নিলে আবারও ইমান ওকে আটকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরল। কাধে থুতনি রেখে বলল

-খুব অভিমান হয়েছে রাইপাখি? আমি সরি তো। অনেক চেষ্টা করেছি কিন্তু গ্রাজুয়েশন কমপ্লিট হওয়ার আগে কোনো ভাবেই আসার সুযোগ হয়নি

রাইমা কোনো উত্তর হীনা নিঃশব্দে কেঁদে ভাসাচ্ছে, ইমান জানে তার প্রেয়সীর এ অভিমান কি করে ভাঙাতে হয়, পেছন থেকে ছেড়ে দিয়ে বলল

-আমি তোমার জন্যেই এসেছি রাই, এতদিন বাদে এসে কেমন চোরের মতো লুকিয়ে শালাকে হাত করে তোমায় দেখতে এসেছি আর তুমিই এমন চুপ করে আছো?

রাইমা তবুও নিশ্চুপ, শুধু ফুঁপিয়ে কাঁদার শব্দটাই কানে আসছে, ইমান রাইমার আরেকটু কাছে এসে বলল

-একবার জড়িয়ে ধরবে না রাই? চলে যাব?

ইমান তার কথা শেষ করার সাথে সাথে রাইমা পেছন ঘুরে ঝাপটে ধরল ইমানকে, বুকে মুখ গুঁজে সশব্দে কেঁদে দিলো। ইমান মুচকি হেসে ওকে আরও নিবিড় ভাবে জড়িয়ে নিলো। অবশেষে তাদের এতদিনের অপেক্ষা ভালোবাসা পরিপূর্ণতা পাবে, বুকের ভেতরে হৃদয় শীতলিকরণ অনুভূতিদের খেলা শুরু হয়েছে, শান্তি লাগছে। গাল আরও প্রসারিত করে নিবিড় বন্ধনে জড়িয়ে রাখল রাইমাকে

~

-আপনি কি করছেন,ছাড়ুন আমার লাগছে

তুরার কথাকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে আহান গটগট করে হেঁটে টেনে নিয়ে যাচ্ছে তুরার হাত ধরে। গালের হলুদ ধুতে ঘরে গেছিল আহান। মুখ ধুয়ে বেরিয়ে স্টেজের দিকে আসতেই এক পাশে দাঁড়িয়ে সিফাতকে তুরার গালে হাত দিতে দেখেই মাথায় খু’ন চড়ে গেছে আহানের, রক্তচক্ষু নিয়ে এগিয়ে গিয়ে তুরাকে কিছু বলতে না দিয়েই হাত ধরে টেনে হিচড়ে বাড়ির ভেতর নিয়ে এসেছে।

-আমার লাগছে,ছাড়ুন আমাকে

টেনে সিড়ি বেয়ে উপরে উঠে গেলো আহান, ঘরের মধ্যে এসে তুরাকে ছেড়ে ধড়াম করে দরজা বন্ধ করে দিলো। ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল তুরার দিকে, তুরা আহানের ধরা জাগায় হাত দিয়ে দেখল লাল হয়ে গেছে, ব্যথায় চোখে পানি এসে গেছে তার।আহানের চোখের দিকে তাকাতেই তুরার শরীর জমে এলো, নাকের পাটা লাল হয়ে গেছে, কপালের রগ গুলো ফুলে স্পষ্ট দৃশ্যমান, কপাল বেয়ে দুফোঁটা ঘাম টপকে পরল, গলার শিরার সাথে কম্পমান কণ্ঠনালির উঠানামা সবটা পরখ করে তুরা তাকাল আহানের ক্রুদ্ধ অগ্নিশর্মা হওয়া চোখে। শুকনো ঢক গিলে আমতাআমতা করে বলল

-আ’আপনি আমাকে এভাবে কেনো আনলেন, ওখানে..

পুরোটা শেষ করার আগেই আহান ঝড়ের বেগে এসে তুরাকে দেওয়ালের সাথে চেপে ধরল। দু’হাত তুরার হাতে চেপে দেওয়ালের সাথে মিশিয়ে ধরে বলল

-ওখানে কি করছিলে তুমি,কি করছিলে হ্যাঁ?ওই ছেলের সাহস কি করে হলো তোমাকে স্পর্শ করার, তোমাকে বলেছি না দূরে দূরে থাকতে, তবুও সাহস কি করে হলো তোমার? চুপ করে আছ কেনো এ্যান্সার মি ড্যাম ইট!!

আহানের ভীষণ রাগী কন্ঠস্বরে বজ্রপাতের মতো কেঁপে উঠল তুরা, আধবোজা চোখ তুলে তাকাল আহানের রাগে টলমল হওয়া চোখে, সারা শরীরে রাগে রীতিমতো কম্পন ধরেছে আহানের,সেই সাথে চেপে ধরে রাখা তুরার, কণ্ঠনালীতে সব শব্দ আটকে গেছে, মুখ খুলে কিছু বলার নূন্যতম প্রচেষ্টাও অপব্যয়িত।
তুরার নিরুত্তর থাকা আহানের রাগে আগুনে ঘি ঢালার মতো প্রতিক্রিয়া দিলো। তুরাকে ছেড়ে দিয়ে পাশে থাকা কাঁচের জগ টা এক আছাড়ে ছুড়ে ফেলল৷ কাঁচ ভাঙার বিকট শব্দে কেঁপে উঠল তুরা, দুহাত কানে চেপে ধরে কেঁদে দিল। আহান আবারও তুরার কাছে এসে দাঁড়ায়, দুজনের মাঝে এক সুচ সমান ব্যবধান নেই, রাগে উত্তপ্ত হওয়া আহানের শরীরে তুরার শরীর লাগতেই ঝংকার তুললো সারা বদনে। আহান তুরার মুখের একদম কাছাকাছি মুখ এনে হিসহিসিয়ে বলল

-আ’ম ওয়ার্নিং ইউ ফর দ্যা ভেরি লাস্ট টাইম, ফারদার যদি তোমার আশেপাশেও কোনো ছেলে দেখি, আমার চেয়ে খারাপ কেও হবে নাহ, এ্যন্ড আই মিন ইট!

কথার সাথে উষ্ণ গরম শ্বাস তুরার সারা মুখে আঁছরে পরল,কাঁপা কাঁপা ঠোঁটে কিছু বলতে যাবে তার আগেই আহান ওকে ছেড়ে পা বাড়াতে নিলে পেছন থেকে আহানের হাত ধরে বলল

-আমার কথাটা শুনুন আমি…

তার আগেই আহান এক ধাক্কায় তুরাকে ফেলে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে, আহানের যাওয়ার পানে চেয়ে তুরা সশব্দে কেঁদে দিল, উঠে দাঁড়িয়ে আবারও পা বাড়াতে নিলে পায়ের নিচে জগের ধ্বংসাবশেষ কাঁচের টুকরো বিধে ঢুকে গেল,,মৃদু চিৎকার করে আর্তনাদ করে উঠল তুরা
.
.
.
চলবে ইনশাআল্লাহ

Humu_♥