তুমি আসবে বলেছে হৃদয় পর্ব-০৯

0
197

#তুমি_আসবে_বলেছে_হৃদয়
#পর্ব-৯
#মেঘলা_আহমেদ

-” আমার দাদুভাই কে বিয়ে করবি রিদিশা? আগলে রাখতে পারবি আমার এরিক দাদু ভাই কে?

কথাটা ডায়নিং টেবিলে যেন ছোটখাটো বিষ্ফো’রণ ঘটালো। দাদুকে বেশ স্বাভাবিক দেখা গেল। রিদিশা কেবল খাবারের লোকমা মুখে দিচ্ছিলো, এই কথা শুনেই লোকমা হাত থেকে পড়ে গেল। রিদিশা বিষ্ফোরিত নয়নে মিসেস ময়ূরী তাহসান এর দিকে তাকান। তার মনে হচ্ছে ভূমি কাঁপছে চারপাশে। চারপাশে ঘূর্ণিঝড়, সিডর, আইলাসহ সব বয়ে যাচ্ছে। এরিক হতভম্ব হয়ে গেছে দাদির কথায়। সে কখনো ভাবেনি তার দাদি এভাবে বিয়ের প্রস্তাব দিবে। যার জন্য সে এত সময় অপেক্ষা করলো, আর দাদি এক কথাতেই বলে দিল? এরিক হাত ধুয়ে কোনদিকে না তাকিয়ে সদর দরজার দিকে যেতে থাকে। রিদিশা নিজেও হতভম্বের মত এরিকের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে আছে। মুখ থেকে কোন কথা বের হচ্ছে না। মিসেস ময়ূরী তাহসান গলা উঁচিয়ে এরিক কে বললেন-

-” আরে দাদুভাই কই যাস? লজ্জা পেয়েছিস নাকি?

এরিক কোন কথার জবাব দিল না। সে হনহনিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল। এখানে থাকলে রিদিশা তাকে খু|ন করবে সিউর। এলেন ফোকলা দাঁতে হাসলেন। রিদিশার দিকে তাকিয়ে বললেন-

-” বুঝলে দাদুভাই, আমার নাতিটার একটু লজ্জা বেশি।

রিদিশা এরিকের দাদুর কথায় বোধহয় সবথেকে বেশি অবাক হলো। এরিক নাকি লাজুক? এই কথা পৃথিবীর সবাই মিলে কিংবা এলিয়েন গোষ্ঠি এসে বললেও রিদিশা বিশ্বাস করবেনা। ময়ূরী রিদিশার দিকে তাকিয়ে বলল-

-” কি হলো রিদিশা উত্তর দিলে না যে দিদিভাই? এরিক কে কি তোমার পছন্দ না?

রিদিশা কি বলবে মাথা কাজ করছেনা। এরিক কে সে বিয়ে করবে? সিরিয়াসলি? এই ছেলের সাথে সারাজীবন থাকা সম্ভব না। রিদিশা মুখ তুলে তার প্রথম যুক্তি দাড় করিয়ে বলল-

-” দেখো গ্র্যান্ড মা এখনে পছন্দ অপছন্দের বিষয় আসছে কেন? তুমি কি জানো না এরিকের চেয়ে আমি তিন বছরের সিনিয়র! ওকে বিয়ে করা অসম্ভব!

রিদিশা আশার আলো নিয়ে তাদের উত্তরের অপেক্ষায় তাকিয়ে আছে। মিসেস ময়ূরী মৃদু হেসে বললেন-

-” এখানে ছোট বড় এর প্রশ্ন আসছে কেন? আর যখন তুমি বয়সের প্রসঙ্গ টানছো তখন বলবো আমাদের ধর্মে জায়েজ আছে বয়সের ব্যবধানে এভাবে বিয়ে করা। যদিও আমরা তার মত মহামানব নই তবুও বলি, আমাদের নবী হযরত মুহাম্মদ (সা) কিন্তু তার চেয়ে বয়সে অনেক বড় নারীকে জীবনসঙ্গী নির্বাচন করেছিলেন। তাদের কি অশান্তি ছিল? তাদের মধ্যে যে প্রেম মোহাব্বাত ছিল তেমন জুটি বিরল। তাই বয়সের প্রসঙ্গ টেনো না এখানে।

রিদিশা অস্বস্তি ফিল করছে। এলেন হা করে মুগ্ধ হয়ে ময়ূরীর কথা শুনছে। আজ এই বয়সে এসেও ময়ূরীর বলা প্রতিটা কথায় সে ছন্দ খুঁজে পায়। রিদিশা জোড় দিয়ে বলে-

-” আচ্ছা মানলাম বয়সের প্রসঙ্গ আর টানছিনা। কিন্তু আমি এরিক কে কখনো ঐ চোখে দেখিনি। ওকে বিয়ে করা আমার পক্ষে অসম্ভব। ওর সাথে আমি এক মিনিট ও থাকতে পারবো না। ওর সাথে আমার একটুও বোনে না। সারাক্ষন ঝগড়া লেগে থাকে। সেখানে সারাজীবন থাকার কথা মানেই ইম্পসিবল !

মিসেস ময়ূরীর মুখটা কালো হয়ে গেল। সে চোখের চশমাটা খুলে চোখের পানি মুছলেন। কন্ঠ খাদে নামিয়ে শুদ্ধ বাংলায় বললেন-

-” দেখো রিদিশা। এই তিনটা বছর ধরে তোমাকে আমি চিনি। আমি তোমাকে আমার নিজের নাতনির মত ভালোবেসেছি। তুমি আমার বান্ধবীর নাতনি। তোমার উপর আমি কোন কিছু চাপিয়ে দেবো না। আসলে এরিক গত দু’বছর ধরে তোমাকে ভালোবাসে। এমন একটা দিন নেই ছেলেটা তোমার খোঁজ নেয়নি। তোমাকে প্রথম দেখে তার ভালো লাগে খুব। আমার মুখে তোমার গল্প শুনে সে তোমার প্রতি দুর্বল হয়ে পড়ে। আমার নাতি আমার কাছে আবদার করে বসে তার তোমাকে চাই। তখন এই বয়সের ব্যাপার টা নিয়ে আমি অনেক তর্ক বিতর্ক করেছি। কিন্তু সে আমায় কতশত যুক্তি দিয়ে হারিয়ে দিল। তার লক্ষ্যই এখন নাকি তোমাকে ভালোবাসা‌। তারপর আমিও সায় দিলাম। আমাদের যত কথা হতো সব তোমাকে নিয়েই। আমার নাতিটা কখনো কোন মেয়ের দিকে তাকায়নি। সে মেয়েদের সঙ্গ পছন্দ করতো না। প্রথমবার তোমাকে মুখ ফুটে যখন চাইলো আমি না ফিরিয়ে দিতে পারিনি। তার পুরো পৃথিবী উল্টে গেলেও তোমাকে চাই। এই যে অফিসে জয়েন করা, সবটা তোমার জন্যেই। নিজের পড়াশোনা শেষ করেই তোমাকে পাওয়ার জন্য এরিক ম|রিয়া হয়ে উঠেছে। তুমি ওর প্রথম ভালোবাসা। আমার নাতিটা তিলে তিলে শেষ হয়ে যাবে তোমাকে না পেলে। ও ইচ্ছা করেই তোমার সাথে ঝগড়া করে। তোমাকে কত ভাবে বুঝিয়েছে, তবুও তুমি তাকে জুনিয়র বলে পায়ে ঠেলেছো। ও অনেক কান্না করেছে আজ। ফেলিক্স অফিসে থাকলে সে তোমায় দেখতে পাবেনা। তোমাকে না দেখে থাকতে পারবেনা তাই আমার কাছে ছুটে এসেছে। তার বাবাকে বোঝাতে বলেছে যাতে ফেলিক্স কে অফিসে না বসায়। কিন্তু আমার মনে হচ্ছে এরিকের বাবা ফেলিক্স কে অন্য কাজের জন্য এনেছে। তার উদ্দেশ্য হয়তো তোমাদের আলাদা করা নয় অন্য কিছু। আচ্ছা রিদিশা যে ছেলেটা তোমাকে দুই বছর ধরে পাগলের মত ভালোবাসে। তোমাকে একেবারে পাওয়ার জন্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তাকে কি এভাবেই পায়ে ঠেলে দিবে?

মি. এলেন বাংলা বোঝেন না। তাই তিনি নিজের মতো খাওয়া শেষ করে উঠে গেলেন। রিদিশা বাক বিমূঢ় হয়ে বসে আছে। কি বলা উচিত, কি বললে ঠিক হবে এই মুহূর্তে কিছুই তার মাথাতে আসছেনা‌। রিদিশা খুব করে চাইছে সে যেন অজ্ঞান হয়ে যায় এখন। এত প্রেসার নেয়া সম্ভব না। এরিক তার সাথে প্রথম দিন থেকে যেভাবে চলেছে, তাতে বোঝাই যায় নি এরিক তাকে আগে থেকে চেনে কিংবা এত ভালোবাসে। আচ্ছা সত্যিই কি ভালোবাসে? ভালো তো সেও বেসেছিল শোয়াইব কে। কই শোয়াইব তো বুঝলো না। এরিক ভালো বাসলে বাসুক তার কি? সে সারাজীবন শোয়াইব কেই নিজের মনে জায়গা দিয়ে রাখতে চায়।

-” রিদিশা! কখনো তো কিছু চাইনি তোমার কাছে। আজ আমি নিষ্ঠুর হয়ে আমার নাতির জন্য তোমাকে চাইছি।

মিসেস ময়ূরীর কন্ঠ দূর্বল শোনালো। সে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো। একজন দাদি তার নাতিকে কত ভালোবাসে তা এনাকে না দেখলে হয়তো রিদিশার জানা হতো না। রিদিশা কথা বলতে পারছেনা। মনে হচ্ছে কোন অদ্ভুত শক্তি তার গলা চেপে ধরেছে। রিদিশা অনেক কষ্টে মুখ খুলে বলে-

-” দেখুন দাদি আমিও একজন কে ভালোবাসি। আমার প্রথম ভালোবাসা। তাকে কি করে ভুলে যাই? আমি চাইনা তার জায়গা অন্য কাউকে দিতে। ক্ষমা করুন। আমি আর নিতে পারছিনা।

রিদিশা মুখ ঢেকে কেঁদে ওঠে। মিসেস ময়ূরীর দৃষ্টি শীতল হয়ে আসে। সে কি করবে বুঝতে পারছেনা‌।
ভালোবাসার কাছে কোন সঙ্গা টিকবে কি? নিজেকে ধাতস্থ করে সে রিদিশা কে প্রশ্ন করে-

-” আচ্ছা আমি তো এই তিনবছরে কারো সাথে দেখা করতে দেখলাম না তোমায়। তুমি যাকে ভালোবাসো সে কি বাংলাদেশের? সেও কি তোমায় ভালোবাসে?

রিদিশা নিভে যায়। কি উত্তর দিবে সে। কার জন্য কান্না করছে? যে তার ছোট বোনের স্বামী? সমাজ কি বলবে? রিদিশা নিচের ঠোঁট কামড়ে কান্না থামায়। ভেজা কন্ঠে বলে-

-” সে আমাকে কখনোই ভালোবাসেনি। সে আমার ছোট বোন কে ভালোবেসেছে। সে আমার ছোট বোনের স্বামী। সে হয়তো জানেও না আমি তাকে ভালোবাসি। তবুও খুব পুড়ে তার জন্য। তার কথা মনে হলেই আমি এলোমেলো হয়ে যাই। ভালোবাসা টা একতরফা ছিল তবুও আমি ভুলতে পারিনা। সে কেন আমায় ভালোবাসলো না?

ময়ূরী রিদিশার মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন-

-” দিদিভাই দুনিয়াটা এমনই রে। দেখ এরিক ও তোকে একতরফা ভালোবাসে দুই বছর ধরে। তুই তো জানিস একতরফা ভালোবাসায় কত কষ্ট। তুই আমার দাদু ভাইটাকে এত কষ্ট দিবি? ওর ও তো আক্ষেপ থেকে যাবে যে তুই ওকে ভালোবাসলিনা।

রিদিশা শুকনো হেসে বলে-

-” ভালোবাসা শব্দটা শুনলেই কষ্ট হয়। এটা কোন চার অক্ষরের শব্দ না। এটা মানুষের অনুভুতি শেষ করে দেয়ার ক্ষমতা রাখে। এটা একটা শব্দ না, অনেক কষ্ট এখনে আবদ্ধ। ভালোবাসা যারে একবার এই রোগে ধরেছে, সেই জানে এর নিরাময় নাই!

রিদিশা ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে। তখনি ভেসে আসে একটা পুরুষ কন্ঠস্বর-

-” একটা সুযোগ কি দেয়া যায়না?

#চলবে