#তুমি_আসবে_বলে
#হুমাইরা_হাসান
পর্ব- ৪৬ (শেষ)
-সমস্যা কি আপনার, শুধু শুধু কেনো ডেকে আনলেন
-চুপচাপ এখানে বসে থাকো
-পারবো নাহ, আমি গেলাম
বলে পা আগাতে নিলেই হাত ধরে হ্যাঁচকা টানে ডিভানে বসিয়ে দিলো থপ করে, আজব লোক নিচে সবার সাথে বসে গল্প করছিলাম,এই লোকটা গিয়ে চোখ রা’ঙানি দিয়ে ডেকে এনে এখন সামনে বসিয়ে রেখে ল্যাপটপ টিপছে। আজব লোক,এর ভাবসাব আমি বুঝি নাহ।
-বললাম তো এক পা নড়বা না এখান থেকে
-কিন্ত এখানে বসে আমি কি করবো
-আমায় দেখো,স্বামীর দিকে তাকিয়ে থাকলেও নেকি হবে, কি সারাদিন পকপক করে বেরাও এর ওর সাথে বলো তোহ
ল্যাপটপের স্ক্রিনে চোখ রেখেই কথা টা বললেন মেঘালয়। আমি চোখ মুখ কুচকে বললাম
-তাতে আপনার সমস্যা কি, বেশ করি পকপক করি।
ল্যাপটপ টা কোল থেকে নামিয়ে পাশের টেবিলে রেখে হাত ছড়িয়ে ডিভানে হেলান দিয়ে বসলেন। আমার দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে আড়চোখে তাকিয়ে আছে। উনার এভাবে তাকিয়ে থাকা দেখে এদিক ওদিক মুখি ফিরিয়ে রইলাম তবুও তাকিয়ে আছে লোকটা বেহা’য়ার মতো।
-এভাবে হা করে তাকিয়ে আছেন কেনো? কি চাই
ঠোঁট এলিয়ে মৃদু হাসলেন। তারপরে সারা মুখে দুষ্টামির হাসি মাখিয়ে বললেন
-তোমাকে চাই।
বলেই এক হাতে টেনে জড়িয়ে ধরলেন। আমি দুহাতে উনাকে ছাড়িয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বললাম
-কিন্ত আমার অন্য কিছু চাই।
-কি চাই তোমার
-ওই যে
বলেই আমার চারতালার বারান্দা টা দেখিয়ে আবারও বললাম
-ওই যে দেখুন ওখানে দোলনা
বারান্দায় না তাকিয়ে আমার দিকে চেয়েই বললেন
-হ্যাঁ দেখছি তো
-নাহ আপনি দেখছেন নাহ আমাকে না ওই যে দেখুন আমার ওই বারান্দায় দোলনা রাখা
-আমিতো দেখেছি সেটা
-দেখেছেন তো এখানে নাই কেনো? আমার দোলনা চাই। যেই বারান্দাতে দোলনা নাই আমি সেখানে থাকবো নাহ
-তোমার দোলনা চাই তো? আচ্ছা,আমি কালই এনে দিবো
উনার কথার তীব্র বিরোধিতা করে বললাম
-নাহ আমার এখনই চাই,আমায় এক্ষুণি দোলনা এনে দিন
-কিন্ত এতো রাতে দোলনা কোথাও পাবো রে বাবা
-তাইলে আপনি থাকুন,আমি যাচ্ছি।
বলেই পা বাড়িয়ে যেতে নিলে এক হাত টেনে ধরে বললেন
-তোমার দোলনা চাই?
-হু
-দোল খেতে চাও?
-হু
-ওকে
বলেই এক টানে আমায় উনার হাটুর উপর বসিয়ে দিলেন। এমন আকস্মিকভাবে টেনে নেওয়ায় ভয়ে দু’হাতে শার্ট খামচে ধরেছি। নিজের অবস্থান টা বুঝতে কয়েক মুহূর্ত সময় লাগলো। মেঘালয় আমায় উনার উরুর উপর বসিরে এক হাতে কোমর জড়িয়ে ধরে আছে।
-কি করছেন টা কি ছাড়ুন
-কেনো তুমিই তো বললে দোল খেতে চাও।
-হ্যাঁ তো আমি দোল খেতে চেয়েছি,আপনার কোলে উঠতে নাহ,ছাড়ুন আমায়।
-দোল ই তো দিচ্ছি জান
বলেই আমায় বসিয়ে রাখা পা টা আস্তে আস্তে দুলাতে লাগলো। আমি ভয়ে উনাকে দু’হাতে আরও জোরে চেপে ধরে বললাম
-এই,এই আমায় নামিয়ে দিন, ছাড়ুন আমি পরে যাবো তো।
-হুস,পরবে কেনো ,, দেখছো নাহ কি সুন্দর ঝাপটে ধরেছি তোমায়।
বলেই হাতের বন্ধন আরও নিবিড় করে,মুখটা কানের কাছে এনে ফিসফিসিয়ে বললো
-তা নিজের স্বামীর কোলে বসে দুলতে কেমন লাগছে মিসেস চৌধুরী
লজ্জায় নাকের পাটা লাল হয়ে আসছে,সব দোষ আমার, এই বেহায়া লোকটাকে কিছু বলাই তো ভুল। কেনো যে দোলনার কথা টা বললাম।
“আফু, রাফাত ডাকছে দেরি হয়ে যাচ্ছে তো”
মামনীর ডাকে ধ্যান ভাংলো। নিজের স্মৃতিচারণ থেকে বেরিয়ে বাস্তবে এলাম। সকালের ফুরফুরে হাওয়া গায়ে লাগাতেই বারান্দায় এসে বসেছিলাম। মেঘালয় কানাডা গিয়েছে আজ একুশ দিন হয়েছে, বারান্দায় ডিভানে বসতেই উনার করা হাজারো পাগলামির কিছু কথা মনে পরে গেছিলো।
ইদানীং কিছুই ভালো লাগে নাহ, নাম না জানা রোগে শরীরের চেয়েও মনটা বেশি মুর্ছে গেছে, সময়ে অসময়ে মন খারাপের বৃষ্টিতে ভিজে একাকার হয় ভেতরটা। দূরত্বের আ’গুনে প্রতিনিয়ত দগ্ধ হয় সারাদিন। ঘরটা ভীষণ ফাঁকা ফাঁকা লাগে, এখন আর কেও কথায় কথায় কোলে নেওয়ার ধ’মকি দেয়নাহ, বাড়ি ফিরেই ডাকাডাকি করে মাথা খারাপ করে দেয়না,কাজের মাঝে বিরক্ত করতে টুপ করে গালের উপর চুমু দিয়ে চলে যায় নাহ। “নূর তুমি আমায় একটুও ভালোবাসো না” বলে কেও গাল ফুলিয়ে বসে থাকে নাহ।
লোকটার বেহায়াপনাও খুব মনে পরে। এই একুশ দিনে যেনো একুশ বছর সমান দূরত্ব লাগছে। মেঘের উষ্ণ আলিঙ্গনে তপ্ত হওয়া শ্বাসটা ভীষণ মনে পরছে। নীলাভ চোখ জোড়ায় আমার জন্য সীমাহীন আকুলতাটা ভীষণ দেখতে ইচ্ছে করছে, ভীষণ।
বেহায়া লোকটা আমাকেও বেহায়া করে দিয়েছে, পারছি না তাকে ছাড়া থাকতে, পারছি নাহ..
আনমনেই ভাবতে ভাবতে ব্যাগ টা হাতে নিয়ে সিড়ি বেয়ে নেমে আসলাম। মামনী কে বিদায় জানিয়ে বেরিয়ে আসলাম। অসুস্থতার দরুন গত কয়েক দিন ভার্সিটি যাওয়া হয়নি। আজকে তাই বেরিয়েছি ভার্সিটির উদ্দেশ্যে। গেইটের কাছে রাফাত আগেই দাঁড়িয়ে ছিলো বাইক নিয়ে,আমি গিয়ে উঠে বসতেই রওয়ানা হলো ভার্সিটির উদ্দেশ্যে। দশ মিনিট পরেই বাইকটা থামলো ক্যাম্পাস গেইটের সামনে, রাফাত বাইকটা পার্ক করে আমার সাথে হাঁটা ধরলো ক্লাসের দিকে। সিড়ি বেয়ে উপরে উঠে ক্লাসের দিকে যেতে নিলেই সামনের ব্যক্তিটিকে দেখে থেমে দাঁড়ালাম
-আরে পালক, কি অবস্থা?
-এইতোহ, আপনার কি অবস্থা আজ ভার্সিটিতে যে?
আরাব ভাইকে হেসে প্রশ্ন করলাম। আরাব ভাইয়ের মাস্টার্স কমপ্লিট হয়েছে কয়েক মাস আগেই, এখন আর খুব প্রয়োজন ছাড়া ভার্সিটিতে আসে নাহ।
-এইতো এসেছিলাম, কিছু পেপারস রিলেটেড ইস্যু ছিলো তাই, তুমি কি ক্লাসের দিকেই যাচ্ছো নাকি?
-হ্যাঁ ভাই, কয়েকদিন অসুস্থ থাকায় ক্লাস করা হয়নি তাই আরকি।
তখন পাশ থেকে রাফাত আরাব ভাইয়ের সাথে কাপ সেরে বললো
-আমরা তাহলে আসি ভাই, ক্লাস শুরু হয়ে যাবে।
-হ্যাঁ সিউর
আরাব ভাইয়ের সাথে কথা শেষ করেই দুজন ক্লাসে ঢুকে গেলাম। বাকি চারজন আগে থেকেই অপেক্ষা করছে ক্লাসে।
ক্লাস শেষ করে বেরোতে প্রায় বারোটা বেজে গেলো। ক্লাস থেকে বেরিয়ে মাঠের আমগাছের নিচে পাতা দুটো বেঞ্চিতে বসলাম ছয় জনে।
-ইয়ারর, এতো প্যারা ভাল্লাগেনা একটার পর একটা ক্লাস টেস্ট নিতেই আছে,এই স্যারেরা। একবার বিয়া টা কইরা লই আর পড়াশোনাই করুম না ধুরর
-তা করবি ক্যান,তোরে তো রাস্তায় দেওয়া উচিত ঝাড়ু দিতে। তোরে সেইখানেই মানাইবো
-ক্যান রে,সবাই কি রিপনা নাকি যে রাস্তা ঝাড়ু দিবো
আরশির কথা শেষ হওয়ার আগেই থপ করে একটা কি’ল বসিয়ে দিলো রাফাত। গজগজ করে বললো
-তোর কি ওই রিপনার নাম না নিলে ভাল্লাগে নাহ? তুই রিপনা তোর চৌদ্দ গু’ষ্টি রিপনা
শা’লার আপদ মেজাজ টাই বিগড়াই দেয়
-আরে কুল, এতো চেইতা যাস ক্যান ভাই
-আরে চেতুম না তো কি। কি একটা রাস্তার পাগলি তারে উই বানাইছে আমার প্রেমিকা
আরাশি পিঠ ডলতে ডলতে বললো
-বেশ করেছি বলেছি। আরও বলবো। ঠিক ই তো রিপনাই তো তোর প্রেমিকা। তোরে দেখলেই হা করে তাকিয়ে থাকে, আর কি লজ্জা। রাফাতের মুখ দেইখা তো রিপনা লাল নীল হয়ে যায়।
-দেখ ছেমড়ি বহুত চিল মুডে আছি,ঘাটিস নাহ। চুপ যা।
এবার আদ্রিশ পাশ থেকে শিমুর দিকে তাকিয়ে বললো
-কিরে ছেমরি,তুই মুখটা বান্দরের মতো কইরা আছোস ক্যান। ধ্রুব ভাই তো গেছিলো শুনলাম তোর বাইত্তে, তাও তোর হয়নাই? এতো পিনিক তোর বিয়াইবার?
-চুপ থাক। শয়’তান গুলা,মুখে খালি আজাইরা গল্প আর বিয়া।
নিবিড় আবার ফোড়ন কেটে বললো
-তোমরা বিয়াইবা তাতে দোষ নাই আমরা বলবো তাও দোষ। ভালোই।
-বিয়াবিয়ে বাদ দেহ, ডিপার্টমেন্ট হেড কি বলে গেলো মাথায় নেই? তিনদিন বাদেই ক্লাস টেস্ট হবে, আমারতো একটা ট্রপিক ও ঠিকঠাক কমপ্লিট নেই।
-আবে চুপ যা ছেমরি, কোন হেড ফেড কি কইলো ওইসব নিয়ে ভাবার টাইম নাই। আজকে তো চিল হবে চিল, আফু সুস্থ হয়েছে এখন পার্টি হবে ব্রো, আফু আজকে কিন্তু নুডলস চাইই
রাফাতের কথায় মুখ কুচকে বললাম
-রাফাইত্তা তোরে যে আজকে রুচিতা আপুরে আনতে যেতে বলেছে সে খেয়াল আছে? তুই খাই খাই করছিস।
রাফাত মুখে বেজায় বিরক্তির ছাপ এনে বললো
-ওই ঝগড়া’ইট্টা মহিলা রে আমি আনুম নাহ। ও আসলে ও তো ঝ’গড়া করতে করতে আমার মাথা খারাপ করবে আর ওর মেয়ে তাফাত তাফাত করে।
-কেনো তাফাত, তোমায় কি সুন্দর করে ডাকে মিষ্টি, তাফাত!!
বলেই আমি সহ সবগুলো হাহা করে হাসা শুরু করলাম।রাফাত উঠে দাঁড়িয়ে বললো
-তোরা এখানে বসে হাহা হিহি করবি নাকি যাবি বাড়ি, আমার পেটের মধ্যে ইন্দুরের রেস শুরু হইছে আমি গেলাম।
বলেই হাঁটা ধরলো, রাফাতের পিছনে আমিও দৌড়ালাম। সাথে বাকি গুলোও। সবগুলো মিলে বাড়িতে আসতে মাঝ দুপুর হয়ে গেলো।
বাইকটা পার্ক করে রাফাত আসতেই সবাই সিড়ি বেয়ে উপরে উঠতে নিলো।
আমি পেছন পেছন উঠছি,হুট করেই শরীর টা কেমন গুলিয়ে আসছে, সারা শরীরের ভর ছেড়ে যাচ্ছে, মাথা টা চক্কর দিয়ে উঠলো, মুহুর্তেই আশপাশ অন্ধকারে ভরে গেলো, আশেপাশে কিছুই দেখতে পাচ্ছি নাহ। পা আর নড়ছে নাহ, সামনে ওদের ডাকার নূন্যতম শক্তিও পেলাম নাহ।
পেছন আসা থেকে ধপ করে শব্দে সবাই হাটা থামিয়ে ফিরে তাকাতেই আরশি চিৎকার করে উঠলো।
-আফু!!
বলেই ছুটে এলো নিবিড়। এসে পালকের জ্ঞানহীন শরীর টাকে ধরে তুলে বললো
-আফু? আফু কি হয়েছে তোর,আফু চোখ খোল
রাফাত এসে পালকের মুখে হাত দিয়ে বললো
-আফু চোখ খোল,কি হয়েছে তোর।
-ওকে ঘরে নিয়ে যেতে এক্ষুনি, শিমু ডক্টর কে ফোন দে
বলেই আদ্রিশ কোলে তুলে নিলো পালককে, অস্থিরতা নিয়েই ছুটে উঠে গেলো উপরের ঘরে
♣
টপটপ করে চোখ বেয়ে পানি পরছে, দূর্বল শরীর টা নিয়েই বিছানা থেকে উঠে গিয়ে দাঁড়ালাম দেওয়ালে টানানো বিশাল ফ্রেমের সুদর্শন চেহারার দিকে, এক হাত মুখের সামনে রেখে বরাবরের মতোই গম্ভীর ভঙ্গিতে বসে আছে। এক হাত ফ্রেমটাই বুলিয়ে আরেক হাত পেটের উপর রাখলাম। হাসছি আমি! মুখ ভরা হাসি আমার,কিন্তু চোখের পানি বাধ মানছে নাহ, নিঃস্তব্ধ রাতে আমার কান্নার হিচকি দেওয়ালে দেওয়ালে প্রতিধ্বনিত হয়ে আমার কানেই বিধছে
-আর কত অপেক্ষা করাবেন আপনি। আর কত? কতগুলো দিন পার হয়ে গেলো, তবুও ফিরলেন নাহ। আমায় ছেড়ে নাহয় দূরে রয়েছেন, কিন্তু ও। ওকেও কি এভাবে একা রাখবেন। ও তো আপনাকে চাই।।
বলেই পেটে রাখা হাতটা আরও দৃঢ় করে বললাম
-জানেন, জানেন মেঘ আমার মাঝে ছোট্ট একটা প্রাণ তিলে তিলে বেড়ে উঠছে। আমার আর আপনার অংশ। আমাদের ভালোবাসার ফল। আধো আধো বুলিতে আপনায় বাবা বলে ডাকার মানুষটা আসছে, ছোট ছোট পা ফেলে সারা বাড়ি মাতিয়ে রাখা মানুষটা আসছে। আপনি খুশি তো মেঘ? বলুন নাহ কতখানি খুশি আপনি?
বলেই হাউমাউ করে কেদে দিলাম। মেঘের অনুপস্থিতি আজ আমায় একটু বেশিই কষ্ট দিচ্ছে আমায়,, খুব বেশি। এই অবস্থায় মেঘকে আমার ভীষণ প্রয়োজন ভীষণ। দুপুরে সিড়িতেই জ্ঞান হারিয়ে পরে গেলে, রাফাত নিবিড় আদ্রিশ সবাই মিলে উপরে আনে।
মামনী আমার এ অবস্থা দেখেই অস্থির হয়ে ডাক্তার ডেকেছে, ডাক্তার চেকআপ করে জানিয়ে আমি সন্তান সম্ভবা, মানে আমি মা হতে চলেছি? মা!!
মেঘালয়ের অস্তিত্বের অংশটা আমার মাঝেই বেরে উঠছে! আমার এ খবর শুনে মামনী, রাফাত নিবিড় আদ্রিশ শিমু আরশি খুশিতে আত্মহারা, বাবা এই খবর শুনেই অফিস থেকে ফিরে এসেছে, সাথে গাড়ি ভরে মিষ্টি এনেছে। সকলের আমেজ আনন্দ দেখে আমি আর মন খারাপ করে থাকার সাহস পাইনি।
যেই খবরে বাড়ির সবাই খুশিতে মাতোয়ারা হয়েছে, সেই খবরটা যার জন্য সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ সেই জানে নাহ। আমিই জানাতে দেয়নি। অভিমানের পাহাড় জমেছে আমার, এক আকাশ সমান অভিমান হয়েছে। মাস ছুতে গেলো পারি দিয়েছে অন্য দেশে তবুও ফেরার নাম নেই৷ কাল থেকে আমার ফোনটাও ধরছে নাহ। এতো কিসের কাজ,আমার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ তার কাজ? দুদিন ধরে প্রাণপ্রিয় কণ্ঠস্বর টাও শুনি নাহ, এতই কাজ উনার যে আমায় ভুলে গেলো। আবারও চোখ ভরে গেলো বারিধারায়। ফোনটা হাতে নিতেই নীলাভ চোখ জোড়ার হাসি হাসি চেহারা স্ক্রিনে ভেসে উঠলো।
সময় রাত তিনটা, আমার দুচোখে ঘুম নেই। আনন্দ চিন্তা দুটিতেই জেঁকে ধরেছে। দুদিন ধরে লোকটার খোঁজ নেই কেনো? কোনো বিপদ হলো নাহ তো?
আবার কেঁদে উঠলাম সশব্দে। ভালো লাগছে না কিছু। অজানা আশঙ্কায় ভেতরটায় টাইফুন শুরু হয়েছে, আবারও মাথা টা ঝিমিয়ে আসছে। শরীরের অসুস্থতা ছাড়িয়ে মন খারাপের অসুস্থতা আমায় গ্রা’স করছে। এসময় টায় আমার উনাকে চাই, খুব চাই। পেটের উপর হাত রেখে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে বললাম
-তোর বাবা খুব খারাপ খুব, একটুও ভালোবাসে না আমাদের, নি’ষ্ঠুর লোকটা, একটা বারও মায়ের খোঁজ নিলো না দেখলি,এমনকি তোর খবরটাও জানে নাহ ৷ বাবা খুব পঁচা। একদম কথা বলবো না আমরা, একবার আসুক আমরাও কথা বলবো নাহ।
আমার কথা শেষ হবার আগেই ফোনের স্ক্রিন টা জ্বলে উঠলো, ফোনটা হাতে নিতেই হাতের কম্পনে পরে গেলো থপ করে। আমি কি ভুল দেখছি? হ্যালুসিনেশন? ফোনে মেঘালয়ের নাম্বার টা জ্বলজ্বল করছে। এত রাতে? এত রাতে কেনো ফোন দিবে? বার কয়েক চোখ কচলে দেখলাম। নাহ চোখের ভুল নাহ। আমার ভাবনার মাঝেই কেটে গেলো ফোনটা, নিচ থেকে ফোনটা হাতে তুলতেই আবারও বেজে উঠলো। রিসিভ করে কানে ধরলাম
দুপাশের নৈকষ নিস্তব্ধতায় ও মেঘালয়ের নিঃশ্বাস প্রশ্বাসের শব্দ স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছি। কান্না গুলো দলা পাকিয়ে বেরিয়ে আসতে চাইছে, মুখে হাত রেখে আটকে আছি। ওপাশ থেকে ভীষণ ক্লান্ত স্বরে বললো
-নূর!
ব্যস, দলা পাকানো কান্না গুলো স্ফূলিঙ্গের মতো বেরিয়ে এলো। সশব্দে কেঁদে উঠলাম, কান্নার সাথে হেঁচকির দাপটে কথা অবদি বলতে পারছি নাহ।
ওপাশ থেকে বেশ শান্ত কণ্ঠের বাক্য আসলো
-খুব বেশি অপেক্ষা করিয়ে ফেলেছি তাই না?
তাও কোনো উত্তর করলাম নাহ এক হাতে মুখ চেপে ধরে আছি। মেঘালয় আবারও বললেন
-খুব রাগ করেছো কি? একবার ভাঙা’নোর সুযোগ দেবে নাহ?
খানিক থেমে আবারও বললো
-একবার বারান্দায় আসো
তৎক্ষনাৎ কান্না থেমে গেলো, কি বললো মেঘ? বারান্দায়? মানে?
-বারান্দায় যাবো মানে?
-বাইশ ঘন্টা জার্নি করে এসেছি নূর, ভীষণ ক্লান্ত। তার চেয়েও বেশি পরিশ্রান্ত তোমার বিরহে, একবার আসো। চাঁদ মুখ খানা দেখিয়ে একটু শান্তি দাও আমায়, এই দূরত্ব আমায় আধ’মরা করে ফেলেছে
হাতের ফোনটা ছিটকে ফেলে ফেলে দৌড়ে গেলাম বারান্দায়, জোৎস্না রাতের আলোয় দূর থেকেও স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে গেইটের বাইরে গাড়িতে হেলান দিয়ে দাঁড়ানো মানুষটার প্রতিচ্ছবি। আমায় দেখেই দু হাত বাড়িয়ে ইশারা করলেন।
এক ছুটে গিয়ে দরজা খুলে ফেললাম। সিড়ি বেয়ে নেমে ঝড়ের বেগে ছুটে গেলাম নিচে। কেচি গেটের তালা খুলেই চাবিটা ছুড়ে ফেলে আবারও দৌড় লাগালাম, এক লহমায় মুছে গেছে সব অভিমান, ভে’ঙে গেছে অভিযোগের পাহাড়। প্রাণপ্রিয় মুখটা দেখার লোভ আর ওই বুকটাতে ঝাপটে পরার ব্যকুলতায় ছুটে গেলাম।
আমায় ছুটে আসতে দেখে হেলান দেওয়া থেকে উঠে দাড়ালো মেঘ। সটান দাঁড়িয়ে দু হাত বাড়িয়ে দিলো। এক মুহূর্তেই আমার শরীরের সমস্ত অসুস্থতা দূর্বলতা মুছে,, গেছে হারিয়ে গেছে।
বিদ্যুতের গতিতে ছুটে গিয়ে হাম’লে পরলাম প্রসস্থ বুকটার মাঝে, দু’হাতে পিঠ খামচে ধরে গলা ছেড়ে কেঁদে দিলাম। এতদিনের সব ধৈর্য, অপেক্ষা, অভিযোগ সব যেনো বাধ ভেঙে কান্নায় আপতিত হচ্ছে। অদ্ভুত প্রাপ্তির যন্ত্রনায় ভেতরের প্রশান্তিও আমায় কষ্ট দিচ্ছে। এ কেমন উন্মাদনা, এ কেমন তা’ড়না। যার টানে আমিই হেরেছি আমার মাঝে, ভালোবাসার টানে নিজের দ্বৈত স্বত্তার কাছে হেরে আমি চূর্ণবি’চূর্ণ হয়ে মিশে গেলাম মেঘালয় নামক লোকটার মাঝে।
দুহাটে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে রেখেছে মেঘ, পারছে বুকের মাঝে পি’ষে ফেলতে, এতদিন কিভাবে ছিলো, কতটা অস্থিরতা যন্ত্র’ণা সহ্য করেছে মেঘ তা কি করে বোঝাবে তার নূর কে! প্রতিটি দিনে প্রতিটি ক্ষণে কতটা ভালোবেসেছে তা কি করে বোঝাবে তার নূর কে!
বেহিসেবী সময়ের কতটা সময় দুটো বুক একত্রে মিশে ছিলো তা তাদেরও গণনার বাহিরে, দুটো উষ্ণ শ্বাস, ডানা ঝাপটানো অস্থিরতা একসাথে মিলেমিশে একাকার হয়ে কতক্ষণ প্রণয়াসরে মেতেছিলো কেও জানে নাহ।।
নিস্তব্ধ রাতের অস্থিরতা কমিয়ে মেঘ পালকের মুখ খানা বুক থেকে তুলে দু’হাতের আঁজলে তুলে একটা দুইটা তিনটা করে অজস্র চুমুতে ভরিয়ে দিলো পালকের অশ্রুঘামে ভেজা মুখ।
সময় নিয়ে নিজেকে সামলেই দূরে সরে গেলো পালক। মুখ ঘুরিয়ে অন্যদিকে ঘুরে দাঁড়ালো। মেঘ স্মিত হাসলো পালকের এমন বাচ্চামি দেখে।
এগিয়ে গিয়ে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে বললো
-এখনো রেগে আছো বউ? আমি সরি তো? কি করতাম বলো কাজ শেষ না করে তো আসতে পারছিলাম নাহ, কাজ শেষ হতেই একদিন ও দেরি করিনি কাল সন্ধ্যার ফ্লাইটেই উঠে পরেছিলাম। তাই তো কাল থেকে তোমার ফোন ধরতে পারিনি জান। আমি অনেক অনেক অনেক সরি।
পালক হাত সরিয়ে দূরে সরে বললো
-তাহলে আবারও ফিরে যান নিজের কাজে, কেনো এসেছেন, লাগবে না আপনাকে, আমরা একাই থাকতে পারবো।
-আরে বাবা বলছি তো আর কোথাও যাবো…
পুরোটা না বলেই থেমে গেলো মেঘ,ভ্রু কুচকে বললো
-কি বললে? আমরা একাই থাকতে পারবো মানে? আবার বলো
পালক এবার মুখ ফিরিয়ে আবার অন্যদিকে ঘুরে গেলো। মেঘ পালকের হাত ধরে নিজের দিকে ঘুরিয়ে বললো
-নূর! তুমি কি লুকাচ্ছো বলো তো?
পালক মেঘের হাত টা ছাড়িয়ে নিয়ে বললো।
-কিভাবে লুকাবো বলুন তো দুদিন পর তো এমনেই ফুলে ট্যাপা হয়ে যাবো তখন ঠিকই বুঝে যাবেন।
মেঘ এখনো হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে আছে, কি বলছে এই মেয়ে! মেঘের এমন অবাক হওয়া চেহারা দেখে পালকের বেশ হাসি পেলো। আরেকটু কাছে গিয়ে মেঘের হাতটা নিজের পেটের উপর রেখে বললো
-একজনকে নিয়েই তো পারি নাহ,দুজনকে কি করে সামলাবো বলুন তোহ
পালকের কথা শুনে মেঘ ছি’টকে সরে গেলো। অতিমাত্রায় স্ত’ম্ভিত দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে বললো
-নূর, নূর তুমি?
-বাবা হবেন মেঘ, ছোট ছোট হাতের আঙুলে আপনার হাতের ভাজে কেও হাত গুঁজে দিবে, আধো আধো বুলিতে আপনায় বাবা বলে ডাকার মানুষটা আসছে মেঘ। আমাদের ভালোবাসার..
পুরোটা শেষ করার আগেই, মেঘ ঝা’পটে ধরলো পালককে, অজান্তেই দু ফোটা জল গড়িয়ে পরলো মেঘের চোখ থেকে,জীবনের এই মুহূর্তে এসে তার নিজেকে বড্ড অচেনা লাগছে? এমন অনুভূতি গুলোয় কি করতে হয় কোনো দিশা পাচ্ছে নাহ মেঘ? অস্থির নিঃশ্বাস প্রশ্বাসের সাথে ঝাপটে ধরে রাখলো পালককে, মিনিট খানেক পর পালক মাথা উচিয়ে মেঘের মুখ দু’হাতে ধরে বললো
-আপনি খুশি তো চৌধুরী সাহেব?
মেঘ পালকের কপালের সাথে কপাল ঠেকিয়ে ঘনঘন নিঃশ্বাস ছেড়ে বললো
-কি করে বলবো নূর, কি করে বলবো তুমি আমায় কি দিলে। কি চাও বলো। এই অধম টা কি করলে এ ঋণ শোধ হবে বলো তোহ। এতো খুশি আমি কোথায় রাখবো। কোন ভাষায় বললে বুঝাতে পারবো তোমায় আমি কতটা খুশি,
খানিক দম নিয়ে আবারও বললো
-আমি বাবা হবো? বাবা হবো আমি নূর? আমাদের ঘরে একটা ছোট্ট পুতুল আসবে? আমি দু’হাতে কোলে নেবো? আমায় বাবা বলবে নূর,তোমায় মা বলবে?
বলেই আবারও জড়িয়ে ধরলো আমায়। মেঘের পাগলামি দেখে খুশিতে অঝোরে জল গড়িয়ে পরলো, এতটা সুখ হয় ভালোবাসায়! এতটা সুখ পরিপূর্ণতায়! এ যেনো কোনো সুখের স্বপ্ন! কখনো শেষ না হোক, এ বুকটা আজীবন আমার আলিঙ্গনে ভরে থাক। আমার ছোট্ট বাচ্চা আর তার বাবাকে নিয়ে আমৃত্যু থাকতে চাই, এই পরম প্রশান্তির বুকটাই শেষ অবদি মিশে থাকতে চাই।
-নূর, এখন থেকে সবসময় কোলে করে রাখবো কিন্তু!
~~সমাপ্ত🌼